#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,১০,১১
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___১০
শ্রেয়া হতবাক। চোখ তুলে তাকাতে অব্দি পারছে না। মাথায় হাজারো রহস্য উন্মোচনের খেলা চলছে। প্রিয়ু পর্যন্ত জানে না ওর অতীত,চৌধুরী বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কের কথা তাহলে তার পরিবার জানবে কেমন করে! বুঝলো যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকতে হবে ত্রিহা ও মেহরিমা চৌধুরীর সামনে। তবে ওর ভিতরে তীব্র হতে তীব্রভাবে আক্রমণ করছে একটা কথা, একটা সত্য এবং তা হলো তূর্য স্যারই তার সেই পাগল স্বামী তূর্য চৌধুরী। পোশাক দ্বারা আবৃত পিঠ বেয়ে ঘাম নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। একটু আধটু ভিজিয়ে দিচ্ছে আকাশী রংয়ের জামা টাও। রাশেদা মেহরিমার দিকে চেয়ে হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
‘ আসুন আপা। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?আর ও প্রিয়ুর বান্ধবী, আমার আরেকটা মেয়ে। ‘
শ্রেয়ার চোখ ছলছল করে উঠলো। প্রিয়ুর মা’য়ের এই আপন পরিচয় দেওয়াটা ওকে বরাবরই অবাক করে। মনে হয় এই মহিলার ভালোবাসা টা ভেজাল বিহীন, কোনো প্রকার স্বার্থ লুকায়িত নেই। অথচ সামনে অতি দামী বেশভূষায় হাজির মানুষ টা সম্পর্কে ওর শাশুড়ী। যিনি একদিন ওকে চৌধুরী বাড়ির গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিল –‘ এতিম মেয়ে ঘরে তুলেছি ছেলের অসহায় জীবন দেখে কিন্তু তুমি আশানুরূপ কাজ করো নি। এই না যে আমি এতিমদের পছন্দ করি না কিন্তু তুমি আমার ছেলের অযোগ্য। তেঁতো হলেও সত্য পাগল হয়েও যে ছেলে তোমার দিকে চোখ তুলেও তাকায় নি, সুস্থ থাকলে ধারে কাছেও ঘেষতে দিত না। আর সেই তুৃমি কিনা সবার সামনে আমার ছেলেকে পাগল প্রকাশ করে তুচ্ছ করে চলে গেল। একবার গিয়ে দ্বিতীয়বার ফেরার মুখ তুমি রাখো নি। রূপা কেমন করে বুঝবে স্বর্ণের কদর!তুমি তো রুপাও হতে পারো নি। সবাই তোমাকে ক্ষমা করলেও আমি তোমাকে ক্ষমা করে ঘরে তুলব না। আমার ছেলে আমার প্রাণ, আর সেই প্রাণকে তুচ্ছ করেছো তুমি। ‘
শ্রেয়া কাল বিলম্ব না করে সালাম দিয়ে রুম ত্যাগ করে। রুম থেকে বেরিয়ে ছুটে যায় ছাঁদে। একপাশের দেয়ালে পিঠ এলিয়ে চোখ বুঁজে নেয়। নিমিষেই তপ্ত নোনতা জল গড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায়। নিরবে,নিঃশব্দে কান্না। কিছু দুঃখ,হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে পাওয়া খুশি মিলে অশ্রু রূপে ঝরছে। ভাঙা গলায় বললো,
‘ আপনি আমার স্বামী তূর্য স্যার?সুস্থ হয়ে গিয়েছেন আপনি?আমার এত কাছে ছিলেন কিন্তু আমি চিনতে পারি নি আপনাকে। শুধু মনে হতো আপনার সেই রোষপূর্ণ কন্ঠস্বর আমার পরিচিত। ‘
বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে শ্রেয়া থামলো। আঁখিদ্বয় বুঁজে রেখেই নিশ্চুপ সময় পার করতে থাকে। একটা সময় ম্লান হাসে মেয়েটা। নিজের মনকে বুঝায়–‘ উনি তো জানেনই না আমি তার বউ। ওনার কাছে আমি শুধু মাত্র ছাত্রী। তূর্য স্যারের ছাত্রী। ‘
