সন্ধ্যামালতী,১৪,১৫

0
500

#সন্ধ্যামালতী,১৪,১৫
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
১৪

সন্ধ্যা বাড়ি ফিরে মন খারাপ নিয়ে। বকুল আর তার মা তখনো বসে আছে। সন্ধ্যাকে দেখে দৌড়ে আসে বকুল। সন্ধ্যা একপলক সেদিকে তাকিয়ে হালকা হাসে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে এগিয়ে আসে বকুলের মায়ের কাছে। বকুলের মা হেঁসে সন্ধ্যাকে বলে,

‘সেই কুন বেলা থেইকা বইসা রইছি তোর তো খবর ওই নাই। আয় দেহি এইদিহে আয়।’

সন্ধ্যা কাছে আসতেই বকুলের মা একটা বেনারসি শাড়ি সন্ধ্যার গায়ে জড়িয়ে দিলো। সন্ধ্যা একবার নিজের গায়ে জড়ানো বেনারসির দিকে তাকায় তো আরেকবার বকুলের মায়ের দিকে। আর মাত্র ২ দিন তারপরই সে অন্য কারো হয়ে যাবে। আর বদলে যাবে তার ভালোবাসার ধরন৷ হয়তো সময়ের টানে ভালোবাসার মানুষটাও বদলে যাবে। সন্ধ্যার ভাবনার মাঝেই বকুলের মা সন্ধ্যার থুতনি উচু করে বলে,

‘মাশাল্লাহ। মাইয়াডারে কি সুন্দর লাগতাছে!’

তারপর সবাই গল্প শুরু করে। বকুল আর বকুলের মা চলে যায়। সাহেদা ভীষণ ব্যস্ত নিজের মেয়ের বিয়ে নিয়ে। সাহেদা বসা থেকে উঠতে গেলে সন্ধ্যা হাত ধরে আটকায়। সাহেদা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সন্ধ্যা মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। চোখের কোণ ভিজে আসলেও নিজেকে সামলে নেয়। সাহেদা বলে,

‘কি অয়ছে আম্মা? শরীর ভালা না তোর?’

সন্ধ্যা অদ্ভুত ভাবে হেঁসে বলে, ‘ভালো।’

সাহেদা বুঝে মেয়ের মন খারাপ তাই মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সন্ধ্যা ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না সংবরণ করে।

৬ ঘন্টা জার্নির পর ঢাকা এসে পৌঁছায় আয়াশরা। নিজের শহরে এসে যেমন সবার ভালো লাগছে তেমনই গ্রামে কাটানো দিন গুলোও খারাপ লাগা তৈরী করছে। সবাই নিজেদের মতো কথা বলায় ব্যস্ত থাকলেও আয়াশ চুপচাপ। রানা একবার আয়াশের দিকে তাকায়। তারপর কাছে এসে ধীর কন্ঠে বলে,

‘মন খারাপ?’

আয়াশ চোখ তুলে তাকায়। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। হুট করেই রানার মনে হলো আয়াশকি কেঁদেছে? রানা ব্যস্ত কন্ঠে বলে, ‘তুই কি কেঁদেছিস? তোর চোখ মুখের এই অবস্থা কেন?’

আয়াশ হালকা হেঁসে বলে, ‘কাঁদিনি। এমনিতেই চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। আচ্ছা শোন তোরা সাবধানে যাস আমি দ্রুত বাড়ি যায়।’

তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির রাস্তায় হাঁটা লাগায় আয়াশ। পেছন থেকে তার বন্ধুমহল হাসে। আয়াশ গলি পেড়িয়ে নিজেদের বাড়ি চলে আসে। দরজা খোলে আয়াশের মা আফরা। আফরা তো ছেলেকে দেখেই খুশি। আয়াশ কিছুক্ষণ কথা বলে নিজের রুমে যায়। কতগুলো দিন পর নিজের রুমকে দেখেও তার প্রশান্তি মেলে না। এত অস্থিরতা, এত শূণ্যতা কিসের? কেন মনে হচ্ছে তার কোনো এক অংশ নেই। তার বুকের বাম পাশে কিসের ব্যাথা? লাগেজ ছুড়ে মারে ফ্লোরে। মাথা চেপে ধরে দুহাতে। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সন্ধ্যার মুখ। দ্রুত চোখ খুলে বসে পড়ে। সে যে ফেসে গেছে তা তার বুঝতে বাাকি নেই। কোনো রকম একটা শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে রুমে বসে আছে তার ফিয়ন্সে সানজিদা। সানজিদা আয়াশকে দেখে হেঁসে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে। আয়াশ বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দেয় তাকে। সানজিদা ন্যাকা স্বরে বলে,

‘কি হয়েছে আয়াশ? এতগুলো দিন পর আসলে তাও আমাকে পাত্তা দিচ্ছো না!’

