সত্য পিঞ্জর’ পর্ব ২০,২১

0
435

‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ২০,২১
তাবিনা মাহনূর

__________

ভোর হয়েছে। রিশতাকে তাহাজ্জুদের সময়ে ফোন করে জানানো হয়েছে আরশকে পাওয়ার কথা। সে আজ দশ দিন পর প্রশান্ত মনে গভীর শ্বাস নিয়ে ভার মুক্ত হয়েছে। আরশ এখানে আসতে চাইছে শুনে সে বলেছে, ‘আসতে দিন। এসে একটু দেখা করে তারপর হাসপাতালে নিবেন। নাহলে মন শান্ত হবে না।’

অল্প এই কথা বলার পর থেকে সে আবার চুপচাপ বসে রইলো। সালাত শেষে নাজিফার ঘরে গিয়ে বললো, ‘মা, ইফতিখার আসছেন।’

নাজিফা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর রিশতাকে জড়িয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠেন তিনি। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নাজিফাকে এমন অবস্থায় দেখে ভেবেছিল আরশ বেঁচে নেই! তাই আনিকা সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জামিল সেটা সামলে নেয়। রিশতা সবাইকে অশ্রু চোখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, ‘কাঁদছেন কেন আপনারা?’

তারা যখন আরশের বেঁচে থাকার খবর জানতে পারলো তখন খুশিতে দ্বিতীয় দফা কেঁদে ফেললো সবাই। রিশতা নাজিফাকে ছেড়ে বললো, ‘আমি স্যুপ আর জুস তৈরি করে রাখি মা। আপনি বিশ্রাম নিন।’

নাজিফা শুনলেন না। তিনিও রান্নাঘরে গেলেন। তিনি চিকেন স্টক তৈরি করবেন আর তরল জাও ভাত রাঁধবেন। রিশতাকে জোর করে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ঘর গুছিয়ে রাখো। আমার ছেলে যেন তোমাকে আর তার ঘরকে যেমন রেখে গিয়েছিল, তেমনি পায়।’

এ কথা দ্বারা তিনি রিশতাকে স্বাভাবিক হতে বলছেন। কিন্তু রিশতার এখনো কোনো চঞ্চলতা কিংবা প্রফুল্লতা কাজ করছে না। বরং অদ্ভুত এক অভিমান জমেছে। তার অনুভূতির প্রকাশ সে নিজেই বুঝতে পারে না। নিজেকে মাঝে মাঝে পাগল মনে হয়!

আরশ প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। রিশতার খুব ঘুম পেয়েছে। এমন ঘুম এর আগে কখনোই পায়নি। যেন ঘুম রাজ্যের রাজা তাকেই তার সকল ঘুমের দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে। একে বলে মনঘুম। মনের মতো ঘুমাতে পারা, শান্তির মাঝে বিশ্রাম নেয়া।

আরশ বাসার গলিতে ঢুকেছে। এখন রিশতাকে ইহসানের সাথে কথা বলতে হচ্ছে না। আমান ফোন নম্বর নিয়ে নিজেই একটু পর পর যোগাযোগ করছে। গলির কাছে চলে আসায় তারা দরজা খুলে রাখলো। এমন সময় রিশতা বললো, ‘আমার খুব ঘুম ধরেছে। আমি একটু ঘুমাই?’

প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা করলো না সে। ঘরে গিয়ে বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়লো। মুহূর্তেই ঘুম সাগরে ডুব দিলো সে।

_____

কপালে উষ্ণ স্পর্শ। রিশতার ঘুম আরো গাঢ় হলো। পরিচিত একটা সুগন্ধ অনুভব করছে সে। পুরো ঘরে নতুন প্রাণ ফিরে পাওয়ার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে ঘুমের মাঝেই। মুখটা এগিয়ে দিয়ে নাক ঠেকালো আরশের বুকের উপর। আরশ হাত দিয়ে তার মাথা নেড়ে বললো, ‘ঘুমাও। অনেকদিন ঘুম হয়নি তোমার।’

রিশতার পনেরো মিনিটের ঘুম এতটাই প্রশান্তির ছিল যা তার কাছে পনেরো দিন ঘুমানোর সমান। চোখ বুজে সে বললো, ‘ঘুম হয়েছে। আপনি ঘুমান।’

– আমাকে একবার দেখবে না?
– না।
– কেন?
– জানি না।

রিশতার আচরণ দেখে আরশ অনুমান করলো তার মানসিক অবস্থা এখনো ভারসাম্যহীন। সে ভেবেছিল তার নূরজাহান তাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়বে। জড়িয়ে ধরে বসে থাকবে বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য যে রিশতার সাথে মানানসই নয়, তা সে ভুলেই গিয়েছিল। এই রিশতা আবেগে তুমি করে বলছে না। এখন তার শঙ্কা জাগছে, তার স্ত্রী কি আবারো পূর্বের রূপে ফিরে গেল? যেই রিশতা ছিল যন্ত্রের মতো?

অনেকক্ষণ পর রিশতা চোখ মেলে তাকিয়ে তার ইফতিখারকে দেখতে পেলো। আরশ যেমন নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে, রিশতা তেমন করেই তাকিয়ে থাকলো। হাত এগিয়ে আরশের গালে রেখে সে বললো, ‘খুব ব্যথা করছে?’

