সন্ধ্যামালতী,০৪,০৫

0
436

#সন্ধ্যামালতী,০৪,০৫
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
০৪

পরিবেশ থমথমে। চারদিকে হালকা বাতাস ছড়িয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধ্যামালতীও ফুটে উঠেছে মিষ্টি গন্ধ নিয়ে। কিন্তু বিকেলে সন্ধ্যার সেন্স হারালেও এখন পর্যন্ত ফিরেনি। হঠাৎ করে সন্ধ্যা সেন্সলেস হওয়ায় সবাই ভয় পেয়ে আছে। আয়াশ, লিজা, জেরিন, আকাশ, সাফি, তমাল, রানা সবাই নিজেদের মতো চেষ্টা করেই যাচ্ছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। কোনো কিছুতেই সন্ধ্যার জ্ঞান ফিরতেছে না। আয়াশ দ্রুত কন্ঠে বললো,

‘ওকে হসপিটালে নিতে হবে। হয়তো আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিসটা নেই যা ওর দরকার। অনেকক্ষণ হলো জ্ঞান হারিয়েছে এতো সময় জ্ঞানহীন থাকলে কোনো সমস্যা হতে পারে।’

সবাই তাতে সহমত দিলো। সাহেদা তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। লিজা আর জেরিন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। আকাশ বাহিরে এসে সবটা পর্যবেক্ষণ করে আবাার বাড়ির ভেতর গিয়ে বলে, ‘দোস্ত হসপিটাল তো অনেকটাই দুর। ওকে নিবো কিভাবে?’

‘বাহিরে কোনো গাড়ি টাড়ি দেখিস নাই?’

আকাশ মাথা নাড়ায়। আয়াশ ‘শিট’ বলেই মাথা চেপে ধরে। কিছু একটা ভেবে সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নেয়। তারপর বলে, ‘কিছু একটার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোরা তাড়াতাড়ি আয়।’

আয়াশ আগে আগে ছুট লাগায়। পেছন পেছন সাহেদা সহ বাকি সবাই আসে। একটু এগোতেই বাড়ির পাহাদার একটি ভ্যান নিয়ে হাজির হয়। আয়াশকে দেখে বলে,

‘স্যার ওরে ভ্যানে কইরা লইয়া যান। তাইলে তাড়াতাড়ি অইবো।’

আয়াশ কথা বাড়ায় না। লিজা, সাহেদা, রানা ভ্যানে উঠে বসে। বাকি সবাই থেকে যায়। সন্ধ্যাকে কোনো রকম বসিয়ে দিতেই সাহেদা দুহাতে জাপ্টে ধরে মেয়েকে। আয়াশ অপলক তাকায় সেদিকে। ভ্যান ছুটতে থাকে দ্রুত। হসপিটালের সামনে নামিয়ে দিলে সন্ধ্যাকে আবার কোলে তুলে নেয় আয়াশ। দ্রুত পায়ে হেঁটে ইমার্জেন্সিতে আসে। ইমার্জেন্সিতে আরো কয়েকজন পেশেন্ট আর কয়েকজন ডক্টরকে দেখে একটা কেবিনে শুইয়ে দেয়। আয়াশ ডক্টরদের সাথে কথা বলে সন্ধ্যার ট্রিটমেন্ট শুরু করে। সবরকম ফর্মালিটিজ পূরণ করে একটা কেবিনে এডমিট করে। ডক্টররা নিজেদের মতো ট্রিটমেন্ট করে স্যালাইন দিয়ে যায়। কেবিনে আয়াশ, সাহেদা, লিজা আর রানা সবাই থাকে। এই অবস্থায় সন্ধ্যা আর সাহেদাকে একা রেখে যাওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে হলো না কারো। সাহেদা আর লিজা সন্ধ্যার কোল ঘেষে বসে পড়ে। আয়াশ আর রানা দেয়ালের সাথে রাখা কাঠের মোড়ায় বসে হেলান দিয়ে। আয়াশ আশে পাশে নজর বুলায়। কিছু কিছু লোক তাদের দিকে ট্যারা চোখে তাকাচ্ছে। আয়াশ পাত্তা দিলো না। নিজের মতো চোখ বন্ধ করে বসে রইলো।

কেটে গেলো অনেকটা সময়। সন্ধ্যার সেন্স ফিরলেও সাথে সাথে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। মাঝরাতে হুট করেই ঘুম ভেঙে যায় সন্ধ্যার। নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করে কি হয়েছিলো তা মনে করার চেষ্টা করে। কবরস্থানের সামনে সে কেন জ্ঞান হারালো তা মনে করতে পারলো না। আশে পাশে তাকিয়ে দেখে তার মা কেবিনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্যপাশে লিজাকে দেখে একটু চমকায়। পুরো রুমে চোখ বুলাতেই অস্ফুট স্বরে আস্তে করে বলে, ‘শহুরে ডাক্তার! উনারা এখানে!’

অনেকটা সময় অপলক তাকিয়ে থাকে সন্ধ্যা তার শহুরে ডাক্তারের দিকে৷ তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

সকাল সকাল সন্ধ্যাকে রিলিজ করিয়ে ফিরে আসে সবাই। আয়াশ সকাল থেকেই গম্ভীর মুখ করে আছে। সন্ধ্যাকেও জিজ্ঞেস করেনি ‘কেমন আছে?’। সন্ধ্যা বার বার আয়াশের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলো। সন্ধ্যাকে বাড়িতে একা রেখে যাওয়াটা ঠিক হবে বলে মনে হলো না সাহেদার। কাল সন্ধ্যার দিকেই সন্ধ্যার দাদাকে আকাশ, তমাল, সাফি আর জেরিন মিলে নিয়ে এসেছে তাদের ওখানে। বুড়ো মানুষ রাতে একা থাকবে! সে হিসেবে সাত্তার সাহেব এখনো ওখানেই আছে। সাহেদা সন্ধ্যাকে নিয়ে আয়াশরা যেখানে থাকে সেখানে আসে। আয়াশ চুপচাপ নিজের রুমে চলে যায়। পেছন পেছন রানাও যায়। আয়াশকে বলে,

‘তুই এমন গম্ভীর হয়ে আছিস কেন?’

আয়াশ কিছু না বলেই ওয়াশরুমে চলে যাায়। রানা বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে! সাহেদা রান্না করে আর সন্ধ্যা তার পাশেই চুপটি করে বসে থাকে। লিজা, জেরিন সহ বাকি সবাই নিজেদের কাজের জন্য রেডি হয়। তারা তো গ্রামে এসেছে চিকিৎসা করার জন্য আর তা তো করতেই হবে৷ আস্তে আস্তে সব পেশেন্ট জড়ো হতে থাকে। বকুল সন্ধ্যার খবর নিতে এসে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। তাই সে আয়াশদের এখানে আসে। লিজাকে দেখে মিষ্টি করে হেঁসে বলে,

‘আপু সন্ধ্যাকে দেখছেন?’

লিজা কাজ করতে করতেই উত্তর দেয়, ‘ভেতরে দেখো। বসে আছে!’

