সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,৩৪,৩৫

0
1118

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,৩৪,৩৫
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩৪

নেত্রযুগল উঁচানো হলো না আর শ্রেয়ার। সেদিন রাতের কথা মনে পড়ে যায়। তূর্য তাহলে সত্যিই সত্যিই সেই মুহুর্তের রেশ ধরেই রেগেমেগে চলে এসেছে। ভাবনা কি নিছক নয়?ওর বাঁধা দেওয়াতে হয়ত একটু বেশিই আহত হয়েছে মানুষ টা। নয়ত এমন করে খোঁচা মা’রত আজ?

আলোকশূণ্য আঁধারিতে সেদিন তূর্য ওর এতই সন্নিকটে আসে যে অবলীলায় উভয়েই একে অপরের হৃদস্পন্দন মেপে নিতে পারে। ধীরে ধীরে শ্রেয়ার অনুভূত হয় পেটে রাখা হাত টা মৃদু মৃদু চাপ সৃষ্ট করছে। বাড়িয়ে তুলছে ভিতরের অস্থিরতা,গতিহীন অনুভূতিদের। কাঁধ হতে আঁচল টা কিঞ্চিৎ সরতেই মনে মনে জন্ম নেওয়া বাক্য টা বাস্তবায়ন করে শ্রেয়া,’ এটা কি মোহ স্যার?’

নিস্তব্ধ কক্ষে আরো কঠিন নির্জীব ভাব চলে আসে প্রশ্নটা শ্রেয়ার নিচু স্বর হতে বেরিয়ে আসতেই। তূর্য বিনা বার্তায় সরে যায়। মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে হাত মুঠো করে জিজ্ঞেস করে,

‘ তোমার এটা মোহ লাগলো?

কন্ঠে প্রবল ক্ষোভ, জেদ,রাগের সংমিশ্রণ। তার সঙ্গে আরও একটা জিনিস রয়েছে এবং তা হলো তাচ্ছিল্য ভাব। একে অভিমান নামক শব্দে রূপান্তরিত করলেও খুব একটা ভুল বলে বিবেচিত হবে না। শ্রেয়া এমন করে প্রশ্নটা করতে চায় নি। কিভাবে যে মুখ ফোটে বেরিয়ে এলো তাতে ও নিজেই বিমূঢ়, হতবাক। অল্পস্বল্প, আবছা আলো তে কেঁপে কেঁপে ওঠে ওর কন্ঠনালি,

‘ আপনি ফুলশয্যার রাতে যেসব বলেছিলেন সেগুলো সত্য নাকি এখন যা হচ্ছিল সেগুলো ভুলবশত, আমি বুঝতে পারছিলাম না। ‘

‘ তোমার মতো গাধা বিয়ে করে আজ, এক্ষুণি আরো একবার পস্তালাম। আগে পাগল ছিলাম,সামনেও আবার হতে হবে মনে হচ্ছে। আমি কি নে’শা-খোর যে মাতাল হয়ে কিংবা ভুল করে তোমার কাছে যাবো?অন্য কোনো মেয়ে হলে হাবভাবে, কথার ধরনে এতদিনে সব বুঝে যেত। ঘুমাও। এখন যদি না ঘুমিয়েছ তাহলে পঁচা পানিতে ডুবিয়ে বুদ্ধি বাড়াবো। বেক্কল,গাধী। এই মেয়ে কটা প্রেম করেছো জীবনে? ‘

‘ একটাও না। ‘– বিরস মুখে উচ্চারণ করে শ্রেয়া।

‘ প্রেম করো নি ভালো কথা। মানলাম আমার সাথে প্রেম করার দৃঢ় ইচ্ছে তোমার। তাও বেশ সুন্দর বিষয়। কিন্তু রসায়নে এত কাঁচা হলে চলে?ভিতরে ভিতরে ভালোবেসে ম’রছো, উল্টো স্বামীকে দূরে সরিয়ে দিলে। আমার এতদিনকার কান্ডকলাপে আমাকে অনুভব না করে সবটা মোহ বলে চালালে। ইচ্ছে করছে কষিয়ে থাপ্পড় মা’রি। কিন্তু বউকে মা’রা যাবে না। কষ্ট হলেও সহ্য করতে হবে। ‘

