#সন্ধ্যামালতী,১০,১১
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
১০
সন্ধ্যার জ্বর ছেড়েছে দুইদিন পর। এই দুদিন সন্ধ্যা আয়াশদের ওখানে আর যায়নি তবে আয়াশরা সবাই এসে দেখে গেছে। বাদল আর বকুলও দুই বেলা করে নিয়ম করে দেখে গেছে। অনেক সময় বকুল থেকেই গেছে সন্ধ্যার কাছে। যতটা সময় সন্ধ্যা বাড়িতে থাকতো ততোটা সময় ছটফট করতো। বকুল জিজ্ঞেস করলেই বলতো, ‘ভালো লাগছে না’। বকুলও আর কিছু জিজ্ঞেস করতো না। সন্ধ্যা সুস্থ হতেই টইটই করে পুরো গ্রাম ঘুরে ফেলেছে। বকুল কাজ করছে বাড়িতে তাই আর বিরক্ত করে নি। একা একাই অনেকটা পথ হেঁটে আবার ঘুরে আয়াশদের ওখানে যায়। সবাই ব্যস্ত কাজে। তাই সন্ধ্যা কাউকে কিছু না বলেই পুকুর ঘাটে চলে আসে। বকুল গাছে উঠে বকুল ফুল পাড়তে থাকে। সেসময় সেখানে আসে সাফি। বকুল গাছে কাউকে নড়াচড়া করতে দেখে ‘ভুত ভুত’ বলে চিৎকার করে উঠে। ঘটনার আকস্মিকতায় সন্ধ্যা গাছ থেকে পড়ে যেতে নিলে কোনো রকমে একটা ডাল ধরে নেয়। ততক্ষণে সাফি দৌড়। সন্ধ্যা নিচে নেমে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে সেদিকে। কি হলো তার মাথার ওপর দিয়ে গেলো। তার দু মিনিট বাদেই সবাই হাজির। সন্ধ্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লিজা বলে,
‘আরে সন্ধ্যা কখন আসলে? তোমার জ্বর ভালো হয়ে গেছে।’
সন্ধ্যা মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘একটু আগে আসছি আপু। তোমরা কাজ করছিলে তাই বিরক্ত না করে এখানে চলে আসছি।’
জেরিন একবার সাফির দিকে আরেকবার সন্ধ্যার দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘তুমি তো এখানেই ছিলে কোন ভুত টুত দেখছো?’
সন্ধ্যা বলে, ‘কিসের ভুত? আমি বকুল গাছে উঠে বকুল ফুল পাড়তেছিলাম সে সময় উনি আসলো আর চেঁচিয়ে উঠলো। আমি তো উনার চিৎকারে গাছ থেকেই পড়েই যাচ্ছিলাম।’
রানা সাফির পেছনে এক লা’থি দিয়ে বলে, ‘হা’রা’ম’জা’দা দেখ ভুত। কইলাম দিন দুপুরে ভুত নাই উনি ভুতের ভয়ে প্যান্টে হিসু করে দিচ্ছে!’
আকাশ আর তমাল শব্দ করে হেঁসে দেয়। সাফি নরম গলায় বলে, ‘আরেহ আমি ওকে দেখে ভাবছি ভুত।’
সন্ধ্যা হেঁসে বলে, ‘আপনি এতো ভুতে ভয় পান কেন? মানে ভুত টুত কখনো দেখছেন নাকি?’
জেরিন হাসতে হাসতে বলে, ‘আরেহ ব’ল’দের দাদি বলছিলো গ্রামে ভুত থাকে তারপর থেকে ভয় পায়।’
আয়াশ বলে, ‘তুমি তো আস্ত একটা ভুত’ই। তোমাকে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক।’
সন্ধ্যা হা করে তাকায় আয়াশের দিকে। তাকে দেখতে কি ভুতের মতো লাগে নাকি? আজব কথা। সন্ধ্যা কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘আমারে দেখতে কি ভুতের মতো লাগে আপনার?’