বকুল কথা না বাড়িয়ে ভেতরে যায়। সাহেদা যেখানে রান্না করছে সেখানে সন্ধ্যাকে দেখে বলে, ‘কিরে আসছিস আমারে ডাকোস নাই কেন?’

সন্ধ্যা মলিন হেঁসে বলে, ‘তুই তো ব্যস্ত!’

বকুল কিছু বলার আগেই সাহেদা ধমক দেয় সন্ধ্যাকে। তারপর ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনায় তিনি বলে। বকুল আঁতকে উঠে বলে, ‘এতকিছু হয়ে গেছে আর আমি কেবল জানতেছি! তুই ঠিক আছিস তো সন্ধ্যা?’

‘হ্যাঁ রে বাবা ঠিক আছি। দেখ না আম্মা আমারে এখান থেকে উঠতেই দিতাছে না৷ চল না পুকুর ঘাটে যায়।’

সাহেদা চোখ গরম দিয়ে বলে, ‘এইহানে বইয়া থাক। বকুল মা তুইও বইয়া থাক।’

সন্ধ্যা ঘ্যানঘ্যান করে বকুল কে নিয়ে পুকুর ঘাটে আসে। আয়াশ সন্ধ্যাকে বের হয়ে যেতে দেখে এগিয়ে আসে সাহেদার কাছে। টুল নিয়ে বসে। সাহেদা হেঁসে তাকায় আয়াশের দিকে। আয়াশ তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে সাহেদাকে তারপর বলে, ‘কাল রাতে সন্ধ্যাকে রেখে কোথায় গেছিলেন আন্টি?’

প্রশ্নটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো সাহেদা। চমকে তাকায় আয়াশের দিকে। আয়াশ তখনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাহেদা হঠাৎ করেই ঘামতে থাকে। আয়াশ বলে, ‘আপনাকে আমি খুব কঠিন কোনো প্রশ্ন করেছি বলে তো মনে হয় না! তাহলে এমন ঘামছেন কেন?’

সাহেদা নিজের ঘাম মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘ব-বাথরুমো।’

আয়াশের কপালে ভাজটা দৃঢ় হয়। কন্ঠ আরো শক্ত হয়। বলে,

‘অসুস্থ মেয়েকে রেখে আপনি পুরো ১ ঘন্টা ২৫ মিনিট বাথরুমে ছিলেন? বাথরুম থেকে আসার পর অতো ঘামছিলেন কেনো? আর এতো ভয় পাচ্ছিলেন কেন?’

‘ক-কই ভয় পাইছি বাজান? তুনি মনো হয় ভুল দেখছো!’

আয়াশ আর কিছু না বলে উঠে আসে। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে সাহেদা চমকে উঠে। অপর পাশের মানুষটা তাকে আঙুল দেখিয়ে সাবধান করে। সাহেদা দ্রুত সব কাজ করে।

সন্ধ্যা আর বকুল শান বাঁধানো ঘাটে বসে চুপ করে আছে। বকুল কথায় কথায় জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কাল জ্ঞান হারাইলি কেমনে?’

সন্ধ্যা অন্যমনষ্ক হয়ে বলে, ‘জানি না। কিছু আবছা স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তারপর কি হলো জানি না।’

‘আচ্ছা বাদ দে। শোন আজ তুই এখানে বসে থাক আমি গাছে উঠবো।’

সন্ধ্যা হাসে। বকুল গাছে উঠে বকুল। ফুল নিয়ে আঁচল ভরিয়ে ফেলে আর উপর থেকে গল্প করতে থাকে। তখন আসে আয়াশ, লিজা, জেরিন, রানা, সাফি, আকাশ আর তমাল। সাফি সন্ধ্যার পাশে বসে বলে,

‘কাল তো আমি তোমারে দেইখা ভয় পাইছি গো সন্ধ্যা। ভাবছি তোমারে ভুতই ধরলো নাকি!’

সেইসময় গাছ থেকে লাফ দিয়ে নামে বকুল। গাছের পাতার শব্দে ভয়ে লাফিয়ে উঠে সাফি। ‘ভুততততত’ বলে চিল্লিয়ে উঠে। সাফির চিৎকার শুনে ভয়েই বকুল দুপা পিছিয়ে যায়। আকাশ দুড়ুম করে সাফির পিঠে কি’ল বসায়। বলে,

‘সব জায়গায় তোর পেত্নী রানী থাকে না। ব’লদ।’

সাফি মাথা চুলকায়। রানা বকুলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলে, ‘এতদিন তো সন্ধ্যা ভুতের মতো গাছে উঠে বসে থাকতো। আজ থেকে কি তুমি শুরু করলা নাকি?’

বকুল এসে সন্ধ্যার পাশে বসে। তারপর বলে, ‘আমরা দুজনেই গাছে উঠি।’

সন্ধ্যা বলে, ‘আপনাদের কাজ শেষ?’

লিজা বলে, ‘না গো। ব্রেক নিলাম একটু। খেয়ে আবার সবাই পেশেন্ট দেখবো। আজ তো অনেক পেশেন্ট!’

সন্ধ্যা ‘ওহ’ বলে আয়াশের দিকে তাকায়। আয়াশ যেনো এ দুনিয়ায় নাই। সে ব্যস্ত তখনো ফোনে! সবাই নিজেদের মতো গল্প করতে থাকে। সন্ধ্যা উঠে আয়াশের পাশে বসে। আয়াশ এক পলক তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা ডাকে,

‘শহুরে ডাক্তার!’

আয়াশ তাকায় তার দিকে। রানা দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে জেরিনকে আস্তে করে বলে, ‘দেখ! সন্ধ্যা ছোট হলেও ওকে কিন্তু আয়াশের সাথে মানায় বল!’

জেরিন হাসে। আয়াশ আর সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে দুজনের একটা ফটো ক্লিক করে। আর আনফরচুন্যাটলি সে সময়ই আয়াশ তাকায় সন্ধ্যাার দিকে। ফটো তে দেখা যায় দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। জেরিন নিঃশব্দে হেঁসে ফটোটা রানাকে দেখায়। আয়াশ সন্ধ্যার দিকে তাকাতেই সন্ধ্যা বলে,

‘আপনি কি সব সময় মুখ এমন করে রাখেন? হাসতে পারেন না?’

‘না।’

আয়াশের সরাসরি উত্তরে নড়েচড়ে বসে সন্ধ্যা। এ কেমন লোক! সন্ধ্যা বলে, ‘ধন্যবাদ।’

‘কেন?’

