সত্য পিঞ্জর’ পর্ব ১৫

0
396

‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ১৫.
তাবিনা মাহনূর

__________

প্রবাহমান জীবনের গতি থেমে থাকেনি। ইমামকে ধরার বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেল। ভুবনের কল রেকর্ডে ইমাম তারিক আর আফজালের সাথে তার কথোপকথন ধরা পড়েছে। ভুবনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল আতিককে মেরে ফেলার। আতিক মাদক পাচার নিয়ে বেশ সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। এতে আফজালের ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আতিক টাকার বিনিময় সংক্রান্ত ঝামেলার কারণে রোহিঙ্গা ছেলেটিকে খুন করে আগুনে পুড়িয়ে প্রমাণ লোপাট করেছিল। কিন্তু আফজাল তবু চিন্তায় ছিলেন আতিককে নিয়ে। তাই তাকে সরিয়ে দিতে ভুবনকে ব্যবহার করেছেন তিনি।

আবার আরেকটা লাভ হয়েছে তাদের, তারিকের নীল নকশার কারণে। তারিক আতিককে বলেছিল ভুবনকে মেরে ফেলতে যেন ভুবনকে নিয়েও কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয়। আতিককে এর কারণ হিসেবে দেখিয়েছিল লাবিবকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা। লোকজন জানাজানি না হলে দুজনের লাশ গুম করে ফেলা হবে, এটা ছিল প্ল্যান এ।

প্ল্যান বি ছিল, পরবর্তীতে লোকজন বিষয়টা আমলে নিলে সত্যিই লাবিবকে ফাঁসিয়ে দিবে। সত্যিই এলাকার লোকজন এ ব্যাপারে মাথা ঘামালে তাদেরকে প্ল্যান বি অনুযায়ী কাজ এগিয়ে নিতে হলো।

আরশের হাতে এখন কল রেকর্ডের ক্লিপ আর ইমামের স্বীকারোক্তির কাগজ। সামনে ফরেনসিক রিপোর্ট যেখানে ইনজেকশনে কোনো বিষাক্ত পদার্থ ছিল না এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট তারিকের তা উল্লেখ করা হয়েছে। সবটা দেখে আরশের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। ইলেকশনের আর বিশ দিন বাকি। এর মাঝে এগুলো তুলে ধরলে আফজালের জয় থামিয়ে দেয়া যাবে। রাশেদও খুব খুশি। আরশ বললো, ‘স্যার, আর দেরি কেন? সাংবাদিক মাধ্যমে…’

– খবরদার না আরশ! এখনই এসব জানানো যাবে না।
– কিন্তু কেন স্যার? সব প্রমাণ তো চলেই এসেছে।
– না আরশ। আমি কার্তিককে একটা শিক্ষা দিতে চাই। সব জেনেশুনে লাবিব দোষী বলে যেই প্ল্যান ওরা সাজিয়েছে তা আমাদেরকে খাওয়ানোর বহুত চেষ্টা করেছে। বোকা পেয়েছে নাকি আমাকে!

আরশ বুঝতে পারলো রাশেদ এখন কি চাইছে। এই প্রমাণ দিয়ে রাশেদ কার্তিক সহ দলের সবাইকে হুমকি দিতে থাকবে ততদিন, যতদিন না তাকে ভাগে নেয়া হয়। আরশ আপাতত এ ব্যাপারে কিছু বললো না। রাশেদ নিজের বুদ্ধি দেখে নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নারসিসিস্ট রাশেদকে দেখে আরশের মায়া লাগছে। লোকটা জুম্মার সালাত আদায় করে, সিগারেট খায় না, শূকরের মাংস খায় না। কিন্তু সুদ ঘুষ খায়। এমন মানুষ সমাজে অহরহ যারা বিশ্বাসী কিন্তু নফসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে না বা চায় না।

রাশেদ ইঙ্গিতপূর্ণভাবে আরশকেও প্রস্তাব করলেন কার্তিককে শায়েস্তা করার পরিকল্পনায়। আরশ তা সন্তর্পণে নাকচ করে বললো, ‘পেপারগুলো কি আমার কাছে থাকবে স্যার?’

