#ষড়রিপু (অন্তিম পর্ব)
#কঠোরভাবে_প্রাপ্তবয়স্কদের_জন্য
মিয়ার কলটা ডিসকানেক্ট করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রিক্ত। উত্তেজনার আবেশে ঘেমো গা টা এখনও তিরতির করে কাঁপছে ওর। বড় বড় শ্বাস ফেলার সাথে সাথে অ্যাড্রিনালিন বয়ে চলেছে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
মুঠোফোনটা টেবিলে রেখে একটা লম্বা শ্বাস নিল রিক্ত। তারপর বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল সদর দরজার দিকে। ভারী পাল্লাটা একটানে খুলে বাইরের দিকে তাকাতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো ওর। মাসকয়েক আগের স্মৃতি তাজা হয়ে ফিরে এল মানসপটে। এলোচুলে গ্রে কালারের সেই হুডি গায়ে চাপিয়ে মিয়া ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে দীঘির দিকে। লম্বা খোলা চুল প্রবল হাওয়ায় উড়ছে। মাতাল করা সেই হাওয়ায় মিয়ার ভরাট শরীরটা থেকে অদ্ভুত সুগন্ধ ভেসে আসছে।
সুতীব্র মেয়েলী গন্ধে পরিপূর্ণ সেই সুবাসে রিক্তর কামরিপু জেগে উঠলো। অবাধ্য কামরিপুর তাড়নায় রিক্ত ভুলে গেল ওর শিয়রে গ্রেফতারের আদেশনামা ঝুলছে। প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া মানুষটি ভুলে গেল স্বরচিত সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বসেছে…ভুলে গেলো তীরে এসে তরী ডুবতে বসেছে।
“মিয়া..” আবেগমথিত কণ্ঠস্বরে রিক্ত ডেকে উঠলো নিজের প্রাক্তন প্রেমিকাকে। ওর কন্ঠস্বর শুনে খানিকটা যেন চমকে উঠল মিয়া। তারপর ধীরে ধীরে মুখ ফেরানো রিক্তর দিকে।
কিন্তু একি!
সহজাত সেই সৌন্দর্য কই! মিয়ার মুখটা দেখে ঘৃণার আবেশে ছেয়ে গেল রিক্তর চোখ, ওর পাপ চোখ…
ফর্সা লাবণ্যমন্ডিত সেই তরুণীর দৈহিক সৌন্দর্যের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই আজ! কপাল, ঘাড় ঢেকে গিয়েছে অগুন্তি র্যাশের সাম্রাজ্যে। লালরঙা ঈষৎ স্ফীত সেই আবের দিকে তাকিয়ে গাটা কেমন গুলিয়ে উঠলো রিক্তর। পূর্বের কামভাব ধুয়ে-মুছে গেল এক লহমায়, তা বলাই বাহুল্য…
“ছি!” নিজের অজান্তেই মুখ চিরে ঘৃণার অভিব্যক্তি বেরিয়ে এলে রিক্তর।
“কেমন আছো রিক্ত?” র্যাশ ভর্তি সেই মুখে এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো মিয়া। কিন্তু সেই হাসিতে সজীব প্রাণোচ্ছলতার চিহ্ন বিন্দুমাত্র নেই, বরং খানিকটা রহস্যময়ই বলা চলে।
রিক্তর অবজ্ঞাসূচক ধ্বনি ওর কান অব্দি পৌঁছালেও ভাষাজনিত সীমাবদ্ধতার কারণে মিয়া বুঝে উঠতে পারেনি।
“ভালো নেই আমি” মিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচমকা ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল রিক্ত। এই মেয়েটাকে দেখে তার বিন্দুমাত্র কামভাব না জাগলেও ওকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা কিছুতেই।
ডুবন্ত মানুষের কাছে একটুকরো খড়কুটো ঠিক যতটা দামী হয়ে ওঠে, রিক্তর কাছে মিয়ার অস্তিত্ব ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ এখন। “অতীতের স্মৃতি মুছে জীবনটা নতুনভাবে শুরু করতে চাইলে মিয়াকে আমার জীবনে ফিরিয়ে আনতেই হবে…”এই ভেবে মিয়ার হাতটা ধরে রিক্ত চলে এলো বেডরুমের মধ্যে।
তরুণী মেক্সিকান মেয়েটি আজ বড়ই চুপচাপ। কিন্তু অতলস্পর্শী চোখদুটো ঠিক তার উল্টো। চঞ্চল, অশান্ত। সেদিকে তাকিয়ে গলাখাকারি দিয়ে বলে উঠলো রিক্ত,”তুমি কি কিছু খুঁজছো?”
