সমর্পণ,পঞ্চম পর্ব

0
695

#সমর্পণ,পঞ্চম পর্ব
#মুক্তা_রায়

একটু চোখটা লেগেছে কী লাগেনি, আবার বোঝে কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।জানে বাপ্পা এসেছে।এও জানে তারও পরিণতি ওই মেয়ে দুটোর মতোই হবে।ও কাউকে ভালোবাসে না—কাউকে নয়!তবে কেন তার মাথায় এত যত্ন করে হাত বুলোচ্ছে?ভালোবাসার স্বপ্ন দেখিয়ে সেটাকে ভেঙ্গে খানখান করবে বলে?হয়তো আজ কাল যেকোন দিন তাকেও চরম কথাটা বলে ফেলবে।তারপর বাঁচবে কী করে অপু?কেন এমন ভুল করছে অপু?দুদিনের চেনা একটা ছেলেকে কেন মনপ্রাণ দিল?কেন ওকে এত আপন লাগে?
– অপু?ঘুমোলে সোনা?
অপু শোনে কী স্নেহমাখা মিষ্টি গলা।এই গলা একটু আগেও শুনেছে।তবে এমন স্নেহমাখা মধুর নয়।প্রথমে কামনা-মাদকতাভরা, শেষে সেই গলা হয়ে উঠেছিল তীক্ষ্ম, কর্কশ, শ্লেষ-ঘৃণাভরা।নাহ্ ,ওকে ভালো করে তুলতেই হবে।চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে বাপ্পার হাতে শাড়ির প‍্যাকেট। © মুক্তা রায়
– এই শাড়িটা পরে একটু সাজো না লক্ষ্মীটি।ফোট তুলবো তোমার।
যন্ত্রের মতো উঠে গিয়ে শাড়িটা পরে অপু।ফাঁসির আসামির শেষ নতুন পোশাক।কপালে-সিঁথিতে সিঁদুর দেয়।বাপ্পা ঘোমটা পরিয়ে কটা ফটো তুলে ফেলে।তারপর পাশে এসে বসে জড়িয়ে ধরে অপুকে।
– কী?মেয়ের মুখ ভার কেন?
– না, মানে আনন্দের হাট ভেঙ্গে গেল, এবার যে যার ঘরে ফেরার পালা।
– আমি যাব পরশু।আমায় চিঠি লিখবে তো?এই আমার ঠিকানা আর ফোন নম্বর-
পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে অপুর হাতে দেয় বাপ্পা।
– আমায় তুমি ভুলবে নাতো?আমি গরীবের মেয়ে-
– ছেলেরা যাকে ভালোবাসে প্রাণ দিয়ে দেয়।তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।যদি তোমায় ভালোবাসি খাদ পাবে না সেই প্রেমে।
এবার অপুকে বাপ্পা কাছে টানে।চরম সুখ ছড়িয়ে দেয় অপুর শরীরে।বাপ্পা ওকে সুখ দেয়,কিন্তু সমর্পণ নয়।হৃদয় ছুঁয়ে যায় না এই সুখ।
– অপু?
– উঁঃ –
আনন্দে আবেগে বাপ্পার বুকের থেকে উত্তর দেয় অপু।জীবনের একটা নতুন দিক যেন খুলে গেল অপুর কাছে।বুঝলো ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হল।
– তুমি খুশি তো?
– তুমি বলে কেউ এঘরে আছে?
– মানে?
চঞ্চল হয়ে ওঠে বাপ্পা।কী বলতে চায় মেয়েটা?
