সম্পূর্ণা-১২,১৩

0
591

সম্পূর্ণা-১২,১৩
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
১২

পৃথিবীতে যেকোনো সম্পর্ক যতই আপন হোক না কেন, একজন সন্তানের কষ্ট সবার আগে উপলব্ধি করে নিজ গর্ভে আগলে রাখা জন্মদাত্রী মা! সন্তানের কষ্টে প্রথম যদি কেউ কাঁদে, তিনি সেই নারী, সেই মা, যিনি সন্তানকে শত কষ্টকর মুহূর্ত পেরিয়ে পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন। সন্তানের এই হুটহাট পরিবর্তন, ঘরবন্দী জীবন ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে এক মা’কে। সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে ভদ্রমহিলার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজের অশ্রুসিক্ত চোখকে দাবিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ তিনি। তারমধ্যেই হুটহাট এক কল তাকে আরও কষ্ট দিচ্ছে। বার বার কানে বাজছে আদনানের বলা কথা। মনে হচ্ছে, একটা উপযুক্ত সন্তানকে আট*কে রেখে শুধু দুটো মনকেই দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন তা নয়, নিজের সন্তানকে ক্রমশ মৃ*ত্যু*র দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। অনেকক্ষণ ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। যা হয় হবে, যা থাকে কপালে! ছেলে সুখী হোক, ভালো থাকুক, এখানে তিনিও সুখী।

দ্রুত পায়ে তানভীরের রুমের সামনে গেলেন তিনি। বাইরে থাকা লক খুলে ঝটপট একটা ব্যাগপ্যাকে প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় ভরে নিলেন। হাতে থাকা সোনার দু’গাছা বালা আর গলার হারটা খুলে দিলেন। তানভীর শুধু মলিন মুখে মায়ের কাণ্ডকারখানা দেখলো। সবকিছু গুছিয়ে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন,

“তোর বাবা বাড়ি আসার আগেই চলে যা। আগামীকাল তোর বিয়ে। হয় নিজের ভালোবাসাকে নিয়ে পালিয়ে যা, নয় বাবার গো*লা*ম হয়ে বসে থাক।”

ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো তানভীর। এখনও সে কিছু বুঝতে পারছে না। তিনি আবারও বললেন,

“ওদেরকে ওই এলাকা তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওরা এখন স্টেশনে আছে। কোথায় যাবে জানি না। একটা মেয়ে রাস্তায় অসহায় হয়ে পড়ে আছে, তুই এখানে বসে কেন চোখের জল ফেলছিস! সাহস নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারছিস না?”

অনেকক্ষেণ পর মায়ের কথার সারমর্ম ধরতে পারলো তানভীর। ঝটপট ব্যাগ কাঁধে ফেললো। শেষ একবার মা’কে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিল। তিনি সময় নষ্ট করতে দিলেন না। দ্রুত পায়ে ছেলেকে নিয়ে পিছনের দরজা খুলে সেদিকেই পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। বললেন,

“আদনান ওখানেই আছে। বাকিটা ও সামলে নিবে। দ্রুত যা।”

“বাবা যদি খোঁজ নেয়! যদি তোমার গায়ে হাত তুলে?”

“পা*ষা*ণ মানুষেরা একটা কাজই পারে। মানুষের উপর অত্যা*চার করতে। তুই ভাবিস না। যা হয় হোক, তোরা পালা এই শহর ছেড়ে। যেখানে গেলে কেউ তোদের খুঁজে পাবে না, সেখানেই যাবি। কারও সাথে যোগাযোগ করবি না। কখনও বাড়ি আসবি না। যা বাবা, সময় খুব কম!”

শেষ আবারও মা’কে জড়িয়ে ধরলো তানভীর। অশ্রুসিক্ত নয়নে ছেলের কপালে চুমু খেলেন। মা’কে বিদায় জানিয়ে দেয়াল টপকে বেরিয়ে গেল আদরের সন্তান। সেইযে মায়ের চোখের আড়াল হয়েছিল, আর ফিরে আসেনি!

স্টেশনে যাওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় অবাক হলো তানভীর। সেখানে আদনান, সাফফাত এমনকি মিতালি সিকদার আর রূহানীও উপস্থিত। ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কিছু একটা ভাবছে আদনান। এলাকার সবাই জেনে গেছে, মা-মেয়েকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। সেই সময়ই তাদের পিছনে এসেছিল সে। কোথায় গেলে সেইফ থাকবে সেটাই ভেবেছে এতক্ষণ। অবশেষে একটা গন্তব্যও পেয়ে গেছে। তানভীরের মা’কে বেশিকিছু বলার প্রয়োজন হয়নি। তিনি শুধু জেনেছেন, রূহানীদের এলাকা ছাড়তে বলা হয়েছে। ব্যস, এতেই তিনি বুঝে গেছেন কী করতে হবে। বুদ্ধিমতি নারী সবকিছুর উপেক্ষা করে নিজের সন্তানকে তার ভালোবাসার পথ চিনিয়ে দিয়েছেন। হয়তো মায়ের মন বুঝতে পেরেছে ছেলে কোথায় সুখে থাকবে। তানভীরকে দেখে আর দেরী করলো না আদনান। গম্ভীরমুখে বলল,

“নবাবজাদার আসার সময় হয়েছে তবে! তুই কি মেয়ে নাকি? ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে চারদেয়ালের ব*ন্দী জীবন বেছে নিয়েছিস! স্টু*পি*ড। সব দুঃশ্চিন্তা আমার মাথায় ঢে*লে উনি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন!”

