#শ্রাবন_আধারে_তুমি_২,২৬,২৭ সমাপ্ত
#লেখিকা_আফরিন_ইসলাম
#পার্ট_২৬
তিন দিন পার হয়ে গেছে ৷ রাইয়ের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হতেই লাগলো ৷সোহরাবের ব্যাপারে এখন সবাই জানে ৷ হাসপাতালের এক কোনায় রাত দিন পার করে সে ৷ রাইকে সবাই একবারের জন্য সামনা সামনি দেখতে চেয়েছে ৷ কিন্তু ডাক্তার দেখা করতে দেয় নি ৷ আবরার নিজেও বেশ অসুস্থ ৷সোহরাব ছোট কাচেঁর জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে রাইয়ের দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা ৷ রাত পার হয়ে দিন হয়ে যায় ৷ কিন্তু রাইকে দেখা তার শেষ হয় না ৷সোহরাবের মা ,বাবা এসে ছেলেকে নিয়ে যেতে চায় ৷ কিন্তু সোহরাব তাদের কথায় কোনো জবাব দেয় নি ৷ শুধুই তাকিয়ে থেকেছে জ্ঞানহীন রাইয়ের দিকে ৷তারাও এক সময় ছেলের প্রতি বিরক্ত হয়ে চলে যায় ৷
রাত ঘড়িতে বারোটা ৷ আইসিইউ এর দরজার কাছে সোহরাব শুয়ে আছে ৷ একটু আগে ক্লান্ত চোখে ঘুম ভর করেছে তার ৷ হঠাৎ চিৎকারের আওয়াজে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল ৷ অজানা ভয়ে লাফিয়ে উঠলো সে ৷ আইসিইউ এর দরজা খোলা ৷কাচেঁ ঘেরা জানালার পাশে যেয়ে দাড়ায় সোহরাব ৷ দেখতে পায় ভেতরে রাইয়ের পরিবারের সবাই দাড়িয়ে আছে ৷ রাইয়ের সাথে সবাই কথা বলছে ৷ সোহরাব বুঝে যায় রাইয়ের জ্ঞান এসেছে ৷ সোহরাবের ইচ্ছে করে রাইয়ের কাছে দৌড়ে যেতে ৷ কিন্তু চাইলেই তো যাওয়া যায় না ৷ রোগীর কাছের লোক ছাড়া ভেতরে যাওয়া নিষেধ ৷রাইয়ের মনোবল বাড়াতেই স্বজনদের ভেতরে যেতে দিয়েছে ডাক্তার ৷ কিন্তু রাই তাদের ভালোবাসা পূর্ন ডাকে সাড়া দিল না ৷ দূর থেকেই রাইয়ের একটু একটু খুলে রাখা চোখ দুটো দেখতে পায় সোহরাব ৷ রাইয়ের দুর্বল চোখ জোড়া হঠাৎ করেই ওপাশের মানুষটাকে দেখে ফেলে ৷ রাই নিজেও তাকিয়ে থাকে সেই দিকে ৷ এত চেনা মুখের ভিড়ে ঐ অচেনা মুখটাই দেখতে থাকে সে ৷ সোহরাব কাচেঁর জানালায় হাত রেখে কেদেঁ ওঠে ৷ আর রাইয়ের চোখের কোনে জল জমা হয় ৷ ডাক্তার রাইয়ের দৃষ্টি অনুসরন করেন ৷ডাক্তার তাকিয়ে থাকে ওদের দুইজনের দিকে ৷ তারপর একটা মুচকি হাসি দিয়ে ডাক্তার নার্সকে বললেন ,
“বাইরে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে আসতে বলো ৷ রোগীর তাকে দরকার ৷”
নার্স ডাক্তারের কথা মতো সোহরাবকে ভেতরে যেতে বলে ৷ সোহরাব দৌড়ে ভেতরে যায় ৷ ডাক্তার রাইয়ের পাশ থেকে সরে যায় ৷ সোহরাব রাইয়ের পাশে থাকা ছোট জায়গায় বসে পরে ৷দুইটা মানুষের চোখেই পানি ৷তাদের চোখ যেন হাজারো কথা বলছে ৷ সোহরাব মাথা নিচু করে রইলো ৷ একটু পর পর শরীরটা কেঁপে উঠছে তার ৷ সোহরাব যখন দেখলো রাইয়ের চোখ থেকেও পানি পড়ছে ৷ তখন সে সেই পানি নিজের হাত দিয়ে মুছে দিল ৷ তারপর নিজের চোখের পানি মুছে বলল ,
” আপনার নাম্বারে কত বার কল করেছি আমি জানেন? আর আপনি এখানে শুয়ে আছেন ৷ আমাকে বাচঁতে বলেছেন ৷ আর এখন আপনি নিজেই চলে যেতে চাইছেন ৷ আপনি কি ভেবেছেন ?আপনার জন্য আমি কেদেঁছি ৷আমি কিন্তু একদম আপনার জন্য কাদিঁ নি ৷ আর কখনো কাদঁবো না ৷ আর আমি কিন্তু আপনাকে দেখতে এখানে আসি নি ৷ আমার শরীরটা ভালো নেই ৷ তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছি ৷ আমি কিন্তু আপনার জন্য আসি নি ৷ ”
রাইয়ের অসহায় চোখ দুটোতে আনন্দ এসে ভর করলো ৷ যেন সে বুঝে গেছে সোহরাবের মিথ্যা ৷ সোহরাবের অগোছালো মিথ্যে গুলো যেন আনন্দ দিল রাইকে ৷সোহরাব তাকিয়ে রইলো সেই চোখের দিকে ৷সোহরাব ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল ,
“আমায় বিয়ে করবেন রাই ?আমি অধিকার নিয়ে আপনার সাথে থাকতে চাই ৷ আমি সবার মতো ভালোবাসি বলবো না ৷ শুনেছি ভালোবাসি বললে ভালোবাসা বেশি দিন থাকে না ৷ ডাক্তার বলেছে আপনি নাকি আর কখনো কথা বলতে পারবেন না ৷ ডাক্তার বলেছে আপনি নাকি কখনো আর দাড়াতে পারবেন না ৷ কিন্তু আমি চাই আপনি আবার কথা বলুন ৷ আমি চাই আপনি আবার খোলা আকাশের নিচে হেটে চলুন ৷ হ্যা আমি আপনার সেই কন্ঠ হতে চাই ৷ যেই কন্ঠ দিয়ে আপনি আবার কথা বলবেন ৷ আমি আপনার সেই নির্ভর যোগ্য মানুষ হতে চাই ৷ যার পায়ে ভর করে আপনি আবার হাটবেন ৷আমি হাজার বছর কোনো সুস্থ সবল মানুষের সাথে থাকতে চাই না ৷ আমি আমার চোখে দেখা এই অদ্ভুত সুন্দর মানুষটার সাথে কয়েক মূহূর্ত কাটাতে চাই ৷ যার কাছে আসতে পারমিশন লাগবে না ৷ বিয়ে করবেন আমাকে ?”
