সম্পূর্ণা-১০,১১
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
১০
বিয়ে! এটা শুধু ছোট্ট একটা শব্দই নয়, এই শব্দের সাথে জড়িয়ে আছে মানবজীবনের সুন্দর আগামী! জড়িয়ে আছে পরিবার, আত্মীয়স্বজন, সমাজ। আছে দায়িত্ব, কর্তব্য, বিশ্বাস, ভরসা আর ভালোবাসার গভীরতা। যথাযথভাবে এই শব্দের পারিপার্শ্বিক অর্থকে আগলে রাখাই দুটি মানুষের প্রধান লক্ষ্য! যখন থেকে নোভার সমস্ত দায়িত্ব আদনানের কাঁধে এসে অর্পিত হয়েছে, তখন থেকেই তাকে আগলে রাখার দায়ভার সে নিশ্চিন্ত মনে গ্রহণ করেছে। উৎসুক দৃষ্টিতে বারংবার ব্যস্ত নোভার ছোটাছুটি দেখছে আদনান, ভাবছে সমস্ত সত্যি শুনার পর মেয়েটা কতখানি ধৈর্য্য ধরবে! কতখানি কষ্ট পাবে! সেই কষ্টকে কি পারবে ভালোবাসা দিয়ে মুছে দিতে? না-কি ভুল বুঝাবুঝি আর অহেতুক দূরত্ব তৈরী হবে? যা-ই হয়ে যাক, এবার অন্তত সত্যিটা বলতেই হবে তাকে।
মেহমানদের বিদায় দেয়ার পর জারা, নোরাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে নোভা। পুরো দিনটাই কেটেছে ব্যস্ততায়। অল্প সময়ের জন্যও বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পায়নি। বাচ্চারা না ঘুমানো পর্যন্ত একেবারে ফ্রি হওয়া যাচ্ছে না। আদনান রুমে বসেই ল্যাপটপ নিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু কাজ করছে। দু’জনের মাথায় হাত বুলাচ্ছে নোভা৷ ঘুম পাড়ানি গান গাইছে। গানের মৃদু সুরটা ভেসে আসছে তার কানে। অবাক চোখে শুধু নোভাকেই দেখছে আদনান। আসন্ন ঝ*ড়*টার তীব্র গতি থেকে কীভাবে বাঁচাবে নিজের বিশ্বাসকে? সব জানার পর তো আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে ওইটুকু নিষ্পাপ মন! সেখানে আবারও বিশ্বাস জাগিয়ে তোলা সম্ভব? ভয়ে ভেতরটা অস্থির হয়ে যাচ্ছে তার।
অনেকক্ষণ পর নোভা টের পেল, বাচ্চাদুটো গভীর ঘুমে ডুবেছে। এই ফাঁকে ফ্রেশ হওয়া দরকার। নোভাকে বিছানা ছাড়তে দেখে হাঁসফাঁস শুরো হলো আদনানের। কোথা থেকে শুরু করবে, কীভাবে শুরু করবে, এসব প্রশ্নের ভিড়ে মন যখন অস্থির, অশান্ত তখনই চোখের সামনে দু’কাপ কফির অস্তিত্ব পেল সে। চমকে গিয়ে বলল,
“আমি তো ভাবলাম, আজও বাচ্চাদের কাছেই আটকে থাকবে।”
“থাকতে দোষ কী? ডিউটি তো এটাই!”
হাসিমুখে উত্তর দিল নোভা। আদনান ভরকালো। চমকে তাকালো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে ধাতস্থ করলো। কী বলছে নোভা এসব? ডিউটি? বাচ্চাদের লালন-পালন করা কি ডিউটির মধ্যে পড়ে? একটা মা কি এটা ভেবেই বাচ্চাকে আগলে রাখে? ভাবনারত আদনানকে অবাক করে দিয়ে নোভা আবারও হাসিমুখে বলল,
“এবার বলুন, কী বলতে চান! বেশি লম্বা কাহিনী? কোনো ইতিহাসের পাতা ঘেটে আনবেন না প্লিজ, অধৈর্য হয়ে যাব। শুধু ততটুকুই শুনবো, যতটুকু জানা প্রয়োজন!”
একহাতে অন্য হাত চুলকে যাচ্ছে নোভা। দৃষ্টি আদনানের দিকে হলেও চোখে তার রাজ্যের কৌতূহল। মুখটা হাসি হাসি। ঠিক বুঝা যাচ্ছে না, পরবর্তী চ্যাপ্টার তার জন্য কতটা সহনশীল। শুধু মনে হচ্ছে, এইযে মেয়েটা হাসছে, ঠিক এক ঘণ্টার মাথায় হাসিটা মুছে যাবে। কাল বৈশাখী ঝ*ড়ে*র পূর্বাভাস টের পাচ্ছে সে। হাসিমাখা মুখে ফুটে উঠবে একরাশ বেদনা, সেইসাথে ভয় এবং দুঃশ্চিন্তা। কিছু সত্য গোপন থাকাই তো শ্রেয়! না বললেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি মিলছে না। মনে হচ্ছে, নিষ্পাপ একটা মনকে অকারণ কষ্টের মুখোমুখি ফেলতে যাচ্ছে।
গভীর করে শ্বাস নিল আদনান। ল্যাপটপের স্ক্রিনে কিছু পুরনো ছবি বের করলো। তার মধ্যে একটা ছবি, যেখানে রূহানী আর নবজাতক জারা এবং নোরা। বেদনাজনিত মলিন মুখে একটা মা, শেষবারের মতো চুমু খাচ্ছে তার বাচ্চাদের। বুকের কাছে আগলে চোখের পানি ফেলছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা স্মৃতি তৈরী হলো। নোভার হাত ধরে নিজের পাশে টেনে আনলো। পুরো স্ক্রিনে ছবিটা ছড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এটাই রূহানী। একটাই ছবি আছে। এটা সাফফাতের তোলা। চট্টগ্রামের একটা হসপিটালের কেবিনে। এখানেই আমরা তাকে একা ফেলে এসেছি। বাধ্য হয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে জারা, নোরার জীবন বাঁচানো ইম্পর্ট্যান্ট ছিল। নিজের জীবনের ঝুঁকি জেনেও বাচ্চাদেরকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি।”
এক দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকালো নোভা। সদ্য জন্ম হওয়া মাতৃত্বের অনুভূতি! সেই অনুভূতিকে এক মুহূর্তে দূরে ছুঁড়ে ফেলা একজন নারী! শুধুমাত্র নিজের বাচ্চাদের বাঁচাতে কত বড়ো ঝুঁকিতে পড়েছিল! শেষ কী হয়েছিল কেউ জানে না। জানে না আদনানও। রূহানীর চেহারায় সুখের চেয়ে দুঃখের ভাগটাই বেশি। সেই দুঃখী দুঃখী চেহারাটা মুহূর্তেই নাড়িয়ে দিল নোভার অন্তর। আনমনেই বলল,
“কী ঘটেছিল?”
