সন্ধ্যামালতী (১৯)

0
501

#সন্ধ্যামালতী (১৯)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
______________

পুরো বাড়ি মেহমানে গিজগিজ করছে। চারদিকে মরিচ বাতির লাল, নীল আলো। অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত আয়াশ, রানা, আকাশ, তমাল আর সাফি। তাছাড়াও রানার কাজিনরাও আছে। আয়াশ সন্ধ্যাকে রানার বোন রুনার কাছে বসিয়ে নিজে কাজ করতেছে। সে ইচ্ছা করেই রুনার কাছে সন্ধ্যাকে রেখে গেছে। লিজা, জেরিনকে দিয়ে তার বিশ্বাস নাই। মেয়ে দুটো মারাত্মক রকমের বুদ্ধি নিয়ে ঘোরাফেরা করে। এসব বুদ্ধিতে মানুষ খুশি কম টাস্কি খায় বেশি। তাই রিস্ক না নিয়ে সন্ধ্যাকে রুনার কাছে রেখে গেছে। রুনা মেয়েটাও বেশ ভালো। এতো ধকলের মধ্যেও সে সন্ধ্যার দিকে পুরো নজর রেখেছে। রানার মুখে যখন সন্ধ্যার কথা শুনেছিলো তখন থেকেই তার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো সন্ধ্যাকে দেখার। সন্ধ্যা সুন্দরী বুঝেছিলো কিন্তু এতো ভয়ংকর রকম সুন্দরী তা সে ভাবেনি। সন্ধ্যা এতো লোকজনের মধ্যে হাসফাস করছিলো বসে বসে। উপায় না পেয়ে রুনার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলে,

‘আপু আমি একটু ওদিকটায় যাই? ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে এখানে।’

রুনা হয়তো বুঝলো। প্রথমে যেতে না দিতে চাইলেই পরে আর নিষেধ করলো না। উল্টো সাবধান বাণী জুড়ে দিলো সাথে। সন্ধ্যা রুনার পাশ থেকে উঠে চুপচাপ একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তেমন লোকজন না থাকায় সন্ধ্যা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। সেসময় পাশ থেকে ভেসে আসে পুরুষালী কন্ঠ। সন্ধ্যা পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে অপরিচিত এক পাতলা গঠনের ছেলে ৩২ টা দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা দৃষ্টি এদিক ওদিক করে চোখ পিটপিট করে তাকায়। অপরিচিত ছেলেটি বলে,

‘হেই সুন্দরী! আমি তুহিন। তুমি?’

সন্ধ্যা জবাব দেয় না। আশে পাশে নজর বুলিয়ে তুহিনের সামনে দিয়ে চলে যেতে নেয়। ঠিক তখনই হাত টেনে ধরে তুহিন। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে সন্ধ্যার। গ্রামের সেই ঘটনাগুলো মনে পড়ে যায়। কোনো রকম হাত ছাড়ানোর জন্য জোড়াজুড়ি করে। তারপর শক্ত গলায় বলে, ‘হাত ছাড়ুন। এগুলো কি ধরনের বেয়া’দবি!’

তুহিন দাঁত বের করে বলে, ‘ওমা! বেয়া’দবি কেন করবো? আমি তো তোমার সাথে গল্প করতে আসলাম।’

সন্ধ্যা কিছু বলতে যাবে তার আগেই শান্ত গম্ভীর কন্ঠ কানে আসে, ‘শুধু ওর সাথে গল্প করলে চলবে! আমাদের সাথেও গল্প করো।’

তুহিন কন্ঠ শুনেই ঝট করে হাত ছেড়ে দেয়। সন্ধ্যা পেছনে ঘুরে আয়াশকে দেখে দ্রুত পায়ে তার কাছে যায়। তুহিন ফাঁকা ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করে। বলে, ‘আ-আরেহ আয়াশ ভাই! ত-তুমি?’

আয়াশ বাঁকা হাসে। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওদিকে দেখো লিজা আর জেরিন আছে ওদের কাছে যাও!’

সন্ধ্যা কথাটা শোনা মাত্রই হাঁটা লাগায়। আয়াশ তুহিনের কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘তোতলাচ্ছো কেন ভাই? তুমি তো সামান্য গল্পই করবে বলেছো এতে তোতলানোর কি আছে বলো! আমিও তো গল্প করতেই আসলাম। তা কোন হাত দিয়ে যেন সন্ধ্যার হাত ধরেছো!’

