#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,১২,১৩
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___১২
আঁধারের ভিড়ে লুকিয়ে পড়েছে সমস্ত প্রকৃতি। দূর হতে সুদূরে থইথই করছে অন্ধকার। শ্রেয়া এক ভয়ংকর কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। কয়েকবার চেয়েও পাশে থাকা মানুষটাকে বলতে পারছে না। আর জানলে হয়ত লোকটা রাগে ওকে ভস্ম করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। যেই গম্ভীর, কাঠখোট্টা, তেঁতো ধাঁচের লোক!ওর ইতস্তত অনুভব হচ্ছে এটা বলতে–‘ ভুলবশত বাসের ঝাঁকুনিতে আপনার পানির বোতলে মুখ লেগে গিয়েছে স্যার। ‘ এটা বললে হয়ত তূর্য ওকে মশলা ভেবে ইচ্ছে মতোন শিল নোড়ায় পিষবে। তারপর শরবত বানিয়ে গিলে ফেলবে। ছি!ছি! কিসব ভাবছে সে ভয়ের তাড়নায়। বলার কি দরকার?ও তো লিপস্টিক ব্যবহার করে নি। তাহলে নাহয় বোতলে দাগ লেগে থাকত,প্রমাণও মিলত। তবে শ্রেয়ার অন্তঃস্থল কড়া নাড়ছে,অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় আছে কখন মানুষ টা বোতল থেকে পানি পান করবে। কখন ওর ওষ্ঠের ছোঁয়া তূর্যর ঠোঁট ছুঁয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। পরক্ষণেই শ্রেয়া নিজের সকল ভাবনা,কল্পনার ইতি টেনে সিটে ঘাপটি মেরে বসে রইল। এসব ভাবনাও ওর জন্য নিষেধ। বহুকাল পূর্বের ন্যায় হৃদয় পথে এলোমেলো অনুভূতিদের বিচরণ পুনর্বার চায় না ও। এই অবিন্যস্ত অনুভূতিরা যেন ওর হৃদয় কুঠিরে বসবাস করে অস্থির করে তুলে সমগ্র সত্তা। বাড়িয়ে দেয় মানুষ টাকে চাওয়ার অদম্য ইচ্ছে।
‘ বোতলে মুখ লাগিয়েছ?’
শ্রেয়া ধরফর করে উঠলো তূর্যর লহু স্বর শুনে। বিস্ফোরিত নেত্রদ্বয় মেলে মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ মানে?’
তূর্য তীর্যক চাউনি নিক্ষেপ করে আঁধারে শ্রেয়ার মুখভঙ্গি বুঝার চেষ্টা করলো। বাসের সব লাইট নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাত্রীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সবাই নয়,কোনো কোনো কপোত-কপোতী মগ্ন প্রেমময় বাক্য বিনিময়ে। কিছুক্ষণ আগেই শ্রেয়া দেখেছে একটা মেয়ে পাশের ছেলেটার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। বিতৃষ্ণায় ভরে উঠেছিল বুকটা এটা ভেবে পাশের মানুষটা ওর জন্য বৈধ হলেও কাঁধে কিংবা বুকে মাথা রাখার অনুমতি নেই। অনুমতি অনেক দূরের শব্দ, লোকটা তো নিজের বউই চিনে না,বিয়ের সম্পর্কেও জানে না। কিন্তু সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে শ্রেয়া এখন ভয়ে আছে,তূর্য কি ওকে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে দেখে ফেলল?তাকে কিছু বলতে না দেখে শ্রেয়ার গলা শুকিয়ে এলো। আবছা আবছা আলোয় চোখে পড়ল তূর্য বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি পান করছে। শুকনো ঢোক গিলল শ্রেয়া। ওর দিকে পানির বোতল টা বাড়িয়ে দিয়ে তূর্য গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ আমি বলে মেনে নিলাম। আর অন্য কারো বোতলে মুখ লাগাতে যেও না। সবাই তোমার স্যারের মতো দয়াবান হবে না৷ ‘
লজ্জায় মিইয়ে গেল শ্রেয়া। তূর্যর থেকে পানির বোতল টা নিয়ে নিজের কাছে রাখল। ইশ!দেখে ফেলল স্যার। মনে মনে বলে নিজেকে গালাগাল করতে লাগল। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। তূর্যর অত্যধিক সন্নিকটে অজস্র ভালো লাগা কাজ করছে তার মনে। চো’রা দৃষ্টিতে তাকালো পাশে। তূর্যর হাতে ধরা পড়ে গেল তৎক্ষনাৎ। তূর্য মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দুর্বোধ্য হেসে বলে উঠলো,
‘ তোমার লিপ বামের ঘ্রাণ টা সুন্দর। বোতলে মুখ না লাগালে হয়ত নাসারন্ধ্রে ঘ্রাণ টা প্রবেশ করত না। মস্তিষ্ক জানান দিত না পাশের মেয়েটার অধর স্পর্শ লেগে আছে এখানে। কিন্তু আফসোস ততক্ষণে আমার ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে ফেলেছে সেই স্থান। ‘
শ্রেয়া এতক্ষণে বুঝতে পারল তূর্য না জেনেই মুখ লাগিয়ে ফেলেছিল। আর আগের প্রশ্নটা এমনিতেই করেছিল জানার জন্য। লজ্জায় এখন ওর মরি মরি অবস্থা। যেভাবেই হোক ধরা তো পড়ে গেছে। লিপস্টিক না হোক লিপ বাম ওকে ফাঁ’সিয়ে দিয়েছে হাতেনাতে। মৃদু কন্ঠে উচ্চারণ করে,
‘ স্যরি স্যার। ‘
তূর্যর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মুহুর্তেই। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গর্জন করে উঠলো,
‘ তুমি কি তোমার জীবনের প্রত্যেক ভুলের স্যরি বলেছো?’