রাশেদ আরশকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। যেকোনো মুহূর্তে আরশ সব ফাঁস করে দিতে পারে। তিনি বললেন, ‘তুমি আমানতের খিয়ানত করার মতো লোক নও। তোমাকে দেয়াই যায়। কেননা আমার কাছে থাকলে ওরা হয়তো আমার বাড়িতে হানা দিবে সব প্রমাণ লুট করতে। কিন্তু আমি যদি অন্য কোথাও রাখি তাহলে ওরা ভয় পাবে। তারপরও তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি যদি সব ফাঁস করে দাও?’

– আমি একাকী কীভাবে ফাঁস করবো স্যার?
– তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। অন্য কেউ যদি আমার সাথে গাদ্দারী করে তাহলে চাকরির সাথে সাথে জীবন হারানোর আশংকা আছে। আরশ, তোমার কাছেই রাখছি সব। দয়া করে কার্তিকের সাথে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত তুমি এ ব্যাপারে ঘাপটি মেরে থাকবে।

আরশ প্রমাণগুলো সাবধানে গুছিয়ে নিজের কাছে নিয়ে বললো, ‘স্যার, আমার যা কাজ আমি করেছি। বাকি দায়িত্ব আপনাদের।’

রাশেদের কাছ থেকে ফিরে আরশ বাসায় গিয়ে যত্ন করে সব গোপন জায়গায় রাখলো। রিশতা গোসল করতে গিয়েছে। সেদিন রিশতার করুণায় তাকে নাচ দেখাতে হয়নি। তবে রিশতাকে ইসলামের ইতিহাস বলেছে সে। রিশতার আগ্রহ দেখে সে একটা অনলাইন কোর্সে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে তাকে যেখানে রাসূলের সিরাহ এর সাথে বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে সাবলীল ভাষায় গঠনমূলক আলোচনা করা হয়। এই কোর্সের ক্লাস করতে হয় সকাল দশটার দিকে। তাই রিশতা ক্লাস শেষ করেই গোসল করতে চলে যায়। এই কোর্সের উছিলায় তার জীবন একটা নিয়মের মাঝে চলে এসেছে। আগে গোসল করতে দেড়টা, দুইটা বেজে যেত।

রিশতা বেরিয়ে আসলে আরশ বললো, ‘আমাকে আবার বের হতে হবে। কার্তিক স্যারের সাথে দেখা করে দায় দায়িত্ব শেষ করে এক সপ্তাহের ছুটি নিতে হবে। এটা কাজ শেষ হওয়ার ছুটি বলতে পারেন।’

রিশতা চুল মুছতে মুছতে বললো, ‘আবার পুলিশ হয়ে যাবেন?’

– হয়তো। ওরা আমাকে সিআইডি হিসেবে পছন্দ করেনি।

নাক কুঁচকে বললো রিশতা, ‘হুহ! পছন্দ না ছাই। ওরা আপনাকে ইচ্ছে করে কাজে রাখছিল না যেন আপনি সব টের না পান।’

আরশ হেসে উঠলো। সে জানতো রিশতা খুব শান্ত মেয়ে। কিন্তু সে প্রতিদিন আবিষ্কার করে নতুন রিশতাকে। অল্প কথা বলা মেয়েটার মাঝে প্রাণোচ্ছল মন আছে। তাই কথা যতটুকু বলে, মনের অন্তঃস্থল থেকে অনুভূতি নিয়ে বলে। কথা কম বললেও চঞ্চলতা ছড়িয়ে তার সর্বাঙ্গে। আরশ উঠে দাঁড়িয়ে রিশতার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে নিজেই মুছে দিতে শুরু করলো। রিশতা বললো, ‘সিআইডির পোশাকটা ভালো ছিল। পুলিশের পোশাকে দেখলেই মনে হয় আপনার ভুঁড়ি আছে। অথচ আপনার ভুঁড়ি নেই!’