আয়াশ পাত্তাই দেয় সন্ধ্যার রাগ৷ বলে, ‘তা নয় তো কি? দিন দুপুরে যদি গাছে উঠে বসে মানুষকে ভয় দেখাও তাহলে তো মানুষ ভয় পাবেই৷ তাছাড়া তোমার জ্বর ভালো হয়েছে মাত্র আর এখনি কি গাছে উঠে আবার হাত পা ভেঙে কয়েকদিন বিছানায় পড়ে থাকার সুযোগ খুঁজতেছো?’
সন্ধ্যা কিছু বলতে যাবে তার আগে জেরিন বলে, ‘থাম থাম। সন্ধ্যা মোটেও দেখতে ভুতের মতো না। সাফির চোখ ভুতের মতো তাই ‘ও’ সারাদিন ‘ভুত ভুত’ করে।’
সাফি সাথে সাথেই নিজের চোখে হাতে দেয়। রানার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দোস্ত আমার চোখ ভুতের মতো?’
রানা কাঁদো কাঁদো ফেইস নিয়ে তাকায়। বলে, ‘লা’থিটা কোথায় খাবি ভাই? সামনে নাকি পেছনে?’
সাফি রানার থেকে দুই হাত দুরে গিয়ে দাঁড়ায়। বাকি সবাই হাসতে থাকে। সন্ধ্যা লিজাকে বলে,
‘তোমাদের কি কাজ শেষ?’
‘হুম। পেশেন্টই তো নাই৷ বুঝলাম না কিছু এতো কম পেশেন্ট!’
‘গ্রামের লোকজন রা ডাক্তারি উপায়ের থেকে অন্যান্য গাছালি পদ্ধতি বেশি ব্যবহার করে।’
‘হুম তাও ঠিক।’
‘আচ্ছা আসো৷ বসে গল্প করি।’
তারপর সবাই শান বাঁধানো পাথরে বসে। আয়াশ ফোন নিয়ে এক কোণায় বসে গেইম খেলতে থাকে। বাকিরা আড্ডা দেওয়া শুরু করে। সন্ধ্যা বার কয়েক আড় চোখে আয়াশের দিকে তাকিয়েছিলো তারপর নিজের মতো আড্ডা দেয়। কথার এক পর্যায়ে জেরিন বলে,
‘আচ্ছা সন্ধ্যা বকুল বাদে তোমার আর কোনো ফ্রেন্ড নাই?’
এই সময় জেরিন এমন প্রশ্ন করতে পারে তা কারোরই মাথায় ছিলো না। আয়াশ ফোন থেকে চোখ তুলে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার চোখে মুখে মলিনতা আর চাপা রাগ ফুটে ওঠে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘ছিলো। মা’রা গেছে।’
জেরিন ‘সরি’ বলে। সন্ধ্যা বলে, ‘ইটস ওকে আপু।’
লিজা আমতা আমতা করে বলে, ‘তোমার ফ্রেন্ডরা কিভাবে মা’রা গেছে সন্ধ্যা?’
সন্ধ্যা কিছুটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর মলিন হেঁসে বলে, ‘আত্মহত্যা।’
আয়াশ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন? কি এমন কারণে এতো বড় একটা কাজ করলো তোমার ফ্রেন্ড?’
সন্ধ্যা আয়াশের দিকে তাকায় না। এই মানুষটার দিকে তাকালেই সে নিজেকে সামলাতে পারে না। কয়েকদিনের পরিচয়ের একটা মানুষ তার এতো আপন কিভাবে হলো? নিজের ভাবনাকে দুরে ঠেলে তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বলে,
‘সেদিন বলেছিলেন না এর আগে গ্রামে ফরিদ কাকার মতো আরো কাউকে মে’রে ফেলা হয়ছে! হুম। চেয়ারম্যান কাকা আর মেম্বার কাকার ছেলেরে মে’রে ফেলছে। ওই চেয়ারম্যান কাকার ছেলে আর মেম্বার কাকার ছেলের জন্য আমার সইয়েরা আত্মহত্যার মতো পাপকে বেছে নিয়েছে।’
কথাগুলো তো সবাই জানতো। তবুও সবাই দুঃখ প্রকাশ করে। সন্ধ্যা রহস্যময় এক হাসি বলে, ‘আরেকজন ছিলো ওকেও কেউ মে’রে ফেলছে। ওই যে আপনারা আসার পরেরদিন যে মেয়েটাকে মে’রে ফেলা হয়ছে ‘ও’ আমাদের সই ছিলো।’
লিজা বলে, ‘ওকে কেউ কেন মা’রলো?’
