#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,৩৮,৩৯
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩৮
রাত্রির মধ্যভাগে শহরতলী তে নিঝুম নেমে এসেছে। হাওয়াও বয়ে চলেছে শব্দহীন। দিনের সবটা সময় ক্লান্তিতে কাটিয়ে সহস্র পরিশ্রমী মানুষ প্রিয়র তালিকায় যোগ করেছে এই নিসাড়া নিশীথিনী কে। চোখের পাতায় আঁধার নেমে এলে কায়ার অবসাদের পরিসমাপ্তি হয়ত ঘটে। শ্রেয়া তূর্যর বুক থেকে সরে আসার জন্য নড়চড় শুরু করলো। বক্ষস্থল হতে কোমল দেহ আলগা হচ্ছে ধীরে ধীরে তা মস্তিষ্ক ধারণ করতেই তূর্য পিঠের উপর চাপ ঈষৎ কঠিন করে। শ্রেয়ার কেশগুচ্ছের মধ্যবর্তী স্থানে ওষ্ঠাধর ডুবিয়ে রাখে কিয়ৎপরিমাণ সময়। হয়ত সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিটের কোঠায় আঁটকে যায় সময়টা। দুই অধর কিঞ্চিৎ ফাঁক হয় তূর্যর। শ্রেয়ার মুখশ্রী তুলে চিবুকে আঙ্গুল রাখে। নেত্রে ভাসে রক্তাভ চেহারা,নিমীলিত আঁখিপল্লব। চিবুক হতে মন্থর গতিতে বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁই ছুঁই করে স্পর্শ করে ফেলে চিকন,সরু গোলাপি ঠোঁট।
শ্রেয়া সামলে ওঠতে পারে না। কি ভয়ংকর অনুভূতি! কতটা গভীর স্পর্শ খানি। আস্তে আস্তে বেড়ে যায় অধর যুগলের কম্পন৷ তূর্য হাসে, আওয়াজ বিহীন প্রাণবন্ত হাসি। দুর্বল চিত্তের মেয়েটা কেমন অশান্ত হয়ে পড়ছে। তার এতটুকুন গাঢ় ছোঁয়া সইতে হিমশিম খাচ্ছে, লজ্জা পাচ্ছে। কাঁপুনির মাত্রা দীর্ঘ না করে আঙুল সরিয়ে আনে ঝটপট। তৎপরে প্রশ্ন করলো,
‘ কি হয়েছে? সরে যাচ্ছো কেন?’
শ্রেয়া চোখ উঁচিয়ে দৃষ্টি মেললো। চাহনিতে মাদকতা ও একরাশ লজ্জার সংমিশ্রণ। দ্বিধান্বিত কন্ঠে বললো,
‘ কখন থেকে এভাবে বসে আছেন। আপনার পা ব্যাথা করছে হয়ত। চলুন রুমে যাই। ‘
‘ পা ব্যাথা করছে না তবে একটা কথা মনে পড়ে গেল। ‘
‘ কি কথা?’
‘ পরশু যে পরীক্ষা এটা মাথায় আছে?অনেকক্ষণ তো বুকে ঘাপটি মে’রে ছিলে এখন মুখ ধুয়ে একটু পড়তে বসো। ‘
‘ আমি আগেই পড়া শেষ করে রেখেছি। পরীক্ষার আগের রাতে একটু দেখলেই হবে। ‘
‘ তাহলে আরকি। তোমার জামাইয়ের বুক তোমার জন্য ফ্রি। ‘
শ্রেয়া ছাত্রী হিসেবে বেশ মেধাবী। ডিপার্টমেন্টের কোন স্টুডেন্ট টা কেমন শিক্ষক হওয়ার সুবাদে অজানা নয় তূর্যর। শ্রেয়া মিহি স্বরে বলে,
‘ রুমেই যাবো। ‘
সাথে সাথেই তূর্য শ্রবণগ্রন্থির নিকটস্থে বলে ওঠে,
‘ রুমে যাওয়ার এত উতলা? ব্যাপার কি?’