*****
ফ্ল্যাশব্যাক :
___________
ছাত্রজীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর সুখকর স্মৃতির আনন্দঘন মুহূর্তই হলো, ফেলে আসা স্কুল, কলেজ কিংবা ভার্সিটি প্রাঙ্গণ। যেখানে বেঁচে থাকে, ছাত্রছাত্রীদের অসংখ্য হাসি-আনন্দের মুহূর্ত। থাকে কিছু বন্ধুত্ব অথবা ভালোবাসার স্মৃতিও। জীবনের যেকোনো প্রান্তে পৌঁছেও মানুষ একটা সময় সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মরণ করে হাসে, কাঁদে, ফিরে পেতে চায় পুরনো সেইসব দিন, সেইসব মুহূর্তকে। যেখানে সকালের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে একরাশ তরতাজা প্রাণ এসে ভরিয়ে তুলতো আঙিনা, হাসাতো, নাচাতো, আবার কখনও কাঁদাতোও। সেইসব দিন হয় আনন্দ এবং বেদনার সংমিশ্রণ।
সরকারি কলেজের প্রাণোচ্ছল তিনটে হাসির নাম ছিল, তানভীর, সাফফাত এবং আদনান। পড়াশোনা শেষ করেও এই তিনটে হাসি কখনও কলেজের আঙিনা ছাড়েনি। যেকোনো আচার-অনুষ্ঠানে সিনিয়রদের সম্মানে জুনিয়র ব্যাচের বন্ধুরা তাদের আমন্ত্রণ জানাতোই। সেই আমন্ত্রণে সাক্ষী হতে এরা পিছ’পা হতো না কখনওই। তেমনি একদিন আড্ডার ছলেই ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয় তারা। পড়াশোনা শেষ করেও তিনজনের মধ্যে চাকরি নিয়ে কোনোপ্রকার হতাশা কিংবা ছোটাছুটি ছিল না। যার যার ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনুযায়ী স্বাধীন জীবন কাটাতে ব্যস্ত ছিল তারা। চাকরির পিছনে ছুটে হাসি-আনন্দের মুহূর্ত নষ্ট করবে না, এই ছিল তাদের পণ। দিন কাটতো, ক্যাম্পাসে আড্ডা, ছোটাছুটি, খেলাধুলা এবং জুনিয়রদের নোট করে দেয়াতে।
হাসি-আনন্দের সময়টাতে যখন তিন বন্ধু প্রায় মজে উঠেছিল তখনই তানভীর ক্যাম্পাসের সীমানায় প্রবেশ করতে দেখে রূহানীকে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে আড্ডা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। উদ্দেশ্য, রূহানীকে প্রেমপত্র দেয়া। ওভাবে তাকে ছুটে যেতে দেখে পিছনে বাকি দু’জনও ছুটলো। আদনান জিজ্ঞেস করলো,
“এখন ওইদিকে কোথায় যাচ্ছিস?”
“ওই মেয়েটাকে দেখ! আমার ভীষণ পছন্দ। ভালোবেসে ফেলেছি দোস্ত। মনের কথা জানাতে হবে। আজই, এই মুহূর্তে!”
চোখ ঘুরিয়ে মূল গেটের দিকে দৃষ্টি ফেরালো আদনান। চারশো বিশ ভোল্টেজ কিংবা তারও বেশি মাত্রার শক খেল তার ব্রেইন। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। রূহানীকে সে শুধু চিনেই না, খুব ভালো করেই চিনে। ভুলবশত সব তথ্য জেনেও সে রূহানীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাদের এলাকাতেই থাকে রূহানীর পরিবার। যাওয়া-আসার পথে প্রায়ই দেখা হয়, অল্পস্বল্প কথাও হয়, কিন্তু কখনও মনের কথা আদান-প্রদানের সুযোগ হয়ে উঠেনি। মেয়েটা সুন্দর, আজকাল সময়ের মেয়েদের মতো ওতো ঢঙ্গী নয়! তবে চেহারাটা ভীষণ মায়াবী। যেই মায়াকাড়া চেহারাতে যে কেউ ডুবে ডুবে ভাসতে পারবে নির্দ্বিধায়। আদনানও ডুবেছিল।
বন্ধুর কথায় মাঝপথে থেমে গেল তার পা। হাত ধরে তানভীরকেও আটকালো। রূহানী ততক্ষণে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। দৃষ্টি সামনে রেখেই বলল,
“তুই জানিস ও কে?”
তানভীর দু’দিকে মাথা নাড়লো। সে জানে না। জানার কথাও না৷ শুধু ক্যাম্পাসেই দেখা। চোখাচোখি। কখনও সামনাসামনি আলাপই হয়নি, তথ্য দেয়া-নেয়া হবে কীভাবে! বন্ধুর না’বোধক ভঙ্গিমা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদনান। বলল,
“ও একটা এতিমখানায় বড়ো হয়েছে। যখন ওর দশ বছর বয়স তখন হি*জ*ড়া এক নারী তাকে দত্তক নেন। সেই নারীটিকে ও মা বলে ডাকে। রাস্তায় বেরোলে কতটা নিন্দেমন্দ শুনে, সেটা জানিস তুই? শুধুমাত্র হি*জ*ড়া ওই মহিলাকে মা বলে ডাকে বলে কত বা’জে বা’জে কথার মুখোমুখি হয়! তোর বাবা তো শহরের নামকরা অফিসার। তিনি কি রূহানীকে ছেলের বউ হিসেবে মানবেন?”
তানভীর শুধু ঠোঁট আওড়ে মৃদুশব্দে উচ্চারণ করলো,
“রূহানী! বাহ্, চমৎকার নাম। নামেই তো ফিদা হয়ে গেছি। বাই দ্য ওয়ে, তুই এত কথা জানিস কী করে?”
