সম্পর্কের_বাঁধন পর্ব০৩

0
2250

সম্পর্কের_বাঁধন
পর্ব০৩
লেখাঃনীল কাব্য

আট মাস পর…..
আদিবার মা আদিবাদের বাসায় আসছে আজ দুই দিন হলো। আদিবা তার সৎ মা কে নিজের মায়ের জায়গায় বসিয়েছিল। কিন্তু তার সৎ মা তাকে নিজের মেয়ের জায়গা দিতে পারেনি। আদিবার মায়ের সাথে তার ছোট ভাই ও আসছে। আদিবার ছোট ভাইয়ের নাম আরিফ। এবার সেভেন এ পড়ে। আদিবার মা তাকে সৎ মেয়ে ভাবলে ও আদিবার ভাই একদম আদিবা কে সৎ বোন ভাবে না। নিজের মায়ের পেটের বোনের মতই আদিবা কে ভালোবাসে।
আদিবা কিচেনে অন্তীলার জন্য দুধ গরম করছিল। অন্তীলা দোলনায় শুয়ে আছে। আদিল অফিসে। আর আদিবার মা রুমে। অন্তীলার কান্নার শব্দ শুনে আদিবা কিচেন থেকে দৌঁড়ে অন্তীলার কাছে আসলো। অন্তীলা কে কোলে নিয়ে
“– কি হলো আমার মামনি টার? পঁচা মেয়েদের মত এতো কান্না করছে কেন?
কাঁদে না সোনা। এই তো তোমার জন্য দুধ নিয়ে আসছি। চুপটি করে লহ্মি মেয়ের মত দুধ টুকু খেয়ে ঘুমিয়ে যাও তো।
তোমার আম্মুর অনেক কাজ বাকি আছে। আম্মুর কাজ শেষ হয়ে গেলে পরে তোমার সাথে অনেক খেলা করবে।
অন্তীলার কান্না শুনে আদিবার মা রুম থেকে বের হয়ে আসে। আদিবার মা আদিবার কাছে এসে দেখে আদিবা অন্তীলা কে( ফিডারে) করে দুধ খাওয়াচ্ছে।
“– পরের মেয়েকে এতো আদর যত্ন দিয়ে বড় করলে তোর লাভ টা কি?
আদিবা তার মায়ের কথা শুনে, মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার অন্তীলা কে দুধ খাওয়াতে মনযোগ দিল। আদিবার মায়ের মুখে এমন কথা শুনে আদিবা একটু ও অবাক হয়নি। কারণ ছোট থেকে আদিবা এমন কথা আগেও বহু বার শুনেছে। তাই আজ আদিবার কাছে এই কথা নতুন বলে মনে হলো না আর তেমন কষ্ট ও পেল না। এখন আদিবার এসব শুনে অভ্যাস হয়ে গেছে। আদিবা তার মা কে কিছু না বলে অন্তীলা কে কোলে নিয়ে বারান্দা থেকে রুমে যেতে নিচ্ছিল।
“– আমি কি বলি,ও তো তোর নিজের মেয়ে না। তোর পেট থেকে জন্মায় নি। ওকে এখন যতই আদর যত্ন দিস না কেন, বড় হয়ে একদিন ঠিকই বলবে তুই ওর সৎ মা।
“– মা আমি এসব কথা শুনতে চাই না। তাই প্লিজ আমার কাছে এসব কথা বলতে এসো না।
“– আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি। তুই নিজের একটা বাচ্চা নে। এই সংসারে তোর খুঁটি পাকা কর। পরের মেয়ের এতো দেখাশুনা না করে নিজের কথা টা ও একটু ভাব।
আদিবা অন্তীলা কে আবার দোলনায় শুইয়ে দিয়ে ওর মায়ের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে
“– তুমি আমার ভালোর জন্য বলছো? সত্যি ই মা তুমি আমার ভালোর কথা চিন্তা করো? সংসারে খুঁটি পাকা করলেই কি,সংসারে সুখে শান্তিতে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো?
আমার নিজের বাচ্চা না থাকলে কি এই সংসার আমার হবে না?
আর তোমাকে কে বলেছে অন্তীলা আমার মেয়ে না? জন্ম দিলেই কি মা হওয়া যায়, নয়তো কি মা হওয়া যায় না?
“– আমি তোর ভালোর কথা না ভাবলে এতো ভালো ঘরে তোর বিয়ে দিতাম না। সংসারে যদি তোর পাকা খুঁটি না থাকে তাহলে সংসার টা তুই হাতে রাখবি কি করে?
তোর নিজের যদি একটা বাচ্চা না থাকে তাহলে এই বিশাল সম্পত্তির একা মালিক হবে এই মেয়েটা। তুই কিছুই পাবি না। পর কখনও আপন হয়না। এই মেয়ের সাথে তোর কিসের বাঁধন?
রক্তের সম্পর্ক গুলো ই এখন নিজের বাবা মা কে দেখে না।
“– দোহাই তোমার মা। চুপ করো।আমি আর শুনতে পারছি না। তুমি আমার ভালোর কথা ভাবো দেখেই টাকার লোভে আমার থেকে দশ বছরের বড় একজন বিবাহিত লোকের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিলে। মাসে মাসে উনি তোমাকে টাকা পাঠিয়ে দেয় এটা এখনও আমার অজানা না। আমি এই সংসার টা হাতে রাখতে চাই না। আমি ভালোবাসা দিয়ে সংসারের মানুষ গুলোর মনে একটু জায়গা করে নিতে চাই। ধন সম্পদ টাকা পয়সা এগুলো সারা জীবন থাকে না কিন্তু ভালোবাসা সারা জীবন থাকে। আমি এই বিশাল সম্পত্তির এক অংশও চাই না। পর কখনও আপন হয়না এটা ভেবেই তো তুমি কোনো দিন আমাকে আপন করে নেও নি তাই না মা?