সন্ধ্যা চোখ বুজে বড় করে শ্বাস নেয়। বলে, ‘জানি না।’
আয়াশ বলে, ‘তোমার ফ্রেন্ড মা’রা গেলো আর তুমি তার বিষয়ে একটু কষ্টও পাচ্ছো না!’
সন্ধ্যা হেঁসে বলে, ‘বেই’মানদের জন্য কষ্ট পেতে নেয়।’
কথাাটা যেনো মুহুর্তেই পরিবেশকে অশান্ত করে তুললো। কিসের বে’ইমানির কথাা বলছে সন্ধ্যা? লিজা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কিসের বে’ইমানি সন্ধ্যা?’
সন্ধ্যা হাসে। বকুল ফুল নাড়াচাড়া করতে করতে গুণগুণ করে গান ধরে। আয়াশ অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সন্ধ্যার দিকে তাকায়। এই সন্ধ্যা ভীষণ রহস্যময়। যতটা এর সৌন্দর্যের গভীরতা ততটাই রহস্যেরও গভীরতা। কিছু তো আছে যা জানে সন্ধ্যা আর নয়তো এসবের সাথে জড়িত। কিছুক্ষণ চুপ থাকে সবাই। সন্ধ্যা গান গাওয়া অফ করে সবার দিকে তাকায়। বলে,
‘কি হলো? সবাই চুপচাপ হয়ে গেলে কেন?’
লিজা আর জেরিন শুকনো ঢোক গিলে। বাকি সবাই নিজেদের গুছিয়ে নেয়। বলে, ‘তোমার গান শুনছিলাম।’
সন্ধ্যা হাসে। এক পলক আয়াশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে উঠে আসে আয়াশের সামনে। আয়াশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকায় তার দিকে। সন্ধ্যা হেঁসে বলে,
‘ফুল নিবেন শহুরে ডাক্তার?’
আয়াশ কিছুক্ষণ ফুলের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যা সব ফুল আয়াশকে দিয়ে বলে, ‘এখন তবে যায়। পরে আসবো আবার।’
লিজা মাথা নাড়াতেই সন্ধ্যা চলে যায় হেলে দুলে। লিজা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে বলে, ‘আ’ম কনফিউজড ইয়ার। কোন সন্ধ্যা সত্যি? এই স্নিগ্ধ রুপের সন্ধ্যাকে দেখলে কখনোই মনে হয় না ‘ও’ কোনো মা’র্ডার করতে পারে আবার সন্ধ্যার রহস্যময় কথা শুনলে অটোমেটিক মাথায় চলে আসে ‘ও’ নিশ্চয় এর সাথে জড়িত।’
রানা বলে, ‘হয়তো সন্ধ্যা কিছু জানে তবে আমার মনে হয় না সন্ধ্যা মাস্টারমাইন্ড!’
