শ্রাবন_আধারে_তুমি_২,১৯,২০

0
688

#শ্রাবন_আধারে_তুমি_২,১৯,২০
#লেখিকা_আফরিন_ইসলাম
#পার্ট_১৯

বিশাল আকাশে একটা চাঁদকে ঘিড়ে লক্ষ তারার বাস ৷ রুপালী চাঁদের আলো সব প্রেমিকের মনে প্রেমে সঞ্চার করে না ৷ মাঝে মাঝে রাতের সৌন্দর্য তাদের হৃদয়ে বিচ্ছেদের দাগ কেটে যায় ৷ পূরন না হওয়া হাজারটা স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় বারবার ৷ যেই স্মৃতি থেকে চাইলেই ফিরে আসা যায় না ৷

বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ ভরা শ্বাস নেয় আবরার ৷ তারপর হৃদয় ভাঙ্গা কন্ঠে বলে ওঠে ,

“জীবনে অনেক না পাওয়া জিনিস অনায়েসে পেয়েছি ৷ কিন্তু আমার সেই বৃষ্টিস্নাত তামাটে কন্যাকে পেয়েও পেলাম না ৷ তাকে নিজের করে পাওয়ার শেষ সময়ে হারিয়ে ফেললাম ৷শুধু একটাই আফসোস থেকে গেল ৷ তার মন পড়তে পারলাম না ৷ তার আসল সত্তা চিনতে পারলাম না ৷”

আবরার পাশেই দাড়িয়ে থাকা সাদির দিকে তাকিয়ে বলল ,

“তোর জন্য আজ আমি রাইয়ের আসল চেহারাটা দেখলাম ৷ তোকে ধন্যবাদ আমার চোখটা খুলে দেওয়ার জন্য ৷ ”

সাদি আবরার দিকে মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে বলল ,

“আমার মনে হয় তোর বিয়ে করা উচিত আবরার ৷ কারন এভাবে একটা জীবন চলতে পারে না ৷ নিজের জীবনটা নতুন করে শুরু কর তুই ৷ কারন আজকে তোকে যা দেখালাম ৷ তারপরে রাইয়ের চরিত্র নিয়ে আমার নিজেরই সন্দেহ হচ্ছে ৷ মাঝ রাতে একটা ছেলের সাথে রাস্তায় বসে কি করছিল গতকাল রাই বলতে পারিস ৷ আজকেও ঐ ছেলের সাথে ছিল ৷আমার মনে হয় রাই খারাপ কাজে লিপ্ত ৷ তুই ওকে ভুলে যা আবরার ৷”

আবরার স্ববিস্ময়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে ৷ সাদির ফোনটা আবরার হাতে ৷ চোখে অশ্রুকনা চিকচিক করছে তার ৷ সিগারেটের বিশাক্ত ধোয়ায় কালচে বর্নধারন করা ঠোঁট দুটো কাপঁছে কিছু সময় পরপর ৷ অন্ধকারের মাঝেও আবরার মুখের রক্তিম আভা দেখা যাচ্ছে ৷আবরার সাদির হাতে ওর ফোনটা দিয়ে দিল ৷ আবরার নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করলো ৷ তারপর নিজের বাবাকে কল করলো ৷ওপাশ থেকে কল রিসিভ করতেই আবরার বলল ,

“বাবা ফুপু যেই মেয়ে ঠিক করেছে ৷ তোমরা তার সাথেই কথা পাকা করো ৷ আর হ্যা যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের তারিখ ঠিক করার ব্যবস্থা করো ৷”

আবরার কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিল ৷তারপর সাদির সাথে কোনো কথা না বলেই দ্রুত পায়ে নিজের গাড়ীর ভেতর ঢুকে গেল ৷ আর সাদি পেছনে থেকে আবরারকে বলল ,

