সম্পূর্ণা-১৮

0
542

সম্পূর্ণা-১৮
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

একজন মায়ের কাছে তার সন্তান যেমন নিজের জীবনের চেয়েও দামী, একজন বাবার কাছেও তাই। বুকে আগলে রাখা আদরের সন্তান দূরে চলে যাক, এমনটা কোনো বাবা-মা চাইবে না। শত কষ্ট করে লালন-পালন করা বাচ্চাকে যে কেউ বুকের কাছে আগলে রাখতে চাইবে সারাজীবন। রূহানীর দিকটা তখন আলাদা আর জটিল ছিল বলেই নিজের বাচ্চাদের সে দূরে সরিয়ে দিতে পেরেছে। তার কাছে তখন বাচ্চাদের জীবনটাই দামী মনে হয়েছিল। নিজেকে নিয়ে সে ভাবেনি, শুধু ভেবেছে বাচ্চারা বাঁচুক। সুস্থ জীবন পাক। নাড়িছেঁড়া ধনকে জেনে-বুঝে দূরে সরিয়ে দেয়া যতটুকু কষ্টের, সেই সন্তানকে বছরের পর বছর বুকে আগলে আবারও তাকে তার মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেয়া, এই ব্যাপারটাও কষ্টের। ঠিক এখানেই আদনানের যত দুর্বলতা। নিজেকে সে সামলাতেও পারছে না, কাউকে তার কষ্টটুকুও বুঝাতে পারছে না।

সকাল থেকে কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে সে। জারা, নোরার সাথে লিমিট মেপে কথা বলছে। নাশতার টেবিলে নিজ হাতে খাইয়েও দেয়নি, বরং সকালের নাশতাটা নোভাই বাচ্চাদের মুখে তুলে দিচ্ছে। রেদোয়ান হাসানও বার কয়েক ফিরে ফিরে ছেলের এমন উদ্ভট আচরণ দেখে অবাক হলেন। ছেলে সচরাচর এমন কাজ করে না। যবে থেকে জারা, নোরাকে নিজের সাথে জড়িয়েছে, সেই জন্মের পরবর্তী সময় থেকে, তাদের দেখাশোনা করা, খাওয়ানো, সবই সামলেছে। এমনকি নোংরা করা কাপড়চোপড়ও নিজ হাতে ধুয়ে পরিষ্কার করেছে। এতিমখানা রাখার পর সেখানেও নিয়মমাফিক রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। নিজেও যতটা পারা যায়, সময় দিয়েছে। অথচ আজই সে প্রথম বাচ্চাদের অবহেলা করছে। বিষয়টা দৃষ্টিকটু হলেও তাঁর মনের কোণায় বিষাদের ছায়া নামলো। ভেতরে জেগে ওঠা কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলেন না তিনি। বাধ্য সন্তানের মতো যথাসম্ভব মুখ নিচু রেখে নাশতা করছে আদনান। তার এরূপ ভাবভঙ্গি দেখে বললেন,

“তুই কি কোনো কারণে আপসেট?”

এই মানুষটা বাবা কম বন্ধু বেশি। ছেলের মতিগতি কখন কোনদিকে দৌঁড়ায়, তিনি ঠিকই তা টের পান। মৌমিতা মা’রা যাওয়ার পর থেকে ছেলেকে তিনি নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছেন। সব কাজে বন্ধুর মতো আচরণ করেছেন। বুঝিয়েছেন। শিখিয়েছেন। মানুষকে ভালোবাসার জন্য সুপ্ত মনে অনুভূতির সঞ্চার করেছেন। বিদ্যাবুদ্ধি যাই হোক, তিনি এতটুকু নিশ্চিত ছিলেন, ছেলে তাঁর সঠিকভাবে মানুষ হয়েছে। নামদারী শিক্ষাদিক্ষা নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে তাকে একজন মনুষ্যত্ববোধ মানুষে রূপান্তরিত করার জন্য দিনরাত সাপোর্ট করেছেন। সেই সন্তানে মনে কখন, কী চলে সেটা বোধহয় সবার আগে তিনিই টের পান।

