#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,৪০,৪১
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪০
প্রকৃতি যখন দ্যুতির ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল তখনই হসপিটালের করিডোরে এসে পৌঁছায় তূর্য, শ্রেয়া,প্রিয়ু। মেহরিমা চৌধুরী থ মে’রে বসে আছেন। পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছেন ত্রিহা। শ্রেয়া জড়তা,শঙ্কা নিয়ে ওনার কাছে এগিয়ে আসল। তূর্য গিয়েছে ডাক্তারের কাছে।
অসহায় চোখে শাশুড়ির অশ্রু বিসর্জন দেওয়া দেখছে শ্রেয়া। খারাপ লাগছে ওর। ও কেন আরেকটু হালকা করতে পারলো না নুরুল চৌধুরীর বুকে চেপে থাকা কষ্টের ভার?এই ওজন সইতে না পেরেই যেন আজ এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কখনও তিনি মুখ খুলে ছোট বাচ্চাদের মতোন আবদার করতে পারলেন না আমার ছেলেদের আগের ন্যায় ফেরত চাই। কিন্তু শ্রেয়া ঠিকই উপলব্ধি করেছে ওনার কথাগুলো কতটা আর্তনাদ মিশেছিল। ত্রিহা ওকে দেখে নিজের জায়গা ছেড়ে, ইশারা করলো বসার জন্য। মাথা নাড়িয়ে না জানালো সে। ত্রিহা শুনলো না। হাত ধরে বসিয়ে দিল। তাঁর মতে মানুষের বিপদ কালে পাশে দাঁড়ালে প্রিয় হয়ে উঠা যায়। প্রিয় না হলেও কমপক্ষে মনে কৃতজ্ঞতার একটা স্থান সৃষ্ট করা যায়। শ্রেয়া কিছু সময় পার করে মিনমিনে কন্ঠে বললো,
‘ আম্মা। কাঁদবেন না। বাবা সুস্থ হয়ে যাবেন। ‘
মেহরিমা ঘাড় বাঁকিয়ে চাইলেন। চোখ মুখে বিধস্ত ভাব। কোনো কথা বলতে মন চাইছে না ওনার। তবুও কাতরস্বরে বলে উঠলেন,
‘তূর্য কে বলো তোহাশ কে কল দিতে। দরকার হলে আমি সেই বাড়ি ছেড়ে দেবো। আমার স্বামীর প্রথম ভালোবাসার চিহ্ন মুছে যাক তা আমি চাই না। যে ভালোবাসা হারায় সেই বুঝে,তার স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরে রাখতে না পারার যন্ত্রণা টা ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। আমার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে উনি ছেলের সাথে এত বছর যোগাযোগ করলেন না। আসলেই সৎ সৎ-ই হয়। যতই একদম বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলো না কেন কখনও সৎ তকমা মুছে যাবে না। আপন মা হাজার বার মা’রলেও তাতে সমাজের বা ছেলে মেয়ের কিছু আসে যায় না,সেক্ষেত্রে এটা শাসন। সৎ মা যদি একটু উচ্চ আওয়াজও করে তাহলে ধরেই নেয় মানুষ সতীনের সন্তান সহ্য করতে পারে না। সব সৎ মা আবার ভালো হয় না। কেউ কেউ হয়। আমি হয়ত সেই কেউ এর তালিকায় যুক্ত হতে পারি নি। আরিয়ানার যত কাছে যেতে চেয়েছি আমাকে সৎ শাশুড়ি ভেবে ততটাই অবহেলা, দোষ দিয়েছে। তোমার আপন শাশুড়ি হয়েও ভালো হতে পারলাম না। খারাপই চাইলাম তোমার। তার মানে আমি সত্যিই খারাপ। ভালো স্ত্রী, ভালো মা, ভালো শাশুড়ি কিছুই হতে পারি নি। এতটাই নিচু মনের হয়ে গিয়েছিলাম যে এতিম মেয়েটাকেও আঘা’ত করেছি। এটারই শাস্তি দিচ্ছেন আমাকে আল্লাহ। ‘
