সম্পূর্ণা-১৪,১৫
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
১৪
“তোমার রুমের জানালাটা ভেঙে গেছে আপু, তাই তুমি চাইলেও এই মুহূর্তে রুমে ঢুকতে পারছো না!”
বাড়ি এসেছে আধঘণ্টা হয়েছে। এতক্ষণ সবাই ড্রয়িংরুমে বসেই আড্ডা দিয়েছে। সবার সঙ্গে একদফা জড়াজড়ি শেষে মাত্রই নিজের রুমের দিকে এগিয়ে এসেছিল নোভা। হাস্যজ্বল চেহারায় তার গলা জড়িয়ে তাকে দরজার মুখেই আটকে ফেললো মুনতাহা। শুধু আটকালোই না, দরজায় লাগোয়া তালা দেখিয়ে বলল,
“জানালা যেহেতু ভাঙা, চো’র-ডা’কাত আসার চান্স খুব বেশি। তাই দরজায় তালা দিয়ে রেখেছি। তুমি আসো। বাচ্চাদের নিয়ে আমার রুমেই বিশ্রাম নাও।”
আশ্চর্য হলো নোভা। সন্দিহান চোখে তাকালো। গাড়িতে ওঠার আগেও বাড়ির সবার সাথে অল্পস্বল্প কথা হয়েছিল, তখনও কেউ বলেনি জানালা ভাঙা। এখন অতিদ্রুত মুনতাহার এই কথাটা সত্য হিসেবে ধরতে পারছে না। কারণ একটাই, মুনতাহার ঠোঁটের হাসি। এই হাসিতেই কিছু একটা গড়বড় টের পাচ্ছে নোভা। চোখমুখ কুঁচকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে। মেজাজ ধরে রেখে বলল,
“ফাজলামি করিস না। ঢুকতে দে ভেতরে। ফ্রেশ হতে হবে।”
“আহা! অযথা সময় নষ্ট করছো তুমি। আসো তো আমার রুমে। জানালাটা ঠিক হোক, তখন রুমে এসো!”
“মুন, তোর ভাইয়া ফ্রেশ হবে তো। তোর রুমে কেমন দেখাবে বিষয়টা।”
“যেমনই দেখাক। তুমি এখন রুমে ঢুকবে না। বলা যায় না, কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে। ভাইয়াকে নিয়ে ভেবো না। বাড়িতে আরও ওয়াশরুম আছে।”
ঠোঁট চেপে হাসলো মুনতাহা। জোরজবরদস্তি করে নোভাকে প্রায় ধরে বেঁধেই নিজের রুমে নিয়ে আসলো। বাচ্চাদুটোকে আদর করে বলল,
“এ্যাই ময়না, টিয়া! মাম্মাকে একদম বিরক্ত করবে না। আগামী দুটো দিন, তোমাদের সমস্ত আবদার পূরণ করার জন্য খালামনি যথেষ্ট।”
ওরা কী বুঝলো কে জানে! মুনতাহার কথাতে সায় জানিয়ে ঘাড় নাড়লো দু’জনে। ওদেরকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো ফের। নোভাকে বলে আসলো,
“ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নাও। আন্টি বললেন সকাল থেকে তোমার নাকি মাথাব্যথা! বাচ্চাদের আমি সামলে নেব।”
মুনতাহার এই চালাকি নোভা কোনোভাবেই ধরতে পারলো না। চিন্তিত চেহারাতেই পরনের শাড়িটা পাল্টাতে ওয়াশরুমে ঢুকলো। এসব শাড়িতে সে মোটেও অভ্যস্ত না। কুর্তি, টপ কিংবা গোলজামা গুলোই বেশি ব্যবহার করে। ডিজাইনার টপ, প্লাজো এসবেই তাকে মানায়। শাড়িতে কেমন বেখাপ্পা লাগে।
ড্রয়িংরুমে এসে ঘর কাঁপিয়ে হাসলো মুনতাহা। নায়লা রান্নাঘর থেকে সেই শব্দ শুনে তাকে শা’সালো। বাচ্চাদের নিয়ে আদনানের পাশে গিয়ে বসলো। ওড়নায় মাথায় আটকে রাখা চাবিটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“সময় খুব কম। যা করার খুব তাড়াতাড়ি করবেন। কখন যে হাওয়ার বেগে রুমে ঢুকতে গিয়ে তালা ভেঙে ফেলে ঠিক নেই। নিজের রুম ছাড়া আমার রুমে খুব একটা সাচ্ছন্দ্যবোধ করে না আপু।”
“ওকে! আমি শুধু রুম চেক করে বাইরে যাব। ঠিক দু’ঘণ্টায় সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। ততক্ষণ সামলে রাখতে পারলেই হলো!”
ধীরপায়েই সোফা ছেড়ে উঠলো আদনান। খুব সাবধানে পা ফেলে নোভার রুমের দিকে এগোলো। চোখ ঘুরিয়ে মুনতাহার রুমেও উঁকি দিল। রুমে কাউকে দেখা গেল না। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আস্তেধীরে লক খুলে পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল। এদিক-সেদিকের সেটিংটা ভালো মতো দেখে আইডিয়া করলো, ঠিক কী কী লাগবে! সবকিছুর একটা হিসাব মিলিয়ে দ্রুত বাইরে ছুটলো। যাওয়ার আগে পিছন ফিরে মুনতাহাকে বলল,
“কী খেতে পছন্দ করে? অপছন্দের কিছু নিয়ে আসলে শেষে ঘাড় ম’টকে ফেলবে! যা জেদী তোমার বোন!”