কথাগুলো বলে বেলকনিতে চলে যায় তূর্য। শ্রেয়া সেদিকে চেয়ে থাকে এক দৃষ্টে। কখন দু চক্ষে ঘুম নামে টের পায় না। তবে সকালে ওঠে তূর্যর চলে যাওয়ার বিষয়টা ভাবায় ওকে। দূরত্বে ও বুঝে তূর্যর গাঢ় অভিমানে বলা প্রত্যেক টা বাক্য। পরিস্থিতি অনুযায়ী কখনও কখনও ছোট্ট একটা প্রশ্নও তীক্ষ্ণ আ-ঘাত হানে কারো কারো অন্তঃস্থলে। শ্রেয়া তো অনুভব করেছিল হৃদয়ের মিলন তবুও কেন থেকে গেল এত সংশয়। তাহলে অনুভূতি কি পরিপূর্ণ ছিল না?

লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ও। ক্ষুদ্র স্মৃতিচারণের অন্ত করে। তূর্য ততক্ষণে দূরত্ব ঘুচিয়ে আরও নিকটস্থে এসে দাঁড়িয়েছে। শ্রেয়া আজ জানে মানুষ টা শুরু থেকেই ওকে চায়। অতিরিক্ত চায়। শুধু তার প্রকাশের ধরন টা ত্যাড়া বাঁকা। তন্মধ্যে তূর্য কড়া কন্ঠে বলে ওঠে,
‘ কি ভেবেছিলে বাঁধা দিয়েছো বলে রেগে চলে এসেছি? তাই মনমরা হয়ে থাকতে সারাক্ষণ?ঠিক মতো না খেয়ে শুকিয়ে হাড্ডি। আমি একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেই তো তোমার সকল হাড্ডি মটমট করে ভেঙে যাবে। ‘

অতীব বিস্ময়াবিষ্ট শ্রেয়া। এ লোক কেমন করে জানলো ও মনমরা থাকত সর্বক্ষণ? এসব রহিমা খালা বলত নাতো?তাহলে ওনার যোগাযোগ থাকত রহিমা খালার সাথে?কিন্তু একটা থেকে যায়। বাড়ির বাদ বাকি কারোর সঙ্গে কেন কথা বলত না?এমনকি আয়ুশের সঙ্গেও না। নাকি স্রেফ ওর সাথেই যোগাযোগ করে নি?প্রচুর পরিমাণে প্রশ্নের জোয়ার শ্রেয়ার অন্দরমহলের ছোট্ট সমুদ্রে। তবে সাহসের অত্যধিক অভাব বোধ করছে ও। কারো সান্নিধ্যে এমনতর ঘটে না। শুধুই এই এক পুরুষের সামনে ভয় ভয় হয়ে ওঠে সবকিছু। স্বাভাবিক গলায় বললো,

‘ আপনি আমার উপর রেগে আসেন নি?’
‘ না। ‘
তূর্য গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিয়ে সোফায় গিয়ে বসে। শ্রেয়া এতক্ষণে শ্বাস ফেলতে মোক্ষম সুযোগ পায়। গুটি গুটি, টালমাটাল পা ফেলে সোফার কাছে এসে দাঁড়ায়। তূর্য মাথা এলিয়ে চক্ষুদ্বয় বুঁজে আদেশ স্বরুপ গলায় বললো,’ বসো। ‘

শ্রেয়া সামনের সোফায় বসে। ওর মনের বিষন্নতা কেটে গিয়েছে তূর্যর তার প্রতি কোনো রাগ নেই শুনে। তবে চলে কেন এলে?কিছু একটা তো হয়েছে। এ নিয়ে ওর মনের পাতায় খচখচ আওয়াজের সৃষ্ট হচ্ছে বারংবার।

‘ এলে সেই দুপুরে,আর আমার কাছে আসলে বিকেলে?পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন?’