আরশ নিস্তেজ স্বরে বললো, ‘সবখানেই ব্যথা পেয়েছি। শুধু গালে নয়।’

হঠাৎ রিশতার মনে পড়লো আরশের পায়ের কথা। সে উঠে বসে আরশের দুই পা হাত দিয়ে ধরে সব আঙ্গুল অক্ষত দেখতে পেয়ে বললো, ‘আমাকে ওরা আঙ্গুল কাটার ছবি দিয়েছিল।’

আরশ রিশতাকে দেখছে। শেষের বাক্যটা বলার সময় রিশতার মুখ কুঁচকে এসেছিল। সে কল্পনা করলো সেই মুহূর্ত, যখন রিশতা ভেবেছিল তার আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছে। কতই না কষ্ট পেয়েছে তার নূরজাহান!

– ওটা ভয় দেখানোর জন্য করেছিল।
– বুঝেছি।
– ইহসান স্যারের কথা মাথায় এসেছিল কার?
– আমার।
– আলহামদুলিল্লাহ।

আর কোনো কথা নেই। রিশতা বসে থেকে আরশের আঘাতের চিহ্ন গুনছে। ময়লা শরীর দেখে সে বললো, ‘পানি দিয়ে গা মুছে দিব?’

আরশ উপর নিচ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। রিশতা বাথরুমে যেতে যেতে বললো, ‘হাসপাতালে যেতে দিব না। এখানে ডাক্তার আসবে, নার্স আসবে। এখানেই সব চিকিৎসা হবে।’

আরশ এর কারণ বুঝতে পেরেছে। ডাক্তারদের বিশ্বাস করছে না রিশতা। যদি ঔষধের সাথে বিষাক্ত কিছু মিশিয়ে দেয় তাহলে টের পাওয়া যাবে না অথচ ধীরে ধীরে ভেতরের সব অঙ্গ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই রিশতা এই ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

পানি আর তোয়ালে নিয়ে আরশের পাশে বসলো রিশতা। আরশের হাতে ছোপ ছোপ কালচে দাগ পড়ে আছে। একটা দাগে অধোর যুগল বসিয়ে আরশের দিকে তাকালো সে। দেখতে পেলো, তার ইফতিখারের চোখে তৃষ্ণা।

_____

– পুরো স্যুপ না খেলে গায়ে ঢেলে দিব একদম!

আজ কতদিন পর মায়ের শাসন শুনতে পেলো আরশ। মোটেও রাগ হচ্ছে না তার। কড়া কন্ঠ শুনে সে বারবার মুচকি হেসে উঠছে। নাজিফা স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছেন। এরপর জুস খাওয়াবেন। এতকিছু হঠাৎ করে খেতে কষ্ট হচ্ছে আরশের। খেতে না চাওয়ায় নাজিফা বকলেন।

– তোর আব্বু অভিমান করেছে। তোকে দেখতে আসবে না বলে দিয়েছে।
– আমিই যাবো।
– তোর যাওয়ার মতো অবস্থা আছে? একটুও হাঁটতে পারছিস না, আবার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামবি কি করে? যেতে হবে না। আমি পাঠিয়ে দিব। আমানের চেহারা দেখেছিস?
– হুম। ভাইয়াকে দেখে মনে হলো তার উপর বিশাল ঝড় বয়ে গিয়েছে।

নাজিফা চামচ বাটিতে রেখে আরশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এতগুলো দিন তোর ভাই ঘুমায়নি। চিন্তায় প্রেসার বেড়ে গিয়েছিল। তোর বাবার ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়েছিল। তবু তোর বাবাকে সামলানো গিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমানের যা হয়েছিল রে! আলহামদুলিল্লাহ, ইমারজেন্সি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। এদিকে বৌমা গর্ভবতী। আনিকাও ভারী হয়ে যাচ্ছে। সব সামাল দিয়েছে জামিল। এই ছেলেটার উপরেও অনেক চাপ গিয়েছে। আনিকাও অভিমান করেছে তুই যাওয়ার সময় দেখা না করে গিয়েছিলি বলে।’

– আমি কি বিদেশ চলে যাচ্ছিলাম আম্মু? দেখা করতেই হবে!
– এটাই তো বলবি। তুই কি বুঝতে পারছিস না তোকে সবাই কত ভালোবাসে?

আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘এটা প্রমাণ সহ কেন দেখাতে হবে আম্মু? আমি কি জানি না?’

– না, জানিস না। জানলে এই চাকরি জীবনেও করতি না। তুই ভাবিস তোর কিছু হয়ে গেলে আমাদের কিছুই মনে হবে না। এজন্যই তুই এমন বিশ্রী চাকরি করিস। সব ছেড়ে দিবি। হয় চাকরি ছাড়বি, আর নাহলে বনবাসী হবি। এখানে তোকে থাকতে দিব না।
– চাকরি এমনিতেই থাকবে না আম্মু।
– আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আলহামদুলিল্লাহ।

চাকরি না থাকায় নাজিফা খুশি হলেন। আরশকে পুরো স্যুপ খাইয়ে দিয়ে বললেন, ‘পরে জুস খা। এখন একবারে খেতে হবে না। তোর ইহসান স্যারকে আজ বিকেলে আসতে বলেছে আমান। লোকটা খুবই ভালো মানুষ। সারা রাত তোকে নিয়েই ছিল বলে তোর আব্বু এখানে বিশ্রাম নিতে বলেছিল। কিন্তু উনি বললেন, আপনারা আরশকে আগলে রাখুন। আমি অবশ্যই আসবো একদিন। আজই আসবেন, তোকে কি যেন জানাতে হবে বললেন।’

আরশ কিছুটা ধারণা করতে পারলো ইহসান স্যার তাকে কি বলতে আসবেন। তবু সে চুপ করে থাকলো। প্রথমে স্যারের সাথে একান্ত আলাপ করতে হবে। তারপর বিষয়টা সবাইকে জানাতে হবে।

কথা রাখতে ইহসান আসলেন বিকেল বেলা। ড্রইং রুমে বসে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। নাজিফা আর ফাতিহা রান্নাঘরে নাস্তা সাজানোয় ব্যস্ত। আনিকা ঘুমিয়ে আছে। তার গর্ভাবস্থার জটিলতার কারণে তাকে সবসময় বিশ্রামে থাকতে হয়।

ইহসানের সাথে বাড়ির পুরুষ সদস্যদের কথোপকথন শেষে ইহসান বললেন, ‘আরশ বাবার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। ঘুমাচ্ছে সে?’