রাইয়ের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরে ৷ রাই নিজের মাথা একটু নাড়িয়ে ‘হ্যা’ সম্মতি জানায় ৷ আবরার একটু দূরেই দাড়িয়ে সবটা দেখছিল ৷ উপস্থিত সকলে এক অদ্ভুত সুন্দর ভালোবাসা উপভোগ করছে ৷ ডাক্তারের চোখেও পানি ৷ তার এত বছরের জীবনে এমন ভালোবাসা আজ হয়তো প্রথম দেখলেন তিনি ৷সোহরাব রাইয়ের চোখের পানি মুছে দেয় ৷ তারপর রাইয়ের হাত জড়িয়ে ধরে নিজেই কাদঁতে কাদঁতে বলে ,
“আজ থেকে আপনার কান্না করা নিষেধ ৷ যদি আপনি আবার কেদেঁছেন ৷ তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না ৷”
সকাল ঘড়িতে নয়টা ,
হাসপাতালে ভেতর এক দম্পত্তির বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে ৷কনের নাম রাই ৷ আর বরের নাম সোহরাব ৷ সোহরাব একটু দূরেই থাকা বাজার থেকে রাইয়ের জন্য বিয়ের জিনিস নিয়ে আসে ৷সোহরাব আইসিইউ এর ভেতর ঢুকে দুইটা ব্যাগ নিয়ে ৷রাই শুয়ে আছে ৷ সোহরাব একটা ব্যাগ থেকে লাল টুকটুকে একটা শাড়ী বের করে ৷ আরেকটা ব্যাগ থেকে আলতা ,কাজল আর রজনীগন্ধার মালা বের করে বলল ,
“জীবন প্রথম আর শেষ বারের মতো বিয়ে করছি ৷ আর বউকে লাল শাড়ী দেব না তা হয় নাকি ৷ আমার বউ পায়ে আলতা দেবে ৷ চোখে কাজল দেবে ৷আমি মুগ্ধ নয়নে নিজের বউকে দেখবো ৷”
সোহরাব রাইয়ের পায়ে আলতা লাগিয়ে দিতে দিতে বলল ,
“সবাই বলে আলতা নাকি ফর্সা পা ছাড়া মানায় না ৷আজ তাদের আমার বলতে ইচ্ছে করছে একটা কথা ৷ যেই আলতা আমার বউয়ের কোমল পা ছুতে পারে নি ৷ সে পূন্য হয়েও শূন্য ৷”
সোহরাব রাইয়ের দুই চোখের পাশে হালকা কাজলের দাগ টেনে দেয় ৷ তারপর লাল শাড়ীটা রাইয়ের মাথায় ধরে বলল ,
“আমার লাল টুকটুকে বউ ৷ আমার জীবন যুদ্ধের সঙ্গী ৷ আমার শেষ প্রেম ৷জানেন আপনার গালে একটা কাঁটা দাগ হয়েছে ৷ ঐ দিন নার্স বলল আপনার মুখে নাকি আর কোনো সৌন্দর্য নেই ৷ কিন্তু আমার চোখে আজ আপনাকে দুনিয়ার সব থেকে সুন্দর নারী মনে হচ্ছে ৷ মনে হচ্ছে এই দাগের জন্যই আপনার সৌন্দর্য এতদিন প্রকাশ পায় নি ৷”
নার্সরা দূর থেকে দেখতে থাকে তাদের ৷ আহা ! কত সুন্দর ভালোবাসা ৷রাই এবার কাদেঁ না ৷ শুধু তাকিয়ে থাকে সোহরাবের দিকে ৷কিন্তু তার চোখে প্রকাশ পায় হাজারো না বলা কথার ভিড় ৷
একটু পরে কাজী আসে ৷বিয়ে পড়াতে শুরু করে কাজী ৷শরিয়ত মতো সব ব্যবস্থা করা হয় ৷ কাজী সাক্ষীদের হাজির হতে বলে ৷ হাসপাতালে ডাক্তার নিজে উকিল বাবা হলো ৷হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তাররা সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হলো ৷অবশেষে সোহরাবকে কবুল বলতে বলল ৷ সোহরাব তিনবার কবুল বলে দেয় ৷ অতঃপর রাইয়ের পালা আসে ৷ কাজী রাইয়ের কাছে যেয়ে বলল ,
“মা তুমি যদি রাজী থাকো ৷ তাহলে ইশারায় তিনবার কবুল বলে দাও ৷ তুমি কবুল বললে বিয়ে সম্পন্ন হবে ৷ যেহেতু তুমি কথা বলতে পারবে না ৷ তাই ঠোঁট নাড়ালেই হবে ৷”
রাই ঠোঁট নাড়িয়ে ইশারায় কবুল বলেই দিল ৷ সাথে সাথে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো ৷
বাইরে আবরার বসে আছে ৷ রায়হান তার ঘাড়ে হাত রেখে বলল ,
“রাইয়ের সাথে সোহরাব নামের ছেলেটার বিয়ে হয়ে গেছে ৷ তুমি তবুও নিশ্চুপ হয়ে আছো আবরার ৷”
আবরার দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয় ৷ তার ভেতর থেকে অনুশোচনা যেন বেড়িয়ে আসে ৷মাথা নিচু করে আবরার বলল,
“রাই যার সাথে সুখে থাকবে ৷ তার সাথেই তার বিয়ে হয়েছে ৷আমি না হয় ব্যর্থতার গ্লানি নিয়েই বাকি জীবন পার করলাম ৷”
রায়হান চলে যায় সেখান থেকে ৷ আর আবরার সেখানেই বসে থাকে পাথরের মতো ৷
রাইয়ের আইসিইউ থেকে সবাই বের হয়ে যায় আস্তে আস্তে ৷ সোহরাব রাইয়ের পাশে বসে আছে ৷ সোহরাব রাইয়ের মাথায় হাত বুলায় ৷ তারপর হাসতে হাসতে বলল,