ধীরেসুস্থে খাবারটা গিললো আদনান। চোখ তুলে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নিল। কথার জবাব দেয়ার মতো আপাতত কোনো কথা সাজানো নেই তার। তাই চুপচাপ খাবারেই মনোযোগ দিল। রেদোয়ান হাসান এবার বোধহয় পুরোটা নিশ্চিত হয়ে গেলেন। কোথাও না কোথাও ঝামেলা একটা আছে, ঠিকই তা উপলব্ধি করতে পারলেন। বয়স হোক কিংবা অভিজ্ঞতা, সবকিছুর বাছবিচারে বুঝতে পারলেন, হাসিখুশি ছেলেটা চুপ হয়ে যাওয়ার পিছনে বড়ো ধরনের কোনো ঝামেলা নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে। নয়তো এমন আচরণ কেন? ছেলের নীরবতাকে প্রশ্রয় দিলেন না তিনি। বললেন,

“সমস্যা যা-ই হোক, সমাধানটা তো ভেবেচিন্তেই করতে হবে, তাই না? তাই বলে নিজের দৈনন্দিন জীবনের শুরুতে যে রুটিন, যা কিছু তোর কাছে সবচেয়ে বেশি দামী, সেখানেই ত্রুটি তৈরী করবি?”

পুরো কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগলো আদনানের। ভদ্রলোক জারা, নোরার দিকে তাকিয়েই চোখের ইশারায় যখন বুঝালেন, তখনই সে কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো। এবার নিজের কাছেই নিজেকে খুব ছোটো মনে হলো তার। লজ্জায় পড়ে গেল। ওইদুটো চেহারায় এতটাই সুখ লুকিয়ে থাকে যে, তাকানো মাত্রই সমস্ত যন্ত্রণা মুছে যায়। একনজর বাচ্চাদের দেখে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফেরালো। নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখতে কতখানি কষ্ট হচ্ছে সেটা শুধু সেই বুঝতে পারছে। দীর্ঘশ্বাস চেপে খাবারে মনোযোগ দিল। বলল,

“মায়া বাড়িয়ে যখন লাভ হয় না, তখন মায়া কাটাতে হয়। আমি সেটাই করছি।”

রেদোয়ান হাসান চকিতে দৃষ্টি ফেরালেন নোভার দিকে। সে-ও যথেষ্ট শান্ত, নীরব, চুপচাপ। যেন আজ কথা বলবে না, এই পণ নিয়েই বসেছে। তিনি কিছু বলার আগেই আদনান প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলল,

“আমাদের বাড়ির সামনের যে শপ, ওই মালিকের সাথে কথা বলেছিলাম। তোমার বৌ’মার কাজের সুবিধার জন্য ওখানে একটা ফুডকর্ণার দিব। রেগুলার কাস্টমার যারা তাদের সুবিধার জন্য। বার বার রান্নার কাজের জন্য ওদেরকে গিয়ে বিরক্ত করবে, এই ব্যাপারটা কেমন দেখায়। আগামী সপ্তাহেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সায়েম আর রাফিকে রেখে দিব, হোম ডেলিভারির জন্য। প্রয়োজনে ওদেরকে ওভারটাইমের বাড়তি টাকা দিয়ে দিব। ভালো হবে না?”

“তোর হয়েছেটা কী বলতো? এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? কিছু কি হয়েছে? কেমন অদ্ভুত আচরণ করছিস! যা একদমই হজম করা যাচ্ছে না। অন্তত তোর এই আচরণ আমি হজম করতে পারছি না আদি। ক্যান য়্যু টেল মি হোয়াট হ্যাপেনড?”