সমগ্র অঙ্গ শিরশির করে উঠলো ওর। ফের প্রয়াস চালালো তূর্যর বাঁধন মুক্ত হওয়ার। ও সত্যিই ভেবেছিল এতক্ষণ এভাবে বসে থেকে বোধ হয় পা ব্যথা হয়ে গিয়েছে তূর্যর। অথচ লোক টা ওকে নিমজ্জিত করছে লজ্জায়। এই ত্যাড়া বাঁকা কথাগুলোই তো ভালো লাগে ওর৷
মানুষ মানুষের সৌন্দর্যের,কথার,ব্যাক্তিত্বের,অঙ্গভঙ্গির,চালচলন কতকিছুর প্রেমে পড়ে। শ্রেয়া না দেখেই প্রেমে পড়ে যায়। আর দেখার পর তূর্যর কথাগুলোও ওর অনুভূতিদের আরও গাঢ় করেছে।
সুপুষ্ট দু হাত সরিয়ে আনলো তূর্য। ছেড়ে দিল দেহ খানা। শ্রেয়া চট করে ওঠে দাঁড়ায়। শাড়ির অবস্থা প্রচন্ড এলোমেলো, অগোছালো। ব্যস্ত হাতে ঠিক করার চেষ্টা করছে সে। তূর্য কতক্ষণ চেয়ে থেকে নিচের ঠোঁটে উপরের ঠোঁট চেপে ধরে। হাত বাড়িয়ে প্রথমে বিধস্ত কুঁচি গুলো ঠিক করে। প্রশ্ন করে গম্ভীর কন্ঠে,
‘ শাড়ি পড়েই ঘুমাবে?’
শ্রেয়া অস্পষ্ট রশ্মিতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝায়। তূর্যও আর কথা বাড়ালো না। ওর হাত টা ধরে এতক্ষণ ধরে নির্জন থাকা কক্ষে আসে।
দু’জনের দেহ এলিয়ে পড়ে বিছানার দু প্রান্তে। মাঝে অনেকখানি ব্যবধান। শ্রেয়ার পা’য়ের তলা জ্বলছে। ভিতরটা উসখুস করছে। এই তো কাছে এলো দু’জন তবে দু’টো দেহ কেন অদূরে? যখনই কোনো বিষয়ে অস্থিরতা কাজ করে এ হাল হয় ওর। ক্রমাগত জ্বলতে থাকে পায়ের তলা। আস্তেধীরে ও হাত রাখে নিজেদের মাঝের খালি জায়গাটা তে। নিমিষেই ওর হাত টা কারো করপুটে বাঁধা পড়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই সমস্ত তফাত গুচিয়ে তূর্য বকুলে সজ্জিত হাত টাও পাঁচ আঙুলে বেঁধে নেয়। হাতের এলোমেলো বিচরণে নরম বকুল ঝরে পড়ে সুতো ছিঁড়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে মেঝেতে। আবছা আলোতে মিলেমিশে একাকার হতে থাকে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস।
শ্রেয়ার গলা শুষ্ক হয়ে ওঠেছে। বুক ধরফর করছে। হৃদযন্ত্রণের গতি অত্যন্ত বেসামাল। ভয়া’বহ রূপ ধারণ করেছে যেন একেকটা স্পন্দন। কিঞ্চিৎ দূরত্ব রাখে নি তূর্য। ওর কাছাকাছি এসে গলায় মুখ ছুঁইয়ে দেয়। কন্ঠস্বর অতীব নেশাক্ত, প্রগাঢ়। এক নিঃসংকোচ,মায়াময় আবেদন করে বসে,
‘ শ্রেয়সী,আমার হবে?’
নেত্রদ্বয় বুঁজে আসে ওর। চক্ষু কার্নিশ ছুঁইয়ে নেমে যায় জল। এত হৃদয় নিংড়ানো কেন বাক্যটা!কি করে জবাব দিবে ও?
তূর্য এক হাত ছেড়ে দিয়ে শ্রেয়ার উন্মুক্ত কোমরে রাখলো। গালে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে বললো- ‘ মুখে জবাব দিতে হবে না। সম্মতি হিসেবে অন্যভাবে বুঝিয়ে দাও। অপেক্ষা টা দীর্ঘ করো না আর। এটার যে অনেক যন্ত্রণা শ্রেয়সী। ‘
এই আকুল কন্ঠ আর শুনতে চায় না শ্রেয়া। কাঁপা কাঁপা অধর যুগল তূর্যর গালে রাখলো। তাদের স্থায়িত্ব হলো সেকেন্ড খানেক। সরিয়ে আনলো তড়িৎ বেগে। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে খেলে গেল তরঙ্গ এবং শাড়ির ভাঁজে প্রিয় মানুষটার হাতের ঈষৎ বিচরণ। জানালার ধার ছুঁয়ে আসা চাঁদের রূপে শ্রেয়ার চক্ষে পড়ে তূর্যর ওর মুখশ্রী পানে রাখা অনিমেষ, অপলক দৃষ্টি, নেত্র।
_____________
তড়িঘড়ি করে মাথায় ওড়না চাপিয়ে নিল শ্রেয়া। প্রিয়ু এখনও হাতে ঘড়ি পড়ছে। শ্রেয়া বিরক্ত ভঙ্গিতে আওড়ায়–‘ পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে তুই ঘড়ির বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে। এটা কি রিকশায় বসে বাঁধতে পারবি না?’
