সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,০৮,০৯

0
1187

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,০৮,০৯
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৮

‘ স্যার আপনি এখানে?’
শ্রেয়া বিস্ময় লুকিয়ে ধীরস্থির ভঙ্গিতে, নম্র গলায় প্রশ্নটা করলো। তূর্যর মুখভঙ্গি ঠিক ঠাহর করতে পারছে না সে। দুই নেত্র ঢেকে আছে কালো সানগ্লাসে। কিন্তু বুঝতে চাইছে। কারণ কারো দৃষ্টি না বুঝে সামনে আহাম্মকের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকাটা ওকে ভীষণ অস্বস্তিতে ভোগায়। ভিতরে ভিতরে নিদারুণ যন্ত্রণার সৃষ্ট করে। এখনও ঠিক এমন হচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। হাঁটু মুড়ে সড়কে বসে যেতে ইচ্ছে করছে। বড় বড় শ্বাস মুক্ত হচ্ছে প্রকৃতিতে নাসারন্ধ্র গলিয়ে। এসবের জন্য দায়ী একমাত্র গাড়িতে বসে থাকা সুদর্শন পুরুষ তূর্য স্যার। কেমন নিরবতা পালন করছে লোকটা! শ্রেয়া একবার ভাবল আবারও প্রশ্ন করবে কি-না। কিন্তু ওকে আর কষ্ট করতে হয় নি। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে তূর্য নিজের অপর পাশের দরজা মেলে দিল। গম্ভীর স্বরে বললো,
‘ কাম ইনসাইড শ্রেয়সী। ‘

তব্দা খেয়ে গেল শ্রেয়া। প্রথম প্রশ্নের জবাব নেই, অন্য কিছুও বললো না, একদম সোজা গাড়ির মধ্যে ঢুকে যেতে বলছে!স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এক পাও এদিক সেদিক করলো না। ওর সেই নির্লিপ্ততা দেখে তূর্য রেগেমেগে বললো,

‘ তুমি কি বয়রা?কানে শুনো না?গাড়িতে আসো। প্রিয়ুদের বাসায় যাবে। একসাথে যাই?’

শ্রেয়া তড়িৎ গতিতে নত মস্তক তুলে চাইল। চমকিত কন্ঠস্বর তার,
‘ আপনাকে কে বললো আমি প্রিয়ুর বাসায় যাবো?’
তূর্য বিস্তর হাসলো। সাবলীল কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ গাধা তুমি হতে পারো আমি নই। ‘
কথাটা শ্রবণ নালিতে পৌঁছানোর সাথে সাথেই শ্রেয়া ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে তাকালো। ‘ গাধা?’ গাধা বলে সংজ্ঞায়িত করলো ওকে?এই ছেলে ওকে ব্যাঙ্গ না করলে কি শান্তি পায় না?কোনো স্যার নিজের স্টুডেন্টের সাথে এমন করে?শ্রেয়ার মানসপটে মুহুর্তেই উদয় হলো স্যার ছাত্রীকে গাধা বলতেই পারে। তবুও মানতে নারাজ সে। কিন্তু স্বভাবতই চুপচাপ, নিরব চরিত্রের অধিকারীণি সে।

ছোট থেকেই শিখেছে কেউ কেটে ফেললেও নিজের নিশ্চুপ চরিত্র দিয়ে মানুষটাকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমি আপনার মতোন উগ্র নই। আট বছর বয়সে এতিমখানায় এসে একা একা এতগুলো বছর পার করা সহজ ছিল না। বরঞ্চ কঠিনসাধ্য ছিল। প্রতিনিয়ত মধ্যরাত্রিতে ফুপিয়ে উঠা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। চক্ষু আয়নায় ভেসে উঠত মা’য়ের বিভৎস রক্তাক্ত লা’শ টা,বাবার নিজ থেকে করা সেই আত্ম/হত্যা। খালা,ফুপি কারো বাড়িতে ঠাঁই না পেয়ে পুরো এক রজনী ছোটোখাটো এক ভাঙ্গাচোরা চায়ের দোকানে প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে বানানো ছাউনির নিচে কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। সেই রাত টা কি সুন্দর ছিল?উঁহু! মোটেও না। এক দানব খুব’লে খাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছিল। ক্রমশ এগিয়ে এসে স্পর্শ করতে চেয়েছিল রাতের গুটগুটে আঁধারে। আট বছর বয়সী সেই বাচ্চা মেয়েটা নিজের পবিত্র অঙ্গে কারো লো*লুপ দৃষ্টি আটকাতে ব্যর্থ হলেও ছোঁয়া হতে নিজেকে রক্ষা করেছে। মদ*খোর মাতাল ব্যক্তির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ছুটতে ছুটতে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল আজকের চেনা এই এতিমখানার দুয়ারে। হাত পা কেটে রক্ত ঝরছিল,ছোট ছোট চুল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল জল। গায়ের সাদা জামাটা কর্দমাক্ত হয়ে এলোমেলো, বি’শ্রী অবস্থা। সারাদিন না খেয়ে শরীর হেলে পড়ে সড়কে,উঠতে চেয়েও আর পারে নি।

