সম্পূর্ণা-২
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
বিশাল বড়ো রাস্তার মাঝখানে মাত্রাতিরিক্ত জ্যামে আটকে আছে সে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে হাইওয়েতে এই জ্যাম চলছে। যদি গ্রীষ্মকাল হতো এতক্ষণে অতিষ্ঠ হয়ে যেত আদনান। মেজাজটা চরম খিঁচড়ে গেছে। একেই তো অনির্ধারিত জ্যাম তার উপর আজকেই ঝামেলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। রেদোয়ান হাসান এইবার পুরোদমে উঠেপড়ে লেগেছেন ঘরে ছেলের বউ তোলার জন্য অথচ সে কোনো অজুহাতই দেখাতে পারছে না।
এত বড়ো ব্যবসা এই বয়সে এসেও তাঁকেই সামলাতে হয় অথচ আদনান দিনরাত তার নিজের কাজে ব্যস্ত। ব্যবসার দ্বার ধারে না সে। তার যত কাজ সব খাবার-দাবার নিয়ে। রেস্টুরেন্ট নিয়ে। কপালে এই মুহূর্তে দু’তিনটে ভাঁজ পরিলক্ষিত তার। হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নিল একবার। এখনো আধঘণ্টা বাকি নির্ধারিত সময়ের। ঠিকমতো পৌঁছাতে পারবে কি-না কে জানে! মেয়ে মানুষকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ হয় তার, এইজন্য সবসময়ই সময়ের আগে পৌঁছে যায় সে। অথচ আজকেই এত দেরী হচ্ছে। এতক্ষণে হয়তো মেয়ে দুটো চলে এসেছে! কী না কী ভেবে বসে কে জানে!
আরো চল্লিশ মিনিট সময় পেরিয়ে জ্যাম থেকে মুক্তি মিললো আদনানের। ধীরে ধীরে জায়গাটা ক্রস করে মোড় ঘুরিয়ে গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল। একটানে চলে এলো চৌমহনা রোডে। রেস্টুরেন্টের সামনে এসে রেদোয়ান হাসানের নাম্বারে ফোন দিয়ে বলল,
“বাবা আমি পৌঁছে গেছি।”
“তুই কিছু সময় অপেক্ষা কর। নোভাও মাত্র বেরিয়েছে। পৌঁছাতে বেশিক্ষণ লাগবে না।”
“আমি চিনবো কীভাবে?”
“হোয়াটসঅ্যাপ ওপেন কর ছবি পাঠাচ্ছি। ওরা দু’জন আসবে। তোর নাম্বার দিয়েছি আমি, মুনতাহা কল করে নিবে।”
“তার নাম্বারটাও আমাকে দাও।”
“ফোন রাখ। দিচ্ছি।”
“বারণ করেছিলাম, তবুও কেন যে জোর করলে!”
“একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবি না। মেয়েটা আমার অনেক পছন্দের। তোরও পছন্দ হবে দেখিস।”
“আচ্ছা দেখি। পছন্দ না হলে আমি কিন্তু রিজেক্ট করে দিব।”
“আদি, আমি তোকে আগেই সব বলেছি। এই মেয়েকেই আমার বউমা হিসেবে চাই।”
“আমার পছন্দের কোনো মূল্য নেই?”
“থাকবে না কেন? এত বছর তোকে সময় দিয়েছি। তুই আমাকে ঘুরিয়ে মা’রছিস। নিজে তো কাউকে পছন্দ করছিস না, আবার আমাকেও এগোতে দিচ্ছিস না। এভাবে চলতে থাকলে কোনদিন যে চোখ বুঁজে ফেলবো টেরও পাবি না। তখন তোর মা যদি জানতে চায়, আমার ছেলেটাকে পৃথিবীর বুকে একা ফেলে আসলে কেন? কী জবাব দিব! অন্তত তোর মায়ের কাছে জবাব দেয়ার একটা পথ করে যাব। তবেই যদি একটু শান্তি পাই।”
আদনান ফোন কে’টে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো রেস্টুরেন্টের সামনে। বাবা তাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমে’ইল শুরু করে দিয়েছেন। কী করবে সে? অপছন্দ হলেই বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে? কোনো না কোনো উপায় বের করতেই হবে। এভাবে হুট করে অচেনা কোনো মেয়েকে জীবনসঙ্গী করা যায় না-কি! জীবনসঙ্গী হলেও মনের মিল হবে তো? বন্ডিংটা কেমন হবে? অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করে সুখী হতে পারবে সে? ভাবতে পারে না আদনান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে লিফটে পা রাখে সোজা উপরে চলে যায়।
*****
একটা টেবিল বুকড করে কফি সামনে নিয়ে বসে আছে আদনান। বার বার ঘড়িতে টাইম দেখছে তবুও কাঙ্ক্ষিত দু’জন নারীর কোনো দেখা মিলছে না। ছবিটা দেখেই চোখদুটো কুঠরে ঢুকে গেছে তার। সামনা-সামনি একটু আলোচনার প্রয়োজন আছে। কললিস্ট থেকে একটা নাম্বার বের করে কাউকে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর আচমকা একটা কল ঢুকলো তার ফোনে। অপরিচিত নাম্বার দেখে ভ্রু কুঁচকে রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে সালাম দিয়ে বলল,
“জি আমিই আদনান। আপনারা কর্ণারে চলে আসুন।”
ফোন হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। সামনের দিকে দৃষ্টি দিল। একটা মায়াবী চেহারায় অদ্ভুত সুন্দর হাসিটা লেপটে রয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই এই মুখটাকে ফোনের স্ক্রিনে টেনেটুনে দেখে গম্ভীরমুখে নিজের বাবার পূর্বপুরুষের গোষ্ঠী উদ্ধার করছিল সে। যদিও গোলগাল সেই মুখশ্রীতে উপচে পড়েছে রাজ্যের মায়া জড়িয়ে রয়েছে, তবে ভেতরে তার অকারণ দুঃশ্চিন্তা শুরু হলো! সঙ্গে আরেকটা মেয়েও আছে। দু’জনেই একসাথে হেসে হেসে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। চোখের সামনে হাতের নাড়াচাড়া টের পেয়ে ভ্রু নাচালো আদনান। মুনতাহা হেসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। আমি মুন, আর ও আমার কাজিন নোভা! আংকেল বলেছেন নিশ্চয়ই?”