শ্রেয়ার বাক শক্তি হারিয়ে ফেলল খানিক সময়ের জন্য। নিস্তব্ধ,অটল চাহনি মেহরিমার দিক। একটা মানুষ কি করে পারে দোষ না করেও নিজের উপর নিয়ে নিতে সবটা?মা হয়ত এমনই হয়। কোনো নিষ্ঠুরতা,স্বার্থপরতা নেই। আছে কেবল মায়া। আচ্ছা তোহাশ কি যোজন দূরে থেকে কখনও অনুভব করেছে সে কতটা জঘ’ন্য ব্যবহার করেছিল মা’য়ের সঙ্গে? কতটা ক্ষত বিক্ষত করেছে মা- বাবার মন?আরিয়ানা কি আঁচ করতে পেরেছে নিজের ভুল নাকি সবকিছুই তার ইচ্ছেকৃত ছিল?বুক ফেটে কান্না আসার উপক্রম শ্রেয়ার। কন্ঠনালি কাঁপছে। নিজেকে সামলে ধাতস্থ হলো।
‘ আপনি কোনো দো’ষ করেন নি। বরং তোহাশ ভাইয়া নিজের কারণেই মা’য়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি ছোট নাহলে আমার মা’কে আগলে রাখতাম,তাহলে বাবা মা’রতে পারতেন না। যে বাবা মা হারায় তারাই মূল্য বুঝে। এ পৃথিবীতে বাবা মা’র মতো নিঃস্বার্থ ভাবে কেউ ভালোবাসে না। অন্য কেউ ভালোবাসলেও সেটা মানুষ ভাগ্য ভালো বলে পায়। ‘
শ্রেয়ার নরম,আফসোসের স্বর কর্ণপাত হওয়া মাত্র মেহরিমা অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হয়ে পড়লেন। কিছু বলতে পারলেন না তিনি। তূর্য ডাক্তারের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতেই ওঠে দাঁড়ালেন।
শ্রেয়ার দিকে এক নজর চেয়ে মেহরিমা চৌধুরীর দিকে তাকালো তূর্য। ক্লান্ত মেশানো গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ ভাই আসছে। গতকাল ফ্লাইটে ওঠার আগে আমাকে ফোন দিয়েছিল। পরিবার সমেতই আসছে। এখন তাকে চৌধুরী বাড়িতে কিভাবে আনবে সেটা তোমরা ভালো জানো। ‘
মেহরিমা চমকে উঠলেন। বললেন,’ হাসপাতালে আসবে?’
তূর্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,’ আমি না করেছি। বর্তমানে মিসেস আরিয়ানার চাচার বাড়িতে আছেন। আমি চাই না হাসপাতালে কোনো সিন ক্রিয়েট হোক। বাবার অবস্থা এখন কিছু টা ভালো। যা করার,বলার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। ‘
.
.
একদিন পর কিছুটা সুস্থ হয় নুরুল চৌধুরী। ওইদিকে ছেলের অবস্থা দেখে ফাতেমা চৌধুরীও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তূর্যর উপর ভরসা রেখে মেহরিমা বাড়িতে চলে গিয়েছেন। শ্রেয়া,প্রিয়ু,আয়ুশ হসপিটালেই রয়ে গেল। করিডোরে পাতানো বেঞ্চিতে বসে ঘুমে আয়ুশের কাঁধে ঢলে পড়েছে প্রিয়ু। অপরদিকে শ্রেয়া বসে বসে ভাবছে কিভাবে এত এত মনোমালিন্যের দেয়াল ভেঙে এক হবে পুরো পরিবার। একই ছাদের নিচে কত মানুষ বাস করে অথচ সবার মনের মিলন থাকে না। বিচ্ছেদ সহজ, সন্ধি কঠিন। খুবই কঠিন।
একজন নার্স এসে জানালো তূর্যকে ডাকছেন নুরুল চৌধুরী, সাথে শ্রেয়াকেও। তূর্যর পিছন পিছন শ্রেয়া কেবিনে ঢুকে পড়ে। ওদের দেখে অচিরেই রোগা চেহারাটা হাসোজ্জল হয়ে ওঠে নুরুল চৌধুরীর। দুর্বল কন্ঠে হাঁক ছাড়লেন,’ কাছে আয় তোরা। ‘
তূর্য চেয়ার টেনে বাবার কাছাকাছি বসলো। শ্রেয়া একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। নুরুল চৌধুরী আবারও মুখ খুললেন। বললেন,’ বাবার কাছে এসে বস। ‘
তূর্যর দিকে এক পলক তাকিয়ে তার পাশের টুলে বসলো শ্রেয়া। ওদের দু’জনের দিকে চেয়ে দুই অধর প্রসারিত করলেন তিনি।