অভিমানী চোখ বন্ধুর দিকে তাকালো তানভীর। হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো। মুচকি হাসলো আদনান। বলল,

“তোর বাবা অ*মানুষ হলে কী হবে! তুই যে মানুষ হয়েছিস সেটা বুঝা যাচ্ছে। এখন বল, বিয়েটা এখানেই করবি না-কি চট্টগ্রাম গিয়ে?”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তানভীর। সাফফাত এগিয়ে এসে বলল,

“ভয় পাস না দোস্ত! সবকিছু রেডি আছে। আমরা শুধু তোর আসার অপেক্ষা করছিলাম।”

বিস্ময়ে চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল তানভীর। দু’চোখে জল নিয়ে দু’হাতে দুই বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলো। বলল,

“তোরা যা ভালো বুঝিস তা-ই হবে।”

অনেকক্ষণ পর আদনানের চেহারা থেকে দুঃশ্চিতার ভাঁজটা সরে গেল। প্রশান্তির হাসি ফুটালো ঠোঁটে। সবাইকে নিয়ে দ্রুত রওনা দিল কাজী অফিসে। সবকিছু আগেই গোছানো থাকায় কোনো ঝামেলা হয়নি। দ্রুতই বিয়ের কাজ সেরে নিল। দুটো মন একই সূত্রে গাঁথা পড়লো, সাক্ষী হলো বাকিরা। কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে স্টেশনে না গিয়ে সোজা সামনের বাসস্ট্যান্ডে চলে আসলো সবাই। তানভীর অবাক হয়ে বলল,

“বাস কেন?”

“তুই কি চাস, তোর বাবা জেনে যাক তোর লোকেশন?”

“না! তা কেন চাইবো?”

“এই মুহূর্তে স্টেশন থেকে একটাই ট্রেন ছাড়বে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে। আর এখান থেকে চারটে বাস যাবে চারদিকে! তোরা কোথায় যাবি নির্দিষ্ট লোকেশন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে! সো, তোদের গন্তব্য এখন চট্টগ্রাম!”

আদনানের বুদ্ধির প্রশংসা করতে বাধ্য হলো তানভীর। তবুও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ চেহারা নিয়েই বলল,

“ওখানে যাব কোথায়?”

পকেট হাতড়ে ঝটপট একটা ঠিকানা বের করলো আদনান। সেটা ধরিয়ে দিল তানভীরের হাতে। আলাদা একটা মোবাইল, সিম কার্ডসহ নিজের এটিএম কার্ডটাও ধরিয়ে দিল হাতে। বলল,

“আমাদের কলেজের সিনিয়র ভাই, তাওহীদ। উনিই সবকিছু সামলে নিবেন। একটা বাসা ঠিক হয়েছে। তুই শুধু লোকেশনে পৌঁছে তাকে কন্টাক্ট করে নিবি! তাহলেই হবে। আর শোন, ভুল করেও আমার পারসোনাল নাম্বারে যোগাযোগ করবি না। তোর বাবার যা মাথা, উনি শেষে আমাকেই জে*লে ভরে দিবেন।”

কয়েক মিনিটের মধ্যে বাস এসে নির্দিষ্ট স্থানে থামলো। শেষ একবার বন্ধুদের জড়িয়ে ধরলো তানভীর। বিদায় নিলে বাসে উঠলো। রূহানীর হাতটা তার হাতের ভাঁজে আটকানো। মিতালি সিকদারসহ তিনজনই বাসে উঠলেন। বাস ছাড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত জানালা দিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা চালিয়ে গেল তানভীর। আদনান শুধু বলল,

“আজ থেকে ওই দুটো মানুষের সব দায়িত্ব তোর। যথাযথভাবে নিজের সব দায়িত্ব কর্তব্য পালন করবি৷ আন্টিকে যা বলার, যা বুঝানোর তা আমিই বুঝাবো। তুই শুধু এই দু’জন মানুষকে আগলে রাখবি। যতদিন না তোর বাবা এই সম্পর্ক মেনে নিচ্ছেন, ততদিন ফেরার নাম নিবি না। যা প্রয়োজন হয় আমাকে বলবি। ভালো থাকিস!”

নিশ্চিন্ত মনে মাথা নাড়লো তানভীর। সে জানে, বন্ধুরা ছিল, আছে আর সারাজীবন থাকবে। এই বিশ্বাস নিয়েই তো সম্পর্ক বেঁচে থাকে। তখনও ওই মানুষগুলোর কেউ জানে না, তিন বন্ধুর মধ্যে কারও মনই বুঝেনি, একজন বন্ধুকে তারা শুধু নতুন জীবনের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে তা নয়, চিরদিনের জন্য প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে! যদি মন কভু আগে সেটা টের পেত, তবে কি এই বিদায়ি মুহূর্ত কখনও আসতো?

*****

সময় বড্ড দ্রুত পালায়। দিন, মাস, বছর চোখের পলকেই চলে যায়। সেদিনের পর ক্যালেন্ডারের পাতা দুটো বছর অতিক্রম করেছে। তানভীর আর রূহানীর ছোট্ট সংসার হয়েছে অচেনা, অজানা এক জায়গায়। মাঝেমধ্যে শুধু বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে সে। তানভীরকে চট্টগ্রামের বাসে তুলে দিয়ে বাড়ি এসে টানা কয়েক ঘন্টার ঘুম দিয়েছিল আদনান। ফারদিন চৌধুরী যখন ছেলের খুঁজে তাদের বাড়ি আসেন তখন ঢুলুঢুলু চোখে ভদ্রলোকের সামনে হাজির হয়েছিল সে। কিছুই জানে না, কিছুই দেখেনি এমন ভাব করে তাঁকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে বিদায় করে দিয়েছিল। ফোন দেখিয়ে বলেছিল,

“আপনার ছেলের সাথে আমার তো যোগাযোগই হয়নি আঙ্কেল! এই দেখুন কল লিস্ট!”

তাতেই কাজ হলো। প্রথম কয়েকদিন ছেলেকে অনেক খুঁজেছেন তিনি। স্ত্রী’কেও শাসিয়েছেন। না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর সময় তার নির্দিষ্ট গতিতেই পেরুলো।

ক্যাম্পাসে আর আগের মতো আড্ডা জমে না। ব্যবসায়ও মনোযোগ দিতে ইচ্ছে হলো না তার। শেষমেশ রান্নাবান্নার আইডিয়া আসলো মাথায়। ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টে ওপেন করে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আদনান। হুটহাট এক সন্ধ্যায় কল আসলো রূহানীর। তার হাউমাউ করা কান্নায় বুক ভারি হয়ে যায় আদনানের। কানে ভোঁতা ভোঁতা শব্দ শুনতে পেল। মনে হলো, সে ভুল শুনছে। কার্ডি*য়াক অ্যারে*স্টের শি*কা*র হয়ে চিরদিনের জন্য পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে তানভীর। খবরটা শোনা মাত্রই দপ করে সোফায় বসে পড়লো আদনান। দু’চোখে জল জমা হলো! নিজেকে কিংবা রূহানীকে স্বান্তনা দেয়ার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেল না। সব ফেলে তড়িঘড়ি করে রওনা দিল চট্টগ্রামের পথে। সঙ্গী হলো সাফফাতও।

