#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,০৪,০৫
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪
‘ এসব তোকে কে বলেছে?আমরা কেন সুযোগ নিতে যাবো বল?ভুল বুঝছিস তুই। পুরো পরিবার তোকে ঠিক কতটা ভালোবাসে এটা তোর অজানা নই ভাই৷ ‘
আয়ুশের কাঁপা কাঁপা কন্ঠ কটাক্ষ করে তূর্য বলে উঠল,
‘ তাহলে তুই বলছিস বিয়ে টা মিথ্যে? আমি মিথ্যে শুনেছি?’
‘ এসব কে বলেছে তোকে?’– আয়ুশের চিন্তাগ্রস্ত স্বর।
তূর্যর অধর কার্নিশ জুড়ে বাঁকা হাসি। নিরলস ভঙ্গিতে বললো,
‘ তোর কি এখনও আমাকে চেনা বাকি আছে?যেই তূর্য জীবনের একেকটা হিসেব সঠিক রাখে,সে তার জীবনের অনেকগুলো বছর অজ্ঞাত,ভারসাম্যহীন কাটিয়েছে, সেই অবস্থায় কি করেছে কিংবা জীবনে কি ঘটে গিয়েছে তার খবর জানবে না?জানতে চেষ্টা করবে না বিন্দুমাত্র?মস্তিষ্ক হতে কয়েকটা বছরের স্মৃতি মুছে গিয়েছে কিন্তু আমার স্বভাব,চরিত্র পাল্টে যায় নি। কোনো খবর জানা আমার কাছে খুব বড় কিছু না। তবে সবাই লুকিয়ে রেখে বেশ ভালো অভিনয় করেছিস। সবার অভিব্যক্তি এমন যেন আমার জীবনে কিছুই পরিবর্তন হয় নি। ধোঁ’কা’য় রাখলি আমাকে। সত্য কোনোদিন গোপন থাকে না আয়ুশ। কেন আনলি তোরা আমার জীবনে আরো একটা স্বার্থ/পর? ‘
আয়ুশ সূক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব করলো। ক্ষীণ স্বরে আওড়ালো,
‘ সবাই অহমিকা নই ভাই। সময় মানুষের জীবনের মোর পাল্টে দেয়। পরিস্থিতি পদক্ষেপ ফেলতে বাধ্য করে। কখনও কখনও সাত রংধনুর রঙের মতোন জীবন রঙিন করতে চাইলেও সেই সাদামাটা, শুভ্র থেকে যায়। সবই সময়ের খেল। নয়ত একটা বার ভেবে দেখ,যেই অহমিকা একদিন তোর হৃদয় ক্ষ*তবি*ক্ষত করেছিল, সেই মেয়েই আজ তোর ক্ষতে মলম লাগিয়েছে। সুস্থ করে তুলেছে তোকে। সবাইকে স্বার্থপর ভাবিস না। এক পাল্লায়ও মাপিস না। ‘
‘ স্বামী পাগল বলেই তো মেয়েটা পালিয়ে গিয়েছিল তাই না?’
‘ হয়ত কারণ টা ভিন্ন। ‘
তূর্য ম্লান হাসল। চায়ের কাপটা রেখে সোফায় গা এলিয়ে বলে,
‘ ভিন্ন নয়। মেয়েটা বড়লোক বাড়ির ছেলে শুনে বিয়েতে রাজি হয়েছিল। যেই না জানল স্বামী পাগল পালিয়ে চলে গেল। সুন্দর হাসবেন্ড চাইছিল। পাগলের সাথে সেক্রিফাইস করে সংসার করার মতোন মেয়ে আদৌ আছে?পৃথিবীর সবাই নিজের স্বার্থ বুঝে। এই ধর মা আমাকে এত চোখে হারায় কিন্তু কেন?এইখানে আমার মা’য়েরও স্বার্থ নিহিত। ভালোবাসার স্বার্থ। তেমনই অহমিকা ও ওই মেয়েটাও নিজের স্বার্থ বুঝেছে। মেয়েটা পাগলের সঙ্গে থেকে ধুকে ধুকে ম’র’তে চায় নি। আর অহমিকার ফিরে আসা?ও শুধু মানসিক রোগীর ডাক্তার হিসেবে আমার চিকিৎসা করেছে। এখন আমার প্রতি কনসার্ন এসব কেবল আমাকে পাওয়ার জন্য। ভালোবাসে নি কখনও আমাকে,বাসলে ছেড়ে যাওয়া টা কঠিন হতো। অন্যমুখো হতে তার বিবেকে বাঁধত। এখন যখন নদীতে তরী ডুবেছে আমার সান্নিধ্যে পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। আমি ওর করুণা নেই নি। আমার জানা মতে আমার ট্রিটমেন্টের জন্য ফুল পেমেন্ট করা হয়েছে। এন্ড ফারদার ওই মেয়ের নাম নিবি না। ‘
এটুকু বলে তূর্য চুপ হয়ে গেল। সুঠাম দেহখানি সোজা করে সামনের দিকে অল্প ঝুঁকে বসল। ফকফকা সাদা মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
