সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,২৪,২৫

0
1138

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,২৪,২৫
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___২৪

তূর্য ফাস্ট এইড বক্স টা এনে বিছানায় রাখল। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ নাও মেডিসিন লাগাও,নয়ত ইনফেকশন হতে পারে। ‘

শ্রেয়া স্থির। নড়ছে না। মাথায় তূর্যর উচ্চারিত একেকটা শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে অনবরত। সত্যিই ইঁদুর অমন করে কামড়াতে পারে?নাকি গম্ভীরমুখো এই লেকচারার হেঁয়ালি করছে ওর সাথে?বোকা বানাতে চাইছে হয়ত। এমনিতেই শৈশব কাল থেকেই ভীষণ বোকা ধাঁচের ও। এটাকে ঠিক বোকা বলে না বিষয়টা হলো এমন,যা-ই হয়ে যাক চুপচাপ থেকে সহ্য করা এবং অতিরিক্ত না ঘাঁটানো। এটাই ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তূর্য কি করে জানল ওর খালি গা পেয়ে কামড়ে দিয়েছে, সে দেয় নি তো?মনে মনে আবোলতাবোল ভাবছে শ্রেয়া। হিসেব মিলাতে পারছে না ঠিক। তূর্য কামড় দিলে কিংবা স্পর্শ করলে সরাসরি প্রকাশ্যে করতে পারে,এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে করার প্রয়োজন নেই। তাহলে ধরে নিবে ইঁদুর কামড়ে দিল?ভয়ে কলিজা ছোট্ট হয়ে যায় শ্রেয়ার। ইঁদুরের দাঁত নিশ্চয়ই ধারালো,তীক্ষ্ণ। কেমন রক্তাক্ত করে দিল!

তূর্য শ্রেয়ার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রোষপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মেয়েটা শাড়ির আঁচল হাতের মুঠোয় পুড়ে চিন্তায় মগ্ন তা ফর্সা চেহারায় স্পষ্ট। ধ্যান ভঙ্গ করতে চাপা গর্জন করে, ‘ মিসেস শ্রেয়সী! ‘

শ্রেয়া হকচকালো। তড়িঘড়ি করে চাইল সামনে দাঁড়ানো তূর্যর দিক। নম্র গলায় বললো, ‘ জ্বি?’

রাগে চোখ দুটো লাল রূপ ধারণ করলো তূর্যর। এই মেয়েকে সেই কখন থেকে ডাকছে আর এতক্ষণে সাড়া দিল!দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’ কোন দুনিয়ায় আছেন?কাইন্ডলি আপনি এদিকে আসবেন নাকি আমি কাছে যাবো?’

শ্রেয়া থতমত খেয়ে গেল। তূর্যর কন্ঠে রাগের আভাস। গুটি গুটি পায়ে কয়েক কদম অগ্রসর হলো ও। থামল তূর্যর থেকে দূরত্ব রেখে। মুহুর্তেই শ্রবণেন্দ্রিয় হলো লহু স্বরের হৃদয় নিংড়ানো বাক্য, ‘ আঁচল টা সরাও। ‘
অপ্রতিভ হয়ে পড়ে নিমেষে। বিব্রত দৃষ্টি মেলে ধরে। প্রশ্ন করার ভাষার প্রায় দুস্থিতি। কোনো রূপ দ্বিরুক্তি করতে পারছে না। শুধু বললো,’ স্যার!’

‘ আঁচল সরাতে বলেছি,ফেলে দিতে বলি নি। না সরালে চিকিৎসা হবে কেমন করে?তাছাড়া ভোর রাতে তো পুরো খোলামেলা হয়ে ঘুমাচ্ছিলে তখন লজ্জা লাগে নি?তোমার আঁচল তখন আমার পিঠের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। ট্রাস্ট মি,বহু কষ্টে সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন করার চিন্তাভাবনা সংবরণ করে ঢেকে দিয়েছি তোমাকে। ‘