মুনতাহা শুধু হাসলো। নোভার রাগ সম্পর্কে যথেষ্ট আইডিয়া আছে তার। বোনকে সে ভালোমতো চিনে আর বুঝেও। কখন, কীভাবে রাগ ভাঙাতে হবে সেটাও জানা আছে। আদনানের তাড়াহুড়ো দেখে ঝটপট বলল,
“আপুর তো চকলেট কেক, স্ট্রবেরি ফ্লেভারের আইসক্রিম আর কাচ্চি বিরিয়ানি খুব বেশি পছন্দ! আপাতত একটা হলেই চলবে।”
খানিক পরই লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে বেরুলো আদনান। গাড়ি স্টার্ট করার আওয়াজ শোনা গেল। ততক্ষণে বাচ্চাদের নিয়ে হাসি-আনন্দে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মুনতাহা।
*****
ফ্রেশ হয়ে মামা-মামির সাথে জমিয়ে গল্প করছে নোভা। এখানে আসার আগ পর্যন্ত মনটা ভীষণরকম অস্থির আর অশান্ত ছিল। অথচ এখন সবকিছু স্বাভাবিক। ভেতরের অস্থিরতাও নেই, কষ্টটাও খুব কম। কাছের মানুষের অস্তিত্ব মনে খুব দ্রুতই প্রভাব ফেলেছে, যার কারণে গতকাল রাত থেকে পাওয়া আঘাতটুকু একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ গল্প করার পরও আদনানকে কোথাও দেখলো না নোভা। তার এই উঁকিঝুঁকি দেখে মুনতাহা দাঁতপাটি বের করে হাসলো। যেন এমনটাই হবে, এটা সে আগেই ধরতে পেরেছিল। তার এমন হাবভাব দেখে আবারও সন্দেহ দানা বাঁধলো নোভার মনে। কিছু বলার আগেই মুনতাহা বলল,
“বাচ্চারা বায়না ধরেছে আইসক্রিম খাবে! তাই অসময়ে ভাইয়াকে দৌড় দিতে হয়েছে! চলে আসবে। চিন্তা করো না!”
‘চিন্তা করো না’ এইটুকু শুনে ধাক্কা খেল নোভা। আসলেই কি সে চিন্তা করছিল আদনান কোথায়? হবে হয়তো। নয়তো তৃষ্ণার্ত চোখ কেন আশেপাশে মানুষটার উপস্থিতির অপেক্ষা করছে! কোথাও তার নড়চড় নেই দেখে নিশ্চিত হলো, মানুষটা বাইরেই আছে! কেন সময়ে, অসময়ে বাচ্চাদুটো তাকে এত জ্বালায়, বুঝে আসে না। অবশ্য ওদেরই বা দোষ কোথায়! ছোটো মানুষ। শত বায়না হোক, শত চাওয়া হোক, এই বয়সই তো সবকিছুকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরার সময়। ঠিক সেই মুহূর্তে নোরা গাল ফুলিয়ে বলল,
“খালামনি, আমরা কখন আইসক্রিম…!”
বাকিটা আর বলতে পারলো না, তার আগেই মুখে হাত দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিল মুনতাহা। নোভা হয়তো সে কথা শুনেইনি। আর দু’চোখে তখন একটা মানুষের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে! অভিমান জমেছে! কেন সে হুট করে বাইরে চলে গেল? যাওয়ার আগে একবার বলে যেতে পারতো না? কীসব বাচ্চামো অভিযোগ এসব! নিজেও আজ নিজেকে বুঝতে পারছে না সে।
রাত আটটার ভেতরে বাচ্চাদের খাইয়ে নিজের রুমে নিয়ে গেল মুনতাহা। নোভা তখনও নায়লার সাথে কাজে হাত লাগাচ্ছে। বার বার ঘড়ির দিকে দৃষ্টি ফেলছে, কখনও ফোন চেক করছে আবার কখনও দরজার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। এতটা সময় পরও আদনানের ফেরার নামগন্ধ পেল না নোভা। ঠিক কী কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বাইরে আছে, সেটাও তো জানা হলো না। অভিমানে নিজেও যেচে কল করলো না। সে থাকুক তার মতো, নোভার এত মাথাব্যথা বাড়িয়ে লাভ কী! লোকটা খা’রাপ, খুব খা’রাপ। বিড়বিড় করে অসময়ে চায়ের কাপ নিয়ে মুনতাহার রুমের দিকেই এগোলো নোভা। কী ভেবে যেন নিজের রুমের কাছাকাছি এসে হাঁটা থামিয়ে দিল। দরজার কাছাকাছি এসে দেখলো, বাইরের লকটা আর নেই বরং দরজা ভেতর থেকে আটকানো। অবাক হলো নোভা। রাগ হলো। তার অনুমতি ছাড়া কে তার রুমে ঢুকলো! ভেবেই পেল না। গলা উঁচিয়ে মুনতাহাকে ডাকলো,
“মুন, দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো! কাকে ভেতরে ঢুকিয়েছিস তুই? কার এত বড়ো স্পর্ধা, আমার অনুমতি ছাড়াই রুমে ঢুকে পড়েছে!”
মুনতাহা ছুটে আসার আগেই তার মামী ছুটে আসলেন। ভদ্রমহিলাকে দেখে নোভার আহ্লাদীপনা বেড়ে গেল। গাল দু’খানা ফুলিয়ে বলল,
“দেখেছো মামি! রুমের জানালা ভাঙা বলে আমার রুমে কাকে যেন ঢুকিয়ে রেখেছে তোমার মেয়ে!”
“থাক মা! ওতো রাগিস না। ভেঙেই যখন গেছে তখন এটা না সারা অবধি তুই মুনের রুমটাই ব্যবহার কর!”
“আশ্চর্য মামী! ঠিক হলে হলো, না হলে নাই। রুমে কে সেটা আমাকে দেখতে দাও!”