যাকে না দেখেই কেবল নাম শুনে হৃদয়ের সন্ধি ঘটাতে চেয়েছিল শ্রেয়া আজ সেই মানুষটার মুখটা মনের ক্যানভাসে রঙিন হয়ে ফুটে আছে। শ্রেয়া তূর্যর এমনিতেই বলা একটা কথাকে কেন্দ্র করে মিনমিনে স্বরে আওড়ালো-‘ আপনার ছবি আমার দৃষ্টিতে আঁকা হয়ে গিয়েছে স্যার। তখন স্যার বলে আপনার কাটা হাত দেখে খারাপ লাগছিল আর এখন আমার স্বামীর রক্তাক্ত হাত মনে করে হৃদয় পুড়ছে। কি অদ্ভুত! এক লহমায় সবকিছুর কত পরিবর্তন। কিন্তু আপনাকে বোধহয় আমার পাওয়া হবে না। কখনোই না। ‘
কাজল লেপ্টে গিয়েছে। নেত্র কার্নিশ বেয়ে জল পরছে না। চিকন দু অধরে ম্লান হাসির আলিঙ্গনে চক্ষু জোড়া থামিয়ে দিয়েছে অশ্রু বিসর্জন। কি হবে এত কেঁদে? দিনের আয়ু ফুরিয়ে সন্ধ্যের আগমন ঘটবে তবুও শ্রেয়ার আশার প্রদীপ জ্বলবে না। কভুও না। তবে শ্রেয়া খুশি,অত্যন্ত শান্তি অনুভব করছে নিজের স্বামীকে চিনতে পেরে।
এটাই শূণ্য জীবনের প্রথম পূর্ণতা। সাদা ওড়না টার এক কোণা হাতে তুলে গালে লেগে থাকা ক্রন্দনের ছাপ মুছে নিল শ্রেয়া। এতে হিতে বিপরীত হলো মেয়েটার সঙ্গে। কাজল চোখের নিচ থেকে ছড়িয়ে গাল পর্যন্ত চলে এলো। বিধস্ত চেহারা টা নিয়ে ছাঁদের সিঁড়ি ভেঙে প্রিয়ুর রুমে চলে আসে। ওকে দেখেই ধ্বক করে উঠে প্রিয়ুর বুক। অনর্গল জিজ্ঞেস করতে থাকে,
‘ কি হয়েছে? মুখের এ অবস্থা কেন?তুই এতক্ষণ মা’য়ের রুমে ছিলি?’
‘ হ্যাঁ। আর মুখে কি হবে?’
‘ আয়নায় গিয়ে দেখ। ‘
শ্রেয়া আরশিতে চেহারার হাল দেখে আনমনে হাসল। হয়ত দুঃখের সাগরে ভেসে যাওয়ার কথা এ মুহুর্তে, উল্টো মেয়েটার হাসি পাচ্ছে। মুখে বললো,
‘ কাজল টা ছড়িয়ে গেছে। ধুইয়ে আসি। ‘
প্রিয়ু এতসময় দম আঁটকে বসেছিল। আয়ুশী খানিক মিনিট পূর্বেই বেরিয়ে গেছে। গেছে বললে ভুল হবে সেটা, বরঞ্চ মা ডেকে নিয়ে গিয়েছে লাঞ্চের জন্য। যাওয়ার সময় রাশেদা বলে গেলেন শ্রেয়াকে নিয়ে যেন বিনা বিলম্বে নিচে যায়। কিন্তু প্রিয়ু উত্তর দিতে পারল না। কোনোমতেই শ্রেয়াকে নেওয়া যাবে না। শ্রেয়া মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসতেই দ্বিধান্বিত চাহনি নিক্ষেপ করে বলে,
‘ নিচে যাবি খেতে?’
শ্রেয়া প্রতি উত্তর করতে পারল না তৎক্ষনাৎ। নিচে অন্য সদস্য থাকতে পারে চৌধুরী বাড়ির। এখন সে প্রস্তুত নয় বাকি সবার মুখোমুখি হওয়ার জন্য। আচ্ছা প্রিয়ু সব জানে?হুট করে শ্রেয়ার মাথায় খেলে গেল বিয়ের পরের দিনের সকালের কথা। রহিমা খালা বলেছিল লেকচারার ওর পাশে ছিল সারারাত। তূর্য তো পাগল ছিল,তার মানে সেই মুহুর্তে লেকচারার বলতে আয়ুশকে বুঝানো হয়েছে। আয়ুশ ওকে চিনে বুঝতে বাকি রইল না শ্রেয়ার। কোথাও প্রশ্ন থেকে যায়। বছর দেড়েক আগে যখন আয়ুশের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় প্রিয়ুর মাধ্যমে তখন কেন চিনেও অচেনা সেজেছিল?আয়ুশ কি প্রিয়ুকে বলে নি?প্রিয়ুর সঙ্গে দেখা হওয়াটা কাকতালীয় না-কি অন্যকিছু?কাকতালীয়-ই হবে নয়ত প্রিয়ু সত্যি টা জানলে ওকে ভুল করে হলেও মুখ ফস্কে বলে দিত৷ ওর জানামতে প্রিয়ুর পেটে কথা হজম হয় না৷ কিন্তু মানুষের কি এক রূপই কি থাকে?হতে পারে একেকজনের সাথে একেক রূপে ব্যক্ত করে নিজেকে। যা-ই হোক, আড়ালে যা থাকুক না কেন শ্রেয়া সিদ্ধান্ত নিল প্রিয়ুকে সব খুলে বলবে। তবে এখন মোক্ষম সময় নয়। তার আগে এখান থেকে চলে যেতে হবে। শ্রেয়া চায় না মেহরিমা চৌধুরীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কারণ হতে।