প্রিয়ু তবুও নাছোড়বান্দা। দাঁড়িয়ে একটা মিনিট নষ্ট করেই ঘড়িটা পড়লো। এসব পড়া,পরীক্ষা ভালো লাগে না ওর। আয়ুশ যদি মুখে একটা বার,স্রেফ একবার উচ্চারণ করে ‘ তোমার আর পড়তে হবে না’ তাহলে ও আয়ুশকে গুণে গুণে একশ একটা চুমু খাবে। কিন্তু এটা কখনও হবার নয়,সেটা সে দিব্যি জানে। মুখ কালো করে শ্রেয়ার সাথে বেরিয়ে পড়লো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় সাথে সাথেই রিকশা মিলে। প্রিয়ু ঘুম ঘুম চোখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
‘ ভাইয়া চলে গিয়েছে? ‘
‘ হ্যাঁ। ওনার ডিউটি আছে পরীক্ষার হলে,তাই একটু আগেই বেরিয়ে গিয়েছেন। ‘
‘ ওহ। ‘
‘ তুই কি ওনার উপর রাগ?’
প্রিয়ু চোখ বড়সড় করে ব্যগ্র গলায় বলে ওঠে,
‘ আরে না। আসলে ভাইয়ার কারণে রাতে বেশিক্ষণ পড়তে হলো আমাদের তাই এখন ঘুম পাচ্ছে। তোর পাচ্ছে না?’
শ্রেয়া ক্ষীণ হেসে জানায়,
‘ না। দেখিস ঘুমাতে ঘুমাতে রিকশা থেকে পড়ে যাস না। ‘
প্রিয়ুর সহজ সরল স্বগোক্তি- ‘ আমার শ্রেয়ু থাকতে কখনও পড়বো না। ‘
শ্রেয়ার কন্ঠনালি গলিয়ে কথা বেরিয়ে আসলো না। সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছাড়লো ও। এত বিশ্বাসের পিঠে কিছু বলাও যায় না। বলতে গেলে উপযুক্ত শব্দ নেই।
দু বান্ধবী মিলে দৌড়ে পরীক্ষার হলরুম পর্যন্ত আসে। ইতোমধ্যে স্যার ঢুকে গিয়েছে। শ্রেয়া ভালো করে তাকাতেই দেখে আজ ওদের হলে তূর্য পড়েছে। ওকে দেখেই ঢোকার আদেশ দেয় তূর্য। তাড়াতাড়ি করে প্রবেশ করে দু’জনে।
তূর্য শ্রেয়ার সামনে খাতা রেখে চলে গেল। আঁড়চোখে একটু চেয়ে খাতায় নাম লিখতে মনোনিবেশ করে শ্রেয়া। কি মনে করে অজান্তেই পুনর্বার তূর্যর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অন্তস্থল,মন দ্রিমদ্রিম করে উঠলো। নয়ন জোড়া আটকা পড়ে তূর্যর ঘাড়ের লম্বা দাগ টার দিক। আঁচড় টা অত্যধিক তাজা দেখাচ্ছে। ফাঁকা ঢোক গিলল ও। একদিন আগের আচঁড় টা এখনও আছে। এত গভীর ভাবে দিয়েছিল?কই তূর্য তো কোনো প্রতিক্রিয়া করে নি। শরমে চোখ মুখ কুঁচকে আসছে বারংবার।
তূর্য শ্রেয়ার মুখোভঙ্গি দেখে ঝাঁঝালো দৃষ্টিতে তাকালো। খাতায় নাম টাম না লিখে মেয়েটা এমন করছে কেন,বুঝতে পারছে না সে। ঘন্টা পড়লে প্রশ্ন দেওয়ার বাহানায় কাছে এসে দাঁতে দাঁত, ঢিমে স্বরে জিজ্ঞেস করলো,’ কি হয়েছে?’
তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে শ্রেয়া। অপ্রস্তুত ভাব। প্রশ্ন টা হাতে নিয়ে অপরদিকে চেয়ে দেখে অন্য একজন স্যার প্রশ্ন দিচ্ছেন। পাশের মেয়েটাও ড্যাবড্যাব দৃষ্টে চেয়ে আছে,তাই চেয়েও কথা টা বলতে পারলো না। চুপচাপ লিখায় মনস্থির করে। কিন্তু তাও ঠিকঠাক হচ্ছে না। বার বার তূর্যর ঘাড়ে চোখ চলে যাচ্ছে। পুরো টা পরীক্ষাই দিল ও এমন করে। বার কতক তূর্য চোখ রাঙিয়েছে সকলের অগোচরে। তবুও লাভ হলো না বিশেষ। যেন ও পাহাড়া দিচ্ছিল কেউ তূর্যর ক্ষতটা দেখে নিল কিনা। পরীক্ষা শেষ হতেই প্রাণ ফিরে পেল। খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে প্রকৃতির তরফ হতে উপহার স্বরূপ পাওয়ার স্নিগ্ধ প্রশ্বাস টেনে নিল অভ্যন্তরে।
প্রিয়ুর চিন্তা হচ্ছে অনেক। পরীক্ষা তত একটা ভালো হয় নি। আয়ুশ বলেছে রেজাল্ট ভালো না হলে ওকে কম কম আদর করবে। একদিকে পড়তে দম বন্ধ হয়ে আসে,অন্যদিকে আয়ুশের অমন শর্ত। মোবাইল বের করে আয়ুশকে ফোন দিল। রিসিভ হতেই কিছুদূরে চলে যায় কথা বলতে বলতে। যে কেউ দেখলে অনায়সে বলবে,মেয়েটা নতুন নতুন প্রেমে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা,গাছের পাতা টেনে ধরা কথা বলার সময়,গাছের গায়ে নখের আঁচড় কাটা এগুলো নাকি নব্য প্রেমে পড়ার লক্ষণ এতিম খানার আপার কাছ থেকে শুনেছিল শ্রেয়া। আলতো হাসলো ও এটা ভেবে। কিন্তু সেই হাসি মিলিয়ে গেল হুট করে একটা কন্ঠস্বর কর্ণে ভারী খে’তেই। সরব করে পাশে তাকালো। তূর্য ধারা’লো দৃষ্টি তাক করে রেখেছে। পুনশ্চঃ প্রশ্ন করে,
‘ পরীক্ষা দেওয়ার সময় এমন করছিলে কেন?’
শ্রেয়া অবিন্যস্তভাবে এদিক সেদিক তাকায়। ঘাবড়ে যাওয়া কন্ঠে প্রতি উত্তর করে,’ আপনার জন্য। ‘
তূর্যর মেজাজ তুঙ্গে ওঠে আছে। খাতা নেওয়ার সময় আগ্রহের ফলে কয়েক পৃষ্ঠায় চক্ষু বুলায়। ফলস্বরূপ দু একটা ভুল বিক্রিয়া চোখে লেগে যায় তার। এসব যে শ্রেয়ার গাফিলতির ফলাফল তা বুঝতে বাকি নেই। রাগান্বিত গলায় বলে উঠলো,
‘ আমার জন্য মানে?আর এত নার্ভাস ফিল করছো কেন?ভার্সিটিতে সবাই জানে তুমি আমার ওয়াইফ। ‘
‘ কি?কীভাবে?’– শ্রেয়ার কন্ঠ বেড়ে যায় মৃদু।
‘ মোবাইল বের করে নিজের ফেসবুক আইডি চেক করো। ‘
তূর্যর কথা শুনে দ্রুত হাতে মোবাইল বের করে নিজের আইডিতে ঢুকল। মেসেঞ্জার ব্যবহার করে না ও। বিয়ের ক্যাচাল প্যাঁচালের জন্য বহুদিন অনলাইন জগতে আসা হয় না। এখন ঢুকেই ও হতভম্ব। মোবাইলে কখনই লক দেই না সে। এমনকি ফেইসবুক পাসওয়ার্ড পর্যন্ত সেভ করে রাখা। তাই কাজটা কোনো রকম ভে’জাল বিহীন সেড়েছে তূর্য। ম্যারিড স্ট্যাটাসের কমেন্ট বক্সে মানুষের শুভেচ্ছার ঢল নেমেছে।
‘ এটা কখন করেছেন আপনি?’
