#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,৩০,৩১
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩০
সারা বাড়িতে চোখ বুলিয়েও শ্রেয়া কাঙ্ক্ষিত মানুষ টার দেখা পেলো না। রেডি হয়ে নিচে এসে সোফায় থম মেরে বসে আছে কতশত, হাজার সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে। তবুও ভুল করেও মানুষ টা নিজের পদধূলি ফেলল না এদিকটায় একবারের নিমিত্তে। রাশেদা টুকটাক কথা বলছেন। তন্মধ্যে বার কতক বলে ফেলেছেন মাশাআল্লাহ শব্দখানা। তিনি যতবারই দৃষ্টি মেলে ধরছেন শ্রেয়ার দিক ঠিক ততবারই স্থবির হয়ে পড়ছে চাহনি,চক্ষু কোটরে জমা হচ্ছে অজস্র মুগ্ধতা। কাউকে সাদায় এত মানাতে পারে?কি চোখ ধাঁধানো রূপ!এ যেন গোবরে পদ্ম। অর্থাৎ অস্থানে ভালো জিনিস। শ্রেয়াও ওনার নিকট একটা পদ্মফুল। যার নির্দিষ্ট ঠিকানা এতকাল না থাকলেও নিজের গুণে, রূপে,মনের সৌন্দর্যে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে এই কঠিন,কোলাহলপূর্ণ নগরীতে। হাত বাড়িয়ে শ্রেয়ার মাথার টায়রা টা ঠিক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ তুই খুশি তো এখন?আগের কথা নিয়ে কেউ কিছু বলেছে?’
প্রশ্নটা অনেক রয়েসয়ে করেছেন তিনি। তাও খুব ক্ষীণ স্বরে। খুব বেশি চিন্তা হচ্ছিল মেয়েটার জন্য। আজ বাবা মা থাকলে হয়ত ওনার মতোন জিজ্ঞেস করতেন, মেয়ের মুখের আনন্দের ঝিলিক টা পরখ করতেন। শ্রেয়া হাসল। মৃদু,নিঃশব্দ হাসি। রিনঝিনে কন্ঠে বলে,
‘ কেউ কিছু বলে নি আন্টি। সবাই খুব ভালো। আমি জানি তুমি দাদির ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছো। উনি এমনই। বুড়ো বয়সে মানুষ বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। কোনটা ভালো,কোনটা সঠিক,কে কি কথায় কষ্ট পাবে এসব আমলে নেয় না, ভাবে না৷ আর দু চারজনের খারাপ ব্যবহার মানিয়ে নিতে পারলে, চুপ করে সহ্য করলে মানুষগুলো পরবর্তীতে এমনি পরিবর্তন হয়ে যাবে বলে আশা করি আমি। সমান সমান লড়াইয়ে একজন না একজন হারে কিন্তু একজনের লড়াইয়ে হারার পূর্বেই মানুষ টা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কারণ লড়াইয়ের জন্য প্রতিপক্ষই তো পায় না। আমি কখনও লড়ব না। ‘
অত্যন্ত অবাক হলেন রাশেদা। এই মেয়েকে কি বুঝাবেন তিনি?সে নিজেই কত মনোহরণ করা বাক্য শুনালো। একা একা সংগ্রাম করে বাঁচা মেয়েগুলো অল্প বয়সেই বাস্তবতা শিখে যায়,শ্রেয়া তারই এক ত্রুটিহীন উদাহরণ।
ফাতেমা চৌধুরী আসন ছেড়েছেন আয়ুশের কথায় পরাজিত হয়ে সেই কখন। আয়ুশও চলে গেছে বাহিরে। খাবারের আয়োজন বাহিরেই করা হয়েছে। এতিমখানায়ও খাবার পাঠানো হয়েছে। রহিমা খালা এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত এনে শ্রেয়ার সামনে রাখলো। বললো,
‘ খাইয়া নাও নতুন বধূ। তূর্য বাবা ফোন দিয়া কইল আগে এক গ্লাস শরবত এরপর ভাত খাইয়া লইবা প্রিয়ুর বাড়ির সবার লগে। ‘
শ্রেয়া হতভম্ব। বিহ্বল কন্ঠে তূর্যর কথা জানতে ইচ্ছে জাগে। কিন্তু লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পারে না৷ প্রিয়ু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসে। রহিমাকে বললো,
‘ ভাইয়া কোথায়?ফোন করে বললো যে?বউয়ের যত্ন সরাসরি এসে নিতে পারেন না?’