আমান বললো, ‘না স্যার। চলুন আপনাকে নিয়ে যাই।’

আজ কেউ অফিসে যায়নি। জামিল ছুটি নিয়েছে আর আমান অফিসের সবাইকে ছুটি দিয়েছে দুদিনের জন্য। আরশের ঘর পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই আমান ডেকে উঠলো, ‘আরশ, তোর বউ আছে ঘরে?’

আরশ উচ্চস্বরে উত্তর দিতে পারছে না। রিশতা বললো, ‘আসুন আপনারা। আমি বারান্দায় আছি।’

রিশতা বারান্দায় যাওয়ার পর ইহসান ভেতরে ঢুকলেন। তিনি একাকী কথা বলতে চাইছিলেন। আমান থাকায় আলোচনাগুলো সংক্ষিপ্ত হলো। আরশ সরাসরি বললো, ‘ভাইয়া, তুমি বরং নিচে গিয়ে দেখো স্যারের ড্রাইভার আছে কিনা। তাকেও নাস্তা খেতে ডাকো।’

আমান এই কথাতেই বুঝে নিলো আরশ কি বলতে চাইছে। সে মুচকি হেসে চলে গেল। ইহসান বললেন, ‘তোমার হাতের চেকআপ করাবে না? তুমি বলেছিলে বাম হাতের উপরের অংশ অবশ মনে হচ্ছে তোমার।’

– জি স্যার। এই হাত উঠাতে পারছি না ঠিকমতো। আর মাথাও প্রচন্ড ব্যথা করে।
– তোমার কন্ঠ শুনেই বুঝেছি। যাই হোক, আজ ডাক্তার আসবেন। সব সমস্যার কথা বলবে। এখন মূল কথায় আসি। তোমাকে হিজরত করতে হবে।

আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘অনুমান করেছিলাম।’

– হ্যাঁ বাবা, তুমি বিচক্ষণ ছেলে। নিশ্চয়ই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না কেন হিজরত করবে?
– জি।
– ওরা তোমাকে দেশে দেখতে চায় না। যদি দুই তিন মাসের মধ্যে দেশ না ছাড়ো তাহলে তোমার জীবন নিয়ে ঝুঁকি বাড়বে। ওরা এখনো তোমাকে টার্গেট করে রেখেছে কেননা ওরা জানে না প্রমাণ কোথায় আছে। অবশ্য আমি ভাবছি বলে দেব সত্যটা। উসমানের জীবন নিয়ে আর আশংকা নেই আলহামদুলিল্লাহ।

আরশ প্রশ্ন করলো, ‘সংবাদ মাধ্যমের কি খবর স্যার?’

– ওহ! ওটা বলতেই ভুলে গিয়েছি। এখন সব চ্যানেলে তোমাকে খুঁজে পাওয়ার খবর এসেছে। পুরো দোষ একজন মাদক পাচারকারী আসামিকে দেয়া হচ্ছে। হাস্যকর বিষয় কি জানো? সেই পাচারকারীকে অনেক আগেই জেলে ঢোকানো হয়েছিল। তাকে জেল থেকে বের করে আবার ঢোকানো হয়েছে। যেন মানুষ ভাবে সে জেল পালিয়ে মাদক ব্যবসা আবার শুরু করেছিল। এবং তোমাকে সে-ই আটকে রেখেছিল।

আরশ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, ‘সত্যিই হাস্যকর! কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি এতো সূক্ষ্ম পরিকল্পনাগুলো কে সাজিয়েছে?’

ইহসান বললেন, ‘মিলন।’

অবাক হলো আরশ, ‘মিলন স্যার! কিন্তু উনি কাজের মাঝখানে সরে দাঁড়ালেন যে। তারপর উনি…’

– তারপর উনি কক্সবাজার গিয়েছিলেন মাদকের বিষয়টা দমাতে। তাই তো? শোনো বাবা, উনি নিজেই মাদক চোরাচালানের একজন বড় মাফিয়া। এই কেসে নিজেকে নিরাপদ রাখতে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। এরপর তুমি যেন এর সাথে কোনোভাবেই না জড়াও সেই চেষ্টাই করছিলেন। কেননা তুমি যদি জেনে যাও বড় বড় মাফিয়া কারা, তাদের তথ্য তুমি কখনোই গোপন করবে না। ফাঁস একদিন করবেই। এই আশংকায় তিনি তার রাস্তা পরিষ্কার রাখতে চেয়েছেন। এমনকি, এখনো তিনি বেশ নিরাপদ অবস্থানে আছেন। কেননা, তোমার গু-ম হওয়ার ঘটনায় তিনি একবারের জন্য সামনে আসেননি।

মিলনের কুবুদ্ধি জেনে বিস্মিত হলো আরশ। এই মানুষটা নিজেকে আড়াল রেখে কূটচাল চেলেছে। আরশ বললো, ‘কিন্তু স্যার, আপনার শত্রু বেড়ে গেল না?’