“আমাদের এলাকায় থাকে।”
সোজাসাপটা জবাব দিল আদনান। তানভীর এবার বন্ধুর হাত-পা ধরে লটকে গেল। শুধুমাত্র রূহানী অবধি প্রেমপত্র পৌঁছানোর জন্য চিঠির ডাকপিয়ন হিসেবে বেছে নিল আদনানকে। জোরপূর্বক তার হাতে কয়েক লাইনের ছোট্ট একটা চিরকুট দিল। গতকাল রাতেই এটা লিখেছিল। ভেবেছিল, যখনই সুযোগ পাবে, মনের কথা বলবে। সুযোগটা যে আজকেই এসে যাবে ভাবেনি সে।
“অসম্ভব! আমি এই চিঠি ওকে দিতে পারবো না।”
প্রায় চিৎকার করে উঠলো আদনান। যাকে নিয়ে একটু একটু করে হৃদয়পুরীতে ভালোবাসার চাষ করতে শুরু করেছে, সেই তাকেই কি-না বন্ধুর হয়ে লাভ লেটার পৌঁছাতে হবে। তানভীরের বাবা যা রাগী মানুষ। যদি জানেন, ছেলে এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করে যার কি-না বংশপরিচয়ের ঠিক নেই, তখন তো তিনি তাদের উপর এসে চড়াও হবেন। এটা সম্ভব নয়, বন্ধুর হয়ে আর যাই হোক, প্রেমপত্র দেয়া-নেয়া সে করবে না। মগের মু*ল্লু*ক নাকি সব! আদনানের এমন আচরণ দেখে তার হাত ধরে ফেললো তানভীর। বলল,
“একমাত্র তুই-ই ভরসা! একটা কিছু কর না ভাই। বাঁচবো না ওকে ছাড়া!”
রীতিমতো শকড হয়ে যায় আদনান। এসব কী বলে তার বন্ধু। একটা মেয়েকে না পেলে মা*রা যাবে? জীবন এতই তুচ্ছ। রাগে গ*র্জি*য়ে উঠলো সে। বলল,
“কী যা তা বলছিস? প্রেমের পা*গ*লা প্রেমিক হয়ে গেছিস? তা-ও একটা মেয়ের জন্য! ভাই শোন, কাউকে স্বপ্ন দেখাবার আগে নিজের পরিবারকে জানা। বিয়ের প্রস্তাব পাঠা। দেখ তোর পরিবার রাজি কি-না। অযথা কারও মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলিস না।”
হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল তানভীর। হাতের চিরকুটটা আদনানের হাতে ধরিয়ে দিল। বলল,
“তুই এই চিঠি তাকে দিবি। যেভাবে পারিস। আমাকে জানাবি কী হয়! ট্রাস্ট মি দোস্ত, ইফ আই ডোন্ট গেট দিস গার্ল, আই উইল কি*ল মাই শেলফ! বিশ্বাস করিস আর নাই-বা করিস, এটাই সত্য।”
হতভম্ব হয়ে গেল আদনান। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো প্রাণপ্রিয় বন্ধুর দিকে। রক্তশূণ্য চেহারায় তখন একরাশ অভিমান, অভিযোগ দেখতে পেল। কী করবে সে? নিজের মনের কুঠরে বেড়ে ওঠা সুপ্ত অনুভূতিকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিবে এক নিমিষে! সম্ভব এটা? মাত্রই তো অনুভূতিরা সমস্ত হৃদয়পুরীতে হা*না দিল! মুহূর্তেই তাকে জলাঞ্জলি দিতে হবে অন্য কারও নামে? তানভীরের অশ্রুসিক্ত চোখে সদ্য জাগ্রত হওয়া অনুভূতির তুমুল আনাগোনা টের পেল আদনান। অভয় দিয়ে বন্ধুর কাঁধে হাত রাখলো। বলল,
“ডোন্ট ওরি! সি উইল বি য়্যুওর্স! টু’ডে ওর টুমরো, সি উইল বি য়্যুওর্স ফোরেভার!”
*****
একই এলাকা হওয়া সুবাদে রূহানীর সাথে রাস্তায় হাঁটা-চলার পথেও হুটহাট দেখা হয় আদনানের। বন্ধুর একটা আমানত নিয়ে রূহানীদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অযথাই ফোন টিপছে সে। কেউ দেখলে ভাববে, ব*খা*টে। যদিও তার উদ্দেশ্য সেরকম নয়, অল্পকিছু সময়ের জন্য বন্ধুর হয়ে ওকালতি করা। এইটুকুই।
ক্যাম্পাস থেকে সোজা একটা কোচিং সেন্টারে যায় রূহানী। সেখানে একজন শিক্ষকের কাছে ইকোনমিকসের কিছু সাজেশন নেয়। সপ্তাহে তিনদিন এই সেন্টারে যাওয়া-আসা করতে হয় তাকে। কোচিং শেষে ফিরতে তার বিকেল হয়। আজও তাই হলো। ফেরার পথেই আচমকা আদনান তার সামনে দাঁড়ালো৷ ভরকে গেল রূহানী। বুকে ফুঁ দিয়ে চারপাশে ভালোমতো চোখ বুলিয়ে নিল। ভেবেছিল, ব*খা*টে*রা হবে হয়তো। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ঝটপট পকেট থেকে চিরকুট বের করলো আদনান। নাটকীয়ভাবে সেটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এটার জবাব লাগবে! আজ অথবা কাল। না শুনতে চাই না। বন্ধুকে কথা দিয়েছি। তার ভালোবাসাকে তার করে দিব। যত আপত্তি থাকুক, একদমই না করা যাবে না।”
সরাসরি এমন প্রস্তাবে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল রূহানী। মেয়ে মানুষ রাস্তায় বেরোলে দু’একটা প্রেমপত্র আসা স্বাভাবিক ব্যাপার, এটা সে জানে। কিন্তু এভাবে সরাসরি প্রস্তাব কতটা গ্রহণযোগ্য। তা-ও কাউকে না চিনে। আদনানকে সে ভালোমতোই চিনে। এলাকার তার এবং তার পরিবারের যথেষ্ট সুনাম আছে। সেই হিসাবে তার বন্ধুদের প্রায়শই আসা-যাওয়া হয় এখানে। কিন্তু কখনও আদনানের সাথে তার আলাপ হয়ে উঠেনি, এমনকি তার বন্ধুদের সাথেও কোনোদিন কথা হয়নি। দু’জনের মধ্যে কে তাকে প্রেমপত্র পাঠাতে পারে এটা ঠিক বোধগম্য হলো না তার। কোনো আওয়াজও বের করতে পারলো না। আদনান ফের বলল,
“সে সত্যিই আপনাকে ভালোবাসে!”
