সন্ধ্যামালতী,১২,১৩

0
483

#সন্ধ্যামালতী,১২,১৩
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
১২

সন্ধ্যা চুপচাপ পুকুর ঘাটে বসে আছে। আজ সে জীবনের এমন কিছু সত্য জানতে পেরেছে যা তার অজানা ছিলো। কিছু সত্য বোধহয় গোপন থাকায় ভালো! আনমনে পুকুরে ঢিল ছুড়ছিলো এমন সময় সেখানে আসে আয়াশ। সন্ধ্যার সেদিকে খেয়াল নেই। নিজের মতো বসে আছে সে। আয়াশ এক পলক সন্ধ্যার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। সন্ধ্যামালতীর যে মন খারাপ তা বুঝি আয়াশও টের পায়। একদম সনন্ধ্যার পাশে বসে তবে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে। সন্ধ্যা তখনো নিজ মনে ঢিল ছুড়তে ব্যস্ত। আয়াশ গলা খাঁকারি দিয়ে সন্ধ্যার আকর্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করে। তাতেও লাভ হয় না। অবাক হয় আয়াশ। জোড়ে ডাকে ‘সন্ধ্যা’ বলে। সন্ধ্যা চমকে পাশে তাকায়। পাশে আয়াশকে দেখে অবাক হয়। আয়াশ কখন আসলো? সন্ধ্যা নিজের চোখ ডলে। মনে মনে আওড়ায়,

‘এটা কি শহুরে ডাক্তার নাকি আমার ভ্রম?’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কি ভাবছো? এতো মন দিয়ে তুমি সারাদিন ভাবোটা কি?’

সন্ধ্যা ধরেই নেয় আয়াশ তার ভ্রম। আয়াশ এখানে কেন আসবে? সে তো সন্ধ্যার কাছে আসার মানুষ না। তাই নিজেকে খোলা, উন্মুক্ত বইয়ের মতো করতে চায় তার শহুরে ডাক্তারের কাছে। তার মনের সব কথা উজাড় করে দিতে চায়। পুকুরে দিকে তাকিয়েই কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘আচ্ছা শহুরে ডাক্তার আপনি যদি জানতে পারেন আপনার জীবনে এমন কিছু সত্য আছে যা আপনি জানেন না বা আপনি যাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন সে খুবই ঘৃণ্য। তাহলে কি করবেন?’

আয়াশ চমকে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। কি বলছে মেয়েটা? সে নিজেকে সামলে বলে, ‘তোমার মাথা বা শরীর ঠিক আছে তো সন্ধ্যা? আর ইউ ওকে?’

সন্ধ্যা হেঁসে বলে, ‘ঠিকই আছি। আমার না ভেতরে ভীষণ পুড়ে যাচ্ছে শহুরে ডাক্তার। আমাকে একটু আপনার বুকে মাথা রাখতে দিবেন?’

সন্ধ্যা তখনো ভাবছে সে নিজের ভ্রমের সাথে কথা বলতেছে। আয়াশ তো অবাকের চরম পর্যায়ে। মেয়ে বলে কি! সন্ধ্যা ভীষণ আকুল চোখে তাকায় আয়াশের দিকে। আকুতি ভরা কন্ঠে বলে,

‘দিবেন?’

আয়াশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সন্ধ্যার মুখের দিকে। সন্ধ্যা অদ্ভুত ভাবে হেঁসে নিজের জায়গা থেকে উঠে দুপা এগিয়ে বলে, ‘আপনি আমার কল্পনাতেই সুন্দর শহুরে ডাক্তার।’