‘এখন আমি জাস্ট আমার বউকে চাই। সংসার করবো না, যে মেয়ে নিজ স্বার্থে পালিয়ে গিয়েছিল তার সাথে আমার সংসার হবে না। মনে মনে ঘৃণা জন্মেছে তার প্রতি। ভালোবাসায় কনভার্ট হওয়ার নো চান্স। শুধু চিনে রাখতে চাই,দেখতে চাই। আই ওয়ান্ট টু সি হার। তুই ওকে দেখেছিস না?চিনিস নিশ্চয়ই? ‘
আয়ুশ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কল্পনায়ও আসে নি তূর্য এত জলদি বিয়ের কথাটা জেনে যাবে। আয়ুশ লুকিয়েছে তার কারণ আছে। তাছাড়া মেহরিমা চৌধুরী বাড়ির সবাইকে বলে দিয়েছে বিয়ের কথাটা যেন চিরতরে মন, মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলে সবাই। বিয়ে নামক বিষয়টা কখনও তূর্যর কান অব্দি না পৌঁছে তাতে ক’ড়া আদেশ জারি করেছেন। তাহলে কেমন করে জানল?কে বলল?তূর্য সুস্থ মস্তিষ্কে থাকলে শ্রেয়সীর মতো মেয়েকে কখনও বিয়ে করত না। মেহরিমা চৌধুরীও চায় নি শ্রেয়সীকে পুত্রবধূ করে আনতে। শুধুমাত্র ফাতেমা চৌধুরীর চাপে পড়ে এমনটা হয়েছে। এখন স্বয়ং ফাতেমা চৌধুরীও শ্রেয়ার নামটা পর্যন্ত শুনতে চায় না। যেখানে মেয়েটাকে সকলে ঘৃণা করে কি লাভ তাকে অতীতের কাঠগড়ায় টেনে এনে আবারও কষ্ট দিতে!আয়ুশ চাই না শ্রেয়সী কষ্ট পাক। বিয়েটাতে ঘোর অমত ছিল ওর। কোনো এক সময় এই মেয়েই কেঁড়েছিল তার রাতের ঘুম। তৎপরে কিছুদিন ভেবে চিন্তে সেই ভালো লাগার অনুভূতি মাটি চাপা দিয়ে দেয়। শ্রেয়ার সুখী জীবন চায় সে, জল ভরা চক্ষু অবলোকন করতে চায় না কোনো কালে। আবার ভাইয়ের সুন্দর জীবনও তার প্রত্যাশা। এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। এতে হয়ত কারো কারো চক্ষুশূল হবে ও। তবুও যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতেই অনড়,অটল থাকবে। তূর্য কে আর অপেক্ষা করালো না। ক্রমাগত অস্থির কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আমি জানিনা ভাই৷ ওই মেয়ের ব্যাপারে কিছুই জানি না৷ এক দেখায় কে কাকে মনে রাখে?আমার মেমোরাইজিং এতো ভালো নয় যে একবার দেখেই তোর বউয়ের চেহারা সারাজীবন চোখের পাতায় ভাসমান থাকবে। ভার্সিটি থেকে এসেছি,খুবই টায়ার্ড। রাখছি। ‘
এক প্রকার কথা কাটিয়ে ফোন রেখে দিল আয়ুশ। তূর্য মোবাইলের স্ক্রিনে চেয়ে থাকল কিয়ৎক্ষণ, কয়েক সেকেন্ড। কল লিস্টে ঢুকে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো। রিসিভ হতেই সোজাসাপ্টা প্রশ্ন তার,
‘ মাদার ইনফরমেশন দিয়েছেন? ‘
‘ দিতে বাধ্য স্যার। আপনাদের এতিমখানা। তবে,,
তূর্যর মুখভঙ্গির পরিবর্তন ঘটলো। কপালে বলিরেখার ভাঁজ স্পষ্টত। বিরক্ত প্রকাশ করে বললো,
‘ তবে?’
‘ মেয়েটার ব্যাপারে যা তথ্য সংরক্ষণ করে রাখা ছিল সব আপনার মা মানে মেহরিমা ম্যাম নষ্ট করে ফেলেছেন। ‘
‘ হোয়াট?মা কেন এমন করলো?জাহানারা খাতুন মানে মাদার নেই? ওনি সব জানবেন৷ ‘
‘ মাদার গত হয়েছেন বছর ফুরিয়ে এসেছে স্যার। তবে মেয়েটার একটা ছবি পেয়েছি। ছবিটা ছোট বেলার। বয়স আট নয় হবে তখনকার। এছাড়া আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করি নি। নতুন যেই মাদার এসেছেন তিনি সঠিক তথ্য দিতে পারছেন না। আপনার বলা হুমায়রা নামেই খোঁজ করেছি। আপনি বললে এতিমখানার অন্যান্য লোক কিংবা বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করে দেখি?’