‘দেখো সানজিদা আমি অনেক ক্লান্ত এখন এসব ভালো লাগতেছে না। তুমি আসতে পারো।’

‘বেবি আমি…

‘যেতে বলেছি।’

সানজিদা অপমানে চোখ মুখ কালো করে রুম থেকে বের হয়ে যায়। আয়াশ দরজা লাগিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। ২ দিন পর সন্ধ্যার বিয়ে, তারও তো বিয়ে এ মাস পেরোলেই। তবে? তাদের বুঝি বিচ্ছেদ লিখা কপালে!

_______________

দিনটা অস্থিরতা আর কারো শূণ্যতা অনুভবে কেটে গেলো আয়াশ-সন্ধ্যার। আজ সন্ধ্যার রেজাল্ট দেবে। সকাল সকাল আয়াশরা যেখানে থাকতো সেখানে এক চক্কর কেটে এসেছে। সব স্মৃতি গুলো যেনো জ্বলজ্বল করে উঠে চোখের সামনে। সন্ধ্যা ১২ টার দিকে রেডি হয়ে সাহেদার কাছে আসে। সাহেদা কাজ অর্ধেক রেখেই এগিয়ে আসে মেয়ের কাছে। চোখে মুখে তার বিষন্নতা। সন্ধ্যা মায়ের মুখ দেখে কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,

‘কি হয়ছে আম্মা? মন খারাপ কেন তোমার?’

সাহেদা মলিন হেঁসে বলে, ‘আজকা তো তোর রেজাল দিবো পরে আমি তোরে কলোজে ভর্তি করমু। তুই মন দিয়া পড়বি।’

‘আমার কি আর পড়া হবে আম্মা? বিয়ে হয়ে গেলে তো মেয়েদের পড়াশোনা শেষ।’

‘বিয়া অইবো না তোর। তুই যা।’

সন্ধ্যা অবাক চোখে তাকায় মায়ের দিকে। তার মা বেশি খুশি ছিলো এ বিয়ে নিয়ে তাহলে কি এমন হলো যে তার মা বিয়ে দিবেন না বলছে? সাহেদা মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলে, ‘সাবধানে যাইস আম্মা।’

সন্ধ্যা হেঁসে মা’কে জড়িয়ে ধরে। তারপর বের হয় বাড়ি থেকে। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দুর গেলেই দেখা হয় রিনির সাথে। রিনিকে দেখে নিঃশব্দে হাসে সন্ধ্যা। রিনি মলিন হেঁসে তাকায়। কিছু বলে না সন্ধ্যাকে। সন্ধ্যা পাশাপাশি এসে হাঁটতে হাঁটতে বলে,

‘স্কুলে যাচ্ছিস?’

‘হুম।’

‘আজ তোর কি হলো? অন্যদিন হলে তো বলতি ‘তোর মতো ফ’কিন্নির সাথে কথা বলার ইচ্ছে নাই’।’

রিনি মলিন হাসে। সামনে তাকিয়ে সন্ধ্যাকে বলে, ‘সব সময় কি সবাই এক থাকে?’

সন্ধ্যা খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠে। বলে, ‘হুম সেই তো। তা কোন কারণে তোর মন খারাপ? আমার হবু স্বামীকে ভালোবেসে নাকি সবাই জেনে গেছে তুই ফরিদ কাকাকে মে’রেছিস!’

চমকে তাকায় রিনি। অবাক কন্ঠে বলে, ‘কি বলছিস এসব? মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে নাকি?’