তুহিন ভয়ে কাঁপতে থাকে। তার অজানা নয় আয়াশ কি ধরনের মানুষ! আয়াশের রাগ সম্পর্কে তার যথেষ্ট ধারণা আছে। তুহিন বার বার ঢোক গিলতে থাকে। আয়াশ হুট করেই তুহিনের ডান হাত মুচড়ে ধরে। ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে তুহিন। আয়াশ ঠান্ডা গলায় বলে,

‘আমার জিনিসের দিকে কেউ তাকালে তার চোখও সহ্য হয় না আমার আর তুই তো সরাসরি আমার সম্পত্তিতে হাত দিয়েছিস! কত্ত বড় কলিজা রে তোর?’

সেসময় দৌড়ে আসে রানা। ব্যস্ত গলায় বলে, ‘কি করছিস আয়াশ! কি হয়েছে?’

আয়াশ তুহিনের হাত ছেড়ে দেয়। রানার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তুহিনের শার্টের ময়লা ঝাড়ার মতো করে বলে, ‘সন্ধ্যার দিকে তাকালে তোর চোখ তু’লে নিতেও আমি দুইবার ভাববো না। আর যদি হাত বাড়াস তোকে মাঝখান দিয়ে কে’টে রেখে দিবো। মাইন্ড ইট!’

আয়াশের ঠান্ডা গলার হুমকিতে কেঁপে ওঠে তুহিন। রানাও বেশ ভয় পায়। ভয়ে ভয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলে না। তুহিন ততক্ষণে পালিয়েছে। আয়াশ বড় করে শ্বাস নিয়ে গম্ভীর গলায় রানার উদ্দেশ্যে বলে, ‘এসব জা’নো’য়া’র আসবে আগে বলতি! অন্তত সন্ধ্যাকে আনতাম না।’

রানা কিছু বলতে গেলে আয়াশ ফের বলে, ‘সন্ধ্যাকে আনতে বলছিস আনছি। ওর দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও তার যা হাল হবে সেই একই হাল তোরও হবে। সো সন্ধ্যাকে সেইফ রাখার দায়িত্ব তোর। কি করবি না করবি তোর ব্যাপার!’

শিষ বাজাতে বাজাতে হাঁটা লাগায় আয়াশ। রানা শুকনো ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলে, ‘এই ছেলে আমাকেও থ্রেট দিয়ে গেলো! হায় আল্লাহ। আজ মনে হয় আমার চোখ দুটোরও ইন্না লিল্লাহ হবে।’

রানা দ্রুত লিজা আর জেরিনের কাছে আসে। সেখানে সন্ধ্যাও আছে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। তারপর লিজা আর জেরিনকে চাপা স্বরে বলে, ‘বইন জীবনে প্রথম বারের মতো একটা হেল্প কর। সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকমু।’

লিজা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘কি হেল্প লাগবো তোর!’

রানা খানিকটা অবাকই হয়। এতো সহজে তো মানার মেয়ে এরা না। বিষয়টা হজম করতে কষ্ট হলেও হজম করে নেয়। তারপর বলে, ‘একটু সন্ধ্যাকে এই অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে সাবধানে রাখ। সন্ধ্যার দিকে কেউ তাকালেও আয়াশ বলছে ওদের সাথে সাথে আামার অবস্থাও খারাপ করবে।’

লিজা আর জেরিন আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর আবার নিজেদের মতো দাঁড়ায়। হাই তুলতে তুলতে বলে, ‘আমরা কাউকে ফ্রি তে হেল্প করি না।’

রানা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘কি লাগবো তোদের?’

জেরিন ৩২ টা দাঁত বের করে বলে, ‘বেশি কিছু না। দুজনের দুইটা আইফোন।’

রানা কটমট দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর বলে, ‘এটুকু সাহায্যের জন্য ঘুষ নিবি তোরা! ছিঃ তোরা বান্ধবী নাকি শ’ত্রু?’

লিজা আর জেরিন একসাথে বলে উঠে, ‘শত্রু!’

রানা দাঁতে দাঁত চেপে ‘আচ্ছা’ বলে চলে যায়। লিজা আর জেরিন হাইফাই করে হাসতে থাকে। তারপর সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে দেখে বেচারী সন্ধ্যা হা করে তাকিয়ে আছে। লিজা আর জেরিন আরো একদফা হেঁসে নেয়। তারপর সন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘চলো ছাদে যাই!’