আয়াশ যেন অবাকের ওপর অবাক হয়। সন্ধ্যার কন্ঠে কিছু তো ছিলো! সেও উঠে পড়ে সন্ধ্যার সাথে। সন্ধ্যার হাত ধরে নিজের দিকে ফিরায়। সন্ধ্যা চমকে ওঠে। এতক্ষণে উপলব্ধি করে আয়াশ সত্যিই আছে। সে নিজের করা কাজে নিজেই স্তব্ধ হয়ে যায়। সে এতো বোকা কবে হলো? কোনটা সত্যি আর কোনটা ভ্রম বুঝতে পারলো না? নাকি সে নিজেই ঘোরের মধ্যে ছিলো বলে বুঝতে পারেনি! আয়াশ হঠাৎ করেই আঁকড়ে ধরে নিজের বাহুতে। সন্ধ্যা স্তব্ধ, নির্বাক। যখন বুঝতে পারে আয়াশ তার ইচ্ছেটা পূরণ করলো তখন সে শক্ত করে আয়াশের টি-শার্ট আঁকড়ে ধরে। আয়াশ নিজের কাজে অবাক হয়। সে তো চাইলেই সন্ধ্যার ইচ্ছেকে, সন্ধ্যার চাওয়াকে উপেক্ষা করে চলে যেতে পারতো তাহলে সে কেনো সন্ধ্যার চাওয়ার গুরুত্ব দিলো? ভাবনার মাঝেই টের পায় সন্ধ্যার ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দ। সন্ধ্যা কাঁদছে! কেন? আয়াশ সন্ধ্যাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়েও করে না। সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সন্ধ্যার কান্নার গতি বেড়ে যায়। শব্দ করে কেঁদে ওঠে৷ আয়াশ আদুরে স্বরে বলে,

‘কি হয়ছে সন্ধ্যা? কান্না করতেছো কেন? কেউ কিছু বলছে?’

সন্ধ্যা জবাব দেয় না। আয়াশ ফের বলে, ‘আচ্ছা শান্ত হও। কি হয়ছে আমাকে বলো!’

সন্ধ্যা থামে না। কেটে যায় বেশ অনেকক্ষণ। আয়াশ বুঝতে পারে সন্ধ্যার কিছু হয়ছে যার কারণে ‘ও’ অদ্ভুত বিহেভ করলো। একসময় সন্ধ্যা শান্ত হয়ে আসে সাথে ধরে রাখা আয়াশের টি-শার্টও আলগা করে দেয়। আয়াশকে ছেড়ে দিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়েই বেরিয়ে যায় বাগান থেকে। আয়াশ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে সেদিকে৷ হঠাৎ করেই কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে পেছনে তাকায়। রানা, আকাশ, তমাল, সাফি, জেরিন আর লিজাকে দেখে নিজেকে সামলে নেয়। রানা ঠোঁট চেপে হেঁসে হেঁসে বার বার আয়াশের দিকে ঘুরতে থাকে। আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘কি? এরকম করছিস কেন?’

রানা বলে, ‘আমাদের সামনে সারাদিন ফিয়ন্সে ফিয়ন্সে করো আর এখন লুকিয়ে প্রেম করতেছো!’

আয়াশ কপালে ভাজ ফেলে বলে, ‘প্রেম করতেছি মানে? আমি কোনো প্রেম টেম করিনি। আর তোর আজাইরা প্যাচাল বন্ধ করে কাজে মন দে।’

বলেই গটগট করে চলে যেতে নেয়। তারপর আবার পেছনে ফিরে বলে, ‘বাই দ্যা ওয়ে তোরা আমার পেছনে কিভাবে আসলি? কখন আসছিস তোরা?’

আকাশ হাই তুলতে তুলতে বলে, ‘যখন সন্ধ্যা তোকে জড়িয়ে ধরতে বললো তখন আসছি কিন্ত বুঝিনি লুকিয়ে লুকিয়ে পুরো জড়িয়ে ধরাটাই দেখতে পারবো ‘

বাকি সবাই হেঁসে ওঠে। আয়াশ কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে চোখ রাঙিয়ে চলে যায়। সবাই শব্দ করে হেঁসে দেয়। লিজা বলে, ‘দোস্ত আমি তো টাস্কি খেয়ে গেছি সন্ধ্যার কথা শুনে তারপর ডাবল টাস্কি খায়ছি আমাদের হিটলারের জড়িয়ে ধরা দেখে। ওহ মাই আল্লাহ আমি তো ভাবতেই পারিনি।’

তমাল বলে, ‘দোস্ত সন্ধ্যা শিউর এই হিটলারের প্রেমের জলে ডুবতেছে কিন্তু এই হিটলারের মনের খবর বুঝি না। একবার মনে হয় আয়াশও ভালোবাসে আবার মনে হয় না বাসে না।’