আকাশ বলে, ‘হ্যাঁ আমারও মনে হয় না। আর যদি ‘ও’ এসব করে থাকে তাহলে বলবো ভালো কাজ করছে। যাদের মা’র্ডার করছে তারা এমনিতেও বেঁচে থাকার যোগ্যতা রাখে না।’
জেরিন সায় দেয়। আয়াশ বাঁকা হেঁসে বলে, ‘কিন্তু মুন্নি কি করছে? অবশ্যই মুন্নিকে মা’রার পেছনে বড় সড় কোনো কারণ আছে নয়তো সন্ধ্যা ওকে বে’ইমান বলতো না। কিছু তো আছে।’
সন্ধ্যা রাস্তায় এসে হেলে দুলে হাঁটতে থাকে। কি মনে করে আবার উল্টো ফিরে কবরস্থানের দিকে হাঁটা দেয়। কবরস্থানের সামনে শুনশান। সন্ধ্যা এসে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকায়। বৃষ্টির কারণে কবরের মাটি সরে গেছে তবুও নতুন দুইটি কবর জ্বলজ্বল করছে। সেই দুইটি কবরের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে সন্ধ্যা। তারপর পুরোনো কবর গুলোর দিকেও তাকায়। নিজের প্রিয় তিনটি কবরের দিকে এক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। সে সময় কেউ কাধে হাত রাখে। চমকে তাকায় সন্ধ্যা। সামনে বাদলকে দেখে খানিকটা হাসে। বাদল ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘তুই এসময় এখানে কি করছিস? কাকার কবর দেখতে এসেছিস?’
সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। বাদল সন্ধ্যার হাত ধরে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘তুই মাত্র জ্বর থেকে উঠেছিস এখনই এমন উড়নচণ্ডীর মতো পুরো এলাকা রাউন্ড দিচ্ছিস কেনো?’
সন্ধ্যা খিলখিল করে হেঁসে বলে, ‘সন্ধ্যামালতীর কাজই তো এটা বাদল ভাই।’
সন্ধ্যার দিকে নিষ্পলক তাকায় বাদল। মেয়েটার হাসিতেও কি ভীষন রকমের মায়া! বাদল চোখ সরিয়ে নেয়। সন্ধ্যা কিছু একটা ভেবে বলে, ‘বাদল ভাই চলেন তো মুন্নির বাড়ি যায়।’
বাদল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ওখানে কেন যাবি?’
‘চলেন দেখে আসি ওর বাড়ির কি অবস্থা!’
বাদল আর না করে না। পাশাপাশি দুজনে হাঁটতে থাকে। দুর থেকে একজন দেখে এ দৃশ্য। কার পাশে কাকে দেখে তার রাগ হচ্ছে তার জানা নেই। সন্ধ্যার পাশে বাদলকে দেখে তার রাগ হয় নাকি বাদলের পাশে সন্ধ্যাকে দেখে রাগ হয় জানা নেই।
________________
সকালের আলো ফুটতেই সন্ধ্যার ঘুম ভেঙে যায়। কেবল বিছানা ছেড়ে উঠেছে সে সময় ছুটে আসে বকুল। চোখ মুখ ফুলে আছে, বিধ্বস্ত চেহারা। সন্ধ্যা দ্রুত এগিয়ে আসে বকুলের কাছে। বকুল সন্ধ্যাকে জাপটে ধরে। শব্দ করে কেঁদে উঠে। সন্ধ্যা ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
‘কাঁদছিস কেন? তোর এই অবস্থা কেমনে হলো?’
কান্নার দমকে বকুল কথায় বলতে পারতেছে না। অনেক কষ্টে সন্ধ্যা বকুলকে শান্ত করে। বকুল ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, ‘ব-বাদল ভাইকে কারা যেনো অনেক মে’রে বাড়ির সামনে ফেলে গেছে।’
সন্ধ্যা চমকে ওঠে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘বাদল ভাই ঠিক আছে তো বকুল?’
বকুলের কান্নার দমক বেড়ে যায় কোনো রকমে বলে, ‘ভাইয়ের মাথা ফেটে গেছে। সবাই মিলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে সন্ধ্যা।’
সন্ধ্যা আর কোনো কথা না বলে বকুলের হাত ধরে ছুট লাগায়। তার মাথায় আসতেছে না এমন কাজ কে করতে পারে! তবে কি এবার শিকার বাদল ভাই? কথাটা মাথায় আসতেই গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় সন্ধ্যার। ছুটতে থাকে হাসপাতালের দিকে….
চলবে..