অনবরত দরজায় ধা’ক্কা মারছে নোভা। তার ধারণা ভেতরে কেউ না কেউ নিশ্চিত আছে। কিন্তু কে আছে? নোভার এমন অগ্নিমূর্তির ন্যায় চেহারা দেখে ঝটপট ছুটে আসলো মুনতাহা। হাত ধরে টেনে প্রায় নিজের রুমে নিয়ে ঢুকালো। দরজা আটকে তাকে বিছানায় বসালো। হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“মিস্ত্রি এসেছে। জানালা ঠিক করছে। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো! তারপরই রুমে ঢুকতে পারবে। এখন চা খেয়ে মাথা ফ্রেশ করো!”
“মিস্ত্রি আসলে দরজা বন্ধ করে কাজ করে নাকি! কেমন লোক এরা?”
“এরা এমনই। লাজুক।”
ভীষম খাওয়ার জোগাড় হলো নোভার। ভেবে পেল না মুনতাহা তাকে উল্টাপাল্টা কী বুঝাচ্ছে এসব! বিরক্তি নিয়ে চা’য়ে চুমুক দিল সে। কড়া লিকারের চা’টাও তখন বিস্বাদ ঠেকলো। ‘ধ্যাৎ’ বলে চায়ের কাপ সরিয়ে ফোন হাতে নিল। মনে মনে বিড়বিড় করলো,
“কোথায় আপনি? কেন এত দেরী করছেন? একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন না, প্লিজ!”
ফোন দিতে গিয়েও সাহসে কুলালো না। রাত, দিন মিলিয়ে নিজের এই অহেতুক ছেলেমানুষীর চাপে পড়ে নিজেই নিজের উপর চরম বিরক্ত সে। কোথাও মানুষটা তাকে ভুল বুঝে দূরে সরে গেল না তো? নিজের এই ভাবনায় নিজেই চমকালো নোভা। অসহ্য লাগছে সবকিছু তার। ক্ষণে ক্ষণে মনের অশান্তি বাড়ছে। সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। কেন এমন হচ্ছে?
*****
অভিমান, অভিযোগ সবকিছু ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। ভেতরটা অজানা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে তার। বাবার ফিরে আসার অপেক্ষা করতে করতে বাচ্চারাও ঘুমিয়ে পড়েছে। বড্ড কঠিন সময় পার করছে নোভা। বাড়ির কেউ জিজ্ঞেসও করছে না আদনান কোথায়? তবে কি সবাইকে বলেই বেরিয়েছে? ফিরতে এত দেরী কেন হচ্ছে? প্রশ্নেরা ভিড় জমিয়েছে মনে। বুক কাঁপছে, অন্তর ছটফট করছে। মানুষটাকে একটুখানি চোখের দেখা দেখবার জন্য দু’চোখে অশ্রুরাও জড়ো হয়েছে। নোভার এই অস্থিরতা বেশ উপভোগ করছে মুনতাহা। মুখ টিপে হাসছে। বিড়বিড় করছে,
“বুঝো ঠ্যালা! শুধু শুধু আমার ভাইটার উপর রাগ-অভিমান দেখানো।”
উপায় খুঁজলো মুনতাহা। নোভাকে হাসানো উচিত। কী করবে, কী বলবে এইভেবে গলা পরিষ্কার করে গুনগুন করে গান ধরলো।
তোর মন পাড়ায়, থাকতে দে আমায়!
আমি চুপটি করে দেখবো,
আর ডাকবো ইশারায়!
তুই চাইলে বল, আমার সঙ্গে চল!
ঐ উদাসপুরের বৃষ্টিতে,
আজ ভিজবো দু’জনায়!
অভিমানী মন আমার,
চায় তোকে বারেবার।
অভিমানী মন আমার,
চায় তোকে বারেবার।
তাই বলি আয় রে ছুটে আয়!
গান থামালো। আড়চোখে নোভাকেও দেখলো। তার চোখদুটো বন্ধ। গাল গড়িয়ে পড়া পানিটুকুও নজর এড়ালো না মুনতাহার। দু’পা এগিয়ে বোনের কাছাকাছি আসলো। আঙুলের আলতো স্পর্শে চোখের পানি মুছে দিল। এক মুহূর্তের জন্য চমকে গেল নোভা। তড়িৎ চোখ মেললো। বোনকে দেখে মলিন হাসি ফুটালো ঠোঁটে। বলল,
“কিছু বলবি?”
“তুমি নিজেও হয়তো জানো না, ভাইয়াকে তুমি ঠিক কতটুকু ভালোবাসো! দু’জনের চেনা-জানা এত অল্প সময়ের, অথচ অনুভূতি কতটা প্রখর! অযথাই ভুল বুঝছো তাকে। জারা আর নোরার ব্যাপারটা অনেক আগেই ভাইয়া সবাইকে জানিয়েছে।”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো নোভা। কপালে দু’তিনটা ভাঁজ পড়লো। মনের ভেতর সন্দেহ গেঁথে রেখেই বলল,
“মানে? তোমরা সবাই জানতে? মামা-মামি?”