‘ তার আর প্রয়োজন নেই। পিকটা সেন্ড করো। ঢাকা গিয়ে বাকিটা দেখব আমি। অনেক হিসেব-নিকেশ রয়ে গেল সবার সাথে। বাই। ‘
ফোন টা কাটতেই ম্যাসেজ টিউন বেজে উঠে। দ্রুত হাত চালিয়ে হোয়াটস অ্যাপে ঢুকল তূর্য। চক্ষু আরশিতে ভেসে উঠল একটা বাচ্চা মেয়ের মুখশ্রী। মাথায় তালগাছ। ছোটবেলায় এক ঝুটি দেখলেই সেটা তালগাছ বলে অভিহিত করে তূর্য। আয়ুশীকে কত জ্বালিয়েছে। বলত,তোর মাথায় তালগাছ উঠেছে। মেয়েটা তখন কেঁদে কেঁদে সব ভাসিয়ে দিতে উদ্যত হতো। তূর্যর বুকে এসে জড়িয়ে ধরে বলত- ভাই এসব বলো না, আমার দুঃখ লাগে। বোনকে আজ বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে তূর্যর। বড় হয়ে আয়ুশী একদম নিশ্চুপ স্বভাবের হয়ে গিয়েছে। প্রয়োজন ব্যাতীত কথা-ই বলে না।
তূর্য ছবিটা বড় করে চোখ গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। মনের পাতায় আঁকল। ভীষণ চেনা চেনা লাগছে ওর। আরেকটু গভীর চক্ষে চাইতেই মুগ্ধতা ফুটে উঠল নেত্রদ্বয়ে। মস্তিষ্কের বিরোধিতা করে মনকে জিতিয়ে দিল কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য। আনমনে বলে উঠল,
‘ আমার পিচ্চি বউ। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে দেখছি আপনাকে এক পলক দেখার নিমিত্তে। পাগল বলে ছেড়ে চলে গেলেন? একটু থেকে সঙ্গ দেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা ছিল বুঝি?’
____________
এপার্টমেন্টের ছাদে হইচই। তীব্র,প্রকটভাবে গানের শব্দ কর্ণকুহরে হনহন করে ঢুকছে। শ্রেয়া কতক্ষণ কপালে হাত রেখে বসে রইল। গত দু’দিন ধরে তার জীবনটা আবার এলোমেলো,অবিন্যস্ত। কিছুই ভালো হচ্ছে না৷ ওই তূর্য লেকচারার আসার পর মনে হচ্ছে তিক্ততা,বিষাদ শব্দগুলো কেবল ওর জন্য প্রযোজ্য। আজও লোকটা ওকে ক্লাসে অপমান করেছে। মুখের ওপর ঝামটা মে’রে দিয়েছে একদম। একটা বিক্রিয়া লিখতেই তো ভুল করেছিল সেকি তিক্ত বান মেরেছে! পুরো ক্লাসের সামনে নিজের চিরাচরিত গম্ভীর স্বরে বললো-‘ বিক্রিয়া গুলে খাবেন,নয়ত কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়া ছেড়ে দিন। ‘ একটু আকটু ভুল হতেই পারে। এই লোক ওকে সহ্যই করতে পারে না যেন।
‘ শ্রেয়া দেখ তোর জন্য লাল শাড়ি এনেছি। ঝটপট রেডি হ বোন,নয়ত রিয়া আবার এসে ডেকে যাবে। তুই কি চাস বেচারি নিজের হলুদ ফেলে তোকে ডাকতে আসুক?’
শ্রেয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। প্রিয়ুর হাতে লাল শাড়ি দেখে ভিতর জ্বলে উঠল। শাড়ি!তিন বছর আগে যে শাড়ি পড়েছিল সেটাই ছিল শেষ পড়া। বধূবেশে টকটকে লাল শড়িতেই তো প্রতীক্ষায় ছিল মানুষটার। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে শ্রেয়ার। ধরা কন্ঠে শুধালো,
‘ আমি যাবো না প্রিয়ু। তুই যা। ‘
সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে রইল প্রিয়ু। জহুরির ন্যায় পরখ করে বললো,
‘ কি হয়েছে শ্রেয়া?এত বছর ধরে এখানে আছি। রিয়ার সাথে কত আড্ডা দিয়েছি। এখন যদি না যাই ওর খারাপ লাগবে। একটা বার দেখা দিয়ে আয়। আর অবশ্যই শাড়ি পড়ে। সবাই সুন্দর করে সেজেগুজে যাবে,তুইও যাবি। ব্যাস!’