হেসে উঠলেন ইহসান, ‘এরা আবার কি এমন শত্রু! তুমি জানো না আমার কাছে কি আছে আরশ। আমার পুরো পৃথিবী জুড়ে শত্রু কিন্তু কেউ কোনো আঘাত করতে পারে না।’

স্যারের রহস্যময় কথার অর্থ খুঁজে পেলো না আরশ। ইহসান অবশ্য মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে বললেন, ‘আমি জানি বড় বড় মাফিয়া কারা। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কারা মুসলিম জাতির জন্য ভাইরাস স্বরূপ। সব কিছুর একটা তালিকা আমার আছে। কিন্তু এই তালিকা আমার কাছে নেই। তাদেরকে বলে দিয়েছি, আমার মৃত্যুর সাথে সাথে তালিকা ফাঁস হয়ে যাবে। তাই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিলেও, মারতে পারে না। সরি আরশ, তোমাকেও বলতে পারবো না কোথায় কি রেখেছি আমি।’

আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘তা না বলাই ভালো স্যার। আল্লাহ আপনার সহায় হন।’

– এটাই বড় কথা। আল্লাহ চান বলেই বেঁচে আছি এতদিন আলহামদুলিল্লাহ। আর, যেহেতু আমার কোনো পরিবার নেই, তাই পিছুটানও নেই।

আরশ প্রতিবারই মুগ্ধ হয়ে এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটাকে দেখে, তার কথা শোনে। পুরো জীবন একাকী পার করে গেলেন ইহসান। বিয়েও করেননি। অবশ্য লোকমুখে শোনা যায়, বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন না যেতেই স্ত্রী মারা যান। তারপর আর কোনো নারীর সংস্পর্শে যাননি তিনি। তাই তো তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি শুধুই হাসেন।

কথাবার্তা শেষে আরশ বললো, ‘অনেক সাহায্য করেছেন স্যার। একটা ছোট্ট সাহায্য চাইছি।’

– অবশ্যই! বলো আরশ।
– সজল নামের রক্ষীর কারণে আমরা এতদূর এগিয়ে গিয়েছি। তার একটা খোঁজ পেলে ভালো হতো। আর রাজীব ভাইয়ের বিষয়টাও জানতে চাই।

ইহসান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আজ রাতের মধ্যেই জেনে যাবে ইন শা আল্লাহ। এখন বিশ্রাম নাও। আর হ্যাঁ, তোমার স্ত্রী কিন্তু তোমার অনুপস্থিতিতে পর্দা ভুলে যায়নি। অবশ্যই তার দিকটা চিন্তা করবে আরশ। সবসময় শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবলে হয় না। তখন মরে যেতে বাধা থাকে না। তাই বেঁচে থাকতে নির্ভরতা প্রয়োজন। রিশতার মতো ভালো মেয়েটাকে ভুলে যেও না। আসছি!’

আরশ সালাম দিয়ে মুচকি হাসলো। হেসে বললো, ‘রিশতা আপনাকে সালাম জানাতে বলেছে। আপনার ঋণ শোধ করার মতো নয়।’

_____

রাত হতেই ইহসান ফোন করলেন। আরশ রিশতার কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। ডাক্তার এসে ঔষধ দিয়ে গেছে এবং অনেকগুলো টেস্ট করতে বলেছে। স্যারের ফোন আসায় সে ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘একটু দেখেন তো কে ফোন করেছে।’

– ইহসান স্যার।
– লাউড স্পিকার অন করে দিন।

ফোন ধরতেই স্যার বললেন, ‘আরশ?’

– জি স্যার, আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ঘুমাচ্ছিলে মনে হচ্ছে? আমি বেশিক্ষণ কথা বলবো না।
– সমস্যা নেই স্যার।
– রাজীব জানতো না তোমার বিষয়টা। সে ভেবেছিল সত্যিই রাশেদকে উদ্ধার করতে যাওয়া হচ্ছে। পরে তোমার পরিণতির কথা জেনে সে একটু বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে চুপ করে রাখা হয়েছিল। এমনকি, সে এখনও কারো সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে না। মনে হয় তাকে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
– রাজীব ভাইকে কোনো দোষ দিতে পারছি না। সবার মন সবল হয় না।
– হ্যাঁ। আল্লাহ ওকে সুবুদ্ধি দিন।
– আমিন। আর সজলের কি খবর?

চুপ করে আছেন ইহসান। আরশ অপেক্ষা করছে উত্তরের জন্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘আরশ, সজল ছেলেটাকে জেল থেকে বের করা হয়েছে। এরপর, তাকে মেরে টুকরো করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে।’

আরশের চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো। মৃদু স্বরে সে বলল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ মাগফিরাত দান করুন!’

_____

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ২১.
তাবিনা মাহনূর

__________

দেড় মাস ধরে আরশের চিকিৎসা চলছে। বাম হাতের স্নায়ুতে সমস্যা ধরা পড়েছিল। তাই হাতে কোনো অনুভূতি ছিল না, অবশ হয়ে থাকতো। আল্লাহর রহমতে সে ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। সিটি স্ক্যান করে মাথায় বড় কোনো আঘাত ধরা পড়েনি। সবই আল্লাহর অনুগ্রহ। এতটা আঘাত পেয়েও সে স্বাভাবিক মানুষের মতো হাটা চলা করতে পারছে।

দুপুরের খাবার খেয়ে আরশ একটু ঘুমিয়েছিল। বিকেলে আছরের আজান দিলে সে বারান্দার দোলনায় বসলো বাইরের নিস্তব্ধতা দেখে। তার নীরব আবহাওয়া খুবই ভালো লাগে। একটু পর রিশতা এসে বললো, ‘শরীর এখন ভালো লাগছে?’