একটা বয়স্ক লোককে দৌড়ে আসতে দেখে ও হাত বাড়ায়। পরক্ষণেই ছোট্ট মস্তিষ্কে হানা দেয় ওই লোকটার মত করে এই লোকও ওর দেহে বাজে স্পর্শ মাখিয়ে দিবে হয়ত। শেষ রক্ষা পাবে না ভেবে কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বরে অস্ফুট ডেকে উঠে মা বলে। দু চোখের পাতা এক হয়। নতুন এক ভোরে আবিষ্কার করে নিজেকে এতিমখানার কোনো এক কক্ষের চার দেয়ালের মাঝে।

গাড়ির হর্ণের তীব্র আওয়াজে শ্রেয়া নড়েচড়ে উঠলো। দৃষ্টি মেলে তাকালো তূর্যর দিক। মনে পড়লো তূর্য তো আয়ুশের ভাই। আজ তো ওদের প্রিয়ুদের বাড়িতে যাওয়ার কথা। শ্রেয়ার তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো রাশেদা বলেছিল প্রিয়ুর শশুর বাড়ির কে নাকি সরষে ইলিশ ভীষণ পছন্দ করে,এতিমখানা থেকে ফিরে যেন সে রেঁধে দেয়। কারণ প্রিয়ু মা’য়ের কাছে ওর সরষে ইলিশ রান্নার এতই প্রশংসা করেছে সবাই চায় শ্রেয়সী আজকের মতোন বিশেষ একটা দিনে এটা রান্না করুক। মেহমান সব এসে গিয়েছে হয়ত। শ্রেয়া ভাবলো এখন দ্রুত যেতে হবে,তূর্য যখন সাধছে সুযোগ টা কাজে লাগানো উচিত। কিন্তু আবার কেমন যেন অনুভব হচ্ছে। তূর্যর সান্নিধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি জাগ্রত হয় মন মাঝারে। অনুভূতিরা হৃদয়স্থলের পুরো পথ ধরে ছোটাছুটি আরম্ভ করে। মনে পড়ে, পরপুরুষের সন্নিকট তার নিষিদ্ধ। আনতস্বরে বললো,
‘ আমি অটোরিকশা ধরে চলে যাবো স্যার। আপনি যান। ‘
তূর্যর রাগে চোয়াল ফুলে উঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
‘ আর একটা কথা বললে গাড়ি দিয়ে ধাক্কা মে’রে হসপিটালাইজড
করবো। ‘

শ্রেয়া ভড়কে গেল। চক্ষুদ্বয়ের আকার বড় হয়ে এলো। হুট করেই গলায় শুষ্ক অনুভব করে তূর্যর এহেন ক্রোধান্বিত স্বরে। মনে হলো এই দাঁতে দাঁত চেপে বলা স্বর পরিচিত। অতীব পরিচিত। কিন্তু সঠিক মনে করতে পারলো না শ্রেয়া। কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠে চুপচাপ ভঙ্গিমা বজায় রেখে। পাশের সিটে বসা পুরুষকে ভয়মিশ্রিত স্বরে ডাকে,
‘ স্যার। ‘
‘ বলো শ্রেয়সী। ‘
আবারও শ্রেয়সী ডাক?শ্রেয়ার অন্তঃস্থলে কম্পন ছড়িয়ে পড়ে। কেন তূর্য ওকে এই নামে ডাকে?সবাই শ্রেয়া ডাকে তাহলে স্যারও কেন ছোট করে ডাকে না?শ্রেয়সীই কেন ডাকতে হবে তার?তাও আজ মিস অর মিসেস বিহীন?শ্রেয়া যখন চিন্তাভাবনার অতল সাগরে নিমজ্জিত তখনই তূর্য ওকে ডাঙায় টেনে তুলল। বললো,

‘ মিস অর মিসেস ডাকতে ডাকতে মুখ ব্যাথা গয়ে গিয়েছে। ভাবলাম সম্পর্কে তুমি আমার ছাত্রী। ছাত্রীর জন্য মিস অর মিসেস সম্বোধনের প্রয়োজন বোধ করছি না আর। এখানে কি করছিলে?’

গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে তূর্য প্রশ্ন করে। শ্রেয়া সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছাড়লো। ভেজা কন্ঠে প্রতি উত্তর করলো,
‘ এতিমখানায় এসেছিলাম স্যার। ‘
তাৎক্ষণিক তূর্য ঘাড় বাঁকিয়ে এতিমখানার মরিচা আক্রমণ করা লোহার গেইট টার দিক নজর নিক্ষেপ করলো। ভ্রুঁ যুগল কিঞ্চিৎ ললাট ছুঁয়ে গেল নিমেষে। শ্রেয়ার উদ্দেশ্যে লহু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুমি এখানে থাকতে?’
শ্রেয়া বাহিরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে স্মিত হাসে। বলে,
‘ জ্বী স্যার। ‘
‘ তুমি জানো এটা কার মালিকানাধীন? ‘
মাথা নাড়ায় শ্রেয়া। মোলায়েম কন্ঠে বললো,
‘ চৌধুরী বাড়ির। ফাতেমা চৌধুরীর নামে এটা। ‘