শ্রেয়া হকচকালো। ভড়কে গেল। প্রতিটা ভুলের স্যরি বললেও একটা ভুলের কখনও বলা হয় নি। কখনো হবেও না। মনে মনে আওড়ালো–‘ আপনাকে ছেড়ে আসার ভুলের স্যরি টা আমার কখনও বলা হবে না স্যার। এটাই আমার ম’রণ পর্যন্ত বাকি থেকে যাবে। ‘
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ওর। সঠিক জবাব নেই তার কাছে। তাই এক প্রকার এড়িয়ে গিয়ে টানা টানা চোখ জোড়ার করুণ দৃষ্টি বাহিরে নিবদ্ধ করে। কানে আসে রিংটোনের তীক্ষ্ণ শব্দ,সেই সাথে গম্ভীর, ভরাট কন্ঠস্বর,
‘ ইডিয়ট!’
শ্রেয়ার কপাল কুঁচকে গেল। এটা কি ওকে বললো তূর্য? আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখে স্ক্রিনে একটা নাম্বার জ্বলজ্বল করছে,কোনো নামে সেইভ নেই। তার মনে হচ্ছে কল দেওয়া ব্যাক্তি কে গা*লি দিয়েছে তূর্য। হতে পারে আবার ওকে। বলা তো যায় না। সাংঘাতিক একটা লোক!
ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেল। শ্রেয়া একটাবারও ঘুমালো না বাসে। অথচ ওর চোখ ব্যাথা করছিল তন্দ্রায়। ঘুমোলে যদি তূর্যর উপর গিয়ে পড়ে তা ভেবে ঘুমাতে পারল না৷ গ্রীষ্মের গরমে অবস্থা বেগতিক। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। তবুও তাতে কুলোচ্ছে না। কমছে না উত্তাপ। তূর্য একটু পর পর বলছে জানালা থেকে সরে বসতে বলছে ওকে। কারণ সে নাকি বাতাস আসতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
শ্রেয়া বিস্মিত, হতবাক। ঠাহর হলো তূর্য এসব বাসে যাত্রায় অভ্যস্ত না। হয়ত নতুন যাত্রী এ বাসের। মাথায় ঢুকছে না এসি বাস,গাড়ি ছেড়ে এরকম বাসে কেন আসতে গেল তূর্য। ভীষণ খারাপ লাগছে ওর মানুষ টার জন্য। বাসের জ্বলন্ত বৈদ্যুতিক বাতিতে ও ব্যথিত চোখে বারবার অবলোকন করছে তূর্যর ফর্সা মুখের রক্তিম হাল। মন টা বিষিয়ে উঠেছে। একটা সময় অত্যধিক ব্যাথা অনুভব করলেও সে ছেড়ে এসেছিল তূর্যকে তখনও বক্ষস্থলে এত কম্পন হয় নি আজ যতটা হচ্ছে তার সান্নিধ্যে। তবে কি দূরে গেলে ভালোবাসা বাড়ে কথাটা নিছক? শ্রেয়া নিজ মনে বললো,’ দূরে গেলে ভালোবাসা বাড়ে সঠিক তা মানুষের মনভেদে,আর কাছে এলে যন্ত্রণা বাড়ে প্রিয় মানুষটাকে পাবো না বলে। ‘ জীবনের সমীকরণ অত্যন্ত এলোমেলো, অগোছালো। নয়ত মানুষ প্রিয়জন কাছে পেলে খুশিতে অশ্রু গড়ায় কিন্তু শ্রেয়া?সে তো কাছে থেকেও যোজন যোজন দূরত্ব অনুভব করে অনলে দগ্ধ হচ্ছে। এর চেয়ে দু’টো দেহের, দু’জনকার নিঃশ্বাসের দূরত্বই বুঝি শ্রেয়।
______________
বাস এসে থামলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে। তবে শ্রেয়া ও তূর্যর নয়,বাসের গন্তব্য।স্ট্যান্ড থেকে এখন আবার অটো কিংবা রিকশা ধরে বাসায় যেতে হবে। শ্রেয়া ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। ভালোই রাত হয়েছে। গভীর রাত বললেও দোষ হবে না। স্ট্যান্ডে বাসের যাত্রী বিহীন তেমন একটা মানুষজন নেই। তূর্যও বাস থেকে নেমে কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। শ্রেয়ার সতর্ক মন কোনো রিকশাওয়ালাকে ভরসা করতে পারছে না। মুখোশের আড়ালে কত শয়-তান যে লুকিয়ে থাকে তা অগণিত ও মানুষের দৃষ্টির বাহিরে। এখন কিভাবে যাবে ভেবে ভেবে কূল হারিয়ে ফেলছে। না ভেঙে পড়া যাবে না। ব্যাগ থেকে ছোট ছু’রি টা হাতে নিয়ে নিল। তৎপরে একজন রিকশাওয়ালার কাছে এগিয়ে গেল যাবে কি-না জানার উদ্দেশ্যে। যদি লোকটা অর্ধ রাস্তা গিয়ে একা পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে বুকে ছু-রি গেঁথে দিবে। ভাড়া ঠিক করল ষাট টাকা। উঠতে যাবে তখনই পিছন থেকে অন্য একটা রিকশার টিংটং শব্দ কর্ণধারে পৌঁছায়। থমকে যায় পা। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে রিকশায় তূর্য। একপাশে চেপে বসে গম্ভীর স্বরে বললো,
‘ আসো।’
শ্রেয়ার মন ছুটে যেতে চাইছে। সত্যি বলতে ভীত হয়ে আছে ও। একা একা যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তবুও মলিন মুখে বললো,
‘ স্যার রিকশা ঠিক করে ফেলেছি। ওনাকে কথা দিয়ে আপনার সাথে যাওয়াটা কেমন দেখায় না?’
