#শ্রাবন_আধারে_তুমি_২,২১,২২
#লেখিকা_আফরিন_ইসলাম
#পার্ট_২১
রাস্তার পাশের একটা বিরাট বড় গাছের নিচে রাই আর সোহরাব বসে আছে ৷ রাই কোন কথা বলছে না ৷ একটু আগে আবরার চলে গেছে ৷ রাইয়ের কথার কোনো জবাব দেয় নি সে ৷ তবে কটমট করে সোহরাবের দিকে তাকিয়ে ছিল ৷ যেন কাঁচা খেয়ে ফেলবে সোহরাবকে ৷ তারপর রাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে ৷ সোহরাব রাইকে উদ্দেশ্য করে বলল ,
“তখন আপনি ঐ লোকটাকে মিথ্যে কথা কেন বললেন ? আর উনি হঠাৎ এসেই যা ইচ্ছে বললো ৷ আবার আমি অপরাধ না করেও মার খেলাম ৷ আপনি আবার তার গায়ে হাত তুললেন ৷ আমাকে একটু বলবেন কি হয়েছে ?
রাই সোহরাবের দিকে তাকায় ৷ তারপর বলে ,
“আপনি জেনে কি করবেন ?আপনি অনেক জায়গায় ব্যাথা পেয়েছেন ৷ তার হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে ৷ লোকটার মাথা ঠিক নেই ৷ আগেও পাগল ছিল ৷ আর এখন আরো পাগল হয়েছে ৷যাই হোক এখন আমার যাওয়া উচিত ৷”
“আপনি কিন্ত কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন ৷”
“আপনাকে বলে কি লাভ হবে আমার ? যারা আমাকে বুঝলে , আজ আমি এখানে থাকতাম না ৷ তারাই তো বোঝে নি ৷ তাই নিজের ব্যাপারে আর সাফাই গাইতে চাই না ৷”
“নিজের বুকের ভেতরে রাখা কষ্ট গুলো চেপে রাখতে নেই ৷ পাশে থাকা মানুষটাকে বলতে হয় ৷ এতে বুকের যন্ত্রনা কমে যায় ৷ আমাকেই দেখুন না ৷ আমি আপনাকে না চিনেও সব বলেছি ৷ আর আপনি বন্ধু হিসেবে আমাকে বলতে পারবেন না ৷”
“আপনি কি সত্যি শুনতে চান সব কিছু ৷ নাকি দয়া করছেন আমাকে ৷”
সোহরাব হাসে ৷ তারপর জবাব দেয় ৷
“মানুষকুলে জন্ম নিয়েছি ৷ তাই দয়া করার সাধ্য আমার নেই ৷ অহংকার ,দয়া এই সব কিছু এক সৃষ্টিকর্তার জন্য ৷ আর আমি বন্ধু হিসেবে আপনার পাশে থাকতে চাই ৷ এখন বাকিটা আপনার ইচ্ছে ৷”
রাই আর কথা বাড়ালো না ৷ এক এক করে জীবনের সকল ঘটনা খুলে বলতে লাগলো সোহরাবকে ৷
অপর দিকে সাদমান আর রায়হান সেই ঔষুধের দোকানে এসেছে একটু আগে ৷ সাদমান নিজেকে পুলিশ হিসেবে পরিচয় দিতেই কর্মচারী তাকে ফুটেজ দেখাতে রাজী হয় ৷ তারা এখন ফুটেজ চেক করার জন্য ল্যাপটপের সামনে বসে আছে ৷কাগজে লেখা তারিখ অনুযায়ী ফুটেজ দেখা হচ্ছে ৷ কিন্তু তেমন কিছুই ধরা পড়ছে না ৷ সাদমান আর রায়হান ফুটেজের দিকে মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে ৷ কিন্তু সন্দেহ করার মতো কাউকে দেখতে না পেয়ে রায়হান এক প্রকার আশা ছেড়েই দিল ৷ রায়হান হতাশ গলায় বলল ,