সন্ধ্যা প্রথমে মানা করলেও পরে রাজি হয়ে যায়। লিজা জেরিনকে চোখ দিয়ে কিছু ইশারা করলে জেরিনও আঙুল দিয়ে ‘ওকে’ বোঝায়। তারপর লিজা আর সন্ধ্যা ছাঁদের দিকে পা বাড়ায়। জেরিনকে না আসতে দেখে সন্ধ্যা বলে, ‘জেরিন আপু কোথায় গেলো?’

লিজা দাঁত বের করে বলে, ‘ও’ একটু জুস আনতে গেছে।’

‘ওহ।’ বলে দুজনে হাঁটতে শুরু করে। ছাঁদে দাড়ানোর কিছুক্ষণ পরই হাতে গ্লাস, বোতল নিয়ে হাজির হয় জেরিন। লিজা ছাঁদে বসে সেসব নিয়ে। সন্ধ্যা আর জেরিনও বসে। সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘এগুলো কি ধরনের জুস আপু?’

‘এগুলো একটু স্পেশাল বুঝলে!’

সন্ধ্যা শুধু ফ্যালফ্যাল করে দেখে গেলো লিজা আর জেরিনের কাজ। গ্রামের মেয়ে হওয়ায় সে কখনোই দেখেনি এসব। লিজা একটা গ্লাস সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘টেস্ট করো সন্ধ্যা। দারুণ মজার এগুলো।’

সন্ধ্যা একবার গ্লাসের দিকে তো একবার লিজার দিকে তাকায়। তারপর হেঁসে বলে, ‘নাহ আপু। তোমরাই খাও আমি খাবো না।’

‘এই কথা বললে তো শুনবো না। রানা যদি শোনে তোমার যত্ন করিনি আমরা তাহলে ছাঁদ থেকে ফে’লে দিবে। তুমি কি চাও অকালে আমাদের প্রা’ণ যাক!’

সন্ধ্যা মাথা দুদিকে নাড়ায়। জেরিন হেঁসে বলে, ‘তাহলে এটা খাও। প্রথমে একটু খারাপ লাগবে তারপর দেখবে দারুণ টেস্ট।’

‘তোমরা কখনো খেয়েছো?’

লিজা আর জেরিন ৩২ টা দাঁত বের করে একসাথে বলে, ‘নাহ গো। আজই প্রথম।’

সন্ধ্যা আর কিছু বলে না৷ গ্লাস মুখের কাছে আনতেই গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে। দ্রুত গ্লাস সরিয়ে বলে, ‘ছিঃ এটার কি বাজে গন্ধ!’

‘আরে এক চুমুক খাও তো আগে। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’

জোড় করে লিজা আর জেরিন সন্ধ্যাকে খাইয়ে দেয়। প্রথম দিকে গন্ধ আর গলা জ্বালা করলেও পরে ভালো লাগতে শুরু করে। একের পর এক গ্লাস শেষ করে ফেলে। বেচারী সন্ধ্যা বুঝতেও পারে না সে জুস নয় ওয়াইন খাচ্ছে। প্রথম বার খাওয়ার জন্য বেশ অল্পতেই নেশা হয়ে যায়। সন্ধ্যা নেশার ঘোরে লিজা আর জেরিনের থেকে বোতল কেড়ে নেয়। ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে, ‘আমি পুরোটাই খাবো। তোমাদের একটুও দেবো না।’

‘নাহ নাহ। আর খেয়ো না।’

লিজা আর জেরিনের কথা পাত্তা না দিয়ে বোতল মুখে লাগায় সন্ধ্যা। লিজা আর জেরিন কোনো রকমে বোতল টেনে অন্য জায়গায় সরিয়ে দেয়। সন্ধ্যা ঠোঁট উল্টে ফ্লোরে পা মেলে বসে। বাচ্চাদের মতো করে বলে,

‘আমি তোমাদের সাথে কথা বলবো না৷ তোমরা পঁচা!’

লিজা মাথা চুলকে বলে, ‘বান্ধবী রে এইটা কি আকাম করে ফেললাম রে! আয়াশ আর রানা আজ আমাদের ক’ল্লা কা’ইটা হাতে নিয়া ঘুরবে।’

জেরিন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, ‘সব তোর দোষ। তোকে কতবার বলছি মেয়েটা কখনো এসব খায়নি ওর বেশি নেশা হয়ে যাবে। তুই তো কানেই তুললি না।’

ওদের কথার মধ্যে সন্ধ্যা বলে ওঠে, ‘এই তোমরা কি ফিসফিস করতেছো! আচ্ছা তোমরা ৪ জন কে? এই তো এটা লিজা আপু, এটা জেরিন আপু আর এই দুটো কে! ওমা এখন তো ৬ টা মেয়ে।’

লিজা আর জেরিন কপালে হাত দেয়। সন্ধ্যা এক, দুই করে গুণতেছে। সন্ধ্যা হুট করেই আকাশের দিকে তাকিয়ে কান্না করে ওঠে। ভয় পেয়ে যায় লিজা আর জেরিন। ব্যস্ত গলায় সন্ধ্যাকে বলে, ‘কাঁদছো কেন? কি হয়ছে!’

সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, ‘আমি আম্মার কাছে যাবো! আম্মা আমাকে একা ফেলে ওই আকাশের তাঁরা হয়ে গেছে। আমি আম্মার কাছে যাবো।’

লিজা আর জেরিনের কোনো কথায় শুনছে না সন্ধ্যা। বার বার বলছে ‘আম্মার কাছে যাবো’। কোনো উপায় না পেয়ে জেরিন শুকনো ঢোক গিলে বলে, ‘দেখ মা’ইর এমনেও খাওয়া লাগবে ওমনেও খাওয়া লাগবে তার থেকে ভালো হবে আমরা আগে আয়াশকে ডাকি। সন্ধ্যাকে ওই সামলাতে পারবে।’

লিজা উপায় না দেখে সায় দেয়। জেরিন উঠে দ্রুত আয়াশকে খুঁজে। আয়াশ তখন রানার সাথে কথা বলতেছিলো। জেরিন ভয়ে ভয়ে আয়াশের কাছে এসে বলে, ‘আয়াশ একটু ছাঁদে চল!’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘ছাঁদে কেন যাবো! কি হয়ছে?’

জেরিন আমতা আমতা করে বলে, ‘আসলে স-সন্ধ্যা!’

আয়াশ ব্যস্ত গলায় বলে, ‘কি হয়েছে সন্ধ্যার?’

‘তুই আগে ছাঁদে চল।’

আয়াশ আর দেরী করে না। ব্যস্ত পায়ে ছুটে যায় ছাঁদে। রানা আসতে চেয়েছিলো জেরিন আটকে দিয়েছে। আয়াশ ছাঁদে এসে দেখে সন্ধ্যা বাচ্চাদের মতে কাঁদছে আর বলছে ‘আমি আম্মার কাছে যাবো’। আয়াশ ভয় পেয়ে যায়। হঠাৎ সন্ধ্যার কি হলো! দ্রুত পায়ে সন্ধ্যার কাছে এসে হাঁটু মুড়িয়ে বসে সন্ধ্যাকে নিজের দিকে ফিরায়। লিজা আর জেরিন ভয়ে আয়াশের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা আয়াশকে দেখেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বলে,

‘আপনি খুব পঁচা শহুরে ডাক্তার। আমি আপনার কাছে থাকবো না। আমি আম্মার কাছে যাবো!’

সন্ধ্যার মুখের গন্ধ আর কথার ধরনে ভ্রু কুঁচকে যায় আয়াশের। পেছনে তাকিয়ে দেখে লিজা আর জেরিন আহম্মকের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়াশ গম্ভীর গলায় বলে, ‘কি খাইয়েছিস ওকে?’

লিজা শুকনো ঢোক গিলে বলে, ‘আ-আসলে আ-আমরা…

‘আসলে নকলে বাদ দিয়ে যা জিজ্ঞেস করেছি তার আন্সার দে!’

জেরিন কোনো রকমে বলে, ‘আমাদের পরে বকিস। এখন ওকে সামলা প্লিজ।’

আয়াশ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। আসলেই এদের মাথায় বুদ্ধি সুদ্ধি নাই। আয়াশ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোরা যা। আমি ওকে নিয়ে আসতেছি।’

‘তুই পারবি?’

আয়াশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় দুজনের দিকে। দুজনে ভয়ে দুই মিনিটেই হাওয়া হয়ে যায়। সন্ধ্যা এতক্ষণ আয়াশের পাঞ্জাবির কলার টানতেছিলো। আয়াশ কলার থেকে সন্ধ্যার হাত ছাড়িয়ে বলে,

‘উঠো। বাড়ি যাবো।’

সন্ধ্যা নাক মুখ কুঁচকে বলে, ‘কিসের বাড়ি? কোথাকার বাড়ি? আমার তো বাড়িইই নাই।’

‘আমার বাড়ি যাবো।’