– আমি আমার অস্তিত্ব হারিয়ে কারও মধ্যে মিশে গেছি-
– কিন্তু আমি তো হারাইনি।তোমার শুনলে খারাপ লাগবে, তোমায় ভালোবাসি না আমি।তবে তোমায় অতটা খারাপ লাগেনি বলে আমার ভালোবাসা দিতে পারলাম না ঠিকই, কিন্তু আমার কৌমার্য তোমায় দিলাম।
– ভালোবাসা বড্ড ছলনা করে।যাকে মনে হয় দেব না তাকেই দেওয়া হয়ে যায়।যাকগে, ঘর গিয়ে ঘুমোও তুমি।যাকে ভালোবাসো না তার সাথে সময় কাটিয়ে নিজেকে কষ্ট দিও না।তবে আমার কষ্ট নেই।আমি তোমায় ভালোবাসি।তাই আমার আর কিছুই চাওয়ার বা পাওয়ার নেই। © মুক্তা রায়
বাপ্পা উঠে চলে যায়।অপুর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।ঘুম ভাঙ্গে পরদিন বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ।ধড়মড়িয়ে উঠে অপুর খোঁজ নিতে গিয়ে শোনে অপু চলে গেছে।দৌড়ে যায় অপুর বাড়ি।সেখানে গিয়ে শুনতে পায় অপু ওর বাবার সাথে কোন আত্মীয়ের বাড়ি গেছে।বাড়িতে তালা।ফিরে আসে।কেন যেন অপুকে কষ্ট দিয়ে কষ্টটা নিজের বুকেই ধাক্কা মারলো!অপু যে তার মানসী–তার ভালোবাসা।ভালোবাসতে না চেয়েও অপুকে ভালোবেসেছে।অপু তো সবার মতো নয়।তবু কেন কেন সে অপুকে কষ্ট দিলো?আমার মুখের কথা বিশ্বাস কর না অপু,আমার মনকে বোঝ।আমিও যে তোমাতে লীন হয়ে গেছি সোনা।

ফিরে এসে মাসীর ঘ‍্যানঘ‍্যানানি শোনে।দেখে
মা-বাবার মুখ কালো।মেয়েদুটো ফুচুর ফুচুর কাঁদছে।কাঁদুক ওরা।তার অপুকে কম কষ্ট দিয়েছে এই কদিনে?উঠে চলে যায় ছাদে।ভাবছে এই কদিনের কথা।যখন রায়গঞ্জে এল ভাবতেও পারেনি এমন অদ্ভুত একটা মেয়ে তার জীবনে আসবে।ওর বলে কিছুই চাওয়ার পাওয়ার নেই!সত্যি সত্যি ও সবার জন্য নিঃশব্দে কাজ করে চলে।কী সেবা কী যত্ন!এমন মেয়েও পৃথিবীতে আছে?ঠিক যেন তার মায়ের মতো।ছোটতে বলে বাপ্পা মাকে বলত,’ মা,আমি তোকে বে করব।’ সবাই হাসতো তার কথায়।আজ সত্যি সত্যি মায়ের এক শিষ‍্যাকেই বিয়েটা করল।পিসিমণি বলে,
‘ অপুটা বৌদির চ‍্যালা হয়েছে।’তার একটা আস্তো বউ আছে।তার অপু।কথাটা মাকে জানতে হবে।না না–!এ কী ভাবছে বাপ্পা?সে না ভেবেছে চিরকুমার থাকবে?কিন্তু কুমারই যে সে নয়।তাতে কী?ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট।সে অবিবাহিত।শুধু পড়াশুনো।এ ছাড়া তার জীবনে আর কিছু নেই।কিচ্ছু নেই–।।
অপু কেমন যেন একটু অন‍্যমনস্ক হয়ে গেছে।কিছুটা রোগাও হয়েছে।স‍্যারের বাড়িতে আর খায় না।মাকে সবিনয়ে না করেছে।মাও কিছু একটা আন্দাজ করে আর জোর দেন না।শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকেন।অপু ওনার সাথে একটু গল্প করেই চলে যায়।পোস্টাপিসে চাকরির চেষ্টা করছে অপু।তার যা নম্বর হয়ে যাবে মনে হয়।পার্ট ওয়ান পরীক্ষা হয়ে পার্ট টু পরীক্ষাও এসে গেছে।দুর্গাপূজো পেরিয়ে গেল।বাপ্পা আসতে পারেনি।পড়া নিয়ে ব‍্যস্ত।পূজোয় যথারীতি অপুই খাটাখাটনি করেছে আর রাতে রাতে লুকিয়ে কেঁদেছে।গ্রামের মেয়ে অপু সেইদিনের পর থেকে শাড়ি পরা ধরেছে।তার যে বিয়ে হয়েছে।সে বিদূষী ঠিকই, কিন্তু শহুরে আধুনিকতার তার নেই।স্নান করে এসে সিঁদুর দেয়।মানুষটা তাকে ছেড়ে গেলেও সে মানুষটাকে ছাড়তে পারেনি। © মুক্তা রায়