দুর্ঘট*নার এই খবরটা টেলিভিশনেও প্রচার হয়। ফারদিন চৌধুরী জেনে যান ছেলে এবং রূহানীর অবস্থান। আদনানরা পৌঁছাবার আগেই তিনি অ্যারোপ্লেনে রওনা দেন চট্টগ্রাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যান হসপিটালে। মিতালি সিকদার এমনকি রূহানীর উপর অত্যাচার করে ছেলের লা*শ নিয়ে ফিরে আসেন তিনি। তার সাঙ্গপা*ঙ্গরা এতটাই আঘাত করে যে, সেই আঘাতে মিতালি সিকদার সেখানেই মা*রা যান। রূহানীকে মা*রা*র জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়, কিন্তু বুদ্ধিমতি মেয়ে অসুস্থ শরীর নিয়ে পালিয়ে আসার চেষ্টা করে। প্রেগ*ন্যান্ট অবস্থায় কতক্ষণ আর দৌড় দেয়া যায়। একটা সময় ক্লান্ত শরীর হসপিটালের বারান্দায়ই হাল ছেড়ে বসে পড়ে। ততক্ষণে শরীরের সমস্ত শক্তি তার হারিয়ে গেছে। শুরু হয়েছে লে*বা*র পেই*ন। মনের সব জোর নিয়ে আদনানকে সবকথা ফোনেই জানায়।

দু’জনে যখন হসপিটালে পৌঁছায় তখন রূহানীর অবস্থা শোচনীয়! আশেপাশে সাহায্য করার মতো কোনো মানুষই পেল না। একটা গ*র্ভব*তী নারীর ছটফটানি কারও চোখেই পড়লো না। দ্রুত ছুটে গেল ইমার্জেন্সিতে। দু’জন নার্স আর ডাক্তার সঙ্গে এনে স্ট্যাচারে তুললো রূহানীকে। দ্রুত অপারেশনের ব্যবস্থা করতে বললো!

বিপদ যখন ঘাড়ে আসে সবদিক থেকেই আসে। ফারদিন চৌধুরীর লোকেরা পুরো হসপিটাল ঘিরে রাখলো। অপারেশনের পর দুটো বাচ্চাকে নিয়ে সব ঝামেলা শেষ করলো দু’জনে। রূহানীর জ্ঞান ফিরলো পরদিন সকালে। বাচ্চাদের একনজর দেখে দু’জনকে তুলে দিল আদনানের হাতে। বলল,

“এই শরীরে আমি হয়তো বেশিদূর যেতে পারবো না। ওরা হসপিটালেই আছে হয়তো। যেভাবে আমার পিছু নিয়েছিল, না মে*রে শান্তি হবে না। আইনের সঙ্গে ল*ড়া*ই করার শক্তি আমার নেই। ওদেরকে বাঁচান আপনি। ওরা জেনে গেছে আমি এখানে! যেকোনোদিন আমাকে মা*রা*র চেষ্টা করবে। নিজেকে নিয়ে ভয় নেই আমার, ভয় শুধু বাচ্চাদের নিয়ে! পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই বাবার ছায়া হারিয়ে গেছে ওদের জীবন থেকে। মা-ও হয়তো হারিয়ে যাবে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে ওরা আপনার কাছে থাকলে ভালো থাকবে। যদি বেঁচে থাকি, কোনো একদিন দেখা হবে। এক্ষুণি চলে যান এখান থেকে।”

“আপনিও আমাদের সাথে চলুন! এভাবে একা ফেলে যাওয়া উচিত হবে না। ওঁরা তো আপনার মা’কেও…!”

“আমার চিন্তা ছেড়ে দিন! জার্নি করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি আমার শরীরে নেই। ওদেরকে বাঁচান। ওঁরা যেকোনো সময় চলে আসবে।”

পুরো হসপিটালেই সিসি ক্যামেরা ঝুলানো। কীভাবে পালাবে, কীভাবে ওই লোকদের নজর এড়াবে সেটাই বুঝতে পারলো না আদনান। জানালা দিয়ে একবার সড়কে দৃষ্টি দিল। তখনও দু’চারজনকে সেখানে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেল। এদেরকে খুব ভালো করেই চিনে সে। ফারদিন চৌধুরীর কেনা গো*লা*ম এরা। মানুষ মা*র*তেও হাত কাঁপে না এঁদের। ঝটপট বুদ্ধি সাজালো। দু’জন নার্সের সঙ্গে আলাপ করে তাদের অ্যাপ্রোন জড়ালো গায়ে। মুখে মাস্ক পড়ে দু’জনই চেহারা ঢেকে ফেললো। রূহানী তখন দু’জনকে কোলে নিয়ে কাঁদছে। কাছে গিয়ে একটা ছবি তুললো সাফফাত। বলল,

“হয়তো ভবিষ্যতে প্রয়োজন হবে! আপনার বাচ্চারা সবসময়ই আপনার থাকবে। আমরা শুধু তাদের আগলে রাখার দায়িত্ব নিলাম।”

অজস্র চুমুর স্পর্শ দিল বাচ্চাদের শরীরে। বুকে আগলে নিল। তখনও হন্নে হয়ে বাইরের লোকজন তাদের খুঁজছে। ভেতরে আসছে, আবার বের হচ্ছে। তড়িগড়ি করে বিদায় নিল দু’জনে। দরজার কাছে আসতেই দু’জন লোকের নজরে পড়লো। উঁকিঝুঁকি মে*রে ভেতর চেক করছে তারা। ভয়ে ঢোক গিললো আদনান। অসুস্থ শরীর নিয়ে বহু কষ্টে বেডের পিছনে লুকালো রূহানী। লোকজন এদিক-ওদিক দেখলো, সন্দেহপ্রবন দৃষ্টি ফেলে দাঁড়িয়ে রইলো। সেই ফাঁকে দু’টো বাচ্চাকে বুকে আগলে হসপিটালের বাইরে চলে আসলো দু’জনে। এরপর ভেতরে কী হলো, তা আর কেউ জানলো না!