মুনতাহা ছোট্ট শব্দে ‘হুম’ বলে মাথা নাড়লো। নোভা বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকালো। বোনের মাথাটা নিজের কোলে আনলো সে। চুলে বিলি কে’টে নিচুস্বরে বলল,
“ওদের জন্মের পরই ভাইয়া বাচ্চাদের নিয়ে মারাত্মক ঝামেলা ফেইস করেছে। নিজের কাছে রাখলেও ঝামেলা, দূরে রাখলেও ঝামেলা! ফারদিন চৌধুরীর নজর এড়াতেই বাধ্য হয়ে বাচ্চাদের এতিমখানাতে রাখে। যদি নিজের কাছে রাখতো, ওই লোকটা বাচ্চাদের কে’ড়ে নিত। হয়তো মে’রেও ফেলতো। এতিমখানাতে থাকার পরও ভাইয়া ওদের সাথে এতটাই জড়িয়ে যায় যে, লোকে জারা, নোরাকে তার সন্তান হিসেবেই ভেবে নিয়েছে। সব জায়গায় অভিভাবকের আসনে ভাইয়ারই সাইন আছে। আংকেল যখন ভাইয়াকে বিয়ের জন্য চাপ দেন, তখন ওদের কারণেই যেকোনো মেয়ের পরিবার বিয়েটা ভেঙে দিত! পরের বাচ্চাকে কেউ লালন-পালন করতে চায় না। নিজের ভবিষ্যৎ সাজাতে ওদেরকে দূরে ছুঁড়ে ফেলতে পারবে না দেখেই বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়নি। তোমাকে দেখেও ভেবেছিল, তুমিও এমনটাই করবে! পরের বাচ্চা বলে ওদেরকে আগলে নিবে না। দূরে ঠেলবে। এই কারণেই রেস্টুরেন্টে আমাদেরকে মিথ্যে বলেছে। শুধু এইটুকু বুঝতে চেয়েছে, একজন মানুষ হিসেবে, মা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে তুমি কতটুকু পারফেক্ট!”
নোভা কোনো জবাব খুঁজে পেল না। যদি পিছনের কারণ এটাই হয়ে থাকে, তবে তো এখানে আদনানের কোনো দোষই নেই৷ তার আচরণ, দায়িত্ব কর্তব্য এমনকি ভালোবাসার হিসাবটাও বুঝে গেছে সে। না বুঝে নিজেই বোকামি করলো না তো? অবাক চোখে তাকিয়ে মুনতাহার সব কথা শুনলো। ভেতরে জমে থাকা পাথরটা সরে গেল, তবে মনের মনিকোঠায় জন্ম নিল একরাশ অপরাধবোধ। বোনের নীরবতা দেখে মুনতাহা আবারও বলল,
“আপু, জীবনসঙ্গী সবসময় মনমতো হয় না। সব মানুষেরই কোথাও না কোথাও একটা ত্রুটি ঠিকই আছে। এইযে, ভাইয়ার সবকিছুই পারফেক্ট, অথচ পরের বাচ্চাকে আগলে রেখেছে দেখে নিজের ভবিষ্যতটাও এখন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। চাইলেও সে তোমাকে বুঝাতে পারছে না, তার ভেতরেও কষ্ট আছে। আমি ছোটো মানুষ, এতোকিছু বুঝি না৷ শুধু এইটুকু বুঝি যে, মান-অভিমান সম্পর্কে ভাঙন ডেকে আনে। যাকে তুমি পেয়েছো, হয়তো বুঝেছো সে কেমন! কারণ এ পর্যন্ত তার আচরণে আমি কোনো দোষ খুঁজে পাইনি। যা করেছে, বাধ্য হয়েই করেছে। ক্ষমা করে দাও না তাকে।”
বয়সে ছোটো হলেও দুই বোন একে-অন্যকে যতখানি বুঝে তা আর কেউ হয়তো বুঝে না! মুনতাহার এই কথাগুলো শুনে নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো নোভা। দূরত্বটা যে অহেতুকই ছেলেমানুষির ফল, মন সেটাও বুঝে নিল। দু’হাতে চোখের পানি মুছে সোজা হয়ে বসলো। ফোন হাতে নিয়ে কল করতে গেলেই মুনতাহা বাঁধা দিল। বলল,
“রুমে যাও। ভাইয়া অপেক্ষা করছে।”
অবাক হওয়ার মাত্রা দ্বিগুণ বিস্তৃত হলো নোভার। বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তা দেখে মুনতাহা মুচকি হাসলো। বলল,
“চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি! বাচ্চারা আজ আমার কাছেই থাকুক।”
*****
চলবে…
সম্পূর্ণা | ১৫
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
দুরুদুরু বুকে বোনের হাত ধরে নিজের রুমের কাছাকাছি আসলো নোভা। ভয়ে, লজ্জায়, এখনও তার সমস্ত শরীর কাঁপছে! গত দু’দিন যেমনই হোক, আদনানের মুখোমুখি হতে খুব একটা দ্বিধা কিংবা জড়তাও কাজ করেনি। কথা বলা, পাশে বসা, একসাথে খাওয়া সবকিছুই খুব সহজ ছিল। মাত্র কয়েকটা ঘণ্টার ব্যবধানে সেটা এখন অস্বস্তিতে রূপ নিয়েছে। কখনও বুঝেনি, এমন দ্বিধান্বিত মনোভাব নিয়ে, সমস্ত অভিমানের পাহাড় ডিঙিয়ে তার কাছে ছুটে যেতে এত লজ্জা আসবে! নিজের উপর যেমন রাগ হচ্ছে, তেমনি আদনানের উপরও রাগ হচ্ছে। সহজ কথা সহজে বলে দিলেই হতো, তাহলে তো সম্পর্কে এত ঝামেলা, এত দোটানা আর মান-অভিমান আসতো না। মনে মনে তার চৌদ্দপুরুষকে ইচ্ছামতো অভিশা’প দিল। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই দরজার কাছাকাছি আসলো। মুনতাহা আলতো করে ছুঁতেই সেটা খুলে গেল! অবাক হলো নোভা! ঘণ্টাখানেক আগেও সে ধা’ক্কা দিয়ে খুলতে পারেনি দরজা, সেটা এখন কোনোপ্রকার জোরজবরদস্তি ছাড়াই খুলে গেল। চোখ পাকিয়ে বোনের দিকে তাকালো সে। বলল,
“তোর মিস্ত্রি ভাঙা জানালা সারিয়েছে?”
“নিজেই গিয়ে দেখো!”
