সম্পূর্ণা-১৬,১৭

0
712

সম্পূর্ণা-১৬,১৭
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
১৬

‘মুমতাহিনা’স কিচেন’ পেইজটাতে কয়েকটা অর্ডার আসার পর থেকেই দুঃশ্চিন্তায় সময় কাটাচ্ছে নোভা। এখনও অর্ডারগুলো কনফার্ম করেনি। বিয়ের আগে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিজের হলেও, বিয়ের পর থেকে একটা মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব চলে যায় তার স্বামীর কাঁধে। কিছু কিছু কাজে তখন স্বামী নামক বিশ্বস্ত সঙ্গীকে সবসময়ই প্রয়োজন পড়ে। প্রয়োজন পড়ে আর সিদ্ধান্তকে। তার সম্মতিকে। অনুমতি ছাড়া এই কাজে হাত দেয়ার সাহস পাচ্ছে না সে। জড়তা আর সংকোচের কারণে আদনানের কাছ থেকে অনুমতি চাইতেও লজ্জা লাগছে। অথচ অর্ডারগুলো বিকেলের মধ্যেই পৌঁছে দিতে হবে।

চিন্তিত চেহারাতেই রুমের ভেতর পায়চারি করছে নোভা। জারা, নোরা নানুবাড়ি এসে মুনতাহার সাথে ভীষণ ভালো সময় কাটাচ্ছে। তাদের কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না এখানে। সবাই যথেষ্ট আদর যত্ন করছে। বাইরে থেকে এসে নোভার এই চিন্তিত চেহারা দেখে অবাক হলো আদনান। সকালে যখন রেস্টুরেন্টে যায়, যখনও সব ঠিকঠাক ছিল। দু’ঘণ্টায় কী এমন হলো যে, চেহারায় মেঘ জমে গেল। হাঁটতে হাঁটতেই পা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো নোভা। আদনানকে দেখে দুঃশ্চিন্তা সরিয়ে বলল,

“এত দ্রুত চলে এলেন?”

“হ্যাঁ! সামলানোর জন্য অনেকেই আছে। আমি না গেলেও চলতো। তোমার কী হয়েছে?”

তখনই হুটহাট প্রচণ্ড আওয়াজে বেজে উঠলো নোভার হাতে থাকা ফোন। কাস্টমারের নাম্বার দেখে আবারও দুঃশ্চিন্তা জমা হলো চেহারায়। ফোন রিসিভ করে কী বলবে সেটাই ভাবতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। পায়ের জুতো, মুজো খুলতে খুলতে জবাব দিল আদনান,

“ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন? রিসিভ করো!”

“রিসিভ করে কী বলবো!”

আচমকাই এই কথা বলে জিহ্বায় কামড় বসিয়ে দিল নোভা। টেনশনে মাথাটা ঠিক জায়গায় নেই। মুখ ফসকে সব বলেই তো ফেলছে। আদনানও খানিকটা অবাক হলো, অর্ধাঙ্গিনীর এমন কথা শুনে। বলল,

“কে ফোন করেছে?”

“রেগুলার কাস্টমার। ছোটোখাটো এই ফুডক্রাফটে যারা নিত্যনতুন খাবার খুঁজে, তাদেরই একজন।”

এবার কোনো সংকোচ নয়, বরং নিশ্চিন্তমনে প্রশ্নের জবাব দিল নোভা। আদনানও তা শুনে বলল,

“তবে রিসিভ করছো না কেন?”

“রিসিভ করে কী বলবো বুঝতে পারছি না! এতদিন তো নিজের সবকিছুর সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছি। এখন যেহেতু আপনি জড়িয়েছেন, আপনার সম্মতিরও প্রয়োজন আছে।”

পুরো ব্যাপারটা বুঝতে খুব একটা দেরী হলো না আদনানের। খুশি হলো এইভেবে যে, নোভা তার সম্মতির অপেক্ষা করছে আর পজেটিভ নেগেটিভ যাইহোক, জবাব ছাড়া নিজের পরবর্তীতে কাজে সে মনোযোগ দিতে পারছে না। অথচ এ ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত জানাটাও খুব একটা জরুরী মনে করছে না আদনান। তবে সঙ্গীকে সম্মান জানাতে, এইটুকু অনুমতির প্রয়োজন আছে। আলগোছে নোভার কাঁধে হাত রাখলো সে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে বলল,

“আমাদের জীবনটা খুব ছোটো নোভা! জীবনকে হাসি-আনন্দে উপভোগ করতে, মাঝেমধ্যে নিজের ইচ্ছেকে মূল্য দিতে হয়! কারও কথা শুনে নয়, নিজের মনের তৃপ্তি আর সুখের জন্য যে কাজটাতে তুমি আনন্দ পাবে সেটাই করো। যদি মনে হয়, এই কাজটা তোমাকে খুশি এনে দিচ্ছে, মনের ব্যথা লাঘব করছে, তোমার চারপাশের মানুষের মুখে হাসি ফুটাচ্ছে তবে সেক্ষেত্রে তুমি নিজের মনের ডাকেই সাড়া দিবে। এতে দ্বিতীয়বার তোমাকে আমার অনুমতি নিতে হবে না মিসেস!”

কেউ যখন সত্যিকার অর্থেই কাউকে ভালোবাসে তখন নিজের সবটা দিয়েই ভালোবাসে। এই ভালোবাসায় যেমন কোনো কমতি থাকে না, তেমনি থাকে না কোনো ছলনা কিংবা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি। সৎ ভালোবাসা সবসময়ই সুন্দর, পবিত্র। মানুষ হয়তো সবসময়ই নিখুঁত হয় না, ত্রুটিবিচ্যুতি থাকে বলেই সুন্দর-অসুন্দরের সৃষ্টি। তবুও যখন ভালোবাসার পবিত্রতা মনকে ছুঁয়ে যায় তখন প্রিয়জনের ত্রুটিটাকেও নিঃসন্দেহে ভালোবাসা যায়। আদনানের ব্যাপারটাও এরকমই। অর্ধাঙ্গিনীকে সে শুধু ভালোবেসেছে এমনটা নয়, তার চেহারা, গজ দাঁতের হাসি, রাগ, অভিমান, কান্নারত মায়াবী মুখটাও তার ভালোবাসার স্থানে চলে এসেছে। মেয়েটা কাঁদলে বুকে অশান্তি সৃষ্টি হয়, হাসলে মনে হয় চোখের সামনে একটুকরো চাঁদ ঝলমলে আলো ছড়াচ্ছে, সেই আলোতে ঝকঝক করছে তার চেহারা। সেই হাসিখুশি চেহারা দেখলে মনে প্রশান্তির বাতাস বয়!