দূরত্ব রেখেই কথাগুলো বললো তূর্য। কন্ঠে পরিহাস। শ্রেয়া একের পর এক ঝটকা সইতে পারল না। পরাজিত হয়ে দেহের ভার সামলাতে বসে পড়ল বিছানায়। ছি!ঘুমের ঘোরে আঁচল সরে শেষ পর্যন্ত যার কাছ থেকে মান সম্মান বাঁচানোর চেষ্টা করছিল তার কাছেই গেল?আবার সেই ব্যক্তিই ওকে ঠিকঠাক করে দিল?কেন আঁচলের কাহিনী পিছু ছাড়ে না?একবার বাতাসে নিচে পড়ে,আরেকবার ঘুমের ঘোরে তূর্যর পিঠের নিচে চলে যায় আবার এখন ভাত খাওয়ার সময় কিঞ্চিৎ সরে যায়। ফলস্বরূপ তূর্যর ঈগল চোখের পাতায় বিঁধে দগদগে কামড়ের চিহ্ন টা। এই লজ্জিত কান্ডগুলো তার সামনেই কেন হচ্ছে যে কিনা ওর প্রতি ভালোবাসার চোখে তাকায় না!তূর্য বিছানায় বসল শ্রেয়ার পাশাপাশি। ফাস্ট এইড বক্স খুলে হাতে তুলো নিয়ে তাতে স্যাভলন লাগিয়ে নেয়। কাঠ কাঠ কন্ঠে আদেশ করে, ‘ চোখ বুঁজো।’

‘ কেন স্যার?’– চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করলো শ্রেয়া। কন্ঠনালি কাঁপছে তরতর করে, সেই সঙ্গে চিকনচাকন দুই অধর যুগল।

তূর্যর ভ্রুঁ কুঁচকে চেয়ে রইল কয়েক পলক। ললাটে ভাঁজ দু’ তিনটে। কন্ঠ নরম করে বলে,’ একটু পরেই তো লজ্জায় লাল, নীল,বেগুনি হয়ে আপনাআপনি চোখ বুঁজে ফেলবে তাহলে এখন বুঁজতে সমস্যা কোথায়?আমি তোমাকে কথা দিয়েছি স্বামীর দায়িত্ব একদম একশতে একশ পালন করবো। পরে যদি ক্ষতটার অবস্থা আরও খারাপ হয় তাহলে আমার বিরাট লস হবে। তোমার স্কিন এত মোলায়েম, একটুতেই এমন,না জানি পুরোতে আমার জে’ল খাটতে হয়। ‘

অতর্কিতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শ্রেয়া। ঠোঁট জোড়া নড়ে উঠলো অল্পস্বল্প, ক্ষীণ –‘ মানে?’
তূর্যর নির্বিকার,নিরলস জবাব–‘ ইঁদুর তোমাকে প্রতি রাতে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করলে তুমি সহ্য করতে পারবে বলে মনে হয় না,পরে দোষ পড়বে আমার উপর। মানুষ বলবে আমি এ হাল করেছি কিন্তু মোটেও তো তোমার ধারে কাছে আসি না আমি। একটুতেই এমন অবস্থা, আমি ভাবছি কোনো একদিন তোমাকে ভালোবেসে ফেললে বাচ্চা ডাউনলোড প্রক্রিয়া কতটা ভয়ং*কর হবে। ‘