আপত্তি করলো না আর শ্রেয়া। শাড়ি হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। নিমেষে ফর্সা মুখে লালের আভা ছড়িয়ে পড়ে। বাধাহীন ঝরতে থাকে অশ্রুকণারা। কি হতো সেদিন মেহরিমা চৌধুরী ওকে ফিরিয়ে নিলে?ভুল কি মানুষের হয় না?ও তো চেয়েছিল ফিরে যেতে। নিজের অনুভূতিদের ঠুনকো হতে দিতে চায় নি। বিধস্ত চেহারায় দাঁড়িয়েছিল পুনর্বার চৌধুরী বাড়ির বিশাল গেটের সামনে কিন্তু ফিরিয়ে দিল ওকে সেই বাড়ির কর্ত্রী। শক্ত কন্ঠে বলেছিলেন –‘ যে মেয়ে আমার ছেলেকে ফেলে একবার চলে গিয়েছে তুচ্ছ করে,তার পদধূলি এই বাড়িতে কখনও পড়তে দিব না আমি। ‘
_________
শ্রেয়া দরজায় তালা লাগিয়ে সিঁড়ির কাছে এলো। শাড়ি পড়ে হাঁটতে অভ্যস্ত নয় ও। সেই কবে পড়েছিল। প্রিয়ু ওকে আসতে বলে ছাদে চলে গিয়েছে। ওখানেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। আরম্ভ হয়ে গিয়েছে ইতমধ্যে। রাত তো আর কম হয় নি। যখন ঘর হতে বেরিয়ে আসছিল তখনই আখিঁদ্বয়ে আটকায় ঘড়ির কাটা দশের ঘরে। তন্মধ্যে একবার রিয়ার ছোট ভাই মিহান এসে ডেকে গিয়েছে। শ্রেয়া আর দেরি করলো না। দ্রুত পায়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলো ও। দু-এক সিঁড়ি পেরোতেই আকস্মিক শাড়িতে পা বেজিয়ে দেহ হেলে গেল পিছনের দিক। ভয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটা দিয়ে উঠল তাৎক্ষণিক। কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। তখনই ওর ভয়ের মাত্রা কমিয়ে দুটো বলিষ্ঠ, পেশিবহুল হাত কোমর জরিয়ে ধরে। বুকের অতি নিকটস্থে টেনে নেয় সমগ্র কায়া। ভারী,গাঢ় নিঃশ্বাস অবলীলায় ছুঁয়ে দিচ্ছে শ্রেয়ার গলা,ঘাড়। নিঃশ্বাসের গভীর ছোঁয়ায় হৃদস্পন্দন চক্রাকারে বৃদ্ধি পেয়ে যায়। কেঁপে কেঁপে উঠে অজ্ঞাত ব্যাক্তির স্পর্শে সমস্ত দেহ,মন। জাগতিক চিন্তা, দুশ্চিন্তা ভুলে গিয়ে শ্রেয়া পড়ে থাকে উন্মুক্ত কোমরে বন্দী দু’হাতের মালিকের প্রশস্ত, শক্তপোক্ত বক্ষে। ভেতর-বাহির উভয় দিক হতেই এ মুহুর্তে প্রচন্ড ভীত সে। নিমিষেই ওর সকল ভয়,কল্পনা বিলুপ্ত করে দিয়ে ওকে টেনে হিঁচড়ে বাস্তবে নিয়ে এলো বুকে ঠাঁই দেওয়া লোকটার বিরক্তিকর কন্ঠস্বর। শ্রবণগ্রন্থির অত্যন্ত নিকটে মুখ এনে মানুষ টা বলে উঠল,
‘ এত তর্ক করতে পারো অথচ শাড়ি পড়ে হাঁটতে পারো না?’
#চলবে,
#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৫
‘ মাগুরার একটা প্রবাদ আছে– হয় দ্যাখে চোপা, নয় দ্যাখে খোপা। তোমার তো দেখি দু’টোই আছে। এতো গুণবতী, রূপে -গুণে,চোপায়। তাহলে শাড়ি পড়ে হাটতে গিয়ে ও’ষ্টা খাও কেন?’
কোমরে আবদ্ধ হাতের মালিকের ফিচেল,ব্যাঙ্গাত্মক স্বর শ্রেয়ার কর্ণে ঝা ঝা করে উঠলো। অ’পমা’ন! পরিহাসের কটু/ক্তি! শ্রেয়া তৎক্ষনাৎ মানুষটার হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ঝিম ঝিম করে উঠে সমস্ত গা,অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। পিছু ফিরতেই দেখে সেই মানুষ, সেই চাহনি। তীক্ষ্ণ, তুখোড় দৃষ্টিপাত করে রেখেছে। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা। তাগড়া শরীরে জড়িয়ে রেখেছে সবুজ রঙা পাঞ্জাবি। শ্রেয়ার ইচ্ছে হলো কপাল চাপড়াতে। কেন?কেন ঘুরে ফিরে সকল দুর্দশায় এই লোক হাজির হয়ে যায়?যখনই আসে তখনই কোনো না কোনো দূর্ঘটনা ঘটে। আর লোকটাও সুযোগ পেয়ে লুফে নেয়। অতঃপর শুরু করে উপহাসের বাক্য। শ্রেয়া তর্কে জড়াতে চাই না তাই এক সাইডে দাড়িয়ে বলতে চাইল,
‘ দেখেন,,’
ওকে বলতে না দিয়ে তূর্য পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে বলে উঠল,
‘ দেখেছি। লাল ব্লাউজ, লাল শাড়ি পড়েছেন। নট ব্যাড। তবে আপনাকে আরো গাঢ় দৃষ্টিতে দেখায় নিষেধাজ্ঞা আছে আমার। পরে বউ জানলে রাগ করবে। নেক্সট টাইম সাবধানে থাকবেন,নয়ত কোমর ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকার প্রস্তুতি টা অগ্রিম নিয়ে রাখবেন। ‘
বউ?শ্রেয়া আহাম্মক বনে গেল। প্রবল আগ্রহ ধরে রেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপনার বউ আছে?’