“এই আবরার দাড়া ৷ কোথায় যাচ্ছিস তুই ৷ দেখ মাথা গরম করে কোনো সিদ্ধান্ত নিস না ৷আমার কথা তো শুনে যা ৷”

আবরার সাদির কথা শুনলো না ৷ গাড়ী চালিয়ে চলে গেল সেখান থেকে ৷আবরার চলে যেতেই সাদির মুখে হাসির রেখা দেখা দিল ৷তারপর সে শিষ বাজাতে বাজাতে বলল ,

“জীবনে কিছু না পাওয়ার থেকেও , কিছু পেয়ে হারিয়ে ফেলা বেশি কষ্টের ৷ আর সেই কষ্ট আমি তোকে দেব আবরার ৷তোকে আমি মারবো না ৷ কিন্তু বেচেঁ থেকেও তুই মরে যাবি ৷ তোকে শেষ করার জন্য রাইকে ব্যবহার করেছি ৷ রাইকে তোর জন্য খুজে বের করেছি ৷ আবার কেড়েও নিয়েছি ৷তোকে ভেঙ্গে শেষ করে দেব আমি ৷ বন্ধুত্বের আড়ালে এমন ছোবল দেব ৷ যা কখনো কল্পনা করতে পারবি না ৷
তোর সামনে এই ভালো সাজতে আর ভালো লাগছে না ৷ আমার একটা শরীরে দুইটা আলাদা সত্তা আমার ভাবা যায় ৷”

অপর দিকে রাইয়ের ভাবি তার ভাই রনির সামনে বসে আছে ৷ রনি নিজের বোনের হাত ধরে বলল ,

“আমরা নিজেদের রাগ ,ক্ষোভ মেটাতে অনেক বড় পাপ করেছি আপু ৷আমার মনে হয় সবাইকে সব বলে দেওয়া উচিত ৷”

“আমি কিছু বুঝতে পারছি না এখন কি করবো ৷ তোর দুলাভাই যদি এই ব্যাপারে জানতে পারে ৷ তাহলে শেষ করে ফেলবে আমাকে ৷ আমি এতদিন যাদের ক্ষতি চেয়েছি ৷ আজ তারাই আমার পাশে ৷ সাদি ভাইয়ের সাথে হাত মিলিয়ে আমরা অনেক বড় ভুল করেছি ৷ তার কথা মতো যত চক্রান্ত করেছি ৷ অনিকের অবস্থা এখনো ভালো না ৷একবার যদি সবাই এগুলো জানতে পারে ৷তাহলে আমরা শেষ হয়ে যাবো ৷ আমাদের সাদির সাথে কথা বলা উচিত ৷”

রনি নিজের বোনের সাথে সহমত প্রকাশ করে ৷ তারপর কল করে সাদির নাম্বারে ৷কয়েক বার কল করার পরেও সাদি রিসিভ করে না ৷ রনি রেগে যায় বেশ ৷ তারপর নিজের কপালে হাত রেখে বলল ,

“শালা বেইমান আমাদের দিনের পর দিন ব্যবহার করেছে ৷ ওর আসল রূপটা কেউ চেনে না ৷ এখন যখন আমাদের আর দরকার নেই ৷ ঠিক তখনই সরে গেছে ৷ইচ্ছে করছে সব বলে দেই সবাইকে ৷”

“এখন কিছু করা যাবে না ভাই ৷ আর যা হচ্ছে হতে দে ৷ আমাদের হাতে এখন আর কিছু নেই ৷ আর আমরা যদি কিছু করতে যাই ৷ তাহলে আমাদের কপালে দুঃখ আছে ৷ ”

অপরদিকে রাই বসে আছে জানালার পাশে ৷ রাইয়ের কোলে মাথা রেখে কুকুরটা শুয়ে আছে ৷চাঁদের আলোয় রাইয়ের মুখটা চকচক করছে ৷রাই ফোনের মধ্যে আবরার ছবি দেখছে ৷ আজকাল এই মানুষটার ছবি দেখতে দেখতেই রাইয়ের রাত পার হয়ে যায় ৷ রাই আবরারের ছবিটাতে হাত বুলায় ৷তারপর ছবিটা বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল ,