শ্রেয়া স্তব্ধ। কথার প্যাঁচে যদি কাউকে কপোকাত করতে হয় তাহলে নিঃসন্দেহে ওর সামনে,নিকটস্থ বসা সুঠাম দেহের সুদর্শন পুরুষ টা জিতে যাবে। বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে আখিঁপল্লব মিশিয়ে নিল ও। বুঁজে ফেলল চক্ষুদ্বয়। ঠোঁট দুটো লজ্জার,নার্ভাসনেসের দাপটে কম্পমান। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে তীব্র গতিতে ক্ষণে ক্ষণে। কিছুক্ষণের নিরবতার প্রহর কাটে। নিমিষেই শিরা উপশিরার তড়িৎ বেগে কিছু একটা ছুটে যায়। অনুভব করে দেহের তাপমাত্রা বেড়েছে, ক্ষত স্থানে নরম কিছুর গভীর স্পর্শ। অতীব গাঢ় তা। তুলার? জ্বলে নি কেন তাহলে?মনেই হয় নি তুলার। অন্য কিছুর ছিল। ভাবতেই মুখ দিয়ে আহ শব্দ টা বেরিয়ে আসে। জ্বলে উঠে। হাত বাড়িয়ে অস্থির হয়ে খামচে ধরলো তূর্যর বলিষ্ঠ হাত।
‘ জ্বলছে স্যার। ‘
তূর্য হাত টা সরিয়ে নিজের অপর হাতে মুষ্টিমেয় করে নিল। ফুঁ দিল কাছে এসে। শ্রেয়ার নিজেকে শক্ত রাখতে পারছে না। বললো,
‘ তাড়াতাড়ি শেষ করুন। ‘
বলার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পদে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে উঠে দাঁড়াল তূর্য। শ্রেয়া আঁচল টা উঠাতে গেলে কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বলে উঠলো,
‘ থাকুক। আমি এসি বন্ধ করে ফ্যান ছেড়ে দিচ্ছি। ‘
কথামতোন কাজ টা করে তূর্য দরজা ভিড়িয়ে চলে গেল। এতক্ষণে উপযুক্ত সময় পেল শ্রেয়া ভালো করে নিঃশ্বাস ফেলার। বক্ষস্পন্দনের গতি নিয়ন্ত্রণ হারা। এত মাদকতা মেশানো কেন তূর্যর চাহনি?চুম্বকের ন্যায় আকৃষ্ট করে বারংবার। মুখ ফোটে বেরিয়ে আসতে চায়–‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি স্যার। আমাকে একটা বার বুকে মিশিয়ে নেওয়া যায় না?’
____________

ফাতেমা চৌধুরী লাঠি ভর দিয়ে রান্নাঘরের কাছে এলেন। রহিমা গুণগুণ করছে আর সবজি কাটছে। মেহরিমা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে ওনার। আজ সন্ধ্যায় আবার বাড়িভর্তি হবে মেহমানে। কাল বউভাত। তাই ব্যস্ত হাতে রহিমা,ত্রিহা বাকি কাজের লোকরা রান্নার আয়োজনে নিমজ্জিত। মেহরিমা শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে মলিন স্বরে বললেন,’ আম্মা কিছু লাগবে?’
‘ হু। আমার গরম ভাত। তোমরা কি ভুইলা গেছো এমন সময়ে আমি ভাত খাই?কই ভাত কই আমার?’– চেঁচিয়ে বললেন ফাতেমা।
রহিমা ওনার মতোন উঁচানো স্বরে বলে, ‘ আম্মা আপনের লাইগ্গা যেই ভাত রানছিলাম ওইডি তো তূর্য বাবা লইয়া গেছে। এখন আবার বসাইছি,কুদ্দুর দাঁড়ান। ‘

মেহরিমা সন্দিহান দৃষ্টে চেয়ে বলে,’ এ সময়ে তো কেউ ভাত খায় না। শুধু আম্মা খাই বলে ওনার জন্য অল্প করে রান্না করা হয়। সবার জন্য দুপুরের দিকে করা হয়। আর তূর্য কখনই খায় না অসময়ে। তাহলে? ‘

রহিমা বলতে চাইছে না। ওনি ভালো বুঝেছেন মেহরিমা শ্রেয়াকে পছন্দ করে না। তাই কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বললো,’ আমি জানি না। তূর্য বাবা-ই কইতে পারব। আমি এত ঘাঁটি নাই। ‘

মেহরিমার সন্দেহ হচ্ছে। নাস্তার টেবিলে দেখেছে শ্রেয়া শুধু একটা পরোটার অর্ধেক খেয়েছে। যা বুঝার বুঝে নিলেন ওনি। শেষমেশ এই মেয়েটাও তার ছোট ছেলেকে সরিয়ে নিচ্ছে,নিজের আঁচলে বেঁধে ফেলছে। অহমিকা যথেষ্ট ভালো মেয়ে ছিল। কখনোই এমন করত না। বিষাদে ভরে উঠে মনটা। শ্রেয়াকে ধরে চ-ড় মারতে ইচ্ছে করছে ওনার। কিন্তু তূর্যর জন্য হাত দু’টো গুটিয়ে রাখতে হয়। স্বামী, ছেলে দুজন কার কেউই ওনার সঙ্গে কথা বলছে না ভালোমতন।