নিমিষেই নখ বিঁধিয়ে দিল শ্রেয়া প্রিয়ুর হাতের পিঠে। এতগুলো মানুষের সামনে মেয়েটা এত নির্লজ্জ,লাগামহীন প্রশ্ন করছে!সবাই কি ভাববে?অনেকেই মুখ টিপে হাসছে। রহিমা শাড়ির আঁচল টা মাথায় টেনে বললো,
‘ তূর্য বাবা তো এতিমখানায় গেছে খানাদানা লইয়া। এক্কেবারে সবার খাওয়া হইলেই আইব। আমারে নতুন বধূর দায়িত্ব দিয়া গেল। ‘
প্রিয়ু ঠোঁট গোল করে বলে,’ ওহ আচ্ছা খালা। ‘
এতিমখানায় গিয়েছে মানুষ টা?শ্রেয়ার ইচ্ছে ছিল আরেকবার যাওয়ার। জীবনে বেড়ে উঠার গল্পটা শুরু তো সেখান থেকেই। বেশ স্পৃহা জাগে সেই চিরচেনা মৃত্তিকায় পা রেখে কল্পনায় মোহিত হয়ে একটাবার আলিঙ্গন করতে মাদারকে। জীবন কতকিছু শেখায়। কতকিছু ত্যাগ করে। চেনা মানুষেরা জড়ো হয় স্মৃতির পাতায়,পড়ে থাকে অতীতে। টেবিল থেকে গ্লাস টা তুলে কয়েক চুমুক খেল সে। এই লোক কাল রাত থেকে ওকে শরবত খাওয়াচ্ছে। মতিগতি ভালো ঠেকছে না। ওর পেট কে বড়সড় একটা পুকুরে পরিণত করার ফন্দি এঁটেছে নাকি!ভাবনামাত্র প্রিয়ু নিচু গলায় কানের কাছে ফিসফিস করলো,
‘ এত্ত ভালোবাসা! যা গরম পড়েছে তার জন্য ভাইয়ার কত চিন্তা! শরবতও পাঠিয়ে দিল বউয়ের অন্তর ঠান্ডা করতে। শ্রেয়ু এত আদর,প্রেম কেমনে হজম করছিস?বলস না প্লিজ। ‘
গালে লালের প্রলাপ পড়েছে শ্রেয়ার। আসলেই তূর্য এমনি এমনি কেন ওর জন্য এত চিন্তা করছে?শুধু বউয়ের যত্নের জন্যে?ভালো না বেসেও বউকে কেউ এভাবে আগলে রাখতে পারে?প্রত্যেক অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে এমন হয়? এর পেছনে একটুখানি অনুভূতিও কি লুকায়িত থাকে না?ভাবতে ভাবতে ভিতরে ভিতরে ক্লান্ত। কি করে বুঝবে ও এই রহস্যময়, গম্ভীর লেকচারারের মন,কথা?রসায়নের জৈব যৌগও এর থেকে ঢের সহজ।
মেহরিমা হাসি মুখে এগিয়ে আসলেন ত্রিহা,রুনাকে সাথে নিয়ে। সম্মান রক্ষার্থে শ্রেয়া,প্রিয়ুর উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ বাহিরে চলো দু’জন, খাবে। ‘
পরক্ষণেই রাশেদার দিকে চেয়ে বলে,
‘ চলুন বেয়াইন। অনেক দেরি হয়ে গেল। এখন খেয়ে নেওয়া দরকার। ‘
রাশেদা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলেন নিজের মনে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা কথাটা পাড়ার। দুই অধর প্রসারিত করলেন,
‘ আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আজ প্রিয়ুর সাথে শ্রেয়া ও তূর্যকেও নিয়ে যেতে চাইছি৷ আপনি কি বলেন?’
মেহরিমা থমথমে গলায় বলে উঠেন,
‘ যেতে চাইলে নিয়ে যান। বাকিটা তূর্যর মর্জি। ওর বউ,ওর অনুমতি ছাড়া ওকে কেউ কিছু বললেও বাড়িতে তুফান বয়ে যায়।’
দিব্যি বুঝলো উপস্থিত সবাই মেহরিমা অপ্রকাশ্যে খোঁচা টা শ্রেয়াকেই মে’রেছে। মলিন মুখে ওঠে দাঁড়ায় ও। প্রিয়ুর মা সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসি বজায় রেখেই বললেন,’ আচ্ছা। ‘
___________________
একটা তপ্ত দুপুর,অপরাহ্ন কেটে পৃথিবীর দুয়ারে হাজির হয় গোধূলির লগ্ন। শ্রেয়া লেহেঙ্গা সামলে বাহিরে আসলো। সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টার পর ঘন্টা পার হলো অথচ আজ আর বাড়িমুখো হয় নি তূর্য। আয়ুশ ফোন দেওয়ায় জানায় শ্রেয়াকে নিয়ে এতিমখানা পর্যন্ত আসতে। অতঃপর সেখান থেকেই যাবে প্রিয়ুদের বাড়ির দিকে। মেহমান বিদায় দিতে চৌধুরী বাড়ির সবাই বাহির অব্দি আসলেন। শ্রেয়া নুরুল চৌধুরীর সামনে দাঁড়িয়ে অতীব নম্র কন্ঠে দু’টো শব্দ মিলিয়ে বাক্য বুনে,