“যদি কখনো আমাদের দেখা না হতো ৷ আর না আপনি আমার জীবনে আসতেন ৷ তাহলে হয়তো আমি একটু ভালো থাকতাম আবরার ৷ আপনার বিচ্ছেদ আমাকে শেষ করে দিচ্ছে প্রতিদিন ৷আপনাকে জড়িয়ে ধরে বড্ড কাদঁতে ইচ্ছে করে ৷ আপনাকে বলতে ইচ্ছে করে না বলা সব কথা ৷ কিন্তু আপনিও আমাকে বুঝলেন না ৷ আপনি কি সত্যি অন্য কারো গল্পের পরিপূর্ন চরিত্র হবেন ৷আপনি বিয়ে করবেন এই কথাটা আমি মানতে পারছি না ৷ আচ্ছা এটা কি মেনে নেওয়াটা স্বাভাবিক ৷আপনাকে ছাড়া আমি ভালো নেই ৷ এই কথাটা চিৎকার করে হয়তো বলতে পারবো না ৷ হয়তো মৃত্যুর সময় আপনাকে ভালোবাসি বলতে পারবো না ৷ হয়তো আপনার কোলে মাথা রেখে রুপালী চাঁদ দেখতে পারবো না ৷ হয়তো কোনো একদিন চেনা রাস্তার মোড়ে আপনাকে দেখবো ৷ সেই দিন হয়তো আপনি অন্য কারো ব্যক্তিগত সম্পদ ৷ হয়তো সেই দিন আবারো আকাশ ভেদ করে বৃষ্টি আসবে ৷ কিন্তু সেই দিন আমাদের গল্পটা অসম্পূর্ন রয়ে যাবে ৷ আপনি হয়তো ভালো থাকবেন ৷ কিন্তু আপনার ভালো থাকা আমি মেনে নিতে পারবো না ৷ অন্য কারো সাথে আপনার ভালো থাকার গল্প না হোক ৷ হয়তো মিথ্যা হাসির আড়ালে আমার হৃদয়ের কান্না কেউ শুনবে না ৷ তবুও চাই আমার শত কষ্টের বিনিময়ে আপনি ফিরে আসুন ৷”

অন্যদিকে রায়হান তার পরিচিত বন্ধু পুলিশ অফিসার সাদমানের সাথে বসে আছে ৷বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে রায়হান বলল ,

“তোকে তো সব বললাম সাদমান ৷আমার কেন যেন মনে হচ্ছে রাই কিছু করে নি ৷নিজের হাতে যেই বোনকে এত বছর মানুষ করেছি ৷ তাকে চিনতে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আমার ৷ আর তোকে যেই দোকানের বিল পেমেন্টের কাগজ দেখিয়েছি ৷ তুই ঐ দোকান থেকে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ নেওয়ার ব্যবস্থা কর ৷ তাহলেই এই সমস্যার সমাধান আসতে পারে ৷”

“তুই চিন্তা করিস না রায়হান ৷ আমি দেখছি কি করা যায় ৷ তুই বাড়ী চলে যা এখন ৷”

চলবে

#শ্রাবন_আধারে_তুমি_২
#লেখিকা_আফরিন_ইসলাম
#পার্ট_২০

সকাল ঘড়িতে আটটা বাজে ৷ আজ কফিশপ বন্ধ ৷ রাইয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল তার রুমমেটের ডাকে ৷গতকাল বেশ রাত করে ঘুমিয়েছে ৷ ঠিক মতো ঘুম হওয়ার আগেই ডাক দেওয়ায় একটু বিরক্ত হলো রাই ৷ তবুও মুখে প্রকাশ করলো না ৷রাই ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল ,

“কি হয়েছে ? ডাকছো কেন আমাকে ?”