করুণ গলায় বললো আদনান। সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুটস্বরে আওয়াজ আসলো। কান পাতলো সে। রূহানী বলল,
“এটা কোনোদিনও সম্ভব হবে না। আপনি আপনার বন্ধুকে বলবেন, আমার পক্ষে প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ানো সম্ভব নয়। আপনি তো জানেন আমার পরিবারের সম্পর্কে! আমি কে তা-ও জানেন। দয়া করে এসব অযৌক্তিক আবদার পূরণের জন্য আমাকে ব*লি*র পাঁ*ঠা বানাবেন না। আমরা নিতান্তই নি*ম্ন শ্রেণীর মানুষ। আমাদের এত উচ্চাকাঙ্খা থাকতে নেই। মাফ করবেন।”
আদনান এটাই আশা করেছিল। যে মেয়ে হাজারো ক*টু কথা হজম করে দিন অতিবাহিত করে, সে হুট করে স্বর্গ হাতে পেলেও তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে না। কাউকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করতেও বাঁধলো আদনানের। তবুও হাতের চিঠিটা সেভাবেই ধরে রাখলো। বলল,
“আমি এটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অনড়! বাঁচা-ম*রা*র প্রশ্ন তুলেছে তানভীর। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না, আপনার কারণে, আপনাকে না পেয়ে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিক। সমাজে কতকিছুই তো বাঁধা। কতদিকেই তো সমস্যা। তাইবলে মানুষ কি ভালোবাসতেও পারবে না?”
“দেখুন, ভালোবাসাতে দোষ নেই। সে ভালোবাসতেই পারে। মেয়ের তো অভাব নেই। আমাকেই কেন? আমি তো বিশ্বসুন্দরী নই, নই কোনো রাজার রাজকন্যাও। আমাদের জন্য ভালোবাসা কতখানি ধরাছোঁয়ার বাইরে তাতো সমাজের আচরণই বলে দেয়! এমন সমাজে আমরা বাস করছি, যে সমাজ মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে জানে না। সেই সমাজে ভালোবাসা তো আমার জন্য, আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই। আপনি প্লিজ আপনার বন্ধুকে বুঝাবেন, জীবন এত সস্তা নয়! চাইলেই জীবন দেয়া-নেয়া যায় না। উপরওয়ালার হুকুমের প্রয়োজন হয়!”
আদনান কী জবাব দিবে ভেবে পেল না! জো*র করলে হিতে বিপরীত হবে, তারচেয়ে ফিরে যাওয়াই ভালো। রূহানী চিরকুট নেয়া তো দূর হাতের দিকে ফিরেও তাকালো না। এক সময় পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। আদনান পিছন থেকে বলল,
“এই প্রত্যাখ্যান যদি ও সহ্য করতে না পারে, যদি ভুল কিছু করে, যদি সুইসা*ইডের সিদ্ধান্ত নেয়, যদি আমার বন্ধুর কিছু হয়, তার জন্য দায়ী হবেন আপনি।”
“অসম্ভব! আমি তো তাকে ভালোবাসতে বলিনি। বলিনি আমার জন্য জীবন দিক। বলিনি আমার পিছনে ছুটে বেড়াক! তবে কেন ভালোবাসার জন্য সে আমাকেই খুঁজে পেল? মেয়ের কি খুব অভাব এই সমাজে? তাকে বুঝান, জীবনটা ছেলেখেলা নয়! চাইলেই তাকে বিসর্জন দিয়ে দিলাম, এমনটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়! আপনার বন্ধুও বুদ্ধিহীন প্রাণী। নিজের খেয়ে পরের জন্য সাফাই গাইতে আসছেন। যান তো বাড়ি যান, গিয়ে ওই আধপা*গল বন্ধুকে বুঝান। ভালোবাসা সবার জন্য নয়।”
মুখের উপর অনেকগুলো কথা বলে দৌড়ের উপর ওই সীমানা থেকে ছুটে পালালো রূহানী। আদনান নিজের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে রইলো। ওইটুকু মেয়ে কী পাকা পাকা কথা বলে গেল, অথচ সে জবাব দিতে পারলো না। রাগে মাটিতে লা*তি মা*রলো আদনান। বিড়বিড় করলো,
“শা*লা*র বন্ধু, তোর জন্য এত কথা শুনতে হলো আমাকে! ম*র তুই। গলায় দ*ড়ি দে, নইলে নদীতে ঝাঁ*প দে, কার বাপের কী! তোর উপর মানহা*নির মা*ম*লা করবো উ*ল্লু*ক৷ শুধুমাত্র তোর জন্য ওইটুকু মেয়ে আমাকে কথা শুনালো! ইডি*য়ট! নিজে আসতে পারে না, আরেকজনকে পাঠায়। নিকুচি করি তোর ওই ভীতিগ্রস্ত প্রেমের!”
চলবে…
সম্পূর্ণা | ১১
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
কেন রে বারে বারে তোরে?
এত বেশি মনে পড়ে!
সে জানে না, মন যাতনা!
সে হীনা প্রাণ বাঁচে না।
কলেজের পিছন দিকে যে রাস্তা আছে সেই রাস্তা ধরেই মূল ভবনের সামনে আসছিল রূহানী। সঙ্গে তার আরও দু’জন ক্লাসমেটও ছিল। ভবন লাগোয়া সিঁড়িতে বসে বন্ধুরা এবং জুনিয়র ভাইদের নিয়ে গানের আসর জমিয়েছে তানভীর। উঁচু গলায় গান সে-ই গাইছে। বাকিরা ঠোঁট নাড়ছে। রূহানীকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসতে দেখেই গান থামিয়ে দিল তানভীর। দ্রুত তার পিছু নিল। অনেক সাহস নিয়ে আজ তার মুখোমুখি হবে বলেই তারই ডিপার্টমেন্টের সামনে বসে এই বাহাদুরি দেখানো। এতগুলো মানুষের সামন ক্রস করে উপরে আসাটা মেয়েদের জন্য চরম বিরক্তির। একনজর চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরলো রূহানী। তানভীরও বাধ্য ছেলের মতো তাকে ফলো করতে শুরু করলো। কিছুটা ঘুরে নিজ ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে পিছনে ঘুরলো রূহানী। সাহস নিয়ে মুখোমুখি হলো। ততক্ষণে তানভীর নিজের জায়গায় স্ট্যাচু। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সাহস সঞ্চয় করছে সে। আচমকাই মিষ্টি কণ্ঠের আওয়াজ শুনে সামনে দেখালো। মেয়েটা ভ্রু নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী চাই? পিছু নিয়েছেন কেন?”