তারপর একদিন রতনবাবু চলন্ত বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন।পেছনের চাকাটা ওনার ওপর দিয়ে চলে যায়।অপু তিনদিনের কাজ করে।ওর কাছে ছুটে এসেছিলেন স‍্যার, মা,বনানী দিদিমণিরা।স‍্যার তাকে ওনার বাড়ি নিয়ে যেতে চান।একা মেয়ে কোথায় যাবে?ওনাদের জোরাজুরিতে রাজী হতেই হয়।যাবার সময় বাড়ির চারদিকটা দেখতে থাকে।চারদিক জুড়ে বাবার স্মৃতি।বাবার হাতের তৈরি বাগান ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে , যেমনভাবে বাবার মেয়ে একটু একটু করে শুকিয়ে যাচ্ছে।
স‍্যারের অনুরোধে তো গেল ওই বাড়ি, কিন্তু সেখানে কিছুই ভালো লাগে না অপুর।স্মৃতি যেন পাথর হয়ে তার বুকে চেপে বসে তার নিঃশ্বাসটুকু রোধ করার চেষ্টা করছে!পরীক্ষাটাও হয়ে গেল।কম্পিটিটিভ পরীক্ষাগুলোয় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে অপু‌।মানুষটার ঘরটা ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করে রাখে শুধু।দেখে একটা সেতার।মার কাছে শুনলো সেতার ভালো বাজায়।দিল্লিতেও আছে একটা।বড়ভাই বাজাতো তবলা।মায়ের বাবা জজ বিশ্বনাথ মুখার্জি দুই নাতির শিক্ষার কোন ত্রুটি রাখেননি।শুনলো দিল্লির কোন্ ধনী এই বাড়ির ছেলেকে জামাই করতে আগ্রহী।সার্জন জামাই।ঠিক করেছেন তিনি জামাই-মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে দেবেন।জামাই ওখানে ফার্দার স্টাডি করে ডলার রোজগার করবে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপু।সিঁথিটা উল্টে নিজের সিঁদুরের রেখেটুকু দেখে।আজই পেয়েছে পোস্টাপিসের ট্রেনিংয়ের চিঠিটা।

আগামীমাসে বিয়ে।স‍্যার আর মা যাবেন মেয়েকে দেখে আশির্বাদ করতে।অপু ওনাদের বলে ট্রেনিংয়ে চলে এসেছে।এখানেও চুপচাপ একাই থাকে।এই
চাকরি-বাকরি, জগৎসংসার কিছুই ভালো লাগে না।এত বড় পৃথিবীতে একা হয়ে গেছে।কেউ নেই যার ভালোবাসার জোরে বাঁচবে, যার জন্য বাঁচবে।যার জন্য বাঁচা সে কারও হয়ে যেতে চলেছে।টাকাই তাহলে জিতলো?আর কিছুই দামি নয় টাকার চেয়ে এই পৃথিবীতে?তবে এই পৃথিবীতে থেকে কী লাভ?এই পৃথিবী তো মরুময়।ভালো লেখাপড়ায় হয়েও সে জীবনে তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলো না।আচ্ছা, সে যাক।কাউকে নিয়ে কারও ভালোবাসায় বাঁচবে, তাও জুটলো না।বাবাও নেই।পরের কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকা।এমন মানুষের বাঁচার কী দরকার?ট্রেনিংয়েও শান্ত-মিষ্টি স্বভাবের জন্য অপু সবারই ভীষণ পছন্দের মেয়ে। © মুক্তা রায়
– অপর্ণা, তোমায় আজ গান শোনাতে হবে-
শেষদিনে ছোট্ট একটা ফাংশন হয়েছিল।সেখানেই সবাই ধরল অপুকে।অপু পাশ কাটাতে চায়।বহুদিন প্র‍্যাকটিশ নেই।আগে প্রবীরজ‍্যেঠুর কাছে গান শিখতো।টাকা নিতেন না।বাবাকে বলতেন,’তোর মেয়ে ভালো গাইয়ে হবে।’ফোর্থ ইয়ারে জ‍্যেঠু মারা যাওয়ায় গানের ইতি।হঠাৎ কখনো নিয়ে বসতো।এখন মাকে মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদী,ভক্তিগীতি গেয়ে শোনাতে হয়।মা আবার গান শেখাতে চান।অপুই না করেছে।সেদিন গান ধরলো অপু-তীর বেঁধা পাখি আর গাইবে না গান।
ট্রেনিং শেষ করে স‍্যারের বাড়িতে ফিরে এসেছে অপু।দু-চার দিনের মধ্যেই পোস্টিং হবে।
– তোমরা গেলে না মা?
