#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,২২,২৩
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___২২
ঘুম ভেঙে শ্রেয়া নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড বিস্মিত হলো। কপালে ভাঁজ পড়ল এক দু’টো। অঢেল চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। প্রথমবার শাড়ি পড়ে ঘুমিয়ছে আশ্চর্যের কান্ড হলো গা থেকে একটুও সরে যায় নি। বাঁধাবিহীন শাড়ি ঘুমের ঘোরে উড়তেও পারত এত সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু হলো বিপরীত। দেহ থেকে সরলো না। শ্রেয়া চক্ষু মেলে দেখে শাড়ি একদম ঠিক আছে। পা থেকে উপরে উঠে নি,বুক থেকেও সরে নি৷ অথচ রাত্রের অনেকখানি প্রহর কেটেছে ওর শাড়ির ভাবনায়। ইতস্তত বোধ হওয়ায় তূর্যকে একটা বার বলতে পারে নি কাঁথার কথা। ভেবেছিল কাঁথা দিয়ে গা ঢাকা দিলে মান ইজ্জত বেঁচে যাবে। এখন দেখা গেল সব ঠিক আছে। তবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারে নি। কি করে সম্ভব! যেখানে থ্রি পিসই ঠিকঠাক থাকে না, শাড়ি?এ যেন অবিশ্বাস্য, বিস্ময়কর ব্যাপার স্যাপার। তবুও মান সম্মান বেঁচে গেছে তূর্যর সমুখে এতেই ঢের।
চুলগুলো হাত খোঁপা করে বিছানা ছাড়ে শ্রেয়া। মানুষ সাধারণত ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে ছুটে ব্রাশ করতে কিন্তু ও গেল বারান্দায়। উদ্দেশ্য নতুন প্রত্যুষে ঢুলুঢুলু আবছা দৃষ্টে চৌধুরী বাড়ির সৌন্দর্য দেখবে। ভিতরকার নয়,বাহিরের। বৃষ্টিতে ভিজে এখনো পিচ্ছিল হয়ে আছে বারান্দার মেঝে। শুকনো কাপড় দিয়ে মুছলে কিংবা রোদ্দুরের দেখা মিললেই শুকিয়ে যাবে। সূর্যকে কৃষ্ণ মেঘ আড়ালে রেখে ঘাপটি মেরে অম্বরে বসে আছে দিব্যি। এক প্রকার লড়াই চলছে তাদের মাঝে। হয়ত লড়াইয়ে মেঘ বৃষ্টি হয়ে নামবে নয়ত দিবাকর মেদিনীতে রশ্মি বিলিয়ে উজ্জ্বল করে তুলবে প্রকৃতি।
শ্রেয়া বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়েই দেখতে পেল নুরুল চৌধুরী দু’হাত পেছনে আড়াআড়িভাবে বেঁধে হাঁটাহাটি করছেন বিরতিহীন। ওনার পাশেই বাগানের একাংশ জুড়ে নানান ফুলের গাছ। ফুলের গাছগুলোর সমাপ্তি রেখা যেখানে টানা হয়েছে সেখানেই অবস্থিত একটা পেয়ারা গাছ। বেশ বড় বড় পেয়ারা ঝুলে আছে তাতে। থেকে থেকে তিনি বারংবার চক্ষু নিক্ষেপ করছেন গাছটায়।
পাতার চেয়ে পেয়ারার পরিমাণই বেশি লাগল শ্রেয়ার কাছে। অবিলম্বে খালি রুমে ফিরে আসল। শশুর যদি সাতসকালে পুত্রবধূকে এলোমেলো অবস্থায় দেখেন তাহলে তা খুবই নিন্দাজনক। বলতে পারে মেয়েটা অগোছালো, অভদ্র। ফলস্বরূপ তড়িঘড়ি করে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়ল। ভেবে ভেবে অবাক হচ্ছে তূর্য কখন উঠলো? ওকে কেন একটা বারও ডাকল না?গেল কোথায়? রাতের অনেকখানি সময় ও ব্যয় করেছে তূর্যর কথাগুলো চিন্তা করে। ভাবল,তূর্য সঠিক কিন্তু ওর ভীতি টাও ফেলনা নয়। মানুষ টা ওকে ভালো না বাসুক নিজের দিক থেকে ভাবনাগুলো খোলামেলা করবে। তিন বছর আগে হাল ছেড়ে দিয়ে যে ভুল করেছে সেটা পুনর্বার ঘটাবে না। তূর্য ভালোবাসে না তাই বলে ওর গলা তো চেপে ধরে নি, তাহলে কেন নিজের অন্তঃপুরের অনুভূতিদের সাথে বেই-মানি করবে?যা বলবে সোজাসাপ্টা।
কাঠ দ্বারা তৈরি কারুকার্য নির্মিত আলমারি খুলে একটা কালো রঙের মাঝে লাল পাড়ের শাড়ি হাতে তুলে নিল। গোসল সেড়ে এসে ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে বসে রইল বিবশ মুখে। কোনো কিছুই গোছাতে পারছে না ও। কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। এ মুহুর্তে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য যে খুবই প্রয়োজন। হাউমাউ করে চিৎকার করে কাঁদতে পারলে কিছুটা শান্তি মিললেও হয়ত মিলতে পারে। কেন ওর জীবনে সবকিছু সহজভাবে হয় না। যা-ই পেতে চায় কঠিন সাধনার পরও পায় না৷ অভাগীদের জীবন এমনই বোধহয়!অক্ষিকোটর ছাপিয়ে জলধারা নেমেই এলো অবশেষে।