রাইয়ের রুমমেট বলল ,

“দারোয়ান কাকা তোমায় ডাকছে ৷ যেয়ে দেখে আসো কেন ডাকছে ?”

রাই গায়ে ওরনা জড়িয়ে নিল ৷ তারপর মাথার চুল গুলোকে একটা হাত খোঁপা করে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে ৷ ঘুম জড়ানো চোখে দরজা খুললো রাই ৷ তারপর দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল ,

“কি হয়েছে কাকা ?এত সকালে আপনি এখানে কেন ?কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি ৷ ”

দারোয়ান তার লালচে দাঁত বের করে হাসলো ৷ তারপর বলল ,

“আম্মা একটা পোলা আপনারে এই গুলা দিয়া গেছে ৷ মুই কইলাম কারে দিমু ৷ পোলায় নাম জানেনা ৷ পরে হেতি চেহারার গঠন কইলো ৷ তাতেই বুঝছি আপনে ৷ এহন লন এই গুলা ৷”

রাই দেখলো দারোয়ানের হাতে একটা বক্স ৷ রাই বক্সটা হাতে নিল ৷তারপর বলল ,

“আপনি কি সিওর যে এটা আমার জন্য দিয়ে গেছে ৷”

“মুই এক্কেবারে সিওর আম্মা ৷ মুই এহন যাই ৷ মোর চোহে মেলা ঘুম এহন ৷ আপনে দরজা লাগাইয়া দেন ৷”

রাই বক্সটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল ৷ তারপর ঘরে যেয়ে বক্সটা নিয়ে ফ্লোরের এক কোনায় বসে পড়লো ৷রাইয়ের রুমে থাকা মেয়ে দুটো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ৷ রাই বক্সটা খুলেই অবাক হলো ৷ বক্সের উপরে দুইটা রজনীগন্ধার মালা ৷রাই মালা দুটো নাকের কাছে ধরে চোখ বন্ধ করলো ৷রজনীগন্ধা ফুলে এক মাতাল করা ঘ্রান আছে ৷ যা মুহূর্তেই যে কোনো ব্যক্তির মনে ভালো লাগার জোয়ার নিয়ে আসতে পারে ৷

রাই বক্সের ভেতরে তাকাতেই বেশ অবাক হলো রাই ৷বক্সের ভেতরে একটা সাদা রংয়ের জামদানি শাড়ী পেল সে৷ শাড়ীর উপরে একটা কাগজ ভাজ করে রাখা ৷ রাই কাগজটা খুললো ৷ সেখানে লেখা ছিল ,

যার হৃদয় আকাশের মতো স্বচ্ছ৷
যার মন আকাশের মতো বিশাল৷
এটা শুধু সেই মানুষটার জন্য৷

রাই চিরকুট রেখে দিল শাড়ীর ভাজে ৷ তারপর শাড়ীটা ধরে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল ৷ কিন্তু উপহার পাঠানো মতো কাউকে খুজে পেল না ৷ অতঃপর রাই বক্সের মধ্যে শাড়ীটা রেখে ওয়াসরুমে চলে গেল ৷

অন্যদিকে রায়হান খুব সকাল বেলা বাসা থেকে বের হয়ে গেছে ৷তার উদ্দেশ্য বন্ধু সাদমানের কাছে যাওয়া ৷ সাদমান একটু আগেই কল করে রায়হানকে যেতে বলেছে ৷ রায়হান যত দ্রুত সম্ভব বন্ধুর কথা মতো পুলিশ স্টেশনে যেয়ে পৌছালো ৷ রায়হানকে আসতে দেখেই সাদমান তাকে বসতে বললো ৷ এক গ্লাস পানি রায়হানের দিকে এগিয়ে দিয়ে সাদমান বলল ,

“পানিটা খেয়ে নে ৷ তোর সাথে অনেক কথা আছে ৷”