‘ জিতেই গেলেন। নিজের অভিমান ভেঙে ছেলেকে ডাকলেন না,কিন্তু সেই অভিমানের ভারে দুনিয়া ছাড়তে রাজি আছেন। ‘
তাচ্ছিল্যমাখা কন্ঠে একেকটা বাক্য উচ্চারণ করলো তূর্য। শ্রেয়া আঁতকে উঠলো। একটা অসুস্থ মানুষকে এভাবে বলা ঠিক? কিন্তু নুরুল চৌধুরীর হাসি দেখে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল ও। তিনি খোশমেজাজে ওকে লক্ষ্য করে বললো,
‘ এই কথাগুলোতে কি আছে জানিস মা?কষ্ট, অভিমান, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়,ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান। তোর স্বামী আমাকে এত ভালোবাসে কিন্তু প্রকাশ করে না। ওর কি বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে লজ্জা লাগে?’
শ্রেয়া সাহসের কাজ করে বসলো। তৎক্ষনাৎ বলে ফেলল,’ হয়ত। ‘
নিমিষেই তূর্য রোষপূর্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো ওর উপর। দৃষ্টিতে দমে গেল ও। নুরুল চৌধুরী মৃদু ধ’মকে বললেন,
‘ ওকে চোখ রাঙালে কেন?আমার সহজ সরল মেয়েটাকে একদম ভয় দেখাবে না। যা সত্য তা-ই বলেছে ও। শুনলাম তোমার ভাই এসেছে? সম্পত্তির ভাগ নিতে?’
‘ না। অফিসের কাজে এসেছে। চলে যাবে আবার৷ ‘
‘ ওকে চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে এসো। সম্পত্তির ভাগ করবো। ওর বউকেও আসতে বলো। তাকে দেখাতে চাই ওর মতো এতিম আরও একটা মেয়ে আমার বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। সারাক্ষণ ভাবে কিভাবে সবার মন জয় করবে,ওর মতো ভাঙ্গার চেষ্টা করে নি।’
____________
সকাল থেকে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন চৌধুরী বাড়িতে। শ্রেয়া ও প্রিয়ু ব্যস্ত হাতে রান্নাঘর সামলাচ্ছে ত্রিহার সঙ্গে। মেহরিমা ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন নিজেকে। বসার ঘর থেকে রহিমা বড় বড় পা ফেলে রান্নাঘরের দুয়ারে উপস্থিত হলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
‘ নতুন বধূ,ত্রিহা,প্রিয়ু আইয়া পড়ছে। তূর্য বাবা লইয়া আইছে ওরা রে। জলদি আইয়ো। ‘
রান্না প্রায় শেষের দিকে। ত্রিহা আদুরে ভঙ্গিতে প্রিয়ুর উদ্দেশ্যে বললো,’ তোমরা যাও। আমি আসছি। ‘
সকাল থেকে প্রিয়ু,শ্রেয়া উভয়েই খুব উত্তেজিত তোহাশ ও আরিয়ানাকে দেখার জন্য। দু’জনেই হাত ধুয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। এসেই পা জোড়া থমকে গেল। অত্যন্ত সুন্দর গড়নের একটা মেয়ে কোলে বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে থ্রি পিস। বাচ্চা টার বয়স বড়জোর এক কি দেড় বছর হবে। মেয়েটার পাশেই একজন সুঠাম দেহী পুরুষ দাঁড়িয়ে। শ্রেয়া হতবাক। কে বলবে এরা একই মায়ের পেটের না। তূর্য ও তোহাশের চেহারায় অনেকটাই মিল। ছোট ছোট পায়ে আরেকটু এগিয়ে আসে ও। ওর পিছন থেকে লাঠি ভর দিয়ে ফাতেমা চৌধুরী সামনে আসেন। তোহাশের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে সোফায় বসে পড়লেন। বলে উঠলেন,
‘ আরে মেহমানেরা দাঁড়ায় আছেন ক্যান?কত বছর পর আসলেন, বসেন বসেন। তূর্য বাবু ওদের বসতে বলবা না তুমি?’