ফাতেমা চৌধুরী বসে বসে তজবি পড়ছেন চোখ বুঁজে। তূর্যর কথার জবাবে তখন বিমূঢ়তায় বাক হারা হয়ে পড়েন। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিরীহ মুখ করে পালিয়ে যেতে চায় কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলেন না। পেলেনও না। তবে ছেলে এসে বাঁচিয়ে দিলেন ওনাকে। নুরুল চৌধুরী তূর্যর পাশে বসে রহিমার কাছে চা চাইলেন। বাহির থেকে হেঁটে ফিরেছেন তিনি। নামাজ পড়তে বেরিয়েছিলেন,রাস্তায় হাঁটলেন তৎপরে বাগানে। হাঁটাহাঁটির অভ্যেস টা উনি যৌবন বয়স থেকেই রপ্ত করেছেন। তখন তিনি একা হাঁটতেন না,পাশে থাকতেন ওনার প্রিয় মানুষ। সকালে,সন্ধ্যায় হাঁটার নাম করে লুকিয়ে বাঁচিয়ে কতশত প্রেমময় কাব্য লিখেছেন তা সীমাবদ্ধ থেকে যায় দু’জনের মধ্যেই। সেই প্রিয় মানুষ টা একটা প্রাণ রেখে গেল দুনিয়ায় অথচ তিনি কথা দিয়েও আগলে রাখতে ব্যর্থ হলেন। এক বুক হতাশা মিশ্রিত নিঃশ্বাস নিঃশব্দে নাসারন্ধ্র গলিয়ে বাহিরে মুক্ত হয়। গম্ভীর স্বরে বলেন,
‘ তোমার বউ উঠেছে তূর্য?’
‘ কেন?বউ সমেত আমাকেও ঘর ছাড়তে হবে?’
সোফায় মাথা এলিয়ে বসেছিল তূর্য। বাবার কথায় সোজা হয়ে বসল। ছেলের ত্যাড়াবাকা কথায় নুরুল চৌধুরীর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ফাতেমাও তজবি পড়া বন্ধ করে কান পেতে রইলেন পরবর্তী কথা শোনার অপেক্ষায়। তিনি হারে হারে টের পাচ্ছেন দ্বন্দ্ব একটা আজ লাগবেই। বাপ,ছেলে দু’জনই ত্যাড়া প্রকৃতির, রগচটা স্বভাবের। মিলে গেল খাপে খাপ। আগে গ্রামে পাশের বাড়িতে ঝগড়াঝাটি হলে তিনি কোমর বেঁধে লেগে পড়তেন উপভোগ করার জন্য। তার মতে,সুন্দর দৃশ্য। কিন্তু বিয়ে বসে যখন ইট পাথরের নগরীতে পা রাখলেন আশেপাশের মানুষের ঝগড়া, চুলোচুলি দূর কান পেতে চাপা আওয়াজটাও শুনতে পান না। ওনার দ্বন্দ্ব কলহ দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা টা মাঝে একবার পূরণ হয় আরিয়ানার মাধ্যমে। আরিয়ানা বাড়িতে পা রাখতেই চৌধুরী বাড়ি গরম হয়ে উঠে,আর আগুনের তেজ কমে আসত তূর্য বাড়িতে পা রাখলেই। দিনগুলো ভারী মজার ছিল।
নুরুল চৌধুরী শক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,
‘ ত্যাড়ামো কবে ছাড়ছো?তোমাকে বিয়ে করতে অনুমতি দিয়েছি বলে লাফ দিয়ে আমার ঘাড়ে চেপে বসবে?লেকচারারের চাকরি ছেড়ে বিজনেসে জয়েন করো। একা হাতে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। আয়ুশও নিজের পেশা ছাড়তে রাজি না,আমরা দু ভাই বুড়ো বয়সে কত করবো?সে নাহয় আগে থেকেই এই পেশায় নিয়োজিত কিন্তু তুমি কেন বিজনেস ছেড়ে ছুঁড়ে এই পেশায় লেগে পড়লে?’
তূর্য নির্বিঘ্নে জবাব দেয়, ‘ কারণ টা আপনার অজানা নয়। আমি মানুষের কাছ থেকে অপবাদ কুড়াতে পারবো না। লোক মুখে শুনতে পারবো না বড় ভাইকে সবকিছু থেকে সরিয়ে নিজে একা বাবার টাকা ভোগ করছি। আসল কথা তো কেউ জানে না। সমাজের মানুষ একটা কারণ পেলে হাজারো কারণ বানাতে দ্বিধাবোধ করে না। একজন বলেছে,পরবর্তীতে শতজন বলবে। ‘
‘ যে বলেছে তার সাথেই তো ভালোই যোগাযোগ রাখছো। ‘
নুরুল চৌধুরীর কথা শুনে তূর্য অধর কার্নিশ বাঁকিয়ে বলে,’ ভাই তো। ভাই ফেলে দেওয়া যায় না। আমাকে হাজার টা কঠিন কথা বললেও মাথায় থাকবে মানুষ টা আমার ভাই। সে দূরে গিয়েছে বলে আমিও দূরে সরে আসব নাকি?’
‘ তাহলে তার কথা ধরে রেখে আমার বিজনেস সামলাচ্ছ না কেন?’