‘ নিচে গিয়ে খাবো না৷ তুই যা প্রিয়ু। আমি রুমেই খাবো। জানিস তো নতুন মানুষদের সাথে মিশতে অস্বস্তি লাগে। সেই জায়গায় খাবার নামবে গলা দিয়ে? তুই যা। ‘
প্রিয়ুর হাসতে ইচ্ছে করলো। যেই মেয়ে এতিমখানার শ’খানেক মানুষের সাথে ডালভাত খেতে কখনও দ্বিধাবোধ করে নি তার না-কি এখন মিশতে অস্বস্তি। কথাটা ব্যাপক মজার ছিল। তবে প্রিয়ুর সন্দেহ জাগল। শ্রেয়া এমন কেন বলল?কি কারণে? তূর্য স্যার আছে বলে?একটু আগেই সে স্যারের ক্ষতে মলম লাগিয়েছে কোনো প্রকার দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়া,তাই তার জন্য না যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে?চৌধুরী বাড়ির অন্য কাউকে দেখে ফেলেছে? প্রিয়ু ভয়ে সেঁটে গেল। প্রাণপ্রিয় বান্ধবী হারানোর ভয় টা ওর অত্যধিক। শ্রেয়া ভুল বুঝলে ওর পুরো পৃথিবীতে অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। আন্দাজ করার জন্য সচকিত নয়নে তাকালো। প্রশ্ন করলো,
‘ আয়ুশের পরিবারের সবাইকে দেখবি না?’
‘ না। ‘
শ্রেয়া কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে প্রতুত্তর করে। প্রিয়ুর সন্দেহের তালিকায় নাম লিখাতে নারাজ সে। প্রিয়ু দীর্ঘ উষ্ণ নিঃশ্বাস ছাড়ল। তবে তা ক্লান্তির নয়,স্বস্তির। আয়ুশকে বলে সব জানিয়ে দিবে ও শ্রেয়াকে। কতক্ষণ এভাবে লুকিয়ে রাখা যায়,যেখানে সত্য চক্ষু সম্মুখে? তাই সেও পারবে না। নিচে গিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে না থাকা সত্বেও শ্রেয়ার জোরাজোরি তে আসতে হলো। মেয়েটার একটাই কথা প্রিয়ু তাদের বাড়ির হবু বউ হয়ে নিচে গিয়ে একসাথে না খেলে ব্যাপার টা খুবই দৃষ্টি কটু দেখায়।
দোনোমোনো করতে করতে প্রিয়ু ডাইনিং টেবিলের সন্নিকটে আসে। ইতোমধ্যে সবাই যার যার আসনে বসে পড়েছে। বিশাল বড় টেবিল। হরেক রকমের পদ সাজানো তাতে। শত হোক শশুড় বাড়ির লোক,তাদের সামনে প্রিয়ুর উঁচু মাথা নুইয়ে গেল লজ্জায়,সংকোচে। ত্রিহা আদুরে স্বরে ডেকে আয়ুশের পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিল। রাশেদা মেয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ কি রে শ্রেয়া কই?’
প্রিয়ু ভড়কে গেল মা’য়ের মুখে শ্রেয়া নামটা কর্ণধার হওয়া মাত্র। ওর সঙ্গে সঙ্গে চমকপ্রদ দেখালো আরো কয়েকটা মুখ। প্রথমত আয়ুশীর গলায় সদ্য পান করা পানি আটকে গেল। বহু কষ্টে ঢোক গিলে চক্ষুদ্বয় বৃহদাকার করে ফেলল। মনে পড়ে এটা তো তার ভাবির নাম। প্রিয়ু আমতা আমতা করে জবাব দেয়,
‘ ওর খাবার উপরে পাঠিয়ে দাও আম্মু। শরীর একটু আধটু খারাপ লাগছে তাই নিচে আসে নি। ‘
তূর্য চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল। প্রিয়ুর কথাটা শ্রবণ হতে না হতেই তূর্যর আচমকা উঠে যাওয়ায় হতভম্ব সবাই। মেহরিমা উত্তেজিত সুরে বলে উঠলেন,
‘ কি হলো?খাবি না?’