‘ আসি বাবা। ‘
নুরুল চৌধুরী হাসলেন না। চোখ মুখও কুঁচকালেন না৷ অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘ নিজের খেয়াল রেখো। ‘
মেহরিমা কে আসি আম্মা বলতেই তিনি দাঁতে দাঁত চেপে সবার অলক্ষ্যে আওড়ায়,’ ম*রে যেও তবুও আমার বাড়ির আঙিনায় তোমার পা না পড়ুক আর। ‘
শ্রেয়ার নেত্রকোণে জল জমে। গড়িয়ে পড়ার অভিপ্রায়। এভাবে কেউ বলতে পারে?নরম মনটা ক্ষতবিক্ষত হলো মুহুর্তেই। এত ধারালো কেন কথা নামক অ-স্ত্র? এ পৃথিবীতে বিশাল বিশাল অ-স্ত্রের প্রয়োজন নেই, মানুষের কন্ঠনালি হতে তৈরি কথার অ-স্ত্র খুবই তীক্ষ্ণ,ধারালো। চাইলেই অন্য একটা মানুষের আত্মার হ-ত্যা করতে পারে নিমেষে। একবার ছু*রি আঘা’তে রক্ত ঝড়ে সময় নষ্ট ব্যতীত কিন্তু কথার আঘা’তে মানুষ রক্তাক্ত হয় ধীরে ধীরে। বুক ফাটে কিন্তু তা দেখানো যায় না। শ্রেয়া কথার মাত্রা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে গাড়িতে গিয়ে বসে। টুপ করে মেকআপে সজ্জিত গাল স্পর্শ করে এক বিন্দু অশ্রু। ব্যতিব্যস্ত হাতে মুছে নেয় কেউ দেখার পূর্বে। আয়ুশ ড্রাইভিং সিটে বসা ছিল। গাড়ির সামনে রাখা টিস্যু বক্স থেকে একটা টিস্যু পেছনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। রাশ ভারী কন্ঠে বলে,’ মুছে নাও। ‘
শ্রেয়া হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলে,’ ঠ,,ঠিক আছি ভাইয়া। ‘
‘ হুম দেখতে পাচ্ছি। ‘–ছোট্ট আয়না খানায় দৃষ্টি রেখে কথাটা বলে আয়ুশ।
প্রিয়ু পাশের সিটে বসে হাতের চুড়িগুলো খুলে রাখছিল। হাত টা চুলকাচ্ছে খুব,খুব। নিজ কাজেই মগ্ন থেকে বলে ওঠে রসাত্মক করে,
‘ নিশ্চয়ই আয়ুশ ভূত দেখছে মিররে। তাই জলদি নাক,মুখের জল মুছতে বলছে। তাড়াতাড়ি মুছে নে। আমার জামাইয়ের হার্ট অ্যাটাক হতে পারে তোর মতোন ভূত দেখে। তাকিয়ে দেখ,কান্নার দাপটে মেকআপ খতম। ‘
অশ্রুসিক্ত নয়নে ঠোঁট ছড়ায় শ্রেয়া। টুকটুকে গাঢ় লাল ওষ্ঠদ্বয়ে স্মিত হাসি অনেকখানি জায়গা লিখে নেয় নিজের নামে। এ দু’টো মানুষ যে ওর জন্য আর কত কি করবে!টিস্যু টা হাতে নিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে আওড়ায়, ‘ ধন্যবাদ ভাইয়া। ‘
বিনিময়ে আয়ুশও অধর প্রসারিত করে। হাসে তৃপ্তির হাসি জানালার দিক মুখ রেখে। কিন্তু তা যে প্রিয়ুর চক্ষে বাঁধা পড়ে অত্যন্ত সহজে। চোখে মুখে হাসি ভাসে ওর। মন ভরে,প্রাণপণ দিয়ে প্রত্যাশা করে শেষ নিঃশ্বাস অবধি জীবনটা এমনই থাকুক। সুখ,ভালোবাসা অগোচরে বিলীন হোক এভাবেই একে অপরের জন্য। অব্যক্ত থাকুক চিরকাল কিছু কিছু সত্য, যাতে ওদের তিনজনের মধ্যকার ভালোবাসার সমাপ্তি কভু না হয়।
_____________
এতিমখানার সামনে এসে গাড়িটা ব্রেক কষে আয়ুশ। শ্রেয়া জানালা দিয়ে মাথা বের করে দৃষ্টি লুকিয়ে লুকিয়ে তূর্যর তালাশ করছে। তৎপরে কানে আসে আয়ুশের জানালায় টোকার আওয়াজ। কর্ণ খাড়া করে সেদিক। আয়ুশ জানালার কাঁচ নামাতেই সুড়সুড় করে প্রবেশ করে চিরাচরিত, হৃদয়ের গহীনে বাস করা একটা কন্ঠস্বর, ‘ আমার বউ?’
বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায় শ্রেয়ার। শীতল পবন সমগ্র প্রকৃতি দখল করে রেখেছে। আয়ুশ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলে,’ পিছনে। গার্ড দিয়ে সহিসালামত নিয়ে আসলাম ভাই, তোর অমূল্য রত্ন।’
শ্রেয়া কান খাড়া রেখেই সবটা শুনে। মনটা কেমন কেমন করে ওঠে। এই কথাগুলো ভালোবাসাময় তো!স্রেফ স্ত্রী বলে এতকিছু ওর মন মানতে অপরাগ,নারাজ। অকস্মাৎ পাশের দরজা খুলে যায়। হাত বাড়ায় কেউ একজন। ঝুঁকে সামান্য। কিঞ্চিৎ দেখেই শ্রেয়ার হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বড্ড অস্বাভাবিক। উথাল-পাতাল ঢেউ অভ্যন্তরে। নরমাল এটা পাতলা সাদা পাঞ্জাবি পড়া তূর্য। গলার দিকটায় একটু একটু কাজ করা। হাতের লোমশে ঘামের অস্তিত্ব। নিয়ন বাতিতে স্পষ্টত সবকিছু।
ঢোক গিলে শ্রেয়া। কাঁপা কাঁপা হাত টা রাখে তূর্যর হাতের উপর। সঙ্গে সঙ্গে মুঠোয় পুরে ওকে গাড়ি থেকে বের নিয়ে এলো তূর্য। গাড়ির দরজা টা সশব্দে লাগিয়ে আয়ুশকে বললো, ‘ তোরা যা,আমরা আসছি কিছুক্ষণ পরেই। ‘
বিনা বাক্যে চলে যায় আয়ুশ। শ্রেয়া স্তব্ধ, নিবিড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওকে ল্যাম্পপোস্টের নিম্নতলে দাঁড় করায় তূর্য। বিমূঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখে তূর্য বুকে হাত বেঁধে চেয়ে আছে নির্নিমেষ। ভাবভঙ্গি বুঝা অসম্ভব। চোখে কেবল ওর প্রতিচ্ছবি ভাসছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত গুণে গুণে তিন বার চক্ষু দৃষ্টি ফেলেছে। অতিরিক্ত এই চাহনি হৃদয়ে নিংড়ে দিচ্ছে ওর।
তূর্য চোখের পলকে কোমর জরিয়ে কোলে তুলে নিল। আকস্মিকতায় সহসা শিরশির করে কেঁপে উঠে দেহ,অঙ্গ প্রতঙ্গ। ভাঁজে ভাঁজে কম্পন আর কম্পন। তীব্র হতে তীব্রতর। তূর্য সমুখে দৃষ্টি রেখে বলে,’ আমার দুপুর, বিকেল,সন্ধ্যার ক্লান্তির অবসান। ‘
হতবাক, হতবুদ্ধি শ্রেয়া। ওকে সাথে করে আনা গাড়িতে বসিয়ে দিল তূর্য। ড্রাইভিং সিটে এসে বসতেই একটা প্রশ্ন করে বসলো সে। প্রচন্ড সাহস খরচ হলো তাতে।
‘ এটাও কি স্বামীর অধিকারে করেছেন?’
তূর্য নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,’যদি বলি হ্যাঁ?তাতে কি স্বামীর অধিকারে একটা চুমু টুমু পাবো?’
আরক্ত হয়ে সিটে সেঁটে গেল শ্রেয়া। তূর্য ওর দিকে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘আকাশের দিকে তাকাও তো?’
‘ কেন?’
‘ তোমাকে বউ ভেবে সুন্দর কয়েকটা বাক্য শুনাবো তাই। ‘
তূর্যর কন্ঠে রাগের মিশ্রণ। পাল্টা প্রশ্ন করলেই তার যত রাগ।
কথামতোন শ্রেয়া দূরের ঐ অম্বরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। রূপালী একটা চাঁদ। আলো ঠিকরে পড়ছে ধরণীতে। চোখ ধাঁধানো রূপ তাহার। অনতিবিলম্বে শ্রেয়ার সমস্ত তনুতে শিহরণ খেলে যায়। সিটে রাখা হাতে হাত রাখে তূর্য। অপর হাতে ওকে বন্দীনি বানায় নিজের বক্ষে। কানের কাছে গাঢ়,নেশাক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ আকাশে একটা রূপসী, আমার বুকে একটাই শুভ্রপরী। ‘
আবেশে নিমীলিত হয় শ্রেয়ার চক্ষুদ্বয়। শ্বাস ভারী হয়ে আসে। আবারও, আবারো শুনতে পায় সেই মাদকতা মিশ্রিত কন্ঠস্বরের বাক্য,
‘ কোনো এক বিষন্ন বিকেল পার করে, রক্তিম আকাশ এড়িয়ে, একটা চাঁদনি রাত আসবে। মুখোমুখি থাকবো আমি, তুমি। নিদারুণ কম্পন হবে বক্ষস্থলের সমগ্র জুড়ে। সন্ধি হবে আরো একবার হৃদয়ে হৃদয়ে। ‘
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩১