রায়হান পানি খেয়ে নেয় ৷ তারপর সাদমান বলল ,

“রায়হান কোথাও একটা সমস্যা আছে বিরাট আকারে ৷ তোর কথা মতো কাল রাতেই আমি লোক লাগিয়েছি ৷ আজকে ঐ ঔষুধের দোকানে আমি নিজে যাবো ৷ তোর বোন বাসা থেকে বের হয়ে যেই বান্ধবীর কাছে থাকতো ৷ আমি সেখানে আজ সকাল ছয়টার দিকে গিয়ে ছিলাম ৷ কিন্তু সেখানের দারোয়ানের থেকে যা শুনলাম ৷তাতে মনে হলো সেখানের পরিস্থিতি আরো বেশি ভয়ানক ৷

“কেন কি হয়েছে সেখানে ?”

“তোর কথা মতো যেই দিন রাইকে তোর শালার সাথে এক রুমে পেয়েছিস ৷ ঐ দিন সায়মার স্বামীকে কিছু লোক ধরে নিয়ে যায় ৷ আর মাঝ রাতে বাসার সামনে ফেলে রেখে যায় ৷তার অবস্থা নাকি ভালো না ৷”

“কি সব বলছিস তুই ?অনিককে কেউ কেন কিডন্যাপ করবে ?”

“সেই প্রশ্নটাতো আমার মনেও দাগ কাটছে ৷ কিন্তু সমস্যা আরেকটা হয়েছে ৷ ”

“কি সমস্যা ৷”

“সায়মার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলার জন্য একটু আগে কল করি আমি ৷ কিন্তু মেয়েটা আমার পরিচয় জানার পরে ফোন কেটে দেয় ৷ আমার মনে হচ্ছে সায়মা মেয়েটা কিছু লুকাচ্ছে ৷ আমি আজকেই ওর কাছে যাবো ৷”

রায়হান সাদমানের হাত জড়িয়ে ধরে ৷ তারপর সিক্ত গলায় বলল ,

“যা করার একটু তাড়াতাড়ি কর ভাই ৷ আমার বোন দোষ করুক আর না করুক ৷ আমি এর একটা সঠিক সমাধান চাই ৷”

“আমি চেষ্টা করবো ৷ তুই চিন্তা করিস না ৷”

নিজের বাড়ীতে এসেই চিৎকার করছে আবরার বড় ভাই আরহাম ৷ তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না ৷ তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কতটা রেগে আছে ৷ আরহাম নিজের বাবার কাছে যেয়ে বলল ,

“তোমরা রাইয়ের বিরুদ্ধে কেন কোনো ব্যবস্থা নাও নি বাবা ৷ আমার সন্তানকে দুনিয়ার মুখ দেখার আগেই শেষ করে দিয়েছে ৷তোমরা ওকে ছেড়ে দিলেও আমি ছাড়বো না ৷ আমি এখন পুলিশের কাছে যাবো ৷”

আনিলা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলায় ৷ তারপর ছেলেকে শান্ত করতে বলল ,

“রাগ করে না বাবা ৷ আর তুই কাউকে কিছু না বলে কেন দেশে এসেছিস ? এভাবে মাথা গরম করিস না ৷রাই তার উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে ৷”

“তুমি আমাকে মাথা ঠান্ডা করতে বলছো মা ৷ আমি কিভাবে মেনে নেব এই অপরাদ ৷ আমার অনাগত সন্তান হত্যা করেছে ৷ একটা বাবার জন্য এই ঘটনা কতটা কষ্টের সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো না ৷”

“তুই জেরিনের কাছে যা ৷ মেয়েটাও ভেঙ্গে পড়েছে ৷ তুই যদি এমন পাগলামি করিস ৷ তাহলে জেরিনকে সামলাবে কে বলতে পারিস ৷ মেয়েটা মনে হয় ঘুমিয়ে আছে ৷ তুই ওর কাছে যা ৷ তোকে দেখলে ওর ভালো লাগবে ৷”