প্রিয়ু মুখ টিপে হাসছে। তূর্য ধপ করে ফাতেমার পাশে বসে পড়লো। ফিসফিস করে বললো,
‘ ফাতু বাবু কেন ডাকো?দু’দিন পর বাবুর বাপ হবো। ‘
চারিধারে দৃষ্টি বুলাচ্ছে তোহাশ। দাদির খোঁচা মা’রা ও ঠিকি বুঝতে পেরেছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে সবার সামনে। কেউই এগিয়ে এসে কথা বলছে না। না বলাটাই স্বাভাবিক। শ্রেয়া সামনের মানুষ টার মনের হাল বুঝে নম্র কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ কেমন আছেন ভাইয়া?’
আরিয়ানা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। তোহাশ মুখে হাসি টেনে উত্তর দেয়, ‘ ভালো। তুমি তূর্যর বউ,রাইট?’
‘ হুম আমার শান্তশিষ্ট, প্যাঁচ বিহীন ভালো মনের বউ। ‘— সোফায় বসে আয়েশি ভঙ্গিতে বলে তূর্য।
#চলবে,,!
( ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪১
নুরুল চৌধুরী কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন। অবস্থা তেমন ভালো না ওনার। বুকের ব্যথা প্রায়শই অসহনীয় হয়ে ওঠে। আয়ুশের সাহায্যে ড্রইং রুমে আসলেন তিনি,তোহাশ আসার খবর পেয়ে। বসার ঘরে পা রাখতেই দীর্ঘ দিনের পুরোনো চশমা টা অস্পষ্ট, ঝাপসা হয়ে আসে। অন্তর্দেশ টায় দমকা সমীরণ বয়ে যায়। সাথে জমানো অভিমানের পাল্লাটা আরও অনেকখানি ভারী হয়ে উঠলো। চেহারায় গম্ভীরভাব ধরে রেখে মাঝ বরাবর এসে দাঁড়ান।
বাবাকে দেখে বাচ্চাদের মতোন ছুটে আসলো তোহাশ। দু হাতে ঝাপটে জড়িয়ে ধরতে চায়,কিন্তু পারে না৷ তার আগেই হাত তুলে বাঁধা দিলেন নুরুল চৌধুরী। গমগমে সুরে বলে উঠলেন,’ বসো। ‘
সোফায় বসে তোহাশ কে বসার জন্য বললেন পুনশ্চঃ। অসহায়, দুর্বল নেত্রে তাকিয়ে তোহাশ তূর্যর পাশে বসলো। টলমলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বাবার দিকে। কখনও তাকে ‘ তুমি ‘ বলে সম্বোধন করেন নি নুরুল চৌধুরী। বাবা ছেলের সম্পর্কটা ছিল একেবারে বন্ধুর ন্যায়। সেই বাবা আজ ওর দিকে তাকাচ্ছে না,ঠিক করে কথা বলছে না। কতগুলো বছর কেটে গেল অনুতপ্ততায়,অনুশোচনায়। হ্যাঁ প্রতিনিয়ত জ্বলছে ওর ভিতরটা। কতশত অভিযোগ নিজের প্রতি জমে আছে হৃদয় কুঠুরিতে। বিলাসিতার প্রাচুর্যে,মায়া মমতায় ভরপুর এই চৌধুরী বাড়ির আঙিনা পার হয়ে একটা মুহুর্তও স্বস্তি মিলে নি তার। নিজের অপরাধের শাস্তি থেকেও রেহাই পায় নি সে। কঠিন শাস্তি ভোগ করেছে, মা’কে অপমান করার ফলস্বরূপ। নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,
‘ বাবা,কেমন আছো?মা’কে দেখতে পাচ্ছি না যে?’