এতোদিন ধরে রিশতা আপনি করে ডেকেছে। তার আচরণ আরশের নূরজাহানের মতো নয়। আরশ অসুস্থ থাকায় রিশতাকে কিছু বলেনি। আজ অনেকটা সুস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। আজই সে রিশতার মনোভাব জানতে চাওয়ায় বলে উঠলো, ‘আমার পাশে বসুন।’

রিশতা তার পাশে বসে বললো, ‘রাশেদ স্যারের কোনো খবর পেয়েছেন?’

রিশতা কোনো স্ত্রীসুলভ কথাবার্তা বলে না। সবকিছু কাজ ও যত্ন কেন্দ্রিক। শরীরের খোঁজ নেয়া, খাবার-ওষুধের নিয়ম মানা ছাড়াও মনের প্রশান্তি বলে যে একটা বড় ঔষধ আছে, তা রিশতার খেয়াল নেই। আরশ তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে বললো, ‘স্যার দুবাই চলে গিয়েছেন। আমার জন্য উনাকেও শাস্তি পোহাতে হলো।’

– এটা উনার প্রাপ্য। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে উনি আপনাকে আসল অপরাধী খুঁজতে সাহায্য করেছেন। এর জন্যই আফজালের দাসগুলো তার উপর রাগ ঝেরেছে। কিন্তু উনিও অন্যায়ভাবে উপার্জন করতে চেয়েছিলেন, লোভ সামলাতে পারেননি।
– আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। উনি নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছেন। আল্লাহ যেন সাহায্য করেন।
– আমিন। আচ্ছা, ভুবনের ফোন ওরা কবরে কেন লুকিয়েছিল? নষ্ট করে ফেললেই হতো। যেহেতু পুলিশের বড় এক অংশ ওদের হাতের মুঠোয় থাকে।
– ভুবনের ফোন ওদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুধু মাদক নয়, লাশ বিক্রি ও পতিতালয়ের সাথে সংযোগ ছিল তার। সব মিলিয়ে ওর ফোনে কিছু ডকুমেন্টস ছিল যেগুলো আফজালের দল উদ্ধার করতে পারছিল না কেস নিয়ে জটিলতার কারণে।

কিছুক্ষণ নীরবতা। রিশতা বললো, ‘লিটন নামের ছেলেটাকে কীভাবে পেয়েছেন ইহসান স্যার?’

– ইহসান স্যার সবসময় শত্রুদের নজরে রাখতেন। কালীর বাজারের সামনে লিটনকে জাহাঙ্গীরের গাড়িতে উঠতে দেখেছিল স্যারের নিয়োজিত পুলিশ। তার পিছু নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল সেই পুলিশ ভাই। লিটন জাহাঙ্গীরের ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার সময় স্যার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। লিটন কিছুতেই স্বীকার করছিল না। স্যার তখন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেন। আমি যেভাবে সজলের মুখ থেকে কথা বের করেছি, স্যার সেভাবেই লিটনের মুখ থেকে আমার ঠিকানা জেনে নিয়েছেন। এ ধরণের মানুষগুলো আল্লাহকে বিশ্বাস করে, ভয় করে। কিন্তু কুসংস্কার আর শির্কী কাজকর্মের ভিড়ে এদের ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।

রিশতা আবার চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বললো, ‘মলম লাগাতে হবে। চলুন।’

– আমার ব্যথা সেদিনই কমে গিয়েছে।
– কোনদিন?
– যেদিন আপনি আমার ব্যথার স্থানগুলো…
– সিনেমার ডায়ালগ!
– আমি সিনেমা দেখিনি কখনো।

রিশতা কিছু বললো না। আরশ বললো, ‘আপনার কি হয়েছে?’

রিশতা তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কি হবে?’
মৃদু স্বরে আরশ বলে উঠলো, ‘অচেনা মনে হচ্ছে আপনাকে।’

– খুব চেনা ছিলাম কি?

এই প্রশ্নে আরশ বুঝতে পারলো, রিশতার মনে কোনো ঝড় চলছে। যেটা সে থামাতে পারছে না বা চাইছে না। আরশ তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, ‘ঝড় থামাতে সাহায্য করবো?’

রিশতা হাত বাড়ালো না। দোলনায় আরাম করে বসে বললো, ‘ঝড় নেই তো। থামাবেন কীভাবে?’

– আমি শুনতে পাচ্ছি। প্রবল বর্ষণ আর বজ্রপাত।
– ভুল শুনছেন।
– ঠিক কোনটা?

রিশতা সামনে তাকালো। শীত শেষে বসন্তের আগমনী বার্তা পাঠাচ্ছে সোনালী রোদের আবির মাখা আকাশ। গোধূলি বেলার কাল বেড়েছে। মনোমুগ্ধকর সময়টা রিশতার মনকে শীতল করে তোলে। নয়ন জোড়া বন্ধ করে মন ভরে শ্বাস নিয়ে সে বললো, ‘বকুল তলায় ঝরে পড়ছে ফুল। কুড়োনোর মানুষটা নেই। নিস্তব্ধ শান্ত আবহাওয়া, নির্জন সেই অঞ্চলের সাক্ষী একটা দীর্ঘশ্বাস। এই শ্বাসের আওয়াজ আপনি শুনতে পাননি, পাবেন না। ঝড় তো দূরের কথা!’