অনুভূতিরা বেসামাল। দমিয়ে রাখা প্রণয়ের পুনর্বার জাগরণ। প্রিয়ুদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে শ্রেয়া বুকে হাত রেখে স্পন্দন পরখ করছে। হৃদস্পন্দন। চলছে কি তা নাকি এখনও থমকে রয়েছে?ভয়ংকর পবনের খেলা চলছে সমগ্র প্রকৃতি জুড়ে। স্পর্শ করছে শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে,উন্মুক্ত বাঁকা কোমরে। কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ সমীরণ বইছে শ্রেয়ার বক্ষস্থলেও। থেমে থেমে উতালপাতাল গর্জন হচ্ছে। চিকন ওষ্ঠযুগলের বেশ খানিক জায়গা মৃদু, তৃপ্ত হাসির দখলে। তূর্যর এত কাছে আসা,ওকে শোনানো সেই মাদকতা মেশানো বাক্যগুলো সবকিছু যেন ওর নামেই উৎসর্গ করেছে মানুষ টা। বউকে এমন শুনাতে ইচ্ছে হলেই শোনাবে?অনুভূতির গভীরতা থেকে সৃষ্ট হয় যেসব শব্দাংশ সেগুলো এমনি এমনি যাকে তাকে বলা যায় না, যার তার কাছে ব্যক্ত করা যায় না৷ আর প্রখরত্বও একদিনে হয় না। হতে হতে অত্যধিক সময়ের প্রয়োজন পড়ে। খুব,খুব,খুব। কেউ একজন সত্যি বলেছিল যখন শ্রেয়া তার কথার মর্মার্থটা বুঝতে সক্ষম হবে সেদিন কিয়ৎক্ষণের জন্যে হলেও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটবে এবং অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল তা।
ছোট থেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্ন দেখত শ্রেয়া। যেমন দেখত বাবা ওকে বুকের মধ্যে গুটিয়ে নিয়ে বলতেন ” আমার কলিজার টুকরা শ্রেয়সী। আমার রাজকন্যা। ” আবার কেউ হাত বাড়িয়ে ইশারা করতো কাছে আসার। জেগে জেগে দিনদুপুরেও নানা ধরনের স্বপ্নে নিমগ্ন হয়েছে,কল্পনায় এঁকেছে মুঠো ভর্তি ভালোবাসার সংলাপ এক কাল্পনিক দেশের রাজকুমারের সহিত৷ কিন্তু কোনো দিন বাস্তবতার চাদরে মোড়ানো হয় নি তাদের। টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গেছে সর্বদা কিংবা ভেঙে খন্ডিত দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। অতঃপর অন্য এক রাজকুমার নয় তবে একজন সুদর্শন পুরুষের প্রেমে মোহিত হয় ও। না দেখেই তাহার প্রতি জন্ম নেয় বিশাল বিশাল অনুভূতি। সেই স্বপ্নও ভাঙ্গে। বিক্ষিপ্ত হয় মন। তৎপরে সেই সুদর্শন পুরুষ নিজের অবয়ব প্রদর্শন করে, কাছে টানে,পূরণ করতে ব্যস্ত ওর ভালোবাসা পাবার স্বপ্ন টা অপ্রকাশ্যে,অতি সন্তর্পণে।
প্রিয়ু ওকে দাঁড় করিয়ে সেই যে নিচে নামল আসার কোনো খবরাখবর মিলছে না। প্রায় ঘন্টা তিনেক পূর্বে প্রিয়ুদের বাড়িতে এসে তূর্য আর ও। পথিমধ্যে একটা কথাও বের হয় নি গম্ভীর সেই পুরুষালী কন্ঠস্বর হতে। কিন্তু শ্রেয়ার তনুমনের তরঙ্গ একটুও কমে নি,একটুও না। শ্বাসরুদ্ধকর ছিল মুহুর্ত খানি। তূর্য কতটা অবলীলায় কন্ঠে মাদকতা মেশালো,কতটা নেশাক্ত বাক্যদ্বয় ওর কর্ণে ঢেলে সরে গেল নিরবে,নিশ্চুপে!তখন থেকে একটা কথাও বলে নি। এখানে এসে প্রিয়ুর দাদি,মামী সবার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে রাশেদার দেখানো রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। শ্রেয়া সাথে সাথে যায় নি রুমে। কারণ দর্শানো হলে ও একটাই দেখাতো স্পন্দনের ভার। এতই অস্বাভাবিক লাগছিল স্পন্দন যে শরীর টা বড্ড টালমাটাল করছিল। ইনিয়েবিনিয়ে থেকে যায় প্রিয়ুর মামীর নিকট কতক্ষণ। তারপর দেখে পাঞ্জাবি পাল্টে একটা কালো শার্ট সুঠাম দেহে জড়িয়ে তূর্য নেমে এসেছে ডান পাশের সিঁড়ি ভেঙে। আয়ুশও আসে সাথে। রাশেদা কোথাও যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে জানায় দু’ভাই একটু বাহিরে যাবে। ব্যাস তারপর আর কি!প্রস্থান ঘটায় দু’জনেই। শ্রেয়ার এতে লাভই হয়েছে। আপাতত তূর্যর মুখোমুখি হতে চাইছিল না৷ বউ ভেবে প্রেমময় বাক্য নিবেদন করেছে কখন না বলে বসে চলো আরও ভিন্ন ভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করি,যেগুলো জামাই বউ সম্পর্কিত!এমন বাঁকা ত্যাড়া,গম্ভীর ধাঁচের লোকই কেন ওর বর হতে হলো?সবকিছু কি প্রকাশ্যে হতে পারে না?ওর মতোন গাধার মাথায় এত এত কথার আসল অর্থের সমাধান হবে?এত না বুঝার মধ্যে একটা বাক্য ভালোই মস্তিষ্কে ধারণ হয়েছে নিখুঁতভাবে এবং সেটার অর্থও জেনে গেছে শ্রেয়া।