জীবন এতটাই ছোটো যে, অনেক সময় কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণের আগেই থমকে দাঁড়ায় সময়। মৃ’ত্যু যেখানে নিশ্চিত জেনেও মানুষ স্বপ্ন দেখে, দুঃখ কিংবা সুখ কোনোটাই চিরস্থায়ী নয় জেনেও মানুষ সুখকে আঁকড়েই বাঁচতে চায়। প্রতিটা মানুষের জীবনে দুঃখকে সবাই কঠিন, জ্বালাময়ী অধ্যায় হিসেবেই চিনে! জীবনে সঠিক মানুষটা যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, সুখে ভরিয়ে দেয় পৃথিবী, ভালোবেসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়, বুঝিয়ে দেয়, এক জীবনে কিছু সুখকে সবসময়ই অনুভব করতে হয়। দুঃখ ছিল, আছে, থাকবে, এমনটা জেনেও সুখকে আঁকড়ে বাঁচতে শিখায়, তখন তো জীবন অনায়াসেই পরিপূর্ণ হয়ে যায়। হোক না জীবন ছোটো, নিজেকে সুখী ভাবতে ক্ষতি কী? প্রিয়জনের এমন ভরসাসূচক সম্মতি পেয়ে মনের সমস্ত দুঃশ্চিন্তাকে এক নিমিষেই দূরে ছুঁড়ে ফেললো নোভা। ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি ফুটালো। বলল,

“থ্যাংক য়্যু সো মাচ্! আই রেসপেক্ট য়্যু, এন্ড রেসপেক্ট য়্যুওর ডিসিশন। দ্যাটস হোয়াই, আই ওয়াজ ওয়েটিং ফোর য়্যুওর কনসেন্ট!”

“ডোন্ট ওরি ম্যাডাম! আজকের পর নিজের কোনো আনন্দের জন্য আমার অনুমতির অপেক্ষা করবে না। প্রমিস, আমি সবসময় তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে পাশে থাকবো।”

*****

যথারীতি নিজের সব চেষ্টা দিয়ে রান্নার কাজ সম্পূর্ণ করলো নোভা। এই কাজের জন্য বাড়ির শেষপ্রান্তে আলাদাভাবে একটা বড়ো সাইজের রুম তৈরী করা হয়েছে। যেখানে নিজের সব ফুড প্রোডাক্টগুলো যত্নে রাখতে পারে। এবং কোনো ঝামেলা ছাড়াই নিজের কাজটা সে মনোযোগ সহকারে করতে পারে। রান্না শেষে যার যার অর্ডার আলাদা প্যাকেট করে নিল। মুনতাহাও কাজে হাত লাগালো। খাবারের প্যাকেটগুলো অর্ডার করেই তৈরী করিয়েছে। ছোটো ছোটো চারকোণা বক্সে খাবার ভরে যত্ন সহকারে চারপাশে মজবুত টেপ মারলো যেন গাড়ির ঝাঁকুনিতেও সেগুলো গড়িয়ে না পড়ে। ‘মুমতাহিনা’স কিচেন’ লোগো বসিয়ে তৈরী করা প্যাকেটেই খাবারগুলো ঢুকিয়ে নিল। এবার শুধু এগুলো জায়গায় জায়গায় পৌঁছানো বাকি!

ঘার্মাক্ত ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো নোভা। ঝটপট গোসল সেরে নিল। ঘামে জবজবে হওয়া শরীর নিয়ে বাইরে যাওয়া যায় না। সাদাফ বাড়িতে থাকলে সেই-ই খাবারগুলো পৌঁছে দিতে পারতো। রুম ছেড়ে ড্রয়িংরুমে এসেই চমকে গেল নোভা। খাবারের প্যাকেটে নির্দিষ্ট জায়গার সিলমোহর মেরে সেগুলো সায়েমের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে আদনান। অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশিও হলো। অর্ধাঙ্গিনীর ক্লান্ত চেহারা লক্ষ্য করেছে সে। এজন্যই কষ্ট দূর করতে সায়েমকে ডাকিয়েছে। বিশাল সাইজের প্যাকেটটা সায়েমের বাইকের পিছনে আটকে দিল আদনান। তার এই কাজের জন্য বাড়তি কিছু টাকাও দিল। ভেতরে ঢুকতেই সামনে দাঁড়ালো নোভা। বলল,

“ওসব তো আমিই নিয়ে যেতে পারতাম।”

“আগে তো আমি ছিলাম না তাই এত ছোটাছুটি করেছো। এখন তো আমি আছি। তোমার সবচিন্তা যখন আমি নিয়েছি, তখন এসব নিয়ে আর দৌড়ঝাঁপ করতে দিব না তোমাকে। বাড়তি দু’জন মানুষ রাখলে তারাই খাবারগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিতে পারবে। যাও, গিয়ে রেস্ট নাও।”

উত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না নোভা। এই কাজ, এতসব আয়োজন, এগুলো নিয়ে মনে যত দুঃশ্চিন্তা সৃষ্টি হয়েছিল, এতক্ষণে সেসব হাওয়ার বেগে উড়ে পালিয়েছে। নায়লার কথার সত্যতা হারে হারে টের পাচ্ছে সে। হ্যাঁ তার ধারণা ভুল প্রমাণ হচ্ছে। সবাই এক হয় না। আদনান পুরোপুরি আলাদা একটা মানুষ। যার শুধু নিজেকে নিয়েই মাথাব্যথা আছে তা নয়, তার আশেপাশে যারা আছে সবাইকে নিয়েই সে ভাবে। আবারও বুঝতে পারলো, আদনানের ব্যক্তিত্ব পুরোটাই আলাদা। যার ভেতর সুন্দর একটা মন আছে, সে তো কখনও খারাপ হতে পারে না। নিজেকে এখন তার সুখী মানুষ ভাবতে ইচ্ছে করে।

বিকেলের মিঠে আলোয় বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ির আশপাশ ঘুরতে বেরিয়েছে মুনতাহা। এখানে আসার পর আদনানও বাড়ির বাইরে খুব একটা বের হচ্ছে না। যেহেতু কাল চলেই যাবে, সেই ফাঁকে বিকেলটা ঘুরাঘুরি করে হাসি-আনন্দে মজে থাকাই শ্রেয়। মুনতাহার হাত ধরে বাচ্চারা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। দূরে থাকা খেলার মাঠে তখন একঝাঁক ছেলেমেয়েদের দৌড় শুরু হয়েছে। বাচ্চাদের নিয়ে সেদিকেই এগোলো সে। সারা বিকেল এলাকার নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ালো সবাই। বাচ্চারা এই সময়টা খুব বেশিই উপভোগ করেছে। সন্ধ্যের দিকে বাড়ি ফিরছে সবাই। জারা, নোরা দু’জনে মুনতাহার হাত ধরে এগোচ্ছে। পিছনে আদনান, নোভা একসঙ্গে হাঁটছে।

হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় পিছিয়ে গেল আদনান। চারপাশে চোখ বুলিয়ে লম্বা সাইজের ঘাস তুলে নিল হাতে। সেটাকে ইচ্ছেমতো পেঁচিয়ে সুন্দর একটা চুড়ি বানালো। দ্রুতপায়ে নোভার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ডানহাত টেনে ঝটপট হাতে ঘাসের তৈরী চুড়িটা পরিয়ে দিল। চমকে গেল নোভা। দাঁড়িয়ে গেল মাঝপথে। হাতের দিকে অবাক চোখে তাকালো। ছোটোবেলায় কত যে এভাবে চুড়ি, নুপুর পরে নিজেকে সাজিয়েছে, তার নির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। সেসব স্মৃতি চট করে নাড়িয়ে দিল মস্তিষ্ক। অর্ধাঙ্গিনীর বিস্মিত চোখকে উপেক্ষা করে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো আদনান। বলল,

“কাঁচের চুড়ি, স্বর্ণের চুড়ি, হীরে-জহরত, সবকিছুর চেয়ে এই চুড়িটা বেশিই আকর্ষণীয়! সিনেমার নায়ক-নায়িকা যখন গিফট দেয়ার মতো নির্দিষ্ট কোনোকিছু খুঁজে না পায়, তখন সস্তায় কাজ সারে। আই মিন, এভাবেই ঘাস দিয়ে আংটি, চুড়ি কিংবা নুপুর তৈরী করে প্রপোজ করে!”

“এটা কী ধরনের প্রপোজ? শুধু চুড়ি পরিয়েই শেষ? কোনো রোমান্টিক ডায়লগ মুখে আসে না? এত বেরসিক কেন আপনি? সস্তায় প্রপোজ করছেন ভালো কথা, দু’লাইন রোমান্টিক গান অথবা কবিতা তো বলতেই পারতেন!”

আদনান চোখ ঘুরিয়ে তাকালো। হাতে-হাত রেখে এক’পা দু’পা এগোলো। বলল,

“ভালোবাসা কী জানো?”

“না তো! জানবো কী করে? আমি তো কাউকে ভালোবাসিনি!”

মুনতাহা ততক্ষণে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আদনান তখনও নোভার হাত ধরেই হাঁটছে। চারপাশে মানুষের সমাগম একদমই নেই। শান্ত, সুন্দর পরিবেশ। সুন্দর মুহূর্তটাকে আরেকটু সুখময় মুহূর্ততে রূপান্তরিত করলো সে। কণ্ঠে মাদকতা জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতেই কবিতার লাইন বিড়বিড়িয়ে ভালোবাসা কী তা বুঝিয়ে দিল।

ভালোবাসা মানে…
ভালোবাসা তুমি, ভালোবাসা প্রতিদিন।
ভালোবাসা মানে…
মন গহীনে, অনুভূতি সীমাহীন।

ভালোবাসা মানে…
হৃদয় মাঝে, তোমারই অনুভব।
ভালোবাসা মানে…
সুখ সাগরে, তোমারই কলরব।

ভালোবাসা মানে…
ছোট মনে, একটুখানি চাওয়া।
ভালোবাসা মানে…
শূন্যতার মাঝে, তোমার পরশ পাওয়া।

ভালোবাসা মানে…
তুমি আমি আর, আমাদের পূর্ণতা।
ভালোবাসা মানে…
থাকবো পাশে, এইতো দিলাম কথা।

নোভা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আদনানের দিকে। তার টুকরো টুকরো পঙক্তি শুনে মনে হলো, আসলেই তো ভালোবাসা এমনই। এমনভাবে সে তো ভাবেনি। তবে কি মন এখনও আদনানকে ভালোবাসতে পারেনি? দুচ্ছাই, কীসব উল্টোপাল্টা ভাবনা এসব। আপাতত ওসব ভাবনা দূরে থাক, সময়টা এখানেই থমকে যাক। ভালোবাসার লেনদেন এমনি করে, এমনভাবে চলুক।

*****

দু’দিন বাড়ির বাইরে থেকে, বাড়ি ফিরে ভীষণ অবাক হলো দু’জনে। রুমের ভেতরে জারা, নোরার কোনো কাপড়চোপড় নেই। ওয়ারড্রব, আলমারি সবকিছুতে শুধু তাদের দু’জনার জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা। অথচ যাওয়ার বেলাও বাচ্চাদের কিছু কাপড় আলমারিতে রেখে গিয়েছিল নোভা৷ লাগেজ থেকে ওদের কাপড় বের করে ওয়াশরুমে রেখে দিল। এগুলো ধুয়ে, পরিষ্কার করে এরপর ইস্ত্রি করে আলমারিতে তুলে রাখতে হবে। নয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রাতের রান্নাবান্নার জন্য রান্নাঘরে ঢুকলো৷ তড়িঘড়ি করে চায়ের পানি ফুটাতে বসালো। তখনই সাফিয়া খানম সামনে আসলেন। ভদ্রমহিলাকে দেখে মুচকি হাসলো নোভা। বলল,

“কিছু লাগবে ফুপ্পি?”

“ব্যস্ত হয়ো না। কিছু দরকারি কথা বলবো। কাল তো চলে যাব৷ আর কবে আসবো, তোমাদের দেখবো, তার তো ঠিক নেই। খুব মনে পড়বে সবার কথা!”

রান্নাঘরে থাকা বাড়তি উঁচু মোড়ায় বসালো তাঁকে। বলল,

“আপনি চাইলে তো আরও কয়েকটাদিন থাকতে পারেন ফুপ্পি!”

“তা কী করে হয় মা! নিজেরও ঘর-সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে। কত দায়িত্ব, কত কাজ! এভাবে বসে থাকলে চলবে।”

ভদ্রমহিলাকে বসিয়ে রেখে চায়ের পানিটা চেক করলো নোভা। অলরেডি সেটা ফুটতে শুরু করেছে। চা’পাতার বৈয়াম বের করে কিছু পাতা ঢেলে দিল কেটলিতে। লিকার কড়া হলে চায়ের স্বাদ বাড়বে। নোভার কাজের দ্রুততা মুচকি হাসলেন তিনি। বললেন,

“মেয়েরা এভাবেই সংসারি হয়ে উঠে! যা কিছু তোমার তা নিজের কাছে আগলে রেখো। এখন থেকে আদির সব দায়িত্ব তোমার। আমি জানি, বুঝতে পারি, তোমরা একে-অন্যের সাথে সুখী হবে। সংসার সবে শুরু হয়েছে, এখন তো প্রাইভেসি দরকার।”

এইটুকু বলাতেই ভদ্রমহিলার পরবর্তী ইঙ্গিতটা খুব সহজেই বুঝে ফেললো নোভা। তাদের দু’জনকে কাছাকাছি আনতেই বাচ্চাদের রুমটা আলাদা করে ফেলেছেন তিনি। লজ্জায় মুখ নিচু রেখে কাজে মনোযোগ দিল। চিনি, দুধ একসঙ্গে নিয়ে চায়ের কাপগুলো ট্রে’তে সাজিয়ে ভদ্রমহিলাকে নিয়েই ড্রয়িংরুমে চলে আসলো।

