সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,৩৬,৩৭

0
1379

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,৩৬,৩৭
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩৬

একই সিরিয়ালে রাস্তার একপাশে দুটো রিকশার অবস্থান লম্বভাবে। অর্থাৎ একটার পশ্চাতে অপরটার স্থান। চালক দু’জনের মধ্যে একজন তাগড়া যুবক এবং আরেকজন বেশ বয়স্ক। চামড়া কুঁচকানো। নিঃশ্বাস টাও কেমন ভারী ভারী ঠেকছে মানুষ টার। দেহে কাঁপুনি ঈষৎ। তবুও পেটের ক্ষুধা, পরিবার সামলাতে সড়কে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে। শ্রেয়ার অত্যন্ত কষ্ট হয় এসব চক্ষুগোচর হলে। মনে মনে কত-শত বার ভাবে ওর যেদিন অনেক টাকা হবে এসব মানুষকে সাহায্য করবে। কেননা অভাব ও বুঝে। এতিমখানা থেকে স্কুল – কলেজে পড়ার খরচের ভার নিলেও কখনও অন্যান্য খরচের টাকা দেওয়া হতো না। ওই যে রাস্তার অন্য পাশে হাওয়ায় মিঠাইয়ের মেলা বসেছে, একটা সময় সেগুলো খাওয়ার জন্য দশ টাকাও ম্যানেজ করতে পারত না। থাকা,খাওয়া,পড়া সবই তো এতিমখানার অধীনে ছিল। কলেজে ওঠে মাদারের পারমিশনে দু একটা টিউশনি করত সেগুলো থেকে পাওয়া টাকাগুলো জমিয়েই রাখত। এক পয়সাও খরচ করতে গেলে কেঁপে উঠত বুক টা। ভাবনায় আসত -অকাজে, আলতু ফালতু শখ, আহ্লাদে টাকা নষ্ট করার মানে হয় না৷ মূলত পরিস্থিতিই আমাদের মনোভাব এমন করে তুলে। কিন্তু এখন ওর অভিলাষ জাগে ছু মে’রে একটা গোলাপি রঙের হাওয়ায় মিঠাই ছিনিয়ে আনতে। হলুদ আলোয় আরো মিষ্টি মিষ্টি লাগছে হাওয়ায় মিঠাইগুলো।

প্রিয়ুর ডাকে দৃষ্টিভঙ্গ হয় শ্রেয়ার। কর্ণকুহরে আসে,
‘ স্যার কে বল আমরা রিকশায়-ই যাবো। ‘
নিমেষে চমকায় শ্রেয়া। ও এমনটাই বলবে বলবে ভাবছে। খোলা অম্বর এবং কৃষ্ণ মেঘপুঞ্জের নিম্নতলে চলবে রিকশা। সঙ্গে থাকবে অনুত্তেজিত, স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া। উত্তাপে হাস ফাঁস প্রকৃতি কয়েক মিনিটে নিজস্ব রূপের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ঠান্ডা ঠান্ডা, নিরুত্তাপ পরিবেশ। ঘাড় টা আলতো ফিরিয়ে তাকায় অতীব প্রিয়তমের নিকট। তূর্য কানে মোবাইল ধরে রেখেছে। অনলাইন মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া করার চেষ্টা। আঁচল আঁটকে যাবার সেই ঘটনার মিনিট খানেক পেরোয়। প্রিয়ু ও শ্রেয়াকে রিকশা থেকে নামিয়ে ইট পাথরের গঠিত ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে রেখেছে তূর্য। চালক দু’জনের ভাড়া মিটিয়ে অস্থির মাখা কন্ঠে জানায়–‘ রিকশায় যাবে না। ‘