‘কালকে আপনারা না থাকলে…

‘সবাইকে গিয়ে বলো।’

সন্ধ্যা কটমট করে তাকায় আয়াশের দিকে। ২৮ ঘন্টাতে হঠাৎ করেই তার অন্য এক অনুভূতির জন্ম হয়েছে। কেন? কিভাবে? কি অনুভূতি! কিছুই তার বোধগম্য নয়। তবে তার ভীষণ ভাবে ভালো লাগে তার শহুরে ডাক্তারকে। সন্ধ্যা কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে আয়াশের দিকে। সেসময় সাহেদা আসে সেখানে। সন্ধ্যাকে ডাকতেই বাড়ির পাহারাদার ছুটে আসে। এসে আয়াশদের উদ্দেশ্য করে বলে,

‘স্যার আপনেরা কেউ একা একা কোনো জায়গায় যাইয়েন না। পাশের গেরামের একটা মাইয়ারে কে জানি মা’ইরা ফালাইয়া রাখছে।’

চমকে উঠে উপস্থিত সকলে। আয়াশ নিজেও ভীষণ অবাক হয়। সন্ধ্যা ছুটে পাহারাদারের কাছে আসতে নিলে সাহেদা হাত ধরে আটকায়। বলে, ‘বাড়ি চ।’

আয়াশ খেয়াল করে সাহেদার হাত আর গলা কাঁপছে। কিসের ভয়ে সাহেদার এমন হাল? মেয়ের ভয়ে নাকি যে খু’ন টা হয়েছে তা নিয়ে? আয়াশ আর খুতায় না। পাহারাদারকে বলে,

‘কোথায় খু’ন হয়ছে চাচা?’

সবাই অবাক হয়ে তাকায় আয়াশের দিকে। রানা সাবধান গলায় বলে, ‘তুই যা ভাবছিস তা ভুলে যা। এটা আমাদের শহর না অপরিচিত একটা গ্রাম।’

আয়াশ পাত্তা দেয় না রানার কথা। ফের শুধায় পাহারাদারকে। পাহারাদার জবাবে বলে,

‘হাসপাতালের ওই কাছো একটা রাস্তা আছিলো ওইহানেই মাইয়াডার লা’শ পইড়া আছে।’

সাহেদা দ্রুত পা চালিয়ে সন্ধ্যা আর সাত্তার সাহেবকে নিয়ে বাড়িতে আসে। সাত্তার সাহেব আর সন্ধ্যাকে এক ঘরে থাকতে বলে নিজে এসে রান্না বসায়। সকালে যেহেতু হসপিটালে ছিলো তাই এখনই রান্না করতে হবে। কালকের তরকারি আছে শুধু ভাত রান্না করবে। রান্না শেষ করতে করতে অনেকটা সময় লাগে। ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আছে। সন্ধ্যা এগিয়ে এসে বলে,

‘আম্মা কি হয়ছে তোমার? এমন করতেছো কেন?’

‘ক-কিছু অয় নাই। তুই খায়বার আয়।’

বলেই খাবার বাড়তে লাগে। সন্ধ্যার খটকা লাগে। তবুও কিছু না বলে খাবার খেয়ে নেয়। তারপর হাতের কাজ সব শেষ করতে করতে বাড়িতে উপস্থিত হয় বকুলের পরিবার। সাহেদা সবাইকে একসাথে দেখে বলে,

‘ভাবি আপনেরা এইহানে?’

বকুলের মা হেঁসে বলে, ‘আপনের লগে আত্মীয়তা করবার আয়লাম।’

সাহেদা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। বকুলের মা হেঁসে বলে, ‘আমাগো বাদলের লাইগা আপনের সন্ধ্যারে নিতো চাইতাছি৷’

সাহেদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ‘আলহামদুলিল্লাহ ‘ বলে জড়িয়ে ধরে বকুলের মা’কে। সন্ধ্যা ঘর থেকে পুরো বিষয়টা দেখে। বকুল দৌড়ে আসে সন্ধ্যার কাছে। জড়িয়ে ধরে বলে,

‘ইয়াহুউউ তুই আমার ভাবি হবি সন্ধ্যা। সারাদিন দুইজন একসাথে থাকমু।’

সন্ধ্যা একদৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে মনে মনে আওড়ায়, ‘আমি আর বাদল ভাই! কেমনে সম্ভব?’

চলবে…

#সন্ধ্যামালতী (০৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

সন্ধ্যার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে তার রেজাল্ট বের হওয়ার ২ দিন পরই। রেজাল্ট বের হতে এখনো ১২-১৫ দিন বাকি। সবাই খুশি এই বিয়েতে শুধু সন্ধ্যা চুপচাপ। সে কি করে বুঝাবে তার কিশোরী মন কি চায়? বকুল তো খুশিতে নাচানাচি শুরু করছে। বাদল এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। সন্ধ্যা তখনো তার নিজস্ব ভাবনায় বিভোর। বাদল এসে আস্তে করে ডাকে,

‘সন্ধ্যা!’

সন্ধ্যা চমকে তাকায়। তারপর মাথা নিচু করে নেয়। বাদল হেঁসে বলে, ‘তোর কি কিছু হয়ছে? বিয়েতে তুই খুশি না?’

সন্ধ্যা কি বলবে খুঁজে পায় না। চোখ বার বার এদিক ওদিক করতে থাকে। বাদল ফের বলে, ‘তোর কোনো সমস্যা থাকলে এখনই বল। নির্ভয়ে বল।’

সন্ধ্যা কিছু বলার আগেই সাহেদা পেছন থেকে বলে ওঠে, ‘হের কি সমস্যা থাকতো বাজান? তুমি শান্তিতে থাহো। বিয়া অইবো।’

সন্ধ্যা আর কিছু বলতে পারে না। চুপ করেই থাকে। বাদল হেঁসে বলে, ‘তবুও একবার সন্ধ্যার থেকে শুনি চাচি। ‘ও’ কি চায়?’

সন্ধ্যা মাথা নিচু করেই বলে, ‘আম্মা যা চাই আমিও তাই চাই বাদল ভাই।’

বাদল নিঃশব্দে হেঁসে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সাহেদা অতিথি আপ্যায়ন করে সবাইকে বিদায় দিয়ে নিজে চলে যায় কাজে। সন্ধ্যা আয়াশদের সেখানে যাবে না যাবে না করেও পা বাড়ায় সেদিকে। বকুল তো সবার সাথে বাড়ি চলে গেছে। সন্ধ্যা রাস্তায় বের হতেই ফরিদের সাথে দেখা হয়। সন্ধ্যা চোখ মুখ শক্ত করে এগোতে নিলে ফরিদ এগিয়ে আসে। সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে যায়। ফরিদ এগিয়ে এসে সন্ধ্যার গাল চেপে ধরে বলে,

‘সেদিন তো বাড়িতে বটি নিয়ে এগিয়ে আসলি। আজ কেমনে বাঁচবি?’