পশ্চাৎ দিক থেকে কোমরে হাত পড়তেই অদূরে ফেলা দৃষ্টি সংকুচিত হয়ে আসে শ্রেয়ার। ছোট ছোট হয় চক্ষু জোড়া। ঝটকা দিয়ে হাত টা সরিয়ে তড়তড় করে ঘুরে দাঁড়ায় ও। প্রিয়ু সশব্দে হেসে উঠে। হাসির দাপটে দেহে ঢেউ খেলছে। চাঁদের ময়ূখ ও ছাদে লাগানো বাতির ধিমে ধিমে আলোয় তার মুখশ্রীতে অজস্র মুগ্ধতার সমারোহ। কি স্নিগ্ধ মেয়েটা!শ্রেয়া বিমোহিত নেত্রে চাইতেই প্রিয়ু হাসি থামিয়ে ভ্রুঁ নাচালো। দুষ্টমি ভরপুর কন্ঠে বললো,
‘ ভাইয়া ধরলে নিশ্চয়ই চুপসে যেতি,নিজেকে সপে দিতি। আমি একটু ভালোবেসে ধরলাম কেমন ঝাড়া মা’রলি!আহা!বান্ধবী এমনই। বিয়ের পর জামাইয়ের মধুমাখা আদরে সব ভুলে যায়,সব।’
শ্রেয়ার হাসি পাচ্ছে মেয়েটার কথায়,কান্ডে। অকস্মাৎ ছোঁয়ায় ভয়ের তাড়নায় সরিয়ে দিয়েছিল। যদি জানত এটা প্রিয়ু তাহলে কখনও এটা করতো না। সুযোগ পেয়ে ভালোই পিঞ্চ মা’রছে সে।
শ্রেয়া ইচ্ছে করেই হা হুতাশ করে। মিনমিন করে বলে,’ আদর?হু।এমন আদর করে আমি শুধু বান্ধবী না, একদম দিন দুনিয়া ভুলে বসি। ‘
প্রিয়ু ঠিকঠাক শুনলো না৷ দখিনা বাতাসে কথা উড়িয়ে নিয়ে গেল বোধহয়। আরেকটু কাছে এসে প্রশ্ন করে,
‘ কি বললি শ্রেয়ু?বুঝি নি তো।’
‘ কিছু না৷ তোকে কখনও ভুলব না। সম্ভব না। আমাকে দাঁড় করিয়ে কোথায় গিয়েছিলি?’
প্রিয়ু আঙুল দিয়ে ছাদের মেঝেতে ইশারা করে। শ্রেয়ার চক্ষু গিয়ে ঠেকে সেদিকটায়। দেখে মেঝেতে ছোট্ট একটা ট্রে তে দু কাপ চা। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় হাত ওর। মৃদু চেঁচিয়ে ওঠে,
‘ লেট লতিফ উপাধি টা তুই এমনি এমনি পাস নি প্রিয়ু। চা এনে এই বাতাসে এতক্ষণ রেখে দিয়েছিস?বলতে এত দেরি কেন করলি?এখন এই ঠান্ডা শরবত তুই গিল। ‘
মুহুর্তেই ফোঁস ফোঁস শব্দ সৃষ্ট হয়, ‘ ভালো করলেও দো’ষ। কত কষ্ট করে বানিয়ে এনেছি৷ আজ পর্যন্ত জামাইকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ালাম না,বয়ফ্রেন্ড থাকতে রান্না করে খাওয়াই নি। আর তুই আমার হাতের রান্না খেয়েছিস কিন্তু কখনও প্রশংসা করিস নি। অভিশাপ দিচ্ছি তূর্য ভাইয়ার প্রেশারে তোর একেকটা লম্বা কেশ অল্প বয়সে বুড়ি যেন হতে পারে। ‘
যতক্ষণ না এই চা নামের ঠান্ডা শরবত শ্রেয়ার কন্ঠনালি বেয়ে পরিপাক গ্রন্থিতে পৌঁছাবে ঠিক ততসময় চলবে প্রিয়ুর কথা নামক অত্যা’চার। তাই বিনা বাক্যে কাপ হাতে উঠিয়ে নেয় ও। ছোট ছোট চুমুক দেয় তাতে। এতটাও ঠান্ডা হয় নি। দুই বান্ধবী মিলে গেইটের দিকে নয়ন তাক করে কাপে ঠোঁটের স্পর্শ মাখছে। আকস্মিক উভয়ের চক্ষে একটা দৃশ্য বিঁধে। তূর্য ও আয়ুশ ফিরেছে। এতে অবাকতার বিষয় নেই। কিন্তু চমকপ্রদ হলো তাদের হাতের এক গাদা ব্যাগপত্র। প্রিয়ুর অবাক কন্ঠস্বর,
‘ ভাইয়া আর আয়ুশ কি শপিং করার জন্য বাহিরে গিয়েছিল? ‘
‘ আমি তো জানিনা। ‘– পাশ থেকে প্রতুত্তর করে শ্রেয়া।
‘ চল নিচে যাই। ‘
শ্রেয়ার মন উসখুস করছে। প্রিয়ু এমনভাবে বলছে যেন ওরা বাচ্চা আর নিচে ওদের জন্য গিফট নিয়ে আসা হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে ছুটে গেলে পরে তূর্য হেয়ালি করে বলবে,’কি বাচ্চা বউ গিফট এনেছি ভেবেছ?’ এক চুল পরিমাণ ছাড়ও দিবে না। কিন্তু প্রিয়ুর সাথে সেটা শেয়ার করতে পারলো না সে। যেতে হলো অগ্যতা।