“আপনি একটু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান ৷ আপনাকে নিয়ে কাশফুল দেখতে যাবো ৷দুইজন মিলে হাওয়াই মিঠাই খাবো ৷তারপর ফেসবুকে ছবি দেব ৷এটা আমার অনেক দিনের শখ ৷ বউ নিয়ে কাশফুল দেখার ৷ আজ থেকে আপনার কিন্তু অনেক দায়িত্ব ৷ আমার বাড়ীতে কিন্তু আরাম করা যাবে না ৷ আমার কিন্তু প্রায় প্রতিদিন বিরিয়ানী লাগে ৷ আমি ঠিক করেছি এখন থেকে আর বাইরের বিরিয়ানী খাবো না ৷ বিয়ে করে বিবাহিত হয়ে গেছি ৷ তাহলে বাইরে কেন টাকা নষ্ট করবো ? আর শুনুন আমাকে রোজ একটু পর পর চা বানিয়ে দিতে হবে ৷ আমি আবার একটু বেশিই চা খাই ৷ তাই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান ৷ কারন আপনি ছাড়া আমার খেয়াল আর কে রাখবে ? নইলে তো আরো একটা বিয়ে করতে হবে ৷ আর আপনাদের দুই সতীনের ঝগড়া আমি কিন্তু সহ্য করবো না ৷তাই যদি না চান ঘরে সতীন আসুক ৷ তাহলে সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি চলুন ৷”
রাইয়ের সাথে কথা বলার মাঝেই সোহরাবের ফোনটা বেজে ওঠে ৷ তাকিয়ে দেখে তার বাবা কল করেছে ৷ সোহরাব রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা কল করেছে ৷ আপনাকে বিয়ে করার কথা শোনার পর তারা কি যে খুশি ৷ বারবার সবাই কল আর মেসেজ করছে ৷ আর আমি লজ্জায় রিপ্লাই করতে পারছি না ৷ আপনি একটু অপেক্ষা করুন ৷ আমি বাইরে যাবো আর আসবো ৷”
সোহরাব বাইরে চলে যায় ৷ একটু আড়ালে যেয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সোহরাবের বাবা কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে ,
“কি সব শুনছি সোহরাব ?তুমি নাকি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করেছো ৷ মেয়েটা কখনো না হাটতে পারবে না ৷ কখনো কথা বলতে পারবে না ৷চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে ৷ আর তার থেকেও বড় কথা মেয়েটার বেচেঁ থাকার কোনো নিশ্চয়তা নেই ৷ নিজের জীবনটা নিয়ে কেন খেলা করছো ?শুধু কি বিয়ে করেছো ?নিজের পাচঁ লাখ টাকার বাইক এক লাখ টাকায় বিক্রি করেছো ঐ মেয়ের জন্য ৷ গতকাল তোমার চাকরিতে জয়েন হওয়ার কথা ছিল ৷ কিন্তু তুমি সেখানেও যাও নি ৷কেন এমন করছো ?”
“বাবা জীবনতো একটাই ৷ এক জীবনে মানুষের চাওয়া পাওয়ার শেষ থাকে না ৷ একজন সুস্থ মানুষের সাথে হাজার বছর থাকার চেয়েও ৷ রাইয়ের কাছে কয়েক ঘন্টা বেচেঁ থাকা আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের ৷ আর আমি সেই সৌভাগ্যকে হাত ছাড়া করি নি ৷আমার রাই আমার সাথে থাকুকু আর না থাকুক ৷ কিন্তু মৃত্যু সময় সে যেন নিজেকে একা মনে না করে ৷ তার শারিরীক কষ্ট হয়তো লাঘব করতে পারবো না ৷ কিন্তু তার মানসিক যন্ত্রনা যেন শেষ করতে পারি ৷হাশরের মাঠে আল্লাহর কাছে তাকে নিয়ে যেন অনন্ত কালের জন্য যেন উপস্থিত হই ৷এক জীবনে কত স্বপ্নই তো পূরন হয় না ৷আমার হাসির আড়ালে কিছু স্বপ্ন না হয় চাপা পরে থাকুক ৷
(যারা সোহরাবের প্রতিটা কথা আজ মন দিয়ে অনুভব করবেন ৷ একমাত্র তারাই বুঝবেন তার ভেতরের অবস্থা ৷ আর যারা অনুভব না করেই পড়ে যাবেন ৷ তারা বুঝবেন না ৷কমেন্ট করে জানাবেন কেমন হয়েছে ৷)
চলবে
#শ্রাবন_আধারে_তুমি_২
#লেখিকা_আফরিন_ইসলাম
#সমাপ্তি_পার্ট
দুই দিন পার হয়ে গেছে ৷ সোহরাব সারাক্ষন রাইয়ের সেবা করেছ ৷ তার সাথে হাজারটা কথা বলেছে ৷ আর যখনই দেখেছে রাইয়ের চোখের কোনায় পানি জমা হয়ে ৷ ঠিক তখনই চোখের পানি মুছে দিয়েছে ৷ রাইয়ের হাতের মুঠোয় শক্ত করে হাত রেখেছে ৷ কিন্তু দিনকে দিন রাইয়ের অবস্থা খারাপ হতে লাগলো ৷ এখন আর চোখ খুলেও খুব একটা তাকায় না ৷ সোহরাব পাশে এসে কথা বললে কিছু সময়ের জন্য তাকিয়ে থাকে ৷তারপর আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে ৷ দুপুরে সোহরাবের কথা শুনতে শুনতেই রাই ঘুমিয়ে যায় ৷ আর রাত সাতটার দিকে রাইয়ের ঘুম ভাঙ্গে ৷ তবে স্বাভাবিক কারনে তার ঘুম ভাঙ্গে না ৷ পাশের চেয়ারে সোহরাবকে দেখতে পায় রাই ৷ মানুষটা ঘুমিয়ে আছে ৷ কিন্তু রাইয়ের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ৷রাই সোহরাবকে ডাকতে চায় ৷ কিন্তু ডাকতে পারে না ৷ রাই চাদর শক্ত করে ধরে ৷রাইয়ের পুরো শরীর কাপঁতে থাকে ৷হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই সোহরাবের কানে একটু গোঙ্গানোর শব্দ আসে ৷ সোহরাবের ঘুম হালকা হয়ে যায় ৷ চোখটা একটু খোলে রাইকে দেখার জন্য ৷কিন্তু পরক্ষনেই লাফিয়ে উঠলো সে ৷ রাইয়ের কাছে ছুটে যায় সে ৷ সোহরাব বুঝতে পারে না তার কি করা উচিত ৷ সোহরাব রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি আছি তো ৷ আপনার কিছু হবে না ৷ আমি কিছু হতে দেব না ৷ আপনি আবার ঠিক হয়ে যাবেন ৷ আমি ডাক্তারকে ডাকতে যাচ্ছি ৷ ডাক্তার খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে ৷”