“আমার মনে হয় না কিছু পাওয়া যাবে ৷ চল এখান থেকে ৷ ”
রায়হান উঠে দাড়ালো চলে যাওয়ার জন্য ৷ ঠিক তখনই সাদমান বলল ,
“দোস্ত তাড়াতাড়ি দেখ ৷চলে যাস না ৷”
রায়হান ফুটেজের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ৷ ফুটেজের মধ্যে দেখা মানুষটাকে দেখে তার বুকটা কেঁপে ওঠে ৷ রায়হান ঠাস করে চেয়ারে বসে পরে ৷
অন্যদিকে আবরার নিজের রুমে যেয়ে সব ভাঙ্গতে থাকে ৷ বাইরে থেকে আনিলা বেগম ছেলেকে ডাকতে থাকে ৷ আবরার ছোট ভাই দরজা ধাক্কাতে থাকে ৷ কিন্তু তাতেও আবরার দরজা খোলে না ৷ আবরার সব ভেঙ্গে ঘরের মধ্যে বসে পরে ৷ দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে কাদঁতে কাদঁতে আবরার বলল ,
“আল্লাহ আমি কি দোষ করে ছিলাম ? আমি তো শুধু ভালোবেসেছি ৷ তাহলে আমি কেন এত কষ্ট পাচ্ছি ? আর কেউ না জানুক ৷ তুমি তো জানো আমার বুকের ভেতর কেমন লাগে ৷ আমি নিজের ভাই ,ভাবির দিকে তাকাতে পারি না লজ্জায় ৷ নিজের মুখটা আয়নায় দেখতে পারি না ৷ ঐ বেইমান মেয়েটা আমাকে শেষ করে দিয়েছে ৷ রনির মতো একটা ছেলের সাথে খারাপ সম্পর্ক করেছে ৷ এক ঘরে থেকেছে তার সাথে ৷ আর আজ অন্য একটা ছেলের সাথে ঘুড়ছে ৷ এত এত অন্যায় করার পরেও আমি তো পারি না স্বার্থপর হতে ৷ আমি তো মন থেকে অন্য কাউকে মানতে পারি না ৷ আমি তো চাইলেই সবার সামনে কাদঁতে পারি না ৷ চাইলেই চোখের পানি দেখাতে পারি না খোদা ৷ হয় আমাকে এই নরক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দাও ৷ নইলে আমাকে এই দুনিয়া থেকে নিয়ে যাও খোদা ৷ আমি আর সহ্য করতে পারছি না ৷”
রাইয়ের সব কথা শুনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয় সোহরাব ৷তারপর হতাশ কন্ঠে বলল ,
“আপনাকে কি বলে শান্তনা দেব তা জানি না ৷ তবে আপনার সাথে অন্যায় হয়েছে ৷আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো ?”
“করুন ৷”
“নিজের পরিবারের কাছে আপনার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না ৷”
“কয়েক দিন আগেও খুব ইচ্ছে করতো ৷ এখন আর ইচ্ছে করে না ৷”
“কেন ইচ্ছে করে না আপনার ? তাদের কাছে পেলে আপনি আবার খুশি থাকবেন ৷”
“যেই মানুষটা নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই বিসর্জন দিয়েছে ৷ তার আবার কিসের খুশি ৷মৃত মানুষের পরিবার হয় না ৷ তারা একদম একা ৷”
“আচ্ছা আপনাকে যারা ধর্ষন করতে চেয়ে ছিল ৷ আপনি তাদের বিরুদ্ধে মামলা কেন করেন নি ?”