শ্রেয়ার বলতে মন চায়,’ আর প্রস্তুতি?কবে আপনার চেহারা টা দেখবো,গায়ের গন্ধ নাকে মাখবো,গম্ভীর স্বরের আওয়াজ শুনবো সেই চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল প্রতিনিয়ত। ভালোবাসা খুব খারাপ স্যার। তার চেয়েও খারাপ আপনি। আঠারো বছর বয়স থেকে প্রেমে ফেলে দিনের পর দিন হেঁয়ালিপনা। ‘

একটা কথাও শ্রেয়ার মন ভেদ করে কন্ঠনালি পর্যন্ত আসলো না। সংকোচ জড়তা লজ্জা কাটিয়ে এবার আঁখি যুগল মেলে ধরে তূর্যর পানে। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর টা আঁতকে উঠলো। মোচড় দিয়ে উঠলো অন্তর। চোখের সম্মুখে ভাসছে তূর্যর হাতের সাদা ব্যান্ডেজ টা। বসা থেকে ওঠে ব্যগ্র কন্ঠে প্রশ্ন করতে লাগল,
‘ আপনার হাতে কি হয়েছে? ব্যান্ডেজ কেন?কি হয়েছে? স্যার?’

তূর্যর কপালে ভাঁজ পড়লো। নড়চড় হলো না বিন্দু মাত্র। শুধু হাত বাড়িয়ে ডাকলো,’ এদিকে এসো। ‘

শ্রেয়ার কষ্টে বুক ফেটে জলবিন্দু বেরিয়ে আসবার উপক্রম। চক্ষু কোলও ভিজে ভিজে ওঠেছে। একটু কাছে আসতেই তূর্য হাত টেনে পুরো দেহ টা নিজের বক্ষে চেপে ধরলো। পুতুলের ন্যায় পড়ে আছে শ্রেয়া। ওকে ঠিকঠাক নিজের সাথে জড়িয়ে একপাশে বসালো তূর্য। ঘাড় হেলিয়ে কন্ঠে কাঠিন্য ভাব এনে বললো,

‘ তোমার চোখে পানি জমেছে কেন?কান্না ভীষণ প্রিয় নাকি আমি?যদি আমি হই তবে তুমি কাঁদতে পারবে না। কারণ তোমার ওই চোখ দু’টি আমার প্রিয়। প্রথমবার তোমার প্রতি সন্দেহ জাগিয়েছিল এ কাজলমাখা আঁখি দু’টো। মনে আছে?বাড়িওয়ালার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান? সেদিনই তোমার চোখে গভীরভাবে তাকিয়ে ফেলি অনিচ্ছা সত্ত্বেও। হয়ত আল্লাহ এটাই চেয়েছিলেন। তা নাহলে বউকে খুঁজে বের করতাম কিভাবে?তোমার ছোট বেলার ছবিতে চোখ গুলো বেশ আকর্ষণ করে আমাকে। সেদিন ছাঁদে তোমার দুই চোখ ভালো করে না দেখলে এখনও বউ খুঁজতেই থাকতাম। অথচ বউ আমার পাশেই থাকত,কাছাকাছি এসে নিঃশ্বাস ফেলত নিঃশব্দে। ‘

শ্রেয়ার বুক চিরে তীব্র আর্তনাদ আসতে চাইছে। ঘুরেফিরে দৃষ্টি তূর্যর ব্যান্ডেজ মোড়ানো হাতের দিকে গিয়ে থামছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দেয় সেই স্থান। তূর্য বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

‘ সামান্য তে ভেঙে পড়ো কেন? এটা ছোট্ট একটা এক্সিডেন্টে হয়েছে। লুক এট মি। আ’ম ফাইন। ডিমের বাহানায় ছুটে আসলে আমাকে দেখতে,তা না করে ফ্যাচফ্যাচ করছো। আদর পাওয়ার জন্য ইশারা?’

চট করে হাত সরিয়ে নিয়ে আসে শ্রেয়া। লজ্জায় তবলা বাজছে শ্রবণগ্রন্থিতে। এই মানুষ টা ওর সব ভাবনা বুঝে যায়। মিহি স্বরে বললো,

‘ সত্যি ঠিক আছেন?’
তূর্য এটার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
‘ প্রিয়ু কোথায়?’
‘ আছে,বাসায়ই। ‘
‘ তুমি কি ওর সাথে থাকবে?’
‘ ও তো একা স্যার। ওখানেই থাকি?’
‘ বউ থাকতে একা থাকবো?ইম্পসিবল। প্রিয়ুসহ এই ফ্ল্যাটেই থাকবে। ওটা ছেড়ে দিতে বলবো। রাতে রেডি থেকো দু’জন। বাহিরে যাবো। ‘
শ্রেয়ার এতক্ষণে একটা কথা মনে পড়ে গেল। তড়িঘড়ি করে বললো,
‘ বাবাকে ফোন দেন না কেন?উনি কথা বলতে চায় আপনার সাথে। ‘
তূর্যর ক্ষিপ্র চাউনিতে মিইয়ে যায় ও তৎক্ষনাৎ। ধ্বক করে ওঠে বুক টা। পাশে বসা মানুষ টার নির্বিকার, নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি,
‘ আমি চাই না। ‘
কিঞ্চিৎ সাহস জোগালো শ্রেয়া। সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘ উনি আপনার বাবা। আপনার ক্ষোভ টা ওনার প্রতি কতটুকু যুক্তি সঙ্গত একদিন বাবা হলে ঠিক বুঝতে পারবেন। ‘