“ভালোবাসি তাই!”
একমুহূর্তও সময় নিল না তানভীর। ঝটপট শব্দটা উচ্চারণ করে চারপাশে তাকালো। মেয়েগুলো হাসছে, তবে রূহানীর চেহারাটা থমথমে। পিছনে বন্ধুরাও দারুণ মজা নিচ্ছে, না তাকিয়েই আয়ত্তে আনতে পারলো। খানিকটা বিরক্তি নিয়েই রূহানী বলল,
“আপনার বন্ধু আপনাকে আমার ডিটেইলস বলেনি?”
“বলেছে।”
“আপনার প্রস্তাব যে প্রত্যাখ্যান করেছি সেটা বলেছে?”
“হ্যাঁ!”
“তবে ছ্যাঁচ*ড়ার মতো পিছু নিয়েছেন কেন?”
“ভালোবাসায় ছ্যাঁচড়ামি জায়েজ আছে!”
“কোথাকার লজিক এটা? কোন বইতে, কোন লেখক উল্লেখ করেছেন এই কথা?”
“কোনো লেখক উল্লেখ করেননি। আমিই ফার্স্ট করলাম, তা-ও তোমার জন্য।”
“ব*ল*দ!”
বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করলো রূহানী। তানভীর ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ছেলেটার পাগ*লামি দেখে যথেষ্ট বিরক্তই সে। সবকিছু জেনে কীভাবে মানুষ এতটা বোকার মতো কাজ করে জানা নেই তার। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তার ভাবভঙ্গি বুঝার চেষ্টা করলো। তাকে ওভাবে খা*ম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
“আপনার মাথায় সমস্যা আছে, ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান।”
“তাহলে সাইকিয়াট্রিস্ট’টা আপনিই হোন। রোগ যেহেতু আপনার কারণেই হয়েছে, রোগটা সারানোর দায়িত্বও তো আপনারই নেয়া উচিত তাই না?”
রূহানী বিস্ফো*রিত চোখে তাকালো। চোখ দিয়েই গিলে খাবে মনে হচ্ছে। ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। তার এমন অগ্নিদৃষ্টি দেখে তানভীর খানিকটা ঘাবড়ালো। দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ালো। দাঁত কিড়মিড়ি করে উচ্চারণ করলো রূহানী,
“স্টু*পি*ড!”
কথা বাড়ালো না রূহানী। বান্ধবীদের নিয়ে দ্রুত ক্লাসে চলে গেল। কিন্তু তানভীর দমে গেল না। বরং তার উৎপাত আরও বেড়ে গেল। ক্লাস, ক্যাম্পাস, অডিটোরিয়াম, খেলার মাঠ, এমনি কোচিং সেন্টার সব জায়গায় রূহানীর পিছু নেয়া শুরু করলো সে। এতে দিনকেদিন অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো রূহানী। ধ*মকে, ব*কে, গা*লি দিয়েও তাকে পিছন থেকে সরানো যাচ্ছে না। কখনও হাওয়ার মতো উড়ে সামনে চলে আসছে, আবার কখনও পিছন পিছন এসে কানের কাছে ‘ভালোবাসি’ বলেই দৌড়ে পালাচ্ছে। মাসের পর মাস একইভাবে তানভীরের জ্বালাতন সহ্য করলো, তবুও সম্মতি প্রকাশ করলো না। সে জানে, সমাজের মানুষের কলুষিত মন কভু দুটো মনের কথা ভাববে না, ভাববে স্ট্যাটাসের কথা। দিন দিন তানভীরের এই পাগ*লামিতে অভ্যস্ত রূহানী একটা সময় চারপাশে শুধু তাকেই দেখতে শুরু করলো। ভালোবাসবে না, সামনে যাবে না, চোখাচোখি হলেও দূরে সরে যাবে, এমন কতশত প্রতিজ্ঞায় নিজেকে রাখলো। তবু শেষ রক্ষা হলো না। সমাজের কিছু নিয়ম খণ্ডাতে গিয়ে একটা সময় নিজেও ভালোবাসার সাগরে হাবুডুবু খেতে শুরু করলো। বুঝতেও পারলো না, মনের কথা মনকে জানানোর আগেই কীভাবে সেই মনে অন্যের বসতী গড়ে উঠলো।
*****
সেদিন হঠাৎ করেই ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে তানভীর তাকে মাঝপথে আটকে ফেললো। কিছু নোটসের ফটোকপি নিতেই কম্পিউটারের দোকানে ঢুকতে হয়েছিল তাকে। সেখান থেকে বের হতেই তানভীরের মুখোমুখি পড়ে সে। রূহানীকে দেখে কেমন নির্লজ্জের মতো দাঁত কেলিয়ে হাসলো। নোটসগুলো ব্যাগে রেখে ভ্রু নাড়ালো রূহানী। বলল,
“কী চাই?”
“তোমাকে।”
“অন্যকারও নামে বুকিং হয়ে গেছি।”
মজার ছলে তানভীরকে রাগানোর চেষ্টা করলো রূহানী। ছোটোখাটো একটা পরীক্ষার কৌশল হিসেবে এইটুকু কথাকেই বেছে নিল। তার কথা শুনে তানভীর দুঃখ পেল নাকি খুশি হলো বুঝা গেল না, তবে চেহারার হাসিটা মুছে গেল। কোনোমতে ধীরস্বরে বলল,
“সত্যি?”
“হ্যাঁ! ছেলেটা ভীষণ হ্যান্ডসাম আর ক্যায়ারিং। আপনার মতো ছ্যাঁচ*ড়া নয়!”
“আমি ছ্যাঁচ*ড়া?”