তূর্য সবে সিঁড়িতে এক পা দিয়েছিল। পাশ ফিরে না চেয়েও প্রতুত্তর করে,
‘ মনের বউ। মনে মনে আমার একটা বউ আছে। ‘
কি অদ্ভুত কথা বার্তা! শ্রেয়ার মনে হচ্ছে এই সুদর্শন পুরুষ আস্ত বড় একটা পাগল। এক তো নিজে যেচে সাহায্য করে আবার উল্টোপাল্টা কথা বলে। মেজাজ দেখায়। রগচটা স্বভাবের এমন পাগল খুব কম দেখেছে শ্রেয়া। কিন্তু স্পর্শ! শ্রেয়ার পুরো শরীরে শিহরণ জাগিয়ে তুলেছে মানুষটার ছোঁয়া। ঘৃ’ণাও হচ্ছে অন্য কারো হওয়া সত্ত্বেও কেন পরপুরুষের স্পর্শ গায়ে মাখবে?অনাকাঙ্ক্ষিত বলেই মেনে নিল। তূর্য চলে যেতে নিলে ডেকে উঠল আবারও, উদ্দেশ্য তূর্যর দৃষ্টিতে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করা।
‘ স্যার!’
তূর্য এবার চরম বিরক্ত হলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইল শ্রেয়সীর পানে। তখনও শ্রেয়া দেয়ালের এক পাশে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে স্থির। তূর্য ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে যেতে গিয়েও সরালো না। পুনরায় মেয়েটার দিকে তাকালো। গাঢ় দৃষ্টি, একরাশ বিস্ময়। বললো,
‘ কি বলবে?ধন্যবাদ? লাগবে না। বার বার ডেকে বিরক্ত করবে না একদম।
কথাটা তীরের মতোন গিয়ে বিঁধল শ্রেয়ার বক্ষস্থলে,অন্তরে। ও কি বিরক্ত করছিল?কারো কটুকথা,ধমক সহ্য হয় না ওর। রাগে,জেদে প্রতিবাদ করে বললো,
‘ধন্যবাদ দিতাম। তার আগে এটাও বলতাম আমি ইচ্ছে করে শাড়িতে পা বেজিয়ে পড়ি নি। শাড়ি আমি সামলাতে জানি। আট বছর বয়সে নিজের জীবন সামলে নিতে জেনেছি,শাড়ি আরকি!শুধু অভ্যস্ত নই বলে একটু আকটু বিপাকে পড়তে হয়। তাছাড়া বিপদ বলে কইয়ে আসে না,তাড়াহুড়োয় পড়ে যেতে নিয়েছিলাম। শুধু শুধু সকল সত্যতা যাচাই বিহীন কাউকে তিরস্কার করবেন না। ‘
কথাগুলো বলে এক মুহুর্তও স্থির রইল না শ্রেয়া। গলা প্রচন্ড কাঁপছিল। তূর্য নির্নিমেষ চেয়ে থাকল ওর যাওয়ার দিক। স্পষ্ট দেখেছে সে মেয়েটার অশ্রুসিক্ত আঁখিদ্বয়,পল্লব ছুঁয়ে যাওয়া এক ফোঁটা নোনতা জল। তূর্য এত মাথা ঘামাল না। পাঞ্জাবির পকেট হতে মোবাইল বের করে গ্যালারিতে প্রবেশ করে। সেই ছোট্ট মেয়েটার পিক সামনে এনে ভ্রঁ উঁচিয়ে বললো ,
‘ আপনিও কি এভাবে কাঁদেন? মেয়েটার কান্নারত মুখটা বেশ মোহনীয় ছিল। খারাপ মনে কিংবা মুগ্ধ হয়ে বলি নি। নরমালি মানুষ যেটাকে চোখের দেখায় সুন্দর বলে সেভাবেই বললাম। যদি তুমি এমন করে কাঁদো, বিশ্বাস করো চেয়ে চেয়ে আমার চোখ জ্বলসে যাবে তবুও এর অন্ত হবে না। ভালোবাসি না তোমাকে স্বার্থ/পর মেয়ে,তবে আমার একটা বউ আছে শুনেই হৃদয়ে টান অনুভব করি। কেন এলে একটুখানি সময়ের জন্য আমার অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে?খুবই ধারালো অ/’স্ত্র তুমি মেয়ে। অদৃশ্য থেকেও আ-ঘাত করতে খুবই দক্ষ। ‘