আবরার সিড়ির পাশেই দাড়িয়ে ছিল ৷ তার মুখে একটা কথাও নেই ৷ নির্বাক দৃষ্টিতে আবরার তাকিয়ে রইলো তার ভাইয়ের দিকে ৷ আরহাম সিড়ির কাছে যেতেই আবরারকে দেখতে পেল ৷কিন্তু একটা কথাও তার সাথে বললো না ৷বেশ রাগ নিয়ে সে উপরে চলে গেল ৷ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে আবরার ৷ তারপর বাসা থেকে বেড়িয়ে যায় ৷

অন্যদিকে রাই ওয়াসরুম থেকে গোসল করে বের হলো ৷ তারপর মাথার চুল আচড়ে নিল ৷ কুকুরটাকে একটু আদর করে বাজারের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেল রাই ৷ঘরে রান্না করার মতো কিছুই নেই ৷রাই বাজারে যেয়ে প্রয়োজন মতো সব কিনে নিল ৷রোদের মধ্যে হাটতে হাটতে বেশ ক্লান্ত হয়ে যায় রাই ৷ একটু সামনে যেতেই দেখতে পায় আখের রস ৷ রাই নিজের জামার পকেটে হাত দেয় ৷ বিশ টাকার একটা নোট পায় সে ৷ রাই দ্রুত হেটে সেখানে যায় আখের রস খেতে ৷ তারপর দশ টাকায় এক গ্লাস আখের রস কিনে খেতে শুরু করে ৷রাই খাওয়া শেষ করে পকেট থেকে টাকা বের করে ৷কিন্তু যখনই সে টাকাটা দিতে যাবে ৷ ঠিক ঐ সময় রস ওয়ালাকে কেউ একজন টাকা দিয়ে বলল ,

“এই নিন ওনার টাকা ৷”

রাই পাশে ফিরে লোকটার দিকে তাকায় ৷ সোহরাব দাড়িয়ে আছে তার পাশেই ৷রাই বিরক্ত কন্ঠে বলল ,

“আপনি এখানে কি করছেন ?আর আপনি কেন আমার টাকা দেবেন ?”

সোহরাব মুচকি হাসি দেয় রাইয়ের দিকে তাকিয়ে ৷তারপর শান্ত গলায় বলল ,

“এখান থেকেই যাচ্ছিলাম ৷ দূর থেকেই আপনাকে দেখে চিনে ফেলেছি ৷ ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলে যাই ৷ তারপর দেখলাম আপনি জামার পকেটে হাত দিয়ে টাকা আছে কি না দেখছেন ৷আপনার কাছে তো বেশি টাকা নেই ৷ তাই আপনার হয়ে আমি টাকা দিয়ে দিলাম ৷”

“দোকানদারকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট টাকা আমার কাছে আছে ৷তাই আপনাকে দয়া দেখাতে হবে না সোহরাব সাহেব ৷রাই টাকা দিয়ে হাটতে শুরু করে ৷”

রাইয়ের পেছনে সোহরাব হাটতে থাকে ৷ তারপর পেছন থেকে সোহরাব বলে ,

“আমরা কি ভালো বন্ধু হতে পারি না ৷”

রাই পেছনে ঘুড়ে তাকায় ৷ তারপর জবাব দেয় ,

“ছেলে আর মেয়ে কখনো বন্ধু হয় না সোহরাব সাহেব ৷”

“আমি আপনার বন্ধু হতে চাই ৷”

“কিন্তু আমি চাই না ৷”

সোহরাব রাইয়ের সামনে দৌড়ে আসে ৷ তারপর রাইকে উদ্দেশ্য করে বলল ,

“আমি আপনার মতো মানুষকে হারাতে চাই না ৷ যেই মানুষটা আমাকে ঠিক ভুল চিনতে সাহায্য করেছে ৷ তাকে বন্ধু হিসেবে সারা জীবন চাই ৷ আপনাকে আমার সুখ দুঃখের ছোট জীবনে বন্ধু হিসেবে চাই ৷”