“বিয়ার হবে?” দুগ্ধফেননিভ শয্যায় ধপ করে বসে বলে উঠলো মিয়া। তারপর প্রাক্তন প্রেমিকের চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,”তুমি আমাকে খুঁজছিলে কেন?”
নোংরা সস্তা জামাকাপড় পরে মিয়া হঠাৎ বিছানায় বসে পড়তে রিক্ত প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠলেও মিয়ার চাহনিতে এমন কিছু ছিল, যা রিক্তর অন্তরাত্মাটাকে নাড়িয়ে দিলো।
“সেরকম কিছু না, মনে পড়ছিলো তোমার কথা।”
আমতা আমতা করে মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো রিক্ত।
“মিথ্যে কথা কেন বলছ?” সেই একইরকম নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলে উঠলো মিয়া। “তোমার আমাকে প্রয়োজন জানি এবং এটাও জানি বিয়ার না আনলে তোমার কোনো কথা শুনতে রাজি নই!”
“এক্ষুনি আনছি…”মিয়ার কথা শুনে তড়িঘড়ি উঠে গেলো রিক্ত। ফিরে আসলো দুটো গ্লাস আর একটা বিয়ারের বোতল নিয়ে।
“একি! নিট খাবো নাকি?” দুটো গ্লাসে রঙিন তরল ঢালতে ঢালতে বলে উঠলো মিয়া।”যাও শিগগির বরফ নিয়ে এসো!”
মিয়ার কথা শুনে বাধ্য ছেলের মত রিক্ত ফের চলে গেলো ঘরের ভিতর।
“এবার বলো কি বলেছিলে?” ঠাণ্ডা রঙিন তরলটা গলায় ঢেলে বলে উঠলো মিয়া। “বাই দ্যা ওয়ে বাংলোর ডেকোরেশনটা কিন্তু দুর্ধর্ষ! আইডিয়া নিশ্চয়ই তোমার স্ত্রীয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত?”
“হ্যাঁ,” হালকা হেসে রিক্ত বলে উঠলেও কথাটা সুতীক্ষ্ণ তীরের মত আঘাত করলো ওর মস্তিষ্কে। অর্থ সম্পদের লোভে বিশ্বস্ত প্রেমিকাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করার খোঁচাটা এমনভাবে দিয়ে বসবে মিয়া, সেটা ভাবতেই পারেনি রিক্ত। অহংবোধে নাড়া লাগলেও স্বভাবগুনে নিজেকে সামলে নিল রিক্ত। তারপর নিপুন অভিনেতার মতো চোখটা মেঝেতে আবদ্ধ রেখে বলে উঠলো, “তুমি কি আমাকে কোনদিন ক্ষমা করবে মিয়া? তোমার সাথে প্রতারণা করেছি আমি, একটা বার আমাকে সুযোগ দিও প্লিজ!” পায়ে পায়ে মিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠল রিক্ত,”ডরোথিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা মস্ত বড় ভুল হয়ে গিয়েছে আমার, কে জানতো এলার্জিক রাইনাইটিসে ভোগা একজন অসুস্থ মেয়ে! রোগে ভোগে শেষ পর্যন্ত মরেই গেলো! আর পুলিশকে আমার পিছনে লেলিয়ে দিয়ে চলে গেলো!”