তূর্যর অধর কার্নিশ জুড়ে সুপ্ত হাসি। এটা যে ওদের এবং ফাতেমা চৌধুরী ওর দাদি সেটা শ্রেয়া জানেনা সেটা বুঝতে পারলো। কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালানোতে মন দিল সে। শ্রেয়া জানালার দিকে মুখ করে ভাবনায় মগ্ন। ওকে তূর্যর সঙ্গে দেখলে মানুষ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে, মিথ্যে রটাবে। তাই বাড়ি থেকে কিছু দূরত্বে নেমে পড়তে হবে। তাছাড়া সামনে দিয়ে যাওয়া যাবে না,এতে ঘরভর্তি মেহমানের মুখোমুখি হতে হবে নিশ্চিত। যাদের কখনও দেখে নি,চিনে না তাদের সাথে অকস্মাৎ একদম সম্মুখে পড়ে যাওয়ার ব্যাপার টা বড্ড বেশি পীড়া দেয়। এক্ষেত্রে শ্রেয়া ঠিক করলো ও প্রিয়ুদের বাড়ির পিছন দরজা দিয়ে ঢুকবে।

পুরো রাস্তা কারো সাথে কারো কথা বার্তা বিনিময় হয় নি। শ্রেয়া নিস্তব্ধ থাকলেও ইচ্ছে ছিল অঢেল, স্যারের সাথে পড়া সম্পর্কিত কথা বলার। চুপ করে থাকা টা স্যারকে অসম্মান করা ঠেকছিল ওর নিকট। কিন্তু তূর্যর গাম্ভীর্য,কঠিন মুখোভঙ্গি চক্ষে বিঁধতেই যা বলবে ভেবেছিল তা যেন খোলা গগণপথে পাড়ি জমিয়েছে। অবশেষে প্রায় মিনিট বিশেক পেরিয়ে এলো প্রিয়ুদের বাড়ির নিকটস্থে। শ্রেয়া মাথায় ঘোমটা টেনে দ্রুত গতিতে বলে উঠলো,

‘ স্যার গাড়ি থামান। ‘
গাড়ি থেমে যায়। শ্রেয়ার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায় তূর্য। দৃষ্টি প্রশ্নসূচক। তা চোখে পড়তেই শ্রেয়া আমতা আমতা করে বলে,
‘ আসলে আমি পিছন গেইট দিয়ে যাবো। ধন্যবাদ আপনাকে স্যার। আল্লাহ হাফেজ। ‘
বাক্যগুলো উচ্চারণ করে এক মিনিটও স্থির থাকল না শ্রেয়া,গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল অবিলম্বে। একটি বার ফিরে পর্যন্ত তাকালো না মেয়েটা,কিছু বলার সময় কিংবা সুযোগ কোনোটাই দিল না অপর মানুষটাকে। তূর্যর কপালের শিরা উপশিরা ভেসে উঠলো। চোখ দুটো জ্বলে উঠলো দপদপ করে। হাত মুঠো করে বুঁজে ফেলল নেত্রদ্বয়। ক্রোধে আওড়ালো,
‘ বেয়া/দব মেয়ে। ‘
____________

প্রিয়ুদের বাড়ির কাঠামো ঠিক জমিদার বাড়ির মতোন। লম্বা করিডোর পেরিয়ে প্রিয়ুর রুমে যেতে হবে। দুই দিকে দু’টো সিঁড়ি। বসার ঘর এক তলার এক কর্ণারে। বেশ বড় বসার ঘরটা। ওইখান হতে বাহিরে কেউ চলাচল করলে অথবা রান্নাঘরে গেলে দেখা যায় না। কারণ লম্বা, প্রশস্ত দেয়াল আর দরজা একদম কর্ণারে। দরজায় না দাঁড়ালে এদিকটার দেখা মিলে না।

শ্রেয়া পিছন দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো। ওকে দেখে নতুন জামদানি শাড়ি পরিহিতা রাশেদা এগিয়ে এলেন। প্লেটে হরেক রকমের নাস্তা সাজাচ্ছিলেন তিনি ব্যস্ত হাতে। সাথে কাজের মহিলা ও প্রিয়ুর মামী। শ্রেয়াকে দেখে রাশেদা মুখ গোমড়া করে বললেন,
‘ এত দেরি করে এলি?এই বুঝি বান্ধবীর প্রতি ভালোবাসা? ও তোর জন্য এখনও রেডি না হয়ে বসে আছে। বলছে তোর সাথে তৈরি হবে। এর আগে তুফান হয়ে গেলেও নিচে নামবে না। অথচ ওর শশুর বাড়ির সবাই বসে আছে বসার ঘরে। তাড়াতাড়ি যা মা। ‘
‘ সরষে ইলিশ রাঁধব না আন্টি?’
‘ ওটা রাতে করিস। তোর কাকা বলেছে আজ জোর করে হলেও সবাইকে রেখে দিবে। প্রায় এক বছর পরে এসেছেন ওনারা। এখন যা।’
‘ আচ্ছা। ‘