– যাব রে।বাপ্পাটা ফোন করে বলল,কদিন দেরী আছে।পরে যেতে।ডেট বলে পেছোবে-
– ওহ্,আমি রান্নাঘরে যাই।স‍্যারের রাতের তরকারি-রুটি বানাইগে-
– এখানে যদি তোর পোস্টিং হতো-
– না মা, দূরে পোস্টিং চেয়েছি।অনেক অনেক দূরে-
দৌড়ে বেরিয়ে যায় অপু।পরদিনই পোস্টিং পেয়ে গেছে বলে রওনা দেয়।স‍্যার কলেজে।মা বার বার বললেন,’সময় আছে।কাল যাস।তোর স‍্যার লোক দেবেন তোর সাথে।’রাজী নয় অপু।বলে তিনদিন পর রবিবার এসে জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যাবে জলপাইগুড়ি।আজ ওকে যেতেই হবে।ও গিয়ে পরে কোন পৌঁছখবর নেই।অস্থির হয়ে ওঠেন স্নেহাংশুবাবু ও তাঁর স্ত্রী।এমন সময় পীযূষ বলে একটা ছেলে দেখা করে জানায় অপর্ণা কেন জয়েন করছে না।ওর পোস্টিং তো রায়গঞ্জেই হয়েছে।
রাতে বাপ্পা মায়ের ফোন পায়।
– আমি অভির চোখ আবার দেখেছি রে বাবু।আবার আমার অভি একা-নিঃসঙ্গ-ভালোবাসাহীন হয়ে হারিয়ে গেছে!ওর সঞ্চিতা আবার ওকে ধোঁকা দিয়ে ধনীর ঘরে বিয়ে করছে।আমার অপুই যে অভি।ও হারিয়ে গেছে।তোকে কতদিন না করেছি প্রতিশোধ নিস না।একের দোষে সবাইকে দোষী করিস না।শুনলি না তুই।অপুর মতো মেয়েকেও তুই ধোঁকা দিয়ে কষ্ট দিলি!যাক ও মরে।তুই তো সুখী হবি?এই তো চেয়েছিলি তুই?আমরা তোর বিয়েতে যেতে পারবো না এমন মানসিক অবস্থায়। © মুক্তা রায়
– মা,কোথায় ও?
আকুল গলা বাপ্পার।
– জানি না-
ফোনটা নামিয়ে রাখেন বসুধাদেবী।মনটা তেতো হয়ে আছে।পরের পরদিনই দিল্লি থেকে দৌড়ে আসে বাপ্পা।
– কেন এসেছিস তুই?ওর শ্রাদ্ধশান্তি করতে?তোর শ্বশুর তোর পেছন পেছন দৌড়ে আসবে নাতো?
কিছুক্ষণের জন্য বোবা হয়ে যায় ছেলেটা।মুখে কদিনের না কামানো দাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল, অবিন‍্যস্ত বেশবাস।লাল হয়ে আছে চোখদুটো।কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু ঠোঁট কাঁপছে।একটু চোখ বন্ধ করে সময় নিয়ে ধীর গলায় বলে-
– না মা, আমার শ্বশুরমশাই যে নেই অপু জানায়নি।আমি ওর চিঠি-ফোনের অপেক্ষা করতাম।কিন্তু কোনদিনই আমায় চিঠি দিল না ও।তোমাদের মুখেই ঘটনাটা জানলাম।তোমাদের কাছে আছে শুনে আশ্বস্ত হয়েছি।আমারই ভুল।আমার তখনই ওর কাছে আসা উচিত ছিল।অন্তত ফোনটাও যদি করতাম।যে মানুষটি এত যত্ন করলেন ওনার বাড়িতে তাঁর মৃত‍্যুতে একটু সমবেদনাও জানাইনি ওনার মেয়েকে!আমার যে ওর সামনে দাঁড়াবার মুখ নেই-
– তবে আজ কেন এসেছিস?যা।দিল্লি ফিরে বিয়ের আয়োজন কর-
– কার বিয়ে মা?বিয়ে তো আমার হয়েই গেছে অপুর সাথে কবেই।দিল্লির ব‍্যাপারটা পুরো বানানো।অপু ছাড়া আমার জীবনে কেউ নেই।ও যাতে সাড়া দেয় তাই ওই গল্প বানিয়েছি।ও যে অমন করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ভাবিনি।ওকে আমি ভালোবাসি মা।খুঁজে ওকে বের করবই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here