সন্ধ্যা এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে অদ্ভুত ভাবে হেঁসে বলে, ‘কাকা আপনিও না! বাড়ির বাইরে নারী দুর্বল ভাবা লোক নিজেই বড় দুর্বল।’

বলেই পিছিয়ে যায়। ফরিদ সন্ধ্যার কোমড়ের শাড়ি টেনে ধরে। রাগে গা জ্বলে উঠে সন্ধ্যার। পাশে থাকা ইটের টুকরো তুলে নেয় হাতে। কিছু না ভেবেই ছুড়ে মারে ফরিদের দিকে। ভাগ্যবশত ইটের টুকরো টা সরাসরি ফরিদের কপালে লাগে। সাথে সাথে ফেটে গিয়ে টুপটাপ করে রক্ত পড়তে থাকে। সন্ধ্যার সেসব দেখার টাইম নাই। নিজের মতো হেলতে দুলতে চলে আসে। ফরিদ মাথা চেপে বসে পড়ে সেখানে।

সন্ধ্যা আনমনে হেঁটে আসে পুকুর পাড়ে। সেখানে চোখ পড়তেই দেখে দাঁড়িয়ে আছে আয়াশ। সন্ধ্যার মাথায় মুহুর্তেই দুষ্টু বুদ্ধি আসে। পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে আয়াশের কাছে। পেছন থেকে শব্দ করে ‘ভাউ’ করে উঠে। আয়াশ চমকে পেছনে তাকাতেই ভর সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে সন্ধ্যা দ্রুত এসে হাত ধরে। এত ভার তো সে সামলাতে পারে না ফলে দুজনেই একসাথে উল্টে পড়ে পানিতে। হুড়মুড় করে পড়ায় দুজনেই যথেষ্ট পানি খেয়ে বসে। ডুব দিয়ে উঠে দুজনেই আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে একে অপরের দিকে। সন্ধ্যার সৌন্দর্যে যেনো আরো একবার চোখ ধাধালো আয়াশের। ছোট ছোট চুলগুলো মুখের সাথে লেপ্টে গেছে। বিন্দু বিন্দু পানির কণা জমা আছে মুখে। ঠোঁট গুলো তিড়তিড় করে কেঁপে উঠছে বারংবার। আয়াশ দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। এ রুপের দিকে তাকালেই তার চোখ ধাঁধিয়ে আসে আর যারা বাজে নজরে তাকায় তাদের কেন চোখ ঝ’লসে যায় না! আয়াশের ভাবনার মাঝেই ভেসে আসে রানার কন্ঠ। আয়াশ সেদিকে তাকাতেই রানা বলে,

‘কিরে দুজনে কি পানিতে সাঁতার কাটতেছিস নাকি?’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে উঠে আসে। কিন্তু সন্ধ্যা পানিতেই থেকে যায়। আয়াশ জেরিনকে ইশারায় কিছু বলতেই জেরিন মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। লিজা বলে,

‘সন্ধ্যা তোমার তো ঠান্ডা লেগে যাবে!’

‘সমস্যা নেই আপু। পুকুরে গোসল করার স্বভাব আমাদের আছে সে হিসেবে আমার না শহুরে ডাক্তারের ঠান্ডা লাগতে পারে।’

আয়াশ চুল থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। পাশ থেকে আকাশ বলে, ‘মাম্মা কাহিনি কি? আজকাল তুমি পুকুরে ভেসে বেড়াচ্ছো!’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই আকাশ গান ধরে, ‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না..’

পাশ থেকে সাফি শুকনো ঢোক গিলে বলে, ‘দোস্ত তোদের আবার ভুত বা পেত্নী ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি তো? লা হাওলা ওয়ালা…

এটুকু বলতেই রানা বলে, ‘হা’রা’ম’জা’দা তোর ভুতের কাছেই আজকে তোরে রেখে যাবো।’

বলেই সাফির পেছনে জোড়ে একটা লা’থি দেয়। সাফি ধপাস করে পানিতে পড়ে। সন্ধ্যা ভয়ে পানির মধ্যেই পড়ে যেতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। সাফি পানিতে থতমত খেয়ে রানাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘শা’লা তুই আমারে পানিতে ফেললি কেন হা’রামি?’

তমাল গালে হাত দিয়ে বলে, ‘রানা তুই কবে তোর বোনের সাথে ওর বিয়ে দিলি?’

রানা ভেংচি কেটে দুপা এগিয়ে বলে, ‘আমার তো বোন বেশি হয়ছে যে ওর মতো ভুতে ভয় পাওয়া ছা’গলের সাথে আমার বোনের বিয়ে দিবো!’

সবাই শব্দ করে হেঁসে দেয়। সাফি ব্যঙ্গ করে বলে, ‘কপালে যদি লেখা থাাকে আমি তোর দুলাভাই হমু তাইলে তুই আটকাবি কেমনে?’

‘তাইলে তোরে প্রতিদিন ভুতের সাথে মিট করাবো।’

সবাই হু হা করে হাসতে থাকে। জেরিন একটা শুকনো টাওয়েল এনে সন্ধ্যার দিকে বাড়িয়ে দেয়। বলে,

‘এটা গায়ে দিয়ে উঠে আসো সন্ধ্যা। বেশিক্ষণ পানিতে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।’

সন্ধ্যা চুপচাপ টাওয়েল গায়ে জড়িয়ে উঠে আসে। ততক্ষণ ছেলেরা সবাই অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেদের মতো গল্প করতে থাকে। আয়াশ সবাইকে ইগনোর করে চলে যায়। সন্ধ্যাকে নিয়ে জেরিন ভিতরে যায়। সাফিও উঠে আসে পানি থেকে। রানা বলে,

‘দোস্ত তোদের মনে হয় না আয়াশ আর সন্ধ্যার মধ্যে কিছু চলছে!’

লিজা বলে, ‘চলছে না বাট সামথিং ইজ ফিসি।’

তমাল ঝাড়ি মেরে বলে, ‘তোর হাইফাই ইংলিশ নিজের বয়ফ্রেন্ডের পকেটে রাখ। আমার মনে হয় আয়াশ আর সন্ধ্যা একে অপরকে একটু একটু পছন্দ করে।’

সাফি বলে, ‘তাই বলে দুদিনে!’

আকাশ সাফির মাথায় গাট্টা মেরে বলে, ‘আরেহ ভালোবাসতে কি যুগ যুগ লাগে নাকি?’

লিজা বলে, ‘তবুও দুদিনে হয়তো ভালোবাসা পর্যন্ত যায়নি। ভালো লাগা তো হবেই।’

রানা গদগদ স্বরে বলে, ‘দোস্ত এই দুইটার ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা পর্যন্ত আমাদেরই আনতে হবে।’

সবাই একসাথে হাত মিলায়। সাফি বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলে, ‘আমার জন্য কারো কোনো চিন্তাই নাই।’

জেরিন আর সন্ধ্যা ভিতরে আসতেই সাহেদা তাকে দেখে। এগিয়ে আসে দ্রুত। বলে, ‘সন্ধ্যা ভিজ্জোস কেমনে?’