*****

শান্ত মেজাজে আদনানের সমস্ত কথা শুনলো নোভা। চোখ ফে*টে কান্না আসলো তার। ভালোবাসার পরিণতি যে এত কঠিন, এত নি*ষ্ঠু*র হতে পারে জানা ছিল না। দুঃখ তার একটা জায়গায়ই জমা হলো! মনের সমস্ত যন্ত্রণাকে মনের ভেতরে চেপে বলল,

“আপনার গল্পের সারমর্ম এইটুকুই বুঝলাম, ওরা আপনার বাচ্চা নয় আর রূহানীও আপনার স্ত্রী নয়! বাচ্চাদুটোকে আগলে রেখেছেন ঠিক আছে, তাদেরকে বাবার স্নেহ-মমতা দিয়েছেন সেটাও ঠিক, আমাকে মিথ্যে কেন বললেন? এইটুকু সত্যি সেদিন রেস্টুরেন্টে বলা যেত না? অযথা একটা কাহিনী কেন বানিয়েছেন? তবে কি আমি ধরে নিব, এই সবকিছু আপনার সাজানো গোছানো পূর্বপরিকল্পিত একটা নাটক! সবকিছু করেছেন আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য? তাইতো ভাবী, প্রথমদিনের আলাপের সাথে পরবর্তী দিনের আলাপের কেন কোনো মিল নেই! আজ বুঝলাম ঝামেলাটা ঠিক কোথায়!”

গলায় আর জোর আসলো না নোভার। মুখ দিয়ে বাকি কথাগুলো বলতে পারলো না। মাথার ভেতর ফাঁকা হয়ে গেছে তার। দৃষ্টিতে অভিমান, অভিযোগ আর অজস্র ব্যথাবেদনা! চোখের কার্নিশ বেয়ে উপচেপড়া জলের ঢেউ গাল বেয়ে পড়ছে। সে জলে মিশে আছে বিশ্বাস ভা*ঙা*র যন্ত্রণা! নিজেকে বুঝানোর মতো আর কোনো লজিক খুঁজে পেল না সে। ওভাবে থম মে*রে বসে রইলো কিছুক্ষণ! আদনান তখনও নীরব। পাথর। অশান্ত। আগেই বুঝেছিল, এই কথাগুলো তু*ফা*ন ছুটাবে! এখন এটাই দেখার যে, কতটুকু আঘাত পেয়েছে তার অর্ধাঙ্গিনী! সেই আঘাতটা কীভাবে মুছে দিবে, সেটাও ভাবতে হবে। নিজেকে সামলে নিতে খানিকটা সময় ব্যয় করলো নোভা। ধীরস্থিরভাবে সোফা ছাড়লো। ততক্ষণে কফির কাপদুটো খালি! সেগুলো হাতে নিয়েই একপলক আদনানকে দেখলো। বলল,

“অসংখ্য ধন্যবাদ! গল্পের পিছনের গল্প যে এতটা কঠিন আর কষ্টকর হবে জানা ছিল না। যেটুকু বিশ্বাস আর ভরসা জমেছিল, তা খুব নীরবেই বিনা আ*ঘাতে ভে*ঙে দিয়েছেন। আমি খুব দুঃখিত আদনান! আপনার এই মিথ্যেটাকে ক্ষমার চোখে দেখতে পারলাম না।”

সময় নষ্ট করলো না নোভা। আদনানের অবাক করা দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি করে দুটো কাপ নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সেগুলো পরিষ্কার করে জায়গামতো রেখে ড্রয়িংরুমে থাকা সোফায় এসে বসলো। বাড়ির সবাই ততক্ষণে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এই মুহূর্তে রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। আদনানের মুখোমুখি হতেও কষ্ট হচ্ছে। মানুষটা তার অনুভূতি নিয়ে খেলেছে, এই কথাটাই বিশ্বাস করতে পারছে না নোভা। সবকিছু তো সহজ, সুন্দর ছিল। সেটাকে কেন এত জটিল করে তুললো! ঘুরেফিরে একটা প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খেল তার। মন তৎক্ষনাৎ সায় জানালো। প্রথম দেখাতেই তাকে আদনানের অপছন্দ হয়েছিল! সরাসরি বলতে পারেনি দেখেই কৌশল অবলম্বন করেছে। বুকের ভেতর কষ্টরা কুণ্ডলি পাকিয়ে বসেছে। ভেতরটাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চোখের পানিকে কোনোভাবেই থামিয়ে রাখা যাচ্ছে না। নিঃশব্দে, নীরবে তা গাল গড়িয়ে পড়ছে তো পড়ছেই।

সোফায় মাথা হেলিয়ে যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করছে নোভা। ভেতরটা ছটফট করছে। কেন সে আরেকটু ভাবলো না? কেন সে সামান্য কথার জা*লে পড়ে ভুল মানুষকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিল? কেন সে আরেকটু গভীর করে সবকিছু ভেবে দেখলো না? কেন বুঝতে পারলো না আদনানের চালাকি! যার মুখের কথায় ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, হাজারও রঙিন ফুলের সুবাসে সুবাসিত হয় মনের উঠোন, কীভাবে বুঝবে তার মনে ভেতরে অন্য গল্পের ছলচা*তুরী চলছে? নিজেকে বড্ড ছোটো মনে হচ্ছে তার! কখনও এমন অদ্ভুত যন্ত্রণার মুখোমুখি পড়েনি। প্রথম যাকে বিশ্বাস করে নিজের জীবনটাকে সহজ আর সুখী ভাবতে শুরু করেছিল, সে-ই কিনা ভেতরে অন্যকিছু লুকিয়ে রেখেছে? জীবন এত কঠিন কেন? কেন এত যন্ত্রণার? কেন সবাই তাকে এভাবে তুচ্ছতা*চ্ছিল্য করে? কেন কেউ মন থেকে ভালোবাসতে পারে না? কোনো সঠিক জবাব খুঁজে পাচ্ছে না সে।

অনেকক্ষণ পরও নোভার কোনো সাড়াশব্দ পেল না আদনান। বুঝতে পারলো, মেয়েটাকে কতখানি আঘাত দিয়ে ফেলেছে। নোভা যদি তাকে ভুল বুঝে, এতসব কথার ভুল ব্যাখ্যা করে তবেই তো সমস্যা তৈরী হবে! কীভাবে বুঝাবে সে? কীভাবে ভুল ভাঙাবে? নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। সাহস নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। তখনই চোখ পড়লো সোফায়। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে মেয়েটা। দ্রুত পায়ে সামনে গেল। পাশে বসতেই চমকে গেল নোভা। চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। দু’হাতের আঁজলায় অর্ধাঙ্গিনীর মুখটা নিজের দিকে ঘুরালো সে। দৃঢ়কণ্ঠে বলল,

“আ’ম সরি! আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো। তখন আমার কাছে আর কোনো অপশন ছিল না। আমি বড্ড অসহায় ছিলাম নোভা!”