“তোমার কথা আমি বুঝতে পারলাম না রিক্ত।” রঙিন তরলে একটা সিপ দিয়ে বলে উঠল মিয়া।
“মানে আর কি! পুলিশ সাসপেক্ট লিস্টে আমার নাম সবার প্রথমে রেখেছে… সামান্য একটা দুর্ঘটনাকে খুন বলে চালাতে চাইছে! আমি তো জানতামই না ডরোথির এলার্জিক রাইনাইটিস ছিল!” সুদক্ষ অভিনেতা মতো একের পর এক মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে রিক্ত। তারপর মিয়ার নরম হাতটা নিজের মুঠোবন্দী করে বলে উঠলো,”আর আমাকে এইভাবে হ্যারাসমেন্ট কে করেছে সেটা জানতে চাইবে না?”
“কে?” রিক্তর হাতে ড্রিংকসের গ্লাসটা গুঁজে দিয়ে বলে উঠল মিয়া।
“তোমার দাদা…”কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট অসহায়ত্বের চিহ্ন বহন করছে, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল রিক্ত,”কাল আমার গ্রেফতারির আদেশনামা নিয়ে আসছে সদলবলে।”
“কালই?”মিয়ার কণ্ঠস্বরের নিস্পৃহতা যেন ফুরোতে চাইছে না। একইরকম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিজের হাতটা রিক্তর পাঞ্জা থেকে ছাড়িয়ে বলে উঠলো মিয়া,”তুমি কি চাইছো? অফিসারের বোন হবার সুযোগ পূর্ণমাত্রায় নিয়ে এই বিপদ থেকে তোমাকে আমি রেসকিউ করি, তাই তো?”
“আমি নির্দোষ মিয়া! স্রেফ মিছিমিছি ফাঁসানো হচ্ছে আমাকে… প্লিজ সেভ মি!” কণ্ঠস্বরে আর্তি ফুটিয়ে রিক্ত এবার বসে পড়লো মিয়ার পায়ের কাছে,”বিনিময়ে তুমি যা চাইবে তাই পাবে। তুমি চাইলে তোমাকে বিয়ে করে আমি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি!”
“পাপ?”নিজের গ্লাসটা সম্পূর্ণ শেষ করে বলে উঠল মিয়া। ওর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে অবজ্ঞাসূচক হাসির ভগ্নাংশ।
“প্রেগনেন্ট অবস্থায় তোমাকে ফেলে পালানোর চেষ্টা পাপ ছাড়া আর কিই বা বলা যায় মিয়া?” রিক্তর মনে তখন সাইকোলজিকাল ইথিকসের সুতীব্র দোলাচল চলছে।
মেয়েটা বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে আমার ধরা পড়ার চান্স একটু হলেও কমবে। তারপর সময় বুঝে ব্যাংক খালি করে দেশ ছেড়ে পালানো সময়ের অপেক্ষা… এমনটা ভেবে রিক্ত বলে উঠল ফের,”মানছি তোমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করাটা…”
“জাস্ট লিভ ইট!” রিক্তর খালি গ্লাসটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলে উঠলো মিয়া। “আমি জানি তুমি কোনদিনও আমাকে বিয়ে করবেনা, নেহাৎ…”
কঠোর বাস্তবটা বলে দুই মুহূর্ত চুপ করে রইল মিয়া, তারপর রিক্তর চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো, “তোমাকে একটা গল্প বলি কেমন? সময়ও কেটে যাবে, আর মনটাও ভালো হয়ে যাবে তোমার…” নাকটা খানিক টেনে বলে উঠলাম মিয়া।
“এখন আবার কি গল্প!” চোরাবিরক্তিটা মন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেও চুপ করে গেল রিক্ত।
বড়শি ছেঁড়া মাছকে ফের টোপে হলে অসীম ধৈর্য্য ধরতে হয় বৈকি। অধিকন্তু তার গলায় যদি বেদনার ক্ষত কাঁটার মতো বিঁধে থাকে, তবে ধৈর্য ধরার পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তারও প্রয়োজন, সাথে থাকতে হবে হিউম্যান সাইকোলজি বিষয়ক অগাধজ্ঞানের ভান্ডার। তাই পরিস্থিতি বিবেচনা করে চুপচাপই থাকার সিদ্ধান্ত নিল রিক্ত। তারপর কৃত্রিম হাসিমুখটা মেলে ধরল মিয়ার সামনে।