সন্ধ্যা ফের হাসে। রিনি মুগ্ধ নজরে তাকিয়ে দেখে সে হাসি। মনে মনে আওড়ায়, ‘তোর এই স্নিগ্ধ মুখের হাসি দেখলে যে কেউ তোর মায়ায় বেধে যাবে সেখানে বাদল ভাই তো কিছুই না।’

সন্ধ্যা রিনিকে কিছু ভাবতে দেখে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে বলে, ‘মিথ্যা কিছু কি বলেছি রিনি? এটা তো সত্যি ফরিদ কাকা তোরেও ছাড় দিতো না। তোরেও বাজে নজরে দেখতো!’

রিনি মাথা নিচু করে নেয়। সন্ধ্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘যা করেছিস ভালো করেছিস। ওমন মানুষ ম’রাই ভালো৷ তা বাদল ভাইকে এতো ভালোবাসিস কেন?’

রিনি ব্যস্ত স্বরে বলে, ‘না না সন্ধ্যা তুই…..

সন্ধ্যা রিনির কথার পিঠে খিলখিল করে হাসে। আর কিছু বলার আগেই বকুলও চলে আসে। রিনি আর সন্ধ্যা দুজনেই চুপ হয়ে যায়। ৩ জনে গল্প করতে করতে চলে আসে স্কুলে। রেজাল্ট দিবে দুপুর ২ টার দিকে ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।

রেজাল্ট দেওয়ার পর সবাই খুশি। ১২ জন শিক্ষার্থী আর ১০ জন ছাত্র A+ পেয়েছে আর ৫ জন গোল্ডেন মার্ক। তার মধ্যে সন্ধ্যাও আছে। বকুল আর রিনি + মার্ক পেয়েছে। সবাই খুশিতে হৈচৈ করে বাড়ির পথে রওনা দেয়। পথে দেখা হয় বাদলের সাথে। রিনিকে সন্ধ্যাদের সাথে দেখে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সন্ধ্যা তা দেখে মুচকি হাসে। রিনি পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সন্ধ্যাা আর বকুল বাদলের সাথে কথা বলতে দাঁড়ায়। বাদল হেঁসে বলে,

‘রেজাল্ট কি দুজনের?’

বকুল খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, ‘আমি A+ আর সন্ধ্যা গোল্ডেন মার্ক।’

সন্ধ্যাা হেঁসে বলে, ‘রিনিও A+ পেয়েছে।’

বাদল ফের অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তবুও নিজেকে সামলে বলে, ‘চল বাড়ির দিকে।’

বকুল আর সন্ধ্যাও তাতে সায় দেয়। বকুল নিজেদের বাড়ির দিকে গেলে সন্ধ্যা আর বাদল একসাথে হাঁটতে থাকে। দুজনেই চুপ। নিরবতা ভেঙে সন্ধ্যাই বলে, ‘আপনি কি রিনিকে ভালোবাসেন বাদল ভাই?’

বাদল অবাক চোখে তাকায়। সন্ধ্যার কথা মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, ‘মানে? বুঝলাম না তোর কথা!’

সন্ধ্যা হেঁসে বলে, ‘কিছু না।’

তারপর আবার দুজনে নিশ্চুপ। দুজনে একসাথে বাড়ি পর্যন্ত আসে। টিনের গেইট খুলে বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই থমকে দাঁড়ায় সন্ধ্যা আর বাদল। বারান্দার ওপরে পড়ে আছে তার মা আর দাদার নিথর র’ক্তাক্ত দেহ। সন্ধ্যা দৌড়ে আসে সাহেদার কাছে৷ বাদলও ছুটে আসে। সন্ধ্যা বার বার ডাকতে থাকে সাহেদা আর তার দাদাকে। কিন্তু ততক্ষণে দুজনের শরীরই শীতল, বরফ হয়ে গেছে। বাদল পালস চেইক করে দুহাত পিছিয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে তাকাতেই দেখে সন্ধ্যা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাদল কাপা কাঁপা গলায় বলে,

‘চাচি আর দাদা মা’রা গেছে সন্ধ্যা।’