সোহরাব রাইয়ের হাত ছেড়ে দৌড়ে বাইরে চলে যায় ৷ কারন ডাক্তারকে ডেকে আনতে হবে ৷সোহরাব বাইরে যেয়ে চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকতে থাকে ৷ আবরার আর রাইয়ের ভাই বাইরেই বসে ছিল ৷ সোহরাবের চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকার কারন তারা বুঝতে পারে না ৷ আবরার দৌড়ে আইসিইউ এর ভেতর চলে যায় ৷ ভেতরে যেয়ে দেখে রাই ছটফট করছে ৷আবরার দৌড়ে ওর কাছে যায় ৷
আবরার কাদঁতে কাদঁতে বলল,
“কি হয়েছে তোমার রাই ?তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে ?ডাক্তার চলে আসবে একটু অপেক্ষা করো ৷”
ডাক্তার দ্রুত আইসিইউতে প্রবেশ করে ৷ তারপর সবাইকে বাইরে বের করে দেয় ৷ নার্স আইসিইউ এর দরজা বন্ধ করে দেয় ৷আবরার দরজার সামনেই ঠাস করে বসে পরে ৷একটু পরেই ডাক্তার দরজা খুলে বের হয় ৷আবরার উঠে দাড়ায় ৷ তারপর ভয়ার্ত গলায় বলল ,
“ডাক্তার রাই ঠিক আছে তো ৷ সব ঠিক করে দিয়েছেন তাই না ৷”
ডাক্তার মাথা নিচু করে বলল,
“উনি আর বেচেঁ নেই মিস্টার আবরার ৷আমরা আপনাদের বলে ছিলাম ওনার মস্তিষ্কে রক্ত জমাট হয়েছে ৷ যে কোনো সময় রক্ত চলাচলে সমস্যা হতে পারে ৷ আর দীর্ঘ সময় যাবৎ রক্ত চলাচল একবার বন্ধ হয়ে গেলে রোগীর হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাবে ৷”
আবরার ডাক্তারকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় ৷ নার্স রাইয়ের অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়েছে ৷রাইয়ের চোখ দুটো বন্ধ ৷ আবরার ধীর পায়ে রাইয়ে কাছে এগিয়ে যায় ৷ আবরার রাইয়ের পায়ের কাছে বসে ৷ তারপর আস্তে আস্তে ডাক দিয়ে বলল,
“এই রাই তুমি আমার সাথে মজা করছো তাই না ৷ আমি খুব খারপ তাই না ৷ তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি ৷ আমি নিজে কি ভালো ছিলাম বলো ?আমি চাই তুমি সুখে থাকো ৷ তুমি যা বলবে আমি তাই করবো ৷ কিন্তু তুমি একবার ফিরে তাকাও ৷”
রাই জড় বস্তুর মতো শুয়ে থাকে ৷আবরার কথা গুলো রাইয়ের কানে পৌছায় না ৷আবরার হঠাৎ রাইয়ের দুই পা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেদেঁ ওঠে ৷ তারপর চিৎকার করতে করতে বলল,
“এই রাই তুই কথা বল ৷ এভাবে চলে যাস না তুই ৷ আমি পাগল হয়ে যাবো রাই ৷ তোকে ছাড়া আমি বাচঁবো না ৷ একটু বোঝার চেষ্টা কর ৷আমাকে তুই আর শাস্তি দিস না ৷ তুই ভালো হয়ে যা ৷ আমি চলে যাবো তোর জীবন থেকে ৷অনেক দূরে চলে যাবো ৷ কিন্তু তুই চোখ খোল একবার ৷তুই আর শুয়ে থাকিস না ৷ ওঠ তুই ৷”
সোহরাব কোনো কথা বলে না ৷ পাশেই দাড়িয়ে থাকে পাথরের মতো ৷কিছু সময়ের মধ্যেই কান্নার রোল পরে যায় রাইকে ঘিরে ৷
ত্রিশ বছর পর,
বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক সোহরাব হোসেন তার হাতে থাকা বইটা বন্ধ করলেন ৷ তার সামনে বসে আছে হাজারো যুবক যুবতী ৷ সাংবাদিকরা নিজেদের ক্যামেরা নিয়ে দাড়িয়ে আছে ৷ কিন্তু হাজারো মানুষের মাঝে কোনো শব্দ নেই ৷ পুরো পরিবেশ নিস্তব্ধ ৷ প্রত্যেকটা মানুষের চোখে পানি ৷ বৃদ্ধ সোহরাব সকলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
“আপনারা আমার কাছে একটা অনুরোধ করে ছিলেন ৷ শ্রাবন আধারে তুমি দ্বিতীয় খন্ড আপনারা আমার মুখ থেকে শুনতে চেয়ে ছিলেন ৷ আমি আমার তরুন পাঠকদের হতাশ করলাম না ৷ তাই আজ আপনাদের আশা পূরন করেই দিলাম ৷ সোহরাব এক বিখ্যাত কথা সাহিত্যিকের নাম ৷ পুরো দেশের এমন কোনো মানুষ নেই যে তার নাম শোনে নি ৷ লেখককে নিয়ে মানুষের মনে হাজারো প্রশ্নের ভিড় ৷ কিন্তু তিনি কারো সাথে খুব একটা কথা বলেন না ৷ তবে লেখক গত দুই দিন আগে তার ফেসবুক পেইজে পোস্ট করে বলেছেন ৷ তিনি সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের জবাব দেবেন ৷ তাই আজ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে সাংবাদিক এসেছে ৷ উৎসুক জনতার মাঝে লেখক সোহরাব বসে আছেন ৷ তাকে ঘিড়ে হাজারো মানুষ ৷লেখক একজন সাংবাদিককে প্রশ্ন করতে বললেন ,
সাংবাদিক হাসিমুখে বললেন ,
“স্যার সবাই বলে পুরুষের সফলতার পিছনে একজন নারীর অবদান থাকে ৷ আপনার সফলতার পিছনে কার অবদান আছে স্যার ?”