#সন্ধ্যামালতী (১১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
___________________
সন্ধ্যা আর বকুল হসপিটালে আসে। বাদলকে ইমার্জেন্সিতে রাখা হয়ছে। কোনো ডক্টরই দেখতেছে না। বকুলের মা, বোন কান্না করতেছে। বকুলের বাবা ডক্টরের কাছে ছুটতেছে কিন্তু কেউই কিছু করছে না। বাদলের যা অবস্থা তাতে এই মুহুর্তে রক্ত বন্ধ না হলে যা তা হতে পারে। সন্ধ্যা বকুলের মা’কে কোনোরকম সামলে বাদলের কাছে যায়। একটা বেডে ফেলে রাখছে নিথর শরীর। সন্ধ্যা কাঁপা কাঁপা হাতে বাদলের শরীর স্পর্শ করেই এক ঝটকায় দু পা পিছিয়ে যায়। শরীর শীতল, ঠান্ডা হয়ে আছে। সন্ধ্যা আবার এগোয় বাদলের কাছে। কি মনে করে মাথাটা বাদলের বুকে চেপে ধরে। কান পেতে শোনে হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ হচ্ছে কি না! ঠিক সেসময়ই সেখানে আয়াশ, রানা, আকাশ, তমাল, সাফি, লিজা আর জেরিন আসে। সবাই দেখে বাদলের বুকে সন্ধ্যার মাথা রাখার দৃশ্য। সবাই আয়াশের দিকে তাকায় । আয়াশ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে৷ জেরিন কোনোরকম সন্ধ্যাকে ডাকতেই সন্ধ্যা ঘুরে তাকায়। ছুটে আসে জেরিনের কাছে। বলে,
‘বাদল ভাইয়ের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। কোনো ডাক্তার হাতও লাগাচ্ছে না। এরকম হলে উনাকে বাঁচানো যাবে না আপু।’
জেরিন সন্ধ্যাকে বলে, ‘তুমি শান্ত হও। আমরা দেখতেছি।’
সন্ধ্যা জেরিনের কথা পাত্তা না দিিয়ে আয়াশের কাছে ছুটে আসে। আয়াশের শার্টের এক কোণা চেপে ধরে। চমকে উঠে আয়াশ। বাকি সবাইও অবাক চোখে তাকায়। সন্ধ্যার খেয়ালই নেই সে কি করছে! কোনো রকম বলে,
‘আপনারাা তো শহুরে ডাক্তার তাই না! বাদল ভাইকে বাঁচিয়ে দিন না শহুরে ডাক্তার।’
আয়াশ সন্ধ্যার উৎকন্ঠা দেখে কিছুক্ষণ। তারপর সন্ধ্যার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, ‘কিছু হবে না তোমার বাদল ভাইয়ের।’
এটুকু বলেই আয়াশ বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা ফের ছুটে আসে বাদলের কাছে। লিজা আর জেরিন সন্ধ্যার কাছে এসে বলে, ‘এতো পাগলামি করো না। শান্ত হও।’
সন্ধ্যা ভাঙা গলায় বলে, ‘আমার প্রিয় সবগুলো মানুষকে আমি রক্তাক্ত অবস্থায় দেখেছি। সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বাদল ভাই কে আমি ওই অবস্থায় দেখতে পারবো না। বাদল ভাই আমার সব সময় পাশে ছিলো, সব বিপদ থেকে আগলে রাখতো। আমি উনার এই অবস্থা মানতে পারতেছি না।’
লিজা আর জেরিন কিছু না বলে বের হয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পর অনেকটা তর্কাতর্কি করেই আয়াশ বাদলকে O.T তে নেয়। সন্ধ্যা, বকুল, বকুলের পরিবার সবাই বাহিরে বসে ছিলো পুরোটা সময়। সাহেদাও এসেছে। ২ ঘন্টা পর অপারেশন শেষ হয়। আয়াশ, রানা, আকাশও অপারেশনে ছিলো। তমাল আর জেরিন রক্ত দেয়। সবাই অপারেশন থেকে বের হয়ে আসে। আয়াশ সন্ধ্যার দিকে তাকায়। তারপর চলে যায়। রানা হেঁসে সন্ধ্যাকে বলে,
‘সন্ধ্যা চিন্তা করো না। অপারেশন সাক্সেকফুল।’
________________
বাদলকে কেবিনে দিছে কয়েকঘন্টা হলো। সন্ধ্যা কয়েকবার রাউন্ড দিছে হসপিটাল। একবার এখানে তো একবার ওখানে। মূলত কাউকে খুঁজছে! বাদলের সেন্স একবার এসেছিলো কিন্তু মাথায় ব্যাথা হতে পারে ভেবে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়ছে। সন্ধ্যা বকুলকে থাকতে বলে নিজে বের হয়ে আসে। হসপিটাল থেকে বের হয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে। পেছন থেকে হঠাৎ করেই কেউ ডেকে উঠে,
‘সন্ধ্যা!’