রাই সোহরাবের কথায় জোড়ে হাসতে থাকে ৷ তারপর নিজের হাসির মাত্রা কমিয়ে জবাব দেয় ৷
“আপনার মতো এত বড় একটা মানুষের মুখে এই কথা মানায় না ৷ যেখানে আমার পেটে খাবার ছিল না ৷ যেখানে আমার মাথার উপর কোনো আশ্রয় ছিল না ৷ সেখানে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা করা বিলাসিতা সোহরাব ৷ এখন আর ধর্ষকদের বিচার হয় না ৷ এখন ধর্ষিতাদের গলা চেঁপে মারা হয় ৷কিভাবে মারা হয় জানেন ?যদি কোনো ধর্ষিতা ধর্ষনের মামলা করতে যায় ৷ তাহলে তাকে প্রশ্ন করা হয় শরীরের কোথায় হাত দিয়েছে ৷কতজন মিলে কতক্ষন ধর্ষন করেছে ৷ ধর্ষন করার সময় গায়ে কাপড় ছিল কি না ৷ মেয়েটার মেডিক্যাল টেস্ট হয় ৷ মেয়েটাকে সাংবাদিকের সামনে যেতে হয় ৷ সমাজের লোকের ঠাট্টার কারন হতে হয় ৷ শান্তনার নামে উপহাসে শিকার হতে হয় ৷ অতঃপর ধর্ষিতারা বাধ্য হয় গলায় ফাঁসির দড়ি দিতে ৷ মরার পরেও তাদের নিয়ে খারাপ কথার শেষ হয় না ৷ আর কিছু দিন পর ধর্ষকরা ঘুড়ে বেড়ায় খোলা আকাশের নিচে ৷ তাই আজ ধর্ষিতারা মুখ খুলতে ভয় পায় ৷ অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ৷ মৃত্যুর কারন গুলো অজানাই থেকে যায় ৷ আর আমার সাথে যেটা হয়েছে ৷ সেটার পর আমি মরে গেছি সোহরাব ৷ শরীরটা ব্লেড দিয়ে কাটতে পারি না ৷ মৃত্যুকে বরন করতে পারি না খোদার ভয়ে ৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ভেতর থেকে শেষ হয়ে গেছি একদম ৷
রাত ঘড়িতে আটটা ৷রায়হান বাড়ীতে এসে কোনো কথা বললো না ৷ নিজের ঘরে যেয়ে সোজা ফ্রেশ হয়ে নিল ৷ একটু পর একটা কল আসতেই রায়হান বেড়িয়ে যায় ৷রাতের খাবার না খেয়েই বেড়িয়ে যায় সে ৷পেছন থেকে তার স্ত্রী কয়েক বার ডাকলো ৷ কিন্তু রায়হান সেই ডাকে উত্তর দিল না ৷
চলবে
#শ্রাবন_আধারে_তুমি_২
#লেখিকা_আফরিন_ইসলাম
#পার্ট_২২
রায়হান বাড়ীতে ফিরে এলো রাত বারোটার দিকে ৷ রায়হান নিজের ঘরের চলে গেল ৷ ঘর যেয়ে দেখলো ছোট রাফী তার মায়ের কোলের মধ্যে ঘুমাচ্ছে ৷ রাফীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে তার মা ৷ রায়হান তাদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ৷ কাপড় পাল্টে বারান্দায় চলে যায় রায়হান ৷ কিছু সময় পর ফোনটা হাতে তুলে নেয় ৷ মনের অজান্তে রাইয়ের নাম্বারে কল করে ফেলে ৷ কল করার কয়েক মুহূর্ত পরেই কলটা রিসিভ হয় ৷ রায়হান ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে ৷ কিন্তু মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারে না ৷ রায়হান নিজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে ৷ যেন অপর পাশের মানুষটা বুঝতে না পারে সে কাদঁছে ৷ ওপাশ থেকে রাই বলছে ,
“হ্যালো ! কে বলছেন আপনি ?”
রায়হান জবাব দেয় না ৷সেচুপ করে থাকে ৷কিছুক্ষন পরে ওপাশ থেকে বিরক্ত গলায় রাই বলল ,
“যখন কথা বলবেন না ৷ তখন কেন কল করেন মাঝরাতে ?”