‘ করেছি কোনো এক সময়। এখন পরীক্ষার হলে ওইসব করার কারণ বলো। ‘
তূর্যর চাউনি প্রশ্নসূচক। শ্রেয়া আমতা আমতা করে প্রতুত্তর করে,
‘ আপনার ঘাড়ে,,’
‘ আমার ঘাড়ে?’
নরমাল একটা কথা বলতে প্রচন্ড বেগ পোহাতে হচ্ছে শ্রেয়ার। এটার কারণ সম্মুখে উপস্থিত মানুষ টাই। আনতস্বরে, এক নিঃশ্বাসে বললো,
‘ নখের আঁচড় দেখা যাচ্ছে। ‘
সঙ্গে সঙ্গে কানের ছিদ্র দিয়ে হুড়মুড় করে ঝংকার তুলে কয়েকটা বর্ণ,শব্দ, বাক্য প্রবেশ করে,
‘ তাতে তোমার কি?আমার বউয়ের আদরমাখা চিহ্ন নিয়ে আমি দেশ বিদেশ সব ঘুরে আসবো। কোনো সমস্যা? ‘
শ্রেয়ার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। বেক্কল বনে গেল। আপনাআপনি দু ওষ্ঠ আলগা হয়ে আসে। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাবে বললো,
‘ না। ‘
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩৯
শ্রেয়া ধীরস্থির ভঙ্গিতে, গুটি গুটি পায়ে ছাদের দরজা অবধি এলো। গরম গরম নিঃশ্বাস ফেলছে ও। সামনে তাকিয়ে দেখে তূর্য কানে মোবাইল ধরে রেখেছে। হয়ত কথা বলছে কারো সাথে। সূর্যের প্রখর তাপে ছোট ছোট চুল থেকে ঘাম বেয়ে ঘাড়,পিঠ স্পর্শ করছে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভিজে উঠেছে পড়নের নীল টি শার্ট। এই লোকের কি কষ্ট হচ্ছে না?ঘামে হাতের লম্বা লম্বা লোমশগুলোও হতাশায়,দুঃখে লেপ্টে আছে। এইবার শ্রেয়ার ভীষণ খারাপ লাগছে। তূর্য কেমন করে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারছে না ও।
আষাঢ় মাসে কথা ছিল বৃষ্টি রিমঝিম ছন্দ তোলার। সেই ছন্দে মানবমন উতলা হতো,নৃত্য তুলে নাচত। রোমাঞ্চকর হতো পরিবেশ, প্রকৃতি, মানুষজন। অথচ হচ্ছে তার উল্টো। পা বাড়িয়ে মন্থরগতিতে সুঠাম,সৌষ্ঠব দেহের সান্নিধ্যে নিজের শীর্ণ,চিকন গা এগিয়ে আনল শ্রেয়া। তূর্য তীররেখা নজরে একবার তাকাল ওর দিকে। পুনরায় দৃষ্টি অদূর অম্বরে নিবদ্ধ করে বললো,
‘ রাখছি ভাই। বউ দাঁড়িয়ে আছে কিছু বলার জন্য। তাকে অপেক্ষা করাতে কষ্ট হয় আমার। ‘
শ্রেয়া অতিকায় অবাক হলো। চমকপ্রদ চাউনি নিক্ষেপ করলো তূর্যর দিক। তূর্য মোবাইল টা পকেটে রেখে এক হাত বাড়িয়ে শ্রেয়ার শরীর টা নিজের মধ্যে আবদ্ধ করতে গিয়েও থেমে যায়। কপালে
তুষ্ট বলিরেখার ভাঁজ ফোটে ওঠে। শ্রেয়া রিনঝিনে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,’ কি হয়েছে?’