হালকা শব্দ করে হেসে ফেললো আরশ। রিশতা বললো, ‘শুনুন, আমাকেও বের হতে হবে।’

– কোথায় যাবেন?
– মেঘ ভাইয়া এসেছেন বিদেশ থেকে। বাড়ি, জমিজমা, এসব বিষয়ে কথাবার্তা সেরে আসতে হবে।

আরশের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তা দেখে রিশতা বললো, ‘আপনিও চলুন।’
– আমি অবশ্যই যাবো। কিন্তু আপনি নরম সুরে কথা বলবেন না আর প্রয়োজনের বাইরে বেশি কথা বলবেন না।

রিশতা খেয়াল করেছে, আরশ মেঘকে পছন্দ করে না। মর্জিনা খালা ফোন করে যখন বলেন, মেঘ রিশতার খোঁজ খবর নেয় মর্জিনার কাছে, তখন আরশ এ কথা শুনতে পেলে ভ্রু কুঁচকে বসে থাকে। রিশতার ধারণা, মেঘের আন্তরিকতা আরশের বিরক্তির কারণ। মনে মনে আরশের জ্বলুনি উপভোগ করে মুচকি হেসে রিশতা বললো, ‘ইন শা আল্লাহ। আর মর্জিনা খালার জন্যও ব্যবস্থা করতে হবে।’

আরশ প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কি রুদ্রর অংশ নিবেন?’

– রুদ্রর অংশ সবটা আজমেরী আন্টির নামে। তবে ওর নামে যেই টাকা ফিক্সড ছিল, সেটা ওর মৃত্যুর পর আমার নামে হয়ে গিয়েছিল। আমি টাকা নিইনি। আন্টি বললেন টাকা নিতে।

আজমেরীকে রিশতা আন্টি বলে ডাকছে দেখে আরশের মনের ভার অনেকটা কমে এলো। রিশতাকে সে বললো, ‘টাকা নিতে যাচ্ছেন?’

– আমি নিতাম না যদি মর্জিনা খালার কোনো আশ্রয় থাকতো।
– মানে?

রিশতা আরশের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বললো, ‘আমি একটা সংগঠন পেয়েছি। ফেসবুকে কিছু বোনের সাথে আমার পরিচয় আছে। একজন বোনের স্বামী একটা সংগঠনের সাথে জড়িত যেখানে হিজড়াদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। এমনকি পুরুষ ও মহিলা হিজড়া আলাদা শনাক্ত করে বিয়ের সিস্টেমও তৈরি করেছেন তারা। কিন্তু থাকার পর্যাপ্ত জায়গা নেই। ছোট বাড়ি আছে একটা। সেটার পরিসর আরো বাড়াতে টাকার প্রয়োজন। এর জন্য একটা ফান্ড আছে, আলহামদুলিল্লাহ সেখানে টাকা জমছে ভালো। রুদ্রর টাকার পরিমাণ সাত লাখের কাছাকাছি। ওটা ওখানে দিয়ে দিব, সেই সাথে মর্জিনা খালাকেও ওখানে থাকতে বলবো।’

সুন্দর এই আয়োজনের কথা শুনে আরশ খুশি হয়ে বললো, ‘খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু নিশচয়তা আছে তো এই সংগঠনের?’

– আছে আলহামদুলিল্লাহ। আমি ওখানকার মহিলা ম্যানেজারের সাথে কথা বলেছি। আপনাকে সাথে নিয়ে জায়গাটা দেখে আসবো। ওটা গাজীপুরে।
– গ্রেট! মর্জিনা খালারও একটা আশ্রয় মিললো।

রিশতা তৈরি হয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আরশের মুখ দেখে সে বুঝতে পারলো আরশ কিছু বলতে চায় যেটা সে সংকোচের কারণে বলতে পারছে না। রিশতা বললো, ‘কিছু বলবেন?’