“তা নয়তো কী? সমাজ, সংস্কার কিছুই মানেন না। ভালোবাসলেই হয়ে যায় না, ভালোবাসার মানুষটার জন্য কিছু করে দেখাতে হয়! বাবার ঘা*ড়ে বসে আর কয়দিন খাবেন? পড়াশোনা তো অনেক আগেই শেষ, চাকরিবাকরি কিছু করুন। দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ আর যাই হোক, তারা কখনও কাউকে মন দিয়ে ভালোবাসতে পারে না।”
“ওকে! আমি তোমার সামনে আসলে প্রবলেম হয়? বিরক্ত হও?”
“অফকোর্স!”
ঠোঁটে হাসি নিয়ে সহজসরল ভাষায় জবাব দিল রূহানী। তানভীর নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। চোখদুটোতে মনের অজান্তেই নোনাজলে ভরে উঠলো। অশ্রুসিক্ত নয়নে রূহানীর দিকে তাকালো। বলল,
“বেস্ট উইশেস ফোর য়্যুওর নিউ লাইফ!”
হুট করে যেভাবে সামনে এসেছিল, তেমনি হুট করেই ছুটে চলে গেল তানভীর। রূহানী স্তব্ধ চোখে তাকালো। কোথাও তাকে আঘাত করে ফেললো না তো?
সপ্তাহ খানেক তানভীরকে আর ক্যাম্পাসে দেখা গেল না। আদনান, সাফফাত যদিও আসতো তবু সে আসতো না।
প্রতিদিনের মতো আজও ক্লাস শেষ করে গেটের কাছে আসলো রূহানী। উদ্দেশ্য রিকশা নিয়ে কোচিং সেন্টারে যাওয়া। গেটের কাছে আদনান আর সাফফাতকে দেখে বেশ অবাক হলো। এড়িয়ে যেতে চাইলে পিছন থেকে আদনানই বলল,
“ভালোবাসবেন না ভালো কথা, কাউকে স্বপ্ন দেখাবেন না সেটাও ঠিক আছে, তাকে ঘৃ*ণা করেন কিংবা ছ্যাঁচ*ড়া ভাবেন, জেনে-বুঝে তাকে মৃ*ত্যু*র দিকে ঠেলে দেন কী করে?”
থমকে গেল রূহানীর পা। পিছন ঘুরে দু’জনার মুখোমুখি দাঁড়ালো। প্রশ্নবোধক রেখা ফুটিয়ে তুললো চেহারায়। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“মানে! আমি কেন তাকে মৃ*ত্যু*র দিকে ঠে*লে দিব?”
“তবে আপনার উপর অভিমান করে, কেন সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে যাচ্ছিলো?”
“আমি তো তাকে কিছু বলিনি!”
“আপনি না-কি তাকে বলেছেন, অন্য কাউকে ভালোবাসেন? কই, আপনার আশেপাশে তো এই ক’দিন কাউকে দেখলাম না? তবে তাকে মিথ্যে বললেন কেন?”
আদনান আরও অনেক বকাঝকা করলো। রূহানী শুধু নীরব হয়ে শুনলো। এই সামান্য কথাতে কেউ যে জীবনকে এত সস্তা করে দিতে পারে, জানা ছিল না তার। শুধুমাত্র তাকে একটুখানি জানতেই সেদিন ওভাবে বলেছিল। তখনও ভাবেনি, শেষের কথা দিয়ে এই ছেলে এমন কিছু ইঙ্গিত দিতে পারে! নিজের মনের মধ্যে অদ্ভুত যন্ত্রণা টের পেল সে। কতই আর যু*দ্ধ করবে, কতই আর দূরে ঠে*ল*বে, সমাজ তো কতকথাই বলবে! সব কথা কেন তাদের হজম করতে হবে! এতসব নিয়ে অনেক ভেবেছে রূহানী, ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সত্যিকার ভালোবাসা এবং সঠিক মানুষ জীবনে একবারই আসে, হেলায় ফেলায় কিংবা অবহেলায় তাকে হারিয়ে ফেলাটা বোকামি। মনে শক্তি টেনে আনলো সে। বলল,
“আপনার বন্ধু এখন কোথায়?”
“হসপিটালে!”
“কেন?”
“গাড়ির নিচে চা*পা পড়তে চাইছিল! টেনেহিঁ*চড়ে বাঁচিয়ে হসপিটাল অবধি রেখে এসেছি।”
অবাক হলো রূহানী। একদম টিনএজ ছেলেমেয়েদের মতো আচরণ। এত বাচ্চামো কেউ করে! তা-ও ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। এসব তো নাটক, সিনেমায় চলে। বাস্তবে এমন কয়জন আধপা*গল প্রেমিক আছে, যারা ভালোবাসা না পেয়ে, প্রেমে প্রত্যাখ্যান পেয়ে সুইসা*ইডের পথ বেছে নিয়েছে? তানভীর তো সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরদের মতো ছেলেমানুষী করছে। এই পা*গ*লকে সামলানো আদৌ সম্ভব তার দ্বারা? মত বদলালো রূহানী। কোচিং সেন্টারে যাবে না, এই মুহূর্তে তানভীরকে একনজর দেখতে যাওয়াই উচিত মনে হলো তার। ভাবনা থামিয়ে ঝটপট বলল,
“কোন হসপিটাল? আমাকে একটু নিয়ে যাবেন? একা যেতে সাহস পাচ্ছি না!”