রানা হেঁসে বলে, ‘আমাদের হিটলার বাবুর মনেও কিছু তো আছে। এখন বুঝতেছে না কিন্তু বুঝাইতে তো আমাদেরই হবে।’

জেরিন বলে, ‘ঠিক। সাফি যেমন ভুত ভুত করে সব জায়গায় আমাদের আয়াশ বাবুও তেমন সব জায়গায় সন্ধ্যা সন্ধ্যা করবে আর তার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের সবার।’

সন্ধ্যা বাড়ি এসে চোখে মুখে পানি দেয়। লজ্জায় চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। ঘোরের বশে সে কি করে বসেছে! সরাসরি আয়াশকে জড়িয়ে ধরতে বলেছে! সে বললো আর আয়াশও ধরে ফেললো! লজ্জায় চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে সে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে কবরস্থানের দিকে। কবরস্থানের সামনে আসতেই চোখ মুখ থেকে সব লজ্জা সরে গিয়ে নেমে আসে বিষণ্নতা। কবরস্থানের গেইটের সামনে এসে এক দৃষ্টিতে তাকায় একটা কবরের দিকে। চোখে মুখে ভালোবাসার জায়গায় উপচে আসে ঘৃণা। সেই ঘৃণা কান্না হয়ে বের হয়। উল্টো ঘুরে হাঁটা লাগায়। হসপিটালে এসে দম নেয়। বাদলের কেবিনে এসে দেখে বাদল তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা নিজেকে সামলে হাসিমুখে বলে,

‘এখন কেমন আছেন বাদল ভাই?’

বাদল হালকা হাসে। বলে, ‘এতক্ষণে খোঁজ নিচ্ছিস?’

‘ছিলাম তো আমি। আপনি ঘুমাচ্ছিলেন বলে চলে গেছিলাম।’

বকুল বলে, ‘ভাই তোমার এই অবস্থা কিভাবে হলো?’

‘জানি না।’

সন্ধ্যা বলে, ‘এসব পরে আলোচনা করা যাবে৷ এখন উনি রেস্ট নিক।’

বকুলের মা সন্ধ্যার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘তোগো রেজাল কবে দিবো?’

সন্ধ্যা হেঁসে বলে, ‘৩১ তারিখে দিবে বলছে।’

বকুলের মা বলে, ‘তাইলে তো হইয়াই গেলো। পোলাডা বেওয়ারার মতো ঘুইরা ঘুইরা এমন মাইর খাইলো!! বিয়া দিয়া দিলে তখন সংসারি হইয়া যাইবো রাইত বিরাতে বাইরেও যাইবো না।’

বকুল তাল মিলিয়ে বলে, ‘ঠিক মা। তাড়াতাড়ি ভাই আর সন্ধ্যার বিয়ের ব্যবস্থা করো তো। সন্ধ্যা আমার ভাবি হয়ে আসলে কত্ত মজা হবে!’

বাদল বলে, ‘হয়ছে এখন থামো। সন্ধ্যা আর বকুলের রেজাল্ট দিক তারপরই বিয়ের কথা তুইলো৷ এখন না।’

সন্ধ্যার মনটা আরো বিষিয়ে গেলো। বার বার আয়াশের জড়িয়ে ধরাটা মনে পড়ছিলো৷ যেনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে দৃশ্যটা। সে কি করে একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের সাথে সংসার বাঁধবে? এতে তো নিজেকেও আর বাদলকেও ঠকানো হবে। নাহ একবার কথা বলতেই হবে বাদলের সাথে। বাদল সন্ধ্যাকে অন্যমনষ্ক দেখে ডাক দেয়৷ সন্ধ্যা হাসার চেষ্টা করে গল্প জুড়ে দেয়।

_________________

পরেরদিন ভোর ভোর উঠে সন্ধ্যা হাঁটতে হাঁটতে আয়াশদের থাকা বাড়িতে যায়। কাল সারাদিন সে লজ্জায় আর এখানে আসেনি। আয়াশের সামনে দাঁড়াবে কি করে সেই চিন্তাই সে ডুবে আছে। লিজা সন্ধ্যাকে দেখে ডাক দেয়। সন্ধ্যা হেঁসে এগিয়ে আসে। লিজা সন্ধ্যার হাত ধরে এগিয়ে আসে পুকুর ঘাটে। সেখানে বাকি সবাই বসে আছে। আয়াশ এক পলক সন্ধ্যার দিকে তাকায় আর বাকি সবাই তাকায় আয়াশের দিকে। আয়াশ ভ্রু কুঁচকে একবার সবার দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দেয়। রানা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

‘আরে সন্ধ্যা! আসো আসো। আজ তোমার মন ভালো তো?’