আদনান এবারও সেই বিষয়ে কথা বাড়ালো না। নাশতা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। হাত পরিষ্কার করে চেয়ারের কর্ণারে থাকা ব্লেজারটা গায়ে জড়ালো। বেরোবার আগে নোভার দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি, ওদেরকে নিয়ে এসো। স্কুলে দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো নোভা। আদনানের এই আচরণটা শুধু তাকেই কষ্ট দিচ্ছে না, বাচ্চাদের মনেও প্রশ্ন জাগিয়ে তুলছে। ওইটুকু বাচ্চাদুটো মুখিয়ে আছে বাবার আদর পাওয়ার জন্য, অথচ আদনান অতি সুক্ষ্মভাবে ওদের অবহেলা করে যাচ্ছে। কেউ না বুঝলেও নোভা ঠিকই বুঝতে পারছে, নিজেকে সামলাতেই সে এই কঠিন পথ বেছে নিয়েছে। নয়তো কোনো বাবা পারে না, জেনে-বুঝে তার নিজের সন্তানদের দূরে সরাতে। জন্মদাতা না হোক, এতগুলো বছর বাচ্চাদের আগলে রেখেছে। সেই হিসেবে বাচ্চাদের দূরে সরিয়ে দিতে তাঁর বুক তো কাঁপছেই, সাথে মাত্রাতিরিক্ত কষ্টও হচ্ছে।

*****

বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেয়ার সময়ও ওদেরকে খুব গোপনে এড়িয়ে গেছে। দু’জনেই তাকে চুমু খেয়ে বিদায় নিয়েছে, অথচ সে নিজের জায়গায় অনড়, পাথর। ক্লাসে দেরী হয়ে যাচ্ছে ওরাও বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেনি, গাড়ি থেকে নেমে ছুটে পালিয়েছে। দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে রেস্টুরেন্টে চলে গেল আদনান। যেন এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর তার জন্য। তার বাচ্চাদুটো একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে, অথচ সে আটকাতে পারছে না। সমস্ত অভিমান, অভিযোগ জন্মালো মৃ*ত বন্ধুর উপর। বড়ো অসময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল সে, কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি ফেলে গেল তাকে। য*মদূত কেন তানভীরকেই কেড়ে নিল? পৃথিবীর আনাচে-কানাচে কত মানুষের চলাচল, আর কাউকে চোখে পড়লো না তাঁর? ওইটুকুন বাচ্চাদের উপর এত অবিচার না হলেই কি হচ্ছিলো না? সাজানো গোছানো জীবনটা তার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, দিনের প্রথম মুহূর্ত কাটছে বাচ্চাদের অবহেলা করে, দ*মবন্ধ করা এমন মুহূর্ত প্রতিদিন পার করবে কীভাবে সে? ওরা তো তার নিঃশ্বাসে, প্রশ্বাসে মিশে গেছে। ওদের ছাড়া সুখ সাজানো সম্ভব?

সাফফাত যখন তার রেস্টুরেন্টে আসলো তখন প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতেই বন্ধুকে কল করা। কিছু সাজেশনের তো দরকার আছে। বন্ধুর এমন দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ চেহারা দেখে খানিকটা অবাকই হলো সে। হাসিখুশি ছেলে, ঝামেলাহীন জীবন কাটাচ্ছে। সুখী সংসার, সবকিছুই প্রাপ্তিতে পরিপূর্ণ। তবুও চেহারার এমন বিষণ্ণতা দেখে ভয় পেল সে। চেয়ারে বসে বলল,

“বিপদটা কী বল! তুই তো আবার ঝামেলা না হলে বন্ধুকে স্মরণ করিস না।”

যদিও কথাটা রসিকতার ছলেই বলেছিল সাফফাত। তবে আদনানের চেহারার গাম্ভীর্যতা দেখে সিরিয়াস মুখ নিয়ে বলল,

“ওভাবে তাকাস না ভাই। কী হয়েছে বল! তোর চেহারা বলছে, ঝামেলা ছোটোখাটো না।”

“গতকাল রূহানী এসেছে। মনে হচ্ছে সে বাচ্চাদের নিয়ে যেতে চাইবে!”

বিড়বিড় আওয়াজে ওইটুকু বলেই চুপ করে গেল আদনান। সাফফাত কিছুক্ষণ ভাবলো। বন্ধুর মনোভাব আর চেহারার ভাবভঙ্গি পাল্টানোর কারণটা বুঝতে পেরে বলল,

“তুই শিওর? সেরকম কিছু বলেছে সে?”

“পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। গতকাল বাচ্চাদের সাথে দেখা করেছে।”

“যদি নিয়ে যেতে চায়, দিয়ে দিবি। তুই তো ওদের সত্যিকার বাবা নোস। সে যদি তার সন্তান চায়, তুই আমি আটকানোর কেউ না!”

বাবারা আসল, নকল হয় এই কথাটুকু বোধহয় জানা ছিল না আদনানের। জন্ম দিলেই শুধু বাবা হওয়া যায়, নয়তো বাবা হওয়া যায় না? বন্ধুর এই কথাটুকু মানতে পারলো না আদনান। চুপ করে বসে রইলো নিজের জায়গায়। তার দৃষ্টিতে শূন্যতা! ভেতরে ভয়। মনের ভেতর প্রশ্ন একটাই, ‘আমি ওদের আসল বাবা নই?’ কী সহজ কথা! অথচ এই সহজ কথাটাই তার জন্য দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“তুই বলতে চাস, ওদের প্রতি আমার সব অধিকার শেষ? আই মিন, আসল বাবা হলেই ওদের আটকে রাখতে পারতাম? আত্মিক যে টান, মায়া-মমতা, আদর-স্নেহ এসবের কোনো দাম নেই? এগুলো সব ফেইক? মিথ্যে? এক নিমিষেই সমস্ত ভালোবাসাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলবো? সাফফাত, সকাল থেকে আমি ওদের সাথে কথা বলিনি, ওদের কোলে নেইনি, স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আদরও করিনি! তুই বুঝতে পারছিস নিজেকে সামলানো আমার কতটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে? যেখানে কয়েকটা ঘণ্টা ওদেরকে দূরে রাখতে আমার বুক কাঁপছে, সেখানে বাকিগুলো দিন আমি থাকবো কী করে?”

বন্ধুর এই কথার ভেতরে থাকা সমস্ত যন্ত্রণা এসে তার বুকেও আঘাত করলো। বুঝতে পারলো, সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। ভেতরে মারাত্মকভাবে রক্তক্ষরণ করছে। একাকী সেটা সামলাতে পারছে না তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু। তাকে ভরসা দিতেই বলল,

“তুই তো রূহানীর সাথে কথা বলতে পারতি! সে আসলেই বাচ্চাদের নিয়ে যেতে চায় কি-না, এই বিষয়ে কনফার্ম না হয়ে শুধু শুধু বাচ্চাদের সাথে অন্যায় করছিস। আর নিয়ে গেলেও তো আমরা কিছু করতে পারবো না। কষ্ট হলেও এটাই সত্য যে, রূহানীর সাথে ওদের নাড়ির টান! এই টানকে অস্বীকার করার মতো সাহস আমাদের নেই।”

“ঠিকই বলেছিস! শত ভালোবাসলেও আসল বাবা-মায়েরই দাবী বেশি থাকে। যাক, নিয়ে যাক। আমি আটকাবো কেন! আমি তো ওদের কেউ না। ওদের উপর আমার এত কীসের অধিকার!”

“আদি, ব্যাপারটা তুই জটিল করে ফেলছিস। আগে রূহানীর সাথে পুরোপুরি আলোচনা কর।”

“অসম্ভব! আমি কোনো আলোচনায় যাব না। ওতো কীসের দায় আমার? আমি কেন আগ বাড়িয়ে এসব নিয়ে আলোচনা করবো? তার বাচ্চা সে নিবে নাকি ফেলে যাবে সেটা সে-ই ভালো জানে। আমি যেচে কারও সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেতে দিব না। অন্তত এই বিষয়ে একটা কথাও আমি বলবো না।”