‘পুকুরে পড়ে গেছিলাম আম্মা।’

‘হায় আল্লাহ কতক্ষণ ধইরা এমনে আছোস? ঠাান্ডা লাইগা যাইবো।’

জেরিন বলে, ‘কাম ডাউন আন্টি। আমি ওকে আমার কাপড় দিচ্ছি। ‘ও’ এখন পড়ে নিক।’

সাহেদা কিছু বলতে গেলে থামিয়ে দেয় জেরিন। তারপর সন্ধ্যাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে কাপড় পাল্টে নিতে বলে। জেরিন তার একটা থ্রি পিস দেয় পড়তে। সন্ধ্যার একটু ঢিলাঢালা হলেও চুপ করে পড়ে নিয়ে মাথায় কাপড় টেনে নেয়। তারপর বাহিরে আসে। সন্ধ্যা সাহেদার জন্য বসে থাকে আর বাকি সবাই কাজে লেগে পড়ে।

বিকেলের দিকে সবাই সাহেদার কাছে আবদার করে আজ তারা সন্ধ্যাকে যেতে দিবে না। সাহেদা প্রথমে না করলেও পরে আর কিছু বলে না। থাকতে দেয়। সবাই তো মহাখুশি। সাহেদা কাজ শেষ করতে করতে ছুটে আসে বকুল। বকুলকে দেখে সন্ধ্যা কিছু বলতে যাবে তার আগেই বকুল গড়গড় করে সাহেদাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘চাচি জলদি চেয়ারম্যানের বাড়ি চলেন। সন্ধ্যা নাকি ফরিদ কাকার মাথা ফা’টায় দিছে এখন চেয়ারম্যান সবাইকে নিয়ে বিচার বসিয়েছে।’

সাহেদা অবাক হয়ে তাকায় মেয়ের দিকে। বাকি সবাইও অবাক হয়। সন্ধ্যা স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। সাহেদা সন্ধ্যার কাছে এসে বলে, ‘এইডা তুই কি করছোস? বকুল যা কইলো তা কি সত্যই?’

সন্ধ্যার মায়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, ‘বিচার যখন বসিয়েছে আর আমাদের খোঁজও লাগিয়েছে তখন তো যেতেই হবে। চলো।’

সাহেদা ভাষা হারিয়ে ফেলে। ওরা যা খারাপ তাতে করে মেয়েটাকে ছাড়বে তো? সাহেদাকে নির্বাক দেখে এগিয়ে আসে সন্ধ্যা। কাছে এসে মায়ের মুখ আজলে নিয়ে বলে,

‘তোমার মেয়ের ওপর তোমার ভরসা নাই আম্মা? তোমার সন্ধ্যা কখনো অন্যায় করছে?’

সাহেদা মাথা নাড়ায়। সন্ধ্যা নিঃশব্দে হেঁসে মায়ের হাত ধরে বাড়ির বাইরে আসে। পেছন পেছন আয়াশরাও আসে। বকুলও আছে সাথে। আয়াশ পেছন থেকে বলে,

‘তোমাদের একা যাওয়া ঠিক হবে না। আমরাও যাবো।’

বাকি সবাইও সম্মতি দেয়। নিঃশব্দে ঠোঁট কামড়ে হাসে সন্ধ্যা। দুদিনেই লোকটাকে তার অনেকটা জানা হয়ে গেছে। তার কিশোরী মন হয়তো জানতো যে আয়াশ তার সাথে যাবে। সবাই মিলে চলে আসে চেয়ারম্যান বাড়িতে। অনেক লোকজন সেখানে জড়ো হয়েছে। সন্ধ্যাদের দেখে সবাই কিছুটা সরে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা আর সাহেদা গিয়ে ফরিদরা যে পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার অপর পাশে দাঁড়ায়। তাদের পেছনে দাঁড়ায় আয়াশরা। চেয়ারম্যান ফিরোজ গম্ভীর গলায় সন্ধ্যাকে বলে,

‘আজকাল তোর সাহস বেড়েছে নাকি সন্ধ্যা? তুই ফরিদের মাথা ফা’টিয়েছিস?’

সন্ধ্যার সহজ স্বীকারোক্তি, ‘হ্যাঁ।’

সন্ধ্যার সহজেই স্বীকার করে নেওয়ায় নড়েচড়ে বসে সবাই। ফিরোজ আরো গম্ভীর আর জোড়ে বলে উঠে, ‘কোন সাহসে তুই আমার ভাইয়ের মাথা ফা’টিয়েছিস? কাল নাকি ওরে বটি পর্যন্ত দেখায়ছিস! রিনিকে থা’প্পড় মে’রেছিস!’

‘হ্যাঁ।’

এবার যেনো ক্ষেপে উঠে ফিরোজ। জোড়ে চিল্লিয়ে বলে, ‘অন্যায় করে আবার জোড় গলায় বলছিস!’

সন্ধ্যা হেঁসে উঠে। বলে, ‘অন্যায়? প্রতিবাদ করলেই তা অন্যায়? আমি আপনার ভাইয়ের মাথা ফা’টিয়েছি বলে বিচার বসিয়েছেন। যখন স্কুলে যাওয়ার সময় ওড়না টেনে ধরতো আপনার এই গুণধর ভাই তখন কোথায় ছিলেন আপনি আর আপনার বিচার? যখন রাস্তা ঘাটে মেয়েদের একা পেয়ে তার ভীষণ গোপন জায়গায় আপনার ভাই হাত ছোঁয়াতো তখন কই ছিলেন আপনি আর আপনার বিচার? যখন বিয়ে বাড়িতে সকলের সামনে আমার শাড়ি ছিঁ’ড়ে অপমান করছিলো আপনার এই ভাই তখন কেথায় ছিলেন আপনি আর আপনার বিচার? কাল যখন রাস্তায় আমার হাত ধরে জোড়াজুড়ি করছিলো তখন কোথায় ছিলেন আপনারা? আজ যখন আপনার এই অনেক গুণওয়ালা ভাই আমাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করছিলো তখন কোথায় ছিলেন আপনারা? আর আমি প্রতিবাদ করে অন্যায় করে ফেলেছি! হ্যাঁ তাহলে করেছি আমি অন্যায়। এমন অন্যায় আমি আজীবন করবো। পারলে ঠেকিয়ে দেখান! আর এই গ্রামের হয়তো একটা মেয়েও আওয়াজ তুলবে না! বলবে না তাদের সাথে আপনার গুণধর ভাই কি কি করার চেষ্টা করেছে তবে আমি এই সন্ধ্যা একাই যথেষ্ট।’

পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। ফরিদ চোরের মতো মুখ লুকাচ্ছে। সে ভাবতেই পারেনি সন্ধ্যা এসব বলতে পারে! আয়াশ, রানা, আকাশ, তমাল, সাফি সবাই রাগে রীতিমতো ফুঁসছে। পারলে এখনই ফরিদকে দুই ভাগ করে ফেলে। কয়েকজন মেয়ে ভীড় ঠেলে ভেতরে আসে। ফিরোজ কিছু বলার আগেই একজন একজন করে বলতে থাকে ফরিদের কু’কর্মের কথা। ফরিদ সবার সাহস দেখে অবাক হয়। একজন আওয়াজ তুলেছে বলে সবাই তুলছে? ফিরোজ বিচার করতে এসে নিজেই বিপদে পড়ে গেলে। সবার সামনে ঠাস করে থা’প্পড় বসিয়ে দিলো ভাইয়ের গালে। সন্ধ্যা তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বলে,

‘লোক দেখানো থা’প্পড় মা’রার কোনো দরকার নাই চাচা। বরং আপনার ভাইকে আমরা সব মেয়েদের হাতে দেন। জীবনের মতো একটা শিক্ষা দিবো সবাই।’

ফিরোজ চেঁচিয়ে উঠতেই পেছন থেকে আয়াশ বলে, ‘চেঁচামেচি কম করেন চেয়ারম্যান সাহেব। যার যার সাথে আপনার ভাই অ’ন্যায় করছে তারাই আপনার ভাইকে শাস্তি দেবে। আর যদি বলেন তাহলে আমি পুলিশ ডাকতে পারি।’

পাশ থেকে রানা বলে, ‘হ্যাঁ। আয়াশ আঙ্কেলই তো পুলিশ অফিসার। উনাকেই বরং কল কর। আর আমি আব্বুকে কল করে বলবো যেনো এমন ভাবে কেইস লড়ে যাতে এই লোক কিছুতেই জেল থেকে বের না হতে পারে!’