শ্রেয়া উপলব্ধি করে তূর্য সেই ঘটনায় অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে পড়েছে। সমস্ত আদলে তীব্র ভয় শঙ্কার ছাপ। সামান্য একটু ব্যাপারে এত উত্তেজনা,ব্যগ্রতা মানুষ টার। বাসা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসা হয় আজ ওরা রিকশায় ঘুরবে। ঘটনা টা হওয়ার পর তূর্য মতামত পরিবর্তন করে ফেলেছে। শ্রেয়া সোজা হয়ে প্রিয়ুকে থেমে থেমে,লজ্জাতুর কন্ঠে বললো,
‘ আমি যদি ওনার সাথে এক রিকশায় চড়ি,আপত্তি আছে তোর?মানে একা খারাপ লাগবে বাকি রাস্তা টুকু?’
প্রিয়ু মুখ কালো করে ফেললো। স্বরনালী বিষন্ন, বেদনামিশ্রিত,
‘ আয়ুশের কথা মনে পড়ে যাবে বেশি বেশি। ওর শূণ্যতায় পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাবো। ‘
মনে মনে এটা নিয়েই সন্দেহাতীত ছিল শ্রেয়া। একা একা নিশ্চয়ই মনোক্ষুণ্ণ হবে মেয়েটার। সুতরাং নিজের কল্পনার জগত উচ্ছেদ করার চিন্তা ভাবনা করলো। চিকন ওষ্ঠযুগল ছড়িয়ে স্মিত হাসলো। বললো,
‘ আমরা এক রিকশায় যাবো। দেখি স্যার কে ম্যানেজ করতে পারি কিনা। ‘
‘ হুম। এক রিকশায় তুই আর ভাইয়া যাবি। আরেকটায় আমি আয়ুশকে কল্পনা করে দিব্যি নিঃশ্বাস ফেলবো। আহা!’
কথাটা বলে প্রিয়ু মিটমিট করে হাসলো। এতে যারপরনাই অবাক শ্রেয়া। এত রূপ বদলে দক্ষ এই মেয়েটা। তবে খারাপ নয়,বরাবরই মানুষকে বিমোহিত করে একেক সৌন্দর্যে,রূপে। শ্রেয়া ওর হাত টা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
‘ শুনেছি সুন্দর মনের মানুষ জীবসঙ্গী হিসেবে একজন ভালো মনের মানুষই পায়। প্রমাণও পেলাম। তুই ও আয়ুশ ভাই দু’জন হলেও মন এক। বুঝি না কিভাবে তোদের ঋণ শোধ করবো। উপায় বলে দিবি প্রিয়ু?’
‘ তুই যতবার হেসেছিস আমাদের ঋণ শোধ হয়ে গিয়েছে। ‘
তৎক্ষনাৎ শ্রেয়ার অবরুদ্ধ চাহনি। বিমূঢ় কন্ঠস্বর,
‘ মানে?’
প্রিয়ু গর্বিত কন্ঠে আওড়ায়–‘ তোকে ভালো রাখা,হাসিখুশি রাখার জন্যই তো এতকিছু। এতেই ঋণ শোধ হয়ে গেল। এখন জলদি যা৷ যদি ক্যাব চলে আসে?’

শ্রেয়া ভীরু ভীরু পায়ে হাঁটে। গতি নেই হাঁটায়। কদম ছোট্ট ছোট্ট। খুব বেশিই ধীরস্থ। তূর্য মোবাইল কান থেকে নামিয়ে পকেটে পুড়ে নেয়। শ্রেয়াকে আসতে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে। ললাট স্পর্শ করে ভ্রুঁ যুগল। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিক্ষেপ করে বলে উঠলো,

‘ কিছু বলবে?’
শ্রেয়া অতিকায় ছোট্ট নিঃশ্বাস মুক্ত করে নাকের দু ছিদ্র মাধ্যমে। বড্ড এলোমেলো ও দ্বিধান্বিত গলায় বলে,
‘ আমরা রিকশায় যাবো। প্লিজ গাড়ি নিষেধ করে দিন। ‘
তূর্য হ্যাঁ বা না কোনো বর্ণ উচ্চারণ করলো না। শ্রেয়া জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টি মেলে রাখে ঠাঁই। সেকেন্ডে পল্লব অল্পস্বল্প কেঁপে ওঠে। চাতক পাখি হয়ে আছে সে উত্তরের অপেক্ষায়। তূর্য গম্ভীর স্বরে বললো,
‘ রিস্ক নিতে পারবো না। আমরা ক্যাবেই যাবো। ‘
শ্রেয়া দমলো না। বুঝানোর ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
‘ আমি সতর্ক থাকবো স্যার। প্রিয়ুও রিকশায় যেতে চাইছে। প্লিজ। ‘
‘ তোমার নিজের খেয়াল না রাখলেও চলবে। কিন্তু আমার বউয়ের কিছু হলে একদমই চলবে না আমার। একটা কথাও না আর। ‘
ঝাঁঝালো কন্ঠে কথাগুলো বলে উঠলো তূর্য। শ্রেয়া মলিন মুখে আগের স্থানে ফিরে যেতে নিলে হাতে চাপ অনুভব করে। শ্রবণ হয় চিন্তিত স্বর-‘ আমার কাছে তুমি আমার মানসিক শান্তি শ্রেয়সী। ‘

অভ্যন্তরে ঢেউ গর্জে ওঠে। অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ হারা তার গতি। শ্রেয়ার ভূ তলে কম্পন। মন জুড়ে শীতল স্রোত বহমান। একটা বাক্যে এত শান্তি! এত সুখ,গভীর ভালোবাসার মিশ্রণ! তাছাড়া আর কি কি আছে তাতে?হারানোর ভয়?ও তো কোনোদিন, কস্মিনকালেও ভাবে নি কেউ ওর আপন হবে,ওকে হারানোর চিন্তায় কাতর থাকবে। ভালোবাসা কি এমন হয়?গম্ভীর, রগচটা, বদমেজাজি মানুষটাকে নরম করে ফেলে,নিভিয়ে দেয় সেই মানুষের তেজস্বী প্রদীপ। তূর্য হাত ছেড়ে দিয়ে সমুখে এসে দাঁড়ালো। শ্রেয়া স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছে কালো কুচকুচে মণিতে বিচলতা।