ফ্রেশ হয়ে বাচ্চাদের নিয়ে একদফা কু’স্তিতে মেতে উঠেছে আদনান। সারা ঘরভর্তি খেলনা ফেলে খেলছে দু’জনে। সে-ও তাদের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে নিয়েছে। খেলার মাঝখানেই ফোন বাজলো তার। স্ক্রিনে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সেখানে থমকে গেল তার। ঠিক পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পর রূহানীর কল এলো। তা-ও বড্ড অসময়ে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোনটা রিসিভ করলো সে। ওপাশ থেকে রূহানী সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে চুপ করে রইলো আদনান। কী বলবে, কী জানতে চাইবে সেটা ভেবেই দোটানায় পড়ে গেল মন! সেদিনের পর আর কোনো যোগাযোগ করেনি রূহানী। নাম্বারটাও বন্ধ ছিল এতদিন। আজই, হঠাৎ করে কেনই-বা এই ফোনকল! ভাবনা থামলো রূহানীর গলার আওয়াজ শুনে। ওপাশ থেকে মৃদুস্বরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে আওয়াজ এলো,

“ভাইয়া, আমি আগামী সপ্তাহে সিলেট আসছি! বাচ্চারা কোথায় আছে, কেমন আছে সেটা যদি জানাতেন, বড্ড উপকার হতো।”

ব্যস! আদনানের হৃদপিণ্ড ততক্ষণে মাত্রাতিরিক্ত বেগে কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিয়েছে। এমনই একটা দিন আসবে, মন সেটা আগেই বুঝেছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে আসবে, সেটা তো ভাবেনি। কী জবাব দিবে? কী বলবে? অন্যের বাচ্চাকে জেনেশুনে নিজের বাচ্চা হিসেবে লালন-পালন করছে? এতগুলো বছর পর রূহানী কী তবে বাচ্চা নিয়ে যেতেই ফোন করেছে? ফারদিন চৌধুরীর লোকজনের হাত থেকে বাঁচলোই বা কীভাবে? একসাথে অসংখ্য প্রশ্ন এসে ভিড় জমালো মনে। তালগোল পাকিয়ে গেল সব। জবাব দিতেও কণ্ঠস্বর কাঁপছে তার। জারা, নোরাকে ছাড়া বাঁঁচবে কীভাবে সে? দমবন্ধ লাগছে আদনানের! চোখের সামনে ভাসছে, তার সন্তানদুটো দূরে সরে যাচ্ছে। চিরদিনের জন্য। নীরব শ্রোতার কোনো জবাবই পেল না রূহানী। ফের প্রশ্ন করলো,

“শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা? আমি রূহানী সিকদার। ভাইয়া, আমার বাচ্চারা ভালো আছে তো? কোথায় রেখেছেন ওদের? ওই লোকটা ওদের কোনো খোঁজ পায়নি তো? কী হলো চুপ করে আছেন কেন আপনি? কোথায় আমার বাচ্চাদুটো?”

গভীর করে শ্বাস টানলো আদনান। নিজেকে বুঝালো। এমনটা হওয়ার ছিল। হচ্ছেও। সে তো আটকানোর কেউ না। দশমাস গ’র্ভে রাখা নারী আর সন্তানের ভাগ কেন অন্য কাউকে দিবে? যা হয় হোক, যদি রূহানী নিজের বাচ্চাদের নিয়ে যেতে চায়, তবে তো তাদের জোর করে আটকে রাখার কোনো অধিকারই তার নেই। আজ বাচ্চারা জানে না, হয়তো একদিন জেনে যাবে। কতটুকু কষ্ট পাবে? নোভার মতো ওরাও কি বড্ড অভিমানী হবে? ভাবতে পারলো না আর। স্বান্তনার হাজারও বানী শুনালো নিজেকে। ধীরকণ্ঠে বলল,

“ওরা আমার কাছেই আছে। ভালো আছে। তানভীরের বাবা জানেন না, ওরা এখানে। আপনি কি এই এলাকায় আসবেন?”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রূহানী। পুরনো স্মৃতি মনের পর্দায় উঁকি দিল। সেসবকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে বলল,

“না। দুসাই রিসোর্টে উঠবো। আপনি শুধু ওদেরকে নিয়ে আসবেন। রাখছি।”

কথা আটকে গেল আদনানের। কোনো আওয়াজ ছাড়াই ফোন কেটে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়। নোভা তখন চায়ের কাপ নিয়ে রুমের ভেতরে এসে ঢুকেছে। ওভাবে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

“কী ভাবছেন ওতো? ড্রয়িংরুমে আসলেন না যে! চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

সমস্ত যন্ত্রণায় একটুখানি প্রশান্তি হয়ে তার সামনে দাঁড়ালো নোভা। দুঃশ্চিন্তা ভুলে গেল আদনান। মেয়েটার হাসি হাসি মুখে বেদনা ঢেলে দিতে ইচ্ছে হলো না তার। থাকুক না কিছু হাসি এমন। কী দরকার, হাসিটা মুছে দেয়ার! এই মুহূর্তে এত বড়ো দুঃসংবাদ কোনোভাবেই জানাবে না সে। জানাতে পারবে না। আপাতত সময়টা হাসিখুশিই থাকুক। নির্ভার হাসি ফুটিয়ে কাঁধ ঝাঁকালো। বলল,

“কিছুই না। ক্লান্তি, বিষণ্ণতা, মনের বিষাদ, দূর করতে এক কাপ চায়ের সাথে তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন ছিল। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কাঙ্ক্ষিত সুখটাকে সামনে এনে হৃদয়টা শান্ত করার জন্য তোমার জন্য ছোট্ট একটা গিফট আছে!”

“তাই…? কী গিফট?”

“চোখ বন্ধ করো।”

“চোখ বন্ধ করলে দেখবো কী করে?”

“দেখবে না! এটা দেখা যায় না। ধরা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়! নাও ক্লোজ য়্যুওর আইজ কুইকলি!”

তাড়াহুড়ো দেখে সঙ্গে সঙ্গে দু’চোখ বন্ধ করলো নোভা। আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকালো। ওরা খেলাধুলাতেই ব্যস্ত। ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই গভীর স্পর্শে অধর ছুঁলো কপালে। সামান্য নড়েচড়ে চোখ বন্ধ করেই উপহারের নামে এই সুন্দর অনুভূতিটাকে যত্ন করে উপলব্ধি করলো মেয়েটা। ঠোঁটে হাসি ফুটলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,

“আপনার সমস্ত ক্লান্তি, অশান্তি, বিষণ্ণতা দূর করতে বার বার আপনার দেয়া এমন স্পর্শ উপহার হিসেবে চাই-ই চাই!”