ওই মুহূর্তে কী যে হলো আদনানের। বিস্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে রূহানীকে একনজর দেখলো। তার চিন্তিত চোখমুখ আর ভীতিগ্রস্ত চেহারাই বলে দিচ্ছে মনের ভেতর কীসের তু*ফা*ন বইছে। একটুকরো স্বচ্ছ অনুভূতি যেন মিষ্টিমুখের প্রতিটা শব্দে উচ্চারিত হলো। বুঝা গেল, মেয়েটা তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে নিয়ে পজেটিভ। বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। মাথা নেড়ে সায় জানালো। এক সঙ্গেই রওনা দিল হসপিটালের পথে। পথিমধ্যে কোনো কথা হলো না কারও, তবে রূহানীর দু’হাতের ভাঁজ দেখে মুচকি হাসলো আদনান। খুব বেশি দেরী হলো না বুঝতে, মেয়েটা একমনে প্রার্থনা করছে ভালোবাসার মানুষটার সুস্থতার জন্য।
*****
কাউকে ভালোবাসলে তার অসুস্থতা কিংবা তার ব্যথাবেদনাতেও অপরজনের মন অসুস্থ হয়ে পড়ে। হারানোর ভয়, আর নিজের বোকামি তাকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করে। নিজের কাছেই যখন একটা মানুষ পুরোদস্তুর অপরাধী হয়ে যায়, তখন অপরজনের কাছেও তো তাকে অপরাধী হতে হয়। সামান্য একটা কথার রেষ ধরে তানভীর যে এরকম একটা পদক্ষেপ নিতে পারেনি ভাবেনি রূহানী। ভাবেনি তার বন্ধুরাও। ভালোবাসার জন্য জীবন দেয়া কি এতই সহজ? কেন কেউ জেনেশুনে বোকামি করে? কেন অনুতাপের আগু*নে জ্বা*লি*য়ে পু*ড়ি*য়ে শেষ করে দেয়? কেন কোনো ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ দেয় না প্রিয়জন? অহেতুক অভিমানকে বুকে আগলে আ*ত্মহ*ত্যা করা কি খুব সহজ কাজের একটা? জীবনের কোনো মূল্য নেই? পরিবারের জন্য চিন্তা নেই? শুধু ভালোবাসাই সব? ভাবতে পারছে না রূহানী৷ তানভীরের এই অহেতুক ছেলেমানুষীতে ভীষণ আঘাত পেয়েছে সে। এমনটা হোক সে তো কখনও চায়নি।
তাকে কেবিনের ভেতর রেখে আদনান আর সাফফাত বাইরে চলে গেল। তানভীর তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার পায়ের গোড়ালিতে ব্যান্ডেজ। হাতে, মুখে অনেক জায়গায় ব্যথা পেয়েছে। আঘাতটা কতখানি বুঝতে পারলো না রূহানী, তবে ব্যথাটুকু আন্দাজ করে ভেতরটা কেঁদে উঠলো তার। আলতো স্পর্শে ডানহাত ছুঁলো। দু’হাতের মুঠোয় ধরে গালের সাথে ঠেকালো। কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে রইলো। কান্নার মৃদু আওয়াজটা কানে আসতেই চোখ মেলে তাকালো তানভীর। চোখের সামনে প্রিয়জনকে আবিষ্কার করে বিস্ময়ে চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল সে। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
“তুমি!”
“এই বোকা বোকা কাজটা কেন করলেন আপনি? যদি কিছু হয়ে যেত!”
“তুমি ছাড়া বাঁচা তো মৃ*ত্যু*র চেয়েও বেশি যন্ত্রণার। তাই কম যন্ত্রণার মৃ*ত্যু*কে আপন করতে চেয়েছিলাম। কী হবে বেঁচে থেকে, যদি তোমাকেই না পাই?”
“জীবন তো সিনেমা নয়! কেন সবকিছুকে সিনেমেটিক ভেবে সুন্দর জীবনটাকে ধ্বং*সের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন? সবকিছু সবার জন্য নয়!”
“তাই? কেন এসেছো তবে? মা*রা গেছি কি-না সেটা দেখতে?”
“আমি তো সেদিন মজা করেছিলাম! ওই ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন কেন আপনি?”
“সত্য হোক কি মিথ্যে, তুমি ছাড়া পৃথিবীটাই তো শূন্য আমার কাছে! আমি যাচাইয়ের প্রয়োজন বোধ করিনি। শুধু বুঝেছি, তোমার থেকে দূরে যাওয়া প্রয়োজন। অনেক দূরে। যেখানে গেলে কোনোদিনও ফিরে আসা সম্ভব নয়।”
রূহানী কোনো জবাব দিল না। নিশ্চুপে চোখের পানি ফেললো। তানভীর তা দেখে মুচকি হাসলো। সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলো। তড়িঘড়ি করে তার পিছনে বালিশ দিল সে। বলল,
“শুয়ে থাকুন! উঠতে হবে না।”
“একটু কাছে আসবে?”
আবদার ফেলার মতো দুঃসাহস পেল না রূহানী। আলগোছে খানিকটা কাছাকাছি এসে বসলো। ডানহাতে তার চিবুক ছুঁয়ে দিল তানভীর। আঙুলের আলতো স্পর্শে চোখ থেকে উপচেপড়া জলের ঢেউকে মুছে দিল। বলল,
“কাঁদছো কেন?”
জবাব দিল না রূহানী। মাথা নিচু রেখে বসে রইলো। দু’হাতের আঁজলায় প্রিয়জনের মুখখানি সামান্য উঁচু করে ধরলো তানভীর। চোখে চোখ রাখলো। গভীর স্বরে বলল,
“ভালোবাসো?”
দু’চোখের পাতা বন্ধ করলো রূহানী। উপরনিচ মাথা নাড়লো। সুখের ঘুরিটা মনের আকাশে নিঃশব্দে উড়ে বেড়ালো তখন। মৃদুস্বরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ তুলে রূহানী বলল,
“আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে!”
“ভালোবাসায় ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক! হারানোর ভয়টাই বুঝিয়ে দেয় ভালোবাসা কতখানি গভীর!”
“সমাজ! এত সহজে সব পাওয়া হবে না। সবকিছুকে কঠিন করে দেয়াই এই সমাজের কিছু মানুষের কাজ!”
“তুমি এসব নিয়ে ভয় পেয়ো না। সবকিছু ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার।”
“যদি না পারেন?”