‘ আপনার সবকিছুতে প্রথম অধিকার আপনার বড় ছেলের। ভাই আসুক,নিজের ভাগ বুঝুক অবশিষ্ট থাকলে বাকিটা আমি বুঝে নিব। আর চাচার ভাগের টা সম্পূর্ণ আয়ুশ ও আয়ুশীর। তাছাড়া আমি আপনার কম টাকা নেই নি। এখনও আপনার দেয়া টাকা আছে আমার একাউন্টে। বাড়ির বড় ছেলে অন্যের অধীনে চাকরি করছে, আমি কেন বাবার টাকায় চলব আর?’
‘ ঠিক আছে। যে ছেলে বাবা মা’য়ের উপর মিথ্যা আরোপ লাগিয়ে চলে যায় তার ব্যাপারে আর কিছু শুনতে চাইছি না। তোমার বউকে ডাকো,কথা আছে। তোমার মা সব বলেছে আমাকে তিন বছর আগে মেয়েটা এ বাড়িতে পুত্রবধূ হয়ে এসেছিল। আমি ওই মেয়েটার কোনো দোষ পেলাম না৷ পেলাম তোমার মা’র, আমার মা’র। ‘
ছেলের কথা শুনে বিষম খেলেন ফাতেমা। রহিমা রান্নাঘর থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এসে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,’ আমি জানতাম আম্মা আপনের পানি লাগব। লন,খাইয়া লন। ‘
নুরুল চৌধুরী দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বয়স্ক মা’কে সন্তান হয়ে বকাঝকা কিংবা রাগ দেখানোর সাধ্য নেই তার। এতিম মেয়েকে বাড়ির বউ করেছে নিঃসন্দেহে উত্তম কাজটাই করেছেন, তাই বলে মেয়েটাকে ঠকানো!এটা মানতে পারলেন না তিনি। একদিক হতে তূর্যর প্রতি গর্ববোধ করছেন মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য,সমাজের চোখে বউরূপে স্বীকৃতি দিয়ে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছে বিধায়। আজকাল কেউ কাউকে তার প্রাপ্য সম্মান টুকুই দিতে নারাজ।
মেহরিমা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলেন। শ্রেয়াকে তিনি কখনও ক্ষমা করতে পারবেন না। ভয় হয় সেও যদি আরিয়ানার মতোন আধো ভাঙ্গা পরিবারটাকে সম্পূর্ণ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়!
________________
শ্রেয়া জানালার ধারে দাঁড়ানো। বিমর্ষ মনে, স্থির নেত্রে বাহিরে তাকিয়ে। নিচে গিয়ে সবার সাথে কথা জমাতে ইচ্ছে করছে। যদিও সে অল্পস্বল্প কথা বলে। এত বড় একটা পরিবার কিন্তু ওর সাথে কথা বলার কেউ নেই। বিয়ের পরের সকালে নাকি পরিবারের সদস্যরা নতুন বউকে ডাকতে আসে, কই কেউ এলো না। হিসেব-নিকেশে সে পুরাতন বধূ তবুও রহিমা খালার ডাক অনুয়ায়ী সে এখনও নতুন বধূ রয়ে গেল। অকস্মাৎ চুলে প্যাঁচানো তোয়ালে টান পড়তেই হকচকিয়ে গেল। ধুকপুক করতে লাগে বুক। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই নিষ্প্রাণ আঁখি যুগলে বিঁধে তূর্য ওর অতীব কাছাকাছি। সুঠাম হাতে তোয়ালে ধরে অতি নিখুঁতভাবে চুল মুছে দিচ্ছে। সযত্নে ঝেড়ে দিচ্ছে চুলের পানি।
শ্রেয়া মোহগ্রস্ত নয়নে তাকিয়ে রইল। কিন্তু বহুক্ষণব্যাপী স্থায়ী হলো না তা। সময়ের পরিমাণ টা ছিল অত্যধিক কম,হয়ত কয়েক সেকেন্ড। তূর্যর কন্ঠে গম্ভীরতা,’ এভাবে তাকালে ঘাড় সারাজীবনের জন্য বাঁকা হয়ে যাবে। মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই, স্বামীর দায়িত্ব পালন করছি। ভালোবাসা খুঁজতে যেও না। ‘
তির্যক,তীক্ষ্ণতেজী কন্ঠে শ্রেয়ার মুগ্ধ দৃষ্টি উবে গিয়ে চক্ষু কোটরে একরাশ বিষাদ জড়ো হলো। শূণ্য হলো মর্মদেশ। সকল যত্ন কেবল স্বামীর দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে!অবিলম্বে অন্তরাত্মার চিৎকারে বক্ষস্থল চিনচিন করে উঠে। অনুভূত হয় তূর্য সরে গেছে। কিন্তু যাওয়ার পূর্বে আঁচল দ্বারা ঢেকে দিয়েছে ওর উন্মুক্ত কেশ। ঘুরে দেখল বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। ইতমধ্যে শুয়ে পড়ল?আবার চোখের পাতায় হাত রাখা। এত কম সময়ে ঘুমায় না কেউ, তা শ্রেয়ার অজানা নয়। একপাশে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল তূর্যকে ঠিক কিভাবে কথাগুলো বললে বুঝবে। ডাকলো ভয়ে ভয়ে,
‘ স্যার। ‘
‘ এখানে স্যার নেই। আমি আছি, আমার বউ আছে। বাচ্চা কাচ্চা নেই তবে সময়ে হলে ডাউনলোড হবে,রুমও দখল করবে। ‘
তূর্যর নির্লিপ্ত অভিব্যক্তিতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল শ্রেয়া। বুঝল অনেক মেপে মেপে কথা বলতে হবে এই লোকের সাথে। নাহলে কোনদিক থেকে লজ্জার পুকুরে ধাক্কা মেরে ডুবিয়ে দিবে তা অভাবনীয়, কল্পনা হীন। রয়েসয়ে রিনঝিনে কন্ঠে বলতে চাইল,
‘ আমি আপনার সাথে কিছু কথা স্পষ্টভাবে বলতে চাই। সুযোগ দিলে বলব। ‘
তূর্য হাত সরিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। কপালে কতশত ভাঁজ। হয়ত বুঝার চেষ্টা করছে নয়ত চিন্তা করছে সুযোগ দিবে কিনা!সুন্দর গড়নের মুখের আদল দেখে ঠাহর করে নিল শ্রেয়া। প্রতীক্ষিত হয়ে তাকিয়ে থাকল জবাবে হ্যাঁ শব্দ শোনার। শুনল তবে তূর্য সাথে আরো কয়েকটা বর্ণ, শব্দ সংযুক্ত করলো,’ এখন নই,দুপুরে নিরিবিলিতে শুনবো। ‘
শ্রেয়ার বলতে ইচ্ছে করলো রুমে কি নিরবতার অভাব, অনটন?এত রুক্ষ কেন আপনি স্যার?ভালোবাসি বুঝে ফেলেছেন বলেই রুষ্ট ব্যবহার করছেন?