আরক্ত কপোলে এক হাত রাখে তূর্য। নিমেষে শ্রেয়ার নির্নিমেষ নেত্রের চাউনি নত হয়। নত মুখশ্রীতে গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তূর্যর চক্ষুদ্বয়। ঠান্ডা গলায় বললো,
‘ তোমার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখও আমায় এখন কষ্ট দেয় শুভ্রপরী। মানুষ তার প্রিয়জনকে ভালো রাখতে কত কি করে। কিন্তু আমি আমাকে ভালো রাখতে তোমার ছোট ছোট দুঃখও নিজের নামে করতে নিতে প্রস্তুত। আমরা রিকশায়-ই যাবো। বউয়ের একটা ইচ্ছে যদি পূরণ না করতে পারি কেমন জামাই হলাম?চলো। ‘

মৃদু হাসলো শ্রেয়া। নিচু স্বরে বললো-‘ আমি আপনার সাথে যাবো।’
তূর্য যেন ভুল শুনলো। সঠিক কিনা যাচাই করতে প্রশ্ন করলো,
‘ কি?’
এ যাত্রায় একটুখানি গলা উঁচায় শ্রেয়া। ঠোঁটে লাজুক হাসি,
‘ আমি আপনার সাথে এক রিকশায় যাবো। ‘
‘ কিন্তু প্রিয়ু?’
‘ ও সামনের রিকশায় থাকবে। আমি ও আপনি পিছনের টায়। ‘

তূর্য আর কোনো কিছু বললো না। দাঁড়ানো রিকশা দু’টো ডাকলো ফের। ক্যাবকে নিষেধ করলো, এমনকি অনলাইনে ভাড়া পর্যন্ত মিটিয়ে দিল। আজ গাড়ি ছাড়া বের হয়েছিল ওরা। উদ্দেশ্য একটুখানি ঘুরাঘুরি। যথারীতি প্রিয়ু সামনের রিকশায় বসলো,শ্রেয়া পিছনের টায়। তূর্য ওর শাড়ির আঁচল টা এবার ভালোভাবে ঠিকঠাক করে দিয়ে বলে উঠলো,
‘ অপেক্ষা করো। আমি আসছি। ‘
ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। কিন্তু শ্রেয়া নির্বাক হয়ে পড়ে কিয়ৎক্ষণ পর।

তূর্য হাতে পাঁচ টা হাওয়ায় মিঠাইয়ের প্যাকেট নিয়ে সোজা প্রিয়ুর কাছে যায়। ওর হাতে দু’টো প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ফিরে আসলো শ্রেয়ার নিকট। তখনও বিস্ময়ের পর্যায়ে শ্রেয়া। তিনটা প্যাকেট ওর কোলে রেখে পাশে বসে পড়ে। দুই হাতের সাহায্যে রিকশার হুডি তুলে দিয়ে বললো,
‘ বউ একটু বেশি পাওনা,তাই বউয়ের ভাগে তার পছন্দের হাওয়াই মিঠাই তিনটা। ‘
‘ আপনাকে কে বললো আমার পছন্দের?’– শ্রেয়ার কন্ঠে অবাকতা।
তূর্য একটা প্যাকেট খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিল। নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি তার- ‘ তোমার দৃষ্টি বলেছে।’
যতক্ষণে স্বাভাবিক হয় শ্রেয়া ততখানি সময়ে হাওয়ায় মিঠাই বাতাসের আলিঙ্গনে চুপসে ছোট আকার ধারণ করেছে। তূর্যর ইশারায় সেই ছোট অংশই মুখে নিয়ে নিল।

দু’টো দেহ পাশাপাশি। শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে শিহরণ,বাতাসের স্পর্শ এটাই তো চেয়েছিল শ্রেয়া। সকল জড়তা কাটানোর প্রচেষ্টায় ও। মৃদু গলায় বলে উঠলো,
‘ স্যার!’
‘ বলো। ‘
শ্রেয়া বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। ডেকেও ফ্যাসাদে পড়ে গেল। ওর নড়াচড়া দেখে তূর্য কোমরে হাত রেখে কাছে টেনে আনলো। ফিসফিস করে বললো,
‘ বলো না কেন?শরম লাগছে?ভাবছো,একটু রোমান্স করতে স্যারের সাথে এক রিকশায় উঠলাম অথচ উনি পাত্তাই দিচ্ছে না। ‘

শ্রেয়া ভড়কে গেল। সরব করে কিছু বলতে চাইলে তূর্য হুস করে ওঠে। আরো গাঢ় হয় গলার স্বর,
‘ আসলে আমার একটু না অনেকবেশি আদর করতে মন চাইছে তোমাকে। কিন্তু রাস্তাঘাট তো। তাই ধৈর্য্য সহকারে একটুই করবো। ‘
শ্রেয়া বুঝে ওঠার পূর্বেই অনাবৃত কোমর চেপে নিজের বুকের কাছাকাছি নিয়ে আসে তূর্য। কপালে ছুঁয়ে দেয় শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয়। নাকেও স্পর্শ পড়ে সেই অঙ্গের। নিমীলিত চক্ষুদ্বয়ে তূর্যর বক্ষে এক হাত রেখে নিশ্চুপে অনুভব করে তা শ্রেয়া।