আরশ ইতস্তত বোধ করে বললো, ‘আপনি আমাকে সত্যিই মেনে নিয়েছেন?’

– কি মনে হয়?
– কেন যেন মনে হয়, আপনি, আপনি, মানে…
– নিজের স্বার্থে ভালোবাসি?

চমকে তাকালো আরশ। তার মনের কথাটা বুঝে ফেলেছে রিশতা। যদিও সে এটা বলতো না, সে চেয়েছিল অন্যভাবে বলতে।
রিশতার খুব কষ্ট হলো কথাটা শুনে। তবু সে মুচকি হেসে বললো, ‘আপনার ভাবনা আপনার মতোই অদ্ভুত!’

রিশতার উত্তর জানা হলো না আরশের। তবে সে দেখল ছলছল দুটো চোখ। যেন বলছে, ‘এখনো বুঝতে পারো না?’

_____

পাঁচ দিন ধরে আরশের কাছে সব কাগজ পরে আছে। রাশেদের কোনো খবর নেই। এই এক সপ্তাহের ছুটিতে আরশ রিশতাকে নিয়ে বান্দরবান ঘুরতে গিয়েছিল। এটা রিশতার জন্য সারপ্রাইজ ছিল। তিন দিনের এই সফর ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম দিনগুলোর কিছু দিন যা স্মৃতিতে আজীবন ধরে রাখা যায়।

বান্দরবানে সাইরু হিল রিসোর্টে তারা একদিন ছিল। সেখানে থাকলে বাইরের পরিবেশ দেখার প্রয়োজন পড়ে না। পাহাড়ের উপরে ঘর, বারান্দায় দাঁড়িয়ে বগালেক দেখা যায়। মেঘের ভেলা এসে ভিজিয়ে দেয় মন, শরীর। এরপর থানচিতে রেমাক্রি জলপ্রপাত পর্যন্ত গিয়েছে তারা। নীলগিরি, নীলাচল, চিম্বুক পাহাড়- সব সৌন্দর্যের ভিড়ে তারা নগর ক্লান্তি ভুলে ছিল কিছুদিন। দুজন যেন কল্পনার বাগানে নানান ছবির সাক্ষী হয়েছিল। প্রতি মুহূর্তে তারা আল্লাহর সৃষ্টির প্রশংসায় অভিভূত হয়েছিল, আর জান্নাতের রূপ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল কতটা সুন্দর হতে পারে তা!

রিশতা বলেছে, পরেরবার দার্জেলিং পাড়া আর কেওক্রাডং যাবে সে। আরশ হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। এ বছর না হলেও পরের বছর নিয়ে আসবে তাকে।

আজ ষষ্ঠ দিন। গতকাল আরশ আর রিশতা ঢাকায় এসে পৌঁছেছে। এখন অব্দি রাশেদের কোনো খবর শোনা যায়নি। বিকেলে রাশেদের ফোন পেয়ে আরশ দ্রুত ধরলো। তার উত্তেজনা সে দমাতে পারছে না।

কিন্তু রাশেদের কথাবার্তা শুনে যতটা খুশি সে হয়েছিল ততটাই ভেঙে পড়লো সে। এই খবর তারা প্রকাশ করবে না। আফজালের সাথে রাশেদের সমঝোতা হয়েছে। এমনকি আফজাল বলেছে সে আরশকেও টাকা দিতে রাজি আছে। সব বলার পর রাশেদ বললেন, ‘আরশ, তুমি এতো বড় সুযোগ হাতছাড়া করো না বাবা। তোমার প্রতি আমার একটা সফ্ট কর্ণার আছে। আমার ইচ্ছে তোমাকে অনেক বড় পদে দেখবো।’

গম্ভীর কণ্ঠে আরশ জানিয়ে দিলো, ‘স্যার, আপনি ভালো করেই জানেন এটা সম্ভব নয়। আমি কখনোই অন্যায় মানতে পারবো না।’

রাশেদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমাকে বোঝানোই ভুল হয়েছে। আজ কালের মধ্যে প্রমাণগুলো অফিসে আনবে। কোনো প্রকার ঝামেলা করবে না বলে দিচ্ছি। আমি তোমাকে চাকরি থেকেই বের করে দিব। আর ওরা তোমার প্রাণ নাশ করবে। আমি চাই না তোমার কোনো ক্ষতি হোক। সুতরাং প্রমাণ যেন কোনোভাবেই সংবাদ মাধ্যমে না পৌঁছায়।’

রাশেদের সাথে কথা শেষে আরশ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। রিশতাকে কিছু জানালো না সে। সারাদিন চুপ থেকে ঘরে বসে কাজ সারলো। রিশতা তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেও কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আরশ নিশ্চুপ পরিবেশ ছাড়া কথা বলে আরাম পায় না। রিশতা তাই অপেক্ষা করলো রাত্রিবেলার।

রিশতার ভাবনা অনুযায়ী আরশ রাতে রাশেদের বলা কথাগুলো বললো। রিশতা বুঝতে পারলো না এর পৃষ্ঠে তাদের কি করা উচিত। আরশ দ্বিধান্বিত হয়ে অগোছালো কথা বললো, ‘আমি তো আসল অপরাধী খুঁজে বের করেছি। তাহলে কি আমার কোনো গুনাহ হবে রিশতা? আমি আসল অপরাধী খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। কিন্তু এখন আমি কি করবো? এখন এই বিষয়টি আমার হাতে নেই।’

– কে বললো আপনার হাতে নেই?

আরশ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে থাকলো রিশতার দিকে। রিশতা মনে মনে কথা গুছিয়ে বললো, ‘আপনি জানেন কে দোষী। তাই না?’

– হুম।
– আপনি জানেন এই বিষয়টা প্রচার না হলে আফজাল হয়তো ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে আবার বিজয়ী হবেন। লাবিব সাহেবের সাথে তা বড় অন্যায় হবে এবং এলাকাবাসী আবারো একজন জঘণ্য নেতার অধীনে থাকবে। ইসলাম কি বলে অযোগ্য শাসককে আসীন করতে?

আরশ বললো, ‘কখনোই না!’

– আপনি যদি এখন বিষয়টা নিয়ে চুপ করে থাকেন তাহলে আপনিও তাদেরকে সাহায্য করবেন। প্রত্যক্ষভাবে নয়, পরোক্ষভাবে। যেমন, অমুসলিমদের উপর নির্যাতন হলে কিছু মুসলিম খুব উত্তেজিত হয়ে যায়। অথচ মুসলিমদের উপর অত্যাচার হলে তারা এটা যেন চোখেই দেখে না। তখন উটপাখির মতো লুকিয়ে পরে। আপনার অবস্থান এখন এমন। আপনি চুপ করে থাকা মানে শত্রুকে প্রশ্রয় দেয়া এবং অন্যায়ের সাথে সামিল হওয়া। দেখেও না দেখার ভান করা।

আরশ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বললো, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন?’

রিশতা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবলো। সে যেটা বলতে চাইছে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। তবু অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে মুনাফিকের মতো বসে থাকলে হাশরের ময়দানে হয়তো লাবিবসহ এলাকার সকলে আফজালের অত্যাচার নিয়ে আরশের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলবে, ‘তুমি জানতে! তুমি জানতে!’ তখন আরশ কি জবাব দিবে?

রিশতা চোখ খুলে বললো, ‘আপনার হাতে প্রমাণ আছে। আপনি কালই সাংবাদিকদের জানাবেন। আপনার চেনা জানা কেউ নেই?’