সন্ধ্যা খানিকটা চমকায়। তারপর হেঁসে মাথা নাড়িয়ে মাথা নিচু করে নেয়। আড়চোখে একবার আয়াশের দিকে তাকায়। সাফি হেঁসে বলে, ‘মন আবার ভালো থাকবে না? আমাদের হিট….

এটুকু বলতেই পায়ে পাড়া লাগিয়ে দেয় আকাশ। সাফি চেঁচিয়ে ওঠে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গেলে সে রাগী চোখে তাকায়। বাকি সবাই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সাফি বোকা বোকা হাসি দিয়ে মাথা চুলকে নিজের পা ডলতে থাকে। রানা বলে,

‘সন্ধ্যাকে আজ অন্যরকম লাগতেছে না?’

জেরিন মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘ঠিক ঠিক।’

আকাশ বলে, ‘সন্ধ্যা সামনে বিয়ে বলে কি এমন লজ্জা পাচ্ছো নাকি?’

সন্ধ্যা কিছু বলে না৷ লিজা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার বিয়ে কবে সন্ধ্যা?’

সন্ধ্যা মাথা নিচু করেই বলে, ‘২ তারিখে।’

রানা আফসোসের স্বরে বলে, ‘ইশশ তাইলে তো সন্ধ্যার বিয়ে খাওয়া হচ্ছে না আমাদের!’

আয়াশ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে থাকে। মুহুর্তেই মনে পড়ে যায় কালকের জড়িয়ে ধরাটা। হার্ট বিটের সাথে সাথে শিরা উপশিরা কেঁপে ওঠে অনুভূতির দখলে। শুধু এ অনুভূতিদের বুঝে উঠতে পারে না। সন্ধ্যা হাসফাস করতে থাকে। লিজা আয়াশকে বলে,

‘দোস্ত আমরা সন্ধ্যার বিয়েটা খেয়ে যায়।’

আয়াশ ফোন স্ক্রল করতে করতে বলে, ‘বিয়ে খাওয়া যায় না। বিয়ের দাওয়াত খাওয়া যায়। তা তোরা কি ইনভাইটেশন পাইছিস?’

সন্ধ্যা চোখ তুলে তাকায়। মানুষটা এতো আজব কেন? আয়াশ ফোন পকেটে রাখতে রাখতে বলে, ‘৩০ তারিখ আমরা চলে যাচ্ছি। সবাই সব গুছিয়ে নে। আজ থেকে পেশেন্টর ভীড় হবে।’

সন্ধ্যা চমকে তাকায় আয়াশের দিকে। ৩০ তারিখ চলে যাবে মানে? আজ তো ২৮ তারিখ তাহলে শহুরে ডাক্তাররা আর মাত্র ২ দিন থাকবে! আর কি দেখা হবে কখনো? শহুরে ডাক্তার কি মনে রাখবে তাকে?…….

চলবে…

#সন্ধ্যামালতী (১৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

পরের দুদিন কেটে গেলো আয়াশের ব্যস্ততায় আর সন্ধ্যার অস্থিরতায়। আজ আয়াশেরা চলে যাবে। সব কাজ কমপ্লিট করেছে তারা দু’দিনেই। শুধু রহস্যের সমাধান পাইনি কেউ। যা করার যতটুকু খোঁজ নেওয়ার এবার শহর থেকেই নিতে হবে। গ্রামটা যেমন জটিল সাথে গ্রামের মানুষগুলোও। আয়াশের জরুরি কল আসায় বাড়ির পেছনের দিকে গেছে। রানা নিজের কাপড় গোছাচ্ছিলো তখন লিজা আসে। লিজা বিষন্ন মন নিয়ে বলে,

‘দোস্ত দুদিনে তো আয়াশ কিছুই বলেনি উল্টো ব্যস্ততাতেই সময় কাটলো সবার। আয়াশ কি তাহলে সন্ধ্যাকে ভালোবাসে না?’