শ্রেয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তারই পাশে উপরে যাওয়ার সিঁড়ি। আবার বসার ঘরের পাশ দিয়েও ধাপে ধাপে সিঁড়ি উপরের দিকে গিয়েছে। ওই পাশের সিঁড়ি বাছাই না করে রান্না ঘরের পাশের টা যাওয়ার জন্য বাছাই করলো শ্রেয়া। প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই ক’দিনের মুখস্থ স্বর কর্ণভেদ করলো। চক্ষু ফিরিয়ে তাকালো সেদিকে। তূর্য কানে মোবাইল ধরে গম্ভীর কন্ঠে কথা বলে চলেছে। শ্রেয়া নজর সরিয়ে নিল। চলে যেতে নিয়ে নিজের অজান্তেই আবারও দৃষ্টি গেল সেদিক টায়। নিমিষেই স্থবির হয়ে পড়ে,কারণ অপরপাশের ব্যক্তিও চেয়ে তার দিকে তীর্যক নেত্রে। কয়েক সেকেন্ডে থমকে গেলেও শ্রেয়া নিজেকে সামলে দ্রুতপদে ছুটে আসে প্রিয়ুর রুমে। এসেই মাথায় হাত। মেয়েটা গায়ে কালো একটা শাড়ি জড়িয়ে মুখে আঁধার নামিয়ে বসে আছে নিশ্চিন্তে। বুঝতে বাকি নেই, তীব্র রাগের ফল। শ্রেয়া ব্যাগ থেকে আকাশী রঙের এমব্রয়ডারি কাজ করা একটা থ্রি পিস বের করে ছুট লাগালো ওয়াশরুমে। গোসল সেড়ে বেরিয়ে আসতেই প্রিয়ু উঠে দাঁড়াল। শাড়ি ঠিক করে ওর কাজিনদের বললো জলদি মেকআপ করে দিতে। এতে হতবাক, হতভম্ব একেকজন। এই তো কিছুক্ষণ আগেও মেয়েটা রেডি হতে নারাজ অথচ এখন শ্রেয়া সেজেগুজে তৈরি হতেই কি ফুড় ফুড়ে মেজাজে সাজছে। এত ভালোবাসা বান্ধবীর জন্য!

রাশেদা তড়িঘড়ি করে এলেন। জানালেন– এখনই প্রিয়ুকে নিয়ে নিচে যেতে। আয়ুশ নিষেধ করে দিয়েছে শ্রেয়াকে যেন এখন মেহরিমা চৌধুরীর মুখোমুখি না করে,তাহলে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধতে মিনিট খানেক সময়ও ব্যয় হবে না। কথামতো নিল না নিচে ওকে। অন্যান্য কাজিনদের সঙ্গে নিচে গেল৷ ত্রিহা ওকে নিজের পাশে বসিয়ে কপালে চুমু খেলো। অত্যন্ত পছন্দ তার প্রিয়ুকে। ছেলের বউকে আদরে ভরিয়ে রাখবে নিজের সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। কিছুসময় প্রিয়ুকে বড়দের মাঝে রেখে একটা সময় ত্রিহা বললো আয়ুশ,তূর্য, আয়ুশী তোরা বাহিরে গিয়ে ঘুরে দেখ।

এতক্ষণ বড়দের মাঝখানে থেকে হাসফাস অবস্থা ছিল আয়ুশীর। মায়ের আদেশ পেয়ে চটজলদি প্রিয়ুর আঁচল ধরে বেরিয়ে আসল। আয়ুশ ও তূর্য গেল ছাঁদে। তন্মধ্যে প্রিয়ুর কাছ থেকে আয়ুশী চলে গেল ওর এক কাজিনের সাথে বাহিরে বাগানের দিকে। এটাই মুখ্য সুযোগ। “যতই কাছে যাবে ততই তো দূরত্ব ঘুচবে।” নিজের এই কথাটাই আমল থেকে শ্রেয়াকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে এলো ছাঁদে। আয়ুশ ও তূর্য ভার্সিটি বিষয়ক কথায় মশগুল ছিল,হুট করে ওদের হুড়মুড়িয়ে ছাঁদে প্রবেশ করায় চক্ষুদ্বয় চলে গেল ওদের দিক। তূর্য ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
‘ যা বউ নিয়ে ছাঁদের অপর পাশে কেটে পড়। ‘
আয়ুশ মাথা চুলকে হাসার চেষ্টা করলো। প্রিয়ুর কাছাকাছি যেয়ে উপস্থিত দু’জনের অলক্ষ্যে চোখ রাঙিয়ে হাত টেনে নিয়ে গেল ওকে ছাদের আরেকদিকে। এদিক হতে ওইপাশ দেখা যায় না। আয়ুশ রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো,
‘ শ্রেয়াকে এনেছ কেন লেট লতিফ? ‘

প্রিয়ু ফুঁসে ওঠে,
‘ আমি লেট লতিফ? আনবো হাজার বার আনবো। তাতে তোমার কি?কি একটু সময়ের দাম দেওয়া শিখেছে অমনি আমাকে লেট লতিফ ডাকে। এখানে কেউ আছে?ওরা যদি কাছাকাছি না আসে তাহলে তূর্য ভাই আমার শ্রেয়ুর মায়াময়ী রূপ কেমনে দেখবে?’
‘ কিন্তু! ‘
‘ কোনো কিন্তু না। আয়ুশীকে আমার এক কাজিন নিয়ে গিয়েছে। আর ছাঁদে কি মুরুব্বীরা আসবে?চিল চার চোখ লেকচারার। চিল।’
প্রিয়ুর কথায় ফিক করে হেসে দিল আয়ুশ। শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো ওর নরম দেহখানি। এই মেয়েটার মাঝে শান্তি খুঁজে পায় আয়ুশ। তার অশান্ত মন শান্ত করার একমাত্র উপায় হিসেবে কাজ করে মেয়েটা।