সাথে রিকশাওয়ালাও তাল মেলাল। তূর্য ঈগল চোখের সূক্ষ্মতায় পরখ করে নিল আধবয়স্ক লোকটাকে। এক লাফে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল সে। হাজির হলো শ্রেয়ার অতি নিকটস্থে। ওয়ালেট বের করে একশত টাকার একটা নোট রিকশাওয়ালার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
‘ এর চেয়ে কম নাকি বেশি?’
শ্রেয়া কন্ঠে একরাশ বিস্ময় ঢেলে তড়িঘড়ি করে বলে,
‘ কি করছেন?আমি দিব আমার টা। আপনি যান স্যার। ‘
তূর্য পাত্তা দিল না। আধবয়স্ক লোকটার দিকে চেয়ে গাঢ় স্বরে বললো,
‘ কত ঠিক করেছে? ‘
‘ ষাট টাকা। ‘
‘ সমস্যা নেই। পুরোটা রাখুন। আর অন্য যাত্রী নিয়ে যাবেন। এটাও খেয়াল রাখবেন যাত্রীরা কখনও যেন আপনার দ্বারা ক্ষ-তিগ্রস্ত না হয়। ভালো মানুষের দাম পৃথিবীতে নগন্য হলেও পরকালে অনেক। ‘
থতমত খেয়ে যায় রিকশাওয়ালা। গলা শুকিয়ে যায় ওনার। তূর্য রিকশায় উঠে অপেক্ষা করতে লাগল শ্রেয়ার। উপায়ন্তর না পেয়ে শ্রেয়া উঠে বসল। চেপে বসল একপাশে। তূর্যর কন্ঠে তেজ,
‘ ছাত্রী বলে প্রটেক্ট করছি, এখন পড়ে গিয়ে ভার্সিটিতে বলে বেড়াবে স্যার তোমার কোমর ভেঙে দিয়েছে। ফা’লতু মেয়ে। ‘
শ্রেয়া এবার একটু সোজা হয়ে বসল। ঝাঁকুনিতে বার বার এক দিকে হেলে যাচ্ছে ও। নিমিষেই অনুভব করলো তূর্য একটা হাত পিছন দিয়ে নিয়ে ওর পাশে রাখল। বাহুতে নয়,রিকশায়। বেঁধে ফেলেছে ওকে বন্ধনে। এই বন্ধনে স্পর্শ নেই,হাত টা ওর গায়ে অব্দি লাগছে না। বুকে দুরুদুরু শব্দ হচ্ছে ক্রমাগত। চোখ বুঁজে ফেলল সে। গড়িয়ে গেল এক ফোঁটা নোনতা,তপ্ত জল। এমন করে কেউ খেয়াল রাখে নি কখনও।
রাতের বিশুদ্ধ সমীরণ গায়ে এসে বারি দিচ্ছে। তূর্য সাবলীল কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ রিস্ক নিতে পারব না, পরে জে-লের ভাত খেতে হবে। ‘
শ্রেয়া নিশ্চুপ। বলবে না কিছু। অজান্তেই হোক,যেভাবেই হোক স্বামী নামক মানুষ টার যত্ন তো মিলছে। জীবনে না পাওয়ার মধ্যে এটা অনেক বড় এক পাওয়া।
বিশ মিনিটের পথ পারি দিয়ে রিকশা এসে থামল বিল্ডিংয়ের সামনে। শ্রেয়া ভাড়া দিতে চাইলে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তূর্য। তাৎক্ষণিক চুপসে গেল সে। তূর্য ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা ধরলো ওকে রেখে। অকস্মাৎ হাঁটার গতি থামিয়ে বলে,
‘ আমাদের যাত্রা টা দীর্ঘ হতো,যদি পুরোনো পথ টা ছেড়ে না দিতে।’
বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল শ্রেয়ার। কি বলে গেল এটা তূর্য? ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বিছানায় পড়ে রইল। মিনিট, মিনিট করে আধঘন্টা অতিবাহিত হয়। চোখ লেগে আসে। কলিংবেলের আওয়াজে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। দরজা মেলতেই দেখে তূর্য। ইতোমধ্যে স্নান সেড়ে ফেলেছে সে। ছোট ছোট চুলগুলো ভেজা। মুখটা স্নিগ্ধ। শ্রেয়ার হৃদস্পন্দন থমকে গেল ক্ষীণ সময়ের নিমিত্তে। কন্ঠে কম্পন,
‘ কিছু লাগবে স্যার?’
‘ তোমাকে লাগবে। ‘
তূর্য নির্লিপ্ত,নির্বিকার। শ্রেয়ার স্পন্দনের গতি তড়িৎ বেগে বাড়তে আরম্ভ করে। থামানোর জো নেই। আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি বলছেন?’