– আছে। উসমান আমার সাংবাদিক বন্ধু। ইএম চ্যানেলের হয়ে কাজ করে।
– তাকেই ফোন করে সব জানিয়ে দিন। আর কেউ নেই?
– ‘জগৎ চেনো’ পত্রিকার একজন সম্পাদকের সাথেও পরিচয় আছে আমার।
– ব্যাস! এখন শুধু আপনার মন কি বলে তা জানতে হবে।

আরশ রিশতার হাত ধরে বললো, ‘তোমার মন যা বলছে আমারও তাই। আমি কালকেই সব জানিয়ে দিব।

_____

সকল যোগাযোগ মাধ্যমে আফজালের কুকীর্তির কথা ছড়িয়ে গিয়েছে। তাকে দল থেকে বহিষ্কার করার ঘোষণা করেছেন দলের একজন এমপি সদস্য। পুলিশ তাকে কোর্টে নেয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে। একাধারে আতিক ও ভুবন খুনের দায়, লাবিবকে ফাঁসানো, মাদক মামলা সহ বেশ কিছু মামলায় জড়িয়ে আফজালের আত্মসম্মান থেকে শুরু করে ক্ষমতা পর্যন্ত সবকিছু নষ্ট হয়ে গিয়েছে মাত্র কিছু মুহূর্তেই।

পুরো বাংলাদেশে ইফতিখার আরশের সাহসিকতার পরিচয় ছড়িয়ে গিয়েছে। আরশের নাম উঠে এসেছে ‘জগৎ চেনো’ পত্রিকা সহ আরো নামকরা পত্রিকার শিরোনামে। ‘তরুণ সিআইডির ঈগল দৃষ্টি’, ‘আফজাল ফেঁসেছেন আরশ জালে’- এমন বিভিন্ন শিরোনামের কলামে আরশের সাহসী পদক্ষেপের কথা বর্ণনামূলক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

তবে আরশ তার ডিপার্টমেন্টের কারো নাম নেয়নি। এটা এখন পুলিশদের কাজ। তার কাজ শেষ এবং তাকে আজিমপুর থানা ছাড়া ঢাকার বেশিরভাগ থানা থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছে। আজিমপুর থানার রাশেদ একবারও ফোন করেননি।

বাড়িতে এক ধরণের উৎসব উৎসব ভাব। কিন্তু সকলের মাঝে আরশের জীবন নিয়ে চিন্তার আভা রয়েছে। নাজিফা একবার রিশতাকে আড়ালে নিয়ে বেশ বকেছেন আরশকে এ ব্যাপারে না থামানোর জন্য। রিশতা যখন বুঝিয়ে বলেছে এটা অন্যায় হয়ে যায়, তখন তিনি কেঁদে ভাসিয়ে আরশকে বকাবকি করেছেন। আরশ অবশ্য এসব মাথায় আনছে না। তার মনে অন্যরকম শান্তি। যেটা সে কাউকে বলে বোঝাতে পারছে না। শুধু রিশতাকে একটু পরপর নিজের খুশির কথা বলছে।

অজানা একটা ভয় আরশেরও কাজ করছিল। চাকরি থেকে যেকোনো মূল্যে তাকে বের করে দেয়া হতে পারে। এতে সমস্যা নেই। রিজিকের মালিক আল্লাহ। কিন্তু জীবন নিয়ে আশংকায় পরে গিয়েছিল সে। এর পরই তার মাথায় এলো, শুধু রিজিকের মালিক কেন? সবকিছুর মালিক আল্লাহ। সুতরাং তার জীবন যার হাতে, তিনি-ই হেফাজত করবেন। সেটা জীবন রক্ষা করে হোক, কিংবা মৃত্যু দিয়ে।

রিশতার মনের ভয়টা সে আরশকে বুঝতে দেয় না। সবসময় আরশের খুশিকে অনুভব করে সে। ঘটনার তিনটা দিন পার হয়ে গেল, আরশকে এখনো কেউ হুমকি দেয়নি। রিশতা তাই অন্য চিন্তায় ব্যস্ত। আরশকে কি তাহলে গুম করে ফেলা হবে? সে মুখে যতটা সম্ভব হাসি ধরে রাখতে চায়। কিন্তু হঠাৎই অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ে। আরশ তখন তাকে ঝাঁকিয়ে ডাকতে থাকে। আরশকে নির্বিকার দেখে রিশতা একটু স্বস্তি পায়। মনে মনে আল্লাহকে বারবার ডাকে যেন সকল বিপদ থেকে তিনি রক্ষা করেন।