পাশ থেকে আকাশ ফিসফিস করে বলে, ‘আয়াশের বাবা পুলিশ অফিসার, রানার বাবা নাকি উকিল ভাই তাইলে কি আমার বাপ গোয়েন্দা!’

চেয়ারম্যান আর কিছু বলতে পারে না। আয়াশ এগিয়ে এসে সন্ধ্যা এবং বাকি মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলে, ‘নিজেদের ইচ্ছা মিটিয়ে আসো।’

আয়াশ বলতে দেড়ি করলেও সন্ধ্যার এগোতে দেড়ি হয়নি। পা থেকে স্যান্ডেল নিয়ে ধপাধপ মুখের ওপর বসিয়ে দেয়। আজ যেনো সন্ধ্যার সাহসে সবাই সাহস পেলো। সবাই গিয়ে একে একে মে’রে আসে ফরিদকে। দুর থেকে এ দৃশ্যে একজন প্রশান্তির হাসি হাসে…

চলবে…

#সন্ধ্যামালতী (০৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

সন্ধ্যার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে তার রেজাল্ট বের হওয়ার ২ দিন পরই। রেজাল্ট বের হতে এখনো ১২-১৫ দিন বাকি। সবাই খুশি এই বিয়েতে শুধু সন্ধ্যা চুপচাপ। সে কি করে বুঝাবে তার কিশোরী মন কি চায়? বকুল তো খুশিতে নাচানাচি শুরু করছে। বাদল এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। সন্ধ্যা তখনো তার নিজস্ব ভাবনায় বিভোর। বাদল এসে আস্তে করে ডাকে,

‘সন্ধ্যা!’

সন্ধ্যা চমকে তাকায়। তারপর মাথা নিচু করে নেয়। বাদল হেঁসে বলে, ‘তোর কি কিছু হয়ছে? বিয়েতে তুই খুশি না?’

সন্ধ্যা কি বলবে খুঁজে পায় না। চোখ বার বার এদিক ওদিক করতে থাকে। বাদল ফের বলে, ‘তোর কোনো সমস্যা থাকলে এখনই বল। নির্ভয়ে বল।’

সন্ধ্যা কিছু বলার আগেই সাহেদা পেছন থেকে বলে ওঠে, ‘হের কি সমস্যা থাকতো বাজান? তুমি শান্তিতে থাহো। বিয়া অইবো।’

সন্ধ্যা আর কিছু বলতে পারে না। চুপ করেই থাকে। বাদল হেঁসে বলে, ‘তবুও একবার সন্ধ্যার থেকে শুনি চাচি। ‘ও’ কি চায়?’

সন্ধ্যা মাথা নিচু করেই বলে, ‘আম্মা যা চাই আমিও তাই চাই বাদল ভাই।’

বাদল নিঃশব্দে হেঁসে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সাহেদা অতিথি আপ্যায়ন করে সবাইকে বিদায় দিয়ে নিজে চলে যায় কাজে। সন্ধ্যা আয়াশদের সেখানে যাবে না যাবে না করেও পা বাড়ায় সেদিকে। বকুল তো সবার সাথে বাড়ি চলে গেছে। সন্ধ্যা রাস্তায় বের হতেই ফরিদের সাথে দেখা হয়। সন্ধ্যা চোখ মুখ শক্ত করে এগোতে নিলে ফরিদ এগিয়ে আসে। সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে যায়। ফরিদ এগিয়ে এসে সন্ধ্যার গাল চেপে ধরে বলে,

‘সেদিন তো বাড়িতে বটি নিয়ে এগিয়ে আসলি। আজ কেমনে বাঁচবি?’

সন্ধ্যা এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে অদ্ভুত ভাবে হেঁসে বলে, ‘কাকা আপনিও না! বাড়ির বাইরে নারী দুর্বল ভাবা লোক নিজেই বড় দুর্বল।’

বলেই পিছিয়ে যায়। ফরিদ সন্ধ্যার কোমড়ের শাড়ি টেনে ধরে। রাগে গা জ্বলে উঠে সন্ধ্যার। পাশে থাকা ইটের টুকরো তুলে নেয় হাতে। কিছু না ভেবেই ছুড়ে মারে ফরিদের দিকে। ভাগ্যবশত ইটের টুকরো টা সরাসরি ফরিদের কপালে লাগে। সাথে সাথে ফেটে গিয়ে টুপটাপ করে রক্ত পড়তে থাকে। সন্ধ্যার সেসব দেখার টাইম নাই। নিজের মতো হেলতে দুলতে চলে আসে। ফরিদ মাথা চেপে বসে পড়ে সেখানে।

সন্ধ্যা আনমনে হেঁটে আসে পুকুর পাড়ে। সেখানে চোখ পড়তেই দেখে দাঁড়িয়ে আছে আয়াশ। সন্ধ্যার মাথায় মুহুর্তেই দুষ্টু বুদ্ধি আসে। পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে আয়াশের কাছে। পেছন থেকে শব্দ করে ‘ভাউ’ করে উঠে। আয়াশ চমকে পেছনে তাকাতেই ভর সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে সন্ধ্যা দ্রুত এসে হাত ধরে। এত ভার তো সে সামলাতে পারে না ফলে দুজনেই একসাথে উল্টে পড়ে পানিতে। হুড়মুড় করে পড়ায় দুজনেই যথেষ্ট পানি খেয়ে বসে। ডুব দিয়ে উঠে দুজনেই আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে একে অপরের দিকে। সন্ধ্যার সৌন্দর্যে যেনো আরো একবার চোখ ধাধালো আয়াশের। ছোট ছোট চুলগুলো মুখের সাথে লেপ্টে গেছে। বিন্দু বিন্দু পানির কণা জমা আছে মুখে। ঠোঁট গুলো তিড়তিড় করে কেঁপে উঠছে বারংবার। আয়াশ দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। এ রুপের দিকে তাকালেই তার চোখ ধাঁধিয়ে আসে আর যারা বাজে নজরে তাকায় তাদের কেন চোখ ঝ’লসে যায় না! আয়াশের ভাবনার মাঝেই ভেসে আসে রানার কন্ঠ। আয়াশ সেদিকে তাকাতেই রানা বলে,

‘কিরে দুজনে কি পানিতে সাঁতার কাটতেছিস নাকি?’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে উঠে আসে। কিন্তু সন্ধ্যা পানিতেই থেকে যায়। আয়াশ জেরিনকে ইশারায় কিছু বলতেই জেরিন মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। লিজা বলে,

‘সন্ধ্যা তোমার তো ঠান্ডা লেগে যাবে!’