বিরক্ত হলো তূর্য। বললো,
‘ তোমাকে লাগবে। একটু খিচুড়ি রান্না করে দিতে পারবে?ভীষণ ইচ্ছে করছে খেতে। আমি পারি না। পরে মনে পড়ে যায় এখানে আমার পরিচিত বলতে প্রিয়ু ও তার ফ্রেন্ড আছে। আর প্রিয়ুর ফ্রেন্ড মানে আমার ব,,,
এতটকু বলে তূর্য থেমে ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। উল্টো দিকে দম আটকে যায় শ্রেয়ার। তূর্য কি সব জেনে গেল?নিশ্চয়ই ওকে ঘৃ*ণা করবে। শ্বাস রোধ হয়ে আসছে ওর। মাথা টা ঝিমঝিম করছে। তূর্য কপালে ভাঁজ ফেলে অর্ধসমাপ্ত শব্দটা উচ্চারণ করে,
‘ বেয়াইন। ‘
তূর্যকে রেখে দৌড়ে চলে গেল শ্রেয়া। রুমে এসে মুখে হাত চেপে কাঁদল কতক্ষণ, কয়েক মিনিট। ফিরে আসে মাথায় ওড়না সমেত। মুখ ধুইয়ে এসেছে। দরজা লাগিয়ে তূর্যকে বললো–‘ চলুন স্যার। ‘
রান্নাঘরে এসে শ্রেয়া যত দ্রুত পারছে সব করার চেষ্টা করছে। তূর্যকে তখন চেয়েও না করতে পারে নি। শত হোক মানুষটা ওর স্বামী। হঠাৎ কানে মোবাইলের শব্দ ভেসে আসল। চেয়ে দেখে তূর্য মোবাইলটা এখানে ফেলে চলে গিয়েছে। ড্রইং রুমে হয়ত। সেখান থেকে টিভির আওয়াজও আসছে। শ্রেয়া মোবাইলটার কাছে এলো। ‘মা’ দেখেই কয়েক পা পিছিয়ে গেল ও। ধরবে না,তূর্যকেও ডাকবে না। পড়ে থাকুক। এই মহিলাকে এখন ভীষণ ভয় হয় ওর।
তূর্য নিজেই ড্রইং রুম থেকে উঠে এলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে শ্রেয়ার দিকে চেয়ে রিসিভ করে। কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বললো,
‘ বলো। ‘
ওপাশ থেকে মেহরিমার অশ্রুসিক্ত কন্ঠ,
‘ এভাবে চলে গেলি তুই?আমি তোর জন্মদাত্রী মা তূর্য। তোর খারাপ চাই আমি?ভালো চাওয়া অন্যায়?এতটুকুই তো চাই অহমিকাকে বিয়ে করে সুখের সংসার কর,অগোছালো জীবন টা সাজা। আগেও তুই বাড়ির বাহিরে থাকতি,যেখানে মন চায় এডভেঞ্চারে চলে যেতি,এখনও চাকরির দোহাই দিয়ে দূরে চলে গেলি। ‘
‘ মানুষের একটাই হৃদপিন্ড হয় মা। সেখানে একজনকেই জায়গা দেওয়া যায়। যদি তুমি আমাকে তা দ্বিখণ্ডিত করে দু’জনকে জায়গা দিতে বলো তাহলে আমার ম’রণ নিশ্চিত। ‘
রোষপূর্ণ কন্ঠে কথাটা বলে মোবাইলটা হাতে চেপে ধরে দ্রুত বেগে রান্নাঘর ছাড়ল তূর্য। শ্রেয়ার চোখ গড়িয়ে অবাধে জল নেমে যাচ্ছে। তার স্বামী অন্য কাউকে ভালোবাসে!
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___১৩
শ্রেয়া খিচুড়ি রেঁধে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। এক তো লং জার্নি করেছে তার উপর গরমে ঘেমে নাজেহাল অবস্থা। নিজের তপ্ত নিঃশ্বাসে নিজেই বিরক্ত। ড্রইং রুমে এসে দেখল তূর্য সোফায় মাথা এলিয়ে বলিষ্ঠ,পেশিবহুল দু’টো হাত দু দিকে প্রসারিত করে চোখ বুঁজে আছে। হুট করেই বুকে ঢিপঢিপ করতে শুরু করলো। সেই শব্দ নিস্তব্ধতায় কানে এসে প্রবেশ করছে অনায়সে। শ্রেয়া ভাবল নিঃশব্দে চলে যাবে। নিজের বুকের ধুকপুকানিতে ও নিজেই বিরক্ত। আর রুমে উপস্থিত অপর মানুষ টা শুনলে লজ্জায় মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়বে। তার চেয়ে ভালো চলে যাওয়া। নিরবে,নিশ্চুপে। তবে তূর্যকে ক্রস করে যেতে হবে,টের পেয়ে গেলে?সেসব ভেবে ধীরে ধীরে পা বাড়ালো শ্রেয়া। যখনই তূর্যর সামনে দিয়ে যেতে নিল কিছু একটায় পা বেজিয়ে দেহ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনের দিকে পড়তে নেয়। ভয়ে চোখ খিঁচে ফেলল। মুহুর্তেই,সেকেন্ডেই শিরশির করে উঠে সমস্ত কায়া,বদন। অনুভব করলো পেটে হাতের স্পর্শ। গাঢ় ছোঁয়া। আঁখিযুগল খুলে দেখার পূর্বেই সেই ছোঁয়া আরও গভীরে রূপ নেয়। একটা সময় টান দিয়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয় ওকে। কানে আসে তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর,
‘ তুমি ছোট বেলায় ঠিকঠাক হাঁটা শিখতে পারো নি। যখন তখন পড়ে যাও। আর আমার সামনেই। নাকি আমার স্পর্শ পাওয়ার ধান্দা?’