তূর্য ফিচেল হাসলো। অসম্ভব সুন্দর সেই হাসি৷ নিমেষে কোমরে দৃঢ় বাঁধন অনুভব করে শ্রেয়া। নিজেকে আবিষ্কার করে তূর্যর মুখের কাছাকাছি। তূর্যর নেত্রের চাহনি প্রগাঢ়, নির্নিমেষ। আরেকটু নিজের সঙ্গে চেপে নিয়ে লহু স্বরে বলে উঠলো,

‘ তাহলে বাবা বানিয়ে দাও। ‘

ঝক্কি দিয়ে ওঠে শ্রেয়ার সমগ্র কায়া। সেকি ভুল শুনলো?কম্পনের তাড়নায় তূর্যর গলার পিছনে গলিয়ে রাখা হাতের বাঁধন শক্ত করে। তূর্য ওর ওষ্ঠের সন্নিকটে ঠোঁট দুটো নাড়ালো। কন্ঠটা মাদকতায় ভরপুর,

‘ এখান থেকেই তাহলে বাবা হওয়ার প্রসেস টা শুরু হোক। ‘

যতক্ষণে কথাটা কর্ণে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে ধারণ করেছে অত্যন্ত বিলম্ব হয়ে যায়। শিরায় শিরায় বইতে থাকে দমকা হাওয়া। না চাইতেও নখ বিঁধিয়ে দেয় তূর্যর ঘাড়ে। প্রথম ভালোবাসার প্রথম ছোঁয়া আজ ওর দুই অধরে। সেই স্পর্শর প্রখরত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নিয়ন্ত্রণহারা স্পন্দনেরা।

তূর্য ঠোঁটের দীর্ঘ আলিঙ্গন শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। রক্তিম মুখ খানা লুকালো শ্রেয়া সোফার উপর। এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে এসে তূর্য ফের পাশে বসলো। নরম গলায় বললো,

‘ মুখ তুলো। পানি খেয়ে ভালো করে শ্বাস নাও। ‘

#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩৫

‘ কোথায় যাবো আমরা?’
‘ জানিনা। স্যার বলেছেন রেডি থাকতে।’
‘ আমি যাবো না। তুই আর তূর্য ভাইয়া-ই যা।’
শ্রেয়া চোখ জোড়া ছোট ছোট করে তাকায় বিছানার দিকে। প্রিয়ু পায়ের উপর পা রেখেছে ক্রসিং স্টাইলে। দিব্যি দুই পাশে দোলাচ্ছে দু পা। হাতে এখনকার নিত্যকার সঙ্গী মোবাইল। এটা ছাড়া যেন আজকাল সবার নিঃশ্বাস-ই চলে না। শ্রেয়া বার্তাহীন চট করে মোবাইলটা কেড়ে নিল।
‘ কেন যাবি না?’
‘ তোরা একসাথে রোমান্স করবি,আমি গেলে করতে পারবি বুঝি?’

প্রিয়ুর বিবশ কন্ঠে রসাত্মক বাক্য শুনে শ্রেয়া হতবাক। ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘ তোর সাথে যখন আয়ুশ ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যেতাম, তখন তোরা রোমান্স করতি?’
‘ না তো। তোর সামনে রোমান্স করতে লজ্জা লাগবে না আমাদের?’
‘ এটাই। স্যার গর্দভ নন যে তোর সামনে রোমান্স করবে। ‘
এবার প্রিয়ু কথার তাল পেয়ে গেল। জেঁকে ধরলো শ্রেয়াকে। মুচকি হেসে গাল দু’টো উঁচু করে। পরক্ষণেই আবার ভ্রুঁ নাচায়।
‘ তার মানে ভাইয়া আড়ালে রোমান্স করে?অনেক রোমান্টিক তাই না?’
নিজের কথায় নিজে হতবিহ্বল শ্রেয়া। সরব করে ব্যগ্র গলায় বলে উঠলো,
‘ এসব নিয়ে পড়ে থাকবি?রেডি হো। নয়ত স্যার উল্টো আমাকে বকবেন। ‘
‘ তোকে ভালোবাসি বলেছেন ভাইয়া?’