‘সমস্যা নেই আপু। পুকুরে গোসল করার স্বভাব আমাদের আছে সে হিসেবে আমার না শহুরে ডাক্তারের ঠান্ডা লাগতে পারে।’

আয়াশ চুল থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। পাশ থেকে আকাশ বলে, ‘মাম্মা কাহিনি কি? আজকাল তুমি পুকুরে ভেসে বেড়াচ্ছো!’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই আকাশ গান ধরে, ‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না..’

পাশ থেকে সাফি শুকনো ঢোক গিলে বলে, ‘দোস্ত তোদের আবার ভুত বা পেত্নী ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি তো? লা হাওলা ওয়ালা…

এটুকু বলতেই রানা বলে, ‘হা’রা’ম’জা’দা তোর ভুতের কাছেই আজকে তোরে রেখে যাবো।’

বলেই সাফির পেছনে জোড়ে একটা লা’থি দেয়। সাফি ধপাস করে পানিতে পড়ে। সন্ধ্যা ভয়ে পানির মধ্যেই পড়ে যেতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। সাফি পানিতে থতমত খেয়ে রানাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘শা’লা তুই আমারে পানিতে ফেললি কেন হা’রামি?’

তমাল গালে হাত দিয়ে বলে, ‘রানা তুই কবে তোর বোনের সাথে ওর বিয়ে দিলি?’

রানা ভেংচি কেটে দুপা এগিয়ে বলে, ‘আমার তো বোন বেশি হয়ছে যে ওর মতো ভুতে ভয় পাওয়া ছা’গলের সাথে আমার বোনের বিয়ে দিবো!’

সবাই শব্দ করে হেঁসে দেয়। সাফি ব্যঙ্গ করে বলে, ‘কপালে যদি লেখা থাাকে আমি তোর দুলাভাই হমু তাইলে তুই আটকাবি কেমনে?’

‘তাইলে তোরে প্রতিদিন ভুতের সাথে মিট করাবো।’

সবাই হু হা করে হাসতে থাকে। জেরিন একটা শুকনো টাওয়েল এনে সন্ধ্যার দিকে বাড়িয়ে দেয়। বলে,

‘এটা গায়ে দিয়ে উঠে আসো সন্ধ্যা। বেশিক্ষণ পানিতে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।’

সন্ধ্যা চুপচাপ টাওয়েল গায়ে জড়িয়ে উঠে আসে। ততক্ষণ ছেলেরা সবাই অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেদের মতো গল্প করতে থাকে। আয়াশ সবাইকে ইগনোর করে চলে যায়। সন্ধ্যাকে নিয়ে জেরিন ভিতরে যায়। সাফিও উঠে আসে পানি থেকে। রানা বলে,

‘দোস্ত তোদের মনে হয় না আয়াশ আর সন্ধ্যার মধ্যে কিছু চলছে!’

লিজা বলে, ‘চলছে না বাট সামথিং ইজ ফিসি।’

তমাল ঝাড়ি মেরে বলে, ‘তোর হাইফাই ইংলিশ নিজের বয়ফ্রেন্ডের পকেটে রাখ। আমার মনে হয় আয়াশ আর সন্ধ্যা একে অপরকে একটু একটু পছন্দ করে।’

সাফি বলে, ‘তাই বলে দুদিনে!’

আকাশ সাফির মাথায় গাট্টা মেরে বলে, ‘আরেহ ভালোবাসতে কি যুগ যুগ লাগে নাকি?’

লিজা বলে, ‘তবুও দুদিনে হয়তো ভালোবাসা পর্যন্ত যায়নি। ভালো লাগা তো হবেই।’

রানা গদগদ স্বরে বলে, ‘দোস্ত এই দুইটার ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা পর্যন্ত আমাদেরই আনতে হবে।’

সবাই একসাথে হাত মিলায়। সাফি বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলে, ‘আমার জন্য কারো কোনো চিন্তাই নাই।’

জেরিন আর সন্ধ্যা ভিতরে আসতেই সাহেদা তাকে দেখে। এগিয়ে আসে দ্রুত। বলে, ‘সন্ধ্যা ভিজ্জোস কেমনে?’

‘পুকুরে পড়ে গেছিলাম আম্মা।’

‘হায় আল্লাহ কতক্ষণ ধইরা এমনে আছোস? ঠাান্ডা লাইগা যাইবো।’

জেরিন বলে, ‘কাম ডাউন আন্টি। আমি ওকে আমার কাপড় দিচ্ছি। ‘ও’ এখন পড়ে নিক।’

সাহেদা কিছু বলতে গেলে থামিয়ে দেয় জেরিন। তারপর সন্ধ্যাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে কাপড় পাল্টে নিতে বলে। জেরিন তার একটা থ্রি পিস দেয় পড়তে। সন্ধ্যার একটু ঢিলাঢালা হলেও চুপ করে পড়ে নিয়ে মাথায় কাপড় টেনে নেয়। তারপর বাহিরে আসে। সন্ধ্যা সাহেদার জন্য বসে থাকে আর বাকি সবাই কাজে লেগে পড়ে।

বিকেলের দিকে সবাই সাহেদার কাছে আবদার করে আজ তারা সন্ধ্যাকে যেতে দিবে না। সাহেদা প্রথমে না করলেও পরে আর কিছু বলে না। থাকতে দেয়। সবাই তো মহাখুশি। সাহেদা কাজ শেষ করতে করতে ছুটে আসে বকুল। বকুলকে দেখে সন্ধ্যা কিছু বলতে যাবে তার আগেই বকুল গড়গড় করে সাহেদাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘চাচি জলদি চেয়ারম্যানের বাড়ি চলেন। সন্ধ্যা নাকি ফরিদ কাকার মাথা ফা’টায় দিছে এখন চেয়ারম্যান সবাইকে নিয়ে বিচার বসিয়েছে।’

সাহেদা অবাক হয়ে তাকায় মেয়ের দিকে। বাকি সবাইও অবাক হয়। সন্ধ্যা স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। সাহেদা সন্ধ্যার কাছে এসে বলে, ‘এইডা তুই কি করছোস? বকুল যা কইলো তা কি সত্যই?’

সন্ধ্যার মায়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, ‘বিচার যখন বসিয়েছে আর আমাদের খোঁজও লাগিয়েছে তখন তো যেতেই হবে। চলো।’

সাহেদা ভাষা হারিয়ে ফেলে। ওরা যা খারাপ তাতে করে মেয়েটাকে ছাড়বে তো? সাহেদাকে নির্বাক দেখে এগিয়ে আসে সন্ধ্যা। কাছে এসে মায়ের মুখ আজলে নিয়ে বলে,

‘তোমার মেয়ের ওপর তোমার ভরসা নাই আম্মা? তোমার সন্ধ্যা কখনো অন্যায় করছে?’