কথাটা শুনতেই সন্ধ্যার সব পাগলামি বন্ধ হয়ে যায়। সাহেদার থেকে দু হাত দুরে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লা’শ দুটির দিকে। পৃথিবীর শেষ আশ্রয় ছিলো তার মা আর দাদা। তাদেরকেই কেউ কেড়ে নিলো? ফরিদ, মুন্নি এদের যে মে’রেছে সেই কি তবে তার মা আর দাদাকে? কিন্তু কেন? এতদিন সে ভাবতো এসবের পেছনে রিনি আছে কিন্তু রিনি তার মা আর দাদাকে কেন মা’রবে? আর আজ তো সে সাথেই ছিলো রিনির। তাহলে? মাথাা ঘুরিয়ে আসে সন্ধ্যার। বাদল এসে আগলে নেয় সন্ধ্যাকে। সন্ধ্যা ওভাবেই জ্ঞান হারায়।

চারিদিকে আগর বাতির গন্ধ। বাড়ির পরিবেশ থমকে গেছে। বকুল আর বকুলের মাও কান্না করছে। লাশ ধুইয়ে পরিপাটি করে রাখা হয়েছে। সন্ধ্যার জ্ঞান ফিরেছে একটু আগে। তখন থেকেই সে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে মা আর দাদার লাশের দিকে। বকুল বার বার সন্ধ্যাকে ধাক্কাচ্ছে কিন্তু সন্ধ্যার এসবের হুশই নেই। আজ খুব করে তার আয়াশকে মনে পড়লো! এই মুহুর্তে তার আয়াশকে ভীষণ দরকার। অন্তত একটু কেঁদে মন হালকা করার জন্য হলেও তার আয়াশকে প্রয়োজন ছিলো। বাদল এসে সন্ধ্যাকে নিজের দিকে করে৷ ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে,

‘সবাই চাচিদের নিয়ে যাবে। তুই একবার চাচির কাছে যাবি?’

সন্ধ্যা ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকায় বাদলের দিকে৷ তারপর উঠে এসে সাহেদার খাটিয়ার কাছে বসে। লম্বা চুল গুলো তখনো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সন্ধ্যা সাহেদার মুখ আজলে নিয়ে আস্তে করে বলে,

‘আম্মা দেখো না আমার চুল গুলো খুব জ্বালাচ্ছে তুমি একটু বেঁধে দাও না! আম্মা তাকাও না। এতো ঘুমালে হবে। দাদার তো এতক্ষণে খিদে পেয়ে গেছে নিশ্চয়!’

তারপর সাহেদাকে ছেড়ে নিজের দাদার খাটিয়ার কাছে আসে। দাদাকে ডেকে বলে, ‘দেখো দাদা আম্মা উঠতেছে না। তুমি কিছু বলো তো। তোমার খিদে পেয়েছে তাই না? আসো আমরা এক সাথে খাবো। উঠো!’

বকুল এসে সন্ধ্যাকে ধরে সরিয়ে দেয়। কান্নার দমকে বকুল নিজেই কথা বলতে পারতেছে না। সে তো জানে, বুঝে এই মেয়েটার এই দুজন ছাড়া যেমন কেউ নেই তেমনই ভালোবাসার মানুষগুলোকে তো মেয়েটা হুটহাট এভাবে হারিয়ে নিজের মাঝে কষ্ট পুষেছে। সন্ধ্যা বকুলের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘দেখ সই আম্মা আর দাদা কেউ উঠতেছে না। এমন করলে কিন্তু আমি বেশি বেশি করে পুরো গ্রামে দৌড়াবো।’

বকুলের মা সন্ধ্যাকে ধরে দুরে আনে। বলে, ‘তোর মা’রে ওরা নিয়া যাইবো এহন। আর কাছে যাইস না মা।’

সন্ধ্যা ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। মায়ের খাটিয়ার কাছে দৌড়ে এসে ওভাবেই জড়িয়ে ধরে। পাগলের মতো শুরু করে। শেষে কয়েকজন মিলে ধরে সরিয়ে রাখে সন্ধ্যাকে। সন্ধ্যার চিৎকারে যেনো পুরো গ্রাম থমকে যায়। আহাজারিতে ভরে যায় সন্ধ্যামালতীর স্বর। সেই আহাজারিতে যেনো কেঁদে উঠে পুরো গ্রামবাসী…

চলবে..