“এই ঘটনা তিনজনের জীবনকে কেন্দ্র করে। এখন সম্পর্কটা ত্রিভুজ, নাকি এলোমেলো ভাবে সাজানো তিনটে সরলরেখা… সেটা বিচার করার দায়িত্ব সম্পূর্ণ তোমার।” গলাখাঁকরি দিয়ে বলে উঠলো মিয়া।”এদের মধ্যে একজন রংতুলিকে সঙ্গী করে বাঁচতে চাইতো জীবনভর। চাহিদা খুব বেশী ছিল না, মাথার ওপর একটা ছাদ আর পেট ভরা খাবার… দিনশেষে বাড়ি ফিরে কারো বুকে মাথা রেখে গল্প করার ইচ্ছা থাকলেও পুষে রেখেছিল নিজের মনের মধ্যে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর মানুষ বড় প্র্যাকটিক্যাল হয়ে যায়, জানো? পকেটে পয়সা না থাকলে দুনিয়ার মুখোশটা খুলে যায় মুহূর্তের মধ্যেই। তাই পরিবারের আপত্তি অগ্রাহ্য করে মেয়েটা যখন অন্য শহরে পাড়ি জমায়, তখনও মনের মধ্যে পুষে রেখেছিল নিজের স্বাবলম্বনের সত্তাকে। প্রথাগতভাবে শিক্ষিত না হলেও কর্মদক্ষতার সুবাদে বেশ কয়েক দিনের মধ্যেই এই শহরে মাথা গোঁজার আস্তানা খুঁজে পায়।”
“তারপর?” কথার মাঝেই বলে উঠলো রিক্ত।
“তারপর আর কি, ভিনদেশী এক যুবকের সাথে ভালোবাসার প্রথম আস্বাদ পায় সে, আবেগের চরম সীমায় ভেসে যেতে যেতেই কবে যে ছোট্ট একটা প্রাণের সঞ্চার ঘটে গিয়েছিল… তা বুঝতেও পারেনি। আসলে শিল্পীরা বোধহয় এত হিসেব-নিকেশ করে পা ফেলতে পারেনা। বড্ড অগোছালো খামখেয়ালি হয় তাদের জীবনটা, তাই না রিক্ত?” প্রাক্তন প্রেমিকের চোখে চোখ রাখলো মিয়া, ছাই চাপা আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠেছে সেই দৃষ্টিতে। যেন পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চাইছে রিক্তর অন্তরাত্মাকে। সেই চাহনির সামনে নিজেকে আর মেলে রাখতে পারলোনা রিক্ত। কুকড়ে সরে গেল মেঝের এক কোনাতে।
ওর মনের মধ্যে দুর্ভাবনার স্রোত বয়ে চলেছে দুর্দমনীয় বানের মতো।
“তবে কি মিয়াই এই জীবন উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে?” আপনমনে বলে উঠল রিক্ত।
“সময়টা ভালই যাচ্ছিল মেয়েটার। টুকটাক কাঁচা পয়সা আসার পাশাপাশি নামও হচ্ছিলো বেশ, সাথে মাতৃত্বের আস্বাদনে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল ওর মনটা। এরমধ্যেই ইন্ডিয়ান মাইথোলজি বিষয়ে আগ্রহ বেড়ে যায় ওর। বিভিন্ন লাইব্রেরীতে, ওয়েবসাইটে ঘুরতে ঘুরতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয় নিজের অজান্তেই। নিজের প্রেমিকের প্রতি শ্রদ্ধাও বেড়ে যায়, কারণ সে যে একজন ভারতীয়…” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মিয়ার মুখ বুক চিরে। নিস্পৃহ দৃষ্টিটা এবার বাইরের দিঘির জলে নিবদ্ধ করে ফের বলে ওঠে,”ভেবেছিলো ভিনদেশী এই ভারতীয়কে নিজের জীবনসঙ্গী বানিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করবে. যেখানে দুইজনের মিলিত প্রচেষ্টায় সাফল্য অর্জিত হবে… আগত সন্তানকেও ভারতীয় সংস্কৃতির চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ করে সংসার পাতবে। কিন্তু মানুষ যেটা ভাবে ঠিক তার উল্টো, মেয়েটার অজান্তেই তার প্রেমিক কখন মধ্যবয়সী রমণীর সাথে বিবাহ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে, বুঝতেই পারেনি! কি অদ্ভুত তাই না?”