কাজের লোকের মাধ্যমে শ্রেয়াকে রুমে ডাকালেন। গোপন কথা চার দেয়ালের বন্দিত্বে থাকাই ভালো। মাথায় ঘোমটা টেনে কক্ষে পদার্পণ করলো শ্রেয়া। মেহরিমা ওকে বসতে পর্যন্ত বললেন না। সোজাসাপ্টা কঠোর কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘ এক রাতেই বশ করে ফেললে আমার ছেলেকে?’
শ্রেয়া ভড়কালো,তাকালো আগ্রহ নিয়ে। ভেবেছিল আগের সবকিছু ভুলে শাশুড়ির মন জয় করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু সময়,পরিস্থিতির অদল বদলে সে আরো বি’ষ হয়ে উঠেছে শাশুড়ির নিকট। কন্ঠে প্রখর নম্রতা বজায় রাখে,
‘ কি বলছেন আম্মা?’
‘ কি বলছি? কোন মুখে এলে আবার?লোভে পড়ে?এখন জামাই সুস্থ বলে?বলতে বলতে হাঁপিয়ে গেছি আমি। আজ বলতে বাধ্য হলাম ফকি’ন্নিকে প্রশ্রয় দিলে বুকে লাথি মারে। লোভী মেয়ে একটা।’

শ্রেয়া নরম অধরে মৃদু হাসি ভিড় জমায়। আলগা করে বলে,
‘ আমি কিন্তু এখনও আপনার ছেলেকে দ্বিতীয় বার ফিরে আসার কাহিনী টা বলি নি শাশুড়ি আম্মা। হাতিয়ার হিসেবে রেখে দিলাম। ‘
তৎপরে মিহি স্বরে বললো,’ লোভী বলবেন না। লোভ করলে প্রথমেই থাকতে পারতাম। শুধু একটু ভালো থাকার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। যখন শুধরাতে চাই, আপনি আমার ভুলের মাত্রা টা বাড়িয়ে দিলেন। আপনার ছেলের সাথে সম্পর্ক কখনও নষ্ট হবে না। কারণ সম্পর্কের মর্ম আমি বুঝি। ‘

মেহরিমা গর্জে উঠলেন,’ বেরিয়ে যাও রুম থেকে। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
শ্রেয়ার ইচ্ছে করে নি ওইভাবে কথা বলতে, বাধ্য হয়ে বললো। দুর্বল ভেবে কতশত আঘা*ত করে কথা শোনাচ্ছে ওকে মেহরিমা। অতিরিক্ত ভদ্র হতে গিয়ে অত্যধিক কষ্ট লিখছে খাতায়।
_________

মধ্যাহ্নের তেজী রূপে বাগানের ফুলের চারার কিছু কিছু পাতা নুইয়ে পড়েছে। শ্রেয়া ব্যস্ত চোখে অবলোকন করছে সেগুলো। পাশে আয়ুশী বক বক করছে বিরতিহীন। ঘরে একা একা শান্তি লাগছিল না বিধায় ত্রিহা চাচী ওদের বাগানের দিকটায় হাঁটতে পাঠিয়ে দিল। খোলামেলা পরিবেশে মনের ঘর হতে কিছুটা হলেও মন খারাপেরা বিদায় নিবে। ত্রিহা তখন ওকে দেখেছিল মেহরিমার রুম থেকে বেরোতেই। কি করে যেন মানুষ টা শ্রেয়ার মন পড়ে ফেলে। প্রিয়ু খুবই কপাল গুণে এমন শাশুড়ি পেয়েছে বলে মনে হয় শ্রেয়ার। হাঁটতে হাঁটতে একটা মুহুর্তে সেই বড় পেয়ারা গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায় দু’জনে। শ্রেয়া উপরের দিকে দৃষ্টি তাক করতেই আয়ুশী উৎফুল্ল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘ পেয়ারা খাবে ভাবী?জানো,এ গাছের পেয়ারার স্বাদ এত ভালো, না খেলে আফসোস থেকে যাবে। ‘

শ্রেয়ার উজ্জ্বল ফর্সা মুখশ্রী চকচক করে উঠলো। মুখ ফোটে বলতে পারছিল না এতসময় অবধি লজ্জায়,জড়তা-সংকোচে। এখন হেঁটে আসা সুযোগ কে পায়ে না ঠেলে আহ্লাদী কন্ঠে সায় জানায়। বলে,’ হুম। ‘