“যতখানি ভরসা করেছিলাম, তারচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছি আপনাকে। এখন শুধু এইটুকুই মনে হচ্ছে, সবকিছু সবার জন্য নয় আর আমিও কারও যোগ্য নই! আঘাত যদি দিবেন সেটা আরও আগেই দিতেন সহ্য করে নিতাম, এখন তো সব অসহ্যকর ঠেকছে! জীবন অনেক জটিল এবং কঠিন সেটা খুব অল্পবয়সেই বুঝেছিলাম। বিশ্বাস ভা*ঙা*র যন্ত্রণা যে এত দুর্বোধ্য তা-তো বুঝিনি আমি!”

সমস্ত শরীর জ্ব*ল*ছে নোভার। লজ্জায়, অপমানে, ঘৃ*ণা*য় নিজেকে অতি তুচ্ছ কীটপ*তঙ্গের চেয়েও নি*কৃ*ষ্ট মনে হচ্ছে আজ! সারা শরীরে বোল*তার হু*ল ফুটেছে যেন! হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পাশাপাশি ঝরাচ্ছে অবিরত র*ক্তে*র ফোয়ারা! জীবনে যত কষ্টই পেয়েছে মানিয়ে নিয়েছে। এই কষ্ট থেকে কীভাবে মুক্তি মিলবে? তবে কি ধরে নিবে তার সমস্ত অনুভূতি একপাক্ষিক? অপরপ্রান্তে শুধু নাটক, সিনেমা আর নিখুঁত অভিনয় লুকিয়েছিল! অবুঝ মনটা ঘুণাক্ষরেও তা টের পায়নি কেন? কেন সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সে ধরতে পারেনি? কেন বুঝতে পারেনি, একটা মানুষের বাইরের আর ভেতরের আচরণের পার্থক্য? কেন এত অপমানিত মনে হচ্ছে নিজেকে? ঘৃ*ণা*য় নিজের দিকে তাকাতেও তো কষ্ট হচ্ছে! এত অপমান, এত কষ্ট কোথায় লুকোবে? কীভাবে লুকোবে? কোথায় গেলে স্বচ্ছ অনুভূতির দেখা মিলবে?

*****

চলবে…

সম্পূর্ণা | ১৩
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

বাইরে রৌদ্রজ্বল এক মিষ্টি সকাল! ভোরের সতেজ আলোতে সবকিছুকেই স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ আর পবিত্র মনে হচ্ছে। অন্ধারের সাথে রাত্রিযাপনের শেষে আলোতে ভরে উঠেছে আঙিনা। মাঠঘাট সবকিছুতে পড়েছে ঝলমলে আলোর ঝলকানি। মৃদু বাতাসের ঢেউ এসে গাছপালা নাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিবেশকে রাঙিনে দিয়েছে সোনারঙা রোদে। পরিবেশ যেমনই হোক, দিনের আলো যতই সুন্দর আর স্বচ্ছ হোক, নোভার মনটা ঘনকালো মেঘের মতোই গুমোটবাধা আঁধারে মোড়ানো। বাইরের এই রূপ, এই সৌন্দর্য তাকে খুব একটা ছুঁয়ে যাচ্ছে না। নিজেকে মানানোর, বুঝানোর অনেক চেষ্টাই করেছে, সব হিসাব-নিকাশ থেমেছে একটা শব্দে এসে, আদনান তাকে মিথ্যে বলেছে। এইটুকুই কোনোভাবে হজম করতে পারছে না সে। বাচ্চা তার নয়, এটা তো স্পষ্ট বলা যেত! এত নাটকীয়তার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবে কেন? অপছন্দ হলে সরাসরিই তার জবাব চেয়েছিল নোভা, অথচ আদনান সেসব এড়িয়ে গেছে। ঠিক কী কারণে এমন একটা মিথ্যের আশ্রয় সে নিল, এটাই বোধগম্য হলো না।

সব কাজেই আজ বড্ড অমনোযোগী নোভা। রান্না করতে গিয়েও ভেতরের অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। সবকিছু অবিশ্বাস্য ঠেকছে। রুবিনার সাহায্যে সকালের নাশতা তৈরী করেছে ঠিকই, কিন্তু খাবার টেবিলে আদনানের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে হচ্ছে না। নিজেকে খুব সস্তা আর অনাহুত একজনই মনে হচ্ছে। আদনান তো বলেছিল, সে রূহানীকে ভালোবাসে। হয়তো এখনও বাসে! হয়তো অপেক্ষায় আছে! সে-ই ভুলবশত মাঝখানে চলে এসেছে। অথচ আদনানের কথাবার্তায় কখনও মনে হয়নি, সে রূহানীর জন্য অপেক্ষা করছে! সবকিছু ঝট পাকিয়ে যাচ্ছে তার। এলোমেলো মনে হচ্ছে। স্থির, অনড়, নীরব হয়ে নিজের মনের ভেতরে জমে উঠা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে চলেছে সে। সঠিক কোনো জবাব দিচ্ছে না মন। বার বার কেবল একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, সে আদনানের অযোগ্য আর ঠিক এই কারণেই আদনান এত কাহিনী সাজিয়েছে। মনের ভেতর এতসব প্রশ্ন নিয়ে ল’ড়া’ই চালিয়ে যাওয়া বড্ড কঠিন। দু’চোখের কোল ঘেঁষে অভিযোগের পানি ঝরছে, খুব ছোটো মনে হচ্ছে নিজেকে তার। অথচ আগে কখনও এমন মনে হয়নি। এই প্রথম সে আবিষ্কার করলো, নিজেকে সে যেভাবেই ভালোবাসুক না কেন, তাকে কেউ এইভাবে কোনোদিন ভালোবাসবে না!