প্রিয়ু রিকশায় বসে আকাশের তারা গুণছে। জানে এটা অসম্ভব ব্যাপার তবুও ক্ষুদ্র প্রয়াস। আকস্মিক রিকশা থামতেই নজর সরিয়ে সামনে ফেলতে প্রস্তুত হয় ও। সাথে সাথেই রিকশা টা হেলেদুলে ওঠে। ধপ করে পাশে বসে কেউ। ঘাড় বাঁকাতেই দেহ পিছিয়ে যায় অনেকখানি। মুহুর্তেই আয়ুশ টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো। হেসে বললো,
‘ তোমার ভাঙা কোমর দেখতে আসি নি। আমার সুস্থ, নাদুসনুদুস প্রিয়ুকে দেখতে এসেছি। ‘
আয়ুশের বুকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে ও। সমস্ত প্রকৃতি, মানুষ, দিকবিদিক ভুলে বুকে তীক্ষ্ন দাঁত বিধিয়ে দিল। এতে হাসির মাত্রা বেড়ে গেলো আয়ুশের।
‘ ভয়ে আমাকে কামড়ানো হচ্ছে? ‘
‘ হ্যাঁ। কখন আসলে?’
‘ সকালে যখন আমার প্রিয়ু আমাকে ফেলে আসলো তখন থেকেই কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ভার্সিটি থেকে বেরিয়েই এখানে ছুটে আসা। কি করলে প্রিয়ু?এত বছরের জাদু এখন কাজ করছে একসাথে। তুমি দূরন্ত এক জাদুকরী। ‘
____________

ঘুরাঘুরি শেষে তূর্য, শ্রেয়া ফিরে আসে। সঙ্গে প্রিয়ু,আয়ুশও। শ্রেয়া প্রথমে স্তব্ধ হয়ে যায় হুট করে আয়ুশ কে দেখে। পরবর্তীতে তূর্য জানায় এটা পূর্বপরিকল্পিত। ওরা সকালে আসার পরপরই নাকি আয়ুশ ফোন করে বলে সন্ধ্যা নাগাদ চট্টগ্রাম থাকবে ও। চমকে দেবে ওদের, বিশেষ করে প্রিয়ুকে। এত বছর ধরে যেই ভালোবাসা চেয়েছে প্রিয়ু তার চেয়েও বেশি পাচ্ছে বলে মনে হয় শ্রেয়ার। কারণ প্রিয়ুর চাওয়া ছিল সীমিত। আয়ুশের একটু যত্ন,ওর সাথে কথা বলাতেই খুশিতে লাফিয়ে ওঠতো। কখনও হয়ত কল্পনায়ও আনে নি ওকে আয়ুশ একদিন পাগলের মতোন ভালোবাসবে। শাড়িটা এখনও পাল্টানো হলো না ওর। এই লাল পাড়ের সাদা শাড়ি টা তূর্যর দেওয়া। একা একটা ফ্ল্যাটে,নির্জনে দু’টো হৃদয় একসঙ্গে বসবাস করবে আজ। রাত টা অতিরিক্ত দীর্ঘ মনে হচ্ছে শ্রেয়ার। প্রিয়ু ও আয়ুশ পাশের ফ্ল্যাটে। তূর্য শোবার ঘরে। শ্রেয়া সোফায় বসে কানের ঝুমকো জোড়া খুলছিল তখনই মোবাইলের শব্দে টেবিলের উপর তাকালো ও। তূর্যর মোবাইলের স্ক্রিনে মেহরিমার নাম্বার ভেসে ওঠেছে। কিছু একটা স্মরণে আসতেই নির্দ্ধিধায় কলটা রিসিভ করলো ও। সালাম দিয়ে কন্ঠে নম্রতা এঁটে নেয়,

‘ কেমন আছেন আম্মা?’
ওপাশ থেকে কড়া আওয়াজ আসে,
‘ তুমি কেন ফোন ধরেছো?তূর্য কোথায়?’
‘ উনি অন্য রুমে। আসার সময় দেখলাম আপনার প্রেশার বেড়ে গিয়ে শরীর খারাপ হয়ে পড়েছিল। এখন ঠিক আছেন?’
‘ তোমার না জানলেও চলবে। কথা বলো না তো। তোমার কন্ঠ শুনে আমার মেজাজ গরম হচ্ছে। এত জেনে কি লাভ? ‘
‘ আজ যদি আমার মা থাকত তাহলে সন্তান হিসেবে আমি আমার মায়ের খবর নিতাম আম্মা। জিজ্ঞেস করতাম কেমন আছে। অসুস্থ থাকলে চিন্তা করতাম। মা নেই কিন্তু আপনি আছেন। শাশুড়ি হলেও আপনাকে আম্মা ডাকি। আমি কি আমার আম্মার ভালোমন্দ জানতে চাইতে পারি না?’
মেহরিমার কন্ঠের তেজ হারিয়ে ফেললেন নিমেষে। কি মধুর মেয়েটার বলা বাক্যগুলো! মা’য়ের জন্য কতটা আকুলতা। ভিতরটা হিম হয়ে আসে ওনার। পারলেন না আর ধমকে উঠতে। নিভে যাওয়া স্বরেই বললেন,
‘ তূর্য আসলে কল দিতে বলো। ‘