‘ দাঁড়াও বাঁশের ব্যবস্থা করি। ‘– কথাটা বলে ছুটে গেল আয়ুশী মালী কাকার কাছে। বাঁশ না পেলে ওনাকেই গাছে উঠাবেন চিন্তা করলো।

নিচের দিকে একটা ডালা ঝুঁকে আছে। তাতে দু’টো পেয়ারা। পায়ের আঙ্গুল মৃত্তিকায় ভর দিয়ে হাত উঁচিয়ে টেনে নিচে নামানো যাবে। ভাবনা অনুযায়ী হাত উপরে তুলে ডালা টা টেনে নামাতে লাগে শ্রেয়া। মুহুর্তেই ককিয়ে উঠে অকস্মাৎ ব্যাথায়। কন্ঠনালি গলিয়ে আসে ব্যাথাসূচক ধ্বনি। মনে হলো কেউ কোমরের মাংস ছিঁড়ে ফেলেছে।

#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___২৫

শ্রেয়া ব্যাথায় ডালা টা ছেড়ে কোমর ঢলতে উদ্যত হয়। তখনি লম্বা,বলিষ্ঠ একটা হাত ওর পিছন থেকে ডালা টা টেনে ধরে। উপলব্ধি করে শ্রেয়া ওর পিঠ ঠেকে গিয়েছে একদম মানুষ টার শক্তপোক্ত, প্রশস্ত বক্ষে। কারো বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে ও।তপ্ত, গাঢ় নিঃশ্বাসের আলিঙ্গন সমগ্র ঘাড় জুড়ে। স্পর্শ, নিঃশ্বাস সবটাই যেন চেনা। মানুষ টার গা থেকে মন মস্তিষ্ক, দেহ মাতাল করা ঘ্রাণ হুড়মুড়িয়ে নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করছে। অতি সন্তর্পণে শ্বাস টেনে নেয় ও। মুহুর্তেই শুরু হয় অন্তঃকরণে অনুভূতিদের বিচরণ।

শ্রেয়া মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চাইলেও পারে না, ব্যক্তি টা আরও সন্নিকটে চলে আসে। অপর হাত দিয়ে পেয়ারা দু’টো ডালা হতে মুক্ত করে ছেড়ে দেয়। নিমিষেই দেহ টা শ্রেয়ার পিঠের সঙ্গে আরো একটুখানি মিশিয়ে শ্রবণগ্রন্থিতে ফিসফিস করে বলে,
‘ বাঁকা, অনাবৃত কোমর টা যদি আমি বাদে অন্য কেউ দেখে ফেলত?এমন করে স্বামীর হক মে’রে দিবে?একটু সাবধানে থাকা যায় না?বোকাসোকা, গাধী বউ নিয়ে তো জ্বালায় পড়লাম। ‘

তাজ্জব বনে গেল শ্রেয়া। পা দুটো ভূতলে অনড়। কাঁপছে না একটুও। ঘাড় বাঁকিয়ে চাইল না পর্যন্ত। ইতমধ্যে লজ্জা-শরমে অভ্যন্তরে তোলপাড় আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। তূর্য এখনও ওর গায়ের সাথে মিশে। সহ্যশক্তি শূন্যের কোঠায় চলে আসছে শ্রেয়ার। দেহের ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বুঁজে দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে মনস্পৃহা জাগছে। স্পষ্টত শুনতে পাচ্ছে রণঢাকের আওয়াজ। কি সুন্দর বাজছে ভিতরে!প্রিয় মানুষের নিকটে কত অদ্ভুত, ভয়ংকর অনুভূতি কাজ করে এ মুহুর্তে উপলব্ধি করতে সক্ষম ও। কখনও এতটা কাছে আসা হয় নি। সাক্ষাৎ হওয়ার পর থেকে কখনই দূরত্ব ঘুচিয়ে নিজ থেকে স্বইচ্ছায় তূর্য মিশে নি ওর কাছাকাছি এসে। পরম আনন্দে,সুখে,অনুভূতির সংমিশ্রণে অন্তরে অনাবিল শান্তির সমীরণ বয়ে যাচ্ছে বাঁধা বিহীন। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ীত্ব লাভ করলো না৷ তূর্য সরে গিয়ে বললো,