চলবে…

সম্পূর্ণা | ১৭
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

স্মৃতি মানুষকে যতখানি হাসায় তারচেয়ে বেশি কাঁদায়। জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া ছোটো ছোটো অধ্যায়কে চোখের সামনে আবিষ্কার দু’চোখের জল ফেলে। সুখের হোক কিংবা দুঃখের, একটা সময় সেই ফেলে আসা দিন যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়। মন থেকে মুছে ফেলাও যায় না, আবার চাইলেও ফিরে পাওয়া যায় না। তবুও স্মৃতিগুলো ক্ষণে ক্ষণে বলে যায়, কিছু একটা অতীত ছিল। যা আজও দু’চোখের পাতায় জ্বলজ্বল করে জলে ওঠা কোনো দুঃসময়ের কান্না!

পরিচিত স্থান, পরিচিত শহরে পা রাখার পরই স্মৃতির পাতায় নড়ে উঠলো, এই শহরের বুকে রচিত কিছু দুঃসময়ের গল্প। যে শহরের বুকে নিষ্পাপ মনের ভালোবাসাও ঠাঁই পায়নি, সেখানে পুনরায় পা ফেলতে হবে এমনটা ভাবেনি রূহানী। কিন্তু সেই অধরা রত্নগুলোকে ছুঁয়ে দেয়ার আশায়, একবার বুকে নেয়ার আশায় ফিরে আসতে হলো। এমন বিদঘুটে শহরে আসা মাত্রই হারিয়ে যাওয়া মানুষটার বুকভরা ভালোবাসা অন্তর কাঁপিয়ে দিল তার। জানালার কাঁচ ভেদ করে দৃষ্টি ফিরে দেখলো, শহরের অলিগলি। যদি মানুষটা বেঁচে থাকতো, এই মুহূর্তটা স্বপ্নের মতো হতো নিশ্চয়ই। কিন্তু তা আর হলো না।

চোখের জলকে সঙ্গী করে শহরের মূল অংশ পেরিয়ে গাড়ি এসে থামলো দুসাই রিসোর্টে। পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলার হাত ধরে চিরচেনা শহরে পা রাখলো সে। ভেতরে থাকা সমস্ত বিষাদকে গভীর শ্বাসে মুক্ত করে খোলা হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। চোখের নিচে জমে ওঠা কালি সাক্ষী, জীবনের সব রঙ মুছে গেছে। রঙহীন ধূসর জীবন কীভাবে কাটানো যায়, জানা নেই তার। তবুও বাঁচতে হয়! স্বজ্ঞানে কেউ যখন আত্মহ*ত্যার পথ বেছে নিতে পারে না, তখনই সময়ের সাথে, জীবনের সাথে যু*দ্ধ করে বাঁচতে হয় তাদের। ঠিক এমনি ভাবেই ম’রে ম’রেও বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাকে। এভাবে ক’দিন চলবে সেটাও জানা নেই তার। শুধু জানে, নাড়িছেঁড়া ধনদের বুকে নিতে হবে। একবার হলেও জড়িয়ে ধরে নিষ্পাপ মুখে চুমু খেতে হবে।

লাগেজ নিয়ে নির্দিষ্ট রুমে ঢুকলো রূহানী। ফ্রেশ হয়ে ভদ্রমহিলাকে নিয়ে রিসোর্টের চারপাশে ঘুরাঘুরি করলো। বাইরের খোলা মাঠে ছাতাসমেত টেবিল সাজানো। সেখানেই দুটো চেয়ারে বসলেন দু’জনে। ওয়েটার ডেকে দু’কাপ কফি অর্ডার দিয়ে চুপচাপ শান্ত চোখে চারপাশের সৌন্দর্য পরখ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। ভদ্রমহিলা রূহানীর দিকে তাকালেন। সদা হাস্যজ্বল মেয়েটা দিনকেদিন হাসি ভুলে যাচ্ছে। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। ঠিকমতো খায় না, কারও সাথে কথা বলা তো দূর বাড়ি থেকে বাইরে কোথাও বেরই হয় না। চারদেয়ালের ব*ন্দী জীবনে সবসময়ই নিজের অতীত খুঁজে ফিরে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে মলিন মুখের মেয়েটাকে দেখলেন তিনি। চুপচাপ মুহূর্তটাকে দূরে সরানোর জন্য আগ বাড়িয়েই বললেন,

“আমি এ কারণেই বলেছিলাম, তোর এখানে আসা ঠিক হবে না। তুই শুনিসনি আমার কথা। বুঝতে পারছি, তুই একজন মা। বাচ্চাদের জন্য মায়েদের মন প্রতিনিয়ত ছটফট করে। সন্তান না থাকলে কষ্ট মানিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু সন্তান বেঁচে আছে জেনেও তাকে ধরতে না পারা, ছুঁয়ে দিতে না পারার যন্ত্রণাটা আমি বুঝি। তুই নিজেও অসুস্থ। এই শরীরে এতটা দূর জার্নি করা উচিত হয়নি। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিলে পারতি।”

“বিশ্রাম? তোমার কি মনে হয় মা, বিশ্রাম নেয়ার মতো মানসিকতা আমার আছে? আমার ভেতরটা কত অশান্ত সে তো তুমি জানো। নিজেকে একটু শান্ত করতেই এখানে আসা। বাচ্চাদের হাসিমাখা মুখ দেখলে হয়তো নিজের সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে থাকতে পারবো।”

ভদ্রমহিলা আর কথা বাড়ালেন না। চুপ করে রইলেন। যেদিন থেকে রূহানীর সমস্ত দায়িত্ব তিনি নিজের হাতে নিয়েছেন, সেদিন থেকে মেয়েটাকে হাসিখুশি রেখেছেন। তিনি নিজেও একজন নিঃসন্তান নারী। পেশায় একজন গাইনিকোলজিস্ট। যার জীবনে একটা সময়ে সন্তানের বড্ড অভাব ছিল। কত প্রার্থনা, কত আহাজারি করেছিলেন তিনি, শুধুমাত্র একটা সন্তানের মা হওয়ার জন্য। অথচ ভাগ্য তাঁর সহায় ছিল না। শত চেষ্টায়ও মাতৃত্বের স্বাদকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাননি তিনি। হসপিটালে অসুস্থ রূহানীর ছোটাছুটি দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাকে ওই মুহূর্তে বাঁচানোই নয়, সমস্ত চিকিৎসা করিয়ে নিজের মেয়ে করে রেখে দিয়েছেন সাথে। রূহানী যখন তাকে মা বলে ডাকে, না পাওয়া সুখটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তাকে। মনে হয়, জীবন বুঝি পরিপূর্ণ হয়ে গেল। পৃথিবীর বুকে তাঁরও একটা সন্তান জন্ম নিল। মা-মেয়ে সুখেই ছিলেন এতদিন। সেই সুখটাও খড়কুটোর ঘরের মতো। ঝ*ড় আসলে তাকে ভাঙার হাত থেকে রক্ষা করার সাধ্য কারও নেই। হুট করে সেই সুখেও ঝ*ড় আঁচড়ে পড়লো। তবুও শক্ত হাতে, ধৈর্য্য নিয়ে মেয়েটাকে সাহস দিচ্ছেন তিনি। চেষ্টা করছেন, সবকিছু আবারও স্বাভাবিক করার। যদি বিধাতা তাঁর উপর দয়া করেন, তবে হয়তো রূহানীকে নিয়ে গোটা জীবনটা সুখেই কাটাবেন তিনি।