দরজার ঠকঠক আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো ও। দরজা তো ভেজানো ছিল, তূর্য ঢুকে লাগিয়ে দিয়েছে কি?মন্থরগতিতে পৌঁছে খুলতেই দেখে প্রিয়ু লাল একটা শাড়ি পড়ে ঘোমটা দিয়ে একগাল হাসি নিয়ে উপস্থিত, সঙ্গে আয়ুশী। দু’জনেই ওকে ঠেলে রুমে উঁকি দিয়ে তূর্যকে শোয়া অবস্থায় দেখে যেই প্রশ্ন টা করলো তাতে লজ্জায় কেঁপে উঠলো শ্রেয়া। চাপা স্বরে বললো,’ কি ধরনের প্রশ্ন প্রিয়ু?শুনবেন উনি। ভাসুর আর জা কে নিয়ে এমন কথা বলছিস নির্লজ্জ মেয়ে। ‘
প্রিয়ুর নরম ওষ্ঠ জুড়ে হাসি খেলে গেল। শ্রেয়াকে টেনে রুমের বাহিরে আনতেই শুনতে পায়,’ আমার বউকে প্রশ্ন করে মে’রো না আবার। বেচারি অনেক লাজুক ও ভীতু টাইপের। ‘
লজ্জায় মাথা কেটে যাওয়ার উপক্রম শ্রেয়ার। প্রিয়ু ও আয়ুশী তূর্যর কন্ঠ শুনে দমে গেলেও, পরমুহূর্তেই শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে হাসি চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। বিফলে গেল না প্রয়াস।
দরজা বাহির থেকে টেনে ভিড়িয়ে দেয় শ্রেয়া। প্রিয়ু ফিসফিস করে বলে,
‘ আমি তো ঠিকি বলেছি,রুম থেকে বের হোস নি না?মনে হয় না স্যার তোকে বের হতে দিয়েছে। দেখলি না এখন কেমন করে বলল?ইশ!কি ভালোবাসা!আর আমি তোর বান্ধবী ছিলাম,থাকব। সো আমার একটা হক আছে। চল আয়ুশীর রুমে চল গোপন কথাগুলো সেড়ে নেই।’
শ্রেয়ার সাদামাটা বাক্য,’ যাবো না। ‘
‘ চুপ থাক। ‘ –বলে টেনেটুনে আয়ুশীর রুমে নিয়ে আসল প্রিয়ু। তূর্যর রুমের সাথেই ওর রুম টা। আয়ুশী কে বললো,তুমি একটু আমার জন্য পানি নিয়ে আসবে?অধর জোড়া প্রশস্ত করে আয়ুশী চলে গেল। শত হোক প্রিয়ু ননদের সামনে তার ভাইদের কথা বলতে পারবে না। কেমন যেন লাগে। আয়ুশী প্রস্থান ঘটাতেই তার কন্ঠে প্রবল উৎকন্ঠা,
‘ স্যার তোকে খুব ভালোবাসে তাই না শ্রেয়া?রাতে অতীত নিয়ে কিছু বলেছে?তুই খুশি তো এখন?’
শ্রেয়া মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মস্তিষ্কের সাড়া মেনে নিল। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। হাসল স্মিত। সাথে সাথেই প্রিয়ু ওর শাড়ির আঁচল কিছুটা টেনে গলার নিচের অংশ হতে সরিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বলে,’ এটাই আমাকে উঁকি দিয়ে জানান দিচ্ছিল স্যার তোকে আপন করে নিয়েছে। ‘
প্রিয়ুর চাহনি অনুসরণ করে নিজের গলার নিচে বুকের ঠিক উপরের অংশে চোখ রাখল। ভালোভাবে দেখতে না পেরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিমেষে রক্ত হিম হয়ে গেল ওর। বুকে বজ্রপাত পড়লো যেন। কামড়ের গাঢ় চিহ্ন!