নোভার হাত ধরেই তাকে নিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকলো মুনতাহা। ভেতরটা অন্ধকার! খানিকটা বিরক্ত হলো নোভা। কোন জানালা ভাঙা সেটা তখনও তার কাছে অস্পষ্ট! অন্ধকার ঘরে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বেলে সুইচবোর্ড খুঁজতে গেলেই হাতে বাঁধা পেল সে। মুনতাহা সলজ্জ হেসে বলল,
“ভাইয়া আপনার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে রেখে গেলাম। রাত তো! একটু সাবধানে রাখবেন। চো’র-ডা’কাত আসলে রক্ষে নেই।”
অন্যপাশের দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের বিশালতায় ডুব দিয়েছিল আদনান। মুনতাহার ম্যাসেজ পেয়েই দরজা খুলে আলতো করে আটকে রেখেছিল, যেন দু’জনার ভেতরে আসতে অসুবিধা না হয়! হুটহাট এমন রসিকতায় অন্ধকারেই গা কাঁপিয়ে হাসলো সে। তবে হাসির শব্দটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে দিল না। নোভা তখনও সেভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই বোনের উল্টোপাল্টা বকবক শুনছে। টর্চের আলোতে দু’জনের অবস্থানই যথেষ্ট পরিষ্কার। আদনান ভেতরে প্রবেশ করে বলল,
“জানালা সারিয়ে নিয়েছি! আমার পারিশ্রমিক ঠিকঠাক পেলে তোমার বোনকে সারারাত কেন, সারাজীবন পাহারা দিয়ে আগলে রাখতে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না!”
“ক্যায়া বাত! সিনেমার হিরোকেও হার মানিয়ে দিবেন দেখছি। বাই দ্য ওয়ে, আপনাকে কিন্তু হিরো লুকে হ্যাব্বি লাগবে!”
রসিকতার ছলে বললো মুনতাহা। আদনান ফের জবাব দিল,
“জীবন তো সিনেমা নয়, তবে সিনেমা জীবনের অংশ! জীবন থেকে উপলব্ধি করেই সিনেমার ডায়লগ, নামকরণ, দৃশ্য উপস্থাপন হয়! রিয়্যাল লাইফে হিরো হতে না পারলে, সিনেমার হিরো হয়ে সুখ নেই শালিকা!”
প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে অর্ধাঙ্গিনীর দিকে দৃষ্টি রেখেই জবাব দিল আদনান। নোভা চোখ নিচের দিকে নামিয়ে রেখেছে। দু’জনার মাঝখানে সে কোনোপ্রকার আওয়াজ করছে না। চুপচাপ শুনছে। যেন তাকে শোনার জন্যই এখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আদনানের কথায় কী মিশে ছিল কে জানে! নির্ভার প্রাণোচ্ছল হাসি ফুটালো মুনতাহা। বলল,
“জীবন হোক কিংবা সিনেমা, সঙ্গিনীর জন্য হিরো হতে দোষ নেই! কী বলেন?
নিঃশব্দে দ্বিতীয় বারের মতো হাসলো আদনান। উপরনিচ মাথা নাড়লো। মুনতাহা কথা ঘুরাতে মুখে হাত রেখে হাই তুললো। বলল,
“অনেক রাত হয়েছে। রাত জাগার অভ্যাস খুব কম। আমি বরং রুমে যাই। ওরা ভয় পাবে। গুড নাইট আপু!”
আলগোছে নোভাকে জড়িয়ে ধরলো। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“হ্যাভ আ নাইস মোমেন্ট!”
বিকেল থেকেই মুনতাহার কথাবার্তাতে সন্দেহ দানা বাঁধছে মনে। একটার পর একটা রহস্যময় কথা তো বলছেই, কাজও করছে সেরকম! উত্তরে কোনো জবাব দিল না প্রথমে। ইচ্ছে হলো এই মুহূর্তে একগাদা কথা শুনাক, করলোও তাই। মেয়েটা শুধু পাকা পাকা কথাই বলছে না, দাঁত কেলিয়ে হাসছে! অতি সাবধানে মুনতাহার হাতে চাপ দিল নোভা। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“তুই বড্ড বেড়েছিস! মামিকে বলবো, তোর জন্য বর দেখা শুরু করতে। আপদ বিদায় হোক। নয়তো দেখা গেল, কোনো একদিন তোর রুমের জানালাটাও ভেঙে গেল, আচমকা এক চো’র এসে তোকে নিয়ে পা’লিয়ে গেল! তখন আমরা সাধারণ জনগণ, হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদবো আর হা-হুতাশ করবো!”
হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালালো মুনতাহা। কথার কোনো জবাবই সে দিল না। এতক্ষণ কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও এখন তার কাঁপুনি শুরু হলো। নিজের জায়গা থেকে এক’পা-ও সরতে পারলো না। থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইলো। নিজেকে আড়াল করতে ঝটপট ফোনের ফ্ল্যাশ বন্ধ করে ফেললো। আপাতত অন্ধকারেই সুখ, আলোর প্রয়োজন নেই। যতসব লুকোচুরি, ভয়-ডর সব এভাবেই দূর করতে হবে, নয়তো লজ্জায় মুখ দিয়ে কথাও বের হবে না আজ!
*****
বিড়বিড় করে দোয়াদরুদ জপছে নোভা! ক্রমান্বয়ে ঠোঁটদুটো কাঁপছে। হাত-পা ততক্ষণে ধৈর্য্যশক্তি হারিয়ে ফেলছে। ঠিক প্রথম দিনের মতোই নিজেকে চরম নার্ভাস অবস্থায় আবিষ্কার করলো সে। হুট করেই দরজায় শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো তার। মনে মনে অস্থির মনকে স্বান্তনার বাণী শুনালো,
“খোদা! এ যাত্রায় রক্ষা করো। আর জীবনেও এই লোকটাকে ভুল বুঝবো না!”