#সন্ধ্যামালতী (১৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

গভীর রাত। শূণশান, নিরবতায় ছেয়ে গেছে পুরো গ্রাম। সবাই সবার মত ঘুমিয়ে আছে। সবার জীবনই চলছে নিয়ম মতো শুধু পাল্টে গেছে সন্ধ্যামালতী আর তার জীবন। দুদিন আগের সেই চঞ্চলতাটা আর নেই। একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। দুদিন থেকে ঠিকমতো খাচ্ছেও না, ঘুমাচ্ছেও না। বকুল আর তার মা অনেক চেষ্টা করেও ঠিক মতো খাওয়াতে পারেনি আর না পেরেছে ঘুম পাড়াতে। বাদল নিশ্চুপ দর্শকের মতো দেখা ছাড়া কিছু করতেও পারে না। সন্ধ্যা এ পর্যন্ত একটা টু শব্দও করেনি কান্না তো অনেক দুরের কথা। সন্ধ্যা এক দৃষ্টিতে মাথার ওপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকায়। পাশ থেকে বকুল তাকায় সন্ধ্যার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যার গালে হাত দেয়। সন্ধ্যা তবুও আওয়াজ করে না। বকুল ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে,

‘আর কতদিন এভাবে থাকবি? আজ দুদিন হলো তুই না ঠিক মতো খাস আর না ঘুমাস! এভাবে তো অসুস্থ হয়ে পড়বি। একটু ঘুমা সই।’

সন্ধ্যা নিশ্চুপ, নিরুত্তর। বকুল জবাব না পেয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে। আজ মেয়েটার বিয়ের দিন ছিলো। কথা ছিলো আজই সন্ধ্যা বউ সেজে বকুলদের বাড়িতে আসবে অথচ পরিস্থিতি সব এলোমেলো করে দিলো। কে বা কারা সন্ধ্যার মা আর দাদাকে মে’রেছে এ নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তায় আছে। পুলিশের কাছে সবটা জানানো হলেও পুলিশ তাতে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। এ থেকে বোঝা যায় যে এর পেছনে নিশ্চয় বড় কারো হাত আছে! বাদল নিজের মতো চেষ্টা করেই যাচ্ছে। বকুল উঠে সন্ধ্যাকেও উঠে বসালো। সন্ধ্যা তখনো অনুভূতিশূণ্যের মতো তাকিয়ে আছে। বকুল ফের বলে,

‘এমন পাথরের মতো কতদিন থাকবি? কতদিন নিজের মধ্যে কষ্ট চেপে রাখবি? কান্না কর না! কান্না করলে অনেক হালকা হবি। এই সন্ধ্যা কান্না কর।’

সন্ধ্যা তবুও নিশ্চুপ। সে যেনো কোনো কথা শোনেইনি। বকুল কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। অনেক চেষ্টার পরও যখন সন্ধ্যা কাঁদে না তখন বকুল করে বসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ। ঠাস করে থা’প্পড় বসিয়ে দেয় সন্ধ্যার গালে। সন্ধ্যা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। তবুও কাঁদে না আর না কোনো কথা বলে! বকুল নিজেই কেঁদে দেয়। জড়িয়ে ধরে তার সইকে। সন্ধ্যা অদ্ভুত ভাবে হাসে।

ফজরের আযান দিবে দিবে ভাব। সন্ধ্যা বকুলের কোলে মাথা রেখে মাত্রই ঘুমিয়েছে। বকুলও ঘুমিয়ে পড়েছে। এমন সময় সন্ধ্যা স্বপ্নে দেখে তার মা আর দাদা আহাজারি করছে। কান্না করছে তাকে বার বার বলছে,

‘পালিয়ে যা সন্ধ্যা। ওরা তোকে বাঁচতে দেবে না৷ পালিয়ে যা।’

শেষ সময়ে ভেসে ওঠে ফরিদের মুখ। বিভৎস মুখ নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। চিৎকার করে যেনো বলছে, ‘তুই আমাকে সবার সামনে অপমান করেছিস তাই না। তোর মা আর দাদাকে যেভাবে মে’রেছি তোকেও মা’রবো।’