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩৭

সেই ছোট্ট বেলা থেকেই শ্রেয়া এক নীরব কন্যা। নিশ্চুপ,চাপা স্বভাবের অধিকারীণি। মূলত বাবার প্রতি ভীতি টাই ওকে এমন করে তুলেছে। বিশেষ করে শৈশব কালে যখন খেলার সঙ্গীদের কাছ থেকে অবহেলিত হয়ে ফিরে আসত ওর ভিতরটা ঠান্ডা, শীতল হয়ে যেত। সেটা প্রস্ফুটিত হতো বাহ্যিক অংশেও। বাবার গর্জন শুনলে ও মাঝে মাঝে মা’য়ের পেটে মুখ গুঁজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত। একটা শব্দও উচ্চারণ করতো না,শুধুই ভিজিয়ে দিত মায়ের আটপৌরে সুতি কাপড়টা। বিষাদে,অবহেলায়, হারানোর বেদনায়, তিক্ত মুহুর্ত, স্মৃতিতে ওর মন ধীরে ধীরে আরও ঠান্ডা হয়ে যায়। কখনও মায়ের মৃ-ত্যুর পর আপনজনের ছোঁয়া পায় নি সে। খোলামেলা,প্রাণবন্ত হয়ে মেশা হয় নি কারো সঙ্গে।

মা ব্যতীত অন্য কোনো আপন মানুষের স্পর্শ কেমন হয় সেটা আগে জানত না শ্রেয়া। কপাল গুণে রক্তের নাহলেও আপন হতে পেরেছে প্রিয়ুর। তবুও জড়তার রেশ রয়ে যায় অল্পস্বল্প, ঈষৎ। এখন অনেক আপনজন ওর। বাবা,আম্মা, দেবর,বেস্ট ফ্রেন্ড,ননদ,দাদি, রহিমা খালা সবাই আছেন৷ প্রাণের চেয়েও প্রিয় হয়ে ওঠেছে একটা মানুষ,যে সম্পর্কে ওর স্বামী। এত এত আপনজনের ভিড়ে ওর নিজেকে আর অসহায়, এতিম মনে হয় না। যারা যারা ওকে অপছন্দ করে,একদিন ওদের মনে ওর জন্য একটা সুন্দর জায়গা তৈরি হবে এটা ওর দৃঢ় বিশ্বাস।

‘ আমার বউ আমার সাথে এত মিষ্টি করে কথা বলে না কেন?মাঝে মাঝে বললেই পারে আপনি আমার স্বামী। দূরে দূরে কেন থাকেন?আদর করতে পারেন না?’

পিছন থেকে ফিচেল,রসাত্মক কন্ঠস্বর তীক্ষ্ণ ভাবে বিঁধে শ্রেয়ার শ্রবণনালিতে। হাতের মোবাইল টা রেখে তড়িঘড়ি করে, ব্যতিব্যস্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো ও। তৎক্ষনাৎ চক্ষু ক্যানভাসে আঁকে সুন্দর একটা দৃশ্য। তূর্যর হাতে বকুল ফুলের মালা। এটা কই থেকে আসলো?কি মন মাতানো সুঘ্রাণ!বড্ড মাতোয়ারা হয়ে ওঠেছে নিস্তব্ধ কক্ষ টা। এই ঘ্রাণ টার সঙ্গে আধা ঘন্টা পূর্বেই তো ওর আর প্রিয়ুর সাক্ষাৎ হয়েছিল। ওরা যেই জায়গায় দাঁড়িয়ে গ্রোগাসে ভর্তা খেয়ে যাচ্ছিল সেখানেই অবস্থান বকুল ফুলের গাছ টা। কত অবলীলায় মধুর সৌরভ বিলিয়ে দিচ্ছিল সবাইকে। ও ভেবেই নিয়েছে চাচার ভর্তা বেশি বিক্রি হয় এই গাছের কারণেই। সুবাস লুফে নিতেই হয়ত মানুষ ভর্তার অজুহাতে মিনিটের পর মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু তূর্যর হাতে বকুল ফুলের মালা এলো কোত্থেকে? লজ্জায় প্রশ্ন করতে পারছে না সে। কিসব বললো সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তি। ওর কিছু বলার অপেক্ষাও করলো না তূর্য। কোমল হাত টা টেনে নিজের কাছে নিল। বকুল ফুলের মালা টা কব্জিতে জড়িয়ে দিতে মগ্ন হয়ে পড়লো। খুব যত্নের সাথে পড়িয়ে দিচ্ছে।

শ্রেয়া ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে রইল। ছোট্ট করে প্রশ্ন করে ব্যাঘাত ঘটালো তূর্যর কাজে।
‘ এটা কখন আনলেন?’
তূর্য বেজায় বিরক্ত হলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ প্রশ্ন টা পরে করা যেত না?’
শ্রেয়া ভাবভঙ্গি আঁচ করে ধীমে স্বরে প্রতুত্তর করলো,
‘ এখনই জানতে ইচ্ছে হলো তাই। আপনি কি বিরক্ত হয়েছেন?’
‘ খুব। তোমাকে মা’রতে মন চাইছে। আমার রোমান্সের শ’ত্রু তুমি। কত যত্ন করে পড়াচ্ছিলাম,এখন বিঘ্ন ঘটিয়ে যত্নে ত্রুটি রেখে দিলে। ‘