তূর্যর নিরলস জবাব, ‘ ঘেমে আছি,এখন জড়িয়ে ধরবো না। ‘
শ্রেয়ার কন্ঠনালি ভেদ করে কোনো কথা এলো না। একটু একটু করে অতীব নিকটস্থে যায় ও তূর্যর। ছোট্ট বাচ্চাদের ন্যায় মিশে যায় বুকে। আঁকড়ে ধরে গেঞ্জি। তূর্যর ওষ্ঠদ্বয়ে নিঃশব্দ হাসি অনেকখানি জায়গা দখল করে। শ্রেয়ার ছাদের মেঝে ছুঁয়ে থাকা ওড়না টা টেনে ওর মাথার উপর দিয়ে সমস্ত চুল,মাথা ঢেকে দিল। সর্বদা ভরাট,গম্ভীর কন্ঠস্বর টা কেমন আদুরে, নরম হয়ে উঠলো। বললো,’ রোদ আমার বউকে কালো ভূত বানাতে চাইছে। ‘
‘ আর আপনি?আপনার শরীর খারাপ লাগছে না। এখানে এসে ফোনে কথা বলতে হয়?’— নির্ভয়ে প্রশ্ন করে শ্রেয়া।
প্রশ্ন করার অনুমতি টা তূর্য-ই দিয়েছে ওকে। তবুও বেশ ভয় হয় ওর। তূর্যর বদমেজাজী, রূঢ় স্বভাব সম্পর্কে ও অবগত। অবশ্য প্রথম পরিচয় টা ফুলশয্যায় হয়েছিল যদিও মানুষ টা মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত ছিল। এবং দ্বিতীয় বার সুস্থ মস্তিষ্কে এই ছাদেই দাঁড়িয়ে কি ত্যাড়া বাঁকা ব্যবহার করে ওর সঙ্গে। তখন থেকেই তূর্যর প্রতি ওর ভীতি। শ্রেয়া ভীতি কে একপাশে রেখে তূর্যর সামনে কথা বলতে গিয়ে দোনোমোনো করার আরেকটা কারণ বের করেছে, তা হলো সম্মান। ও এই মানুষ টাকে প্রচন্ড সম্মান করে। বুকে মুখ গুঁজে চক্ষুদ্বয় বুঁজে ফেলল। অচিরেই শ্রবণ হলো গলার আওয়াজ,
‘ তোমার মতো সুন্দরী বউ ফেলে প্রেমটেম আমার দ্বারা হবে না। আমি যেদিন ছোট্ট শ্রেয়সীর মাথায় ঝুঁটি দেখেছি,বড় শ্রেয়সীর কাজলমাখা আঁখি দেখেছি সেদিনই শেষ। একদম শেষ। সেটা আমার বউও জানে ভালো করে। ‘
শ্রেয়া লাল রঙের প্রলেপে ঢাকা কপোলদ্বয় লুকোতে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো। তূর্য কর্ণ পাতায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
‘ কি করছো?এটা কিন্তু ছাদ। চলো রুমে যাই। ‘
বড্ড রসাত্মক শুনালো কন্ঠ টা। কানে ঝংকার তুলে একেকটা ধ্বনি। শ্রেয়া লজ্জায় নেতিয়ে পড়ছে। তবুও অস্পষ্ট,মিহি স্বরে প্রতিবাদ করার তীব্র প্রচেষ্টা করে,
‘ আমি তো,’
‘ তুমি তো কি?চেক করতে এসেছো ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি কিনা?’
‘ চেক করতে আসবো কেন?আপনি সিগারেট খান। স্বচক্ষে দেখলাম একদিন। ‘
বুক থেকে মুখ তুলে নির্দ্বিধায় কথা খানা ব্যক্ত করে শ্রেয়া। তূর্য ওকে ছাদের রেলিংয়ের সঙ্গে ঠেসে ধরলো। দু হাত দুই পাশে রেখে আঁটকে ফেললো ওকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ কিস করার সময় নাকে সিগারেটের গন্ধ লেগেছিল?লাগলে ওয়াক,থু থু করো নি কেন?লেগেছিল?’