বিকট শব্দে হেঁসে উঠে। লাফিয়ে ওঠে সন্ধ্যা। ঘেমে নেয়ে তার একাকার অবস্থা। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করতেই কানে ভেসে আসে আযানের প্রতিধ্বনি। একবার বকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ আযান শুনতে থাকে। আযান শেষ হলে উঠে এসে অযু করে নামাজ পড়ে। মোনাজাত শেষ করে আরেকটু অপেক্ষা করে ভোরের। ভোরের আলো যখন আবছা আবছা ফুটে উঠেছে তখনই সে বের হয় ঘর থেকে। সবার অলক্ষ্যে চলে আসে নিজের বাড়ি। নিজের বাড়ির প্রতিটা কোণা সে চোখ ভরে দেখে। এ বাড়িতে তার কত স্মৃতি! ফের ভেসে ওঠে তার মা আর দাদার পড়ে থাকা রক্তাক্ত লা’শের প্রতিচ্ছবি। চোখ ভরে আসে সন্ধ্যার। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেয়। নিজের জমানো কিছু টাকা তার মায়ের জমানো কিছু টাকা ছিলো সবটা নিয়ে নেয়। এ বিষাক্ত গ্রাম ছেড়ে সে অনেক দুরে হারিয়ে যাবে। যেখানে তাকে কেউ খুঁজে পাবে না। তার আর সাহেদার ছবি নিয়ে চলে আসতে গিয়ে চোখ যায় একটা কার্ডের দিকে৷ কার্ডটা হাতে নিতেই তার যেনো ভেতর থেকে আরো হাহাকার আসে। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে আস্তে করে আওড়ায়,

‘আপনাকে আমি খুব করে চেয়েছিলাম শহুরে ডাক্তার কিন্তু পেলাম আর কই! আপনিও হারিয়ে গেলেন আর আমার শেষ সম্বল, আমার মা আর দাদাও হারিয়ে গেলো। এ পৃথিবীতে সন্ধ্যামালতীই কেনো বার বার তার প্রিয় জিনিস, প্রিয় মানুষ গুলো হারিয়ে ফেলে! কেনো এ পৃথিবী এই সন্ধ্যামালতীর প্রিয় জিনিসকে তার থাকতে দেয় না! সন্ধ্যামালতী তো নিঃস্ব, সর্বহারা তবুও কেনো তারই বার বার সব হারাতে হয়! সন্ধ্যামালতীর আর হারানোর কিছু নেই। এবার শুধু প্রাণটাই বুঝি হারানো বাকি!’

অদ্ভুত ভাবে হাসে সন্ধ্যা। তার শহুরে ডাক্তারের কার্ডটা হাতে নিয়েই ঘর থেকে বের হয়। পুরো বাড়ি আরো একবার দেখে নিয়ে বের হয়ে আসে। একটু হেঁটে আসে কবরস্থানের সামনে। কবরস্থানে যদিও মেয়েদের ঢুকা নিষেধ তবুও কেউ নেই বলে সন্ধ্যা সাহস করে ঢুকে পড়ে। নতুন দুইটা কবরের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। মা আর দাদার কবর দেখেই তার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। মায়ের কবর জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। মা মা একটা গন্ধ আসে নাকে। কেঁদে উঠে শব্দ করে। তার চোখের জলে যেন ভিজে যায় মায়ের কবরের সদ্য মাটি। নিজের দাদার কবরও জড়িয়ে ধরে তারপর উঠে যায়। প্রিয় কিছু কবরের দিকে তাকিয়ে যেনো বিদায় জানায়। সকালের আলো ঠিকমতো ফোঁটার আগেই সন্ধ্যা মুখে আঁচল চেপে গ্রামের বড়রাস্তার দিকে হাঁটা লাগায়। সেখান থেকে অটো রিকশা করে স্টেশন পর্যন্ত যাবে তারপর চলে যাবে এক অপরিচিত শহরে।

___________________

সকাল সকাল আয়াশ হসপিটালে এসেছে। বুকের ভেতরটা এখনো তার হাহাকার করতেছে। কাল নিশ্চয় সন্ধ্যার বিয়ে হয়ে গেছে! সন্ধ্যা নিশ্চয় এখন অন্য কারো বউ! তার সব ভাবনার মাঝেই রানা আসে। আয়াশকে অন্যমনষ্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ছেলেটা নিজের মনে গুমড়ে মরতেছে অথচ কালকেও ওকে কতবার সবাই মিলে জোড় করলো একটাবার সন্ধ্যার গ্রামে যাওয়ার জন্য। রানা আনমনে ভাবে কালকের ঘটনা!