মেহরিমার দিকে তাকালো না তূর্য। সোজা দৃষ্টি ফেলল প্রিয়ুর বাবার দিকে। নম্র,ভদ্রতা বজায় রেখে বললো,
‘ ক্ষিদে ফুরিয়ে গিয়েছে আংকেল। কিছু মনে করবেন না একটা জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছে। হঠাৎ মেসেজ আসল। এখনই যেতে হবে। রাতে আসব। ‘
এক দন্ডও আর উপস্থিত থাকলো না প্রিয়ুদের বাড়িতে। বড় বড় পা ফেলে বাহিরে আসে অন্দরমহল ছেড়ে। নিজে ড্রাইভ করতে পারবে না বিধায় একজন ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ির পিছনে উঠে বসলো। ড্রাইভার মোতালেব দেখল তূর্যর অগ্নিময় দু চক্ষু। ঘাবড়ানো স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কোথায় যাবো স্যার?’
‘ পাগ’লাগারদে। মনে হচ্ছে আবারও পাগল হতে চলেছি। এক্সি-ডেন্টে নয়, হৃদয়ের যন্ত্রণায়। ‘
তূর্যর বিরক্তিভরা কন্ঠের উল্টপাল্টা কথা শুনে মোতালেব তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইল কয়েক পলক,কিছু সময়। পরমুহূর্তেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যেতে থাকে অজানা গন্তব্যে।
_______________
রাশেদা সবাইকে রুম দেখিয়ে দিলেন বিশ্রামের জন্য। সারাদিন, রাত পড়ে আছে পরিণয়ঘটিত আলোচনার। মেহরিমা রুমে এসে চুপ করে বসে রইলেন। হাসফাস অবস্থা ওনার। তূর্য হাত কিভাবে কা’টল সেটা বলে নি তার উপর না খেয়ে আকস্মিক বেরিয়ে গেল। ছেলেটার মাথায় কি চলছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না ওনার। কিন্তু তূর্য অনেক ধূর্ত। জীবনের হিসেব-নিকেশে বড্ড পটু। নিশ্চয়ই কয়েক বছরের সমীকরণ মেলাতে হন্ন হয়ে ঘুরছে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। যে করেই হোক ছেলেটার জীবনটা গুছিয়ে দিতে হবে। প্রথম ছেলের মতোন দ্বিতীয় সন্তানকে নিজের বানানো গন্ডি পেরিয়ে যেতে দিবেন না তিনি। প্রিয়ু ও আয়ুশের সাথে অহমিকা ও তূর্যর জুটি বেঁধে দিবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু তার আগে পুরোনো আপদকে সরাতে হবে। কাজের একজন মহিলাকে দিয়ে শ্রেয়াকে ডেকে আনালেন তিনি রুমে। দরজা বন্ধ করে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। কন্ঠে প্রবল আক্রোশ,
‘ এখানে কি করছো তুমি?প্রিয়ুকে বান্ধবী বানিয়ে আমার ছেলের জীবনে বসত গড়ার চেষ্টা করছো?’
শ্রেয়া ভেবেছিল চুপিসারে সব হজম করবে। পারল না। নিজের ধৈর্য্যের সীমানা অতিক্রম করে বললো,
‘ বসত গড়লে আমাকে ঠেকানোর সাধ্য আদৌ আছে আপনার?আপনার প্রথমেই বুঝা উচিত ছিল আমি যেহেতু আপনাদের চোখের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখছি তার মানে আমি স্ত্রীর অধিকার চাইছি না। কোন ভিত্তিতে আমাকে এসব বলেন?আমার স্বামীর উপর আমার হক আছে। কিন্তু আমি নিজের অতীতের বিষাদগ্রস্ত স্মৃতি টেনে ওনাকে ফেলে চলে গিয়েছিলাম। তাই এখন ওনার সামনে স্ত্রী হয়ে দাঁড়ানো টা স্বার্থপরতা বৈ কিছুই না। যার খারাপ সময়ে আমি থাকতে পারি নি,তার ভালো সময় আমার প্রাপ্য না। ‘
মেহরিমা বাঁকা হেসে বললেন,
‘ আসলেই তুমি ডিজার্ভ করো না। করে একমাত্র অহমিকা। তূর্য বিয়ের কথা জানে না। যদি জানে তুমি ওর স্ত্রী এবং বিয়ের পরদিন সে পাগল বলে তুমি তাকে ছেড়ে পালিয়েছ তাহলে ঘৃ’ণা করবে। কারো ঘৃ-ণার পাত্রী হওয়ার চেয়ে আড়ালে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। অহমিকা ওকে সুস্থ করেছে, মেয়েটার ভালোবাসায় স্বার্থ নেই। আমি ওকেই আমার ছেলের জীবনে চাই। শুনো,ডিভোর্স পেপার বানানোর জন্য উকিলকে ফোন দিয়েছি আমি, সাইন করে দিবে। যেই সম্পর্কের সূচনা তূর্যর অগোচরে হয়েছে, তার সমাপ্তিও ওর অজান্তেই হবে। ‘
অধিকার না দেখানোর বিষয়টার ক্ষেত্রে শ্রেয়া বিনা যুদ্ধে নিজেকে পরাজিত দাবি করেছিল, কিন্তু ডিভোর্স!