মর্জিনা খালাকে গাজীপুর রেখে আসা হয়েছে। হিশামের বাড়িটা ডেভেলপারদের হাতে দিয়ে আজমেরী বিয়ে করে ফেলেছেন। ইদ্দত শেষ না হতেই বিয়ে করেছেন। রিশতা এ ব্যাপারে বলতে গেলে তিনি শেষ একটা কথা বলে ফোন রাখেন, ‘আমাকে আর কখনো ফোন করবে না। নতুন বর পেয়ে বেয়াদবি শিখে গিয়েছো।’

– কি ভাবছেন?

আরশের কথায় ঘোর কাটলো রিশতার। সে এই কয়দিন শান্ত নীরব থাকে ঠিক আগের রিশতার মতো। তার মনের অবস্থা আরশ খুব ভালো বুঝতে পারে। এতদিন সে কিছু বলেনি। কিন্তু আজ সে রিশতাকে বলবে আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখার কথা।

রিশতা তার কাঁধে মাথা রেখে বললো, ‘আমি কি আপনাকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়েছি?’

– এমন ভাবলে আমি কষ্ট পাবো।
– কি করবো বলুন? আমি নিজেই তো আপনাকে…
– আপনি না বললেও আমি এই কাজটাই করতাম। বরং আপনি বলার কারণে আমি খুব শান্তি পেয়েছি। মানসিক শান্তি।

আরশ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখতে বললো রিশতাকে। খুব সুন্দর করে বোঝানোর পর রিশতার মন ভালো হলো। সে আরশকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। আরশকে ছেড়ে সে বললো, ‘চা বানাবো। আপনি খাবেন?’

– নাহ, আমাকে বের হতে হবে। উসমানের সাথে দেখা করবো।
– ঠিকাছে, আসার সময় গোলাপ ফুল নিয়ে আসবেন।

আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘ইন শা আল্লাহ।’

_____

উসমানের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা সেরে আরশ বাইক নিয়ে ধানমন্ডি লেকে আসলো। ওখানে বাচ্চারা মাঝে মাঝে ফুল বিক্রি করে। এখন রাত সাড়ে এগারোটা বেজে যাওয়ায় কোনো বাচ্চার হাতে ফুল দেখলো না সে। রিশতার আবদার সে রাখতে পারেনি ভেবে মন খারাপ হলো। তখনই দেখা পেলো তিনটা গোলাপ ফুল হাতে একটা ছোট্ট ছেলে মাটির উপর বসে আছে। ফুলগুলো অনেকটা নেতিয়ে গিয়েছে।

আরশ তার কাছ থেকে সব ফুল কিনে নিলো। বাচ্চাটা টাকা পেয়ে খুশিতে বললো, ‘আইজক্যা ভালো ভাত খামু।’

– ভালো ভাত কি রে?
– মরিচ ছাড়া ভাত। প্রতিদিন মরিচ ভাত খাই। আইজ মনে হয় আলু ভর্তা দিয়া খাইতে পারুম।’

আরশের মনে ব্যাথা জেগে উঠলো। সে তিনশ টাকার নোট বের করে বাচ্চার হাতে দিয়ে বললো, ‘কালকে মুরগি দিয়ে খেও। ঠিকাছে?’