প্রিয়ুর হঠাৎ প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল শ্রেয়া। অপ্রতিভ হলো অত্যধিক পরিমাণে। বাহ্যিক অংশে অপ্রস্তুত ভাব এলেও মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে তীব্রভাবে বিঁধে প্রশ্ন খানা। না বললেও ওর হৃদয় থমকেছে যেদিন, তক্ষুনি বুঝে নেয় তূর্যর অপ্রকাশিত অনুভূতি। একদিক থেকে ভাবলে সেটা অব্যক্ত নয়। কারণ মানুষ টা প্রতিনিয়ত নিজের আচরণে মিশিয়ে দিচ্ছে কোনো এক মনোমুগ্ধকর অনুভূতি। সন্ধি তো ঘটে গিয়েছে।
কবে,কখন,কোন স্থানে,কেমন করে অতশত প্রশ্ন না করলেও চলবে। সর্বক্ষণ ভালোবাসি না,বাসি না বলা মানুষ টার কথার ভাঁজে লুকিয়ে আছে তীব্র ভালোবাসা। শ্রেয়ার ঠোঁটে লাজুক হাসি৷ মিহি কন্ঠস্বর। ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করলো,

‘ বলা কি খুব প্রয়োজন?’
প্রিয়ু মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘ একদমই নয়। তবে ভাইয়ার অতীত মানে অহমিকাকে নিয়ে কথাগুলো জানতে ইচ্ছে হয় না তোর?’

‘ অতীত ঘেটে কি লাভ?যেখানে আমি ওনার বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব। তাছাড়া ওনার মুখ থেকেই শুনেছি অহমিকা আপু বড্ড স্বার্থপরতা করেছেন। ওনার ঘৃ*ণা মিশ্রিত বাক্যগুলোই বুঝিয়ে দিয়েছে ঠিক কতটা কষ্ট দিয়েছেন অহমিকা আপু। ‘

‘ তাহলে তুই স্যারের কাছ থেকে এত দূরে দূরে থাকিস ক্যান?লজ্জা পাস?একান্তে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে না তোর?দেখিস অহমিকা এসে আবার না তোর স্যার কে নিয়ে যায়। এত কিসের জড়তা?আমি তো আয়ুশকে পারি না খামচে মে’রে ফেলি। ‘

শ্রেয়ার চক্ষু ছানাবড়া। এই মেয়ের মুখে কিছুই আটকায় না কখনও। সময়,মানুষ, পরিস্থিতি কিছুই বিবেচনা করে না। কেবল মুখ ফোটে বলতে পারলেই যেন পরম আনন্দ, শান্তি। আনমনে কপাল কুঁচকে এলো। বললো,
‘ তুইও স্যারের মতোন লাগামহীন। ‘
নিমিষেই প্রিয়ু অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। বিছানা ছেড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। বলে,
‘ আমি কি ভাইয়ার মতো বলেছি নাকি?ভালোবেসে একটু আধটু চিমটি মা’রতেই পারি আমার জামাইকে। চাইলে তুইও মা’রতে পারিস। ‘
পরক্ষণেই প্রিয়ুর মুখের আদলে পরিবর্তন আসে ব্যাপক। শ্রেয়ার দেহ মুক্ত করে হাত ধরে বিছানায় এসে বসলো। কন্ঠে গুরুতর ভাব এনে বললো,