সন্ধ্যা নিজের নাম শুনে পেছনে তাকায়। পেছনে আয়াশকে দেখে খানিকটা অবাকই হয়। পুরো হসপিটালে যাকে খোঁজা শেষ সে এতক্ষণে কোথা থেকে আসলো? সন্ধ্যার ভাবনার মাঝেই আয়াশ কাছে চলে আসে। সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘বাড়ি যাচ্ছো?’
সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। আয়াশ বলে, ‘ওকে চলো একসাথে যায়।’
তারপর দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। সন্ধ্যা কিছুটা সময় চুপ থেকে বলে, ‘আপনি কি কোথাও গেছিলেন?’
‘কেনো বলো তো?’
‘আপনাকে তো হসপিটালে কোথাও দেখলাম না এখন কোথা থেকে আসলেন?’
আয়াশ কেমন ভাবে হাসে। সন্ধ্যা তাকিয়ে থাকে আয়াশের দিকে। হার্ট বিট করছে বারংবার। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এই মানুষটা আশে পাশে থাকলেই তো তার এমন হয়। কিন্তু কেন হয়? আবার এই মানুষটাকে না দেখলেই কেমন অস্থির অস্থির লাগে। কেন হয় তার সাথে এমন? সন্ধ্যার ভাবনার ছেদ পড়ে আয়াশের কথায়। আয়াশ ধীর কন্ঠে বলে,
‘ওদিকে একটা কাজ ছিলো। শেষ করতে গেছিলাম।’
‘ওহ’ বলে সন্ধ্যা চুপ হয়ে যায়। আয়াশ কিছুটা সময় পর জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি বাদল ভাইকে ভালোবাসো?’
চমকে ওঠে সন্ধ্যা। খানিকটা অবাকও হয়। সে বাদল ভাইকে ভালোবাসে মানে? বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আয়াশ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি? বলো!’
‘ভালোবাসা কি বা কাকে বলে আমার জানা নেই শহুরে ডাক্তার। তবে আমি ভালোবাসা মানে এটুকু বুঝি যে এটা এক অন্যরকম অনুভূতি যা বাদল ভাইয়ের ওপর আমার নেই।’
‘তাহলে বিয়ে কেন করছো?’
‘আপনি কেন বিয়ে করছেন?’
এমন প্রশ্নে কিছুটা অস্বস্তি হয় আয়াশের। সন্ধ্যা তাকে উল্টো জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারেনি। সন্ধ্যা আয়াশের উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি আপনার হবু বউকে ভালোবাসেন শহুরে ডাক্তার?’
আয়াশ চোখের দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। সে কি উত্তর দিবে বুঝতে পারে না। সন্ধ্যা মুচকি হেঁসে বলে, ‘কিছু সময় ভালো না বাসলেও বিয়েতে সম্মতি দিতে হয় আর তারওপর আমরা মেয়ে। আমাদের নিজস্ব কোনো মতামত থাকতে নেই। পরিবারের খুশি আমাদের খুশি।’
‘আজ হসপিটালে এতো পাগলামি করলে কেন যদি ভালোই না বাসো!’