*****

সকালের নাশতা শেষ করে তড়িঘড়ি করে বাচ্চাদের স্কুলড্রেস পরাচ্ছে নোভা। বার বার ঘড়ি দেখছে, আবার দ্রুত হাতে তাদের পোশাক পরানো থেকে শুরু করে জুতো, মুজো পরিয়ে, চুলগুলোও ঠিকঠাক বেঁধে নিয়েছে। ততক্ষণে আদনানও রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে গেছে। বাচ্চাদের ব্যাগদুটোতে বইগুলো সাজিয়ে প্রয়োজনীয় খাতা, কলম, পেন্সিল তাতে ঢুকিয়ে নিল। বেরোবার আগে দু’জনকে অসংখ্যবার চুমু খেয়ে বলল,

“ক্লাসে কোনোপ্রকার দুষ্টামি করবে না। যদি উল্টোপাল্টা কোনো কাজ করো, ম্যাম নালিশ দিবেন। তখন কিন্তু খুব বকা খাবে দু’জনে।”

দু’জনেই মাথা নাড়লো। বিদায় দেয়ার আগে কিছু দোয়া পড়ে দু’জনের গায়ে ফুঁ দিল নোভা। আদনানকে বলল,

“সাবধানে নিয়ে যাবেন।”

আদনানও মাথা নাড়লো। বেরোতে বেরোতে বলল,

“ফিরতে দেরী হবে। ওদের নিয়ে একটা জায়গায় ঘুরতে যাব।”

এই মুহূর্তে ঝড়ের কোনো প্রকার আভাস নোভাকে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না আদনান। আগে বাচ্চাদের নিয়ে ওখানে যাবে, পরিস্থিতি বুঝবে। তারপরই সিদ্ধান্ত নিবে, কী করবে। এত আগেই টেনশন ঢুকিয়ে লাভ নেই। রূহানী এখানে তিনদিনের জন্য এসেছে। সেই তিনদিন ভালোয় ভালোয় কাটুক। সময় বুঝে সব কথা বললেই হবে।

রেস্টুরেন্টের কিছু কাজ সামলে দুপুরের দিকে বাচ্চাদের স্কুলের সামনে গেল আদনান। সেখান থেকে দু’জনকে গাড়িতে তুলে রওনা হলো রিসোর্টের দিকে। যখন ওখানে পৌঁছালো, তখন দেখলো বাইরের বাগানেই হাঁটাহাঁটি করছে রূহানী। দু’হাতে কনুই চেপে রেখে হাঁটছে। তার চিন্তিত মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু ভাবছে। যখন পুরোটা সামনে গেল তখনই থমকে গেল সে। সেই হাস্যজ্বল মুখটা আর নেই। চেহারার রঙ জ্বলে গেছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে, হাঁটার ভাবভঙ্গিতে বুঝা যাচ্ছে, কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। মুহূর্তেই ভাবনাগুলো দূরে সরালো সে। সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল,

“কেমন আছেন?”

চোখের সামনে পুতুল পুতুল দুটো চেহারা। তাদের ঠোঁটের কোণে লেপটে থাকা হাসি। ঝুঁটি বাঁধা চুল। পরনে স্কুল ড্রেস। সবকিছু একই হলেও চেহারায় কিঞ্চিৎ একটা পার্থক্য আছে। যা চটজলদি নজরে আসে না। খুব ভালো করে তাকিয়ে থাকলেই ধরা যায়। কারণ দু’জনের মধ্যে একজনের ভ্রু জোড়। একসাথে জয়েন করা। অন্যজনের ভ্রু আলাদা হলেও পাপড়িগুলো ঘনঘন। এই পুতুল পুতুল মায়াবী চেহারার মেয়েদুটো তার। সে কথা ভেবেই বুকের ভেতরে জমে থাকা সমস্ত যন্ত্রণা মুছে গেল। জলে টইটম্বুর চোখে তাকিয়ে রইলো দু’জনার দিকে। হাসতে ভুলে গেল। কান্নায় ভেতরটা ভার হয়ে এলো। সাহসী মেয়ের মতো নিজেকে সামলে নিল ঝটপট। চোখের পানি মুছে জবাব দিল,

“ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“এইতো চলে যাচ্ছে।”

“কোথাও বসে কথা বলি?”

ভেতরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লো না। খোলা আকাশের নিচে বসে কথা বলাই সাচ্ছন্দ্যের মনে হলো। দু’জনকে দু’পাশের চেয়ারে বসিয়ে মাঝখানে বসলো আদনান। ঠিক তার মুখোমুখি চেয়ারে রূহানী। নিজেকে ধাতস্থ করতে বেশ খানিকটা সময় নিল রূহানী। সবকিছু গুছিয়ে বলল,

“ওদেরকে কোন স্কুলে ভর্তি করেছেন?”

“সানফ্লাওয়ার্সে!”

“আপনাকে অনেক ঝামেলা সামলাতে হয়েছে নিশ্চয়ই!”

এই কথার কোনো জবাব দিল না আদনান। ঝামেলা যা ছিল তা তো ওদের জন্মের পরপরই। এখন তো সব ঠিকঠাক। বন্ধুকে ভালোবেসে, একজন মানুষ হিসেবে যতটুকু করণীয় সে করেছে। সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে আগলে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। দু’হাতে কোলে তুলে লালন-পালন করেছে। এসব কষ্ট যে করে, সে-ই বুঝে বাচ্চা লালন-পালন করা কতখানি ধৈর্যের। প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল,

“হঠাৎ কী মনে করে? কিছু কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? আই মিন, আপনি কি ওদের…!”

বাকিটা বলতে পারলো না আদনান। ইঙ্গিত দিয়েই বুঝিয়ে দিল। বাচ্চাদের সামনে এমনসব কথা বলা যুক্তিযুক্ত নয়। রূহানীও বোধহয় সেটা বুঝতে পারলো। কথার উত্তরে মুচকি হাসলো শুধু। বলল,

“ওদের নাম কী রেখেছেন?”