ছাদে মানুষের সমাগম,গানের উচ্চআওয়াজ। একপাশে বিশাল বড় করে স্টেজ করা হয়েছে। এই বিল্ডিংয়ের ছাদ টা বেশ বড়সড়। আজ যার গায়ে হলুদ সে হলো বিল্ডিংয়ের মালিকের একমাত্র মেয়ে। ছেলেও আছে দু’জন তবে মেয়ে একজনই। শ্রেয়া তেমন কাউকে চিনে না। সব বাড়িওয়ালার আত্মীয় স্বজন। প্রিয়ুকে খুঁজতে বারংবার চারপাশে চাইতেই চোখে পড়ে মেয়েটা একপাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছে। হয়ত আয়ুশের সাথে। মানুষের ভিড়ে আর চেনা কাউকে না পেয়ে একপাশে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল শ্রেয়া। স্টেজের দিকে চক্ষুজোড়া নিক্ষেপ করতেই দেখল রিয়া লজ্জামাখা চেহারা নিয়ে বসে আছে হলুদের সাজে। কয়েকটা মেয়ে ওকে ঘিরে ধরে বসে আছে। ফিসফিস করে কি যেন বলছে আর লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে পড়ছে ও। শ্রেয়ার বুকটা কেঁপে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। ঠাহর করে ফেলল রিয়ার মনের অবস্থা, ভাবনা-চিন্তা। ঠিক একদিন ও এমন পরিস্থিতিতে ছিল। মনে ছিল শত শত স্বপ্ন, অনুভূতি। নিমিষেই শ্রেয়ার ফর্সা মুখে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। ওষ্ঠদ্বয় নড়ে উঠলো ক্ষীণ,
‘ আমার অনুভূতিদের আগলে রাখার মানুষ টার দেখা মিলেও মিলল না। ‘
তূর্য সামনে দিয়েই যাচ্ছিল। শ্রেয়ার বিষাদমিশ্রিত,আক্ষেপের স্বর উচ্চআওয়াজেও তার কর্ণগোচর হতে বাধাপ্রাপ্ত হয় নি। থামল সে। শ্রেয়া নতমস্তকে দাঁড়িয়ে। তূর্যর মনে হচ্ছে মেয়েটার অনেক কষ্ট। কিন্তু কিসের?দিব্যি ভালোই তো ঘুরছে,ফিরছে,পড়ছে। ছাত্রী হিসেবেও মন্দ নয়। তাহলে মেয়েটা হুটহাট এমন নিশ্চুপ হয়ে যায় কেন?চোখে মুখে কষ্টের ছাপ প্রতীয়মান হয়। প্রেমঘটিত সমস্যা নই তো?হতে পারে। নিশ্চয়ই প্রেমিকের কাছ থেকে ছ্যাঁকা খেয়েছে। তূর্য আর দাঁড়াল না। অন্য কাউকে মায়া দেখিয়ে লাভ নেই। এখন ওর মূল লক্ষ্য বউ খুঁজে বের করা,সেই মেয়ের মুখশ্রীটা কিছু সময়,একবারের জন্য হলেও চোখের পাতায় চিরতরে বন্দী করা।
শ্রেয়া তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ তুলে তাকালো। প্রিয়ু ও রিয়ার আম্মু হাসি মুখে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। প্রকৃতি যেহেতু স্বাভাবিক ও অনুকূলে তাহলে সে কেন নিজের মুখ কৃষ্ণ আঁধারে ঢেকে রাখবে?ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। সূক্ষ্ম,মুগ্ধময় হাসি। ওর সেই হাসির দিকে চেয়ে কারো নজর আঁটকে গেল এক লহমায়,নিমেষে।
‘ শ্রেয়া এখানে কি করছো?চলো। রিয়ার শশুর বাড়ির লোকজনও এসেছে। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম নতুন কুটুমদের সাথে কিন্তু তোমরা রয়ে গেলে। ‘
রিয়ার আম্মুর ব্যবহার অত্যধিক ভালো। অনেক সুন্দর করে কথা বলেন। বিল্ডিংয়ের সবার সঙ্গে অতিশয় সখ্যতা ওনার। কে বলবে তিনি এত বড় একটা এপার্টমেন্টের মালিকের বউ!কোনোকিছুতেই অহং-কার নেই। শ্রেয়া বিনয়ী স্বরে বলে উঠলো,
‘ চলুন আন্টি। ‘
সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল শ্রেয়া ও প্রিয়ুকে রিয়ার মা। রিয়ার শশুর বাড়ির লোক বেশ প্রভাবশালী। শুনেছে এখানকার একজন কাউন্সিলরের ছেলে রিয়ার হবু জামাই। বরপক্ষের একজন মহিলা তূর্যকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ এই ছেলেটা কে?’