শ্রবণনালিতে সীসা ঢাললেও হয়ত এতটা ছ্যাৎ করে উঠতো না যতটা করেছে গম্ভীর, তীর্যক কন্ঠ খানা। শ্রেয়া চক্ষু মেলে নিচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বুঝার চেষ্টা করছে কিসের সাথে পা লেগে পড়তে নিয়েছিল। কিন্তু ও নির্বাক, স্তব্ধ। কোথাও কিছু নেই। পুরো মেঝে সাদা ফকফকা। একটা ময়লা পর্যন্ত নেই। শ্রেয়ার ইচ্ছে হচ্ছে ম্যাগনিফাইং গ্লাস এনে ঝুঁকে ঝুঁকে চেক করতে। যদি ছোটখাটো, অদৃশ্য ময়লার সঙ্গে ওর পায়ের অমিলন হয়ে পড়ে যাওয়ায় সেই কান্ডকারখানা ঘটে থাকে!নিজের বোকামি ভাবনায় সে নিজেই বিস্মিত। কিন্তু এখন কি করে তূর্যর ভুল ধারণা ভাঙ্গবে?লজ্জায় দৃষ্টি নুইয়ে যাচ্ছে বারবার। অসহায় অনুভব হচ্ছে। পা বেজিয়ে যাওয়ার উৎপত্তি টার সন্ধান পেলে হয়ত দেখিয়ে বলতে পারত স্যার আমি ইচ্ছে করে পড়ে যাওয়ার নাটক সাজাই না,আপনার স্পর্শ পাওয়ার ধান্দাও খুঁজি না। অকস্মাৎ শ্রেয়ার মাথায় খেলে গেল তূর্য এমন করে নি তো?মানে সামনে পা দিয়ে? না সে কেন এমন করতে যাবে। কি লাভ?অহেতুক ভাবনা বাদ দিয়ে ও নতমস্তকে ধীর স্থির ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
‘ স্যার খিচুড়ি রান্না শেষ, বাসায় যাবো আমি। ‘
তূর্য পুনরায় সোফায় বসে পায়ের উপর পা উঠিয়ে দিল। থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়ার দরুন পায়ের অর্ধাংশ উন্মুক্ত। ঘন কালো পশম গুলো স্পষ্টত,বিশদ। শ্রেয়ার গলা শুকিয়ে কাঠ। অশনীর ন্যায় কম্পন বক্ষস্থল জুড়ে। ফাঁকা ঢোক গিলে আবারও বললো,
‘ আসি স্যার। ‘
তূর্য কপাল কুঁচকে তাকালো। ফিচেল স্বরে বলে উঠলো,
‘আমার কথার উত্তর দাও নি। সত্যিই কি ধরে নিব আমার ছোঁয়া পাওয়ার আশায় তৃষ্ণার্ত তুমি?তাই সুযোগ খুঁজো? ‘
বেহায়া,অসভ্য,ঠোঁটকাটা লোক। শ্রেয়া এগুলো বলতে চেয়েও বললো না। মুখে প্রতিবাদ করে বলে,
‘ আপনি বাজে বকছেন স্যার। দুর্ঘটনা কেউ ইচ্ছে করে ঘটায় না। ‘
তূর্য উঠে দাঁড়াল। এক হাতের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিল নিমিষেই। কিঞ্চিৎ মাত্র দূরত্ব বজায় রাখল না। ঘটনার আকস্মিকতায় শ্রেয়া বাকরুদ্ধ বনে যায়। পিছুতে নিলে তূর্য এগিয়ে আসে আরও। ঝুঁকে পড়ে ওর দিকে।
শ্রেয়ার বক্ষস্পন্দন বেড়ে অবস্থা বেগতিক। তোলপাড় হচ্ছে সমস্ত অভ্যন্তরে। অনুভূতিরা চিৎকার করে জানান দিচ্ছে বাসর রাতের পর আজ তোর বর তোর এতটা কাছে এলো স্বইচ্ছায় শ্রেয়া।ঘাড়ে,গলায় তপ্ত নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস মুক্তি লাভ করছে শ্বাসনালি হতে। তূর্য কানের কাছে মুখ এনে ঠোঁট দুটো নাড়লো ক্ষীণ। ম্লান হেসে বলে,
‘ পেটে কি তুলা আছে? এত কোমল কেন?’
নেশাতুর কন্ঠে উম্মাদ হয়ে পড়ে শ্রেয়া। কিন্তু সেই মাতাল করা অনুভূতি পরিণত হয় লজ্জায়। কাঁপা কন্ঠে তেজের অস্তিত্ব ঢেলে প্রশ্ন করে উঠলো,
‘ কি?’