রানা হেঁসে বলে, ‘আয়াশের সাথে আমি ছোট বেলা থেকে আছি। ছেলেটা বড্ড চাপা স্বভাবের। আছে শুধু পকেট ভর্তি রাগ আর জিদ। কখনো কাউকে মনের কথা বলতে পারে না তবে এক্ষেত্রে ‘ও’ নিজেই বুঝতেছে না নিজের অনুভূতি গুলো। আমি দেখেছি সেদিন হসপিটালে যখন সন্ধ্যা পাগলামি করছিলো তখন আয়াশ অনুভূতিশূণ্যের মতো তাকিয়ে ছিলো। আমরা এভাবে কখন তাকায় জানিস? যখন আমাদের কষ্ট হয়।’

লিজা উত্তরে বলে, ‘সে সব তো বুঝলাম। কিন্তু আমরা এই দুই জুটিকে মিলাবো কিভাবে? তাছাড়া আয়াশের ওই খা’টাশ ফিয়ন্সে তো আছেই। আবার সন্ধ্যারও ২ দিন পরই বিয়ে।’

রানা নিজের কাজ করতে করতে বলে, ‘দেখতে থাক কি হয়! কিছু কিছু সময় দুরত্ব অনুভূতি বুঝাতে সাহায্য করে। আমরা চাইলেই আয়াশকে আটকাতে পারি যাওয়া থেকে কিন্তু এতে ‘ও’ সন্ধ্যার শূণ্যতা, সন্ধ্যার প্রতি ওর দুর্বলতা টা টের পাবে না। আমার শুধু একটাই চাওয়া আয়াশের বুঝতে যেনো দেড়ি না হয় আর সন্ধ্যাও যেনো কোনো রকম ভুল না করে।’

‘আই উইস দোস্ত এমনই যেনো হয়। আয়াশ যেনো সঠিক সময়েই নিজেকে বুঝতে পারে।’

‘হুম এখন জলদি রেডি হ। আমাদের কিন্ত তাড়াতাড়ি বের হতে হবে।’

লিজা ‘আচ্ছা’ বলে রুম ত্যাগ করে। নিজের সব কাপড় ঠিক মতো গুছাতে শুরু করে। আয়াশ কথা বলা শেষ করে এসে নিজের সব কাপড় গুছায়। রানা পাশ থেকে হাই তুলতে তুলতে বলে,

‘দোস্ত গ্রাম থেকে যেতে পারবি তো নাকি আবার বেঁকে বসবি!’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকায় রানার দিকে। রানা গলা পরিষ্কার করে বলে, ‘না মানে গ্রামটা অনেক ভালো লাগছে। তাাই বলতেছি।’

‘তোর ভালো লাগছে তুই থেকে যা।’

‘তোর ভালো লাগেনি?’

আয়াশ কপালে ভাজ ফেলে। কাপড় ছেড়ে ঠিক মতো তাকায় রানার দিকে। বলে, ‘কি বলতে চাচ্ছিস ক্লিয়ার করে বল!’

রানা নিজেকে সামলে কয়েক হাত দুর গিয়ে দাঁড়ায়। দাঁত কেলিয়ে বলে, ‘না মানে বলতে চাচ্ছিলাম যে সন্ধ্যাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে না দোস্ত?’

কথাটা আয়াশের কানে যেতেই পাশ থেকে শার্ট ছুড়ে মারে রানার দিকে৷ রানা এক দৌড়ে বাহিরে। বাহিরে এসে শব্দ করে হাসতে থাকে। বিড়বিড় করে বলে, ‘কষ্ট হয় কি না তা তো ঢাকা গেলেই বুঝবো।’

এর মাঝেই সেখানে দৌড়ে আসে বকুল। রানাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাক দেয় তাকে। বকুলের কন্ঠ শুনে আয়াশও বের হয়ে আসে। রানা আর আয়াশ বারান্দায় আসলে বকুল আস্তে করে বলে,

‘সন্ধ্যা আসছিলো ভাইয়া?’

রানা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কই না তো। কেন?’