তখনও জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারছে না নোভা। আদনানেরও আওয়াজ পেল না। চোখ পিটপিট করে তাকাতে গিয়েই চমকে গেল! ম্যাচের কাটি ছুঁইয়ে মোমবাতিতে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে আদনান। ছোট্ট একটা চকলেট কেকের মাঝখানেই মোমবাতিটা জ্বলছে! তার চারপাশে জ্বলজ্বল করছে উপরের লেখাগুলো। ঠোঁট নাড়িয়ে সেইসব শব্দ আওড়ে গেল নোভা। তাতে লেখা, ‘সরি মাই ডিয়ার!’ একপাশে ছোট্ট দুটো কার্টুন! একটা ছেলে আর একটা মেয়ে! তাদের দু’জনার হাতে ছোট্ট একটা লাভ বসিয়ে রাখা। স্থির চোখে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। আদনানও তাকালো। দৃষ্টি বিনিময়ের সেই সময়ে কাঙ্ক্ষিত পুরুষের গভীর চোখের চাহনি দেখে ভরকে গেল নোভা। সমস্ত ভয়-ডরকে পিছনে ফেলে দু’পা এগিয়ে আসলো। মাত্র কয়েকটা ঘণ্টার অদেখাতে দু’চোখে তার রাজ্যের তৃষ্ণা জমেছে। মন স্থির না হওয়া পর্যন্ত চোখের এই লেনদেন অব্যাহত থাকলো। চোখ সরিয়ে কেকের পাশে থাকা ছোট্ট চিরকুটটায় নজর দিল। মোমবাতির আলোতেই সেটা স্পষ্ট চোখে ভাসলো। ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করলো,
‘বুকের ভেতর আস্তো একটা শহর,
সেই শহরে তোমার আনাগোনা!
সেথায়, তপ্ত দুপুর কিংবা সন্ধ্যে-রাতে,
রাগ-অভিমান জমিয়ে রাখতে মানা!’
দু’চোখ বন্ধ করে গভীর করে শ্বাস টানলো নোভা। অর্ধাঙ্গিনীকে খুশি করতে, তাকে ভালোবাসি বুঝাতে, তার রাগ-অভিমান মুছে দিতে এইটুকুই যথেষ্ট ছিল। নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। গতকাল রাতের আচরণে বিকেল থেকে অপরাধবোধে গা ঘিনঘিন করছে নোভার। কতটা বাজে আচরণ করেছিল সে। কষ্ট দূর করতে ক্ষমাও চেয়েছে, কাছে টানতে চেয়েছে, জড়িয়ে ধরে সমস্ত ব্যথাবেদনা শুষে নিতে চেয়েছে, অথচ সেখানে সে রাগ-অভিমানকে পুঁজি করে দূরত্বকে বেছে নিয়েছে! এখন বুঝতে পারছে, এই অহেতুক রাগ শুধু মানুষটাকে দূরে সরায়নি বরং সম্পর্ককে দুর্বল করে দিচ্ছে। অথচ স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক সবচেয়ে সুন্দর আর মজবুত সম্পর্কের একটা।
আরও কিছুটা সময় নীরব রইলো নোভা। কী বলে এগোনো উচিত ভেবে পেল না। এমন অস্বস্তিকর মুহূর্ত আগে কখনও আসেনি জীবনে! জীবনসঙ্গীকে পাশে দাঁড়িয়ে রেখেও চুপ করে থাকা, তার এই আয়োজনকে গ্রহণ করতে না পারার মাঝে কঠিন যন্ত্রণা আর কিছুতেই বুঝি নেই! গলায় কোনো জোরও আসছে না। আদনান নিজেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নোভার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করছে। হয়তো বুঝেছে, হয়তো না। অর্ধাঙ্গিনীর নীরবতা আর নীরব অশ্রু বিসর্জন বুকে কাঁপন তুললো তার। মনে হলো, একটাই উপায় আছে সব রাগ-অভিমানকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়ার। সেটাই প্রয়োগ করলো। পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। চমকে গেল নোভা। ভড়কালো। তখনই কানের কাছে হাওয়ার বেগে ছুটে চলা ঝুনঝুন শব্দ ভেসে আসলো।
“তখনকার মতো যদি মনে করো, এই মুহূর্তের কাছে আসাটাও অসহ্য লাগছে! তবে এরপর আর কোনোদিনও তোমার কাছে আসবো না। দূর থেকে তোমাকে দেখবো, আগলে রাখবো, ভালোবাসবো! প্রমিস জান। তুমি ডাকলেও আসবো না।”
বুকফাটা নীরব আর্তনাদে ভেসে গেল চিবুক। শব্দেরা সেই কবেই হারিয়ে গেছে। কোথাও তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যখন থেকে মানুষটা চোখের আড়াল হয়েছে, তখন থেকেই সমস্ত রাগ, অভিমান, অভিযোগ মুছে গেছে। মুনতাহার মুখে সব শুনে, এরপর থেকে নিজেকেই বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। ক্ষমা চাওয়া উচিত কার, আর ক্ষমা চাইছে কে! বুঝতে পারলো না নোভা। কী বলে বুঝাবে প্রিয়জনকে! না বলা কথা কি সে বুঝে নিতে পারে না? কেন সে মন পড়তে পারে না? কেন বুঝে না, নোভার সব অভিমান ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে! তার নীরবতা দেখে আদনান আবারও বলল,
“য়্যু টেইক য়্যুওর টাইম!”