তূর্য নিষ্পলক চোখে দূরের রাস্তার দিকে চেয়ে আছে। প্রিয়ু এখানে এনে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দিবে টের পেলে ভুলেও পা বাড়াত না শ্রেয়া। পা দু’টো ফ্লোরে আঁকড়ে ধরে রোবট হয়ে যেত। তবুও আসত না৷ চলে যাওয়ার নিমিত্তে পা ফেলতেই কর্ণগোচর হয় তীক্ষ্ণ স্বরের প্রশ্ন,
‘ পাগলের মা’র খেয়েছেন কখনও?’
মুহুর্তেই থরথর করে কেঁপে উঠলো শ্রেয়া। সেই কাঁপুনি তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ে শিরায় শিরায়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। গ্রীষ্মকালেও বিনা বার্তায় শীতের আগমন ঘটলো যেন।

# চলবে,,,!

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৯

তূর্য রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে শ্রেয়ার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে চাইল। মেয়েটার ফর্সা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম তার চক্ষু এড়ালো না। কপালে বলিরেখার ভাঁজ ফুটে উঠলো। স্পষ্ট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি হয়েছে শ্রেয়সী?এদিকে এসো। ‘
শ্রেয়ার পা চলছে না। ছাদের মেঝেতে আটকে গেছে যেন দুই পা। দেহে অল্প পরিমাণ শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। গলা উঁচিয়ে বলতে চাইল–‘ স্যার আমি পাগল ভয় পাই। খুব ভয় পাই। আমাকে ডাকবেন না স্যার। ‘ কিন্তু দু অধর আলগা হলো না কিঞ্চিৎ মাত্র। মাথায় বারংবার জেঁকে বসতে শুরু করে বিবাহের প্রথম রাত্রের সেই বিষাক্ত স্মৃতিটুকু। মনে হলো এখনও দু’টো শক্ত হাত ওর গলা চেপে ধরেছে। হুংকার ছেড়ে বলছে–‘ খু*ন করবো তোকে। ‘
শ্রেয়ার শরীর কাঁপলেও মনটা শক্ত রাখার প্রয়াস চালালো। কতকাল কাটাবে এই পাগলের প্রতি ভয় নিয়ে? এই ভয়ই তো ওর জীবনের সকল সুখ কেড়ে নিয়েছে,নিঃস্ব করে দিয়েছে ওকে। সেদিন নববধূ বেশে স্বামী পাগল জেনে পুরোনো ক্ষত দগদগে নাহলে,ভয় কাজ না করলে কখনও এই শহর ছাড়তে হতো না। জীবন চিরকালের জন্য একা হয়ে যেত না। এই একটা ভয় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে ওর ভিতরটা। পুনর্বার ডাকলো তূর্য। সন্দেহাতীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনড়।

না কাউকে বুঝতে দিবে না শ্রেয়া নিজের দুর্বলতা। মনের জোরে এগিয়ে গেল তূর্যর দিকে। দাঁড়ালো মাঝে বিস্তর দূরত্ব রেখে। তাও অনায়সে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে দু’জনের কাছ হতে ভেসে আসা সুগন্ধী। একজনের ভেজা সিক্ত চুল থেকে শ্যাম্পুর কড়া গন্ধ, অপরজনের সুঠাম দেহ হতে পারফিউমের ঘ্রাণ। মিলেমিশে একাকার হয়ে দু’জনের নাসারন্ধ্র প্রবেশ করছে অবলীলায়।

হুট করে কেমন অনুভূত হলো শ্রেয়ার। দূরত্ব বাড়িয়ে দিল কিঞ্চিৎ। তূর্য তা অবলোকন করে হাসল। মৃদু হাসি। শ্রেয়া উন্মুক্ত অম্বরে একবার তাকালো। রোদের তেজে চোখ জ্বালা করে উঠলো ওর। চোখের মণিকোঠা জলে টইটুম্বুর হয়ে ওঠে। আবছা আবছা অন্ধকার ভিড় জমালো চারদিকে। শ্রেয়া বুঝতে পারে দিবাকর তার চাহনি পছন্দ করে নি। তাই তো রশ্মি ছুঁড়ে ভস্ম করতে চাইল ওর কাজলমাখা আঁখি যুগল।

তূর্য বাহিরে বের হলে পকেট টিস্যু রাখে নিজের সঙ্গে সর্বদা। শ্রেয়ার মুখভঙ্গি, পদক্ষেপ সবটাই সে লক্ষ্য করলো। একটা টিস্যু বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

‘ চোখের পানি মুছে নাও। ঠিক হয়ে যাবে। পরবর্তীতে ভুলেও আকাশের দিকে এমন করে তাকাতে যেও না। চোখের ক্ষতি হবে। তখন চাইলেও আপন কারো মুখ দেখার তৃষ্ণা কখনও মিটবে না তোমার। চোখ দুটো ভালো রাখো,হয়ত তোমার গাঢ় দৃষ্টিতে কারো ছবি আঁকা বাকি এখনও। ‘