‘ খিচুড়ি কি এমনি খাবো?দু’টো ডিম ভাজি করে দাও না শ্রেয়সী। ‘
কি নিঃসংকোচ আবদার! মায়াময় পূর্ণ বাক্য। শ্রেয়া নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। আঁড়চোখে চাইল তূর্যর দিকে। তখনও ওর কানের কাছে ঝুঁকে আছে তূর্য। সরে গেল ও। বললো,
‘ করে দিচ্ছি স্যার। ‘
স্মিত হাসল তূর্য। ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
‘ গুড ব,,,বেয়াইন। স্বামীর বাধ্যগত বউ তুমি। ‘
শ্রেয়া বড়বড় নেত্রে চাইতেই তূর্য রুমে যেতে যেতে বলে,
‘ সারাজীবন কুমারী থাকবে নাকি?এবার বোধহয় তোমার কুমারীত্ব হারানোর সময় ঘনিয়ে এলো। তালিকা থেকে নাম কাটা পড়বে শিগগির। ‘
বুকে হাত দিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল শ্রেয়া। কিসব বলে গেল তূর্য?মাথা ভো ভো করে ঘুরছে। দুই গালের উত্তপ্ততা অনুভব করতে পারছে। লাল হয়ে উঠেছে বুঝি?কিন্তু ভিতরটা ক্ষত হচ্ছে তূর্য বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও অন্য একটা মেয়ের সাথে এমন বিহেভ করছে?সে তো জানেই না শ্রেয়া তার বউ। শ্রেয়ার নেত্র কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। এক নিদারুণ যন্ত্রণা হচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটার সান্নিধ্য আশার প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে চিরতরে। তূর্য কখনোই জানবে না ও এই এতিম মেয়েটার স্বামী, তা ভেবে শ্রেয়ার নিজেকে শেষ করে দেওয়ার স্পৃহা জাগছে। মন চাইছে ধরে বেঁধে আবারও তাকে পাগল বানিয়ে দিতে। বলতে,’থাকুন আপনি পাগল,সুস্থ হলেই তো আপনি অন্য কারো। এই যে এমনিতেই আমার সাথে ঢলে পড়ছেন,কাছাকাছি আসছেন আপনি কি জানেন আপনি বিবাহিত ছেলে?অন্যায় করছেন বউয়ের সাথে। ভারী অন্যায়। নিজের উপর নিজের হিং/সে হচ্ছে স্যার। সৌভাগ্য হবে না কখনও আপনার প্রশস্ত বুকে মাথা ঠেকানোর। আপনার হৃদয়ের সাথে আমার হৃদয়ের সন্ধি টা হলো না আর। অনুতপ্ততার বেড়াজালে হেরে যাই স্বয়ং। আগ বাড়িয়ে বলতে গেলে যে আপনি আমার দিকে ঘৃ*ণার আঙুল তুলে বলবেন কেন চলে গেলে?থাকতে পারতে না?তুমি নিজের স্বার্থ টা বুঝলে?’
এসব ভাবতে ভাবতে শ্রেয়ার চোখের মনিকোঠা হতে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। কিন্তু খেয়ালই করলো না সেই জল মেঝে না ছুঁয়ে কপোল বেয়ে জমা হচ্ছে কারো আঁজলায়।
‘ অনেকখানি নোনতা জল জমেছে এবার থেমে যাও কাঁদুনে কন্যা।’
অকস্মাৎ চেনা গম্ভীর স্বর কর্ণপাত হতেই শ্রেয়া চকিতে মাথা তুলে তাকালো। একগুচ্ছ রক্ত জমেছে যেন মেয়েটার ফর্সা চেহারায়। ঠোঁট দুটো কাঁপছে ক্ষণে ক্ষণে। দেহ কেঁপে উঠলো ঈষৎ। জড়িয়ে যাওয়া অশ্রুসিক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপনি?’
‘ তোমার জামাই ম’রে গিয়েছে? ‘
বিরক্তিভরা কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তূর্য। শ্রেয়ার অধর যুগল কিঞ্চিৎ ফাঁক হতেই বাঁধা দিয়ে বললো,
‘ জানি এখন বলবে আমার তো জামাই নেয় স্যার। আমি আনম্যারিড। তাই তো?’
শ্রেয়া কি বলবে ঠাওর করতে পারছে না৷ কিন্তু এখন যদি বলে সে বিবাহিত তাহলে হাজার টা প্রশ্ন করবে তূর্য। তার চেয়ে ঢের ভালো একটা মিথ্যে। মলিন,নিষ্প্রভ স্বরে বুক পাথর বেঁধে উত্তর দেয়,’ জ্বী। ‘
তূর্য হেসে উঠে দাঁড়াল। বাঁকা হেসে বলতে লাগল,