শ্রেয়া কিংকর্তব্য বিমূঢ়। স্থির নেত্রে তাকিয়ে রইল। ওর ললাটে জমাট হয়ে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে যাচ্ছে কানের কাছ দিয়ে। তূর্য একটু একটু করে ঘমার্ক্ত ফোঁটাতে হাত ছুঁয়ে দিল। নিশ্চল, মায়াবী নয়ন জোড়ায় কতক্ষণ চেয়ে থেকে কপালে রাখল ওষ্ঠদ্বয়। শ্রেয়ার বক্ষস্থল থরথর করে কেঁপে উঠলো। শরীরের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সেই কম্পন। ওর মনে হচ্ছে জীবন টা এখন সুখের অনুচ্ছেদ। ভালোবাসার অভাব নেই। যেদিকে দৃষ্টি মেলে রঙিন সুতোয় যেন বাঁধা পড়ে। মাস খানেক আগেই প্রাণ টা চলছিল কোনোরকম। সবকিছু সাদা মলাটে আবৃত থাকে। অতঃপর রঙিন প্রচ্ছদের শিল্পী হিসেবে আসে তূর্য নামক গম্ভীর পুরুষ। ওষ্ঠ এখনও শ্রেয়ার ললাটে ডুবে। কিয়ৎক্ষণ পর কপাল ছেড়ে নেমে আসে তিরতির করা অধর পানে। মুখোমুখি অধর জোড়া। গলা শুকিয়ে গেল শ্রেয়ার। তূর্য কি আজও পানি সাধবে?এখানে জল কোথায় পাবে?সেদিন কি তাড়াহুড়ো করেই না গ্লাসের পানি সমাপ্ত করে ও,মনে হয়েছিল কতযুগ পানি পান করা হয় নি। ভাগ্যিস তূর্য পানি দিয়েছিল নয়ত তৃষ্ণার্ত হয়ে লজ্জার ভারে সোফায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকত।
তূর্য সরে গিয়ে বললো,’ আমি সিগারেট খাই না। একবার যে ছাদে দেখে ভেবেছিলে সেটা ছিল ভুল দেখা। নিচের ফ্ল্যাটের একটা ছেলে খেয়েছিল। অর্ধ অংশ টা ফেলে চলে যেতেই তোমার আগমন। ‘
বিস্ময়াহত চক্ষে তাকায় শ্রেয়া। আনমনে,অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করে বসে,’ সত্যি? ‘
‘ বউ কি বিশ্বাস করে না?’
তূর্যর প্রশ্নে থ মে’রে যায় ও। বিশ্বাস করে ও। অনেক বেশিই করে৷
পুনশ্চঃ লহু স্বরে বলে ওঠে তূর্য,
‘ আমার জীবনের কিছু ভুল অনেকখানি সময় নষ্ট করে দিয়েছে। সুস্থ স্বাভাবিক থেকে আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। অ্যাল-কোহল, সিগারেট এসব ক্ষণিকের ডিপ্রেশন কাটিয়ে একটা মানুষকে মিছে সুখ দিতে পারবে। কিন্তু একটা সময় পাল্টা আক্র’মণ করবে এসব। তোমার কাছাকাছি আমি যে সুস্থতা অনুভব করি সেটা কাটিয়ে আমাকে পা’গল বানানোর ক্ষমতা একমাত্র তুমিই রাখো।যদি মানুষের জীবন সীমা হাজার বছর হতো,তাহলে তোমার সাথেই হাজার বছর বাঁচার আকুতি করে যেতাম শ্রেয়সী। ‘
শ্রেয়া নিশ্চুপ। অন্তর্দেশে শীতল অনুভূতি। অতিরিক্ত দুঃখে চুপ হয়ে যায় একটা মানুষ,শ্রেয়ার তা হচ্ছে না। বরঞ্চ অত্যধিক আনন্দে নির্বাক সে। তূর্য ফের বলে,
‘ ছাদে আসলে যে?’
‘ আয়ুশ ভাইয়া এসেছে। ‘
‘ হঠাৎ? ‘
‘ প্রিয়ু নাকি অনেকদিন ধরে ওনার সাথে কথা বন্ধ করে রেখেছেন তাই। ‘
তূর্য উল্টো ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
‘ বাহ!আয়ুশ তো উন্মাদ প্রেমিক হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। চলো নিচে যাই। ‘
এক প্রকার দৌড়ে কাছাকাছি আসলো শ্রেয়া। সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। তূর্য ভ্রুঁ কুঁচকালো ঈষৎ। রাশ ভারী গলায় বললো,
‘ কি হলো?’