‘আসলে ‘ও’ কে কোথাও দেখতেছি না। ভাবলাম এখানে আসছে হয়তো! দেখি হয়তো কবরস্থানের কাছে গেছে।’

আয়াশ বিড়বিড় করে বলে, ‘এই মেয়ে কবরস্থানের কাছে কেন যায় সবসময়!’

রানা বলে, ‘বকুল ২ দিন পর না সন্ধ্যার বিয়ে আজ ‘ও’ এভাবে ঘুরতেছে কেন?’

বকুল হেঁসে বলে, ‘সন্ধ্যার মতো উড়নচণ্ডী বাড়িতে বসে থাকতে পারে নাকি? ওর পুরে এলাকা দৌড়ে বেড়ানো স্বভাব। বুঝছেন?’

রানা হেঁসে বলে, ‘তা ঠিক৷ বাদল ভাই কেমন আছে এখন? উনার এ অবস্থাতেই বিয়ে হবে? মানে ডেট পিছাবে না?’

‘না ভাইয়া। বিয়ে ২ দিন পরই। কাল আমাদের রেজাল্ট দেবে। আর বাাদল ভাইয়া এখন ভালো আছে।’

‘ওহ আচ্ছা।’

‘আপনারা নাকি চলে যাবেন?’

‘হ্যাঁ। একটু পরই বের হবো।’

‘ওহ আচ্ছা। আমি গিয়ে সন্ধ্যাকে খুঁজে আনি।’

রানা মাথা নাড়ায়। আয়াশ এক পলক বকুলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রানার দিকে তাকায়। রানা ঠোঁট চেপে হেঁসে শিষ বাজাতে বাজাতে লিজা আর জেরিনের রুমের দিকে যায়।

বাদল একটু হাঁটার জন্য বের হয়েছে। পুরো গ্রামে একবার নজর বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ তাকে কেউ কেনো অ্যাটাক করলো? সে কি করেছে? এতো গুলো খু’ন তারপর তাকে অ্যাটাক! কেনো? বাদল হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দুর এসে জমির আইল ডিঙিয়ে একটা আম গাছের নিচে বসে। জীবনের কিছু হিসাব মিলাতে ব্যস্ত ছিলো এমন সময় হাজির হয় রিনি। রিনিকে দেখে খানিকটা চমকায় বাদল। রিনির চোখের মুখের অবস্থা বিশেষ ভালো না। চোখের নিচে কালি জমে গেছে। বাদল হেঁসে জিজ্ঞেস করে,

‘কি হয়ছে রিনি? চোখ মুখের এ অবস্থা কেন? আর এখানে কেন?’

‘আপনার সাথে কথা আছে আমার।’

বাদল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই চোখ ছলছল করে ওঠে রিনির। চোখের জল লুকাতে মাথা নিচু করে নেয়। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে, ‘এ বিয়েটা করবেন না বাদল ভাই।’

বাদল অবাক চোখে তাকায় রিনির দিকে। কাল বাদে পরশু বিয়ে আর আজ এ মেয়ে বলছে বিয়ে না করতে! পাগল হলো নাকি! বাদল কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

‘২ দিন বাদেই আমার বিয়ে আর তুমি বলছো বিয়ে না করতে! কেনো করবো না বিয়ে? সন্ধ্যার মধ্যে কি সমস্যা?’

রিনি বিষাদের সুরে হেঁসে বলে, ‘সমস্যা তো সন্ধ্যার নেই। সমস্যা তো আামার আছে। আমি যে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি বাদল ভাই।’

অবাকে সপ্তম পর্যায়ে বাদল। কি বলবে বুঝতে পারে না। চোখের দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। রিনির গাল বেয়ে ততক্ষণে নোনাজলের স্রোত। বাদল নিজেকে শান্ত করে বলে,

‘দেখো রিনি তুমি ভালো করেই জানো আমার ব্যাপারে সবটা। আমি কাকে ভালোবাাসি আর কাকে বাসি না! আমার পক্ষে সম্ভব না তোমার কথাটা শোনা। আমি সন্ধ্যাকেই বিয়ে করবো।’

‘ভালোবাসতে পারবেন ওকে?’