অধরে হাসি ফুটে উঠলো শ্রেয়ার। ছোট ছোট বিষয়ে কত যত্ন মানুষ টার। ভিতরে প্রচন্ড ভালো লাগার পবন বইছে। একটা সময় ছিল চাইলেও কিছু পেত না,আর এখন না চাইতেই কত কিছু,কত সুখ পেয়ে যাচ্ছে। তূর্য মালাটা পড়িয়ে মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
যেন অসাধ্য কাজ সাধন করেছে সে। ঠোঁটে প্রফুল্ল হাসি। নিঃশব্দ তা। হাত টা এখনও ধরে রেখেছে। বললো,

‘ এটা আসার সময় এনেছি। ‘
শ্রেয়া থ হয়ে গেল। অনতিবিলম্বে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কই আমি দেখি নি যে?’
‘ তোমার সব কেন দেখতে হবে?আমাকে দেখো। কাজল চোখে আমাকে দেখে চোখ দুটোকে ধন্য করো। ‘

দেখি তো আপনাকে। লুকিয়ে অনেক দেখি। আমার দেখা সুদর্শন পুরুষ আপনি।– কথাগুলো কন্ঠনালি মাধ্যমে বাহিরে এলো না। মনে পিঞ্জিরাবদ্ধ হয়ে থেকে গেল। তূর্য হাত টা ছেড়ে দিতে নিয়ে আবারও আঁকড়ে ধরলো। দুই ওষ্ঠের সন্নিকটে নিয়ে আসে বকুলে সজ্জিত হাত খানা। শ্রেয়ার অন্তঃস্থল থেকে থেকে তিরতির করে কাঁপছে। তূর্য নরম ত্বকে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। চোখের পলকে শিরশির করে উঠলো শ্রেয়ার সমস্ত অঙ্গ। সর্বাঙ্গে নিদারুণ কম্পন, আন্দোলন। দেহের তাপমাত্রা উষ্ণ।

তূর্য বকুল ফুলের ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে টেনে নিয়ে ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলে উঠলো,
‘ জ্বর আসছে নাকি?দেহের তাপ বেড়ে গেল হঠাৎ?’

শ্রেয়ার সমস্ত বদন রক্তাভ। লালের প্রলাপ পড়েছে। মিহি কন্ঠে উচ্চারণ করে- ‘ তেমন কিছু না। ‘

কিঞ্চিৎ তফাত বোধহয় আর সইতে পারলো না তূর্য। শ্রেয়ার হাত টা নিজের বুকের বা পাশে রাখে। কোমর জড়িয়ে দেহ টা আঁকড়ে ধরে বুকের ভেতর। শ্রেয়া থমকে গেল। স্তব্ধ হয়ে পড়লো। অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়লো হৃদস্পন্দন। তূর্যের বুকে অবস্থিত হাত টা বারংবার নড়চড় হচ্ছে। কাঁপছে।

তূর্য হালকা ঝুঁকে আসলো। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ মাখলো শ্রেয়ার মসৃণ, কোমল গালে। সঙ্গে সঙ্গে শ্রেয়ার হাত টা তূর্যর গেঞ্জি খামচে ধরে। তূর্য মৃদু হাসলো। কোমরের বাঁধন কঠিন হতে কঠিনতর করে মিশিয়ে নিল চিকন দেহখানি। বললো,

‘ আমার সামান্য চুমুতে তোমার দেহের এত উত্তাপ। আগে জানতাম চুমুতে জ্বর ভালো হয়,আজ জানলাম চুমুতে জ্বর হয়। এটা অবশ্য নিব্বা নিব্বিদের জানা উচিত। নয়ত আজীবন ভাববে চুমুতেই বুঝি জ্বরের ওষুধ। ‘

শ্রেয়া ঠোঁট টিপে হাসে। তবে সেটা অগোচরে। তূর্য ওকে আঁকড়ে ধরে রেখেই কর্ণ পাতায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,

‘ আমার পছন্দ টা পাল্টে গেল। তোমার পছন্দগুলো আমার চাওয়া হয়ে উঠলো। তোমাকে স্ট্রং করতে যেয়ে আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম তোমার প্রতি। কিভাবে হলো এসব শ্রেয়সী?’

অন্তঃপুরে ঝড়ের শুরু। সেই ঝড়ের প্রচন্ড বেগ। সবকিছু নাড়িয়ে তুলছে। শ্রেয়ার দু ঠোঁট নড়ে উঠলো ,
‘ আমি,,।’
একটা বাক্যের শুরু হয়েছিল সবে। পুরোটা বলার আগেই তূর্য শান্ত,নরম কন্ঠে পুনর্বার বলে,
‘ আমি তোমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরি?’