বৃদ্ধ সোহরাব সাংবাদিকের কথায় হাসলেন ৷ তারপর বললেন ,
“আমার সফলতার পিছনেও একজন আছে ৷ আমার একমাত্র পথ চলার সঙ্গী ৷আমার অন্ধকার জীবনের এক টুকরো আলো ৷”
“স্যার আপনার কিছু দিন আগের এই রাই চরিত্রটা সকলের মন কেড়ে ছিল ৷ এই চরিত্রটা কাল্পনিক নাকি বাস্তব? অনেকে বলে আপনি নাকি বিয়ে করে ছিলেন ৷ কিন্তু আপনার স্ত্রীর ব্যাপারে কখনো কাউকে কিছু বলেন নি ৷ অনেকের ধারনা রাই আপনার স্ত্রী ৷ আবার অনেকে বলে শ্রাবন আধারে তুমি গল্পের ২ নং খন্ড আপনার জীবনের গল্প ৷ কথা গুলো কতটা সত্য স্যার ?”
“লোকে যা বলে তা কিছু হলেও ঘটে ৷ আর হ্যা আমি বিয়ে করে ছিলাম ৷ তবে সেটা ছিল একটা লোক দেখানো অভিনয় ৷ যেটা আজ ত্রিশ বছর ধরে অজানা রয়ে গেছে ৷ আর সেই গল্পটা আমার ছোট জীবনের একটা অংশ ৷আর রাই চরিত্রটা আমার সেই অভিনয়ের একমাত্র কারন ৷ যে এখনো আমার কাছে বাস্তব ৷”
“আপনি দ্বিতীয় বিয়ে কেন করেন নি ?”
সোহরাব নিজের সাদা চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,
“মানুষ জীবনে একবার জন্ম নেয় ৷ মৃত্যুও একবার ৷ আর বিয়ের কথা বলছো ৷ আমি কখনো বিয়েই করি নি ৷ তবে একজনকে ভালোবেসে ছিলাম ৷ তাই দ্বিতীয়বার কাউকে নিয়ে ভাবার সময় হয় নি ৷ তবে রাইয়ের সাথে মাত্র দুই দিনের এক মিথ্যা ভালোবাসার সংসার ছিল আমার ৷ যেখানে স্ত্রী হিসেবে দুই দিনের জন্য এসেছিল সে ৷ সে বাচঁবে না জেনেও আমি তাকে স্ত্রী রুপে চেয়েছি ৷ তবে সেটা শুধুই অভিনয় ৷ ”
“আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার ৷ একবার বলছেন বিয়ে করেছেন ৷ আরেকবার বলছেন অভিনয় ছিল ৷ আসল ঘটনা কি স্যার ? ”
“আসল ঘটনা জানতে হলে ত্রিশ বছর আগে যেতে হবে ৷ রাইয়ের যেই দিন জ্ঞান ফিরে আসে ৷ তার কয়েক ঘন্টা আগের কথা ৷ আমি হাসপাতালের ভেতরে হাটছিলাম ৷হঠাৎ দুইজন ডাক্তারের কথা আমার কানে আসে ৷ প্রথমে গুরুত্ব দেই নি ৷ কিন্তু যখনই আমি রাইয়ের নাম তাদের মুখে শুনতে পাই ৷ তখন লুকিয়ে তাদের কথা শুনতে থাকি ৷ তারা বলছিল রাই বাচঁবে না ৷ মস্তিষ্কে যে অংশ জুড়ে রক্ত জমাট হয়েছে ৷ ঐ অংশের জন্য ওর রক্ত চলাচলে যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যাবে ৷ওর মারা যাওয়ার চান্স একশ ভাগ ৷ আমি সেই দিন আড়াল থেকে দাড়িয়ে সব শুনে ছিলাম ৷অতঃপর সিদ্ধান্ত নেই আমি তার শেষ পর্যন্ত থাকবো ৷ আমি ঐ দিন ডাক্তারদের পা জড়িয়ে ধরে ছিলাম ৷ তাদের সবটা খুলে বলি ৷ অতঃপর রাইয়ের জ্ঞান ফেরার পর প্লান মতো মিথ্যে কাজী নিয়ে আসা হয় ৷ সেখানে কাগজ পত্র সব মিথ্যা ছিল ৷ আমি শুধু চেয়ে ছিলাম রাই যেন নিজেকে একা না ভাবে ৷ আমি তার ওপারে যাওয়ার যাত্রায় কোনো আক্ষেপ রাখতে চাই নি ৷ তাই তো সেই দিন একটা ছোট নাটক করে ছিলাম সবার সামনে ৷ যেন কেউ মিথ্যা অধিকারের দোহাই দিয়ে ওর থেকে আমাকে দূরে রাখতে না পারে ৷ ”
“আপনি তো জানতেন সে বাচঁবে না ৷ তাহলে কেন এই নাটক করলেন ? শুধু কি বন্ধুত্ব নাকি ভালোবাসতেন তাকে ?”