#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___২৩
শ্রেয়ার নিশ্চল চাহনি আয়নার দিক। কথার স্বাধীনতা কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে গেল। বিশদ বর্ণনা দিচ্ছে কামড়ের দাগ টা। কারো কাছে আসার, তীক্ষ্ণ দাঁতে ওর কোমল ত্বক ছুঁয়ে যাওয়ার বিবৃতি। দৃষ্টির নড়চড় হলো। আরেকটু গাঢ় দৃষ্টে আঁখিপাত করতেই চক্ষুগোচর হয় রঙ লেপন। রক্ত জমাট বেঁধে লালের প্রলেপ পড়েছে কামড়ের অংশে। এতক্ষণে মনে পড়ে যায় এই কারণবশত গোসলের সময়টাতে পানির সংস্পর্শে গলার নিচের অংশে জ্বালা করছিল অত্যধিক। কিন্তু মাথায় সহস্র চিন্তার বিচরণ ছিল বলে খেয়ালই করে নি।
তাছাড়া আরেকটা কথা মন পিঞ্জিরায় বন্দি হতেই অন্তস্থল কেঁপে উঠে শ্রেয়ার। ভোর হবে নাকি গহন রাত্রি ওর সঠিক জানা নেই তবে হঠাৎ করে তীব্র ব্যাথা অনুভব করেছিল ঘুম ঘুম অবস্থায়। কিন্তু চোখের পাতায় যে আঁধার ছেয়েছিল তা সরিয়ে দেখা হয় নি আর কিছুই। তারপর কি হলো,কে কামড় দিল তাতে এখন বেশ সন্দিহান সে। ছোটকাল থেকেই গাঢ় ঘুমের অভ্যেস। কক্ষে হাজারো শব্দ খেলা করলেও সহজে ঘুম টা ভাঙ্গে না। অভ্যাসবশত পূর্ণ হলেই আপনাআপনি জেগে ওঠে ও, নয়ত অন্য কারো সাহায্যে। পরিণামে জ্বলন,বেদনা ভুলে ঘুমে মাতাল হয়ে পড়ে।
হুট করে মাথায় চেপে বসে তূর্যর নাম খানা। শত শত অনুভূতিতে থমকে যায় শ্রেয়ার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া প্রক্রিয়া। চোখের দৃষ্টি নিম্নে মেলে ধরে জোরালো নিঃশ্বাস ছাড়ে। না কখনোই তূর্য এমন করবে না। সে তো তাকে প্রেমের চক্ষে আঁকে না,কেবল মর্যাদা দেয় স্ত্রী রূপে। নিজ থেকেই কথার তালে বুঝিয়ে দিয়েছে স্পষ্টত প্রেম মিশিয়ে না ছুঁইয়ে কাছে টানবে না কখনও। যা হবে,যা করবে তা শুধু, শুধুই স্বামীর দায়িত্ব পালনে। কোনোকালেই স্বামী রূপে প্রেমিক হয়ে উঠবে না। কিন্তু! এই দাগের উৎপত্তি কোথা থেকে তা-ই ঠাহর করতে পারছে না ও।
প্রিয়ু পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভ্রুঁ নাচিয়ে, উৎফুল্ল কন্ঠে বলে,’ আমার খুব ভালো লাগছে। উল্টো বাসর রাতে চিন্তা করছিলাম স্যার তোকে সম্পূর্ণভাবে মেনে নিবে কি-না!এখন অনেক অনেক শান্তি লাগছে। আমরা ভাগ্যবতী শ্রেয়া। দু’জনেই দু’টো সুদর্শন,প্রেমিক পুরুষ পেয়ে গেলাম। দুই বান্ধবী এখন জা। ‘
প্রতি উত্তরে শ্রেয়া ম্লান হাসে। সতর্কতার সহিত ঢেকে নিল ক্ষত স্থানটি। পাছে যদি কারো চোখে পড়ে যায় সেই জন্য। ভেজা চুলগুলোর উপর ঘোমটা জড়িয়ে নেয়। কন্ঠ নরম,তেজহীন,
‘ একটু শরম কর প্রিয়ু। রাতারাতি কেমন নির্লজ্জ হয়ে গিয়েছিস।’
‘ জামাই করে দিয়েছে। ‘– প্রিয়ুর নির্বিকার অভিব্যক্তি।
শ্রেয়ার চোখ ছানাবড়া। প্রিয়ুর কথাতে নয়,দরজায় দাঁড়ানো আয়ুশীকে দেখে। মেয়েটা শুনে ফেলেছে বোধহয়!কেমন মিটমিট করে ঠোঁট যুগল চেপে হাসছে। গলা ঝাড়ল ও। আয়ুশীর দিকে তাকিয়ে উঁচানো স্বরে ডাকে,’ ওইখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?আসো।’
আয়ুশীর আনন্দিত গলা ও নির্লিপ্ত জবাব,’ ভাবী দের গোপন কথা শুনছিলাম। ‘
প্রিয়ু ও শ্রেয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় লাল নীল হয়ে যায়। আয়ুশী ওদের দু’জনের এক হাত করে দু হাত টেনে ধরে বললো,’ মা নিচে নিয়ে যেতে বলেছে তোমাদের। নাস্তার টেবিলে উপস্থিত হতে হবে তিন মিনিটে। চলো, চলো। ‘