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____১১
আয়ুশী ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে আছে বিছানার উপর বসে থাকা শ্রেয়ার দিক। মনে হচ্ছে সে কোনো ভূত দেখছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা। বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। আকস্মিক পরিচিত মুখ দেখে হতবিহ্বল সে। টালমাটাল পায়ে শ্রেয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ তুমি তো শ্রেয়া ভাবি তাই না?’
‘ হুম।’- নিঃসংকোচ উত্তর শ্রেয়ার।
‘ কোথায় ছিলে এত বছর?বিয়ের পরের দিন সকালে চলে গেলে কেন ভাবি?’
শ্রেয়া আঁড়চোখে প্রিয়ুর মুখের দিকে তাকাল। কোনো হেলদোল নেই তার। যেন এমন কান্ড,কথা বার্তা শুনে সে মোটেও অবাক হচ্ছে না। উল্টো চমকাচ্ছে শ্রেয়া স্বয়ং। প্রিয়ু কি সব জানে?নয়ত এত আয়েশি ভঙ্গিতে মেয়েটা গালে হাত দিয়ে ওদের কথা শুনছে কেন?আয়ুশী শ্রেয়ার সামনে বসল। বললো,
‘ তুমি ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে ভাবি?ভাইয়া সেদিন মে’রেছিল বলে?জানো এখন ভাইয়া সুস্থ হয়ে গিয়েছে কয়েক মাস হবে। কিন্তু! ‘
মন খারাপ করে কথা বলা থামিয়ে দেয় আয়ুশী। প্রিয়ু ওর নিশ্চুপ মুখ দেখে গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
‘ কিন্তু কি আয়ুশী?’
আয়ুশী মলিন মুখে এক পলক চাইল। নিষ্প্রভ স্বরে বললো,
‘ ভাইয়ার পা’গল হওয়ার পরের কোনো মুহুর্ত মনে নেই। ভাইয়া তো এটাও জানে না সে বিবাহিত। চাচি চায় না ভাবির সম্পর্কে, বিয়ের সম্পর্কে ভাইয়া জানুক। কারণ ভাবি ভাইয়াকে পা’গল দেখে পালিয়ে গিয়েছে। এতে বেশ কষ্ট পেয়েছে চাচি। সবার তিক্ত কথায় কেঁদেছে অনেক। আমাদের বুঝ হওয়ার পর চাচিকে কখনও এত কাঁদতে দেখি নি। এমনকি বড় ভাইয়া বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় টাতেও না। একমাত্র সবাই যখন তূর্য ভাইয়াকে পাগল বলে নানান কটুক্তি করছিল চাচি সহ্য করতে পারে নি। তুমি কি সত্যিই ভাইয়ার পাগল রূপ দেখে পালিয়েছ ভাবি?’
শ্রেয়া বলার জন্য কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। সবাই ঘুরেফিরে তাকে কেন এই একটা-ই প্রশ্ন করে?লজ্জা লাগে ওর। ভীষণ পা/ষাণ মনে হয় নিজেকে। কি করে পারল সেদিন চৌধুরী বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে?না আসলে আজকের গল্পটা হয়ত সুন্দর হতো,ভিন্ন হতো। প্রিয়ু পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠল,
‘ তোহাশ ভাইয়ের কি খবর?কথা হয় তোমাদের সাথে?’
‘ ভাইয়ার সাথে হয়। আমি কথা বলেছিলাম দু’একবার। ভাইয়ার একটা মেয়ে হয়েছে। আয়ুশ ভাইয়া বলে নি তোমাকে?’
‘ না। পাঁচ টা বছর কেটে গেল। বাংলাদেশ আসবেন না আর?’