“আমার তার প্রতি ভালোবাসা হয়ে ছিল কিনা জানি না ৷ আমি আজও এর উত্তর পাই নি ৷তবে আমি তাকে যেই সময় বিয়ে করে ছিলাম ৷ ঐ সময় আমাকে তার দরকার ছিল ৷ তার হাতটা শক্ত করে ধরার জন্য আমাকে তার দরকার ছিল ৷ “আমি আছি ” এই কথাটা বলার জন্য আমাকে তার দরকার ছিল ৷ জানেন একটা মানুষ যখন মৃত্যু পথযাত্রী হয় ৷ তখন তার প্রিয় মানুষের একটু ভরসা অনেক দরকার হয় ৷ যে তাকে সাহস দিবে ৷ কিন্তু দিন শেষে যার প্রিয় মানুষ থাকে না ৷ একমাত্র তারাই জানে জীবন কত কষ্টের ৷ শারীরিক কষ্ট আর মানসিক কষ্ট যখন এক হয়ে যায় ৷ তখন মানুষের জীবন জাহান্নামের থেকেও ভয়ংকর হয়ে ওঠে ৷ রাই তার পরিবারের থেকে বিচ্ছেদ হওয়ার পর একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে ছিল ৷ ওর কথায় বারবার তা প্রকাশ পেত ৷ ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার একমাত্র কারন তারাই ছিল ৷ অন্য দিকে রাই নিজের পরিবার আর ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে বিশ্বাস একেবারেই হারিয়ে ফেলে ছিল ৷তাই ওর জ্ঞান ফেরার পর তাদের দিকে ফিরে তাকায় নি ৷ হয়তো বুকের ভেতর গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়ে ছিল তার ৷ কিন্তু সে যখন আমার দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ৷ তখন কেন জানি না নিজেকে আটকাতে পারি নি ৷তাই তার সাথে মাত্র কয়েক দিনের এক অনিশ্চিত জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েই নেই ৷ আর সে নিজেও হয়তো বুঝতে পেরে ছিল যে তার হাতে সময় নেই ৷ তাই হয়তো একটু স্বার্থপর হয়ে ছিল ৷ নিজের পাশে হয়তো শেষ সময় কাউকে চেয়ে ছিল ৷ যে তাকে ছেড়ে যাবে না ৷ তাই হয়তো বিয়ে করতে রাজী হয়ে ছিল আমাকে ৷”
“যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আবরার আর আপনার মধ্যে কে বেশি রাইকে ভালোবাসে ৷তাহলে আপনার উত্তর কি হবে ?”
“অবশ্যই আবরার রাইকে বেশি ভালোবাসে ৷ তার ভালোবাসা আকাশ ছোয়া ৷যেটা আমার ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ ৷”
সাংবাদিক অবাক কন্ঠে বলল,
“কিন্তু কেন স্যার ?”
“রাইয়ের সাথে মিথ্যে বিয়েটা হওয়ার পর আবরার ছোট ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়ে ছিল ৷ ফারহানের মুখ থেকে শুনেই আবরারের ভালোবাসা আমি পরিমাপ করে ফেলি ৷ রাইকে সবাই প্রথমে ভুল বুঝলেও আবরার কিন্তু ভুল বোঝে নি ৷ এমন কি আবরার অনেক জায়গায় রাইকে খুজেছে ৷ অনেক বার তার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছে ৷ কিন্তু পারে নি ৷ কিন্তু রনির সাথে যখন রাইকে এক ঘরে পাওয়া যায় ৷ঠিক তখনই আবরার মন ভেঙ্গে যায় ৷ ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে দেখলে কেউ সহ্য করতে পারে না ৷ আবরার নিজেও পারে নি ৷ আবরার জায়গায় যদি রাই থাকতো ৷ তাহলে সেও ভুল বুঝতো ৷ কিন্তু প্রকৃত অর্থে তারা দুজনেই ষড়যন্ত্রের শিকার ৷তারপর থেকে আবরার হতাশায় ভুগতো ৷একটা সময় তার মা , বাবা মেয়ে দেখতে শুরু করে ৷ তারা ভেবে ছিল বিয়ে করালে হয়তো আবরার ঠিক হয়ে যাবে ৷ কিন্তু আবরার রাইকে ভুলতে পারছিল না ৷ তাই সে মেয়ে দেখতে নিষেধ করে ৷ অতঃপর সাদি আমার আর রাইয়ের ছবি আবরারকে দেখায় ৷ আবারো রাইয়ের নামে মিথ্যা বলা শুরু করে ৷ তারপর একদিন আমাকে আর রাইকে সে রাস্তায় দেখে ফেলে হাত ধরে রাখা অবস্থায় ৷ বড্ড মেরে ছিল আমাকে ঐ দিন আবরার ৷ কিন্তু রাই তাকে যখন আঘাত করে ৷ তখন কিন্তু সে নিশ্চুপ ছিল ৷ অতঃপর রাগ আর অভিমানে বিয়ের জন্য হ্যা বলেই দেয় আবরার ৷ রাই আর আবরার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায় ৷ রাই আবরারের বিয়ে মেনে নিতে না পেরে শহর ছাড়ে ৷ অতঃপর রাইয়ের সত্যি সবার সামনে আসে ৷ আবরার সেই রাতেই রাইকে খুজতে চলে