‘ এদিকে ফিরো। ‘

শীগ্রই ঘুরে দাঁড়াল শ্রেয়া কোনো প্রকার ভণিতা না করে। তূর্য কপাল কুঁচকে চিরাচরিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘ বাহিরে এসেছো কার সাথে?’
‘ আমার সাথে এসেছে ভাইয়া। ‘

পিছন থেকে বলে উঠলো আয়ুশী। পাশে মালী কাকা দাঁড়িয়ে। তার হাতে বড় লম্বা একটা বাঁশ। তূর্য হাতের পেয়ারা দু’টো শ্রেয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’ ধরো। ‘

শ্রেয়া কাঁপা কাঁপা হাতে নিয়ে নেয় সেগুলো। তূর্য মালী কাকার কাছ থেকে বাঁশ টা নিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, ‘ আপনি যান কাকা। ‘
অতঃপর নিজেই পেয়ারা পাড়তে শুরু করে। অকস্মাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো আয়ুশীর উদ্দেশ্যে,’ অনুমতি নিয়েছিস তোরা এ গাছের পেয়ারা ছোঁয়ার? ‘

আয়ুশী আমতাআমতা করে বলে,’ বড় আব্বু একবার বলেছে আমরা চাইলেই খেতে পারব। তুমি তো পেয়ারা পছন্দ করো না তাই নিউজ টা তোমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি৷ ‘

‘ এত সহজে বাবা তোদের খাওয়ার অনুমতি গ্র্যান্টেড করে দিল?দিতেই পারে, যার অতি মহামূল্যবান রেখে যাওয়া জিনিস আগলে রাখার বদলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, এই সামান্য পেয়ারা গাছ আর কি!’

শ্রেয়া খেয়াল করলো তূর্যর কন্ঠে তাচ্ছিল্য, উপহাস। একটা পেয়ারা গাছের পেছনে এত রহস্য? এটা কি নুরুল চৌধুরীর খুব প্রিয়?হতেই পারে!নতুবা সকালে অমন ঘুরে ঘুরে দেখে ছোট্ট ছোট্ট নিঃশাস কেন ফেলছিল। তূর্য আরও তিনটে পেয়ারা আয়ুশীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাতে লেগে থাকা ময়লা ঝেড়ে নেয়। তৎপরে হনহন করে ঢুকে যায় সৌন্দর্যে ভরপুর দু’তলা বাড়িটার ভেতরে। স্তম্ভিত হয়ে স্থবির, অনিমেষ নেত্রে চেয়ে থাকে শ্রেয়া মানুষ টার যাওয়া অব্দি। ও বুঝে পায় না এমন কেন এই লেকচারার?মুখের আদলের পরিবর্তন ঘটে ক্ষণে,ক্ষণে। এই মেঘ,এই বৃষ্টি। আবার কখনও কড়া, তপ্ত রৌদ্দুর।

প্রিয়ু ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে আয়ুশ একমনে টেবিলের সামনে বসে খাতায় কি একটা জহুরি চক্ষে চেক করছে। হয়ত ভার্সিটির কোনো জরুরি কাগজ হবে। খুব বেশিদিন ছুটি পায় নি সে। দু’দিন বাদেই আবার নিয়মিত ক্লাস করাতে যেতে হবে। উঁচানো গলায় ডাকল প্রিয়ু,
‘ চার চোখ লেকচারার বাহিরে যাবো আমি। ‘
‘ যাও।’– সিধে সাধা, সোজা জবাব আয়ুশের। দৃষ্টি টেবিলের উপর বিছিয়ে রাখা কাগজেই মগ্ন।
প্রিয়ু ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে স্থির হলো। মুখে লজ্জা মেখে আওড়ালো,
‘ একা একা যেতে পারব না। কেমন লজ্জা লাগে!তুমি দিয়ে এসো না। ‘
নিমিষেই ফিক করে হেসে দিল আয়ুশ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি সংবরণ করে বললো,
‘ গত রাতে কোথায় ছিল এই লজ্জা? তুমি যদি পারতে আমাকে রক্তাক্ত করেই দম নিতে। কিন্তু আমার শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে গেল। ‘
কথাগুলো শুনে প্রিয়ু স্তব্ধ। কানের কাছে তবলা বাজছে যেন। রি রি করে উঠে সমস্ত কায়া। আঁচল দিয়ে মুখ লুকিয়ে বলে,
‘ নির্লজ্জ! ‘
সাথে সাথেই আয়ুশের কন্ঠে নির্লিপ্ততা, ‘ অনলি ফর ইউ। ‘
পরক্ষণে মুখের আকৃতির বদল হয়। কন্ঠে জড়তা নিয়ে বলে উঠে,’ একটা প্রশ্ন করবো প্রিয়ু?’
‘ হ্যাঁ করো। ‘
সম্মতি পেয়ে আয়ুশের নিঃসংকোচ বাক্য, ‘ বড় আব্বুর কথায় শ্রেয়া কষ্ট পেয়েছে, ওর সাথে একটু বেশি বেশি থেকো। মেয়েটা তোমার উপর ভরসা করে খুব। ভাইয়ের ব্যাপার টা বুঝতে পারছি না। শ্রেয়ার হয়ে যখন কথা বলল বেশ ভালো লেগেছে, এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছে মেয়েটাকে অত্যন্ত ভালোবাসে সে৷ কিন্তু! এত সহজে সবকিছু ভুলে আপন করার পাত্র না তূর্য ভাই। ‘