কাজে অন্যমনষ্কতা পছন্দ না আয়াশের সেই আয়াশকে যখন কাল অন্যমনষ্ক দেখেছিলো তখনই বুঝেছিলো সন্ধ্যার জন্যই তার মন খারাপ। রানা এগিয়ে আসে আয়াশের কাছে। গলা পরিষ্কার করে বলে,

‘কাজে অন্যমনষ্ক? ব্যাপার কি দোস্ত?’

আয়াশ কিছু না বলে চুপ করে থাকে। রানা আয়াশের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলে, ‘গ্রাম থেকে আসার পর থেকেই দেখতেছি তুই কেমন অন্যমনষ্ক হয়ে গেছিস। তোর কি কিছু হয়ছে?’

আয়াশ মাথা নাড়িয়ে আস্তে করে বলে, ‘কিছু হয়নি।’

‘নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ডকে নিজের অনুভূতি লুকাচ্ছিস?’

আয়াশ অন্যদিকে তাকায়। মৃদু স্বরে বলে, ‘আমি নিজেই নিজেকে বুঝতেছি না তোকে কি বলবো? আমি জানি না আমার কি হয়েছে!’

রানা মুচকি হেঁসে বলে, ‘সন্ধ্যাকে মনে পড়ছে?’

আয়াশ তাকায় রানার দিকে। রানা হেঁসে বলে, ‘দোস্ত তুই তো গেছিস মনে হয়। ভালোবাসিস সন্ধ্যাকে তাই না!’

আয়াশ কিছু বলে না। রানার চোখ মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠে। দ্রুত আয়াশের কাছে এসে আয়াশকে জড়িয়ে ধরে। হেঁসে বলে, ‘বুঝছি তো আমি। দেখ আজকেই সন্ধ্যার বিয়ে তুই তাড়াতাড়ি গিয়ে ওকে নিয়ে আয়। তাহলেই সব মিটমাট।’

আয়াশ রানাকে ছাড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলে, ‘সব কিছু চাইলেই সম্ভব না।’

ব্যাস তারপরই আয়াশ বেরিয়ে যায়। সত্যি আয়াশ গ্রামে যায়নি সন্ধ্যাকে আনতে! কাল হয়তো সন্ধ্যার বিয়েও হয়ে গেছে এমনটাই সবার ধারণা। ফোনের শব্দে ঘোর কাটে দুজনেরই। আয়াশ রানাকে নিজের কেবিনে দেখে খানিকটা অবাক হয়। বলে,

‘তুই কখন আসলি?’

রানা কল কেটে ফোন সাইলেন্ট করে এগিয়ে আসে আয়াশের কাছে। বলে, ‘যখন তুই ভাবনায় বিভোর তখন এসেছি আমি।’

আয়াশ কিছু বলে না৷ দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ থাকে। দুজনের নিরবতার মাঝেই লিজা, জেরিন, তমাল, আকাশ, সাফি আসে। সবারই মন খারাপ। লিজা একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,

‘সন্ধ্যার কি বিয়ে হয়ে গেছে রানা?’

রানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় লিজার দিকে। রাগী কন্ঠে বলে, ‘তুই যেখানে আমিও সেখানে। তাই আজাইরা প্রশ্ন করে মাথা নষ্ট করিস না।’

জেরিন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘তোর কি সমস্যা? রেগে কথা বলতেছিস কেন?’

রানা মলিন কন্ঠে বলে, ‘এমনিতেই। তোরা এখানে কেন?’

আকাশ আয়াশকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তুই আর কবে নিজের অনুভূতি বুঝবি? কাল আমরা তোকে কতবার বুঝিয়ে বললাম যে যা সন্ধ্যাকে আনতে কিন্তু তুই তো তুই-ই! গেলি না। আজকে কেন মন খারাপ করে আছিস?’