তূর্যর কথা শুনে শ্রেয়া বিস্মিত হয়। কেমন রহস্যময় ঠেকল শেষোক্ত বাক্য টা। সত্যিই তো ওর অনেক তৃষ্ণা নিজের স্বামীর চেহারা টা এক নজর দেখার। কিন্তু তা কখনও পূরণ হবে না। শ্রেয়া এত বছরে এটাও জানতে পারল না কেমন আছে পাগল মানুষটা?সুস্থ হয়েছে কি?আর হলেও কি ওদের বিয়ের কথা জানে?এমন শত শত প্রশ্ন শ্রেয়ার মস্তিষ্কে কিলবিল করতে থাকে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। আর ভাবতে পারলো না শ্রেয়া। খুবই সতর্কভাবে তূর্যর হাত থেকে টিস্যু টা নিতে গেল। তবুও ঘটে গেল এক অসতর্ক কান্ড।

শ্রেয়া অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। তরঙ্গ খেলে গেল শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। টিস্যু নিতে গিয়ে ওর বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁয়ে দিল তূর্যর কনিষ্ঠ আঙুল। তূর্য স্পর্শ অনুভব দূরে থাক লাগেও নি এমন ভাব করে সামনের দিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। শ্রেয়া অতিশয় চমকে আড়ষ্ট। এত নির্লিপ্ততা!ক্ষণে,ক্ষণে মুখের আদল পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে এই লেকচারার।

‘ চোখ ঠিক হলে সামনে তাকাও শ্রেয়সী। ‘

সুবোধ বালিকার ন্যায় শ্রেয়া প্রিয়ুদের বাড়ির পেছনের রাস্তায় চক্ষু মেলে তাকালো। দুই পাশে সারি সারি বিভিন্ন কাঠের গাছ,মাঝে পিচঢালা রাস্তা। সেই রাস্তার কিনারায় জীর্ণ শীর্ণ দেহ,রুক্ষ ও অবিন্যস্ত চুলের, নোংরা কাপড় পরিধানকারী একজন লোক বসে আছে। সবচেয়ে অবাক কান্ড হচ্ছে সেই লোককে একদল বাচ্চা কাচ্চা ব্যাঙ্গ করছে লাগাতার,কেউ কেউ আবার পাথর নিক্ষেপ করছে। লোকটাও পাথর নিয়ে বাচ্চাগুলোর দিক ছুটে যাচ্ছে। এতেই ভো দৌড় বাচ্চাগুলোর। শ্রেয়া শুষ্ক কন্ঠনালি গলিয়ে বেরিয়ে এলো,

‘ পাগল!’
তূর্য নিরলস ভঙ্গিতে সায় দিয়ে বললো,
‘ তা-ই মনে হচ্ছে। তাই তো তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম কখনও পাগলের মা’র খেয়েছ কি-না। আমি একবার খেয়েছিলাম ছোট বেলায়। সময় টা তখন স্কুল জীবনের। ‘

বাসর রাতে স্বামী মা’রতে যাচ্ছিল আবার মা’র খেয়েছে কিনা!প্রশ্নটা শ্রেয়ার নিকট অত্যন্ত হাস্যকর ঠেকল। আবার বিস্তর হাসিও ঠোঁটে ফুটতে চাইছে তূর্য স্যারের পাগলের হাতে মা’র খেয়েছে শুনে। আগ্রহ নিয়ে বললো,
‘ তারপর কি হলো স্যার?’
তূর্য কপাল কুঁচকে তাকালো। তীর্যক নেত্রে চেয়ে বললো,
‘ তারপর আমি তোমাকে বলতে অনাগ্রহী। ‘

এত বড় অপমান? শ্রেয়ার ভীষণ রাগ হলো। কেন জিজ্ঞেস করতে গেল এই ছেলেকে। ও তো প্রথম দিন থেকেই জানত এই ছেলে নিজেই একটা পাগল। নয়ত সামান্য পানি পড়া নিয়ে স্যরি বলার পরও এত রিয়েক্ট করত নাকি!আজব লোক। শ্রেয়া চলে যাবে,আর এক মুহুর্তও থাকবে না এখানে। তূর্যর সান্নিধ্য মানে সেকেন্ডে, সেকেন্ডে শরীরে কম্পনের ছড়াছড়ি। অদ্ভুত হলেও এটা আচ করতে পেরেছে সে তূর্যর কথাবার্তা ওর অভ্যন্তরে দাফন করতে চাওয়া অতীতের স্মৃতি জাগ্রত করে,বাড়িয়ে দেয় ভয়ের মাত্রা। আর ভুলেও তার ধারে কাছে আসা যাবে না। আজ ওরা থাকলে সারাক্ষণ রুমে থাকার পণ করলো শ্রেয়া। নড়বে না এক পাও। এ মুহুর্তে এখান থেকে প্রস্থান ঘটাতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচবে। শ্রেয়া
সরব করে বললো,
‘ আসি স্যার। ‘