রাই কল কেটে দিল ৷ রায়হানের আর দ্বিতীয়বার সাহস হয় না কল করার ৷ কয়েক দিন আগেই নতুন একটা সিম কিনে ছিল রায়হান ৷পুরনো নাম্বার থেকে কল করে নি সে ৷ তাই রাই চিনতে পারে নি ৷ কিছু সময় পর রায়হান ঘরে চলে আসে ৷ নিজের ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে রায়হান ৷ স্ত্রীর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে ৷ তারপর বাম হাতে চোখ মুছে রায়হান বলল,
“তুমি আমাকে ঠকিয়েছো ৷ তোমাকে তোমার পাপের ফল ভোগ করতে হবে ৷ আমার তরফ থেকে এতটুকু ছাড় আমি দেব না ৷ নিজের বোনের বেলায় যেমন কঠোর ছিলাম ৷ তোমার বেলাতেও তার ভিন্ন হবে না ৷ অন্যায়ের কাছে ভালোবাসা মূল্যহীন ৷ তুমি যা করেছো ৷ তার কোনো ক্ষমা হয় না ৷শুধু অপেক্ষা করো ৷”
রাতের অন্ধকার কাটিয়ে নতুন ভোরের আবির্ভাব হলো ৷নিজের স্ত্রীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো রায়হানের ৷ কাল রাতে বারান্দায় বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে গেছে ৷ স্ত্রীর থেকে মুখ ঘুড়িয়ে নিল রায়হান ৷রাইয়ের ভাবি স্বামীর ঘাড়ে হাত রেখে বলল ,
“কি হয়েছে তোমার ?এমন মন মরা হয়ে আছো কেন তুমি ?কাল রাতে এসে আমায় ডাকলে না ৷ আবার বারান্দায় ঘুমিয়ে আছো ৷ কি হয়েছে আমাকে বলো ?”
রায়হান স্ত্রীর দিকে না তাকিয়ে বলল ,
“ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খাবো ৷ বাবা , মা আর ভাইকে আসতে বলো ৷ তাদের সাথে আমার দরকারি কথা আছে ৷”
রায়হান চেয়ার থেকে উঠেই ওয়াশরুমে চলে গেল ৷ রাইয়ের ভাবি স্বামীর এমন অদ্ভুত আচরনের কারন খুজে পেল না ৷
প্রায় দশ মিনিট পরে রায়হান খাবার টেবিলে গেল নাস্তা করতে ৷ সেখানে যেয়ে দেখলো সবাই বসে আছে ৷ রায়হানের বাবা আজাদ মাহমুদ বললেন ,
“কি ব্যাপার রায়হান তুমি আমাদের সবাইকে কেন আসতে বললে ? বৌমা বলল তুমি নাকি কিছু বলবে ৷”
“হ্যা বাবা আজ তোমাদের কিছু বলতে চাই ৷”
রায়হানের ছোট ভাই ফয়সাল বলল ,
“তাড়াতাড়ি বলো ভাইয়া ৷ আমাকে আবার বের হতে হবে ৷”
রায়হান খাবার খেতে খেতে বলল ,
“বাবা আমি আলাদা হতে চাইছি ৷”
বড় ছেলের কাছ থেকে এমন কথা আজাদ মাহমুদ আশা করেন নি ৷ তিনি রেগে বললেন ,
“কি সব বলছো রায়হান ৷ মাথা ঠিক আছে তোমার ৷”
রায়হান শান্ত ভাবেই জবাব দিল ,