‘তোরা সবাই একই কথা কানের কাছে না বলে নিজেদের কাজে যা। আমারে একা থাকতে দে।’

রানা এবার চরম রেগে যায়। রেগে বলে, ‘কি সমস্যা তোর? তুই একা থাকবি তো থাক। একাই থাক।’

তারপর বেড়িয়ে যায়। সাথে বাকি সবাইও যায়। আয়াশ চুপচাপ বসে থাকে। বললেই তো আর সব করা সম্ভব না! গ্রামের মেয়েদের সম্মান প্রখর হয়। গ্রামের মেয়েদের বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙে যাওয়া মানে অনেক কিছু। সন্ধ্যার সম্মানের সাথে সাথে সাহেদার সম্মানও থাকতো না। এটা এদের কিভাবে বুঝাবে? সন্ধ্যা নাা হয় তার সাথে চলে আসতো তাই বলে কি সাহেদাও আসতো! যতটুকু তাদের চেনা হয়েছে তাতে তাদের আত্মসম্মান প্রখর।
পুরোটা সময় আয়াশের কাটে ছটফট করতে করতে। দুপুরের দিকে হসপিটাল থেকে বের হয়ে আসে। গাড়ি নিয়ে আপন মনে চলতে থাকে।

নতুন শহরের কিছুই চেনা নয় সন্ধ্যার। এতো শতো গাড়িও সে কখনো দেখেনি। কত বড় বড় বিল্ডিং, কত বড় বড় রাস্তা ঘাট। আজ ৩ দিন সে তেমন কিছুই খায়নি তারওপর এতো দুরের রাস্তায় জার্নি করে এসে বড্ড ক্লান্ত সে। একটা ফাঁকা রাস্তায় বসে পড়ে। শুনশান রাস্তায় তেমন কেউ নেই। সন্ধ্যা কিছুক্ষণ বসে উঠে পড়ে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে ঠিকই কিন্তু এতো বড় শহরে সে যাবেই বা কোথায়? এসে তো পড়েছে কিন্তু যাওয়ার মতো তো কেউ নেই। আল্লাহর যখন এতদুর এনেছেন তখন তিনিই কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিবে। চোখ মুখ মুছে উঠে হাঁটা লাগায়। কিছুটা দুর যেতেই ৩-৪ টা ছেলের দেখা মিলে। সন্ধ্যা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে থাকে। কিন্তু কথায় আছে না বিপদ যখন আসে সব দিক থেকেই আসে! সন্ধ্যা পাত্তা না দিলেও বখাটে গুলো ঠিকই পাত্তা দেয়। সন্ধ্যার পিছু পিছু আসতে থাকে। সন্ধ্যা বুঝতে পারে তার পেছনে কেউ আছে তাই একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে। ছেলেগুলোকে তার পেছনে আসতে দেখেই বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। পুরোনো কিছু আবছা স্মৃতি ভেসে ওঠে। হাতের ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে। মনে মনে স্মরণ করতে থাকে আল্লাহকে। চোখ বুজে মায়ের মুখটা মনে করেই ছুট লাগায়। ছেলেগুলোও পেছন পেছন ছুটতে থাকে। গ্রামের মেয়েরাা মাত্রাতিরিক্ত দৌড় ঝাপ করে বলে তেমন সমস্যা হয় না সন্ধ্যার দৌড়াতে। কিন্তু ৩ দিন ধরে ঠিক মতো না খাওয়া মানুষের আর কতটুকুই শক্তি থাকে শরীরে! সন্ধ্যা যখন দেখে সে আর দৌড়াতে পারবে না তখন দুইদিকে দুটো গলি যায় সেটার একটাতে ঢুকে পড়ে। একটু আড়ালে লুকিয়ে চোখ মুখ খিচিয়ে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। হয়তো সন্ধ্যার প্রতি আল্লাহর দয়া ছিলো তাই সে বেঁচে যায়। ছেলেগুলো অন্য রাস্তায় চলে গেছে৷ কিছুক্ষণ সেখানে বসেই আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে। জানা নেই কোথায় যাচ্ছে তবুও তার যেতে হবে। কিছুটা দুর আসতেই সে মেইন রোডে পৌছে যায়। শরীর দুর্বল বলে আর হাঁটতে পারে না। কোনোরকমে রাস্তা পার হতে গেলে ধাক্কা খায় একটা বাইকের সাথে। ছিটকে পড়ে দুরে। লোকজন ভীর জমায় সেখানে। নিভু নিভু চোখ খোলা অবস্থায় দেখতে পায় আরেকটি মুখ। ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠে এক টুকরো হাসি। আস্তে করে আওড়ায়, ‘শহুরে ডাক্তার!’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here