রাই বাজারের ব্যাগটা পাশে রাখে ৷ সোহরাবের মুখের দিকে কিছু সময় রাই তাকিয়ে থাকে ৷তারপর বেশ রাগী গলায় বলে ,

“সকালে আমার বাসায় ফুল আর শাড়ী আপনি পাঠিয়েছেন তাই না ৷”

সোহরাব মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকে ৷ রাই তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল ,

“আপনি কাজটা একদম ঠিক করেন নি ৷ আর আমার বাসাও চিনে গেছেন ৷আজ দারোয়ানের থেকে শাড়ী আর ফুল নিয়ে আসবেন ৷ ঐ সব আমার দরকার নেই ৷”

রাই বাসার দিকে হাটতে শুরু করে ৷ তার মুখের ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে খুব বিরক্ত ৷সোহরাব রাইয়ের কাছে আবারো আসে ৷ তারপর মাথা নিচু করে বলল ,

“আপনি হয়তো ভাবছেন আমি বিরক্তিকর ৷ হয়তো আমি আপনাকে ফলো করছি খারাপ উদ্দেশ্যে ৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন ৷ আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই ৷ আপনি ঐ দিন না থাকলে আজ হয়তো আমি দুনিয়ায় থাকতাম না ৷ আপনি যদি ভালোবাসা কি তা না বুঝাতেন ৷ তাহলে আমি এখনো মরিচীকার পিছনে ছুটে চলতাম ৷ গতকাল রাত আট টায় আমার চাকরির খবর এসেছে ৷ কয়েক দিন আগে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পনীতে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দেই ৷ গতকাল রাতেই তারা আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছে ৷ আজ হয়তো আমি এই দুনিয়াতে থাকতাম না ৷ আমার মৃত্যুর কারনটা হয়তো কেউ জানতো না ৷ আপনাকে মুখে ধন্যবাদ বলতে চাই নি ৷ তাই পকেটে থাকা সামান্য টাকা দিয়েই আপনার জন্য একটা শাড়ী কিনে ফেলি ৷ আর যেই দিন আপনি আমাকে বাচিঁয়ে ছিলেন ৷ ঐ দিন অনেক রাত হয়ে গিয়ে ছিল ৷ কেন যেন একা একটা মেয়েকে ছাড়তে ইচ্ছে করে নি ৷ তাই আপনি যখন আমার থেকে অনেক দূরে চলে যান হাটতে হাটতে ৷ তখন আমি দূর থেকেই আপনার পিছু নেই যখন দেখি আপনি বাসার ভেতর চলে গেছেন ৷ তখন আমি ফিরে যাই ৷ বিশ্বাস করুন আমার কোনো খারাপ মতলব নেই ৷ শুধু আপনার মতো একটা মানুষকে হারাতে চাই না ৷ আমি সত্যি আপনার বন্ধু হতে চাই ৷”

সোহরাব বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় রাইয়ের দিকে ৷ আপনজন হারানো রাইয়ের মনটা ছটফট করে ওঠে ৷ কেন যেন সোহরাবকে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ৷ রাই সোহরাবের হাতের দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয় ৷ সোহরাব মুচকি হেসে বলে ,

“আমি সারা জীবন এই বন্ধুত্ব অটুট রাখবো ৷”

রাই সোহরাবের কথার পিষ্ঠে কিছু বলতে চায় ৷কিন্তু তার আগেই একজন বলল ,

“বাহ দিনের আলোয় রঙ্গলীলা ভালোই চলছে ৷শুধু কি হাত ধরা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ৷ নাকি আরো অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছো দুইজন ৷”