অবনত মস্তকে প্রিয়ু,শ্রেয়া নিচে আসে আয়ুশীর সঙ্গে। মাথা উঠিয়ে দেখার সাহস পাচ্ছে না। শ্রেয়ার ভয় করছে,সবাই কিরূপ ব্যবহার করবে ভাবছে। বিশেষ করে তূর্যর বাবার কথা চিন্তা করছে। সবার সঙ্গে পূর্বে একটু আধটু কথা হলেও ওনার মুখোমুখি কখনও হয় নি সে। দেখে গম্ভীর ধাঁচের লোক তা আঁচ করে ফেলে। ত্রিহার কন্ঠস্বরের আওয়াজে হেঁটে ডাইনিং টেবিলের কাছাকাছি আসল। সালাম দিল সবাইকে উদ্দেশ্য করে। কে আছে,কারা আছে দেখে নি শ্রেয়া। তবে আন্দাজ করে নিল সকালের খাবার টাইমে অবশ্যই পরিবারের প্রত্যেক সদস্য থাকবে। গমগমে স্বরে কেউ একজন ওর সালামের জবাবে দেয়। বলে,’ বসো। ‘
কন্ঠটার সাথে আগে কখনও পরিচিত হয়েছে বলে মনে হয় নি শ্রেয়ার। জড়তা সংকোচ নিয়েই দৃষ্টি তুলে তাকায়। প্রথমে অবলোকন করে নুরুল চৌধুরীর চেহারা। তৎপরে দেখে,ওনার পাশের চেয়ারেই ওনার অর্ধাঙ্গিনী মেহরিমা চৌধুরী। সালামের জবাব টা নুরুল চৌধুরীই দিয়েছেন বুঝতে বেগ পোহাতে হলো না ওর। ত্রিহার তাড়াতে চেয়ারে বসতেই,ওর পাশের চেয়ার টেনে বসল তূর্য।
‘ আজকালকার মেয়েরা স্বামী ছাড়াই খেতে বসে যায়। বাহ!এটাও শিখাতে হবে আমার। ‘
আচমকা গাম্ভীর্য মিশ্রিত স্বরে চাপা কথায় ঘাড় আলতো বাঁকিয়ে চাইল শ্রেয়া। তূর্য প্লেটে পরোটা নিয়ে একটু একটু ছিঁড়ে খাচ্ছে। চোখে মুখে গম্ভীরতা। একবারও ফিরে তাকাচ্ছে না। এখন যেন খাওয়াটাই অতীব জরুরী৷ অথচ সেকেন্ড সময় আগেই একটা বাক্য শুনিয়ে দিল। এই ছেলের মতিগতি বুঝতে যদি কোনো ক্লাস করানো হয় তাও নির্দ্বিধায় মনোযোগ সমেত করবে ও।
_______
শ্রেয়া নিজের প্লেটে শশুড় কে পরোটা তুলে দিতে দেখে থমকে যায়। স্তব্ধ হয়ে পড়ে চোখ জোড়া। নুরল চৌধুরী আরো একটা পরোটা দিয়ে বললেন,’ খাবার টেবিলে মনোযোগ সহকারে খাবার খাওয়া উচিত। খাও। ‘ কখনও ভাবে নি ও যেচে কথা বলবেন তিনি। সবার দিকে তাকিয়ে দেখে সবার উৎসুক দৃষ্টি ওর দিকেই নিবদ্ধ, কেবল দুটো মানুষ বাদে। প্রথমজন তার স্বামী ও দ্বিতীয়জন শাশুড়ী। মেহরিমা তাকিয়েছিল এক পলক তবে সেটা ছিল তীক্ষ্ণ,রোষপূর্ণ চাউনি।
অল্পস্বল্প খেল ও। পেট টা গুড়গুড় শব্দ সৃষ্ট করছিল বারংবার। কারো কর্ণকুহর হবার আগে দমানোর জন্য পেটে পরোটা চালান করে। সবার খাওয়া শেষ হওয়ার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ও। রহিমা পান খাওয়া লালচে দাঁতগুলো প্রদর্শন করে বললো,’ বসার ঘরে চলো নতুন বধূ। বড় সাহেব তোমারে কি যেন কইব। ‘
শ্রেয়া ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বুকটা কেঁপে উঠে। দ্রিমদ্রিম শব্দ তুলে। না জানি কি বলেন নুরুল চৌধুরী!ছোট ছোট পা ফেলে রহিমার সাথে আসে। সোফায় সারিবদ্ধভাবে বসে আছে সকলে। ভাবে মনে হচ্ছে সালিশ বসেছে,বিচারক নুরুল ও অপরাধী শ্রেয়া। অসহায় দৃষ্টিতে চাইতেই দেখে তূর্যও বসে আছে। একটা নিউজ পেপার প্রশস্ত করে ধরে রেখেছে মুখের সামনে। যার দরুন চেহারার আকৃতি, দৃষ্টি বুঝা মুশকিল।
শ্রেয়ার পা শক্তিহীন হয়ে দেহ টলে টলে পড়বে অবস্থা। ভরসা যোগ্য কোনো মানুষ খুঁজে পাচ্ছে না যে ইশারায় বলবে ‘ দুর্বল হয়ে পড়ছো কেন?আমি আছি না?’ অভাব বোধ করে অনতিবিলম্বে দীর্ঘ নিঃশ্বাস মুক্ত করতে চায় সে কিন্তু ভয় ও মানুষের সমাগমে পারে না।
নুরুল চৌধুরীর কন্ঠস্বর কর্ণধার হওয়া মাত্র সোফায় বসলো ওনার আদেশ মোতাবেক ঠিক প্রিয়ুর সান্নিধ্যে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আবারও মুখ খুললেন,
‘ শুনেছি তুমি আমাদের এতিমখানায় বড় হয়েছো। আমার মা তোমাকে সেখানে দেখে পছন্দ করে বউ করে আনে। তার পরের দিন তুমি স্বামী পাগল বলে পালিয়েছিলে। ভয়ে পালিয়েছিলে নাকি ইচ্ছে করে?’