আর কত চেষ্টায় অভিমানের পাহাড় গলিয়ে ভালোবাসার অনুভূতি বুঝাতে পারবে, বুঝতে পারলো না আদনান। তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ! এবার সত্যি সত্যি রাগ হলো! কেউ দূরে থাকতে চাইলে তাকে তো আর জোর করে কাছে টানা যায় না। সম্পর্ক যেমনই হোক, ভুল করেও তা এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা সে করবে না। এমনতর অভিমানকে সঙ্গী করে দূরে সরে আসতে চাইলো সে। এরপর আর ভুল করেও কাছে যাবে না। এতক্ষণে এটা পরিষ্কার যে নোভা তার ভুলটাকে ক্ষমার চোখে দেখেনি।
সামান্য সরতেই হাতে টান অনুভব করলো। আঙুলের ভাঁজে আটকা পড়লো আরও পাঁচটা আঙুল। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো তার। নোভা ততক্ষণে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে চোখ রেখে অভিমানী মেয়ে সমস্ত অভিমানকে আগলে নিয়ে বলল,
“নকল মিস্ত্রিদের শুধু ভাঙা জানালা নয়, ভাঙা মন সারানোর দায়িত্ব নিতে হবে! নয়তো অভিযোগ কমবে না। বরং একদিন অভিযোগগুলো বেড়ে গিয়ে তা আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে।”
“দায়িত্ব তখনই নিব, যখন তোমার মনটা তুমি আমার মনের কাছে গচ্ছিত রাখবে। এখন বলো কবে রাখবে?”
আরও কাছে এগোলো নোভা। দু’হাতে গলা পেঁচিয়ে ধরলো। কপালে কপাল ঠেকালো। কম্পিত অধরের প্রথম উষ্ণ স্পর্শ দিল বন্ধ কাঙ্ক্ষিত পুরুষের চোখের পাতায়। ফিসফিস করে বলল,
“মন তো সেই কবে থেকেই আপনার মনে আটকে আছে। শুধু মুখ ফুটে বলা হয়নি! বলা হয়নি, আপনি আমার প্রথম অনুভূতি, প্রথম সুখের ছোঁয়া!”
*****
“বাবা বলেছিলেন, তার বৌ’মাকে যেন কখনও কষ্ট না দেই! আমি তো খারাপ লোক, জেনে-বুঝে তাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। যতক্ষণ না তার কষ্ট দূর করে মুখে হাসি ফুটাতে না পারছি, ততক্ষণ স্বস্তি পাব না।”
কেক কাঁ’টার ছু’রিটা নোভার হাতে ধরিয়ে দিয়ে উল্লিখিত কথাগুলো বললো আদনান। বিছানায় সেটিং করে রাখা ছোটো ছোটো রঙিন বাতিগুলো রিমোটের সাহায্যে সুইচ টিপে জ্বালিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পুরো বিছানা ঝলমলে রঙিন আলোয় ভেসে গেল। চারিদিকে চোখ পড়লো নোভার। লাভ শেপের নানা রঙের বেলুন দিয়ে পুরো বিছানা ভরে রাখা। প্রতিটা বেলুনে উপরে লেখা ‘সরি’। সামান্য অভিমান ভাঙাতে এত আয়োজন দেখে অজান্তেই ঠোঁট প্রসারিত করে রৌদ্রজ্জ্বল ঝলমলে হাসি ফুটালো অভিমানিনী। ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,
“ভাবছি এখন থেকে দিন একবার আপনার উপর সমস্ত অভিযোগ ঢেলে, রাগ দেখিয়ে কথা বলা বন্ধ করে, গাল ফুলিয়ে বসে থাকবো। আপনিও অভিমান ভাঙাতে এতসব আয়োজন করবেন। তখন মনে হবে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী আমি!”
“জেনে-বুঝে কষ্ট দিয়েছি, তাই সুখ দিতে এই আয়োজন! রোজ রোজ তো একই কাহিনী আমি সাজাবো না। কারণ তুমি অভিযোগ ঢালো, এমন কোনো পথই আমি তোমার সামনে খুলে রাখবো না। অভিমান, অভিযোগের সব দরজায় মোটা সাইজের তালা ঝুলিয়ে রাখবো। নাও, এবার একটা কিছু মুখে দাও। রাতের খাবারটাও তো খাওয়া হয়নি!”
আহা! এমন ভুল হলো কী করে তার। বাড়িতে নতুন জামাই আসলে কতশত রান্নার আয়োজন চলে। খাবার টেবিলে বসিয়ে পাত ভরিয়ে ফেলে খাবার ঢেলে। অথচ সে এমন কিছুই করতে পারেনি। উলটে রাগের বশবর্তী হয়ে অকারণ অভিমানকে টেনে এনেছে। ঝটপট দরজা খুলে বাইরে যেতে চাইলো নোভা। উদ্দেশ্য খাবার নিয়ে আসা। মানুষটা আসার পর চা ছাড়া কিছুই খায়নি। ইশ, কীভাবে এই ভুলটা করতে পারলো সে! প্রচণ্ড রাগ হলো নিজের উপর। নিজেই নিজেকে শোধালো,
“একটু খেয়াল রাখলে কী হতো!”
বাধা পেয়ে আবারও নিজের জায়গায় ফিরে আসলো নোভা। ছোট্ট টেবিলটায় প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম দুটো প্লেট রাখলো আদনান৷ প্যাকেট ছিঁড়ে দ্রুত হাতে কাচ্চি বিরিয়ানি তাতে সাজিয়ে নিল। অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল সে। বলল,
“একসাথে এত শ’ক খেলে আমি হার্ট অ্যা’টা’ক করে বসবো আদি!”