সাফিয়া খানম যখন রান্নাঘরে এসে নোভাকে এভাবে বেখেয়ালি দেখলেন, তখনই চমকে গেলেন। অবাক হলেন তার চোখমুখ দেখে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এলে আপন লোকজনকে মনে পড়ে মেয়েরা অনেক কাঁদে এটা যেমন সত্য, নোভার এই মুহূর্তে কান্নামাখা মুখশ্রীও বুঝিয়ে দিয়েছে মেয়েটা ঠিক এই কারণে নয়, অন্য কোনো কারণে কাঁদছে। কারণ তার চোখমুখ ফুলে ঢোল হয়ে আছে। চোখের চারপাশের রগে রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে গেছে। নাকের ডগাও লালছে। চেহারাটাও মেঘে ঢাকা। তড়িঘড়ি করে নোভার কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। চমকে গেল নোভা। সরে গেল বেসিনের কাছে। ঝটপট চোখেমুখে পানি ঝাপটা দিল। তিনি শুধু বললেন,

“কেউ কিছু বলেছে তোমাকে? চোখমুখ দেখে তো মনে হচ্ছে ঘুমাওনি। আদি কিছু বলেছে?”

“না ফুপ্পি! ওসব কিছু না। একটু মাথাব্যথা করছে। চা খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“তা তো করবেই! ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঁদলে মাথাব্যথা তো বাড়বেই। অসুস্থ শরীর নিয়ে রান্না না করলেই পারতে। যাও, একটু বিশ্রাম নাও।”

এই মুহূর্তে আদনানের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে বিশ্রামের বাহানায় রুমে চলে যাওয়াই উত্তম। রাত থেকেই এড়িয়ে চলার পথ খুঁজছে। পুরো রাতটাই নির্ঘুম কাটিয়েছে শুধুমাত্র অন্ধ অভিমানকে সঙ্গী করে! কাছাকাছি, পাশাপাশি হওয়া তো দূর চোখাচোখিই হয়নি। নিজেকে দমিয়ে রাখতে, সামলে রাখতে কষ্ট হলেও মানিয়ে নিচ্ছে।

*****

নাশতার টেবিলে নোভাকে না দেখে অবাক হলেন রেদোয়ান হাসান। মেয়েটাকে সুখের মুখ দেখাতে এখানে নিয়ে এসেছেন, অথচ মেয়েটার অভিমানী চেহারা বলছে, তাকে সুখের সংসারে নয় কোনো জল’ন্ত আগ্নে’য়গিরির লা’ভাতে ঢেলে দেয়া হয়েছে। যার ভেতর বাহির শুধু জ্বল’ছে তো জ্বল’ছেই! আড়চোখে ছেলেকেও একবার দেখলেন। তার চেহারাটাও থমথমে। নির্ঘুম রাত বুঝি সে-ও কাটিয়েছে। গণ্ডগোলটা ঠিক কোথায় শুরুতে তিনি ধরতে পারলেন না, তবে আদনানের এরূপ নীরবতাতেই কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেন। সন্দিহান চোখে ছেলেকে বার দু’য়েক দেখে বললেন,

“কী নিয়ে ঝামেলা চলছে?”

মলিন মুখে বাবার দিকে দৃষ্টি ফেরালো আদনান। খাবার টেবিলে বাচ্চারাও আছে। এই মুহূর্তে রাতের ঘটনা বিস্তারিত বলা মানেই জেনে-বুঝে ঝামেলা তৈরী করা। অভ্যস্ত হাতেই জারা, নোরাকে খাওয়াচ্ছে সে। শুধু ফাঁক দিয়ে একবার রান্নাঘরে চোখ বুলিয়েছে। তখনই অনাকাঙ্ক্ষিত চোখাচোখি! সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে নোভা। দ্রুত পায়ে চলে গেছে রুমে। এই ব্যাপারটাও রেদোয়ান হাসান অতি সুক্ষ্মভাবে পরখ করলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আদনান নিজেই বলল,

“রূহানীর ব্যাপারটা জানিয়েছি! এরপর থেকেই চুপ হয়ে গেছে। কথা বলা তো দূর ফিরেও তাকাচ্ছে না।”

ছেলের কণ্ঠে স্পষ্ট অভিমান দেখতে পেলেন তিনি। কেমন বাচ্চামো ভঙ্গিমায় বিড়বিড়িয়ে কথা বলছে! বুঝাতেও পারছে না, নোভাকে তার ঠিক কতটুকু প্রয়োজন! চায়ে চুমুক দিলেন তিনি। বললেন,

“তোকে আগেই বলেছিলাম, যা করবি বুঝেশুনে কর! ঝামেলাটা তুই তৈরী করেছিস, শেষ করবি তুই! আমি তোর হয়ে সাফাই গাইবো না।”

“বাবা!”

শান্ত অথচ অভিমানী কণ্ঠস্বর। নোভাকে নিয়ে তার পজেটিভ মনোভাবে খুশি হলেন। সঙ্গিনীকে সে ঠিক কতটা আপন ভাবছে, সেটা তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। হারিয়ে ফেলার ভয়, দূরে সরে যাওয়ার ভয়টাও তার চোখেমুখে স্পষ্ট। এমন পরিস্থিতি হবে, সেটা তিনি আগেই বুঝেছিলেন। ছেলেকে বুঝিয়েছেনও। জেনে-বুঝে কেউ যদি ভুল করে তবে তো তার কিছু করার নেই। বাবা হিসেবে তিনি সঠিক কাজই করেছেন। ভুল করার আগে বার বার বুঝিয়েছেন, তবুও যদি সে এমন একটা কাজ করে তবে তিনি তৃতীয় পক্ষ হয়ে আর কী-ই-বা বুঝাবেন। পক্ষান্তরে দু’দিকে মাথা নাড়লেন তিনি। বললেন,

“আজ তো তোদের ওই বাড়িতে যাওয়ার প্রোগ্রাম। মনে আছে?”

উপরনিচ মাথা নাড়লো আদনান। তিনি আবারও বললেন,

“শোন, মানুষ হিসেবে সে কতটুকু সঠিক সেটার ব্যাখ্যা আমি তোকে দিব না। আশাকরি এটা তুই নিজেই বুঝেছিস। শুধু এইটুকু বলবো, এরপর যেন আর কোনো ঝামেলা না হয়! ভুল যেহেতু করেছিস, ক্ষমা তো চাওয়া উচিত তাই না?”