আরশ একমনে তাকিয়ে আছে রিশতার দিকে। খুব ইচ্ছে করছে রিশতার সবুজ চোখের মায়া মাখতে। আকাঙ্ক্ষা দমিয়ে সে বললো, ‘মানুষটা তোমার পাশেই আছে।’

সঙ্গে সঙ্গে রিশতার উত্তর, ‘নেই! যে আছে সে আরশ। আমার ইফতিখার নয়।’

আরশের উত্তর, ‘যার দীর্ঘশ্বাস শুনছি সে রিশতা, আমার নূরজাহান নয়।’

চোখ খুললো রিশতা। আরশ ফিরে আসার পর আজ প্রথম তাকে নকল করে কথা বলেছে। রিশতা সেটা খেয়াল করে এক গালে হাত রেখে পায়ের উপর কনুইয়ের ভর রেখে ভাবুক ভঙ্গিতে বললো, ‘অতএব সমীকরণটি সিদ্ধ হলো।’

মুচকি হেসে উঠলো আরশ। নূরজাহান তখনই হবে যখন ইফতিখার প্রকাশ পাবে। আরশ বললো, ‘কি হয়েছে তোমার বলো না? হেঁয়ালি করো না।’

– বলছি তো। কি হবে?
– অভিমান?
– মনে হয়।
– সেদিন আমাকে যেতে মানা করেছিলে। আমি গিয়েছি বলে অভিমান হয়েছে?

চুপ করে আছে রিশতা। কিছুক্ষণ আরশের দিকে তাকিয়ে থেকে রিশতা বললো, ‘সেদিন আপনি রাজীব ভাইকে যখন আল্লাহর প্রতি ভরসার কথা বললেন, তখনই আমার মাথায় এলো ব্যাপারটা। আল্লাহ চাইলে আপনি বাসায় থাকলেও মৃত্যু দেখবেন, বাইরে থাকলেও দেখবেন। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে মরার চেয়ে ন্যায়কে আঁকড়ে ধরে শহীদ হওয়া অনেক অনেক বেশি সম্মানের। তাই সেদিন আপনাকে আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল রেখে যেতে বলেছিলাম। তবে…’

আরশ অপেক্ষায় আছে বাকি কথা শোনার জন্য। রিশতাকে চুপ থাকতে দেখে সে বললো, ‘তবে?’

রিশতা সামনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তবে আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। এটা প্রমাণ পেয়েছি।’

খুব হাসি পাচ্ছে আরশের। রিশতার মুখশ্রী জুড়ে এখন শিশুর মতো অভিমান। অনেকটা তার নূরজাহানের মতো। রিশতা খুব চেষ্টা করেও নিজের গম্ভীরতা ধরে রাখতে পারছে না এখন। রুদ্ধ কণ্ঠে সে বললো, ‘আপনি চলে গেলেন। একবারও বলেননি আবার আসবেন। একবারও বলেননি আমি যেন আপনার অপেক্ষায় থাকি। একবার জড়িয়ে ধরেননি, আশা দেননি। আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে বারবার শুনতে চেয়েছিলাম আপনি আবার আসবেন। কিন্তু, আপনি নিজের মতো হাসিমুখে চলে গেলেন।’

আরশ মনে করলো সেই সময়ের কথা। সেই আবেগঘন মুহূর্তে, চিন্তার ঝুড়ি মাথায় নিয়ে তার এসব বলার কথা মনেই ছিল না। অথচ তার পুরোটা জুড়ে তখন রিশতা আর মায়ের চিন্তা ছিল। মাকেও সে বলেনি ফিরে আসার কথা। মা তবু অভিমান না করে ছেলেকে আগলে রেখেছেন। কিন্তু রিশতা? তার অভিমান হবে নাই বা কেন? তার মনের সবটা জুড়ে শুধু ইফতিখার। আর কাকে নিয়ে সে অভিমানের ঘর গড়বে?

আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘আমি যদি বলতাম আমি ফিরে আসবো, তারপর যদি না ফিরে আসতাম। তাহলে সেটা কথার আমানতের খিয়ানত হতো না?’

রিশতার গাম্ভীর্য আবার ফিরে এলো। স্থির চোখে তাকিয়ে সে বললো, ‘ইন শা আল্লাহ, দেখা হবে। এটুকুও বলেননি।’

আরশের হাসি থামছে না। অনেকদিন পর সে নূরজাহানকে দেখছে। এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কি আছে! সে প্রশ্ন করলো, ‘কি করলে ক্ষমা পেতে পারি?’

রিশতা উঠে দাঁড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে বারান্দার চৌকাঠ পর্যন্ত গেল। তার উপর দাঁড়িয়ে আরশের দিকে তাকিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো সে। নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে বললো, ‘আমার ইফতিখার চাই।’

আরশ চুপ করে আছে। কিছুক্ষণের মাঝেই শব্দহীন জলধারা ঝরে পড়লো সবুজ আঁখি জোড়া থেকে। আরশ উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল সেদিকে। রিশতার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বারান্দার দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো সে। হাত দুটো পেছনে রেখে মাথা উঁচু করে দরজায় ঠেকিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকলো রিশতার দিকে।

রিশতা আর আরশের মাঝে স্বল্প দূরত্বের ব্যবধান। সেই ব্যবধানে দেখা যাচ্ছে সামনের বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের টকটকে লাল সৌন্দর্য। সেখান থেকে বৃষ্টির ন্যায় ঝরছে ফুল, ঝরছে পাতা। রিশতার অশ্রু এমন করে তার শুভ্র কপোল জোড়া রক্তিম করে তুলছে। আরশ সেদিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমার সত্তা জুড়ে তুমি। এখানে শুধু নূরজাহান পাবে। কোনো ইফতিখার নেই! তুমিই তো আমি।’

আরশের বলা শেষ কথাটি রিশতার মনের কথা। আজ কতদিন পর আরশ তাকে তার প্রিয় সম্বোধনে ডাকলো! রিশতা ভালোবাসে, তুমিই তো আমি শুনতে।

রিশতা সোজা হয়ে দাঁড়ালে আরশও শীতল দৃষ্টি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এখনো অশ্রু ঝরছে। আরশের বুকে মুখ গুঁজে তার বুক ভিজিয়ে তুললো। চোখ বন্ধ করে ফেললো আরশ। এ সময়টা অনুভবের।

মোহনীয়তা যখন অসীমকে স্পর্শ করেছে, তখন উভয়ের মুখ ফুটে একসাথে বের হলো, ‘ভালোবাসি!’