“ওহ্, স্টপ মিয়া, প্লিজ।” নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা রিক্ত। হাতদুটো নিজের কানে চেপে দিয়ে মুখটা গুঁজে দিলো হাঁটুর মাঝে। কাঁপতে থাকা আঙুলগুলো ওর মানসিক পরিস্থিতির সদর্থক প্রমাণচিহ্ন বহন করছে। সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ফিরে এলো মিয়ার। মুখে বলে উঠল,”বাস্তব ঘটনা শুনে কানে আঙ্গুল দেওয়ার কোন মানে আছে কি? এমন তো নয় মনগড়া কাহিনী বলে চলেছি তোমাকে!”
বলে রিক্তর বাধাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে গলা খাকারি দিয়া উঠলো মিয়া,”প্রেমিকের হাবভাব সুবিধের না লাগায় মেয়েটা পিছু নিতেও দুবার ভাবেনি। তাই পিছুপিছু চলে আসে এক রাজপ্রাসাদের আঙিনায়। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য নারীর বাহুবন্ধনে দেখে পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল তার। খুব সস্তা মনে হয়েছিল নিজেকে… আগত সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মনটা ভেঙে গেলেও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেছিল আপ্রাণ। মন ভাঙলে কোনও শব্দ হয় না, তাই না রিক্ত?” নিস্পৃহ ভঙ্গিতে ফের বলে উঠলো মিয়া।”কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য বাচ্চাটাকে রাখতে পারলনা! প্রেমিকের সাথে বোঝাপড়ার চেষ্টাটাও চোরাবালিতে ডুবতে বসেছিল এর ফলে। পরে সংবাদপত্রে দেখলো তার স্ত্রীর রহস্যময় মৃত্যুর খবর, এটাও জানতে পারলো মেয়েটা মানুষ কতটা স্বার্থপর, নিচ হতে পারে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে নিজের স্ত্রীকেই মেরে ফেললে রিক্ত? ছি!” ঘৃণা উগরে বেরিয়ে আসতে চাইল মিয়ার কণ্ঠস্বর থেকে…
“প্রতিহিংসা? কিসব বলছো তুমি! তোমার দাদা আমাকে ফাঁসাতে চাইছে।” বিষাক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো রিক্ত,”অনেকক্ষণ ধরে তোমার এই ড্রামা সহ্য করছি আমি! এক্ষুনি বেরিয়ে যাও তুমি আমার বাড়ি থেকে।”
“মোটিভ?” রিক্তর হুংকার সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে গেলো মিয়া,”আমার দাদা স্রেফ এভিডেন্স কালেক্টর। তোমাকে ফাঁসাতে চাইবে কোন মোটিভে?” বলে মুঠোফোনে রিক্তর ইন্ডিয়ার কেস ডিটেইল খুঁজতে শুরু করলো মিয়া। “এবার বলো সার্চ ইঞ্জিনও তোমার ব্যাপারে রং ইনফো দিচ্ছে?”