তূর্য চেয়ারে বসে মোবাইলে মগ্ন হয়েছিল। মিশু নামের একটা মেয়ে বার কতক ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রথমে একটু কথা বললেও মেয়েটা সাবলীল কন্ঠ ছেড়ে কেমন উদ্ভট কথা বলতে শুরু করলো। তাই যথাসাধ্য চেষ্টা চালালো তূর্য এড়িয়ে যাওয়ার। পাত্তা না পেয়ে মেয়েটা ওর পাশের চেয়ারে বসে পড়ল ধপ করে। সাথে সাথে তূর্য উঠে দাঁড়াল। মেয়েটাকে ঠাটিয়ে চড় মারতে পারলে ভিতরে যেই অগ্নিশিখার উৎপত্তি হয়েছে তা নিভে যেত। এত বেহা’য়া,নাছোরবান্দা সে দেখে নি। না এখানে আর থাকা যাবে না। থাকলেই এই মেয়েকে ছাদ থেকে ফেলে দিতে হাত কাঁপবে না তার।
তূর্যকে এদিকে আসতে দেখে রিয়ার আম্মু অধর প্রশস্ত করে জানালো,
‘ উনি আমাদের নতুন ভাড়াটিয়া। পেশায় ভার্সিটির লেকচারার। ‘
ততক্ষণে তূর্য এসে দাঁড়িয়েছে। মস্তিষ্কে রাগ তড়তড় করে বেড়ে চললেও কন্ঠস্বর নরম,নম্র,
‘ আন্টি আমি চলে যাচ্ছি। কিছু মনে করবেন না,মাথা ব্যাথা করছে। ‘
রিয়ার আম্মু তড়িঘড়ি করে বলে,
‘ একটু থাকলে হয় না বাবা?সবেই তো এলে। ‘
বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে এলো তূর্যর। তবুও ভদ্রতা বজায় রেখে মাথা নেড়ে বললো ,
‘ আচ্ছা। তাহলে আরেকটু থাকি আন্টি। ‘
বরপক্ষের সেই মহিলা টা খুশি হলেন যেন। নিজের মেয়েকে ডেকে আনলেন। তূর্য, শ্রেয়া,প্রিয়ু সুস্থির দৃষ্টিতে চাইল। শ্রেয়ার মনে হচ্ছে মহিলা টার একটু বেশিই আগ্রহ তূর্যর প্রতি। আড়চোখে, তীররেখা নজরে তাকালো ও তূর্যর দিক। সহসা ধরাস করে কেঁপে উঠল হৃদযন্ত্র। থরথর করে তরঙ্গ খেলে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। চোরা দৃষ্টি যে ওকে চো’র সাব্যস্ত করবে ভাবতেই পারে নি। তূর্যর চোখে চোখ আঁটকে গিয়েছে। তড়িৎ গতিতে অন্যদিকে ফিরে তাকালো ও। গম্ভীরমুখো লোকটা কি ভাবছে ওকে?কেন চাইতে গেল?ভদ্র মহিলা গলা খাকাড়ি দিয়ে বলে উঠলেন,
‘ আমার মেয়ে মিশু। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। ‘
‘ জ্বি। চিনি আপনার মেয়েকে,আমি যেই ডিপার্টমেন্টে কর্মরত সেখানেই পড়ছে। ‘–তূর্যর নির্লিপ্ত জবাব।
‘ তা তুমি কি বিয়ে নিয়ে ভাবছো বাবা?মানে ভাবির কাছ থেকে শুনলাম তুমি এখানে সিংগেল থাকো। তোমার পরিবার থাকে ঢাকায়। একজন সঙ্গী হলে ভালো হয় না?’
মহিলার মধুর বাক্য বুঝতে সময় ব্যয় হয় নি শ্রেয়া ও প্রিয়ুর উভয়ের। শ্রেয়ার রীতিমতো হাসি পাচ্ছে। শেষে কি-না রগচটা স্যার বিয়ের প্রস্তাব পেতে যাচ্ছে। ওর সেই হাসির পানে তূর্য তীর্যক নজরে চেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে সম্মুখে নিবদ্ধ করলো। অকস্মাৎ বলে বসল,
‘ আমি একদম পিওর বিবাহিত আন্টি। ‘
এটুকু শুনে থমকে গেল সবাই। হতভম্ব, নির্বাক। শ্রেয়া হকচকালো, বিমূঢ়তায় বাকহারা সে। সত্যিই বিবাহিত?মা ও মেয়ের মুখে কালো মেঘ নেমে এসেছে। এক্সকিউজ মি বলে জায়গা ছাড়ে তূর্য। ছাদের এক কর্ণারে এসে দাড়ায়। প্রিয়ু শ্রেয়াকে টেনে এনে সেখানে উপস্থিত হলো। আমতা আমতা করে ডাকল,
‘ স্যার। ‘
তূর্য কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বললো,
‘ ভার্সিটিতে আমি তোমার স্যার,বাহিরে আমি তোমার জন্য ভাই প্রিয়ু। ভাই ডাক টা ভুলে গিয়েছ নাকি?’
নিস্তব্ধ শ্রেয়া। অবিশ্বাস্য চক্ষে তাকালো একবার প্রিয়ুর দিক তো আরেকবার তূর্যর গম্ভীরমাখা চেহারায়। প্রিয়ু ও তূর্যর কথোপকথন ওর বোধগম্য হচ্ছে না। মস্তিষ্ক ফাঁকা, ফাঁকা। তবে এতটুকু বুঝতে পারছে দু’জন পূর্বপরিচিত। তাহলে প্রিয়ু কেন বলে নি আগে? বড্ড অভিমান হলো শ্রেয়ার। চলে যেতে নিলে প্রিয়ু হাত চেপে ধরলো,তা তূর্যর দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। ভ্রুঁ কুঁচকে প্রশ্ন করে,
‘ এনিথিং রং মিস অর মিসেস শ্রেয়া?’
প্রিয়ু দ্বিরুক্তি করে বললো,
‘ মিস অর মিসেস?’
তূর্য স্বভাবসুলভ কন্ঠে বলে উঠল,
‘ ম্যারিড নাকি আনম্যারিড জানিনা তো তাই। ‘
‘ ভাইয়া ও,,’
হাত চেপে বাঁধা দিল শ্রেয়া। তূর্য সচকিত নয়ন তাক করে বলে,
‘ কি হলো?’