এই জটিল বিষয়টা সমাধানের নির্দিষ্ট কোনো পথ জানা নেই সাফফাতের, সে শুধু জানে বাচ্চাদের জন্য ভাবতে হবে। হুট করে রূহানীকে মা হিসেবে ওরা কতটুকু মেনে নিবে, ওদের ছোট্ট মস্তিষ্কে তা কতটুকু প্রভাব ফেলবে, দুঃশ্চিন্তা এখন এটা নিয়েই। কীভাবে আলোচনা করলে সব সহজ হবে সেটাই ভাবতে লাগলো সে। সত্যিটুকু বাচ্চারা বিশ্বাস করবে কি-না তা-ও বুঝতে পারছে না সে। সহজে সেটা গ্রহণ করবে না-কি ভয়, আতঙ্ক ছোট্ট মনে কোনো আঘাত সৃষ্টি করবে, সেসব নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুব দিল সাফফাত। যে করেই হোক, সহজ একটা সমাধানে আসতে হবে। যেন বাচ্চারাও আঘাত না পায়, আর রূহানীও সবকিছুকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেয়। তার জন্য রূহানীর সাথে বিস্তারিত আলোচনায় নামার প্রয়োজন বোধ করলো সে।

*****

স্কুল ছুটির ঠিক আধঘণ্টা আগে বাড়িতে ফোন করলো আদনান। নোভা তখন দুপুরের রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে এমন ব্যস্ত ভঙ্গিমায় কথা বললো আদনান। জানালো,

“আমি একটা জরুরী কাজে আটকে গেছি। বাচ্চাদের বাড়িতে নিয়ে এসো। গাড়ি পাঠাবো?”

বাচ্চারা তাদের মায়ের কাছে ফিরে যেতেই পারে, মায়ের অধিকারটাই বেশি। কত ঝড়তুফান পেরিয়ে একটা মা সন্তান জন্ম দেয়। সেই মায়ের অধিকার থাকবে না তো আর কার থাকবে! আদনানের এই অবহেলা, বাচ্চাদের এড়িয়ে চলা, এটা খুব সহজে মেনে নিতে পারলো না নোভা। মনে হচ্ছে, ছেলেটা অকারণ ওদের কষ্ট দিচ্ছে। অবুঝ বাচ্চা, ওতো ঝামেলা, ওতো মান-অভিমান আর দূরত্বের কী বুঝে ওরা! ওদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, আদনান তো নিজেকেই কষ্ট দিচ্ছে। ওদের মনেও সন্দেহ জাগিয়ে তুলছে। এটাও যে সাজানো একটা কথা, শুধুমাত্র বাচ্চাদের এড়িয়ে যাওয়ার একটা অজুহাত মাত্র, তা খুব সহজেই বুঝে গেল নোভা। তার কথা বলার ধরন, কাজের ব্যস্ততা আর বাচ্চাদের প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে দিব্যি জ্ঞান আছে তার। একটা মানুষ জেনে-বুঝে যখন নিজের দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যায়, তখন আর তাকে কী বলে বুঝানো উচিত, সামলানো উচিত এ-ও জানা নেই নোভার। রাতে কতবার বুঝালো, অথচ মানুষটা সেই ত্যাড়া ত্যাড়া আচরণই করছে। কেমন অবুঝের মতো ব্যবহার করছে। যেন এগুলো তার দামী খেলনা!

“কী হলো, চুপ করে আছো কেন? গাড়ি কি পাঠাবো? একা নিয়ে আসতে পারবে?”

“থাক। গাড়ি লাগবে না। উবার ডেকে নিব।”

এইটুকু শোনার অপেক্ষায় ছিল আদনান। জবাব পেয়ে দ্রুত কল কেটে দিল সে। নোভাও হাতের কাজ ফেলে তড়িঘড়ি করে রওনা দিল বাচ্চাদের স্কুলের দিকে। বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে না। পনেরো থেকে বিশ মিনিটের পথ। উবার কল করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো তাকে। সবমিলিয়ে আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেল স্কুলের গেটে।

ছুটির ঘণ্টা পড়তেই হুড়মুড়িয়ে বাচ্চারা বেরিয়ে এলো। কর্তব্যরত মহিলা সব বাচ্চাদের অভিভাবকদের হাতের নাগালে নিয়ে আসলেন। জারা, নোরা তাদের মা’কে দেখে ছুটে আসলো। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে নোরা বলল,

“তুমি একা এসেছো? পাপা আসেনি?”

“পাপা কাজে আটকে গেছে সোনা। চলো আমরা যাই।”

“আইসক্রিম খাব!”