বাচ্চাটা খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে মায়ের কাছে চলে গেল। দূরে তার মা ভাপা পিঠা বানিয়ে বেচছে। আরশ মুচকি হেসে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাসায় পৌঁছে রাতের খাবার খেলো। নাজিফা আর আনিকা খাবার দিয়ে বসে আছেন। রিশতাকে না দেখতে পেয়ে সে একটু অবাক হলো। কিন্তু নাজিফাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না। বোনের দিকে একবার তাকিয়ে ভাবমূর্তি বোঝার চেষ্টা করলো। আনিকাও তার সাথে বসে খাচ্ছে। সে সন্ধ্যার পর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে রাতের খাবার খেতে দেরি হয়েছে। চুপচাপ খাওয়া শেষে উপরে চলে গেল আরশ।

আর গিয়েই দেখতে পেল আলোকিত ঘরে তার জাহানের নূর লাল সূর্যের রূপ মেখেছে। তার প্রিয়তমা ঘরের কোণায় মোমবাতি জ্বালিয়েছে। পর্দার পেছনে গোল গোল বলের মতো লাইট জ্বলছে। আজই কিনেছে হয়তো। রক্তলাল শাড়ি পরে চুল খোঁপা করেছে তার প্রাণের নূরজাহান। আরশকে দেখে মুচকি হেসে সে বললো, ‘এনেছো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? পাঞ্জাবিটা পরে ফেলো।’

সাদা পাঞ্জাবি এগিয়ে দিয়ে ফুল নিয়ে আয়নার সামনে চলে গেল রিশতা। আরশ সম্মোহিত হয়ে অপলক দেখছে সব। আজ রিশতার কি হলো? তখনই ফোনের আওয়াজ।

রাজীব ফোন করেছে। আরশ তা ধরার আগেই রিশতা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘এখন কোনো অফিস না। ধুর!’

আরশ হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেল। বেরিয়ে আসার পরও ফোনের আওয়াজ শুনতে পেলো সে। রিশতাকে বললো, ‘একটু ধরি?’

একটা মোম নিভে গিয়েছে। রিশতা সেটাতে আগুন ধরিয়ে বললো, ‘না!’

ফোন কেটে গেল। ম্যাসেজের আওয়াজ এলো। আরশ সেদিকে এগিয়ে গেলে রিশতা চোখ গরম করে তাকালো। আরশ অনুরোধ করে বললো, ‘ম্যাসেজটা অন্তত দেখি নূরজাহান?’

– ঠিকাছে। কিন্তু রিপ্লাই দেয়া যাবে না। রিপ্লাই দিলে বকবক করবে।

হাসতে হাসতে আরশ বললো, ‘আপনার হুকুম আমি মান্য করি সুলতানা।’

ম্যাসেজ দেখতে গেল সে। পাঁচবার ফোন করেছে রাজীব। নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আরশ আজ শুধু রিশতাকে সময় দিবে। মেয়েটাকে পুরো একদিনও ঠিকমতো সময় দেয়া হয় না। বান্দরবানের ট্যুরেও অফিসিয়াল ফোন আসতো। থানচিতে নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাওয়ার পর একটু শান্তি মিলেছিল।

ম্যাসেজটা উপর থেকে দেখার চেষ্টা করলো আরশ। দুটো শব্দ ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না। ‘রাশেদ স্যারের…’ এরপর বাকিটা দেখতে সে স্ক্রিনে চাপ দিলো।

আরশের বুকের উপর দুই হাত দিয়ে রিশতা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। পিঠের উপর কপাল ঠেকিয়ে সে বললো, ‘ইফতিখার শুধুই আমার!’

আরশের অনুভূতি নেই। তার মনঃজগত এখন বিচ্ছিন্ন চিন্তায় মগ্ন।

‘রাশেদ স্যারের বাড়ি থেকে তার স্ত্রী ফোন করেছেন। স্যার আজিমপুর থানা থেকে বাসায় আর ফিরে যাননি। স্যারের গাড়ি সহ স্যার উধাও। ফোন সুইচড অফ বলছে। আমার ধারণা, স্যারকে গুম করা হয়েছে।’

রিশতা প্রশ্ন করলো, ‘কি হয়েছে?’

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আরশ বললো, ‘কিছু না!’

_____

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here