‘ উঁহু! যতদিন না চাচি আরিয়ানা ভাবির প্রাপ্য সম্মান টুকু দিয়ে না আনেন ভাইয়াও চৌধুরী বাড়িতে পা রাখতে নারাজ। ‘
ওদের কথোপকথনের মাধ্যমে শ্রেয়া ঢের বুঝতে পারল তূর্যর বড় ভাই আছে। হয়ত কিছু মনোমালিন্যের দরুন বাড়ি থেকে দূরে থাকেন আলাদা বউ সন্তান নিয়ে।
শ্রেয়া ভেবেছিল আজ রাতেই ও চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে। কারণ রাত নাগাদ ডিভোর্স পেপার রেডি হয়ে যাবে বলে জানায় মেহরিমা। সে ডিভোর্স দিতে চায় না,কোনোক্রমেই নয়। তাই এখানে থেকে মেহরিমার চক্ষুশূল হওয়ার চেয়ে চলে যাওয়াই উত্তম মনে হলো। রুমে এসে প্রিয়ুকে অতীতের সমস্ত অধ্যায় খুলে বলার চেষ্টা করে। তখনই আচমকা আগমন ঘটে আয়ুশীর। ভয় হচ্ছে শ্রেয়ার প্রচন্ড। যদি এক এক করে কথার মাধ্যমে তূর্যর কর্ণকুহরে পৌঁছায় ও তূর্যর বউ তাহলে লোকটা সবকিছু শুনে নিশ্চিত ওকে ঘৃ*ণা করবে। বলবে নিজের স্বার্থ বুঝে পালিয়েছে। চাইলেও অতীত টেনে নিজের ভয়গুলো স্পষ্ট প্রকাশ করার সুযোগ টা মিলবে না। সত্যি বলতে ও স্বার্থপরের মতোই কাজ করেছে। পারবে না ও স্বামীর ঘৃ*ণা সহ্য করতে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। প্রিয়ু যেহেতু শুরু থেকেই সব জানে আর চট্টগ্রামে ওর সাথে দেখা,আশ্রয় কোনোকিছুই কাকতালীয় নয়, তাই শ্রেয়া আর বর্ণনা কিংবা বিশ্লেষণ করার কিছু পেল না। এ মুহুর্তে ওর এই ইট পাথরের শহর ছাড়তে হবে। নিজের জীবন শুভ্র বলে অন্যের টা কি রঙিন হওয়া দোষের? একদমই না। তূর্য স্যারের জীবনে রংধনু আসুক,শুভ্র শ্রেয়সী বিনা।
শ্রেয়া আলমারি খুলে সঙ্গে আনা দু সেট জামা গোছাতে শুরু করল। আয়ুশী, প্রিয়ু স্তব্ধ হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। পরক্ষণেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রিয়ু উঠে আসে। কন্ঠে প্রবল অস্থিরতা,
‘ কি করছিস তুই শ্রেয়া?’
শ্রেয়া সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছাড়ল। চোখে জল টলমল করছে ওর। আঁখি বুঁজলেই বুঝি গড়িয়ে পড়বে অশ্রু কণারা। বাহ্যিকভাবে শক্ত থাকলেও স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের কথা ওর হৃদয় ক্ষত/বিক্ষত করে দিচ্ছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে অবলীলায়। অভ্যন্তর যদি এই মেদিনীর নি*র্দয়,কঠোর মানুষগুলো দেখতে পেত তাহলে চক্ষে বিঁধত কতটা পুড়ছে হৃদপিণ্ড। কত হাহাকার ধ্বনি তোলছে প্রিয় মানুষকে পাওয়ার আশায়,মিলনের তৃষ্ণায়।
ওষ্ঠদ্বয় চেপে শ্রেয়া কান্না সংবরণ করে নিল। কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আমি ফিরে যাবো প্রিয়ু। এভাবে কতদিন বন্ধ করবো কোচিং সেন্টার? তোর সামনের সপ্তাহে বিয়ে। হাতে আরও তিনটে দিন।এতদিন এখানে থাকলে আমার বাকি জীবনটা কিভাবে কাটাব আমি?তুই তো শশুড় বাড়ি চলে যাবি কিন্তু আমার জীবনটা আমার নিজের হাতে সামলাতে হবে। আমার কোনো নিড়,আপনজন নেই। আমার ভরসা,আশ্রয়স্থল সবকিছুই আমি। একদম আটকাবি না আমাকে। তোর বিয়ের দিন আমাকে পাবি চোখের সামনে। আজ আমাকে আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে দে। ‘
প্রিয়ু সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলো,
‘ শশুড় বাড়ি থাকতে,স্বামী থাকতে তুই আপনজন নেই বলে অস্বীকার করছিস?’
‘ আপনজন থাকলেই কি সবাই আপন হয়ে যায়?’