‘ তোকে কিছু কথা বলবো শ্রেয়া,মনোযোগ দিয়ে শুনবি। এতদিন আমি বাড়িতে সবকিছুই দেখেছি। এটাও দেখেছি বড় মা অহমিকাকে বাড়িতে আনার চেষ্টা করছেন আবারও। ওনার ভাষ্যমতে অহমিকাই মেয়ে হিসেবে ভালো। অথচ উনি অল্পতে পাওয়া সম্মানে ভুলে বসলেন তূর্য ভাইয়ার খারাপ অবস্থার জন্য সেই মেয়েটা কোনো না কোনো ভাবে জড়িত ছিল। কি না করেছেন ভাইয়া মেয়েটার জন্য? ঠিক কতটুকু ভালোবেসেছিল ওকে আমার জানা নেই। কারণ ভালোবাসা পরিমাপ করার ক্ষমতা আদৌ কারো হয় নি। তবে আমার চোখে পড়ত মাঝে মাঝে মেয়েটার জন্য ভার্সিটির ক্লাস মিস দিয়ে ভাইয়া মেডিকেল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন যা ওনার ব্যক্তিত্বের সাথে মিলাতে পারতাম না আমি। আমার জানামতে এবং ছোট থেকে চেনা অনুযায়ী তিনি একজন গম্ভীর এবং খুবই রগচটা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কোনো মেয়ের জন্য ওনার এত অপেক্ষা আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করত। চাইতাম, আয়ুশও আমাকে এমন করে ভালোবাসুক। স্কুলে পড়তাম তখন তূর্য ভাইয়ার এসব পাগলামি আমার কিশোরী বয়সে অনেক প্রভাব ফেলে। ভেবে ভেবে সাজাতাম আয়ুশও কোনো একদিন আমাকে এমন করে ভালোবাসবে।

ছোট থেকেই ওনাদের বাড়িতে আমার আসা যাওয়া লেগে থাকত। সেই সুবাদে একদিন গিয়ে অহমিকাকে পাই সেখানে। বড় মা হাতে চুড়ি পড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তূর্য ভাইয়ার সঙ্গে নাকি ওর বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক। তোহাশ ভাইয়া যাওয়ার পর তূর্য ভাইয়া বেশ ভেঙে পড়েন,আঘা*ত পায় কিছু কথায়। তুই জানিস না কিন্তু আমি দেখেছি তূর্য ভাইয়ার কাছে ওনার পৃথিবী ছিলেন তোহাশ ভাইয়া। কিন্তু সেই পৃথিবী দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ভুবন নতুন করে সাজায় অহমিকা। শক্ত মানুষও ভাঙ্গে,তবে বাহ্যিক ভাবে নয়,ভিতরে ভিতরে। আমরা চাই কেউ আমাদের হোক,আমাদের বুঝুক। তূর্য ভাইয়াও হয়ত চাইতেন,সেই চাওয়ায় পরিপূর্ণতা এনে দিল অহমিকা। আবার কেড়েও নেয় সে। একবার দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেললে মানুষ সেই সুযোগে আরো কঠিন ভাবে আঘা*ত করে। অহমিকা নিজেকে ভালো জাহির করতে এতটাই পরিপক্ব ছিল কেউ ওর আসল রূপটাই দেখতে পারে নি। এমনকি তূর্য ভাইয়াও না। বছর খানেক চুটিয়ে প্রেম করে বিয়ের আগের দিন জানায় লন্ডন চলে যাবে। বিয়ে করবে না। বিয়ে নামক বেড়াজালে বাঁধতে চায় না নিজেকে। তূর্য ভাইয়া প্রথমে ভেবেছিল হয়ত মজা করছে আর সবাই স্বাধীনতা প্রিয় তাই অনেক বুঝায়। বুঝানোর কোনো ত্রুটি রাখে নি। এটাও বলে পড়তে চাইলে লন্ডন চলে যাক,এখন বিয়ে করতে না চাইলে অপেক্ষা করবে। পরে নাহয় করবে। কিন্তু অহমিকার একটাই কথা সে বিয়ে করবে না। একটা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ এতটা নত হলো তার ভালোবাসার কাছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। চলে যায় অহমিকা। সে যাওয়ার পর ভাইয়াকে এসব ব্যাপারে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে নি। কিন্তু কথা তো গোপন থাকে না বেশিদিন। বাতাসের মতোই বইয়ে আসে সত্যটা। লন্ডনে অবস্থিত কাজিনের সঙ্গে প্রেম অহমিকার, তাই তূর্য ভাইয়াকে ছেড়ে পাড়ি জমানো।