জবাব দিল না তানভীর। বাবাকে সে ভালোমতোই চিনে। তিনি যে এত সহজে রূহানীকে মেনে নিবেন না, এই সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে তার। তবুও চেষ্টা করতে হবে। এতদিন একপাক্ষিক ছিল দেখে কিছু জানায়নি কাউকে, এখন তো জানাতেই হবে। খুব শীঘ্রই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। ভালোবাসা জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগেই তাকে আপন করে নেয়া উত্তম।
*****
সুখের আকাশ যতই বড়ো হোক, দুঃখের বৃষ্টি যখন সেই আকাশের বুক ছিঁড়ে মাটির বুকে আঁচড়ে পড়ে তখন রঙিন ওই ঝকঝকে আকাশটাও আঁধারে তলিয়ে যায়। সেই আকাশে তখন কোনো নীলসাদা মেঘের ভেলাকে ভাসতে দেখা যায় না, বরং অন্ধকার তারমধ্যে অন্যরূপের সৃষ্টি করে। বুঝিয়ে দেয়, ঝকঝকে আকাশটা যেমন ক্ষণিকের, সুখটাও তেমনি অল্পক্ষণের। প্রেম ভালোভাসা কিংবা মন দেয়া-নেয়ার পরমুহূর্তে মনের আকাশে রঙিন ঘুরি যেমন ভেসে বেড়ালো, ঠিক বৃষ্টি নামার পূর্বক্ষণে ঘুরির সুঁতোটাও তীব্র বাতাসের কবলে পড়ে আটকে গেল গাছের ডালে। রূহানী আর তানভীরের মনে জাগ্রত হওয়া নব্য প্রেমের অনুভূতিটাও ঠিক তেমনি। ভালোবাসার সুখটাকে খুব বেশিদিন আঁকড়ে ধরা হলো না। সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখার আগেই ভে*ঙে গেল সেই সাজানো গোছানো স্বপ্নের ঘর।
তানভীরের বাবার যেমন নামডাক, তেমনি যশ, খ্যাতিও। তিনি চাইলে যা খুশি তাই করতে পারেন। যখন জানলেন, ছেলে তার প্রেম করে বেড়াচ্ছে কোনো এক হি*জ*ড়ার পালিত মেয়ের সঙ্গে তখনই সূক্ষ্মবুদ্ধি আঁটেন তিনি। গোপনে, কৌশলে, লোকচক্ষুর আড়ালে দলবলসহ একদিন উপস্থিত হোন রূহানীদের বাড়িতে।
মিতালি সিকদার তার বর্তমান নাম। পূর্বনাম মঈন সিকদার। যিনি বাবা-মায়ের আদর সংস্পর্শে বড়ো হয়েও একটা সময় সেই আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন। সমাজ, সংসার যখন তাকে হি*জ*ড়া ভেবে গালিগা*লাজ দিতে শুরু করলো সেদিন থেকে নিজেকে নিয়ে অন্য এক রাজ্য তৈরী হলো তার। সমাজের সাথে থেকেও মানুষের বা’জে আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে চলে আসেন অন্যত্র। হি*জ*ড়া জনগুষ্ঠির সাথে বসবাস শুরু করেন। সেখানে থেকে একদিন চাঁ*দা তুলতে যান এতিমখানায়। ছোট্ট রূহানীকে দেখে মায়া হয়। আলোচনা করে নিয়ে আসেন নিজের কাছে। স্ব-স্নেহে লালন-পালন করে সন্তানের মতোই আগলে রাখেন। নাম দেন রূহানী সিকদার। সেই থেকে ছোট্ট রূহানী তার ছত্রছায়াতেই বড়ো হতে থাকে।
“মেয়েকে নিয়ে যত দ্রুত পারেন, এই এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবেন। নয়তো আপনার একার দোষে এতগুলো মানুষের বাসস্থান নিয়ে টানাটানি হবে। যা আমি চাইছি না। ভালোয় ভালোয় বলছি, এখনও সময় আছে। আমার ছেলেকে ফাঁ*সা*নো*র চেষ্টা করবেন না একদম।”
বাড়িতে পা রেখে এটাই ছিল ফারদিন চৌধুরীর প্রথম কথা। যিনি এই শহরের বহুল পরিচিত জেলা প্রশাসক হিসেবে পরিচিত। মিতালি সিকদার ঘাবড়ে গেলেন ভদ্রলোকের এমন আচরণে। তিনি তখনও জানতেন না, রূহানীর রিলেশনের কথা! দ্রুত ছুটে এসে ভদ্রলোকের পা ধরলেন। বললেন,
“মাফ করবেন সাহেব! আমি আমার মেয়েকে সামলে নিব। আর সে আপনার ছেলের দিকে চোখ তুলেও তাকাবে না।”
নানারকম হুম*কি ধা*মকি দিয়ে সে যাত্রায় বিদায় নিলেন ফারদিন চৌধুরী। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে মায়ের অত্যাধিক প্রশ্নের মুখোমুখি পড়লো রূহানী। মা*র খেল, তবুও মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলো। ওইদিন প্রথমবারের মতোই মেয়ের গায়ে হাত তুললেন মিতালি সিকদার। অনেক মা*র*লেন। চ*ড়, থা*প্প*ড় থেকে শুরু করে চু*ল ধরে টা*ন*লেন। মা*র খেতে খেতে এক পর্যায়ে মুখ খুললো রূহানী। বলল,
“আমি চাইনি মা। বিশ্বাস করো, অনেক চেষ্টা করেছি দূরে থাকতে। তবুও পারলাম না। আমায় ক্ষমা করে দাও।”
“আর কোনোদিন ওই ছেলের নাম নিবি না তুই। যদি নিস, এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবি। আমার থেকে দূরে যাবি। ভুলে যাবি, আমি তোকে লালন-পালন করে বুকে আগলে রেখেছিলাম।”
এতসব ঘটনা সবকিছুই শুনলো আদনান। এলাকায় রটে গেল। চারিদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। ঘরবন্দী জীবন উপহার পেল রূহানী। পড়াশোনা বন্ধ হলো। সবকিছুই অধরা থেকে গেল তার। দুঃস্বপ্ন আর মানুষের নিন্দেমন্দের কাছে একটু একটু করে হারিয়ে গেল স্বচ্ছ অনুভূতিটুকুও। এইটুকুতেই থেমে থাকেননি ফারদিন চৌধুরী। ঘটা করেই বিয়ে ঠিক করলেন ছেলের। কাউকে জানালেন না। জানলো না আদনান, কিংবা সাফফাতও। লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেই, কোনো এনাউন্সমেন্ট ছাড়াই ছেলের বিয়ের আয়োজনের মাঠে নামে তিনি। বাবার এমন চল-চা*তুরী কিছুই টের পেল না তানভীর নিজেও। চারদেয়ালের ভেতরে আটকা পড়ে ক্রমশ আঁধারে তলিয়ে যেতে শুরু করলো ভালোবাসা নামক ছোট্ট শব্দের গভীর অনুভূতিগুলো। দু’জন, দুই প্রান্তে আ*ট*কা পড়লো। নেই কোনো যোগাযোগ কিংবা চিঠি আদান-প্রদানও। সবকিছু যেন থমকে গেল মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যবধানে।
*****
চলবে…