আলতো হেসে পাল্টা প্রশ্ন করে শ্রেয়া। প্রিয়ুর উত্তরের ধৈর্য্য না ধরে পুনরায় বলে উঠল,
‘ ফুপু,খালারা এই শহরের বাসিন্দা। তাদের রক্ত আমার দেহে বহমান। তবুও কি তারা আপনজন হতে পেরেছে? আর তূর্য স্যার তো জানেই না আমি ওনার বউ। কোন ভিত্তিতে খুঁটি গাড়ব আমি?যেখানে ভিটেমাটি-ই নরম। আসি। তিন দিন পর ফিরে আসব। তবে এতদিন এখানে দম হাতে নিয়ে এক সেকেন্ডও থাকা সম্ভব না আমার পক্ষে। মন খারাপ করিস না৷ আমার তরফ হতে আয়ুশ ভাইয়াকে এত বছর আড়ালে সাহায্য করার জন্য ছোটখাটো একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দিস। বিশাল,বড় আকারের দিতে পারলাম না৷ কেননা সুখের ন্যায় আমার শব্দভাণ্ডারেও শব্দের অভাব। ‘
দিনের আলো ফুরিয়ে প্রকৃতিতে সাঁঝ নেমে এসেছে। অন্তরিক্ষে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার ন্যায় লাল রক্ত জমাট বেঁধেছে যেন। জানান দিচ্ছে ঘরে ঘরে রোশনাই জ্বালানোর সময় হয়েছে। রাশেদা,প্রিয়ুর দাদি,প্রিয়ুর বাবা সবার কাছ থেকে এক প্রকার জোর করে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এসেছে শ্রেয়া। কারণস্বরূপ দেখিয়েছে আগামীকাল খুব জরুরি একটা কাজ আছে কোচিং সেন্টারে। না গেলে চাকরি টা আর টিকবে না। প্রিয়ুর বাবা তো বলেই বসলেন আমার মেয়েকে আমি পালব,তোর কেন চাকরি করতে হবে?এত একরোখা, জেদি কেন তুই? নিষ্ঠুর ভূমিতে এত ভালো মানুষগুলোর নাগাল পেলে শ্রেয়ার ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরে বলতে-‘ আমার বাবা মা’র জীবনটা কেন এত অগোছালো ছিল?কেন সুন্দর পথের পথিক আমি হতে পারলাম না?আটকাবেন না আমাকে স্বাবলম্বী হতে। পরনির্ভরশীল হওয়া মানে যে নিজের হাতে নিজেকে খু*ন করার বন্দোবস্ত। ‘
প্রিয়ুসহ আসার জন্য জেদ ধরল,কিন্তু বিয়ে নামক নিয়মনীতিতে কড়া বাঁধনে বাঁধা পড়ল সে। তবুও সকল বাঁধা অতিক্রম করে আসতে উদ্যত হয়। শ্রেয়া কোনোরকমে বুঝিয়ে, মিনতি করে মেয়েটাকে রেখে আসে। ও চায় না ওর মতোন করে প্রিয়ুও চৌধুরী পরিবারের সদস্যদের চোখে তিক্ত হয়ে উঠুক। বলে তো গিয়েছে প্রিয়ুকে আবারও আসবে কিন্তু এই চেনা শহরে ফিরে আসার ইচ্ছেটা শ্রেয়ার প্রায় নিভু নিভু।
________________
আজ বাস ছাড়তে দুই ঘন্টা দেরি হলো। কোনো একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল বাসে। শ্রেয়া আলসেমি করে আর অন্য বাস স্ট্যান্ডে যায় নি। এখন বাস ছেড়ে দেবার পালা। ঘাড়’ত্যাড়া একটা অভ্যেস আছে ওর। যেই অভ্যেস কে অনভ্যাসে পরিণত করতে গিয়ে শ্রেয়া প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই একে ঘাড়/ত্যাড়া বললে ভুল হবে না এবং তা হলো বাসে উঠলেই মাথা ব্যাথার যন্ত্রণা। সেই কারণবশত শ্রেয়া বাস যখন ছেড়ে দেওয়ার পালা তখনই উঠলো। বসল জানালার ধারের সিটে। দৃষ্টি বাহিরে নিবদ্ধ করতেই পাশের সিটে কারো উপস্থিতি টের পায়। চোখ ফিরিয়ে পাশে ফেলতেই চোখ ছানাবড়া ওর। দৃষ্টি স্থবির মানুষ টার চেহারার দিকে। বাসের অল্প স্বল্প আলোতে স্পষ্ট চেহারায় গম্ভীর ভাব টুকু। শ্রেয়ার মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো,
‘ স্যার আপনি?’
তূর্য মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে গম্ভীর স্বরে বললো,
‘ কেন বাসে থাকা নিষিদ্ধ? ‘
‘ না। মানে আপনি?চট্টগ্রাম যাবেন?’