যায় ৷ কিন্তু খুজে পায় না ৷অতঃপর যখন জানতে পারে রাই আর বেচেঁ নেই ৷ তখন ঐ মানুষটাই পাগলের মতো চট্টগ্রামে ছুটে যায় ৷ তারপর অন্য একটা লাশকে রাইয়ের লাশ ভেবে সহ্য করতে পারে না ৷ খিঁচুনি শুরু হয়ে যায় তার ৷ যাকে মেডিকেলের ভাষায় এপিলেপসি বলে ৷ কতটুকু ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষের লাশ দেখে এপিলেপসি হয় ৷ এটা হয়তো সবার বোঝার কথা ৷ রাই মারা যাওয়ার পর আমার তো এমন হয় নি ৷ আমাকে তো কেউ কাদঁতে দেখে নি ৷ নিজের মতো করে বেশ ভালো আছি ৷ আবরার মতো আমি ভালোবাসার পরীক্ষা দেই নি ৷ আমি তার মতো ভালোবাসার মানুষকে অন্যের বিছানায় দেখি নি ৷ কিন্তু সে এগুলো দেখেছে ৷ সবাই যে যার জায়গা থেকে ঠিক ছিল ৷ আর ভালোবাসার কথা যদি আসে ?তাহলে বলবো আমি রাইকে কখনো ভালোবাসি নি ৷ আমি শুধু তাকে শেষ যাত্রায় সঙ্গ দিয়েছি ৷ আবরার প্রতি তার এক আকাশ অভিমান ছিল ৷ রাই চাইলেই সে সময় সব ভুলে যেতে পারতো না ৷ আমি চেয়ে ছিলাম সে যেন নিজেকে একা মনে না করে ৷ তাই ক্ষনিকের মিথ্যে ভালোবাসা দিয়ে তাকে বিদায় দিয়েছি ৷এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে রাইকে কেন আমি প্রপোজ করে ছিলাম ৷ আমি তাকে প্রপোজ করি নি ঐ দিন ৷ আবরার প্রতি তার ভালোবাসা যাচাই করেছি ৷ আর রাইয়ের ভালোবাসায় এতটুকু খাদ আমি পাই নি ৷ যেই মানুষটা আমাকে রঙ্গিন করে বাচাঁর স্বপ্ন দেখিয়েছে ৷ আমি তাকে কালো অন্ধকারে হারাতে দিতে চাই নি ৷”
“আচ্ছা স্যার রাইকে যদি আবার ফিরিয়ে আনা যেত ৷ তাহলে আপনি কি করতেন ?”
সোহরাব কিছু সময় চুপ থেকে বলল,
“রাইকে যদি সামান্য কিছু সময়ের জন্য ফিরিয়ে আনতে পারতাম ৷ তাহলে আমার সবটা দিয়ে তাকে নিয়ে আসতাম ৷ তবে সেটা আমার জন্য না ৷ তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতাম আবরার জন্য ৷ কারন তার রাইকে খুব দরকার ৷”
সাংবাদিক অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,
“কেন স্যার ?”
“যেই মানুষটা আজ ত্রিশ বছর কথা বলে না ৷ যেই মানুষটা আজ ত্রিশ বছর শিকল বন্দি জীবন পার করছে ৷ যেই মানুষটা এখন আর দিনের আলো দেখে না ৷ যেই মানুষটা আজ ত্রিশ বছর যাবত পাগল রাইয়ের জন্য ৷ রাই তার কাছেই ফিরে যাবে ৷ আমার মতো ভেসে আসা একটা খড়কুটো রাইকে পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না ৷”
“তার মানে আবরার পাগল হয়ে গেছে ৷ কিন্তু কিভাবে স্যার ?”
বৃদ্ধ সোহরাব নিজের চোখের পানি মুছে বলল,
“রাই মারা যাওয়ার পর থেকেই আবরার মধ্যে অস্বাভাবিক আচরন লক্ষ্য করে সবাই ৷ আস্তে আস্তে আবরার কথা বলা বন্ধ করে দেয় ৷ নিজেকে ঘরে আটকে রাখতে শুরু করে ৷ মানসিক ডাক্তার দেখিয়েও লাভ হয় নি ৷ অতঃপর নিজের স্বাভাবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ৷”
“আর সেই কুকুরটার কি হলো ? যাকে রাই এত ভালোবাসতো ৷”
“আপনার সব থেকে প্রিয় জিনিস টা কারো না কারো কাছে তুচ্ছ ৷ আপনি যেটা নিজের জীবনের থেকেও বেশি আগলে রাখেন ৷ অন্য কেউ সেটা ছুড়ে ফেলে ডাস্টবিনে ৷ ঐ দিন এক্সিডেন্টে কুকুরটা থেতলে গেছে ৷ তবুও রাই তাকে নিজের সাথে আগলে ধরে ছিল ৷ আর অন্য লোকেরা কুকুরটাকে ছুড়ে ফেলে ছিল রাস্তায় ৷ও একটা কুকুর ছিল ৷ তাই রর দেহটাও তেমন মূল্য ছিল সবার কাছে ৷”
সাংবাদিক আবারো বললেন,
“আপনি কি সত্যি তাকে ভালোবাসেন নি ৷”