নিচে এসে দেখে এলাহি কান্ডকারখানা। বাজার করে এনেছে বাড়ির দু জামাই এটা বলে বলে রাশেদা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছেন। মন ভরে দোয়া করছেন। তিনি কখনও ভাবেন নি এত দায়িত্ববান হবে শ্রেয়া ও প্রিয়ুর জামাই। এমন করে শশুর বাড়ির মানুষজনদের খেয়াল রাখবেন। রান্নার জন্য বিভিন্ন জাতের শাকসবজি, গরুর গোশত, মুরগি সব এনেছে। সবার জন্য অনেক গিফটও হাজির। শ্রেয়ার মন বলছে দুই ভাই পুরো বাজার মাথায় তুলেছে। রান্নাঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু অবলোকন করছে ও। রাশেদার মুখে তূর্যর প্রশংসার ফোয়ারা। প্রিয়ুর মামী হেসে হেসে বলছেন,
‘ শ্রেয়া ভালো মনের মেয়ে,তাই হাসবেন্ড পেয়েছে লাখে একটা। এই লক্ষী মেয়েটাকে আমার ঘরে তুলতে পারলাম না। তোর একটা বোন যদি থাকত রে শ্রেয়া। এত সুন্দর কেন তুই?ভেতর,বাহির দু’টো সুন্দর হওয়া দরকার ছিল?এখন আমার আফসোস হচ্ছে কেন তোকে দেখলাম। এখন তোর মতোন একটা মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে পেতে ইচ্ছে করছে। ‘
প্রিয়ু ফিসফিস করে, ‘ মামী তূর্য ভাইয়া শুনলে বলবে তার বউ কেঁড়ে নেওয়া হচ্ছে। ধীরে ধীরে বলো। দোয়া করে দিলাম তোমার বারো বছরের ছেলের জন্য অন্য একটা রুপবানের দেখা পাবে জলদি। ‘
মানুষ যখন পায় সবকিছু একসাথে পেয়ে যায় বোধহয়। এ যে শ্রেয়া ভালোবাসা চেয়েছিল ছোট থেকে এখন না চাইতেও সবার ভালোবাসা পাচ্ছে ও। ওর ইচ্ছে করছে এগুলো বাক্সবন্দি করে রাখতে। যদি কখনও দুঃখের দিন আসে,বাক্স মুক্ত করে একটু একটু করে ভালোবাসা নিবে ও।
রাশেদা লেবুর শরবত বানালেন। কয়েকটা গ্লাস ট্রে তে তুলে নেয়,আরেকটা ধরিয়ে দেয় শ্রেয়ার হাতে। বললেন,
‘ তূর্য রুমে চলে গিয়েছে। ওর শরবত টা রুমে দিয়ে আয় মা। ক্লান্ত লাগছিল খুব। সারাদিন এতিমখানায় ছিল, এখন আবার বাজার করে এসেছে। তাড়াতাড়ি যা। ‘
শ্রেয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। ধীরস্থির পায়ে আসে রুমের দরজা অব্দি। প্রথমে হাতের সাহায্যে এক দু’টো শব্দ তুলে। এতেই কাজ হয়ে যায়। অন্দর হতে ভেসে আসে,’ কাম ইন। ‘
দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো ও। তূর্য হাতের একটা ব্যাগ সোফার উপর রাখলো। পরক্ষণেই ওর দিকে তাকালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। কপালে ভাঁজ। দ্রুত হেঁটে এসে এক প্রকার ছিনিয়ে নেয় শরবতের গ্লাস টা। দু চুমুকে সবটা শেষ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ তুমি আমার কাপড় আনলে ভালো কথা কিন্তু শর্ট প্যান্ট আনলে না কেন?গত রাতগুলোতে আমাকে দেখেছো রাতে ঘুমানোর সময় থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়ে ঘুমাই। তবুও আনো নি যে?’
শ্রেয়া হতভম্ব,নির্বাক। তূর্য মিছে বলে নি৷ লোকটার বোধ হয় আগে থেকেই ওর মতে, অর্ধেক প্যান্ট পড়ে ঘুমানোর অভ্যেস। কিন্তু ওর কেমন লাজুক লাজুক ভাব হচ্ছিল ওইসব ধরতে। ফলস্বরূপ লম্বা লম্বা শার্ট প্যান্টই ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছে। এখন কি জবাব দেবে?সুদুত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। বদনে লজ্জার অন্ত নেই। তূর্য আঁড়চোখে চেয়ে গলা ঝেড়ে ফিচেল কন্ঠে বললো,
‘ তোমার শাড়ি হতে শুরু করে ছোট বড় সাইজ সব নিজ হাতে কিনলাম, আর তুমি আমার একটা শর্ট প্যান্ট আনার কথা বলাতে বেহুশ হয়ে যাওয়ার অবস্থা? মিসেস শ্রেয়সী আমার ভবিষ্যৎ ডুবিয়ে দিও না। আগে থেকে শক্ত হও,প্রস্তুতি নাও। যেকোনো সময় কিন্তু ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়ে যেতে পারে। ওয়া*র্নিং দিয়ে রাখলাম। ‘