“সুযোগটা তো দিবে!”

“পারফেক্ট জীবনসঙ্গী কেউ-ই পায় না! কাউকে বুঝতে না পারলে, নিজেকে বুঝাতে না পারলে, জীবনসঙ্গী যেমনই হোক, সংসারে সুখ আসবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিমানকে দূরে ঠেলে আত্মসমর্পণ করতে হয়! তুই একজন বুদ্ধিসম্পন্ন, বিচক্ষণ মানুষ। খাঁটি সোনা যেহেতু চিনতে পেরেছিস, তাকে আগলে রাখবি, সম্মানে, স্বযত্নে রাখবি, এটাই আশা করবো।”

বড্ড ভুল হলো তার! কেন যে এসব কথা বলতে গেল! এখন এই অভিমান ভাঙানোর একটাই পথ খোলা আছে! সেটাই কাজে লাগাতে হবে। অহেতুক মান-অভিমান, ভুল বুঝাবুঝি সংসারে অশান্তি ডেকে আনবে। কোনো অশান্তি চায় না সে, সুন্দর, সাজানো গোছানো স্বপ্নের একটা ঘর চায়। যে ঘর ভালোবাসায় ভরে থাকবে, কোনো মিথ্যে কিংবা দূরত্ব সেখানে ছিঁটেফোঁটা জায়গাও পাবে না।

*****

দু’জনের চোখে রাজ্যের বিস্ময় আর কৌতূহলেরা ভিড় জমিয়েছে। ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি ফেলে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখছে দু’জনে। আগ্রহী শ্রোতার মতো উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদনানের দিকে। নোভা তখন মনের ব্যথা লাঘবের সামান্যতম চেষ্টা করে চলেছে ফোনে কথা বলার মাধ্যমে। ওপাশে মুনতাহা কতশত কথার ঝুড়ি খুলে বসেছে। এপাশ থেকে সে শুধু হু হ্যাঁ তে জবাব সারছে। বেলকনি থেকেই চোখ পড়লো রুমের ভেতরে থাকা তিনজন মানুষের দিকে। জারা তখন ভাবুক নয়নে ফোনের স্ক্রিনে আঙুল ঘষলো। বলল,

“ওটা কে পাপা?”

কাহিনীটা ঠিক জমাতে পারছে না আদনান। কীভাবে বললে নোভার মনের পর্দায় স্মৃতিটুকু ভেসে উঠবে সেটাই ভাবছিল সে। জারার প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসলো। বলল,

“এটা তো তুমি!”

“ওমা! ওটা আমি? মাম্মার কোলে?”

“হ্যাঁ! তুমি তখন অনেক ছোটো ছিলে। তোমাদের দু’জনকে নিয়ে আমি আর তোমার সাফফাত আংকেল একটা শপিংমলে গিয়েছিলাম কিছু জামাকাপড় কিনবো বলে! তখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে! একটা কিশোরী মেয়ে পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিলো। বেখেয়ালিতে সে জারার স্ট্রলারে ধা’ক্কা মারে। সেই ধা’ক্কায় বেল্টের ফাঁক গলে উপর থেকে নিচে ছিঁটকে পড়ে জারা।”

ভয়ে, আতঙ্কে জারার মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,

“জারা নিচে পড়ে গিয়েছিল?”

“পড়েনি তো! আল্লাহর ইশারায় তখন একটা ডানাকাটা পরী সেখানে হাওয়ার বেগে ছুটে আসে। ঝাপটে ধরে জারাকে! আগলে নেয় বুকে। চোখে-মুখে অসংখ্য চুমু খায়!”

“তাই…? ডানাকাটা পরী!”

বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে জারার মুখ! আস্তো একটা পরী এসে তাকে আগলে নিয়েছে, ভাবতেই পারছে না সে। কেমন সুখী সুখী চেহারা বানিয়ে আদনানের গলা জড়িয়ে ধরলো সে। বলল,

“কিন্তু ছবিতে তো মাম্মা! পরী কোথায়? পরীকে দেখা যাচ্ছে না কেন?”

“এই ডানাকাটা পরীটাই তোমাদের মাম্মা! মায়েরা যখন যেখানে উপস্থিত থাকে, সন্তানেরা বিপদমুক্ত থাকে। তাদের ছায়া যখন সন্তানকে আগলে রাখার দায়িত্ব নেয়, তখন শত ঝড়তুফান থেকেও বাঁচিয়ে নিতে পারে। কখনও মাম্মাকে ব্যথা দিবে না! মাম্মা যদি না থাকতো, হয়তো আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলতাম জারা!”

দু’হাতে জারাকে বুকের কাছে আগলে নিল আদনান। বুকটা ধড়ফড় করছে তার। মনে হচ্ছে, বাচ্চাদুটোকে হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে! কঠিন তুফান আসছে জীবনে। সেই তুফানের তীব্র গতির সাথে দূরে সরে যাচ্ছে তার বাচ্চাদুটো।

*****

নোভার চোখ তখন একটা জায়গায়ই স্থির! বিস্ময় নিয়ে চার হাত দূরের মানুষটাকে দেখছে সে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ওই দু’চোখে জল চিকচিক করছে! তবে কি আদনান কাঁদছে? ভরকে গেল নোভা। কল কেটে ধীরপায়েই রুমের ভেতরে আসলো। বিছানায় পড়ে থাকা মোবাইলটা হাতে নিল। বার কয়েক চোখের পলক ফেলে ছবিটা টেনে টেনে দেখলো। অবিশ্বাস্য কিছু আবিষ্কার করতে পেরে বিছানাতেই বসে পড়লো। দু’হাত চেপে ধরলো মাথায়। নোরা সেই ফাঁকে নোভার কোল চড়ে বসলো। বলল,

“ডানাকাটা পরীটা শুধু জারাকেই ভালোবাসে! নোরাকে ভালোবাসে না!”

গাল ফুলালো নোরা। অভিমানী অভিযোগ ঢেলে চুপ করে রইলো। নোভা আড়চোখে আদনানকে আরও একবার দেখলো। মনে মনে বিড়বিড় করলো,

“ড্রামাবাজ!”