অন্তীলার সাথে আমার ভালোবাসার বাঁধন, সম্পর্কের বাঁধন। সম্পর্কের বাঁধন যা রক্তের বাঁধনের চেয়ে অনেক বড়। আমি তোমার মত হতে চাই না মা। আমি আমার মেয়েকে আমার সব ভালোবাসা উজাড় করে দিতে চাই।
“– আমি শুধু তোর কথা ভেবেই বলছিলাম। তোর যা মনে আসে তুই তা কর। আমার কথা তুই শুনবি কেন আমি তো আর তোর নিজের মা না যে তুই আমার কথা শুনবি।
“– তুমি নিজে কখনও আমাকে আমার নিজের মেয়ে ভেবেছো?
তুমি যদি আমার কথা ভাবতে তাহলে, আমাকে নিজের বুকে আগলে রাখতে। তুমি যদি আমার কথা ভাবতে, তাহলে আমাকে কখনও সৎ মেয়ে মনে করে দূরে ঠেলে দিতে না। তুমি যদি আমার কথা ভাবতে তাহলে, ছোট বেলা আমাকে একা ঘরে থাকতে না দিয়ে নিজের কাছেই রাখতে। তুমি যদি আমার কথা ভাবতে তাহলে, আমি যখন রাতে একা একা ভয় পেয়ে ঘুমাতে পারতাম না তখন তুমি আমার পাশে থেকে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ানোর গান বলে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে। তুমি যদি আমার কথা ভাবতে তাহলে, এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর পরই বিবাহিত একজন লোকের সাথে আমার বিয়ে দিতে না।
অন্তীলা দোলনায় শুয়া অবস্থায় কাঁদতে লাগলো। আদিবা অন্তীলার কান্না শুনে অন্তীলা কে কোলে নিয়ে রুমে চলে গেল। আদিবার মা এখনও স্থির দৃষ্টি নিয়ে আদিবার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আদিবার বলা কথা গুলো শুনে আদিবার মায়ের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। আদিবার মায়ের মনে অপরাধ বোধ কাজ করছে। একবার যদি আদিবা কে নিজের সন্তান ভেবে বুকে টেনে নিত। আদিবা কে যদি একটু ভালোবাসা দিত।
আদিবার মা বিকেলে আরিফ কে নিয়ে আদিবাদের বাসা থেকে চলে গেল। যাওয়ার সময় খুব ইচ্ছে করছিল আদিবা কে একটা বারের জন্য বুকে টেনে নিত কিন্তু নিজের অপরাধ বোধের কারনে তা আর পেরে উঠলো না।
সন্ধ্যায় আদিল বাসায় আসলো। হাতে কয়েকটা শিউলি ফুলের মালা। আদিল রুমে এসে শিউলি ফুলের মালা গুলো ড্রেসিনটেবিলের সামনে রেখে, গলা থেকে টাই টা খুলে র্শাটের বোতাম খুলতে খুলতে আদিবা কে ডাক দিল। আদিবা পাশের রুম থেকে আদিলের ডাক শুনে এই রুমে আসলো।
“– মা কোথায়?
“– চলে গেছে।
“– চলে গেছে কেন?
আচ্ছা কখন গেছে?
“– এই তো বিকেলের দিকে।
“– আর কয়েক দিন থেকে যেতে বলতে।
আদিবা আদিলের কথার উত্তর না দিয়ে আদিল কে এড়িয়ে রুম থেকে বের হতে নিচ্ছিল। আদিল পিছন থেকে..
“– আদিবা কি হয়েছে?
“– কই কিছু হয়নি তো।
“– আমার কাছে মিথ্যে বলে লাভ নেই। আমি তোমার সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্য বুঝতে পারি।
“– মা আমাকে কখনও নিজের আপন মেয়ে মনে করতে পারেনি। সব সময় আমাকে সৎ মেয়ের চোখেই দেখেছে। একটা সন্তানের মায়ের থেকে যেটুকু ভালোবাসা প্রত্যাশা থাকে মা কখনোই আমাকে ততটুকু ভালোবাসা দেয়নি। পর কখনও আপন হয়না এটা ভেবেই সারা জীবন আমাকে দূরে রেখেছে কখনও কাছে টেনে নেয়নি। এতে মায়ের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।
“– হুম কিন্তু এসব কথা এখন কেন মনে করছো আর কেনই বা বলছো?
“– মা চায় উনি যেমন সারা জীবন আমাকে অবহেলা করে গেছেন আমিও আমার মেয়েকে তেমন ভাবেই অবহেলা করতে। আমি যেমন প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কষ্ট পেয়েছি আমার মেয়েও তেমন ভাবেই কষ্ট পাক। কারণ উনার কাছে মনে হয় পর কখনও আপন হয়না।
আদিবা কথা গুলো বলে কাঁদতে লাগলো। আদিল আজও শুধু অবাক হয়ে আদিবাকে দেখেই যাচ্ছে। কিছু বলতে পারছে না। একটা মানুষ এতো ভালো হতে পারে এটা আদিবা কে না দেখলে আদিল কখনোই জানতে পারতো না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here