হাসিমুখেই বাচ্চাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আদনান। দু’জনের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলো রূহানী। হাত বাড়ালো দু’জনের দিকে। প্রথম দেখায় যেকোনো বাচ্চাই সহজে কারও সাথে মিশে না। জারা, নোরাও এগোলো না। ভয়ে, আত*ঙ্কে আদনানের সাথে সেঁটে গেল একদম। দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,

“পাপা, বাড়ি যাব। মাম্মা অপেক্ষা করছে।”

মুখের হাসিটা মুছে গেল রূহানীর। নাড়িছেঁড়া ধন তাকে চিনতে পারে না। কোলে আসে না। ভয়ে দূরে সরে যায়। এই দৃশ্য একজন মায়ের কাছে কতটুকু সহনীয়! নিজেকে আটকে রাখা দায় হয়ে পড়লো রূহানীর। কান্নারত চেহারাতেই বলল,

“আসো না মামনি। একটু কাছে আসো। আন্টি হইতো আমি তোমাদের। আন্টির কাছে আসবে না! অনেকগুলো গিফটস এনেছি তোমাদের জন্য। নিবে না?

রূহানীর মনোভাব বুঝার চেষ্টা করলো আদনান। মেয়েটা মায়ের পরিচয় দিচ্ছে না। হয়তো সাহস পাচ্ছে না। নয়তো বাচ্চাদের আঘাত দিতে চাইছে না। এ পর্যায়ে নিজেই দু’জনকে বুঝালো সে। অভয় দিয়ে বলল,

“এই আন্টি’টা একদম মাম্মামের মতো। অনেক আদর করবে। যাও। দেখো, তোমরা সরে আসাতে আন্টি কষ্ট পেয়েছে। যেভাবে মায়ের কান্না মুছে দাও, সেভাবে আন্টির কান্নাও মুছে দিয়ে আসো।”

দু’জনেই রূহানীর দিকে তাকালো। মাথা নেড়ে কাছে ডাকলো সে। দু’জনেই গুটি গুটি পায়ে এগোলো। দু’হাতে দু’জনকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল রূহানী। চোখ ফেটে অশ্রুর ঢল নামলো। পাগ*লের মতো দু’জনের চোখেমুখে, হাতে অসংখ্য চুমু খেল সে। বার বার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। একটা সময় কান্না থামলো। দু’জনেই তার চোখের পানি মুছে দিল। জারা আহ্লাদী কণ্ঠে হাত বাড়িয়ে বলল,

“এবার আমাদের গিফট দাও।”

“দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করো।”

দু’জনকে রেখে দৌড়ের উপর নিজের রুমে ঢুকলো রূহানী। আলাদা দুটো ব্যাগ নিয়ে আসলো। তাতে অসংখ্য চকলেট, খেলনা, আরও প্রয়োজনীয় কিছু পোশাকও রয়েছে। দু’জনের হাতে দুটো ব্যাগ ধরিয়ে দিল। হাঁটু ভাঁজ করে ঘাসের উপর বসে বলল,

“এবার দু’জনে আমাকে আদর দাও!”

হাসিমুখে দু’দিক থেকে দু’জনে রূহানীর দু’পাশে গালে চুমু খেল। বলল,

“তুমি খুব ভালো আন্টি। একদম মাম্মা’র মতো।”

“তাই? তোমাদের মাম্মা কেমন?”

“অনেক ভালো। আমাদেরকে কত্ত আদর করে। ঘুম পাড়িয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়, পড়া শিখিয়ে দেয়, আমাদের নিয়ে খেলতে বসে। কতকিছু করে।”

আরও ঘণ্টাখানেক বাচ্চাদের নিয়ে গল্পের ছলে হাসিখুশি সময় কাটালো রূহানী। দূর থেকে ভদ্রমহিলা চেয়ে চেয়ে দেখলেন। ঠিক কতদিন পর মেয়েটাকে এতটা খুশি দেখলেন, জানা নেই তাঁর। শুধু মনে মনে প্রার্থনা করলেন, এই হাসিটুকু বেঁচে থাকুক, এভাবেই।

*****

রূহানীর আচরণ এখনও সন্দেহজনক। বাচ্চাদের সামনে সাহস নিয়ে কিছু বলেনি। অকারণ মন খারাপ আয়োজন তৈরী হবে, হয়তো এটা সে বুঝতে পেরেছে। তাইতো মা হয়েও বাচ্চাদের সামনে নিজেকে খুব সহজেই আন্টি হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এতেও তার চোখেমুখে যন্ত্রণার ছাপ পড়েছিল তখন। কতখানি ধৈর্য্য থাকলে একটা মা সন্তানের সামনে পেয়েও বলে, ‘আমি তোমাদের আন্টি হই’ সেই ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই আদনানের। ওই মুহূর্তে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছিলো সে। এখনও পাচ্ছে। বাড়ি ফিরে বাচ্চাদের খুশি দেখেও নিজের ভেতরের দুঃশ্চিন্তা থেকে সরে আসতে পারছে না সে। একমনে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে সে। নোভা তখনও বাচ্চাদের সামলাতে ব্যস্ত। ওদেরকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, এই সময়টা খুব বেশি কঠিন আর ধৈর্যের কাজ। মা না হয়েও এই দিকটা খুব ধৈর্য নিয়েই সামলে আসছে তার অর্ধাঙ্গিনী। তার মধ্যে কখনও কোনো বাড়তি বিরক্তি দেখা যায় না। বরং বাচ্চাদের সাথে সময়টা খুব আনন্দেই কাটায় সে। এখন যদি রূহানী তার বাচ্চা নিয়ে যেতে চায়, তার প্রভাবটা নোভার উপর কতটুকু পড়বে সে বিষয়েও কোনো ধারণা হলো না তার। শুধু বুঝতে পারলো, মেয়েটা অনেক কষ্ট পাবে। কীভাবে বলবে সে আজকের ঘটনা? কীভাবে সামলে অভিমানিনীকে? হুট করে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঝ*ড় জীবনে কেন আসলো? কী শান্তির, সুখের সময় কাটাচ্ছিলো সবাই মিলে! পরিপূর্ণ পরিবার, হাসিখুশি মুহূর্ত! সবই তো ঠিক ছিল। কেন আসলো রূহানী? কিছুই তো জানা হলো না। বিদায়বেলা শুধু জানতে চাইলো,

“তানভীরের কব-রটা কোথায়?”