_____

আরশের এ দেশে থাকা হচ্ছে না। ভিনদেশে পারি জমানোর প্রক্রিয়া চলছে। এর মাঝে ইহসান একবার ফোন করে বলেছেন, আরশের দেশ ত্যাগের পর আর কোনো ধরণের আশংকা থাকবে না। কেননা ইতিমধ্যে দেশের লোকজন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যদি তার ক্ষতি করা হয় তবে শত্রু পক্ষের ক্ষমতা আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। জনগণ একবার ক্ষেপলে রক্ষা নেই!

তাই তাকে মেরে ফেলে কিংবা গু-ম করে শুধু শুধু ঝামেলা বাড়াতে চায় না অমানুষগুলো। তবে সে দেশে থাকলে ঝুঁকি আছে। বিদেশে গেলে তাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না কেউই।

এসব জানার পর আমান তার ভাইকে বাইরে পাঠানোর জন্য কোনো ব্যবস্থার ত্রুটি রাখেনি। কোন দেশে তাদের কেমন আত্মীয় স্বজন আছে, কোথায় গেলে আরশ আর রিশতা ভালো থাকবে, সকল খোঁজ নিয়ে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। জামিলও সাহায্য করছে এ ব্যাপারে। এমনকি মেঘ মর্জিনা খালার কাছ থেকে রিশতার বিষয়ে জানার পর আমেরিকায় নিয়ে আসার জন্য সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু আরশ বলেছে, ‘আর যা-ই হোক, আমেরিকার মাটিতে পা রাখবো না কখনোই!’

বাংলাদেশে আরশের অবস্থান আর অল্প কিছুদিন। নাজিফা তাই এখন বেশ চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। আনিকার অবস্থাও একই। আরশের মন খারাপ হয়। তার একমাত্র বোন কথা না বলে একটুও সময় কাটাতে পারে না। অথচ এই বোন এখন তাকে দেখলেই কথা হারিয়ে ফেলে। শুরুতেই বলে ওঠে, ‘ভাই, তুই গল্প কর আমি শুনি।’

আরশ গল্প জানে না। সে গালে হাত দিয়ে বলে, ‘তুমি বলো, আমি শুনি।’

আনিকা তখন খুব কষ্টে অশ্রু ধরে রাখে। দাঁত বের করে খিলখিলিয়ে হেসে চোখ বন্ধ করে কথা বলে সে। আরশকে সে বোঝাতে চায়, তার হাসির জোরে চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে। অথচ সে যে অশ্রু লুকাতে চাইছে, তা আরশ খুব ভালোভাবেই জানে। আরশ তখন বলে, ‘হাসিটা রেকর্ড করে নিয়ে যাবো আপু?’

আনিকা তখন অশ্রু ঝরায়। আরশ সেই অশ্রু হাতে নিয়ে বলে, ‘বোতলে নিয়ে যাই? তুমি জমা করে রেখো। গিয়ে ফ্রিজে রেখে দিব যেন কখনো না শুকায়।’

লুকমানের অভিমান কমে না। আরশ কখনো লুকমানের অভিমান ভাঙানোর জোর চেষ্টা করেনি। প্রতিবার সে দুটো কথা বলে চলে আসতো, ‘আব্বু সরি।’ কিন্তু এবার যেন সে ছোট্ট বাচ্চা হয়ে গিয়েছে। সবসময় লুকমানের পিছে শিশুর মতো লেগে থাকে। লুকমান যখন রাগ করে বলেন, ‘শুনোনি বাপের কথা। এবার এই চাকরিই তোমাকে পরিবার ছাড়া করছে। থাকো দূরে! তুমি তো পরিবার চাও না। শুধু একা একা থাকবে বলেই এই চাকরি নিয়েছিলে, তোমার চাল আমি বুঝি না নাকি?’

আরশ তখন মিটমিটে হাসি হেসে বাবার পাঞ্জাবির এক কোণ ধরে বলে, ‘আমাকে আইসক্রিম এনে দাও না আব্বু। আর একটা চিপস।’

এসব দেখলে লুকমানের চোখে জল চলে আসে। ছেলেটার বয়স যখন তিন থেকে চার বছর, তখন এমন আবদার কত করেছে! তখন তিনি বকতেন। এখন বকা আসে না। বকতে গেলেই গলা ধরে আসে। ভাঙা কণ্ঠে বলেন, ‘অসুস্থ শরীরে আবার ঠান্ডা জিনিস খাবে। আমানের মা! দেখো তোমার ছেলে কী বলছে…’

তারপর তিনি মুখ লুকাতে রান্নাঘরে চলে যান নাজিফার কাছে। আরশ হেসে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। সেদিক থেকে কোনো কথা ভেসে আসে না। আসবে কীভাবে? রান্নাঘরে দুজন স্তব্ধ কান্না কাঁদছে।

আমান অবশ্য স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। বাবার ব্যবসার একটা অংশ আমান পরিচালনা করে। এক অংশ আরশের। আরশ সেটা ভাইকে দিয়ে দিতে চাইলে আমান বলে, ‘উহু, তুই যতদিন না বিদেশে একটা ভালো পর্যায়ে যাবি, ততদিন তোর ভাগের ব্যবসার টাকায় চলবি।’

– আমিই তো থাকছি না। আমার অংশের ব্যবসা কে চালাবে?
– এটা কেমন কথা বললি আরশ? আমি থাকতে তোর কিসের চিন্তা?