বায়না ধরলো নোরা। বাচ্চাদের এইটুকু আবদার ফেলার সাহস হলো না নোভার। কাছাকাছি থাকা আইসক্রিম পার্লার থেকে দু’জনের জন্যই আইসক্রিম কিনলো। সুবিধামতো খাওয়ার জন্য চেয়ারে বসিয়ে দিল। বলল,

“ক্লাসে ঠিকঠাক মনোযোগ দিয়েছিলে? মিস কোনো হোমওয়ার্ক দিয়েছেন আজ?”

“অনেক! পড়াশোনা করে কী হয় মাম্মা? রোজ রোজ এত পড়াশোনা একটুও ভালো লাগে না।”

মুখভার করে অভিযোগ দিয়ে বসলো জারা। নোভা হাসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেল। বলল,

“সঠিক মানুষ হতে হলে অনেক জানতে হয়। জানার জন্য পড়তে হয়। না পড়লে তো সবকিছু অজানা থেকে যাবে। সামনের পথ কখনওই সহজ হবে না।”

দু’জনের কেউ-ই এই কথাগুলোর অর্থ বুঝলো না। নোভা ফের বলল,

“পৃথিবীতে যত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আছে তারা সবাই অনেক পড়েছে। তুমি জীবনে যা-ই হও, সবার আগে মানুষ হতে হবে তোমাকে। মানুষ না হতে পারলে এসব সার্টিফিকেট কোনো কাজে আসবে না। জীবনের লক্ষ্য শুধু জ্ঞানী হওয়া নয়, বরং একজন ভালো মানুষ হওয়া। প্রকৃতপক্ষে সঠিক মানুষ তারাই যারা অন্যের জন্য নিজের সুখকে বিসর্জন দেয়। অন্যের সুখে নিজেকে সুখী ভাবতে পারে। এজন্য মানুষ হতে হলে, শিক্ষার যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন বিবেক বুদ্ধিরও। তোমরা তো অনেক ছোটো, এতসব কথা এখনই বুঝবে না। যখন বড়ো হবে তখন বুঝবে, মাম্মা কেন এসব বলে! আমি চাই, তোমরা সঠিক মানুষ হও। নামের পিছনে টাইটেল নিয়ে নয়, মনের ভেতরে মনুষ্যত্ব জাগিয়ে মানুষ হও।”

“তাহলে অনেক পড়তে হবে?”

ভাবুক নয়নে প্রশ্ন করলো নোরা। নোভা তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

“হ্যাঁ! অনেক পড়তে হবে। আঁধার পেরিয়ে আলোর দিকে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রেখো, জীবনে যত কঠিন সময়ই আসুক না কেন, ধৈর্য্য হারাতে নেই। স্রষ্টার উপর থেকে বিশ্বাস সরাতে নেই। আঁধার যখন তিনি দিয়েছেন, আলোটাও তিনি দেখাবেন। শুধু ধৈর্য্য নিয়ে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হবে। যখন মাম্মা থাকবো না, তখন নিজেরাই নিজেদের সামলাতে শিখবে।”

“কেন থাকবে না? তুমি কোথায় যাবে?”

কাঁদো কাঁদো গলায় প্রশ্ন করলো জারা। ওইটুকু বয়সে এতসব কথা হজম করতে পারছে না দু’জনে। শুধু তাদের মাম্মা থাকবে না, এই কথাটা বুঝতে পারলো না দু’জনের কেউ-ই। পালাক্রমে দু’জনকে চুমু খেল নোভা। ভেতরের ভয়টা কাটাতে বাচ্চাদেরকে একটু একটু করে বুঝাচ্ছিলো সে। আসলে ওটা বাচ্চাদেরকে বুঝানো নয়, বরং নিজের জন্যই স্বান্তনা খোঁজার বৃথা চেষ্টা মাত্র।

“এ্যাক্সকিউজ মি! আপু একটু সময় হবে আপনার?”