শ্রেয়া অপ্রতিভ হলো। লজ্জা ও ভীরু ভীরু মন নিয়ে বললো,’ খেতে নিচে আসবেন। ‘
কথাটা বলে তড়িঘড়ি করে পালিয়ে আসে। সেখানে থাকাটাও দমবন্ধকর ছিল।
______________
মেহরিমা বাহিরে আসলেন স্বামীর খোঁজে। দূরে চোখ ফেলতেই দেখে নুরুল চৌধুরী পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে রেখেছেন। আজও হয়ত ক্ষমা চাইছেন মনে মনে প্রিয় সেই নারীর নিকট শত শতবার। সেদিকে আর পা বাড়ালেন না তিনি। বুড়ো বয়সেও অন্তরে তীব্র জ্বলন হয়। হিংসায় নয় বরং নুরুল চৌধুরীর জীবনের প্রথম নারী হতে না পেরে। তোহাশের মা অনেক ভাগ্যবতী। মেহরিমাও কপাল গুণে এ বাড়ির বউ হয়ে ছোট একটা সুন্দর বাচ্চা ছেলে পেয়ে গিয়েছিলেন। কত মায়া মমতা মিশিয়ে মা বলে ডাকত সে। বুকের সাথে মিশে গিয়ে বলত নতুন মা তুমি অনেক সুন্দর। আমাকে আদর করো বেশি বেশি। সময়ের প্রেক্ষিতে তিনি বুঝলেন পৃথিবীতে সব নারী সংসার সাজায় না,কেউ কেউ ঘরও ভাঙ্গে। বিচ্ছেদ ঘটায় মনের। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে তোহাশের জন্য মন পুড়ে ওনার। জন্মদাত্রী না হোক মমতা মিশিয়ে বড় করেছেন তিনি তাকে। রুমে এসে কেঁদে উঠলেন। দুই সন্তানের জননী হয়েও তিনি আজ একা। মনোমালিন্য ছেলেদের সঙ্গে। মা ভালো চায় এটা কি সন্তানেরা বুঝে না?
.
.
খাবারের পর্ব শেষ করে কক্ষে পা রাখে শ্রেয়া। এসেই সংশয়ে পড়ে যায় ও। তূর্য সোজা হয়ে শুয়ে আছে। মুখের উপর মোবাইলের আলো। মনোনিবেশ সম্পূর্ণ তাতেই। শ্রেয়ার দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রধান কারণ হলো গত রাতগুলো তূর্যর আদেশ মোতাবেক খাটেই শুয়েছে, প্রিয়ুদের বাড়িতেও কি তার পাশেই একই বিছানায় ঘুমাবে?এখানে তো টাকা পোষানোর প্রশ্নই ওঠে না তবুও কি বিছানায় থাকতে দিবে?নাকি নাটকের মতোন বলবে নিচে থাকো?ঠিক কতবছর চলবে লোকটার হেয়ালিপনা,অভিনয়?অতীব চিন্তায় মশগুল থাকার এক পর্যায়ে খেয়ালে আসে তূর্য ওঠে বসেছে। কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বললো,
‘ চিন্তা করতে করতে মুহুর্তের মধ্যে একটুখানি শুকিয়ে গেলে৷ নিশ্চয়ই আধা কেজি কমে গেছে ওজন। এদিকে এসো শ্রেয়সী। ‘
তাজ্জব হলেও গুটি গুটি পায়ে কিছু টা এগিয়ে গেল ও। আলতো, নরম স্বরে বললো,
‘ আমি কোথায় থাকবো স্যার?’
তূর্য আবারও সটান হয়ে শুয়ে পড়ে। দাঁতে দাঁত চি’বিয়ে বলে,
‘ বুকে। ‘
‘ কি?’
হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে শ্রেয়ার নরম সরম দেহ টা বিছানায় ফেলল তূর্য। ভয়ে হকচকিয়ে গেল শ্রেয়া৷ সহসায় ধরাস ধরাস করে কাঁপলো সমগ্র অঙ্গ প্রতঙ্গ। অনুভব করলো ওর গলায় শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয়ের গাঢ় ছোঁয়া। ক্রমশ গভীরে পরিণত হয় তা। শাড়ি ভেদ করে বলিষ্ঠ হাতের চাপ পড়ে উদরে। আনমনে, অস্থিরতায় তূর্যর ঘাড়ে খামচে ধরতে নেয় ও। তখনই তূর্য কঠিন সুরে শা’সায়,
‘ একদম না। শরীরে নখ বিঁধলে আমি কিন্তু সীমালঙ্ঘন করে ফেলবো। তুমি কি তাই চাইছো?’
শ্রেয়া নিমীলিত চক্ষুদ্বয়ের পল্লব নাড়ে। তূর্য ওর জবাবের অপেক্ষা করে না। শ্রবণনালির সান্নিধ্যে মুখ রাখে। বলে,
‘ আমি তো বউ কোথায় থাকে সেটা প্র্যাক্টিক্যালি দেখাচ্ছিলাম। তুমি এখন আমাকেই ধৈর্য্যহীন করার তোরজোড় চালাচ্ছো বউ?’
হুট করে পুরো কক্ষ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। কারেন্ট চলে গিয়েছে। তূর্য এটা নিয়েও কথায় শোনায়। গাঢ় স্বরে বলে ওঠে,’ সবকিছু কেমন তোমার পক্ষ হয়ে আমাকে কিছু একটা ইশারা করছে। ‘
শ্রেয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ। তর সইল না আর। চোখ মুখ খিঁচে মনের চিন্তা টা বাস্তবায়ন করেই ছাড়ল।
#চলবে,,,!