নির্দিষ্ট জায়গার নাম বলে এসেছে আদনান। এ-ও বলেছে, তানভীরের বাবাকে নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে দেশের বাইরে সেটেল্ড হয়ে গেছেন প্রায় দু’বছর আগে। তাই সে বিনা ভয়েই কব*রস্থানে যেতে পারে।

ভাবনারত আদনান চমকে উঠলো কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে। ভেতরটা দুঃশ্চিন্তায় এতটাই ডুবেছিল যে, নোভার স্পর্শে হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো। ভ্রু নাড়িয়ে দৃষ্টি ফেললো পাশে। প্রশ্নবোধক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো নোভা। সেই দৃষ্টি’টা নজরে পড়তেই বুক ভার হয়ে গেল। অতি সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস লুকোলো সে। বলল,

“কখনও ভেবেছো, বাচ্চারা ওদের মায়ের কাছে ফিরে গেলে কীভাবে থাকবে? তোমার কি খুব কষ্ট হবে নোভা? নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছে আমার। কিছু বুঝতে পারছি না কী করবো! ওদের ছাড়া বেঁচে থাকা তো কষ্টের হয়ে যাবে।”

কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না নোভা। আদনানের ছেলেমানুষী কথা আর কান্নায় চোখেমুখে বিস্ময় খেলে গেল তার। অবাক হয়ে জানতে চাইলো,

“হঠাৎ করে এমন চিন্তাভাবনাকে কেন ঠাঁই দিচ্ছেন মাথায়?”

“যদি এমন হয়? যদি রূহানী তার বাচ্চা নিয়ে যেতে চায়? দিয়ে দিব? আটকে রাখার অধিকার নেই আমার?”

শক্ত করে আদনানের ডানহাত ধরলো নোভা।অন্যহাতে চুলে আঙুল বুলালো। বলল,

“সে তো মা! নিজের সন্তান সে চাইতেই পারে। যদি চায়, দিয়ে দিবেন। জোর করে তো আটকে রাখা যায় না।”

বুকের ভেতর জমে ওঠা কান্নার ঢেউকে আটকে রাখা কঠিন হয়ে গেল তার। দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে। ঠোঁটমুখ চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো। বিড়বিড় করে বলল,

“রূহানী ফিরে এসেছে নোভা। বাচ্চাদের নিয়ে ওর সাথে দেখা করতেই গিয়েছিলাম! আমার খুব ভয় হচ্ছে। যদি ফেরার পথে ওদের নিয়ে যেতে চায়, কীভাবে দিব? ওরা আমার জীবনের সাথে এমনভাবে জড়িয়েছে যে, আমার সকাল, সন্ধ্যা, এমনকি রাতও ওদের হাসিমাখা মুখ দেখে কাটে। এক মুহূর্ত চোখের সামনে না পেলে, সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় আমার। যে দু’হাতে ওদেরকে আগলে নিয়েছি, কীভাবে সে দু’হাতে ওদেরকে দূরে সরিয়ে দিব? কী করবো আমি বলো না নোভা? থাকবো কী করে ওদের ছাড়া!”

চোখবুঁজে পুরো কথাটা শুনলো নোভা। কষ্ট হলেও সামলে নিল নিজেকে। এই কয়েকটা দিনে বাচ্চাদের সাথে সে নিজেও পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে। রক্তের টান, নাড়ির টান না থাকলেও মনের যে টান সেই টান থেকেই বুঝে, বাচ্চারা তার কতখানি আপন হয়ে জড়িয়ে গেছে তার সাথে। ওদের মুখে মা ডাকটায় পুরো পৃথিবীর উপচেপড়া সুখকে খুঁজে পায় সে। জীবনটা সুখে পরিপূর্ণ হয়ে এভাবে আবারও শূন্য হয়ে যাবে, এমনটা তো দুঃস্বপ্নের কল্পনাও ছিল না তার। এখন এসব কথা শুনে ভয় জেঁকে বসলো মনে, বাচ্চাদের দূরে সরাতে হবে, তাদেরকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে হবে, এই বিষয়টা সহজেই মানতে পারলো না তার অবুঝ মন। কোথাও যেন একটা অধিকারবোধ জন্ম নিল।

রূহানীর দিকটাও ভাবলো। মেয়েটা সব হারিয়েছে। এখন শুধু স্মৃতি হিসেবে বাচ্চারাই আচ্ছে। সে হয়তো চাইবে, ভালোবাসার মানুষটার শেষ স্মৃতিকে নিজের কাছে আগলে রাখতে। কোনো মা এই সুযোগ হাতছাড়া করবে না কভু। দশমাস, দশদিন গ*র্ভে রেখে জন্ম দেয়া শিশুকে পাওয়ার অধিকার তো তারই বেশি। জেনেবুঝে নিজের অধিকার কেউ ছাড়বে না নিশ্চিত। নিজেকে বুঝিয়ে শান্ত করলো নোভা। দু’হাতে আদনানের চোখের পানি মুছে দিল। বলল,

“সে মা! তার বাচ্চার উপর তারই অধিকার বেশি! আমরা যতই ভালোবাসি না কেন, জোর করে তার বাচ্চা আটকে রাখার অধিকার আমাদের নেই।”

“ওরা জানলে খুব কষ্ট পাবে নোভা। ওইটুকু মনে আঘাত আসবে না? তুমিই বলো, যখন ওরা জানবে আমরা তাদের কেউ না, তখন কত কষ্ট পাবে!”

“ওরা অবুঝ। কিছুই বুঝে না। এখনও এ সম্পর্কে ধারণা ওদের খুব কমই আছে। এক মায়ের দিকেও তাকাতে হবে আমাদের। কষ্ট হলেও, মায়ের বুকে সন্তানদের ফিরিয়ে দেয়া উচিত।”

“আই কান্ট!”

অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো আদনান। এ কাজটা তার দ্বারা হবে না। প্রয়োজনে সে স্বার্থপর হয়ে যাবে, তবুও জারা, নোরাকে দূরে যেতে দিবে না। নিজের কাছে আগলে রাখবে। সে-ও তো কষ্ট করেছে, লালন-পালন করেছে, মৃ*ত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে কত ছোটাছুটি করেছে, অসুস্থ হলে রাত জেগে সেবাযত্ন করেছে, কতশত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে, বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে, তার কষ্টের দাম নেই? এত কষ্ট করে, দু’হাতে আগলে রাখা আদরের সন্তানদের সে কীভাবে দূরে সরিয়ে দিবে? মায়ের কষ্টের দাম আছে, তার কষ্টটা বুঝি খুবই তুচ্ছ? ভাবতে পারলো না আদনান। গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে ঝরঝর করে চোখের পানি ফেললো। শক্ত করে দু’হাতে গ্রিলে চাপ দিল। বিড়বিড় করলো,

“কাকে বুঝাবো আমার ভেতরের ঝ*ড়! কেউ বুঝবে না। একটা পথ দেখাও আমায় খোদা! তুমিই অন্তর্যামী! আমার অন্তরের বেদনা তো তুমিই জানতে পারছো। তুমি চাইলেই সব সম্ভব। সব ঠিক করে দাও। আমার বাচ্চাদের তুমি সবসময়ের জন্য আমার করে দাও। আমি আর কিচ্ছু চাই না তোমার কাছে। শুধু আমার বাচ্চাদের মুখে বাবা ডাকটা শুনতে চাই। সারাজীবন চাই।”

*****

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here