পরিচিত কারো কন্ঠস্বর শুনেই রাই পেছনে তাকালো ৷ রাইয়ের থেকে একটু দূরেই আবরার দাড়িয়ে আছে ৷ রাই আবরারকে এই মুহূর্তে একেবারেই আশা করে নি ৷আবরার চোখে স্পষ্ট ক্ষোভ দেখতে পাচ্ছে রাই ৷রাই সোহরাবের হাত ছেড়ে দেয় ৷ রাইয়ের দিকে তাকিয়ে আবরার বলল ,

“তুই আর কত ছেলের জীবন নিয়ে খেলবি ৷ তোর ভালোবাসা কি বাজারে বিক্রি করিস ৷তোর খারাপ রূপ আর কত সহ্য করবো আমি ৷”

রাই আবরার দিকে তাকিয়ে বলল ,

“আবরার মুখ সামলে কথা বলুন ৷ আপনার যা ইচ্ছে তাই আমাকে বলবেন না ৷ আমি কিন্তু সহ্য করবো না ৷”

“আমার যা ইচ্ছে আমি তাই বলবো ৷ কি করবি তুই হ্যা ৷ কিসের এত ভাব এই ছেলের সাথে তোর ৷ আমাকে আর কত ভাবে ভেঙ্গে দিবি তুই ৷ এর থেকে ভালো একেবারেই মরে যেতাম ৷ রাত নেই দিন নেই ওর সাথেই থাকিস ৷ নাকি একেক সময় একেক জনের কাছে যাওয়াই তোর ধান্দা ৷ নাকি বেশ্যা হয়ে গেছিস তুই ৷”

সোহরাব যেন আর চুপ করে থাকতে পারে না ৷ আবরার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে সোহরাব বলল ,

“মুখ সামলে কথা বলুন ৷ কারো সম্পর্কে না জেনে যা ইচ্ছে বলবেন না ৷ আপনি যদি আর একটা খারাপ কথা বলেন ৷ তাহলে সেটা একদম ভালো হবে না ৷”

সোহরাবের এই কথা গুলো আবরার রাগ কয়েক গুন বাড়িয়ে দিল ৷ নিজের রাগ সামলাতে না পেরে আবরার সোহরাবের কলার চেপে ধরে ৷ তারপর চিৎকার করে বলল ,

“তোর কাছ থেকে শিখতে হবে এখন আমাকে ৷ আমার যা ইচ্ছে আমি বলবো ৷ তুই কে বলার?”

আবরার সোহরাবের গায়ে হাত তুলে ফেলে ৷ একটা সময় দুই জনের মধ্যে মারামারি লেগে যায় ৷ আশেপাশে মানুষ ভিড় করে দাড়িয়ে আছে ৷ রাই যখন দেখলো আবরার সোহরাবকে বিনাদোষে মারছে ৷ তখন আর সে সহ্য করতে পারে নি ৷ রাই দৌড়ে আবরার কাছে যায় ৷ তারপর সোহরাবের কাছ থেকে আবরারকে ছাড়িয়ে নেয় ৷ আবরার আবারো সোহরাবকে মারতে চায় ৷ কিন্তু রাই তার আগেই আবরার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় ৷ তারপর চিৎকার করে বলে ,

“আপনি যদি আর একটা ফুলের টোকা সোহরাবকে দিয়েছেন ৷ তাহলে আমার থেকে আর কেউ খারাপ হবে না ৷সবাই মিলে আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছেন ৷ এবার দয়া করে একটু ভালো থাকতে দিন ৷ হ্যা আমি সোহরাবকে ভালোবাসি ৷ আর খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করছি আমরা ৷ আপনিও তো বিয়ে করছেন ৷ তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন ? চলে যান আপনি ৷ আপনার মুখ আমি দেখতে চাই না ৷ যারা ভালোবাসার মানুষ গুলোকে বিশ্বাস করতে পারে না ৷ তাদের সাথে কোনো সম্পর্ক আমার নেই ৷”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here