সন্ধ্যা শব্দ করে হেঁসে দেয়। আয়াশ সে হাসির দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নেয়। এ মেয়ের সৌন্দর্য যেনো আগুন তাকালেই চোখ ঝলসে যাবে। সন্ধ্যা হাসি থামিয়ে বলে,
‘একটা মানুষ যদি আপনাকে সবসময় আগলে রাখে, সব বিপদে পাশে থাকে আপনি কি তার বিপদের সময় বসে থাকবেন? আমি পারি না শহুরে ডাক্তার। বাদল ভাইয়ের ওই অবস্থা দেখে আমি হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। মানুষটা আর বাঁচতোই না যদি না আপনারা থাকতেন! আপনাদের কাছে আমরা অনেক কৃতজ্ঞ।’
এরপর সব চুপচাপ হয়ে যায়। দুজনে নিজেদের মতো হাঁটতে থাকে কোনো কথা ছাড়াই। একজন নিজের অনুভূতিদের বুঝতে চেষ্টা করছে অন্যজন নিজ মনে কিছু ভাবছে। নিজেদের অনুভূতির সাথে লড়াই করতে করতেই একটা সময় দুজন দুদিকে যাওয়ার পথ আসে। আয়াশ নিজের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘যাও সাবধানে।’
সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। আয়াশ চলে যায়। সন্ধ্যা কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে ভাঙা ভাঙা স্বরে আওড়ায়, ‘এভাবেই আপনি একদিকে আর আমি আরেকদিক শহুরে ডাক্তার। আমার অন্যরকম অনুভূতি গুলো আপনার নামে দখলদার কিন্তু এ কথা আপনিও বুঝবেন না। এ অনুভূতি যদি ভালোবাসা হয় তবে আমি আপনাকে ভালোবাসি শহুরে ডাক্তার ভীষণ ভালোবাসি। যদি কয়েকদিনের পরিচয়ে একটা মানুষকে ভালোবাসা যায় তবে আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি জানি এ ভালোবাসা তুচ্ছ আপনার কাছে। তবে আমার এ শ্রেষ্ঠ অনুভূতি আমি কারো কাছে তুচ্ছ করবো না।’
তারপর পা বাড়ায় নিজেদের বাড়ির দিকে। আয়াশ সন্ধ্যার পথ এভাবেই দু পথের মাথায় গিয়ে হয়তো শেষ হবে। একজন ভালোবাসায় ডুবতেছে আরেকজন রহস্যের জালে ডুবতেছে। এ রহস্য শেষে সে পাড়ি জমাবে তার নীড়ে পড়ে রইবে শুধু সন্ধ্যামালতীর কঠিন অনুভূতি, ভালোবাসা।
আয়াশ দ্রুত বাড়িতে এসে দেখে সবাই বসে আছে। সবাইকে দেখে তাড়া দিয়ে বলে, ‘সবাই রুমে আয়। ফাস্ট!’
সবাই খানিকটা চমকায়। তারপর দ্রুত রুমে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। রানা দ্রুত কন্ঠে বলে, ‘কি হয়ছে আয়াশ?’
আয়াশ কিছু না বলে হোয়াইট বোর্ডের সামনে মার্কার নিয়ে দাঁড়ায়। একটা গোল বৃত্ত এঁকে তারমধ্যে নাম লিখে সোনিয়া আর নয়না। আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তুই ওদের নাম লিখছিস কেন?’
আয়াশ বলে, ‘গ্রামে ফার্স্ট কে মা’র্ডার হয়ছে?’
তমাল বলে, ‘চেয়ারম্যান আর মেম্বারের ছেলে।’
রানা বলে, ‘কিন্তু কেন?’