সেই ঘটনার পর ভাইয়াকে বাসায় দেখা যেত না সবসময়। ভবঘুরে হয়ে গিয়েছিলেন। এডভেঞ্চার দিয়ে বেড়াতেন। কোনো একদিন আয়ুশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ভাইয়া অ্যালকোহল ব্যবহার করছেন। পরিবারের ভাঙন, তোহাশ ভাইয়ার করা আঘা*ত,অহমিকার করা কান্ডে হয়ত ভেঙে পড়েন তিনি কিন্তু সেটা প্রকাশ করেন নি। নিজেকে সামলেছেন অন্যভাবে। দীর্ঘ দিন অ্যালকোহল ব্যবহারের কারণে তিনি সাইকোসিস ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

নেত্রগহ্বর জলে টুইটুম্বুর। ভিতরটা ধ্বক করে ওঠে শ্রেয়ার। সাইকোসিস ডিসঅর্ডার সম্পর্কে একটু হলেও অবগত ও। এটা এক প্রকার মানসিক ব্যাধি। গুরুতরও বলা যেতে পারে। মূলত বিভ্রম সৃষ্টি করে মানুষের মধ্যে। হ্যালুসিনেশন হয় ওই মানুষ টার সবসময়। ভাবে কেউ আছে। কাউকে অনুভব করে। কখনও কখনও মস্তিষ্ক উগ্র হয়ে যায় মানুষটাকে অনুভব করে। এটা মূলত স্বল্প মেয়াদী হয়। বিরল ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন, বছরও গড়ায়। সাইকোসিস একজন ব্যক্তির পাঁচটি ইন্দ্রিয় তাদের আচরণ ও আবেগকে প্রভাবিত করতে পারে। মন বাস্তবতার সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। তূর্যর বেলায়ও ঠিক এটাই হয়েছে হয়ত। শ্রেয়া ব্যাথাতুর কন্ঠে মৃদু আর্তনাদ করে। দুই অধর নড়েচড়ে ওঠে,
‘ সাইকোসিস ডিসঅর্ডার? ‘

‘ হ্যাঁ। তুই একবার পত্রিকায় এ রোগ সম্পর্কে পড়ছিলি আমি দেখেছিলাম, তাহলে তোর ধারণা রয়েছে। আমার আর বলতে হবে না খোলে। ভাইয়ার রোগ টা ধীরে ধীরে তীব্র আকার ধারণ করে। উনি বেশি কল্পনা করতেন অহমিকা কে। ওকে ভেবে অনেক মানুষকেই আ’ঘা’ত করে ফেলতেন। প্রথম প্রথম নিজেকে নিজ থেকেই অনেক নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতেন কিন্তু পেরে ওঠতেন না। দিনকে দিন ক্রমশ হয় তা। কোনো গতি না পেয়ে সকলে মিলে বন্দী রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। বাড়িতেই ট্রিটমেন্ট চলত ভাইয়ার। একটা সময় ডাক্তার জানালেন চিকিৎসার পাশাপাশি আপনজনদের সেবা যত্নে ভাইয়া বাস্তব জগতে ফিরে আসতে পারেন। যেহেতু তিনি পরিবারের কাউকে সহ্য করতে পারতেন না, সেক্ষেত্রে দাদি তোকে দেখে সিদ্ধান্ত নেয় ভাইয়ার খেয়াল রাখার জন্য বউ করে আনার। উনি মনে করেছেন তুই অচেনা,তোর ক্ষতি করবে না। কিন্তু ভাবনা ভুল ফলে। তুই চলে আসার প্রায় দুই বছরের মাঝামাঝি সময়ে অহমিকা আবার ফিরে আসে। ডাক্তার আংকেল ওকে রেফার করে ভাইয়ার ট্রিটমেন্টের জন্য। প্রথমে বড় মা ওকে দেখে জানিয়ে দেয় ঘৃণায়, ট্রিটমেন্ট করাবে না। পরে ছেলের অবস্থা দেখে অটল থাকতে পারলেন না। বেশ ভালোই চিকিৎসা চালিয়ে যায় ও। সময়ের স্রোতে আবারও ভালো সেজে বড় মা’র মনও জয় করে নেয়। বড় মাও ভাবে ও ভালো হয়ে গিয়েছে। এটাও বলে ও নাকি তূর্য ভাইয়ার অবস্থা শুনেই ফিরে এসেছে। কি জানি কোন স্বার্থ হাসিলে পরাজিত হয়ে আবার কোন স্বার্থের টানে ফিরে এসেছে। ‘