নিরুত্তর, হতবাক শ্রেয়া। ওর শরীর বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। আর কতটুকু শক্তি প্রয়োগ করলে একদম ঢুকে যাবে ও তূর্যর বুকে?বুকের কাছ থেকে হাত সরিয়ে দু হাত আস্তেধীরে,মনে মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে ও তূর্যর পিঠে রাখলো। এতেই যেন সম্মতি লুকিয়ে আছে। নিমেষে আলিঙ্গন অত্যধিক গাঢ় হয়। সাহস সঞ্চয় করে একটা প্রশ্ন করলো শ্রেয়া,

‘ আমাকে স্ট্রং দেখার জন্যই সেদিন ফুলশয্যার রাতে ভালোবাসেন না বলেছেন তাই না?’

‘ এখনও কি বলেছি ভালোবাসি?’
তূর্যর নিরলস জবাব শুনে শ্রেয়া প্রতিবাদী কন্ঠে বললো,
‘ আমি বুঝে নিয়েছি। আমার হৃদয় থমকেছে। সেদিন রাস্তায় বলা কথাগুলোর মানে বুঝতে আজ আর ভাবতে হয় না আমার। ‘

তূর্য মুখ সরিয়ে এনে শ্রেয়ার মুখের দিকে তাকালো। ততক্ষণে মাথা নুইয়ে ফেলেছে শ্রেয়া। নিজের কথায় নিজেই আহাম্মক বনে গেল ও। তুখোড়,অনিমেষ নেত্রের চাহনি ও সহ্য করতে পারবে না। আই কন্টাক্ট সম্ভব নয় ওর পক্ষে। এই চাহনিতে ও হাজার বার লজ্জাবতী হবে। তবুও পারবে না চোখে চোখ রাখতে। মুহুর্তেই তূর্য তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘ অবশেষে বুঝলে। নয়ত ভেবেছিলাম বউ আমার সারাজীবন গাধী থাকবে। স্ট্রং না বানাতে পারি,গাধী শব্দটার ইতি তো টানতে পারবো। ‘

আনমনে কপাল কুঁচকে এলো শ্রেয়ার। প্রশ্ন করলো,
‘ স্ট্রং?’

তূর্য চিকন দেহ খানি বন্ধন মুক্ত করে দেয়। শ্রেয়ার হাত টা ধরে শোবার ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় নিয়ে আসলো। ওকে একটা টুলে বসিয়ে দিল সে। নিজে বসলো ওর সামনে হাঁটু গেড়ে। বললো,

‘ কোনো একদিন চৌধুরী বাড়ির বারান্দায় বসে বলেছিলাম আমি তোমাকে চাই না। সত্যিই সেদিন আমি কোনো দুর্বল শ্রেয়সী চাই নি। বউ হিসেবে তোমাকে আমার জীবনে ফিরিয়ে আনলেও,তুমি এসেছিলে আমার হৃদয়হরণকারী হয়ে। তোমার ছোট বেলার ছবি দেখেই প্রথম এক অসহনীয় অনুভূতি জাগে আমার মাঝে। অনুভূতির প্রখরত্ব এতটাই বেশি আমি সেদিনের পর তোমাকে চেয়েও ঘৃ-ণা করতে পারি নি। শুধু মনে হয়েছিল আমার তোমাকে চাই, জীবনে রেখে দেই তোমাকে। আর যেদিন জানলাম তুমিই আমার বউ তখন শুধু মাথায় আসে এত নরম চরিত্রের মেয়েটা কেন আমার হলো?ও যখন অন্যের কথায়,আচরণে কষ্ট পাবে আমি কিভাবে সহ্য করবো?অন্যকে জবাব দেওয়া শিখাতে হবে ওকে। জীবনটাকে আরো কঠিন পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে হবে যেন ও উপলব্ধি করে স্ট্রং হওয়া ছাড়া জীবনে টিকে থাকা দুর্বিষহ হয়ে যায়। যেমন আমার মা ওর ফিরে আসার পরও সরলতার সুযোগ নিয়ে, অসহায় ভেবে তাড়িয়ে দিল ওকে। তাহলে জীবনে ও সবসময় এভাবেই নিজেকে গুটিয়ে নিবে?অনেক চিন্তায় পড়ে যাই। ‘

তূর্য থেমে যাওয়াতে অশান্ত হয়ে পড়ে শ্রেয়া। লম্বা,লম্বা আঙুলের ফাঁকে নিজের ছোট ছোট আঙুল গলিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,

‘ থামলেন কেন?’