শ্রেয়া নির্বাক। জানত, এমন প্রশ্ন ওর পিছু ছাড়বে না। চোখ বুঁজে চুপ রইল খানিকক্ষণ। এই কথাগুলো শুনলে ওর ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। নিজেকে সংবরণ করে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে। কন্ঠস্বর নিষ্প্রভ, ‘ ভয়ে। ‘
নুরুল চৌধুরী মুখের কাঠিন্যতা বজায় রেখে বললেন,’ এটাই স্বাভাবিক। তোমাকে আমার পরিবার ঠকিয়েছে তার জন্য আমি লজ্জিত। তবুও একটা কথা বলবো বাড়ির বউ যখন হয়েছো সংসার ভাঙার নয় বরং গড়ার চেষ্টা করবে। তোমার মতই কেউ একজন সরলতার সুযোগ নিয়ে আমার সংসার অর্ধেক ভেঙে দিয়ে আমার কলিজা ছিন্নভিন্ন করেছে। ‘
তূর্যর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। পেপার টা ছুঁড়ে মারে সমুখে রাখা ছোট্ট টেবিল টার দিক। কন্ঠনালি রাগে শক্ত হয়ে উঠে তার,
‘ আপনি আমার বউয়ের সাথে নরম গলায় কথা বলুন বাবা। ‘
নুরুল চৌধুরী তেতে উঠলেন, ‘ আমি কি খারাপ কথা বলেছি?’
‘ হ্যাঁ। সবাইকে এক পাল্লায় কেন মাপবেন আপনি?সহজ সরল চেহারার মেয়ে মানেই খারাপ? ধারণা পাল্টান। ‘
‘ আমি বলি নি তোমার বউও তেমন। শশুড় হিসেবে উপদেশ দিতে পারব না?’
‘ পারবেন তবে মায়া দেখিয়ে। আমার বউ যদি কখনও আপনার সংসার ভাঙ্গার চেষ্টা করে তাহলে ভাইয়ের মতোন আমি সহ্য করবো না,একদম মে’রে পুঁতে দিব। কিন্তু আমি জানি ও কখনও এমনটা করবে না। ওকে আদর করে কথা বললেই আমি খুশি হবো। বাবা-মায়ের স্নেহ পায় নি ও। আপনারা ওকে সেটা দিলে আপনাদের জন্য জীবন দিতে ও দু’বার ভাববে না তা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ‘
সবাই চুপচাপ ভঙ্গিতে বাবা ছেলের তর্ক দেখছে। তাছাড়া উপায় নেই। শ্রেয়ার অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে এসব দেখে। প্রিয়ুর হাতে হাত রেখে মলিন মুখে বসে রইল। শশুড়ও ওকে দেখতে পারে না। দোষী বলে সাব্যস্ত করে নি তবে অন্য কোনো কারণে হয়ত। নুরল চৌধুরী গলা ঝেড়ে বললেন,
‘ আমার কাউকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে নেই। আমি শুধু চাই আমার পরিবার যেন না ভাঙ্গে তাই দু একটা কথা বলা। আসি। ‘
কথাগুলো বলে তিনি বেরিয়ে আসলেন। মেহরিমা আসলেন পিছু পিছু কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করে গাড়িতে বসলেন। গত রাত থেকেই কথা বন্ধ করে দিয়েছেন স্ত্রীর সাথে। জীবনে হারিয়ে হারিয়েই তিনি আজ পাষণ্ড হয়ে উঠেছেন। শ্রেয়াকে অভদ্র, খারাপ মেয়ে মনে হয় নি কিন্তু বিশ্বাসও করতে পারছেন না। তাই আগে থেকে ওয়ার্নিং দিয়ে দিলেন যেন পরবর্তীতে পরিবারের কোনো দুঃখের কারণ সে না হয়।
_______________
বিছানার এক কোণে বসে বসে শ্রেয়া শশুড়ের কথাগুলো মনে মনে আওড়াচ্ছে বার বার। মানুষ টাকে কঠোর লাগে নি,কঠিন হবার অভিনয় করছিল যেন। কিন্তু কি কারণে?আর তূর্য ও তার বাবার মধ্যে অন্য কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে কথা কাটকাটির সূচনা ঘটেছিল। কোনো প্রকার শক্তি খরচ না করেই শ্রেয়া ধরে ফেলে সবটা তূর্যর বড় ভাই কি যে নাম তোহাশ ও তার বউয়ের সাথে জড়িত। কি এমন হয়েছিল যার ফলে পরিস্থিতি এরকম হয়েছে? হিমেল হাওয়ায় কক্ষের সাদা পাতলা পর্দাগুলো উড়ছে। সুড়সুড় করে এসে ছুঁয়ে দেয় শ্রেয়ার আধা ভেজা উন্মুক্ত কেশ। সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ফেলে সামনে তাকাতেই সৌষ্ঠবপূর্ণ দেহের মানুষটাকে দেখে পেট মোচড় দিয়ে উঠে। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তূর্য চেয়ে আছে। কপাল কুঁচকে ধারালো কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ কি ভাবছো?’