‘ আজকালকার মেয়েরা জামাই, বয়ফ্রেন্ড থাকতেও নিজেদের সিংগেল দাবি করতে ঘাবড়ায় না। আসলেই মানুষের সবকিছুতে বেশি বেশি। ‘
শ্রেয়া ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো এক লহমায়। ওকে অবাক করে দিয়ে তূর্য গলার স্বর পরিবর্তন করে ফেলল। কন্ঠে এখন আর ঠাট্টার চিহ্ন নেই। চিরাচরিত গম্ভীর স্বরে ফিরে এসে বললো,
‘ আমি ডিম ভেজে ফেলব। তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমার সাথে খাবে। ‘
‘ কিন্তু স্যার। ‘
‘ প্লিজ লিভ। ফ্রেশ হয়ে এসো। অপেক্ষা করবো। কিন্তু আমার খিচুড়ি ঠান্ডা হলে তোমায় গরম করতে সময় নিব না। তুমি কি চাও তোমার তুলোর মতো দেহ মোমের ন্যায় গলে গলে পড়ুক?না চাইলে যাও। রান্না করলে তুমি,একা একা খেয়ে পেটে অসুখ বাঁধাতে চাই না। দৃষ্টি বলেও একটা কথা আছে। ‘
________________
ঘড়ির কাটা এ মুহুর্তে ১০ টা ২০ এর ঘরে। এত বেলা পর্যন্ত কোনো কালে ঘুমোয় নি শ্রেয়া। হয়ত গতকাল সারাদিন রাত যে ধকল গিয়েছে তাতে শরীর দুবর্লতা,বিষন্নতায় মুষড়ে পড়েছিল। তড়িঘড়ি করে গোসল সেড়ে তৈরি হয়ে নিল। চুল থেকে পানি ঝরে ভিজিয়ে দিচ্ছে পিঠের অংশ, কোমর। ভিজে জবজবে হয়ে যাচ্ছে জামা টা। যেহেতু কালো পড়েছে তাই শ্রেয়া আর মাথা ঘামালো না। ভেজা চুলগলো বাঁধল না। খোলা রেখে পিঠ জড়িয়ে বড়সড় একটা ঘোমটা টেনে নিল ওড়না দ্বারা। ব্যাগ সমেত বেরিয়ে এসে দরজায় তালা লাগিয়ে আনমনে তাকালো পাশের দরজার দিক। মস্ত বড় এক তালা ঝুলছে। তার মানে তূর্য কি চলে গেল ভার্সিটিতে? এই ছেলে রাতে ওকে সেইরকম নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। খাটিয়েছে ইচ্ছে মতোন। এমনকি খাওয়া শেষে প্লেটগুলো পর্যন্ত ধুইয়ে দিতে হয়েছে। তার অবশ্য খারাপ লাগে নি। হোক না সম্পর্ক টা গোপন তবুও মনে হচ্ছিল তূর্যর সবকিছুর উপর কেবল ওর অধিকার। একমাত্রই ওর।
শ্রেয়া অতি সন্তর্পণে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ভার্সিটির পথে পা বাড়ায়। আজও রিকশায় উঠেছে। তবে পার্থক্য পাশে সেই মানুষ টা নেই। হৃদয় বড্ড বেহায়া এক অঙ্গ। কি সাবধানে মানুষের জীবন নিয়ে খেলে। এই যে ওর এত বছরের সকল শক্তি চুষে নিচ্ছে। মনের শক্তি।মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানেই, তূর্যর নিকটে থাকতে থাকতে শ্রেয়া এখন ভিতরে ভিতরে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। আমাদের কিছু ভুলের জন্যই হয়ত আমরা ফিরে যাওয়ার পথ হারিয়ে বসি। সুযোগ পায়ে ঠেলে দিয়ে মরিচীকার জীবনটাকে স্বর্ণ ভেবে উপভোগ করতে থাকি। কিন্তু একটা সময় ভ্রম ভেঙে গুড়িয়ে যায়,সবকিছু থাকে হাতের নাগালের বাহিরে।
ভাড়া মিটিয়ে শ্রেয়া ভার্সিটির ভিতরে চলে এলো। ১১টায় ক্লাস তাও তূর্যর। তাই দম টা হাতে নিয়ে এক প্রকার দৌড়ে আসল ক্লাসের সামনে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করলো দরজায় দাঁড়িয়ে। পাশ দিয়ে তূর্য ক্লাসে ঢুকতেই তার টনক নড়লো। দ্রুত এসে বসল একটা বেঞ্চে। বসে পলকহীন চেয়ে রইল তূর্যর দিকে।
শ্রেয়ার আজ নিজেকে বেহায়া বেহায়া লাগছে। হঠাৎ করে অনুভূতিদের কাছে মস্তিষ্ক পরাজিত হয়ে পড়ে। নিষ্পলক চেয়ে চেয়ে শেষ করে সম্পূর্ণ ক্লাস। তন্মধ্যে তূর্য একটা বারও তাকায় নি। কি ভাবলেশহীন ছিল লোকটা!শ্রেয়া বিড়বিড় করে আওড়ালো,’ জামাইকে দেখার মধ্যে এত পরিতৃপ্ততা!এই তৃপ্ত মুহুর্ত আমার কপালে কতকাল থাকবে?’