মুহুর্তেই সকলের কর্ণে কর্ণে প্রতিধ্বনিত হয় তাচ্ছিল্য কন্ঠস্বর,
‘ তোমার মা আছে?সে তো তোমাকে জন্ম দেওয়ার সময়েই এ দুনিয়া ছেড়েছে। হয়ত বুঝে গিয়েছিল মা’কে সম্মান করতে অক্ষম তুমি। কুলাঙ্গার সন্তান। ‘
স্তব্ধ পরিবেশ। ফাতেমা চৌধুরী বাঁকা হাসলেন। নিশ্চুপে,লুকিয়ে,নিঃশব্দে। মনে মনে বেশ আনন্দ পেয়েছেন। তূর্যর নজর সাদা,ফকফকা মেঝেতে। তোহাশের কন্ঠনালি ভেদ করে এলো,’ তুমি ঠিক বলেছো বাবা। ‘
তৎক্ষণাৎ আরিয়ানার চোখের কার্নিশ ছুঁইয়ে এক ফোঁটা জল গড়ালো। স্বামীর দুঃখের পরিমাণ নিতে পারে না ও। নিমীলিত চক্ষু পত্রে টুপ টুপ অশ্রু পড়তেই অত্যধিক জোরে চিল্লাতে শুরু করে তিতিসা। ওর চিৎকারের শব্দে শ্রেয়া অস্থির হয়ে ওঠে। ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন করে,
‘ আপু ও কাঁদছে কেন?’
আরিয়ানা জবাব না দিয়ে তিতিসাকে থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শ্রেয়ার নিশ্চল দৃষ্টি ছোট্ট তিতিসার পানে। ঠোঁট ভেঙে কান্না করছে মেয়েটা। ওষ্ঠাধর কেমন লালচে রঙের। হাত মুঠো করে রেখেছে। কান্নার তালে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এতটুকুন মেয়ের রাগ, জেদ। শ্রেয়ার অভ্যন্তরে শীতল শীতল ভাব। বাচ্চারা অদ্ভুত মায়ায় মাখে মানুষকে। পাষাণ হৃদয়ও গলে মোম হয়ে যায় তাদের সান্নিধ্যে।
তূর্যর ডাকে ভাবনা ছিঁড়ে ফিরে তাকায় ও। আদেশের স্বরে বলে তূর্য, ‘ মিসেস আরিয়ানাকে রুমে নিয়ে যাও। তিতিসার এখানে ভালো লাগছে না হয়ত। ‘
আরিয়ানা না চাইতেও শ্রেয়ার সঙ্গে ড্রইং রুম ছাড়তে হলো। ওদের গমনের পথে তাকিয়ে তূর্য কন্ঠে গাম্ভীর্য রেখে বললো,’ আপনার সিদ্ধান্ত টা ভাইকে জানিয়ে দিন বাবা৷ ‘
তোহাশের কন্ঠে চমক,’ কিসের সিদ্ধান্ত?’
দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস মুক্ত করলেন নুরুল চৌধুরী। বললেন,’ তুমি এই বাড়িতেই থেকো। সন্ধ্যার পর উকিল আসবে৷ সম্পত্তির বন্টন হবে। আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার ও তোমার বউয়ের কথামতো আমরা তোমাদের প্রাপ্য সম্মানই দিব। এই বাড়িতে তোমার অধিকার আছে,নিজের পাওনা কেন ছাড়বে?সেই যে বলে গেলে তোমার হক তূর্য মে’রে দিবে,আজ পর্যন্ত আমার ছেলে তোমার ভাগের এক রত্তিও ভোগ করে নি। বুকে পাথর চেপে ভালোবেসে,সম্মান দেখিয়ে তোমার সাথে যোগাযোগ রেখেছে। ওর মা খারাপ না সেটা প্রমাণ করেছে। যদি খারাপ হতো তাহলে নিশ্চয়ই তোমার বিরুদ্ধে ফুসলিয়ে বড় করত ওকে। ছোট থেকেই এটাই শিখাত তোমাকে দূরে রাখলে সব সম্পত্তি পাবে। এমন কিছু কি করেছে? করে নি। ওর মায়ের দেওয়া ভালো শিক্ষায় ভুল অভিযোগের ফলেও সে তোমাকে সম্মানের সাথে এ বাড়িতে এনেছে। বড় হলেই বিবেকে উচ্চ হওয়া যায় না। দুধ দিয়ে কালসাপ পুষলে দিনশেষে ছোবলই খেতে হয়। যার ভুক্তভোগী মেহরিমা। কোনোদিন ওকে বলি নি সতীনের ছেলেকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে হবে ওর৷ না বলা সত্ত্বেও সে সেটা করেছে। এতকিছুর বিনিময়ে তুমি কি দিয়েছো ওকে?