তৎক্ষনাৎ শ্রেয়া কম্পনরত কন্ঠে এলোমেলো বাক্যে উত্তর সাজায়,’ ভাবছি,,কিছু না। ‘
তূর্যর কপালে বলিরেখার ভাঁজ পড়ল। দ্রুত বেগে এসে সুঠাম দেহ খানি এলিয়ে দিল শ্রেয়ার পাশে। ঘাড় হালকা কাত করে গম্ভীর স্বরে বললো, ‘ আমার পা টিপে দাও তো। ‘
শ্রেয়া হতভম্ব! ভুলভাল শুনেছে কি?কিন্তু না তূর্য গর্জে উঠলো পুনশ্চঃ, ‘ ঠিক কত বার বলতে হবে?বউ বানিয়ে এমনি এমনি আনি নি। পতিসেবা করো। ধরে নাও তুমি আগেরকার যুগের অবলা নারী। নাও স্টার্ট। ‘
হনহন করে বিছানা ছাড়ল শ্রেয়া। তূর্যর পায়ের কাছে আসতেই মেয়েটার হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার অভিপ্রায়। তেষ্টা পেয়ে বসে। ধবধবে ফর্সা পায়ে কালো কালো লোমশ। দুর্বল হাত দু’টো বাড়িয়ে গুটিয়ে নেয়। আঁড়চোখে তূর্যর দিক চাইতেই অক্ষিপটে ভেসে ওঠে তূর্যর কঠিন মুখো ভঙ্গি। নিরুপায় হয়ে ভয়ে ভয়ে হাত দেয়। চাপ দিতে থাকে আস্তেধীরে। তখনই শোনা গেল রাগান্বিত কন্ঠস্বর,
‘ শরীরে শক্তি নেই? মনে হয় তুলো উড়ে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার পা। তোমার শক্তির পরখ করে যা বুঝলাম আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ‘
অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তূর্য রুম ত্যাগ করে। বুকে হাত দিয়ে থম মেরে বসে থাকে শ্রেয়া। শ্বাস ফেলতে ফেলতে বিছানায় মাথা এলিয়ে বসে। তখনই হাতে প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকে তূর্য। শ্রেয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, ‘ তাড়াতাড়ি খেয়ে শেষ করবে। ‘
প্লেট ভর্তি গরম ভাত ও তরকারি। শ্রেয়া ঢোক গিলে। মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে মনের ভাবনা বাহিরে উন্মুক্ত হয়,’ এত ভাত খেতে পারবো না স্যার। ‘
‘ তাহলে আমাকে গিলে খাও। পারবে?হয় ভাত নয় আমি?কোনটা?তূর্য নাকি ভাত?অবশ্য আমি বেশি টেস্টি। ‘– দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো তূর্য।
শ্রেয়ার কর্ণে আগুন জ্বলছে। হাত চলছে ভাতের প্লেটে। লজ্জা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে স্পর্শ করে শিহরণ জাগিয়ে তুলছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাওয়া চালিয়ে শেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা। কোনোমতে ভাত গুলো গিলে আঙ্গুল চেটেপুটে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্লেট রেখে হাত ধুয়ে আসে। তূর্য বালিশে মাথা ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে। একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে আনতস্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘ পা টিপে দিব স্যার? ‘
চট করে উঠে দাঁড়ায় তূর্য। চলে আসে শ্রেয়ার সন্নিকটে। অন্তঃকরণের বেসামাল ধুকপুকানি তে শ্রেয়া পিছিয়ে যেতে চায়,কিন্তু পারে না৷ তূর্য ক্রমশ ঝুঁকে আসলো ওর গলার কাছে। তূর্যর তপ্ত নিঃশ্বাসে ঢেউ সৃষ্ট করে সমগ্র সত্তায়। উতালপাতাল ঝড় বইছে ভিতরে।
‘ কামড় দিল কে?এত গভীর প্রেমের বিষ কে ছড়ালো?’
শ্রেয়া লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। জড়োসড়ো হতে চায় জীর্ণ শীর্ণ দেহটা।বাকহারা হয়ে মাথা নাড়ে। অর্থ্যাৎ জানে না ও। তৎপরে দেখতে পায় তূর্যর ওষ্ঠে ফিচেল হাসি। ঝুঁকে থাকা অবস্থায় আফসোস করে,’ এজন্যই রহিমা খালাকে বলেছিলাম আমি আসার আগে রুম ভালো করে পরিষ্কার করতে। কিভাবে করেছে কে জানে ইঁদুর গুলো সুন্দরের মোহে পড়ে আমার সম্পদে হস্তক্ষেপ করলো। সর্বনাশ করলো তোমার। ‘
শ্রেয়া যেন আকাশ পথ ভুলে ধরণীতে ধপ করে ছিটকে পড়ল। অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,’ ইঁদুর? ‘
তূর্য সরে এসে ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করতে করতে জবাব দেয় গাঢ় স্বরে, ‘ ভেবো না বড়লোকের বাসায় ইঁদুর কোত্থেকে আসবে!কত দিক থেকে চলে আসে টেরও পাবে না। ইঁদুরকে এভাবে আকৃষ্ট করলে নিজের প্রতি উদাম অঙ্গ দেখিয়ে ,দেখো প্রতি রাতে না আবার কামড়ে দেয়। ‘
#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)