সাথে সাথে মেহরিমা চৌধুরীর কথা মনে পড়ে গেল। তূর্যর জীবনে তো অন্য নারী আসবে। অহমিকা নামের কোনো এক সুন্দরী রমণী। শ্রেয়া নিজেও সায় দেয়, তূর্যকে অহমিকা ডিজার্ভ করে কারণ সে পাশে থেকেছে।
এসব ভাবতে ভাবতে মাঠের দিকটায় আসল। পানিপুড়ি দেখে সেদিকে এগিয়ে গিয়েও মন পরিবর্তন করে চলে যাবে বলে ঠিক করে। প্রিয়ু নেই। আর একা একা কার ভালো লাগে খেতে?ফুচকা,পানিপুড়ি এসব খাওয়ার জন্য হলেও একজন সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। কয়েক পা সামনে আগাতেই আপনাআপনি থমকে গেল। কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। ভারী হলো পা জোড়া। সামনের মানুষ টা এতদিন পর কোত্থেকে এসে হাজির হলো বুঝতে পারছে না। নিজেকে সংবরণ করে মানুষ টার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
‘ পথ রোধ করে দাঁড়ালেন কেন আভাস ভাই?সরে দাঁড়ান। ‘
‘ দাঁড়াবো না। আজ সাথেরটা কই?গত কয়দিন কই ছিলা? ট্যুর দিতে গেলাম আর অমনি গায়েব?ভয় পাচ্ছো আমাকে?সিনিয়রদের ভয় পাওয়াই উচিত। ‘
শ্রেয়ার মুখভঙ্গি কঠিন হলো। ক্ষিপ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্তপোক্ত কন্ঠে বললো,
‘ সিনিয়রদের ভয় নয়,সম্মান করতে হয়। আর সিনিয়র যদি অ*সভ্য হয়,গায়ে পড়তে আসে তাহলে গালে পাঁচ আঙ্গুল বসাতেও পিছুপা হতে নেই। ‘
মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল আভাসের। চক্ষুদ্বয় লাল বর্ণে ছেয়ে গেছে। এই ভার্সিটিতে কমবেশ সুনাম আছে তার। মেয়েদের পটানোর সুনাম। কিন্তু এই মেয়ের পিছনে তিন বছর ঘুরেও পাত্তা পাচ্ছে না। আজ একটা বিহিত করেই ছাড়বে। এগিয়ে গিয়ে হাত ধরতে চাইলে শ্রেয়া সরে গেল পিছনের দিকে। পাশে কারো উপস্থিতির টের পেল। চেয়ে দেখল তূর্য দাঁড়িয়ে আছে একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। তবে কপালের শিরা উপশিরা ভেসে উঠেছে।
শ্রেয়ার দিকে না তাকিয়ে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে আভাসের দিক দৃষ্টি জ্ঞাপন করলো। সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ পেশায় লেকচারার। পেশাটা খুবই সম্মানের। তাই ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে এটার অসম্মান করতে চাইছি না। বাহিরে চলো। নয়ত মেয়েদের বিরক্ত করা,অনুমতি ব্যতীত স্পর্শ এসব ছেড়ে দাও। ‘
‘ তাহলে আপনিও ছেড়ে দিন না স্যার মেয়েদের জন্য মায়া দেখানো। শ্রেয়ার সাথে তো আমি ভালোভাবেই কথা বলছিলাম। তাছাড়া গার্লফ্রেন্ড রাগ করে ক্ষিপ্ত হওয়াটা স্বাভাবিক না?ও আমার গার্লফ্রেন্ড। রাগ করেছে তাই মানানোর চেষ্টা করছি। ‘
আভাসের কথা শুনে শ্রেয়া চমকালো। চমকিত নয়নজোড়া মেলে তূর্যর কাছে নিজের হয়ে সাফাই দিতে নিলে তূর্য থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘ জানো আভাস,আমি কিন্তু কয়েক বছর পা’গল ছিলাম। ভালোই এক্সপিরিয়েন্স আছে পাগলামির। আবার যদি সেই পাগলামো শুরু করি সামনের মানুষ টা কে তা ভুলে যাবো। তাছাড়া দিলে কি আর কম দিব বলো?নাহলে পরে বউ পাবো না। বউ বলবে আমার গায়ে জোর কম,এমন ছেলে দিয়ে পোষাবে না তার। রিজেক্ট হয়ে যাবো।তাই আমি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে রিস্ক নিতে চাই না। বউয়ের পছন্দসই হতে হবে তো। ‘
শ্রেয়া,আভাস, উপস্থিত আরও তিন চারজন থতমত খেয়ে চেয়ে আছে। এই লোক থ্রেট দিচ্ছে নাকি বিটলামি করছে?বাকিরা ছেলে বলে মানানসই। কিন্তু শ্রেয়ার কান লজ্জায় গরম হয়ে উঠেছে। এক মিনিট কি এক সেকেন্ডও স্থির হতে পারল না সেই জায়গায়। তূর্য আভাস কে মাইন্ড ইট বলে শ্রেয়াকে পিছু ডাকল,
‘ দাঁড়াও। ‘
একজন বাধ্য ছাত্রীর ন্যায় দাঁড়িয়ে গেল সে। আদেশের সুরে গম্ভীর কন্ঠে বললো তূর্য,
‘ সোজা পানিপুড়ি বিক্রি করা চাচার কাছে যাও। ‘
শ্রেয়া ঘাড় বাঁকিয়ে বলে,
‘ কেন স্যার?’
‘ পানিপুড়ি খেতে। আমি খাওয়াবো। ‘
‘ আপনি?’
‘ হু। আমি আবার স্যার হয় ছাত্রীর সাথে পানিপুড়ি শেয়ার করা যাবে না। তবে খুশিতে ট্রিট দিতেই পারি। ‘
‘ কিসের ট্রিট? ‘– শ্রেয়ার ভয় ভয় কন্ঠ।
তূর্য পাশের একটা বেঞ্চে বসল আয়েশি ভঙ্গিতে। অনেকেরই নজর তার দিকে নিবদ্ধ। শ্রেয়াও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না,উসখুস করছে। সেটা আন্দাজ করতে পেরে বললো,
‘ এখানে বসলাম। খেয়ে আসো। কিসের ট্রিট সময় হলে বুঝবে। আর হে, খেয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিবে কিন্তু ” ট্রিট ফ্রম তূর্য বেয়াই। ”
শ্রেয়া বেক্কল হয়ে গেল নিমিষেই। মন বললো,’ পাগলের এক্সপিরিয়েন্স হয়েছে বললে ভুল। আপনি এখনও পাগল। আগে ছিলেন হিংস্র আর এখন, এখন কেমন কি জানি!কর্মকান্ড বুঝে নাম দিব৷ ‘
#চলবে,,,!