প্রিয়ু অত ভাবল না। বিলম্ব না করে উত্তেজিত সুরে বললো,’ আরে তুমি জানো না স্যার একদম আপন করে নিয়েছে শ্রেয়ু কে। আমি তো প্রমাণও দেখেছি। অযথা চিন্তা করো না। ‘

আয়ুশের ভ্রুঁ যুগল ললাট স্পর্শ করে,’ প্রমাণ?’

চেহারায় রক্তিম আভা ফুটে ওঠে প্রিয়ুর। চোখ জোড়া নত হয়। অধর কোণে ঈষৎ স্মিত হাসি।
‘ ওই তুমি যেটা আমাকে দিয়েছো আমি সেটা শ্রেয়ার গলার নিচে দেখেছি। ‘
নিমিষেই আয়ুশ সজোড়ে বুকে জড়িয়ে নিল সম্মুখে নত মস্তকে দাঁড়ানো প্রিয়ুর নরম দেহ খানি। প্রিয়ু প্রচন্ড বিস্মিত হলো। ধ্বক করে কেঁপে উঠে নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে পড়ে ওর হৃদযন্ত্র। পিঠে হাতের বাঁধন দৃঢ় হতে অত্যধিক দৃঢ় হয়। হয়ত আয়ুশ ওকে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলতে চাইছে।

হাত দু’টো বাড়িয়ে প্রিয়ুও চেষ্টা করলো আয়ুশের সুঠাম শরীর টা নিজের দু হাতে বন্দী করার। শ্রেয়ার ব্যাপারটা এমন খোলাখুলি করে বলা উচিত হয় নি প্রিয়ু বুঝতে পারল। শত হোক ক্ষত সহজে শুকায় না। ও ভালো করে চিনে আয়ুশকে। উপর থেকে শক্ত খোলসে আবৃত তার নরম মনটা। অনায়সে কোনো কষ্ট ভুলতে পারে না। তাই বলে ওকে ভালোবাসে না এমনটা নয়। পিছুটান সবারই থাকে। খুব কম মানুষ, যারা কঠোর হৃদয়ের তারাই পারে সেই পিছুটান ফেলে এগিয়ে যাবার। আবার অনেকে এগিয়ে যায় ঠিকি কিন্তু মনের কোণে থেকে যায় না পাওয়ার, অতৃপ্ততার বিষাদ,বেদনা। আয়ুশ ওকে বাহুতে বন্দী রেখেই আনন্দিত গলায় বলে,’ এবার আর কোনো চিন্তা থাকল না আমাদের। ভালো থাকুক মেয়েটা। ‘
_____________