হয়তো আদনানের এই রূপটা তার কাছে অভিনয়ই মনে হচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না, আবার পুরোটা অবিশ্বাসও করা যাচ্ছে না। এত বছর আগের ছবির সাথে এই জারার কোনো লিংক থাকতে পারে তা তো কস্মিনকালেও ভাবেনি সে। ওসব তো অনেক পুরনো ঘটনা। স্মৃতি থেকে মুছে গেছে সেই কবে! এখন নোভার মনে পড়ছে, সেদিন রাগের মাথায় যাকে ধা’ক্কা মে’রে শপিংমল থেকে ছুটে এসেছিল সেই ছেলেটা আদনানের বন্ধু সাফফাতই। হ্যাঁ! এই চেহারাই! মনে প্রশ্ন জাগলো তার, ওই ঘটনার পর থেকেই কি আদনান তাকে চিনে? কই, কখনও তো তাদের দেখা হয়নি! প্রথম দেখা রেস্টুরেন্টেই! ওখানেই প্রথম আলাপ!

“কে বলেছে পরী শুধু জারাকে ভালোবাসে? পরী দু’জনকেই ভালোবাসে! তোমরা দু’জনই আমার আত্মার চেয়েও আত্মীয়! আমার দিনের খুশি আর রাতে সুখের ঘুম। এখন তো তোমাদের তৈরী হতে হবে। নানু বাড়ির সবাই অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য। যাবে না?”

খুশিতে ঘাড় নাড়লো নোরা। ঝটপট কোল ছেড়ে নামলো। জারাকেও টেনে আনলো আদনানের কাছ থেকে। নানু বাড়ি যাব, নানু বাড়ি যাব, এইবলে পুরো ঘরময় ছুটোছুটি শুরু করলো। সেই ফাঁকে নোভাও উঠে দাঁড়ালো। আলমারি খুলে দু’জনের জন্য প্রয়োজনীয় জামাকাপড় বের করলো। সেগুলো লাগেজে ভরতে গিয়েই বাঁধা পেল হাতে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়। আদনানের উপস্থিতি তার নিঃশ্বাসেরও আরও কাছে। গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ তাকে আড়ষ্ট করে দিল। পুরো মুখ জুড়ে শুধু একটা মানুষের বিচরণ চলছে। তার অধরের মৃদু স্পর্শে চোখ ফেটে কান্না আসছে নোভার। মানুষটা তাকে বুঝে না, একটুও না। শুধু কাঁদায়! হতে পারতো এই স্পর্শ কোনো সুখময় মুহূর্তের সাক্ষী, কিন্তু হয়ে গেল বিরহিণীর নীরব আর্তনাদের সাক্ষী! অনেকক্ষণ চুপ থেকে মুখ খুললো আদনান। বলল,

“সঠিক মানুষ বাছাই করা অনেক কষ্টের নোভা! বহুদিনের সাধনায়ও হয়তো একটা সঠিক মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। যেদিন শপিংমলে তোমায় প্রথম দেখেছি, সেদিনই মনে হয়েছে; এমন কেউ জীবনে আসুক। যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। সঁপে দেয়া যায় নিজের পুরো অস্তিত্বকে! ভালোবাসা যায়। গোটা জীবনটার দায়িত্ব যার উপর চাপিয়ে দেয়া যায়! সে কেবল একজন হোক, এমন হোক, বিশ্বস্ত আর আপন।”

“আপনি আজও রূহানীকে ভালোবাসেন তাই না? অপেক্ষায় আছেন তার ফিরে আসার? যদি ফিরে আসে কোনোদিন, আমার প্রয়োজন তো তখন ফুরিয়ে যাবে! কারণ আপনি শুধু আমাকে বাচ্চাদেরকে আগলে রাখার দায়িত্ব দিয়েছেন। তাদেরকে ভালোবাসার দায়িত্বও দিয়েছেন অথচ বাচ্চাদের বাবাকে ভালোবাসার অধিকার দেননি!”

“ভুল ভাবছো তুমি! আমি মোটেও রূহানীর ফিরে আসার অপেক্ষা করছি না। একটু বিশ্বাস করো আমায়!”

“পারছি না তো! বিশ্বস্ত মানুষটা যখন বিশ্বাস ভেঙে দেয় তখন গোটা পৃথিবীর সবাইকেই আমরা বিশ্বা’সঘা’তক মনে করি! সরুন। বাচ্চারা চলে আসবে।”

“দূরে ঠেলে দিচ্ছো?”

“হু!”

“এইটুকু ভুলে এত কঠিন শা’স্তি দিতে পারবে?”

“আপনার কাছে ভুলটা সামান্য মনে হলেও, আমার কাছে অনেক। জীবনে অনেক কথা শুনেছি, অনেক হজম করেছি, আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার পর টের পেলাম, একটা মানুষ অন্তত আছে, যে আমাকে বুঝে! অথচ এখন সবকিছুকে শুধু ছলনাই মনে হচ্ছে। আপনার কাছে আসাটাও অসহ্য লাগছে আমার।”

থমকে গেল আদনানের দৃষ্টি! নোভার পুরো কথা বুঝার চেষ্টা করলো। যখন বুঝতে পারলো চট করে দূরে সরে গেল। ছোট্ট শব্দে ‘সরি’ উচ্চারণ করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। আর কীভাবে চেষ্টা করলে মনের ক্ষতটা সেরে যাবে পুরো? যতটা আঘাত করেছে, তারচেয়ে বেশি ভালোবাসলে তো আঘাত মুছে যাওয়ার কথা! তবুও কেন হচ্ছে না? অভিমানী মেয়েটা আরও দ্বিগুণ অভিমান জমিয়ে ফেলেছে। ভুল ভাবছে, ভুল করছেও। অযথাই রূহানীকে মাঝখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। বিশ্বাস তো করছেই না, উলটে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে! কোনোমতেই তো অভিমানিনীকে বুঝানো যাচ্ছে না! কীভাবে এই মান-অভিমানের দেয়াল ভাঙবে সে? কীভাবে বুঝাবে, মনের ভেতর কার বসতী গড়ে উঠেছে? সেখানে শুধু একটাই নাম ক্রমান্বয়ে ঝ’ড় তুলছে। তীব্রস্বরে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলছে, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি!’

*****

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here