“আমার মাথা একদম ঠিক আছে বাবা ৷ আর বিয়ের পর থেকে তোমাদের বৌমা এটাই চেয়ে ছিল ৷বিয়ের অনেক বছর পরেও তার ইচ্ছে রাখতে পারি নি ৷ স্বামী হিসেবে তার কথা যদি রাখতাম ৷তাহলে হয়তো আজ আমি মানসিক যন্ত্রনার শিকার হতাম না ৷রাফী সুস্থ হলেই হোস্টেলে পাঠিয়ে দেব ৷ পরিবারের সাথে থেকে আর কি করবে ৷ যেখানে পরিবারের মানুষ গুলোই বিশ্বাস যোগ্য না ৷ সেখানে ওর নিরাপত্তা নেই ৷ আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ৷ আমি কয়েক দিনের মধ্যে আলাদা হবো ৷”
তনিমা বেগম ছেলেকে বললেন ,
“কি সব বলছিস বাবা ৷ আমাদের কথাটা একবার ভেবে দেখ ৷ তোদের জন্যই তো আমরা বেঁচে আছি ৷তোরা যদি আমাদের ছেড়ে চলে যাস ৷ তাহলে আমরা কাদের বুকে নিয়ে থাকবো ৷”
রায়হান টলমল নয়নে মায়ের দিকে তাকায় ৷ তারপর বলে ,
“মা তোমরা আমার উপরের দিকটাই দেখছো ৷ ভেতর থেকে আমিও ক্লান্ত ৷ ভুল মানুষের হাত ধরে ছিলাম আমি ৷ বছরের পর বছর ধরে যেই আগুন চার দেয়ালের মাঝে আটকে রেখেছি ৷ আজ সেই আগুন আমার পরিবারের লোকদের শেষ করে দিচ্ছে ৷”
আজাদ ছেলেকে কিছু বলবে ৷ তার আগেই রায়হান বলল,
“প্রশ্ন করো না কোনো ৷ কারন সময় হলেই সব জেনে যাবে ৷তখন সূর্যের আলোর মতো সব পরিষ্কার হয়ে যাবে ৷ দয়া করে আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে এসো না তোমরা ৷ আমার জন্য একটা নিরপরাধ মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে ৷আর কাউকে শেষ করতে চাই না ৷”
রায়হানের কথার মাঝেই কলিংবেল বেজে ওঠে ৷তনিমা বেগম ফুলিকে দরজা খুলতে বলে ৷ফুলি দরজা খোলার কিছু সময় পর আফজাল খান আর আনিলা বেগম ভেতরে আসেন ৷ তাদেরকে রাইয়ের পরিবারের কেউ এই সময় আশা করে নি ৷আফজাল খানকে সালাম দিলেন আজাদ মাহমুদ ৷ তনিমা বেগম তাদের বসতে দিলেন ৷ রাইয়ের ভাবি তাদের জন্য নাস্তা বানাতে রান্না ঘরে চলে গেল ৷ আফজাল খান রাফীর ব্যাপারে আগে জিজ্ঞাসা করলেন ৷আজাদ হাসিমুখেই নাতির কথা বললেন ৷ তারপর বেশ মলিন গলায় বললেন ,
“আপনারা হঠাৎ কিছু না বলেই চলে এলেন ৷ আমাদের একটা কল করতেন ৷তাহলে একটু অতিথি সেবা করা যেত ৷”
আফজাল খান হালকা হেসে বললেন ,
“আমরা এখানে বেড়াতে আসি নি ভাই ৷ আপনাদের একটা গুরুত্বপূর্ন কথা বলতে এসেছি ৷ আপনারা আমাদের অতি আপন ৷ তাই আপনাদের আগে জানাতে এলাম ৷আমার মেজো ছেলে আবরার খান জয়ের বিয়ে দুই দিন পরে ৷ কালকে গায়ে হলুদ ৷ বিয়ের কার্ড ছাপা হয় নি ৷ আসলে আমরা একটু তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি ৷ তাই অতিথি হিসেবে সবাইকে দাওয়াত দিতে যাচ্ছি ৷আর কার্ড তৈরি করতে সময় লাগবে ৷ কিন্তু আমরা তাড়াতাড়ি সব করতে যাচ্ছি ৷”
আজাদ মাহমুদ একটা নিঃশ্বাস নেয় ৷ তারপর হাসিমুখে বলে ,
“খুব ভালো কাজ করেছেন ৷ তা মেয়েটা কে ?”