হালকা হেসে বলে উঠলো মিয়া।”কিন্তু তুমি জেনে রেখো আমার দাদার মতো হাজারটা ইন্টেলিজেন্স অফিসার এলেও কিচ্ছু ক্ষতি করতে পারবেনা তোমার। কেস ফাইল তো দূর! সম্পূর্ণ এভিডেন্স নষ্ট করে দেওয়া হবে।”
“মানে?” রিক্তর মুখে আশার ক্ষীণ রেখা জেগে উঠেছে ততক্ষনে।
“একজন অপরাধীকে বাঁচানোর জন্য সমাজের একস্তরের মানুষ যে সর্বক্ষণ রেডি থাকে, বিনিময়ে সামান্য কিছু পয়সা চাইবে আর কিছুই না।” ঠোঁটের রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে ফের বলে ওঠে মিয়া।”ঠিক যেমন ইন্ডিয়াতে তুমি কিছু মানুষের মদতে পালাতে পেরেছিলে দেশ ছেড়ে, তেমন মানুষ যে এদেশেও ভুরি ভুরি আছে রিক্ত।”
“তাহলে তোমার গন্তব্যে এখন কোন দেশে? শীতল কেজো কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো মিয়া,”ইন্ডিয়াতে তো ফিরতে পারবেনা! মেক্সিকোতে থাকলেও বিস্তর হ্যাপা, দুই তিন মাসের নামকাওয়াস্তে জেল খেটে নিশ্চিন্ত জীবনযাপন। আসলে একশ্রেণীর মদত সর্বক্ষণ থাকবেই, যার জোরে তোমাদের মত হাইপ্রোফাইল অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে প্রত্যেকবার। কিন্তু তুমি মোটেই তাদের মতো নও।” হাসতে হাসতে বলে উঠলো মিয়া।
“মানে কি বলতে চাইছো তুমি!” জ্যা মুক্ত তীরের মত একঝটকায় উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেও সফল হলনা রিক্ত। গোড়ালি সন্নিহিত সুদৃঢ় পেশি বেঁকে গিয়েছে ততক্ষনে। অজানা কোনো কারণে অসহ্য যন্ত্রণায় মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে রিক্তর।
“মানে তুমি গড়পড়তা হাইপ্রোফাইল অপরাধীর মতো নও। বরং তাদের থেকে কয়েকধাপ উপরে। মারণরোগের জীবাণু নিয়ে বয়ে চলা জীবন্ত বায়ো ওয়েপন! যার জীবনটা নিজের বিবেক বুদ্ধির হাতে নেই, প্রতিটা পদক্ষেপ নির্ধারণ করে মনে পুষে রাখা ছয়টা রিপু, ষড়রিপু!”
“জাস্ট গেট লস্ট ফ্রম মাই হাউস, রাইট নাউ! আমি ভেবেছিলাম আমাকে বিপদে দেখে তুমি ছুটে এসেছো।” হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোক্রমে বলে উঠলো রিক্ত। উত্তেজনায় গোটা শরীরটা ঘেমে গিয়েছে ওর, নাকের পাটা ফুটে উঠেছে লালচে বিন্দু। মুখের চোয়াল সঞ্চালনের ক্ষমতাও লোপ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।
“তোমার বিপদে আমি ছুটে আসবো?যার কারণে অগণিত মানুষের জীবন নষ্ট হতে বসেছে, হাজার কাকুতি-মিনতিতেও যার হৃদয় পাথর গলে না! সে আজ অন্য কারোর কাছে সাহায্য চাইছে?” শীতল কণ্ঠস্বরে ফের বলে উঠলো মিয়া,”গিরগিটিও তোমাকে দেখে লজ্জা পাবে রিক্ত…ভাবতেই অবাক লাগে অনুসুয়া দেবীর মত মায়ের গর্ভ থেকে তোমার মতো জন্ম হয়েছে। ছি!”