কথাটা বলে আবারও তূর্যর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। গটগট পায়ে ছাঁদের দরজা অব্দি আসতেই কর্ণ গহ্বরে পৌঁছালো তূর্যর ব্যাথাতুর আর্তনাদ। ‘ আহ!শব্দ শুনলো বিশদ। তবে তা খুবই ক্ষীণ ছিল। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও আর্তনাদে ঘুরে তাকালো শ্রেয়া। নিমেষে ওর হৃদয়ের গতি নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে পড়ে। মুখশ্রী রক্তশূণ্য, ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দিকবিদিকশুন্য হয়ে দৌড়ে এলো তূর্যর কাছাকাছি। হাত টা স্পর্শ করতে যেয়েও করলো না। সমুখের মানুষটার ফর্সা হাতের উপরিভাগ ছিলে রক্ত ঝরছে। হাত থেকে দৃষ্টি উপরের দিকে তুলল শ্রেয়া,তূর্যর মুখের পানে। উজ্জল চেহারাটা অনুজ্জ্বল, মলিন,বিবর্ণ। এই তো এখনই রৌদ্রজ্জ্বলে চকচকে করছিল মুখটা। শ্রেয়া আর্তস্বরে, বিচলিত কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ স্যার কিভাবে কাটল?রক্ত ঝরছে।’
‘ ঝরুক। ‘– নির্বিকার অভিব্যক্তি তূর্যর।
‘ ঝরুক মানে?পাগল আপনি?’
মৃদু চেচিয়ে উঠলো শ্রেয়া। তূর্যকে রেখে ছুটে এলো প্রিয়ুর রুমে। পুরো রুম তন্ন তন্ন করে ফাস্ট এইড বক্স টা খুঁজে বের করে পুনরায় ছুটল ছাঁদে। তড়িৎ গতিতে ছোটবার দরুন অবস্থা কাহিল ওর। এমনিতেই শরীর,মন দুটোই দুর্বল,শক্তিহীন। কাল থেকে অনবরত ছোটাছুটির উপর দিন রাত কাটছে। তাতেও শ্রেয়ার দুঃখ নেই। সকল কষ্ট মনের দুয়ারে এসে থেমে যায় ওকে দুর্বল রাখতে। যত চায় শক্ত নারী হতে,মন ততই ওর বিরোধিতা করে। এই যে এখন তূর্যর রক্তাক্ত হাত দেখে ওর মন খারাপ হচ্ছে।

ফাস্ট এইড বক্সটা তূর্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘ স্যার ব্যান্ডেজ করে নিন। ‘
তূর্য ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে শ্রেয়ার প্রস্তাবটা। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
‘ প্রয়োজন নেই। যাও এখান থেকে। ‘

শ্রেয়া এক চুলও নড়ে নি। নিশ্চল থেকে উসখুস করে বলে উঠলো,
‘ প্রয়োজন আছে। আপনার হাত থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। ‘
তূর্যর রাগের মাত্রা আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে বেশ জোরেই চেঁচিয়ে উঠলো,
‘ আমি বলেছি আমার সাহায্য লাগবে?আর কেমন সাহায্য করছো?ডান হাত কেটেছে। বাম হাতে ব্যান্ডেজ করতে পারবো?গাধা কোথাকার! ‘

শ্রেয়া বিমূঢ়তায় বাক হারা। খুঁত খুঁত করতে করতে এগিয়ে গিয়ে তূর্যর রক্তাক্ত হাত টা আলগাভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু সক্ষম হলো না সে। ওর অভ্যন্তর চিৎকার করে বাঁধা দিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ স্পর্শ করতে। কিছু বাঁধা মানতে নেই,বিশেষ করে যে বাঁধা অতিক্রম করলে পরোপকার হয়। সমস্ত ভালো-মন্দ, নিষেধাজ্ঞা দূরে ঠেলে একটুখানি! স্রেফ একটু স্পর্শ করলো হাত টা। কিন্তু তূর্য ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিল। কড়া গলায় বললো,
‘ একদম না। যাও তুমি। ‘
‘ এত রাগ ভালো না স্যার। ‘– শ্রেয়ার প্রতিবাদী কন্ঠস্বর।

শ্রেয়া ছাঁদের রেলিংয়ের উপর বক্সটা রাখল। নিজের হাত টা মেলে ধরে বললো,
‘ দিন স্যার। হাত টা দিন। রগচটা স্বভাব টা নাহয় পরে দেখাবেন। ‘

ততক্ষণে প্রিয়ু ও আয়ুশ উপস্থিত। তূর্য হাত টা রাখল শ্রেয়ার হাতের উপর। এমন দৃশ্য চক্ষে বিঁধতেই আয়ুশ ও প্রিয়ু একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি সেড়ে নিল। ইচ্ছে হলো না কাছে যেতে কিন্তু তূর্যর হাতে রক্ত দেখে নিজেদের আটকাতেও পারল না। আয়ুশ বিচলিত কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ কি হয়েছে ভাই?’
শ্রেয়া রক্ত পরিষ্কার করে সাদা ব্যান্ডেজ হাতে জড়িয়ে দিচ্ছিল,আয়ুশের ব্যগ্র স্বরে লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে গেল মুখ খানা। সমস্ত বদন লজ্জার আবরণে ঢেকে যায়। অপ্রস্তুত হাতে তূর্যর ব্যান্ডেজ কোনোমতে সেড়ে প্রিয়ুর পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। আয়ুশ হাত টা ধরতে নিলে তূর্য সরিয়ে ফেলল। নত মস্তকে থাকা শ্রেয়ার পানে চেয়ে রাশভারি গলায় বললো,
‘ স্পর্শ নিষেধ আয়ুশ। ‘
পরক্ষণেই গলার স্বর স্বাভাবিক করলো,
‘ দেখলে এভাবে দেখ,ধরার কি দরকার?’
তূর্য হাত নেড়েচেড়ে দেখালো। তার কার্যকলাপে হতবাক আয়ুশ। উদ্যোগী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কাটলো কিভাবে?’
ইশারায় পাশের লেবু গাছটা দেখায় তূর্য। ভালোই বড়সড় একটা গাছ। টব থেকে ডালপালা বেরিয়ে ছড়িয়ে আছে। কাটাগুলো অনেক বড় বড়। লেবুও ধরেছে অনেক।
‘ এটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ভুলবশত হাত গিয়ে লেগে গিয়েছে। আমি নিচে যাই। ‘
কথাটা বলে থামলো তূর্য। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে শ্রেয়ার দিকে তাকালো। স্থির, অবিচল দৃষ্টিতে। শ্রেয়া হকচকিয়ে যায়। কি মোহনীয় দৃষ্টি তূর্যর। সে চোখ সরিয়ে বেসামাল ভাবে এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। তূর্য দুর্বোধ্য হাসল। বললো,
‘ ধন্যবাদ আয়ুশের শালী সাহেবা। ‘