আনিলা বেগম বেশ হাসিমুখে বললেন ,
“আমার ননদের বড় ভাসুরের মেয়ে ৷মেয়েটা মেডিকেলে পড়ছে ৷ দেখতেও বেশ সুন্দর ৷ আবরার সাথে বেশ মানাবে ৷মেয়ের ছবি দেখেই আমাদের পছন্দ হয়ে গেছে ৷তাই আর না করি নি ৷আপনারা কাল পুরো পরিবার নিয়ে যাবেন ৷ আমরা খুশি হবো ৷”
আজাদ মাহমুদ হতাশ গলায় বললেন ,
“আমরা অবশ্যই যাবো ৷”
অন্যদিকে রাই নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছে ৷কুকুরটা তার পাশেই বসে আছে ৷রাই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ৷ তারপর বলে ,
“কি রে তোর কি মন খারাপ ?মন খারাপ করিস না ৷ এই শহর আমাদের জন্য না ৷ আমরা এই ইট পাথরের শহরে কিছুই পাবো না ৷ অনেক তো হলো ৷ এবার চল নিজেদের মতো করে বাঁচার চেষ্টা করি ৷যেখানে কোনো প্রিয়জন নেই ৷ যেখানে কোনো পরিচিত মুখ নেই ৷ সেখানে দুজন খুব ভালো থাকবো ৷ জানিস আজ আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে ৷ ওদের আর দেখতে পাবো না ৷ ওদের থেকে পালাতেই তো চলে যাচ্ছি এই শহর ছেড়ে ৷গতকাল কফিশপের মালিক কল করে ছিল ৷ কক্সবাজারে তার নাকি নতুন কফিশপ হচ্ছে ৷ সেখানে নাকি লোক লাগবে ৷ আমি চাইলে সেখানে যেতে পারি ৷ কথাটা শুনেই হ্যা বলে দিয়েছি ৷ মা নেই ,বাবা নেই ,ভাই ,বোন ,পরিজন ,পরিবার কিছু নেই ৷তাই এখানে থেকে আর কি করবো ৷ ওরা ভালো থাকুক ওদের মতো ৷আর আমি নিজের মতো তোকে নিয়ে ভালো থাকবো ৷ আজকে অনেক কাজ আছে ৷ একটু পর টিকিট কাটতে যাব ৷ তারপর আবার সোহরাবের থেকে বিদায় নেব ৷ আর তো দেখা হবে না ৷ চল আজ এক সাথে বের হবো আমরা ৷”
রাই কিছুক্ষন পর বাসা থেকে বের হয় ৷ তারপর চলে যায় বাসের টিকিট কাটতে ৷ সিরিয়ালে দাড়িয়ে টিকিট কাটতে হবে ৷ তাই তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যায় রাই ৷
অন্যদিকে রায়হান বাসা থেকে বের হয়ে বন্ধু সাদমানকে কল করে ৷ ওপাশ থেকে কল রিসিভ করতেই রায়হান বলল,
“সাদমান প্রমান যোগার করতে পেরেছিস কিছু ৷ এদিকে আবরার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ৷ সাদির বিরুদ্ধে প্রমান না পেলে অনেক বড় অন্যায় হয়ে যাবে ৷হ্যালো সাদমান কথা বলছিস না কেন ? অনিকের জবান নিয়েছিস তুই ৷ চুপ করে আছিস কেন ?”