সাহেদা মাথা নাড়ায়। সন্ধ্যা নিঃশব্দে হেঁসে মায়ের হাত ধরে বাড়ির বাইরে আসে। পেছন পেছন আয়াশরাও আসে। বকুলও আছে সাথে। আয়াশ পেছন থেকে বলে,

‘তোমাদের একা যাওয়া ঠিক হবে না। আমরাও যাবো।’

বাকি সবাইও সম্মতি দেয়। নিঃশব্দে ঠোঁট কামড়ে হাসে সন্ধ্যা। দুদিনেই লোকটাকে তার অনেকটা জানা হয়ে গেছে। তার কিশোরী মন হয়তো জানতো যে আয়াশ তার সাথে যাবে। সবাই মিলে চলে আসে চেয়ারম্যান বাড়িতে। অনেক লোকজন সেখানে জড়ো হয়েছে। সন্ধ্যাদের দেখে সবাই কিছুটা সরে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা আর সাহেদা গিয়ে ফরিদরা যে পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার অপর পাশে দাঁড়ায়। তাদের পেছনে দাঁড়ায় আয়াশরা। চেয়ারম্যান ফিরোজ গম্ভীর গলায় সন্ধ্যাকে বলে,

‘আজকাল তোর সাহস বেড়েছে নাকি সন্ধ্যা? তুই ফরিদের মাথা ফা’টিয়েছিস?’

সন্ধ্যার সহজ স্বীকারোক্তি, ‘হ্যাঁ।’

সন্ধ্যার সহজেই স্বীকার করে নেওয়ায় নড়েচড়ে বসে সবাই। ফিরোজ আরো গম্ভীর আর জোড়ে বলে উঠে, ‘কোন সাহসে তুই আমার ভাইয়ের মাথা ফা’টিয়েছিস? কাল নাকি ওরে বটি পর্যন্ত দেখায়ছিস! রিনিকে থা’প্পড় মে’রেছিস!’

‘হ্যাঁ।’

এবার যেনো ক্ষেপে উঠে ফিরোজ। জোড়ে চিল্লিয়ে বলে, ‘অন্যায় করে আবার জোড় গলায় বলছিস!’

সন্ধ্যা হেঁসে উঠে। বলে, ‘অন্যায়? প্রতিবাদ করলেই তা অন্যায়? আমি আপনার ভাইয়ের মাথা ফা’টিয়েছি বলে বিচার বসিয়েছেন। যখন স্কুলে যাওয়ার সময় ওড়না টেনে ধরতো আপনার এই গুণধর ভাই তখন কোথায় ছিলেন আপনি আর আপনার বিচার? যখন রাস্তা ঘাটে মেয়েদের একা পেয়ে তার ভীষণ গোপন জায়গায় আপনার ভাই হাত ছোঁয়াতো তখন কই ছিলেন আপনি আর আপনার বিচার? যখন বিয়ে বাড়িতে সকলের সামনে আমার শাড়ি ছিঁ’ড়ে অপমান করছিলো আপনার এই ভাই তখন কেথায় ছিলেন আপনি আর আপনার বিচার? কাল যখন রাস্তায় আমার হাত ধরে জোড়াজুড়ি করছিলো তখন কোথায় ছিলেন আপনারা? আজ যখন আপনার এই অনেক গুণওয়ালা ভাই আমাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করছিলো তখন কোথায় ছিলেন আপনারা? আর আমি প্রতিবাদ করে অন্যায় করে ফেলেছি! হ্যাঁ তাহলে করেছি আমি অন্যায়। এমন অন্যায় আমি আজীবন করবো। পারলে ঠেকিয়ে দেখান! আর এই গ্রামের হয়তো একটা মেয়েও আওয়াজ তুলবে না! বলবে না তাদের সাথে আপনার গুণধর ভাই কি কি করার চেষ্টা করেছে তবে আমি এই সন্ধ্যা একাই যথেষ্ট।’

পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। ফরিদ চোরের মতো মুখ লুকাচ্ছে। সে ভাবতেই পারেনি সন্ধ্যা এসব বলতে পারে! আয়াশ, রানা, আকাশ, তমাল, সাফি সবাই রাগে রীতিমতো ফুঁসছে। পারলে এখনই ফরিদকে দুই ভাগ করে ফেলে। কয়েকজন মেয়ে ভীড় ঠেলে ভেতরে আসে। ফিরোজ কিছু বলার আগেই একজন একজন করে বলতে থাকে ফরিদের কু’কর্মের কথা। ফরিদ সবার সাহস দেখে অবাক হয়। একজন আওয়াজ তুলেছে বলে সবাই তুলছে? ফিরোজ বিচার করতে এসে নিজেই বিপদে পড়ে গেলে। সবার সামনে ঠাস করে থা’প্পড় বসিয়ে দিলো ভাইয়ের গালে। সন্ধ্যা তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বলে,

‘লোক দেখানো থা’প্পড় মা’রার কোনো দরকার নাই চাচা। বরং আপনার ভাইকে আমরা সব মেয়েদের হাতে দেন। জীবনের মতো একটা শিক্ষা দিবো সবাই।’

ফিরোজ চেঁচিয়ে উঠতেই পেছন থেকে আয়াশ বলে, ‘চেঁচামেচি কম করেন চেয়ারম্যান সাহেব। যার যার সাথে আপনার ভাই অ’ন্যায় করছে তারাই আপনার ভাইকে শাস্তি দেবে। আর যদি বলেন তাহলে আমি পুলিশ ডাকতে পারি।’

পাশ থেকে রানা বলে, ‘হ্যাঁ। আয়াশ আঙ্কেলই তো পুলিশ অফিসার। উনাকেই বরং কল কর। আর আমি আব্বুকে কল করে বলবো যেনো এমন ভাবে কেইস লড়ে যাতে এই লোক কিছুতেই জেল থেকে বের না হতে পারে!’

পাশ থেকে আকাশ ফিসফিস করে বলে, ‘আয়াশের বাবা পুলিশ অফিসার, রানার বাবা নাকি উকিল ভাই তাইলে কি আমার বাপ গোয়েন্দা!’

চেয়ারম্যান আর কিছু বলতে পারে না। আয়াশ এগিয়ে এসে সন্ধ্যা এবং বাকি মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলে, ‘নিজেদের ইচ্ছা মিটিয়ে আসো।’

আয়াশ বলতে দেড়ি করলেও সন্ধ্যার এগোতে দেড়ি হয়নি। পা থেকে স্যান্ডেল নিয়ে ধপাধপ মুখের ওপর বসিয়ে দেয়। আজ যেনো সন্ধ্যার সাহসে সবাই সাহস পেলো। সবাই গিয়ে একে একে মে’রে আসে ফরিদকে। দুর থেকে এ দৃশ্যে একজন প্রশান্তির হাসি হাসে…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here