এত লম্বা লম্বা বাক্যে প্রিয়ু হাঁপিয়ে উঠেছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নাসারন্ধ্র বেয়ে বাহিরে উন্মুক্ত হয়। প্রিয়ু পুনর্বার বলে উঠলো,

‘ তোকে এগুলো বলার একটাই উদ্দেশ্য শ্রেয়া ভাইয়ার কাছাকাছি থাক। কাউকে তোদের আলাদা করার সুযোগ দিবি না। কাউকেই না। ভাইয়া তোকে খুব ভালোবাসে। জানিস উনি কেন এতদিন একা একা কাউকে না জানিয়ে এখানে ছিল?কারণ ভালো নেই উনি। সেদিন সকালে বেরিয়ে আসার একটাই কারণ উনি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন আবারও। পুরোপুরি পিছু ছাড়ে নি রো’গ টা। অতিরিক্ত চিন্তা করলেই মাথা ব্যাথা করে। এ ক’দিন যাবত সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন ছিলেন। আমাকে আর রহিমা খালাকে তোর দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন। তুই উনার দ্বিতীয় ভালোবাসা হতে পারিস তবে ভুল মানুষ না। ‘

শ্রেয়ার হৃদয়স্থলে গিয়ে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা বিস্তার করে প্রিয়ুর কথাগুলো। তূর্য একা একা কতকিছু সহ্য করছে অথচ ও জানতেই পারলো না। প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য প্রয়োজন নয়ত কেউ কেউ পরিণত হয়ে যায় মানসিক রোগী তে। মানসিক রোগের ওষুধ হলো সঙ্গ,ভালোবাসা, যত্ন। কিন্তু একটা সময় ও এসবই দিল না তূর্যকে। এখনও কি দিচ্ছে? প্রিয় হোক কিংবা অপ্রিয় মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত মানুষগুলোকে পারলে একটুখানি সঙ্গ দেওয়া উচিত।
_______________

রিকশা চলছে সোজা পিচঢালা রাস্তা ধরে। ব্যস্ত হাতে চাচা গামছা সমেত কপালের তপ্ত জলবিন্দু কণা মুছে নিচ্ছেন। মৃদুমন্দ সমীরণে ওড়ছে শ্রেয়ার শুভ্র রঙা আঁচল। সাঁঝবেলা পার হয়ে রজনী নেমেছে সদ্য। তবুও ঘোর রজনী চারিধারে। কোথাও কোথাও নিয়ন আলো পথিকদের সঠিক পথ দেখিয়ে চলেছে যেন আঁধারের অতলে ডুবে না যায়। প্রিয়ু পাশে বসে খানি সেকেন্ড বাদে বাদে নিরবতার সমাপ্তি ঘটাচ্ছে। বেশ কয়েকবার মলিন,নিষ্প্রভ স্বরে এক রাশ আফসোস নিয়ে বলেছে,

‘ আয়ুশকে বড্ড মিস করছি। আগে দূরে ছিলাম সইয়ে গিয়েছে। এখন কাছে থেকে অভ্যাস হয়ে গিয়ে অল্প সময়ের বিচ্ছেদে দম বন্ধ হয়ে আসছে। ‘

বিচ্ছেদের বেদনার স্বাদ শ্রেয়া নিয়েছে। তাই প্রিয়ুকে প্রতুত্তরের শব্দাংশ খুঁজে পেল না। অচিরেই পেছনের রিকশা টা ওদের রিকশা পার করে থামলো। চাচাও প্যাডেল ঘুরানো বন্ধ করে দিলেন। শ্রেয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলেছে সবে,তখনই তূর্য অপর রিকশা থেকে নেমে আসে। মুখে কেমন একটা উদ্বিগ্ন, অস্থিরতা। বড় বড় পা ফেলে এসে ঝুঁকে ওর শাড়ির বড়সড় আঁচল টা রিকশার চাকার কাছ থেকে তুলে ঠিক করে দিল। শ্রেয়ার হৃদস্পন্দন প্রায় থমকে গিয়েছে। কি হতে যাচ্ছিল এখন!সামান্য সতর্কতার অভাবে প্রাণ টা খোয়াতে হতো। তূর্যর দিকে করুণ চাহনি নিক্ষেপ করতেই নরম,শীতল কন্ঠস্বর শুনতে পায়,

‘ মে’রেই ফেলছিলে আমাকে। ‘

#চলবে,,!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here