ওপাশ থেকে হঠাৎ একটা তীব্র হাসির আওয়াজ আসে ৷ কেউ একজন প্রচন্ড হাসছে ৷ রায়হান কৌতুহল হয়ে বলল,
“এই কে আপনি ?সাদমানের ফোন আপনার কাছে কেন ? সাদমানকে ফোন দিন ৷ ওর সাথে আমার কথা আছে ৷”
রায়হানের কথা শেষ হতেই ওপাশ থেকে বলল ,
“আরে রায়হান ভাই এত কাঁচা খেলোয়ার হলে চলবে ৷ আপনি বড্ড বোকা ৷ আচ্ছা আপনারা এত বোকা কেন ? ওহ সরি !আমি আপনাদের বোকা বানিয়েছি বারবার ৷ আপনি আমার মুখোশ সবার সামনে খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন ৷ আর আমি টের পাবো না ৷ এটা কি করে হয় বলুন ৷ আর আপনার পুলিশ অফিসার বন্ধুকে কাল আমি কিডন্যাপ করেছি ৷ বেচারা আমার বিরুদ্ধে সব প্রমান যোগার করে ফেলেছে ৷এটাকে ভাবছি বাচিঁয়ে রাখবো না ৷ তারপর সেই খবর সায়মাকে দেব ৷আর সায়মা তার অসুস্থ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কাউকে কিছু বলার সাহস করবে না ৷ আর আপনার বউ অথবা তার ভাই চেয়েও কিছু বলতে পারবে না ৷ কারন তাহলে তারাই ফাঁসবে ৷ আর আপনি কিছু প্রমান করতে পারবেন না ৷ আর কিছু যদি করতে যান ৷ তাহলে আপনার বউ ফেঁসে যাবে ৷ কারন খেলাটা আমি ঐ ভাবেই সাজিয়েছি ৷গুড বাই রায়হান ভাইয়া ৷”
রায়হান মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে ফুটপাতে ৷ তবে কি এবার প্রান প্রিয় বন্ধুকে হারাতে হবে তার ৷
বিকেলের শেষ ভাগ ৷ সূর্যের আলোয় তেজ নেই ৷ চারিদিক শান্ত ৷ একটু দূরে দূরে দুই একজন করে মানুষ ৷ রাই বসে আছে একটা মাঠের মাঝখানে ৷সোহরাব দূর থেকে রাইকে দেখে ৷ তারপর দৌড়ে আসে তার কাছে ৷রাইয়ের কাছে এসে হাপাতে হাপাতে বলল ,
“আপনার জন্য কতো কষ্ট হয়েছে আমার তা জানেন ৷হুট করেই একটু আগে বললেন দেখা করতে ৷ ”
রাই সোহরাবের দিকে একটা পানির বোতল এগিয়ে দেয় ৷ তারপর বলে ,
“পানিটা আগে খেয়ে নিন ৷ তারপর কথা বলছি ৷”
সোহরাব রাইয়ের পাশে বসে পানি খেয়ে নেয় ৷ তারপর বলে ,
“আপনি সব সময় কখন কি দরকার তা কি করে বোঝেন ?যাদু বিদ্যা জানেন নাকি !এবার বলুন কেন ডেকেছেন ?”
রাই দিগন্তের দিকে তাকিয়ে হাসে ৷ তারপর জবাব দেয় ,
“সত্যি বলতে আমি নিজেও জানি না কেন ডেকেছি ? কেন যেন বুকের ভেতরটা অজানা কারনেই মোচর দিচ্ছে ৷ আপনজন বলতে তো কেউ নেই ৷ নিজের একাকিত্বকে বিদায় দিতেই আপনাকে আসতে বলা ৷ আপনি কি বিরক্ত সোহরাব ?”