অপমান, মিথ্যে অপবাদ। সত্য মিথ্যা যাচাই ছাড়া কষ্ট দিলে। এত বছরের ভালোবাসা প্রত্যাখান করেছো দুদিনের ভালোবাসার মোহে। আাশা করি সুখেই ছিলে। বুড়ো বয়সে অনুরোধ করবো পারলে থেকে যাও। তোমার মা’কে খুব ভালোবাসতাম, তোমাকে দেখলে যেন আমি তাকেই অনুভব করতে পারি। অভিমানের দেয়াল টা আর তুলে রাখতে পারলাম না। থেকে যাও। আমি কথা দিচ্ছি আরিয়ানার কোনো ক্ষতি হবে না। দরকার পড়লে আমি চট্টগ্রাম চলে যাবো মেহরিমাকে নিয়ে। অন্তত এই সমাজ বলতে তো পারবে আমার খাটিয়া ধরা থেকে কোনো ছেলে বঞ্চিত হয় নি। ‘
কথাগুলো শেষ হতেই তোহাশ ঢলে পড়লো নুরুল চৌধুরীর পায়ের সমীপে। ওনার হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ওঠে। পুরুষ নাকি শত কঠিন পরিস্থিতিতেও ভাঙ্গে না?অথচ প্রিয়ুসহ সবাই দেখলো কতটা সহজে বাবার পা ছুঁয়ে কাঁদছে তোহাশ। কই ছিল এত কাল? প্রিয়ু বুঝে পায় না মানুষ কেন সবসময় সময় খুইয়ে নিজের ভুল বুঝে?নুরুল সাহেব অটল। টু শব্দটুকু করলেন না তোহাশের উদ্দেশ্যে।তূর্যর দিকে নজর ফেলে স্রেফ বললেন,’ সন্ধ্যার পর থাকিস। ‘
তৎপরে সোফায় ঘাড় এলিয়ে চুপ করে রইলেন। তোহাশও পা আঁকড়ে ধরে রাখলো। মুখ দিয়ে কথা আসছে না। আয়ুশ ওর কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় আওড়ালো,’ উঠুন ভাই। বড় আব্বুর জন্য স্ট্রেস ঝুঁকিপূর্ণ। ‘
সকালেই রুম টা গোছগাছ করে রেখেছিল শ্রেয়া। আরিয়ানাকে নিয়ে আবছা অন্ধকার কক্ষে ঢুকে ও। নিজ হাতে রুমের কালো পর্দাগুলো সরিয়ে দিয়ে সূর্যের রশ্মি ঘরে আসার সুযোগ করে দেয়। তিতিসার কান্না থমকে গিয়েছে ততক্ষণে। ভাসা ভাসা আখিঁদ্বয়ে সে দেখছে কালো একটা তাতের কাপড় পরিহিতা মেয়েকে। ওর চাহনিতে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় পা ফেলে অভিমুখে এসে উপস্থিত হয় শ্রেয়া। বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে দু হাত বাড়ায়,উদ্দেশ্য কোলে নিবে৷ তিতিসা ঠোঁট ছড়িয়ে ওর বুকে ঝাপিয়ে পড়বে পড়বে অবস্থা তখনই আরিয়ানা নিজের সঙ্গে চেপে ধরে ওকে। শ্রেয়ার মন আহত হয়। মনোক্ষুণ্ণ হয়। বুকটা কেঁপে ওঠে। আরিয়ানা ক্রোধান্বিত চাহনি নিবদ্ধ করে। মুখ থেকে বেরিয়ে আসা একেকটা ধ্বনিতে রাগের মিশ্রণ, ‘ আমার মেয়েকে ধরবে না। ‘