“মায়ের কথা জানলো কীকরে!” হতবাক হয়ে আপন মনেই বলে উঠলো রিক্ত। কারণ সময় গড়ানোর সাথে সাথে বাকশক্তিও কমে আসছে ওর।
ওর মনের কথাটা ফুটে উঠেছে দৃষ্টিপটে। সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠলো মিয়া,”শুধু মায়ের কথাই নয়, এটাও জানি নিজের অপরাধ লোকানোর জন্য নিজের মাকেও ছাড়োনি তুমি! ভুলে যেও না আমার দাদা তোমার প্রিভিয়াস ইনভেস্টিগেশন হ্যান্ডেল করছে, তাই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে বিশেষ অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।”
“মানে?” প্রবল ইচ্ছেশক্তির জোরে কথাটুকু কোনমতে বলে উঠলো রিক্ত।
“এমনই যন্ত্রণা দিয়ে তুমি মেরে ফেলেছিলে মালবিকাকে। ওদেশে মামলা চলাকালীনও প্রতিশোধস্পৃহা বিন্দুমাত্র কমেনি তোমার। নিজের মায়ের পানীয়তেও চুপিসারে বিষ মিশিয়েছিলে এভিডেন্স সাক্ষ্যপ্রমাণ মেটানোর জন্য। এমনই কুসন্তান তুমি যে নিজের ষড়রিপু চরিতার্থ করতে বিন্দুমাত্র বিবেক বাঁধলনা তোমার। ছি!” কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট ঘৃণা গলন্ত লাভার মত বেরিয়ে আসছে এবার।”ভাগ্যিস তোমার মা সেদিন চা টা খাননি। কিন্তু রিপোর্টে সব কিছু এসে গিয়েছিল। এভিডেন্স নষ্ট করা কি অতই সহজ রিক্ত?” বলে মুঠোফোনটা ফের মেলে ধরলো রিক্তর সামনে।
“ব্লাডি স্লাট!” অশ্রাব্য গালিগালাজটা বেরিয়ে আসতে চাইলেও বাক্যস্ফূর্তি হলোনা, তীব্র বিষক্রিয়ায় রিক্তর চোখে জল চলে এসেছে ততক্ষনে। মুখটা এক দিকে বেঁকে গেছে… শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
“প্রতারিত হওয়ার বেদনা তো ছিলই, সাথে জ্বর সর্দি কাশি লেগে থাকায় জানতে পারি এইডস রোগের শিকার আমি। তোমাকে একটু একটু করে চিনে নেওয়ার পালা শুরু হয় তখন।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে মিয়া,”ভেবেছিলাম নিজের বাচ্চাকে কিছুতেই এই রোগের শিকার হতে দেবনা, কিন্তু বড্ড দেরী হয়ে গেছিল রিক্ত। অ্যান্টিভাইরাল থেরাপি দেওয়ার সামর্থ্য ছিলনা, বাচ্চাটা এইডস পজেটিভ হয়ে গেলো। বাঁচাতে পারলাম না আমি।” সবটুকু বলে নিজেকে আর আটকাতে পারলনা মিয়া। দুই হাতের ফাঁকে মুখটা গুঁজে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো সে।”চোখের সামনে আমার রক্ত মাংসে গড়ে ওঠা প্রাণটাকে ছেঁচে তুলে নিয়ে গেল, ওহ।
না জানি কতজনকে তুমি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে এই মারণ রোগের বাহক বানিয়েছো রিক্ত। ধিক্কার তোমাকে!”
এইডস এর প্রভাবে র্যাশে ভরে যাওয়া মিয়ার লালচে মুখটা দেখতে দেখতে দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে রিক্তর। জবাব দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালালেও জিভটা অবশ হয়ে গিয়েছে পুরোপুরি।
মিয়ার প্রতিটা শব্দবাক্য নিখুঁত লক্ষ্যভেদে ওর আত্মবিশ্বাসের বুদবুদগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে লাগল এবার। অবশ, কালচে হয়ে যাওয়া ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল মিয়া,”সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম নিজের কাছে, আমার যা সর্বনাশ হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে, কিন্তু তোমার কোনো পরিকল্পনা সফল হতে দেবনা!