“আপনার প্রতি বিরক্ত কেউ হতেই পারবে না ৷ আপনি অতি সাধারনের মাঝেও অসাধারন মানুষ ৷আর এর জন্যই আপনাকে আমরা খুব ভালো লাগছে ৷ মাত্র তিন,চার দিনের পরিচয়েই খুব ভালো লাগছে আমার ৷”
“আমাকে ভালো লাগার কিছু কারন বলুন সোহরাব ৷”
“ভালো লাগার আবার কারন হয় নাকি ৷”
“অনেক তো অপবাদ শুনলাম ৷ এবার প্রশংসা শুনতে চাই ৷ভালো লাগার কারন বলুন ৷”
“ভালো লাগার কারন যদি শুনতে চান ৷ তাহলে বলবো জীবন নামক নাট্যমঞ্চে টিকে থাকার জন্য আপনাকে আমার ভালো লাগে ৷ আপনি যেমন ঠিক ঐ ভাবেই নিজের উপস্থাপনা করার জন্য আপনাকে আমার ভালো লাগে ৷ এই যে আপনি আপনার কালো রংটা নিয়ে সন্তুষ্ট এর জন্য আপনাকে আমার ভালো লাগে ৷ নিজের জন্য বেঁচে আছেন এর জন্য ভালো লাগে ৷ আমার জীবনে জীবনী শক্তি হয়ে এসেছে ৷ এর জন্য আপনাকে আমার ভালো লাগে ৷ যদি বলেন কতটুকু ভালো লাগে ৷ তাহলে বলবো ভালো লাগার সীমা পার করলে যতটুকু ভালো লাগা যায় ৷ তার থেকেও একটু বেশি ভালো লাগে ৷”
“আপনি অনেক ভালো সোহরাব ৷ আপনাকে আমার সারা জীবন মনে থাকবে ৷”
“আমরা মাত্র কয়েক দিনের পরিচয়ে কত আপন হয়ে গেছি তাই না ৷”
“হুমমম৷”
“আচ্ছা একটা কথা বলবো ?”
“হাজারটা বলুন ৷মানা করেছে কে ?”
“আপনার নামটা এখনো জানা হয় নি ৷”
“রাইমা ইসলাম রাই ৷”
“আর আপনার কুকুর মশাইয়ের নাম কি ?”
“ওর কোনো নাম রাখি নি ৷”
“কেন ?”
“কিছু বন্ধুত্বের যেমন নাম হয় না ৷ঠিক তেমনি কিছু বন্ধুর নাম হয় না ৷ যাই হোক এবার আসল কথায় আসি ৷আমি এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি কাল ৷ আমাদের হয়তো আর কখনো দেখা হবে না ৷”
“আপনি চলে যাবেন মানে ৷ তাহলে আমাদের ফ্রেন্ডশিপের কি হবে ? আপনি চলে গেলে আমার অনেক কষ্ট হবে ৷”
“খুব একটা কষ্ট হবে না আপনার ৷ কারন আমরা খুব তাড়াতাড়ি একে অন্যের প্রিয়জন হয়েছি ৷ আর তাই খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে ৷ আর খুব তাড়াতাড়ি আমরা একে অন্যকে ভুলে যাবো ৷ পেছনের এই সুন্দর অতীত একটা সময় হাসির কারন হয়ে যাবে ৷”
রাই নিজের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে উঠে দাড়ায় ৷ তাপর সোহরাবকে বলে ,
“নিজেক খেয়াল রাখবেন ৷আপনাকে কখনো ভুলবো না ৷”
রাই সোহরাবকে রেখে চলে যেতে থাকে ৷ আর সোহরাব পাথরের মতো দাড়িয়ে থাকে ৷ তারপর চিৎকার করে বলে ,
“আমি আপনার অতীত হয়ে থাকতে চাই না রাই ৷”
রাই পেছনে ঘুড়ে তাকায় না ৷ সোহরাব রাইকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
“আমাকে কি আপনার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বানাবেন ? আমি জানি না কথা গুলো বলা উচিত হবে কি না ৷ আমাদের দুজনার একটা কালো অতীত আছে ৷ আচ্ছা আমরা কি ঐ কালো অতীতকে ভুলে বাচঁতে পারি না ৷ আপনাকে আমার এই কথা গুলো বলা উচিত না ৷তবুও বলবো থেকে যান আমার হয়ে ৷ মানুষটা সঠিক হলে , বর্তমান আর ভবিষ্যৎ অনেক সুন্দর ৷ থাকুক না কিছু মানুষ অতীতের ভয়ংকর সময়ে ৷”
চলবে