প্রিয়ুকে নিচে না পেয়ে একটা পেয়ারা হাতে রেখে বাকিগুলো আয়ুশীকে দিয়ে দিল শ্রেয়া। বললো,
‘ প্রিয়ুকেও দিও। ‘
আয়ুশী মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুমি প্রিয়ু ভাবী কে অনেক ভালোবাসো তাই না ভাবী?’
শ্রেয়া নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। মস্তিষ্ক খাটিয়ে চিন্তা করলো কতক্ষণ, কয়েক সেকেন্ড। ঠিক উত্তর মিলল না। মিহি কন্ঠস্বর ওর,
‘ ঠিক কতটুকু ভালোবাসি পরিমাপ করা মুশকিল। কারণ আমার এতটুকু আসা অবধি ওর অনেক অবদান। ভালোবাসি বললে শব্দ টা কম হয়ে যাবে আয়ুশী। প্রিয়ু আমার প্রিয় একজন মানুষ। আমার প্রিয়র তালিকায় চাইলেই কেউ যোগ হতে পারে না। মানুষগুলোর দেওয়া ভালোবাসা,যত্ন গুলোই তাদের আমার প্রিয় নামক তালিকায় যুক্ত করে। আপাতত শুধু দু’টো মানুষই হতে পেরেছে। ‘
‘ সেই দু’জনের আরেকজন ভাইয়া?’
আয়ুশীর প্রশ্নে শ্রেয়া নিরুত্তর। বাধ্য হয়ে ও ফের প্রশ্ন করলো। ঠোঁট দুটো নড়ে উঠলো শ্রেয়ার। অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে বলে,’ হুম। ‘

তৎক্ষনাৎ দু’জনের কর্ণগোচর হয় কারো গম্ভীর, তেজি স্বর। হকচকিয়ে যায় শ্রেয়া। উপরের দিকে তাকাতেই দেখে তূর্য সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখ কুঁচকানো। ঠোঁটে ফিচেল হাসি। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল শ্রেয়া। তূর্য শুনে ফেলে নি তো?ও সরাসরি ভালোবাসি বলে নি,কখনও বলতেও পারবে না। ভয় করে যদি তূর্য ফিরিয়ে দেয়?এমনিতেই প্রকাশ না করতেই সুদূরে ঠেলে দিয়েছে। এছাড়া শুনলে ওকে কথার মাধ্যম ব্যবহার করে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে।

তূর্য লহু স্বরে ডাকল পুনর্বার,’ উপরে আসো শ্রেয়সী। ‘

সোফায় ফাতেমা চৌধুরী, ত্রিহা বসেছিল। ওনাদের কানেও পৌঁছাল কন্ঠস্বর। তাৎক্ষণিক মুখ বাঁকালেন ফাতেমা। বিড়বিড় করলেন দাঁতে দাঁত চেপে,’ কালা জাদু জানে এই মাইয়া জামাই বশ করার। ‘
ত্রিহা নরম কন্ঠে বললো,’ তূর্য শুনলে রেগে যাবে আম্মা। ‘
ফাতেমা চৌধুরী চোখ রাঙিয়ে গিয়ে কিছু বলতে চাইলে ত্রিহা সোফা ছেড়ে উঠে গেল। এগিয়ে এসে সিঁড়ির মুখে দাঁড়ানো শ্রেয়ার কাঁধে হাত রেখে বললো,’ যাও। ‘
মাথা নেড়ে সিঁড়ির প্রত্যেক ধাপ অতিক্রম করে শ্রেয়া তূর্যর কাছাকাছি যায়। স্থির হতে না হতেই হাতের কব্জিতে চাপ প্রয়োগ করে রুমে নিয়ে আসে তূর্য। টেনে খাটে বসায়। দরজা লক করে এসে বসলো শ্রেয়ার পাশে। চাহনি প্রগাঢ়,তুখোড়। শ্রেয়া মুখো ভঙ্গি পুরোপুরি বুঝার আগেই তূর্য হাত বাড়িয়ে হেঁচকা টানে বক্ষে এনে ফেলল ওর কোমল দেহ টা। ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিল সঙ্গে সঙ্গে। গভীরভাবে ডুবিয়ে দেয় রুক্ষ শুষ্ক ওষ্ঠাধর।

ওষ্ঠ যুগলের উষ্ম ছোঁয়ায় শীতল স্রোত নেমে গেল শ্রেয়ার শিরদাঁড়া বেয়ে। শিরা উপশিরায় প্রবল অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল। সইতে না পেরে হাতের আঁজলা মুঠো ভর্তি করে নিল তূর্যর কয়েকটা চুল। খামচে ধরলো কঠিন ভাবে।

#চলবে,,,!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here