আরশ হেসে বললো, ‘তুমি আমার ভাই। তোমাকে আমি আমার অংশ পুরোটা দিলাম। বিদেশে গিয়ে চাকচিক্যময় অবস্থায় থাকতে চাই না। সাধারণ জীবনযাপন করবো। যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু উপার্জন করবো ইন শা আল্লাহ।’

আমানের সাথে ব্যবসা ছাড়াও আরো অনেক গল্প করে আরশ। ছোটবেলার স্মৃতি, কিশোর বয়সের গল্প, এমন নানান বিষয়ে তারা একান্ত আলাপ জমিয়ে তোলে। ফাতিহা একবার আমানের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী দেখে দুআ করে, ‘জান্নাতে যেন সবাই একসাথে থাকি হে আল্লাহ!’

মুয়াজ আর মুসআবকে নিয়ে আরশের অবসর সময় কাটে। তাদের সাথে বসে ক্বুরআন তিলাওয়াত করা, নবীজির জীবন কাহিনী গল্প আকারে বলা, মজার ছড়া বলা- এসব কাজের মাঝে কেটে যায় সুন্দর মুহূর্তগুলো। একবার আরশ মুয়াজকে বিছানায় গড়াগড়ি করতে দেখে রিশতাকে বলে, ‘আমাদের কবে হবে?’

রিশতা মুচকি হেসে উত্তর দেয়, ‘আল্লাহ যেদিন চাইবেন।’

_____

দুই একদিনের মাঝেই আরশের বিদেশ যাত্রা শুরু হবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরশ একাকী সময় কাটাচ্ছে। এ বাড়িতে কত স্মৃতি জমে আছে! রিশতা তার কাছে গেল না। এ সময়টা একান্তই আরশের।

বিকেল উপভোগ করে মায়ের কাছে গেল আরশ। নাজিফা ইস্তেগফার করছেন। ছেলেকে দেখে বললেন, ‘কিছু বলবি?’

আরশ বিছানায় শুয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে বললো, ‘গল্প বলবো।’

নাজিফা চুপ করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আরশ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ অনুভব করলো। তারপর বলে উঠলো, ‘পনেরো বছর বয়সে হজে গিয়েছিলাম। তুমি তখন আমাকে রেখেই দৌড়ে ক্বাবার সামনে চলে গিয়েছিলে। আমি অবাক হয়েছিলাম তোমার কাণ্ডে। আমার হাত ধরে আব্বু হেসে উঠেছিলেন আর বলেছিলেন, তোদের মা কেমন বাচ্চা মেয়েদের মতো করছে!’

নাজিফা হাসলেন। আরশ মুচকি হেসে আবার বললো, ‘তারপর হজের সব কৌশল সেরে যখন ফিরে আসবো, তখন খুব কষ্ট হয়েছিল। মনে হয়েছিল, আমার বুকের মধ্য থেকে হৃদপিন্ড ছিঁড়ে বের করছে কেউ। এখানে হৃদপিন্ড রেখে আমি বাংলাদেশ যাচ্ছি। কিশোর ছিলাম, অনুভূতি গাঢ় ছিল। আমান ভাই যখন আমাকে খুব কাঁদতে দেখলেন, প্রশ্ন করলেন, কাঁদছিস কেন? উত্তর দিলাম, এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করছে।’

নাজিফা আনমনে সেসময়টা ভাবছেন। যেন তিনি অতীতে চলে গিয়েছেন। সাদার মিছিল, মাঝে কালো আবরণে ঘেরা বাইতুল্লাহ। সমস্বরে সবাই বলছে, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক!’

– আমার উত্তর শুনে আমান ভাই বললো, ‘পাগল, এখানে থাকতে ইচ্ছে সবারই করে। কিন্তু বাস্তবের কাছে হার মানতে হয়। তুই ছোট বলে বুঝতে পারছিস না। আবেগ দিয়ে ভাবছিস। কিন্তু বড় হলে বুঝবি, সবসময় আবেগকে প্রশ্রয় দিতে হয় না। এখন তোর থাকতে ইচ্ছে করছে। এটা আবেগ, বাস্তবতা নয়। সুযোগ হলে আবার আসবো এখানে ইন শা আল্লাহ। সবাই মিলে আসবো।’

নাজিফা বললেন, ‘তুই কি বলেছিলি?’

– আমি কিছুই বলিনি। ভাইকে সামনে এগিয়ে যেতে দেখলাম। ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে দেখলাম। মনে মনে বললাম, আবেগ হোক আর যাই হোক! আমি এখানেই থাকবো। তুমি আমাকে এখানেই রেখে দিও আল্লাহ!

নাজিফার দু চোখ বেয়ে দু ফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো। আরশের কপালে এক বিন্দু অশ্রু স্পর্শ করলে সে চোখ খুলে মায়ের দিকে তাকালো। এক হাত দিয়ে মায়ের গাল ছুঁয়ে পৃথিবীর সব থেকে দামি জল হাতে নিয়ে বললো, ‘সেবার মক্কা মদিনায় রাখেননি আল্লাহ। কিন্তু দুআ ঠিক কবুল করেছিলেন। তাই তো ত্রিশ বছর বয়সে এসে ফিরে যাচ্ছি রাসূলের দেশে।’

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here