তূর্য চলে যেতেই প্রিয়ু হেসে মিনমিন করে বলে–‘ আয়ুশের শালী আপনের বউ দুলাভাই। ‘ বাক্যটা এতই নিচু স্বরে আওড়ালো শ্রেয়ার কর্ণপাত তো দূর ও বুঝতেই পারে নি প্রিয়ুর দুই ওষ্ঠ নড়ছে। সে তো অন্য চিন্তায় নিমগ্ন,নিমজ্জিত। খুব বেশি জোরে ঝাড়া না মারলে লেবু গাছের কাটায় হাত লেগে এত গভীরভাবে চামড়া ছিলে রক্তপাত হওয়ার কথা না। নিশ্চয়ই জোরে লেগেছে, আয়ুশের চিন্তা কমানোর নিমিত্তে হয়ত তূর্য ভুল বাক্য সাজিয়েছে। এটাই হবে।
________________

প্রিয়ু ফ্যাসাদে পড়ে গেল। রুমের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখে ওর রুমে আয়ুশী। শ্রেয়া ওর মায়ের রুমে গিয়েছে আপাতত রাশেদার ডাকে। এখন যদি শ্রেয়া ও আয়ুশী মুখোমুখি হয়ে যায়?ভেবেছিল যে করেই হোক আজ এদের ভাগিয়ে দিবে,আয়ুশও চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারলো কই?উল্টো ওর বাবা-মা ধরে বেধে রেখে দিয়েছে। আবার অন্যদিকে ভয় হচ্ছে মেহরিমা চৌধুরীর চোখে শ্রেয়া পড়ে যায় কি-না। খানিক বাদেই সবার দুপুরের খাওয়ার ডাক পড়বে। শ্রেয়াকে নিচে যেতে আটকাতে পারলেও,এখান থেকে গায়েব করা অসম্ভব ব্যাপার। চিন্তায় যখন মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম আয়ুশী বিছানা ছেড়ে টুপ করে চলে এলো ওর সামনে। ‘ভাবি’ ডেকে টেনে রুমে নিয়ে গেল।

শ্রেয়াকে ডেকে প্রিয়ুর আম্মু আয়ুশের জন্য বানানো আন্টি টা দেখালেন। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,
‘ এটা ভালো হবে না রে মা?প্রিয়ুকেও দেখাই নি। ওর তো আবার তোর পছন্দসই জিনিসই ভালো লাগে। তাই ভাবলাম তোকে একবার দেখাই। ঠিক আছে?’
‘ অনেক সুন্দর আন্টি। আমি এখন যাবো?’
‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ। আর শোন,একটু পরে লাঞ্চের জন্য ডাকা হলে প্রিয়ুকে নিয়ে নিচে চলে আসিস। মেহমান আছে ভেবে লজ্জা পাস না আবার। ‘
শ্রেয়া ঘাড় হেলিয়ে বলে,
‘আচ্ছা। ‘
ও রুম থেকে বেরোতে নিবে তার পূর্বেই প্রিয়ুর মামী রুমে ঢুকল। সাথে দুজন মহিলা। চেনা দু’টো মুখ দেখে ভূ-তল কেঁপে উঠলো শ্রেয়ার। তিন বছর!পাক্কা তিন বছর পর কিছু সময়ের পরিচিত হওয়া মানুষের চেহারা দেখল। শ্রেয়া হতভম্ব,কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সামনের মানুষ দু’জনেরও একই হাল। প্রিয়ুর মা হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললেন,
‘ আপনারা এখানে?শ্রেয়া ওনারা প্রিয়ুর শাশুড়ি ও চাচী শাশুড়ি।’
অকস্মাৎ কিছু সত্য সামনে এলে মেনে নেওয়া কঠিন সাধ্য হয়ে পড়ে। হারিয়ে যায় বাকশক্তি। ত্রিহা চৌধুরী শ্রেয়াকে কিছু বলতে যাবে তখনই ওনার হাত চেপে ধরে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মেহরিমা সকলের অলক্ষ্যে,অগোচরে।

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here