মলিন ভাব কাটিয়ে শ্রেয়া হাসে। অত্যন্ত মৃদু হাসি। ধাতস্থ হয়ে বলে, ‘ আমি কি তিতিসার ক্ষতি আপনার চোখের সামনে করে ফেলব?আর কেনই বা করবো?আমার হাত এতটাই শক্ত না যে তিতিসার শরীর থেকে চামড়া খসে পড়ে যাবে। কিংবা আমার মন কুৎসিত না যে একটা বাচ্চার ক্ষতি করবো। আমার এমন কোনো ইচ্ছেও নেই। আপনার আচরণের ব্যাপারে শুনেছিলাম, আজ দেখেও নিলাম। আমার মনে হয় কি জানেন?আপনি ওভার পজেসিভ। নিজের জিনিস একান্তে নিজের করে রাখতে চান। কারো সান্নিধ্য সহ্য হয় না আপনার। আপনার জন্য সংসারে ফাটল ধরেছে। শুনেছি আপনিও আমার মতো এতিম। কোনোদিন আপনজনের অভাব ফিল করেন নি?একবারও মনে হয় নি আপনজনের কাছে থাকাটা কতটা শান্তি দেয়?জানেন আপু আমি আপন মানুষের স্পর্শ পাওয়ার জন্য কত ব্যকুল ছিলাম। আল্লাহ আমার সেই চাওয়া এই পরিবারের মাধ্যমে পূর্ণ করে দিয়েছেন। আশা করি আপনিও একদিন বুঝবেন। তিতিসাকে এমন করে বড় করবেন যেন আপনাদের সম্মান করে। ভুল বললে ক্ষমা করে দিবেন আমাকে। আজও সময় আছে নিজেকে শুধরানোর। আমি আপনাকে আপু বলেই ডাকি?আমার কেউ নেই। বড় বোনের অভাব বোধ করি। আপনি বললেও ডাকবো,না বললেও ডাকবো। ‘
হাসি বজায় রেখে তিতিসাকে এক প্রকার কেঁড়ে নিল শ্রেয়া। সাথে সাথেই তিতিসা ওর বুকে মিশে গেল। ওর মাথায় চুমু খেয়ে প্রশান্তির শ্বাস টেনে নেয় শ্রেয়া। আরিয়ানার কন্ঠ নিভে গেল। অকস্মাৎ কি হয়েছে কে জানে!বললো,’ ওকে বেশি চেপে ধরো না। নয়ত গরমে কষ্ট হয় ওর। ‘
শ্রেয়া মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। বলে,’ আচ্ছা। ‘
কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ টিকল না। মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল আরিয়ানার উচ্চারিত দু বাক্যে,’ তোমার আপন শাশুড়ি তো তাই এমন পক্ষপাতীত্ব করো। আমার মতো সৎ ঘরের হতে তাহলে এক দন্ডও মনের স্বস্তি পেতে না। ‘
থেমে থাকলো না শ্রেয়া। চট করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘ মনের স্বস্তির জন্য নিচে নেমেছেন?আপন না বলে?মানুষ হোন। আপন পর দিয়ে নয়। মানবতা, মন দিয়ে যাচাই করুন। আপনি মেন্টালি সিক সেটা বুঝতে পারছেন আপু?ছিহ!’
সমস্ত গা ঘৃ-ণায় রি রি করে উঠলো তার। তিতিসা কে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। নারী মন নাকি দুর্বল হয়,মায়ায় ভরা থাকে। কিন্তু আরিয়ানা ক্ষেত্রে মতামত সম্পূর্ণ পাল্টে গেল শ্রেয়ার।
___________
সম্ভবত অপরাহ্নেই বাড়ি ফেরছে পাখির দল। হতে পারে ভীষণ তাড়া তাদের। সন্ধ্যা নামলো না ধরণীতে,এখনই যাওয়ার কত অস্থিরতা। শ্রেয়া নীলাম্বর থেকে চক্ষু সরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলো,
‘ হঠাৎ কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
তূর্য একমনে ড্রাইভ করতে মগ্ন। কোমল কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই বলে উঠলো, ‘ খালা শাশুড়ির বাড়িতে দাওয়াত খেতে। ‘
শ্রেয়া বিষম খেলো। খালা শাশুড়ি মানে তো ওর খালা।
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)