বাদল মুচকি হেঁসে বলে, ‘বাসি তো।’

রিনি চোখ তুলে তাকায়। চোখ ভর্তি জল। বাদল উঠতে উঠতে বলে, ‘তুমি খুব ভালো রিনি। তুমি আমার থেকে অনেক ভালো ছেলে পাবে। যেটা তুমি ডিজার্ভ করো। শুধু শুধু আবেগে গা ভাসিয়ে নিজের লাইফ টা নষ্ট করো না কেমন!’

বলেই বাদল সামনের দিকে হাঁটা দেয়। রিনি শব্দ করে কেঁদে ওঠে। বাদলের কানে যায় সে শব্দ তবুও পিছু ফিরে তাকায় না। পিছনে ফিরলেই মেয়েটি আবার তার আশা করবে যা সে চায় না। তার মাঝে সবটা জুড়ে থাকবে সন্ধ্যা। আর দুটো দিন বাদে যে তার বউ হবে।

বকুল খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যাকে পেলো কবরস্থানের সামনে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটা কবরের দিকে। রাগে যেনো জ্বলে উঠলো বকুল। এগিয়ে এসে ধমক দিয়ে বলে, ‘এই মেয়ে তোর কি হুশ জ্ঞান নাই? দু’দিন পর তোর বিয়ে আর তুই এই মুহুর্তে এখানে কবরের সামনে এসে বসে আছিস?’

সন্ধ্যা অদ্ভুত ভাবে হেঁসে বলে, ‘মানুষের আসল ঠিকানাই তো এটা। যত যায় করি দিনশেষে আমাদের সকলের এ জায়গায় আসতে হবে।’

‘যখন আসতে হবে তখন আসিস। এখন বাড়ি চল। সবাই তোর বিয়ে নিয়ে এতো এতো ব্যস্ত।’

সন্ধ্যা আর বকুল পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। বকুল কথায় কথায় বলে, ‘জানিস আজ না শহর থেকে আসা ডাক্তাররা চলে যাবে!’

সন্ধ্যা চমকে তাকিয়ে বলে, ‘আজ কত তারিখ?’

‘৩০ তারিখ।’

সন্ধ্যা বুকের বাম পাশে হুট করে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে। এ ব্যাথা কেমন ব্যাথা? অনুভূতি ঘিরে যে মানুষটা সে দুরে চলে যাবে বলে তার এ ব্যাথা? সন্ধ্যা কোনোরকম নিজেকে সামলায়। বকুলকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘তুই বাড়ি যা। আমি আসতেছি।’

‘আরেহ কিন্তু..

‘বেশিক্ষণ লাগবে না। চলে আসবো।’

বকুল ‘আচ্ছা’ বলে চলে যায়। সন্ধ্যা আয়াশদের থাকা বাড়ির রাস্তার দিকে দৌড় লাগায়। কিছুটা যেতেই দেখা পায় আয়াশের। হাতে লাগেজ। আয়াশের পেছনেই লিজা, জেরিন, আকাশ, তমাল, সাফি। সবাই হেঁসে এগিয়ে আসে সন্ধ্যার কাছে। লিজা হেঁসে বলে,

‘চলে যাচ্ছি তোমাদের গ্রাম ছেড়ে। তোমাকে ভীষণ মিস করবো।’

জেরিন বলে, ‘হ্যাঁ। তোমাদের সাথে অনেক ভালো সময় কাটিয়েছি সব স্মৃতি হয়ে থাকবে আর আমাদের কোনো বন্ধু যদি তোমাদের গ্রামে বিয়ে করে তবে আবার দেখা হবে।’

সবাই হেসে ওঠে। আয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকায় সবার দিকে। আকাশ বলে, ‘তোমাদের গ্রামের ভুতকে ভীষণ মিস করবো সন্ধ্যা। এই ভুত ভুত করে সাফি আমার পিঠের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে গেছিলো।’

সাফি ভেংচি কেটে বলে, ‘সন্ধ্যা ওর কথায় কান দিও না। তুমি কিন্তু বিয়ের পর ঢাকায় আসলে আমাদের ওখানেও আসবে।’

তমাল আয়াশের পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দিয়ে দেয় সন্ধ্যাকে। আয়াশ হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে তমালের দিকে। তমাল বিনিময়ে ৩২ টা দাঁত দেখিয়ে দেয়। সবাই সন্ধ্যার থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। শুধু থেকে যায় আয়াশ আর সন্ধ্যা। দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়াশ কি বলবে বুঝে ওঠে না। সন্ধ্যা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘আপনারা সত্যিই চলে যাচ্ছেন শহুরে ডাক্তার?’