“দেখুন কাউকে ভালোবাসার আগে যাচাই করা উচিত ৷ আপনি কারো প্রিয়জন নাকি প্রয়োজন ৷ আমি যাকে ভালোবাসতাম সে কখনো আমাকে প্রিয়জন ভাবে নি ৷ কিন্তু সে আমার প্রিয়জন ছিল ৷ অপর দিকে রাই আমার প্রিয়জন আর প্রয়োজন দুটোই ছিল ৷ আমি জানি না প্রিয়জনের ব্যাখ্যা কি করে দিতে হয় ৷ শুধু এতটুকু জানি আমি আজও ঐ হাইওয়ের উপর দাড়িয়ে থাকি ৷ আমি আজও বাসস্টপের সামনে দাড়িয়ে থাকি ৷ আমি আজও রজনীগন্ধ্যার মালা কিনি ৷ কিন্তু তাকে দেওয়া হয় না ৷ আমি আজও মোনাজাতে তার জন্য কাদিঁ ৷ শুধু সে জানে না ৷আমি জানি না সে আমাকে প্রিয়জন ভেবেছে কি না ৷কিন্তু যখন আমাকে তার দরকার ছিল ৷ আমি তখন নিজের সবটা দিয়ে তার সাথে থেকেছি ৷ তবুও তাকে আমি ভালোবাসতে পারি নি আবরার মতো ৷ আমি আবরার মতো বুক পকেটে ভালোবাসার মানুষটাকে যত্নে রাখতে পারি নি ৷ আমি তার জন্য ভারসাম্য হারাই নি ৷আমি শুধু প্রয়োজন হয়ে পাশে থেকেছি ৷ অপর দিকে সময়ের সাথে আজ আমি আমার প্রথম প্রেমকে মনে করতে চাই না ৷ কারন সে বিশ্বাসঘাতক ছিল ৷আমি আফসোস করি না তাকে নিয়ে ৷ উল্টো তার কথা মনে পড়লে হাসি ৷কারন আমি বিশ্বাসঘাতক হারিয়েছি ৷ আর রাইয়ের কথা মনে পড়লে আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই ৷ কারন আমি একজন বন্ধু হারিয়েছি ৷”
বৃদ্ধ সোহরাব সকলের দিকে চেয়ে বললেন,
“জীবনে যদি কাউকে ভালোবাসো
তাহলে তোমার ধ্বংস নিশ্চিত ৷
অতিরিক্ত ভালোবাসা মানুষকে
পাগল করে দেয় ৷
কেউ প্রিয়জনকে ভালোবাসতে বাসতে পাগল হয় ৷
কেউ তার বিরহে পাগল হয় ৷
তাই অতিরিক্ত ভালোবেসো না ৷”
রাত ঘড়িতে বারোটা ৷ একটা হাইওয়ের উপর দাড়িয়ে আছে বৃদ্ধ সোহরাব ৷তার হাতে একটা সাদা গোলাপ ৷ তার দৃষ্টি অদূরে ৷ একটা দমকা হাওয়া সোহরাবের গায়ে এসে লাগতেই সে বলল,
“আজ আপনার ত্রিশতম মৃত্যু বার্ষিকী রাই ৷ আজকের দিনে আপনি চলে গিয়ে ছিলেন ৷ কিন্তু আমাকে বেচেঁ থাকার এর নির্মম অধ্যায় শিখিয়ে গেছেন ৷ আজকেও আমি আপনার জন্য সাদা গোলাপ এনেছি ৷ খুব ইচ্ছে হয় আপনাকে দেখার ৷ মাঝে মাঝে এখানে এসে আমি বসে থাকি ৷ কেন যেন মনে হয় একটা কুকুরের সাথে আপনি আবার আসবেন ৷ কিন্তু আমি নিরাশ হই ৷কোনো এক নির্জন নিশিতে আবার ফিরে আসুন রাই ৷ আপনার পরলোক গমন কাউকে সুখ দেয় নি ৷ আপনার বাবা মারা গেছেন ৷ আপনার মৃত্যুর ঠিক সাত দিন পর ৷ আপনার আবরার ভালো নেই ৷ আমি ভালো নেই ৷ ষড়যন্ত্রকারী শাস্তি পেয়েছে ৷ কিন্তু আপনি চলে গেছেন ৷ কোনো এক শ্রাবনে আবার ফিরে আসুন রাই ৷”
অন্ধকার রাতে খান বাড়ীর একটা ঘর থেকে শিকলের ঝনঝন শব্দ শোনা যাচ্ছে ৷আলোহীন ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাড়ালো এক বৃদ্ধ ৷ তার মাথায় জট হয়ে যাওয়া চুল ৷লম্বা দাড়ি আর গোঁফে ঠোঁট , থুতনি সব ঢেকে গেছে ৷ শরীরে বেশ ময়লা ৷ গায়ে ময়লা জামা ৷ রুপালী চাঁদের আলোয় লোকটার চোখ চকচক করে উঠলো ৷ লোকটা আর কেউ নয় ৷ লোকটা আবরার ৷ ত্রিশ বছরের ব্যবধানে আজ সে যুবক থেকে বৃদ্ধ ৷ আজ সে শিকলে বন্দি এক বদ্ধ পাগল ৷ যার কোনো জ্ঞান নেই ৷আবরার তার ছেড়া শার্টের পকেট থেকে একটা পুরনো ছবি বের করলো ৷ ছবিটা অনেক জায়গায় ছিড়ে গেছে ৷ আজ থেকে অনেক বছর আগে এক শ্যাম কন্যার ডায়েরী থেকে ছবিটা চুরি করে ছিল সে ৷শ্যাম কন্যা আজ নেই ৷ তবে তার ছিড়ে যাওয়া ছবিটা এখনো আবরার বুক পকেটে ৷ আবরার প্রায় মুছে যাওয়া ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে ৷ তার চোখ থেকে বিরামহীন অশ্রুকনা ঝড়তে থাকে ৷ মুখ থেকে বলতে চায় হাজারো না বলা কথা ৷ কিন্তু অন্তরের গভীরে চাপা পরে যায় কথা গুলো ৷ বৃদ্ধ আবরার শ্রাবনের এক অন্ধকার দিনে তার জীবনে আসা শ্যাম কন্যার ছবিটা বুকে চেঁপে ধরে ৷ বুকটা কেঁপে উঠতে থাকে তার ৷ বৃদ্ধ আবরার বারান্দার মেঝেতেই শুয়ে পরে ছবিটা বুকে নিয়ে ৷তার পর তাকিয়ে থাকে দূর আকাশের থাকা চাদেঁর দিকে ৷
জীবনে সবার কিছু পাওয়া আর না পাওয়ার গল্প থাকে ৷
আমরা সবাই সেই গল্প গুলো প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখি না ৷
আমরা দিনশেষে ভুলে যাই নিজের আপন সত্তাকে ৷
যারা ভালোবাসে তারা দিনশেষে হয় দেবদাস ৷
তারা দিনশেষে হয়ে যায় বদ্ধ পাগল ৷
তারা দিনশেষে হয়ে যায় জীবন্ত লাশ ৷
তবুও ভালোবাসাকে ভালোবাসি ৷
সমাপ্ত