“সে তোমার যা খুশি করো! স্ত্রীকে ভালোবেসে তার সমস্ত দায়িত্ব যখন নিজের কাঁধে নিয়েছি, তখন তার মান-অভিমান বুঝাটাও আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।”
ততক্ষণে মৃদু স্পর্শে নোভার হাত ধরলো আদনান। কেকের উপর ছু’রিটা বসিয়ে দিল। ছোট্ট করে একটা পিস তুলে ধরলো মুখের সামনে। নির্দ্বিধায় তাতে কামড় বসিয়ে দিল নোভা। অল্প খেয়ে বাকিটা আদনানের মুখে ঢুকিয়ে দিল। জীবন এত সুন্দর, এত সুখের এই মানুষটাকে না দেখলে উপলব্ধি হতো না নোভার। তাকে ভালোবেসে মন ভুল করেনি! সুখ সুখ অনুভূতিতে ভরে উঠলো তার মনের আঙিনা! আলগোছে সেই সুখকে আগলে নিল সে। নিঃশব্দে মাথা ঠেকালো বুকে! বিড়বিড় করে বলল,
“সময়ের সাথে তো অনেককিছুই পালটে যায়! যদি কখনও আপনিও পালটে যান? যদি কোনোদিন বুঝতে পারেন, সঙ্গিনী হিসেবে আমি আপনার অযোগ্য? তখন এতসব সুখের মুহূর্ত, আবেগ, অনুভূতি মিছে হয়ে যাবে না তো?”
অকারণ ভয় পাচ্ছে মেয়েটা। কাছে আসলেও ভয় তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। প্রতি মুহূর্তে এই ভয় তাকে কাবু করে ফেলছে। হাতের বাঁধনটা আরও মজবুত করলো আদনান। বুঝিয়ে দিল, এই বাঁধন কখনও ছিঁড়ে যাওয়ার নয়। আলতো স্পর্শে অধর ছুঁলো কপালে। অভয় দিয়ে বলল,
“তুমি বোধহয় সবকিছুকে জটিল করে ভাবো! স্বচ্ছ অনুভূতি কখনও মিছে হয় না বোকা। মিছে তখনই হবে, যখন নিজেকে তুমি কোনোভাবে অসুখী অবস্থায় আবিষ্কার করবে। তোমার কি মনে হয়, পারফেক্ট কাপল অর্থাৎ, বাহ্যিকভাবে কোনো মানুষ আকর্ষণীয় হলেই তার ভেতরটাও ঝকঝকা ফকফকা? তারা সবচেয়ে সুখী দম্পতি? যদি এমনটা ভাবো, তবে এটা তোমার ভুল ধারণা। একজন মানুষকে ততক্ষণ তুমি পারফেক্ট বলতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি তার অভ্যন্তরীণ আচরণে সৌন্দর্য খুঁজে পাচ্ছো! মুগ্ধ হচ্ছো। তার চারিত্রিক আচার-আচরণে পবিত্রতা খুঁজে পাচ্ছো। স্বচ্ছ অনুভূতিটাও তেমনি। সঙ্গী/সঙ্গিনী যেমনই হোক, যখন যেভাবে তুমি তাকে উপলব্ধি করছো, সেভাবে যদি সুখী থাকো তবে অনুভূতি কখনও মিথ্যে হবে না। আর যদি মনে করো, এসব মিথ্যে মোহ’র একটা, তখন সবকিছুই তোমার কাছে মিছে মনে হবে! ভুল মনে হবে, মনে হবে হয়তো তুমি এরথেকেও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো।”
ঠিক এই জায়গায়ই ভুলটা করেছিল নোভা। বাহ্যিক সৌন্দর্য আর অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যকে গুলিয়ে ফেলছিল। মুহূর্তের মধ্যেই সবকিছুকে তখন মিথ্যে, ছলনা, মিছে অভিনয় মনে হয়েছিল। এখন বুঝতে পারলো, ঠিক কতটা ভুল ছিল তার চিন্তাভাবনায়। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে গিয়ে, আদনানের সমস্ত অনুভূতিকেই ভুল বুঝে সন্দেহ করে এসেছিল। কী করে এত বাজে আচরণ করতে পারলো সে? নিশ্চিত তার এমন আচরণে আদনান অনেক কষ্ট পেয়েছে! মুখ ফুটে বলেনি ঠিকই, তবে তার এখনকার কথাবার্তাতে পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল চোখে। এমন ভুল আর না হোক কভু। ভুল করেও মানুষটাকে কষ্ট দিবে না। সামনে যা হয় হোক, যত বাঁধাই আসুক, সাহস নিয়ে সব কঠিন সময়ের মুখোমুখি সে হবেই। অনেক বুঝিয়ে নিজেকে শান্ত করলো নোভা। অস্ফুটস্বরে বলল,
“জীবনের জটিল হিসাব আমি খুব কম বুঝি। এজন্যই হয়তো যেকোনো সহজ বিষয়ও কঠিন হয়ে ধরা দেয় চোখে।”
“ভয় পেও না। পৃথিবীতে যদি আমার কাছে বাবা-মায়ের পর দামী কিছু নিজস্ব বলে থাকে, তবে সেটা তুমি। আমার অর্ধাঙ্গিনী। তুমি শুধু আমার উত্থাল হৃদয়ের একটুখানি প্রশান্তি নও, স্রষ্টার দেয়া শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই সম্পদকে সম্মানের সাথে আগলে রাখার দায়িত্ব কেবল আমারই। যা একান্তই আমার সম্পদ তা তো আমি কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করতে পারবো না নোভা!”
এরচেয়ে প্রশান্তিসূচক হৃদয়ছোঁয়া কথার জা’দু বোধহয় নোভার ডিকশিনারির কোথাও নেই। হৃদয়টা শুধু শান্তই হলো তা নয়, ভেতরের সমস্ত ভয়-ডর, দুঃশ্চিন্তা কেটে গেল। মনে হলো, জীবন সুন্দর। এমনই সুন্দর। বিশ্বাস আর ভালোবাসাতেই জীবনের অন্যতম সুখ লুকিয়ে আছে। মন আজ শুধু তা উপলব্ধিই করেনি, ছুঁয়ে দেখার অধিকারও অর্জন করেছে!
*****
চলবে…