আয়াশ মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘যেতে তো হবেই৷ আমরা এসেছিলাম কাজে সেই কাজ তো শেষ।’

‘ওহ।’

‘হুম।’

তারপর আবাার দুজনে চুপ। দুজনের মনেই অনেক কথা অথচ দুজনেই জড়তায় ভুগছে। অস্বস্তিতে কেউ কিছু বলতে পারছে না। আয়াশ নিজেই আবার জিজ্ঞেস করে, ‘কাল তোমার রেজাল্ট দিবে?’

‘হুম।’

‘গুড। ভালো করে পড়াশোনা করবে। বাদল ভাইকে দেখে যতটুকু মনে হয়েছে উনি অনেক ভালো তুমি বলে দেখতে পারো।’

‘হুম।’

আবারও নিরবতা। আয়াশ লাগেজ হাতে নিয়ে দুপা এগিয়ে বলে, ‘আচ্ছা ভালো থেকো। আর নিজের খেয়াল রেখো।’

‘আপনি কি শহরে গেলে আমাকে ভুলে যাবেন শহুরে ডাক্তার? একটুও মনে পড়বে না আমাকে?’

আয়াশের পা থেমে যায়। সন্ধ্যার প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে বুঝে ওঠে না। লাগেজ নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়। সন্ধ্যা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। যতটুকু দেখা যায় ততটুকু তাকিয়ে থাকে সন্ধ্যা। চোখের আড়াল হতেই মাটিতে বসে পড়ে। চোখ থেকে টুপটাপ কয়েক ফোঁটা জল গড়ায়। ভীষণ কাতর স্বরে আওড়ায়,

‘আপনাকে ভালোবেসে সন্ধ্যামালতী নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে শহুরে ডাক্তার। নিজের অজান্তেই কয়েকটা দিনে আপনাকে কিভাবে ভালোবেসেছি আমি জানি না তবে আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি শহুরে ডাক্তার। ভীষণ বেশি। আপনি আমাকে ভালেবাসলে কি খুব ক্ষতি হতো শহুরে ডাক্তার?’

পেছন থেকে এই ভীষণ কাতর স্বর শোনে রানা। সন্ধ্যার কষ্টে জড়ানো কন্ঠ যেনো ভেতরটাকে পুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। রানা নিজেকে সামলে এগিয়ে আসে সন্ধ্যার কাছে। সন্ধ্যাাকে পেছন থেকে ডাকতেই সন্ধ্যা তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছে নেয়। তারপর হেঁসে তাকায় রানার দিকে। রানা নিঃশব্দে হাসে। পিচ্চি মেয়েটা কষ্টও লুকাতে জানে! সন্ধ্যাকে বলে,

‘চলো। আমরা বড় রাস্তায় গিয়ে গাড়ি নেবো। এগিয়ে দেবে না আমাদের?’

আরো একটি বার আয়াশকে দেখার লোভ যেনে সন্ধ্যা ছাড়তে পারলো না। রানার সাথে এগিয়ে আসলো বড় রাস্তা পর্যন্ত। আয়াশের চোখে মুখেও বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। এই বিষণ্ণতা কেনো? সন্ধ্যাকে ছেড়ে যাওয়ায়? সন্ধ্যার শূণ্যতায় নাকি অন্য কোনো কারণ? রানা আর সন্ধ্যা এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। সবাই কিছুক্ষণ হাসাহাসি করতেই গাড়ি চলে আসে। একে একে সবাই সন্ধ্যার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। আয়াশ গাড়িতে উঠার আগে একবার তাকায় সন্ধ্যার দিকে৷ বুকের বাম পাশ টা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ২ দিন আগের জড়িয়ে ধরার অনুভূতিটা আঁকড়ে ধরে। গাড়িতে উঠে চুপচাপ সামনের দিকে তাকায়। সন্ধ্যার চোখ বেয়ে আবারও এক ফোঁটা অশ্রু গড়ায়…..

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here