কিছু বলার আগেই একটা আওয়াজ শুনে সামনে তাকালো নোভা। অপরিচিত অথচ সেই মায়াবী মুখখানি দেখে দৃষ্টি থমকে গেল তার। চিনতে ভুল হলো না যে, তার থেকে চার হাত দূরে থাকা নারীটিই রূহানী সিকদার। জারা, নোরার জন্মদাত্রী মা। তবে কি রূহানী তাদের ফলো করে এখানে এসেছে? বাচ্চাদেরকে নিয়ে যেতে এসেছে?

“জি…? আপনি?”

হাসিমুখেই এগিয়ে এলো রূহানী৷ বাড়তি চেয়ারে বসে দু’জনের গালেই চটজলদি চুমু খেল। বলল,

“আপনার সাথে জরুরী কিছু কথা আছে! আধঘণ্টা সময় নিব। শুনবেন?”

কী মিষ্টি আওয়াজ! চেহারা যেমন মায়াবী, কণ্ঠস্বরেও তেমন মুগ্ধতা। তবে ঠোঁটের কোণে হাসি থাকলেও চোখের মাঝে রাজ্যের বিষণ্ণতা। কান্নার ছাপ তার চেহারায় স্পষ্ট। কাঁদলে চেহারা কেমন হয়, তা নিজেকে দিয়েই খুব ভালোভাবে বুঝেছে নোভা। সাহস হলো না, এই মেয়েটার করুণ আকুতি উপেক্ষা করার। মৃদুস্বরেই উত্তরে বলল,

“অসুবিধা নেই। আপনি বলুন।”

“আদনান ভাইয়ার কাছে নিশ্চয়ই সব শুনেছেন? সব কথা কি আমি আবারও বলবো, নাকি শুধু প্রয়োজনীয় আলাপটাই সারবো? ওহ হ্যাঁ, আমাকে চিনতে পেরেছেন তো? আমার পরিচয়?”

“জানি! আমি সবকিছুই শুনেছি। আপনি যা বলতে চান বলতে পারেন।”

“আমি চাইলেই সব কথা আপনার হাসব্যান্ডকে জানাতে পারতাম। কিন্তু কিছু কথা সবার সাথে শেয়ার করা যায় না। এ কারণেই স্কুলে আসা। আমি ওনাকে ফোন করেছিলাম, জানতে পারলাম আপনি স্কুলে। তাই এখানে আসলাম। বিরক্ত করলাম?”

“একদমই না। আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। এমনিতেও আমি ফ্রি আছি। তাছাড়া আপনাকে সামনা-সামনি দেখার একটা আগ্রহ ছিল মনে, ভালোই হলো দেখা হয়ে গেল। আপনি চাইলে যা কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ আপনি মা! আপনার ইচ্ছের কাছে, অধিকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা সবসময়ই তুচ্ছ!”

নির্ভার হাসি ফুটালো রূহানী। বাচ্চাদেরকে নোভা এতক্ষণ যা যা বলেছে, সবই সে শুনেছে। এ-ও বুঝেছে, বাচ্চারা তাকে কতটুকু ভরসা করে, ভালোবাসে। আর সে-ও কীভাবে বাচ্চাদেরকে সাপোর্ট করে। কেউ দেখলে বুঝবেই না যে, নোভার সাথে বাচ্চাদের মাতৃত্বের কোনো সম্পর্কই নেই। যা আছে তা শুধু, হৃদয়ের মজবুত সম্পর্ক। যে সম্পর্ক চাইলেই ভে*ঙে ফেলা যাবে না। এই দৃশ্য দেখে ভেতরে থাকা সমস্ত দুঃশ্চিন্তাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলেছে সে। মন বুঝে গেছে, শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না; তারচেয়েও বেশি কিছুর প্রয়োজন পড়ে। বুকের ভেতরে জমে ওঠা যন্ত্রণার পাহাড় একটু একটু করে ভেঙেচুরে ঝুরঝুরে বালিতে পরিণত হলো তার। মনে হলো, পৃথিবীতে বিশ্বস্ত কিছু মানুষ আছে বলেই, বিশ্বাস টিকে আছে। মানুষ বেঁচে আছে সেইসব বিশ্বাসকে সঙ্গী করে।

*****

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here