‘ জানিনা। তুমি ঠিক করে দাও আমার গন্তব্য। ‘
তূর্যর কন্ঠে বিরক্তভাব। শ্রেয়ার মনে হচ্ছে সে কথা বলতে ইচ্ছুক না। কিন্তু তূর্য এখানে কেন?নিজেদের গাড়ি থাকতে বাসে?হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে চলেছে শ্রেয়ার। চমক চেপে বসে রইল সিটে। পারে না মেয়েটা বাস ভেঙে বাহিরে চলে যায়। তূর্যর দেহ হতে ভেসে আসা পারফিউমের ঘ্রাণ ওকে ক্রমে ক্রমে মাতাল করে তুলছে। কেমন নেশা ধরানো। মাথার যন্ত্রণার চেয়ে হৃদয়ের যন্ত্রণা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। স্পন্দন ক্রিয়া অস্বাভাবিক , নিয়ন্ত্রণহীন। আগে তো এমন হতো না! তূর্যর এক হাত কিছু সময় পর পর ওর এক হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে। আচ্ছা বাসের সিট কি ছোট বানালো?নয়ত না চাইতেও কেন স্পর্শ লাগছে বারংবার!এভাবে চলতে থাকলে হয়ত হার্ট অ্যাটাক হতে দেরি নেই শ্রেয়ার।
তূর্য মোবাইল টা পকেটে পুরে সিটে মাথা এলিয়ে দিল। সেই অবস্থায় ঘাড় বাঁকিয়ে শ্রেয়ার পানে তাকালো সে। নিমিষেই থতমত খেয়ে গেল শ্রেয়া। ও তূর্যর দিকেই চেয়েছিল পলকহীন। কি সুন্দর বাহিরের আলো এসে ঠিকরে পড়ছিল লোকটার ফর্সা চেহারায়। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো একটুখানি ছুঁয়ে দিতে পারলে শান্তি মিলত। যদি পারত তবে বলত,’আপনার আর আমার সম্পর্কটা পবিত্র তবুও মাঝে বিশাল দূরত্ব। ‘
শ্রেয়া চোখ সরিয়ে নিতেই তূর্য ফিচেল হাসে। লহু স্বরে বললো,
‘ দেখার পালা চুকিয়ে ফেলেছ?’
শ্রেয়ার বক্ষস্থল থরথর করে কাঁপল। লজ্জায় নুইয়ে যাওয়ার উপক্রম। নিজের চোখ জোড়া সংযত করতে পারল না কেন ও?স্যার কি ভাবছেন?এমনিতেই লোকটা ওকে কটুবাক্য শোনানোর একটা সুযোগও হাতছাড়া করে না। ভাবনায় মগ্ন হতেই তূর্যর ভরাট কন্ঠস্বর শুনতে পেল। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো তৎক্ষনাৎ।
‘ মুখ মলিন দেখাচ্ছে কেন?’
জবাবের প্রতীক্ষায় চেয়ে তূর্য। তুখোড় দৃষ্টি তাক করে রেখেছে। চোখের কালো কুচকুচে মণিতে শ্রেয়ার অস্পষ্ট মুখশ্রী ভেসে আছে।
এক এক করে পাঁচ মিনিট পেরিয়ে যায় তবুও উত্তর পায় না। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
‘ চুপ থাকার বাজে অভ্যাস ত্যাগ না করলে চিরতরে বোবা বানিয়ে দিব। বেয়া-দব মেয়ে। সবসময় তর্কের বেলায় এক পায়ে খাঁড়া থাকে। ভালো কিছু জিজ্ঞেস করলে মনে হয় কথা বলতে কষ্ট হয়। যত্তসব। ‘
রাগান্বিত কন্ঠে কথাগুলো বলে তূর্য সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চোখ বুঁজে পুনর্বার বললো,
‘ মাথা ব্যাথা করছে? ‘
এবার মুখ খুলে শ্রেয়া। ছোট্ট একটা শব্দ উচ্চারণ করলো,
‘ জ্বি। ‘
তূর্য সামনে গিয়ে বাস ড্রাইভারের সঙ্গে কি যেন বললো কতক্ষণ। শ্রেয়া মাথা উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। মাঝখানে হওয়ায় কথার আওয়াজ এখান পর্যন্ত আসছে না। তারপর প্রায় আধঘন্টা পরে কোনো এক বাজারে বাস থামাতেই তূর্য নেমে যায়। বিস্মিত হলো শ্রেয়া। সে কি চলে গেল?আবার বাসও ছাড়ছে না। রাত তেমন একটা হয় নি। বাজারের সবগুলো দোকান খোলা। তূর্য ফিরে এলো প্রায় মিনিট চারেক পর। বাস ড্রাইভারের সাথে আবারও সংক্ষিপ্ত কথোপকথন সেড়ে ওর পাশে এসে বসল। একটা পানির বোতল ও ট্যাবলেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘ খেয়ে নাও। মাথা ব্যাথা কমে যাবে। ‘
শ্রেয়ার পুরো দুনিয়া থমকে গেল মুহুর্তেই। চলন্ত বাসও যেন থেমে গেছে। তূর্য ওর জন্য বাস থামিয়ে ওষুধ এনেছে? কেন?এতো দরদ?এত যত্ন?পরক্ষণেই ওর মনগড়া সমস্ত ভুল প্রশ্নের জবাবটা সোজাসাপ্টা তূর্যই দিয়ে দেয়। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
‘ পানির তেষ্টা পেয়েছিল। তোমার মাথা ব্যাথা। তাই মানবতার খাতিরে ওষুধও নিয়ে এলাম। ভুল কিছু আবার মনে পুষে রেখো না। আমি স্যার মানুষ একটা মায়া কাজ করেছে ছাত্রীর প্রতি। বুঝলে?’
#চলবে,,!