টাকা দিলে তুমি সহজেই পার পেয়ে যেতে, দাদার মতো হাজারখানেক ইন্টেলিজেন্স অফিসার এলেও তোমাকে ফাঁসির দড়ি পরাতে পারতোনা। নিজের দেশেরই কিছু ক্ষমতাবান সুবিধাবাদ শ্রেণি এগিয়ে আসতো তোমার সাহায্যে। যেমন মারিয়া ফ্যামিলির কারবার বাড়তে সাহায্য করেছে তারা সৃষ্টিলগ্ন থেকে…ডেভিডের মত ঘরশত্রু বিভীষণ জন্মালেও রাবণ বধের আশা এখন বড়ই ক্ষীণ। ন্যায়বিচার এখন তলানিতে ঠেকেছে। তদন্তের সাথে যুক্ত একের পর এক অফিসার নিখোঁজ হবে, আর তোমাদের মত সমাজের নরকের কীটরা একের পর এক অন্যায় করে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে।” একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে এবার থেমে গেলো মিয়া। তারপর মুঠোফোনে টুকটাক কিছু টাইপ করে ফের তাকালো রিক্তর দিকে। বিষক্রিয়ায় আচ্ছন্ন ওর ছয় ফুট লম্বা শরীরটা ততক্ষনে নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
“ডেভিড পারিনি নিজের পরিবারকে অন্যায় রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনতে, যেমনটা তোমার মা পারেনি তোমাকে সৎপথে ফিরিয়ে আনতে। বাস্তবটা বড় কঠিন রিক্ত। এখানে আবেগ-অনুভূতি হেরে যায় ষড়রিপুর চক্রান্তের জালে।” ক্রমশ বেঁকে যেতে থাকা রিক্তর শরীরটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে মিয়া,”যেমনটা আমার, অহনা, মালবিকা, ডরোথির ভালোবাসা হেরে গেল ষড়রিপুর কাছে, যার ফাঁদে পরে তুমি চলছো জীবনভর। যার ফাঁদে নিজের ভৃত্যকেও ঠেলে দিয়েছিলে আত্মহত্যার দিকে, এমনকি নিজের মাকেও মেরে ফেলতে চেয়েছিলে এভিডেন্স লোপাটের আশায়। তাই সেই বিষকেই হাতে তুলে নিলাম আমি।” বলে হুডির পকেট হাতড়ে মিয়া বের করে আনলো ছোট্ট শিশিটা। সাদা পাউডারের গুঁড়োটা স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ ভেদ করে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। “স্ট্রিকনিন, এই বিষ তুমি মিশিয়েছিলে…সেই আমি নিজের হাতে তুলে নিলাম।” বলে শিশিটা রেখে দিলো টেবিলের উপরে,”স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে এই পরিকল্পনা করলেও প্রথমে নিজের মনটাই বাধা দিয়েছিল। মন বলেছিল রিক্ত নিজেকে শুধরে নেবে, বিবেক দংশন নিশ্চই হবে। কিন্তু বাস্তবটা যে কতটা কঠোর সেটা তুমি না থাকলে জানতে পারতাম না আমি। স্ত্রীকে মেরে ফেলার পরও তোমার কোনরকম খারাপ লাগা নেই, উল্টে বলে চলেছো রোগভোগে ভোগা একজনকে বিয়ে করে ভুল করেছো! আইনকে ফাঁকি দিতে আমাকে ব্যবহার করতেও চাইছো…” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো মিয়া,”আমার অনুমানক্ষমতা জানাচ্ছে কাজ শেষ হলে তুমি আমাকেও মেরে ফেলতে! এই সাইক্লিকাল প্রসেস থামবার নয়, তোমার ষড়রিপুও লোপ পাওয়ার নয়। তাই বরফ আনার আছিলায় বিয়ার খাওয়ানোর নামে তোমার হাতে তুলে দিলাম বিষপাত্র।”
সমস্ত এভিডেন্স কালেক্ট করে নিজের ব্যাগে ভরতে ভরতে বলে উঠলো মিয়া,”একটু আগেই কপস ডিপার্টমেন্টকে বার্তা পাঠালাম। আশা করি ভোর হওয়ার আগেই চলে আসবে ওরা। তখন এগুলো জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করবো। হাইপ্রোফাইল আসামি নই, তাই বাঁচানোর জন্য একদল শ্রেণীও ওৎ পেতে বসে নেই।” হুডির চেইনটা আটকিয়ে বলে উঠলো মিয়া,”এইডস এর সাথে কতদিন বাঁচবো জানিনা, কিন্তু তোমার মত বায়ো ওয়েপন করে তুলবনা নিজেকে।”
রিক্তর নিষ্প্রাণ শরীরটাকে ডিঙিয়ে এগিয়ে গেলো মিয়া। বাইরে সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে গিয়েছে দীঘির জলে।
মুঠোফোনে ওয়ালপেপারে সেভড কৃষ্ণবর্ণা ক্রোধন্মক্ত দেবীমূর্তির দিকে মিয়া তাকিয়ে নিলো একবার। তারপর কাঁধের ব্যাগটা সামলিয়ে এগোতে শুরু করলো সদ্য থেমে যাওয়া পুলিশ ভ্যানের দিকে।।
সমাপ্ত