‘বলতেছি! দেখ সোনিয়া আর নয়না সুইসাইড করার পর ওই দুজনকে কেউ মা’র্ডার করে দেয়। এখানে আমাদের কাছে স্পষ্ট কেউ ওদের সুইসাইডের জন্যই প্রতিশোধ নিছে। এরপর মা’রা যায় এক্স মেম্বার উনিও মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করতো। এরপর মা’রা যায় মুন্নি যে কি না সোনিয়া, নয়না আর সন্ধ্যার ফ্রেন্ড। কিন্তু এই মৃত্যুতে সন্ধ্যা মোটেও কষ্ট পায়নি। কেন? এরপর মা’রা গেছে ফরিদ। যে কি না দিনে দুপুরে মেয়েদের ইভটিজিং করতো। দেখ ঘুরে ফিরে সন্ধ্যা!’
রানা জিজ্ঞেস করে, ‘তো?’
‘তো মানে কি? সন্ধ্যার সাথে বড় কোনো লিঙ্ক আছে এটার।’
লিজা বলে, ‘সন্ধ্যার মতো বাচ্চা মেয়ে একা কখনোই এসব পারবে না।’
‘নয়নার একটা বয়ফ্রেন্ড ছিলো কিন্তু সে কে এখনো জানা যায়নি। মুন্নি জানতো শুধু। তাহলে কি মুন্নি এটাও জানতো মা’র্ডার গুলো কে করতেছে!’
লিজা বলে, ‘পসিবল। বাট সন্ধ্যা ওকে বে’ইমান কেন বললো? আর কে হতে পারে যে এসবের পেছনে আছে?’
‘হয়তো মুন্নি সন্ধ্যার কথা সবাইকে বলে দিতে চেয়েছিলো তাই হয়তো ওকে বে’ইমান বলেছে!’
তমাল বলে, ‘তবুও আমি মানতে পারছি না সন্ধ্যা এতো কিছু করতে পারে। আর নয়নার বয়ফ্রেন্ড হিসেবে কাকে সন্দেহ করছিস?’
‘বাদলকে সন্দেহ করেছিলাম কিন্তু ‘ও’ যেভাবে মা’র খেয়েছে তাতে নিজে নিজেকে আঘাত করা ইম্পসিবল।’
রানা বলে, ‘হুম নিজেকে কেউ এতোটা গভীর ভাবে আঘাত করতে পারবে না। কিন্তু আমার মাথায় এটা আসতেছে না কেউ বাদলকে কেনো অ্যাটাক করলো?’
লিজা বলে, সেটাই।ঘুরে ফিরে সেই শূণ্য। এখন কি করবো আমরা?’
‘নয়নার বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজতে হবে। আমার বিশ্বাস সব প্রশ্নের উত্তর তার কাছেই আছে।’
‘কেমনে খুঁজবো? সন্ধ্যা কখনোই আমাদের বলবে না। আর মুন্নি জানতো সে বর্তমানে ডেড।’
আয়াশ গভীর ভাবে কিছু ভেবে বলে, ‘যত দ্রুত সম্ভব আমাদের এখান থেকে যেতে হবে।’
______________
সন্ধ্যা বাড়ি এসে দেখে সাহেদা বসে আছে। সন্ধ্যা আসতেই সে জিজ্ঞেস করে, ‘বাদল ঠিক আছে?’
‘হুম।’
বলেই সন্ধ্যা মায়ের ঘরে যায়। পুরোনো ট্রাঙ্কের মধ্যে তার কিছু দরকারি জিনিস খুঁজতে থাকে। সেসময় হাতে কিছু শীতল লাগে। সন্ধ্যা সব জিনিস উল্টে জিনিসটা বের করেই খানিকটা অবাক হয়। পুরোনো জং ধরা রাম দা। জং ধরে যাওয়ার প্রথমে সে বুঝতে পারেনি এটাতে রক্তও শুকিয়ে আছে। উল্টে পাল্টে দেখে যখন বুঝে যায় তখন ওটা ফেলে দিয়ে ‘আম্মা’ বলে চিৎকার করে উঠে। সাহেদা দৌড়ে এসে দেখে সন্ধ্যা দুকদম পিছিয়ে ভীত দৃষ্টিতে কিছুর দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে নিজেই পড়ে যেতে নিলে কাঠের দরজা ধরে নিজেকে সামলায়। সন্ধ্যা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘এটা কি আম্মা? তুমি….
চলবে…