শ্রেয়া ভড়কে গেল। উত্তরে বললো,
‘ কিছু না স্যার। ‘
‘ তুমি প্রিয়ুর সাথে থাকো?’
মাথা নাড়ালো শ্রেয়া। অর্থাৎ, হ্যাঁ। তূর্যর এ মুহুর্তে সমুখে দাঁড়ানো লাল টুকটুকে শাড়ি পরিধান করা মেয়েটার সম্পর্কে জানার ব্যপক আগ্রহ জন্মাচ্ছে। প্রিয়ুর কাছ থেকে জেনেছে শ্রেয়া আর ও বেস্টফ্রেন্ড। প্রথমে তূর্য জানত না ওদের পাশের ফ্ল্যাটেই শ্রেয়া থাকে। শুধু জানত প্রিয়ু থাকে। তাই সেদিন প্রিয়ুর বাসায় শ্রেয়াকে দেখে চমকে গিয়েছিল। তূর্য নিজেদের নিরবতা কাটিয়ে দৈবাৎ প্রশ্ন করে,
‘ তোমার বাড়ি কোথায় শ্রেয়া?’
এত সময় অবধি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও এহেন প্রশ্নে শ্রেয়ার মাথা নত হয়ে গেল। যখনই কেউ এই প্রশ্নটা করে মনে হয় ম’রে গেলে কাউকে বলতে হবে না জীবনের চরম সত্যটা। তবুও সত্য তো সত্যই। শ্রেয়া চায় না নিজের পরিচয় লুকাতে। নিজেকে ধাতস্থ করে শক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আমার বাড়ি নেই স্যার। আমি এতিম। ‘
পা ভেঙ্গে আসতে শুরু করল বুঝি!শাড়ি আঁকড়ে ধরে ছুটে চলে গেল শ্রেয়া। দাঁড়ানোর মতো শক্তি হয়ত অবশিষ্ট রইল না মেয়েটার মন,দেহে। প্রিয়ুও চলে গেল ওর পিছু পিছু। তূর্য খানিকটা ব্যথিত হলো মেয়েটার বেদনামিশ্রিত স্বরে। তবে খুবই ক্ষীণ সময়ের জন্য, তার স্থায়িত্ব থাকে নি বেশিক্ষণ।
.
.
‘ তূর্য ভাইয়া আয়ুশের ভাই। তাছাড়া ওনাকে আমি ছোট থেকেই চিনি। তোর জানার বাহিরে নই এটা বাবা ও আয়ুশের আব্বু খুবই ভালো বন্ধু। সেখান থেকেই ওই বাড়ির মানুষজনদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। বিয়ের প্রস্তাব টাও আয়ুশের বাবা দেয়। তূর্য ভাইয়াকে লেকচারার হিসেবে দেখে আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। আমি জানতাম না উনিই আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের সেই লেকচারার। পরে আয়ুশকে জিজ্ঞেস করায় জানতে পারি। তারপর কথা হয়। উনি বেশ গম্ভীর, রগ/চটা স্বভাবের ছোট থেকেই। আয়ুশের থেকে অনেক জেনেছি ওনার ব্যাপারে। চাকরিরত স্থানে পরিবারের গল্প কিংবা ভাব এসব ওনার পছন্দ না। কেউ অপ/রাধ করলে ছাড় দেন না। সে ব্যাপারে অনেক স্ট্রিক্ট তিনি। প্রফেশনের বাহিরে ওনার ব্যবহার ততটা খারাপ নই। আমি তোকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তুই কেন নিজেকে এতিম বলতে গেলি শ্রেয়া?আমি আব্বু,আম্মু কেউ হয় না তোর?এত বছরেও আমাদের আপন করতে পারলি না?’
‘ তুই না থাকলে আমার মাথার উপর ছাদ থাকত না। তাই বলে এই না যে আমি এতিম এই শব্দটা আমার জীবন থেকে মুছে যাবে প্রিয়ু। সত্যি বলতে কিসের শরম?’
শ্রেয়ার ধারলো কথা শুনে প্রিয়ু হাল ছেড়ে রুম ত্যাগ করলো। বিছানায় চুপটি মেরে বসেছিল শ্রেয়া। হাঁটুতে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো। প্রিয়ুর প্রতি অভিমান সরে গিয়েছে। কিন্তু!মাথা চারা দিয়ে উঠেছে আবারও সকল ক’ষ্ট,না পাওয়ার অতৃপ্ততা। সবকিছু কঠিন কেন তার জীবনে?সহজলভ্য হতে পারল না?এভাবেই দুঃখে দুঃখে মর’ণ কাল বুঝি ঘনিয়ে আসবে?
_____________
আজও লেকচারার তূর্য চৌধুরীর ক্লাস টা হবে না একজন দপ্তরি এসে জানিয়ে গেলেন। গত তিনদিন ধরে এটাই শুনছে শ্রেয়া। সেই রাতের পর তূর্যকে প্রিয়ু ও সে কেউ দেখে নি। হুট করে মানুষ টা গায়েব হয়ে গেল। সেই সাথে দরজায় ঝুলিয়ে যায় বড় একটা লোহার তালা। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শ্রেয়া মিনমিন করে,
‘ কোথায় উধাও হলেন স্যার?’
#চলবে,,,!