‘ তুমি দুর্বলচিত্তের মেয়ে শ্রেয়সী। নিজের অধিকার ছি’নিয়ে নিতে জানো না তুমি। নয়ত কেমন করে পারতা অহমিকা ও আমার বিয়ে সহ্য করতে?একটা বার কাউকে বলেছো?বলো নি। প্রথম যেদিন জানলে আমিই তোমার স্বামী প্রিয়ুদের বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসলে চট্টগ্রাম। তারপর আমার আর অহমিকার বিয়েটা মেনেই নিচ্ছিলে। এটা কি তুমি ড্রামা পেয়েছিলে?এটা তোমার বাস্তব জীবন শ্রেয়সী। ল’ড়াই করে বাঁচতে হয় এখানে। তাহলে তুমি তা না করে সবকিছু থেকে গুটিয়ে কেন নিচ্ছিলে নিজেকে?এমনকি তোমার ভিতরের প্রতিবাদী রূপ টা জাগানোর জন্য আমি নিজেকে ক্ষ’ত বিক্ষ’ত করেছি। সেই রাতে তুমি কষ্ট পেয়েছো কতটুকু? তার থেকে বেশি আমি পেয়েছি। কারণ তোমার দুঃখগুলো আমারই। বিনিময়ে শুধু একটু স্ট্রং শ্রেয়সী চেয়েছিলাম। যে আমি না থাকলেও কখনও ভেঙে পড়বে না। ওই রাতে এতকিছু বলার একটাই মানে ছিল তুমি আমাকে যোগ্য জবাব দিবে। তোমার মা’য়ের উদাহরণ দিয়েছিলাম কারণ তুমি যেন ওনার মতোই মনের দিক থেকে শক্ত থাকতে পারো। আড়ালে ভালোবাসার যন্ত্রণা টা খুবই ভয়ং’কর। তাও সহ্য করেছি কেবল বলবে বলে আমাকে বউয়ের অধিকার দিন। কিন্তু তুমি নিজের অবলা রূপটা তেই সীমাবদ্ধ থাকলে। তুমিই জিতে গেলে৷ হে’রে গেলাম আমি। যদি পারতাম তবে নিউজপেপারে ছাপাতাম বউকে স্ট্রং করতে গিয়ে স্বামী নিজেই দুর্বল হয়ে গেল। একেই বলে সঙ্গ দো’ষে স্বভাব নষ্ট। ‘

শ্রেয়া স্তব্ধ, নির্বাক। তূর্য এত ভেবেছে ওর জন্য? আসলেই কেন পারে না ও নিজের অধিকার নিতে?এভাবে কি জীবন চলে?তূর্য যদি স্টেপ না নিত তাহলে আজ সে না, অহমিকাই তার জীবনে অর্ধাঙ্গিনী হয়ে থাকত। তূর্যর এত এত হেয়ালিপনাতে ভালোবাসা ছিল,ফুলশয্যার রাতে বলা একেকটা বাক্যতে ছিল ওকে স্ট্রং দেখার চাওয়া,প্রবণতা। তাহলে ইঁদুরের কামড়?শ্রেয়ার মন বললো,সেটা একটা চরম মিথ্যে ছিল লেকচারার সাহেবই দিয়েছিলেন। লজ্জায় তূর্যর বুকে ঢলে পড়লো ও। তূর্য পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। শ্রেয়া চুপটি করে বুকে মুখ গুঁজে রাখে। একমাত্র ওর ভিতরকার সত্তা জানে এ বুকে মুখ লুকাতে কতটা লজ্জা বিসর্জন দিয়েছে ও,এতে যদি ভালোবাসার মানুষ টা অল্পপরিমাণ শান্তি পায়।

তূর্যর অধর কোণে সুপ্ত হাসি। কন্ঠে ফিচলেমি,
‘ এখন কেন অধিকার খাটাচ্ছো?’
শ্রেয়ার নিঃসংকোচ উত্তর অত্যন্ত মৃদুস্বরে- ‘ কারণ স্যার আমাকে অধিকার খাটানো শিখিয়েছেন। ‘
তূর্যর গলায় রাগের আভাস। কিছুটা রেগেমেগেই আওড়ায়,
‘ ছাত্রীকে বুকে নেই না আমি। বউকে নেই। সরো আমার বুক থেকে।’
শ্রেয়া সরলো না,নড়লো না সামান্য পরিমাণ। চন্দ্র রোশনাই বিলীন করছে। অমানিশায় ডুবে থাকা বারান্দায় আসছে একটু আধটু আলো। কানে আসছে তূর্যর শা’সন মিশ্রিত কন্ঠস্বর,
‘ স্যার ডাকবে না আর। ‘

আয়ুশ ও প্রিয়ু বারান্দায় এসেছিল রাতের বাতাস উপভোগ করতে। কিন্তু চাঁদের আলোতে তূর্য শ্রেয়াকে দেখে ঝটপট রুমে ফিরে আসলো। প্রিয়ু অবশ্য উঁকি ঝুঁকি দিয়ে নিজেদের বারান্দা থেকে চুপি চুপি দেখতে চেয়েছিল কিন্তু আয়ুশের জন্য সকল চেষ্টা বিফলে। যতবার দরজার কাছে গিয়েছে আয়ুশ টেনে হিঁচড়ে ফিরিয়ে এনেছে। এখন এক আকাশ সমান আফসোস হচ্ছে প্রিয়ুর, মানুষ নাকি বারান্দা থেকে কত কপোত-কপোতীর রোমান্স দেখে অথচ ও আয়ুশের জন্য দেখতে পারলো না। লোকটা নিজে নিরামিষ, ওকেও বানাচ্ছে এমন। ক্ষেপে গিয়ে আয়ুশের বুকেই গুটিসুটি মে’রে রইল। মনে মনে বেশ তৃপ্তি পাচ্ছে ও। এটাও জানে,আয়ুশও পাচ্ছে। ভালোবাসা শেষ হলেও কখনও কখনও সম্মান রয়ে যায় এবং সেই সম্মান থেকে সৃষ্ট হয় মানুষ টার ভালো চাওয়া।

#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here