সন্ধ্যা ঠোঁট উল্টায়। আয়াশের বুকে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলে, ‘আপনার বাড়ি যাবো না। আপনি ভীষণ পঁচা। আমাকে একটুও ভালোবাসেন না।’

আয়াশ কিছু বলে না। সন্ধ্যাকে টেনে দাঁড় করায়। সন্ধ্যা উঠতে নারাজ। সে কোনোমতেই উঠবে না। আয়াশ জোড় করে টেনে তুলার পর সন্ধ্যা আয়াশের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ায়। ড্রাংক হওয়ার জন্য ঠিক মতো দাড়াতেও পারছে না। সন্ধ্যা আয়াশের বক্ষে মাথা রেখে দু হাতে আঁকড়ে ধরে। বিড়বিড় করে বলে, ‘এই শহুরে ডাক্তার!’

আয়াশ ছোট্ট করে ‘হু’ বলে। সন্ধ্যা আয়াশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি শহুরে ডাক্তার। আপনি আমার হবেন? ভালোবাসবেন আমাকে?’

হার্টবিট বন্ধ হওয়ার উপক্রম আয়াশের। সন্ধ্যামালতীর মুখে ‘ভালোবাসি’ শুনে যেনো শহুরে ডাক্তারের দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সন্ধ্যা মাথা তুলে তাকায় আয়াশের মুখের দিকে। তখনো সে আয়াশকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে আছে। আয়াশের মুখের দিকে তাকিয়েই জড়ানো গলায় বলে,

‘ভালোবাসবেন না?’

আয়াশ শ্বাস আটকে মাথা নাড়ায়। সে ভালোবাসবে তার সন্ধ্যামালতীকে। সন্ধ্যা ফের জড়ানো গলায় বলে, ‘আমাকে কেউ ভালোবাসে না। আর যারা ভালোবাসে তারা আমাকে একা করে দিয়ে আকাশের তাঁরা হয়ে যায়। আপনি কখনো আমাকে একা করে দিয়ে হারিয়ে যাবেন না তো শহুরে ডাক্তার!’

আয়াশ আগলে নেয় সন্ধ্যাকে। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘নাহ। আমি কখনোই তোমাকে একা করে হারাবো না। আমি আজীবন তোমার হয়ে তোমার সাথে থাকবো সন্ধ্যামালতী।’

সন্ধ্যা হাসে। আয়াশের হাতের বেড়াজালে থেকে মাথা ঘুরিয়ে দু হাত মেলে বলে, ‘আমার শহুরে ডাক্তার। শুধু আমার!’

হঠাৎ করেই মিইয়ে যায় সন্ধ্যা। আয়াশের দিকে মাথা উচু করে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলে, ‘আমার আব্বা যেমন করে আমার আম্মাকে ভালোবাসতো আপনি কখনোই আমাকে তার মতো করে ভালোবাসবেন না শহুরে ডাক্তার।’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে, ‘কেন? তুমি তো তোমার বাবাকে অনেক ভালোবাসো তাহলে!’

সন্ধ্যা অদ্ভুত ভাবে হাসে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে, ‘ভীষণ ঘৃণা করি আমি আমার আব্বাকে। ভীষণ রকম ঘৃণা। যাকে আমি পুরো পৃথিবীর থেকে বেশি ভালোবাসতাম ওই মানুষটাকেই আমি সবথেকে বেশি ঘৃণা করি।’

আয়াশ অবাকের সপ্তম পর্যায়ে। মাথা যেনো ঘুরিয়ে আসে। কি এমন হলো যার জন্য সন্ধ্যা তার বাবাকে এতো ঘৃণা করে! সন্ধ্যা তো ওর বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতো তাহলে হঠাৎ কি হলো! কি হয়েছিলো সন্ধ্যার বাবা আর মায়ের! চারদিকে হাতড়েও কোনো উত্তর পেলো নাা আয়াশ। সন্ধ্যা তখনো আওড়াচ্ছে একই কথা। একসময় ক্লান্ত হয়ে আয়াশের বুকে মাথা রেখেই চুপ হয়ে যায়। আয়াশ বার বার সন্ধ্যাকে ডেকেও সাড়া পায় না। ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোলে তুলে নেয়। অগ্রসর হয় ছাঁদের দরজার দিকে সাথে নিয়ে যায় অনেক প্রশ্ন যার একটা উত্তরও তার কাছে নেই। সন্ধ্যা কি এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর আদৌও দেবে নাকি সব রহস্য ঢাকা পড়ে যাবে ধীরে ধীরে! সেটাও জানা নেই আয়াশের..

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here