‘ আমরা আরও পরে যাই। ‘— কম্পনরত কন্ঠে উত্তর দেয় শ্রেয়া।
তূর্য বাঁকা হাসে। বলে,’ ওদের কি প্রাইভেসির জন্য পুরো ফ্ল্যাট লাগবে?এক রুমে হয় না?আমাদের তো এক রুমেই চলে। সারাজীবন নিরব থেকে এখন আমার থেকে ধাপে এগিয়ে গেল আয়ুশ। বউটা গাধী, বোকাসোকা নাহলে আমি অনেক ধাপ পেরিয়ে যেতাম। ‘
এ যাত্রায় আর সহ্য করতে পারলো না শ্রেয়া। এত মা’রাত্মক কথা!এদিক সেদিক তাকাতেই তূর্য কব্জি চেপে ধরে বুকে মিশিয়ে বললো,’ লুকোচুরি খেলতে হলে আমার বুকেই লুকাও। ‘
.
.
প্রিয়ু ভয়ংকর রেগে আছে। রাগের কারণ আয়ুশ সত্যিই ওকে পরীক্ষা খারাপ হওয়াতে আদর দূর ফোনও দেয় নি। পরীক্ষা শেষ হয়েছে কতদিন,ঘন্টা, সেকেন্ড পেরিয়ে গেল। পাঁচটা দিন আয়ুশ ওকে যন্ত্রণায় রেখেছে। বাড়িয়েছে ছটফটানি। পরে যখন রাগ কমলে কল দেয় প্রিয়ু পাল্টা জেদ ধরে ফোন ধরে না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে আবারও চট্টগ্রাম ছুটে এসেছে। এখনও আসার পর থেকে কথা বলছে না প্রিয়ু। এমনকি দরজা লাগিয়ে রুমের ভেতর বসে আছে। আয়ুশ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মলিন কন্ঠে বললো,
‘ আমার যন্ত্রণা হচ্ছে লেট লতিফ। বেরিয়ে আসো। রেজাল্ট খারাপ হলেও বকা দেবো না। বিশ্বাস করো, খুব ভালোবাসি তোমাকে। তোমার চেহারা না দেখলে ভিতরটা ব্যথা করে,কন্ঠ না শুনলে অশান্তি লাগে। বেরিয়ে আসো প্লিজ। ‘
চট করে দরজা টা খুলে গেল। আয়ুশ মুখশ্রী দেখার পূর্বেই ওর উপর ঝাপিয়ে পড়লো কাঙ্ক্ষিত মানুষ টা। প্রিয়ুর নিকট তার নিরামিষ স্বামী এখন বদ প্রেমিক। আয়ুশ শক্ত হাতে পেঁচিয়ে নেয় ওকে নিজের সঙ্গে। গলায় ঠোঁটের তীব্র স্পর্শ মেখে বললো,
‘আমি বার বার ছুটে আসতে রাজি কিন্তু আর একদিনও কথা না বলে থাকতে পারবো না। ছোট্ট জীবন টা অভিমানে কাটিয়ে দিলে ভালোবাসবো কখন?আই লাভ ইউ প্রিয়ু। ‘
প্রিয়ু সঙ্গে সঙ্গেই এক হাত আয়ুশের হৃদয়স্থল বরাবর রাখে। ধ্বক করে ওঠে আয়ুশের ভিতরটা। শুনতে পায় প্রিয়ুর মায়ামিশ্রিত স্বর,
‘ এই স্থানের মালিক আমিই যেন চিরকাল থাকি। ‘
________________
শ্রাবণের হাওয়ায় বিষাদের গন্ধ। মধ্য রাতে ঘুম থেকে ওঠে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে শ্রেয়া। দেখে তূর্য হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার তোরজোর চালাচ্ছে। শ্রেয়া কোনো কিছু না ভেবে বিছানা ছেড়ে ভয়ার্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,’ কোথায় যাচ্ছেন?’
তূর্য ওর হাত ধরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। বলে,’ যেমনই আছো,তেমনভাবেই চলো। ‘
মনটা কু ডাক ডাকছে শ্রেয়ার। গলা ধরে এলো,’ কেন?’
‘ প্রিয়ু গাড়িতে অপেক্ষা করছে। বাবার শরীর ভালো নেই। হার্ট অ্যা’টাক করেছেন। ‘
ভূ-তল কেঁপে উঠলো শ্রেয়ার। সেদিনই না ওর সন্ধি হলো বুড়ো মানুষ টার হৃদয়ের সঙ্গে? সুন্দর একটা বাবা- মেয়ের সম্পর্কও সৃষ্ট হয়েছিল। এভাবেই কি সুন্দর মুহুর্ত গুলো জলদি জলদি ফুরিয়ে যায়?
#চলবে,,,!