“হ্যাঁ! বসুন আপনারা।”
প্রচণ্ড অবাক হলো আদনান। মুনতাহা যতটা স্বাভাবিক তার তুলনায় নোভার চেহারায় চরম অস্বস্তি! পুরো ব্যাপারটা আন্দাজ করে শুকনো গলায় ঢুক গিললো আদনান। এতক্ষণ এই গোলগাল চেহারাটা তার কাছে মায়াবী মনে হলেও এখন অন্যকিছু মনে হচ্ছে। আচমকা প্রচণ্ড ভয় পেতে শুরু করলো আদনান। সে যে নিয়মকানুন মেনে চলে তার ধারেকাছেও নোভার যাওয়া-আসা নেই! নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে জানা নেই। তবে এই মানুষগুলোর সাথে খারাপ ব্যবহার করা চলে না। সুপ্ত একটা শ্রদ্ধাবোধ টের পেল সে। নারীজাতিকে অপ’মান, কটু’ক্তি এসব তাকে দিয়ে হয় না।
আদনানের এমন বিমর্ষ চেহারা দেখে ভরকে গেছে নোভা। পাত্র তাকে রিজেক্ট করার চিন্তাভাবনা করছে, এটাই বুঝতে পারছে সে। অবশ্য এতে তার আফসোস নেই। এই নিয়ে অসংখ্যবার রিজেক্ট হয়েছে সে, বিন্দুমাত্র আক্ষেপ হয় না তার। তবুও আজ ভেতরে প্রচণ্ড ছটফটানি অনুভব হচ্ছে। কী যে হতে চলেছে কে জানে! দু’জন মানুষের নীরবতার মাঝখানে মুনতাহা কথা বলল,
“ভাইয়া, দু’জনে কথা বলে নিন। আমি সামনেই আছি।”
“অসুবিধা নেই। আপনিও থাকুন। এতে উনি ইজি ফিল করবেন। অযথা অস্বস্তি বাড়াতে চাইছি না। তার আগে কিছু অর্ডার করি। কী খাবেন বলুন!”
“কফি হলেই চলবে। আমি বরং পাশের টেবিলে যাই। স্পেস তো থাকা উচিত তাই না?”
“থ্যাংকস্ বুঝার জন্য।”
মুনতাহা হাসলো। দু’পা হেঁটে আলাদা একটা টেবিলে চলে গেল। চেয়ারে বসে ফোন হাতে নিয়ে তাতে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করলো। আপাতত পাশের টেবিলের দিকে তার দৃষ্টি নেই।
চরম নার্ভাসনেস সাথে নিয়ে চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে আছে নোভা। হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে বার বার ঘাম মুছছে। রেস্টুরেন্টে এ্যাসি থাকার পরেও সে ঘামছে। আতঙ্কে, লজ্জায় ফর্সা গালদুটো লাল হয়ে যাচ্ছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘামের উপস্থিতি টের পেয়ে টিস্যু চেপে ধরলো সেখানে। আদনান বেশ মনোযোগ দিয়েই সেটা লক্ষ্য করছে। মেয়েটা তার সামনে কতটা ইতস্ততভাবে বসে আছে সেটা ভেবেই হাসি পেল তার। ফোনটা টেবিলের কর্ণারে থাকা আলাদা একটা টিস্যুর উপর রেখে নোভার দিকে দৃষ্টি দিল একবার। নীরবতা ভেঙে বলল,
“বি ইজি ম্যাম! এত ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমি একজন সাধারণ মানুষের দলেই পড়ি।”
ইশ! ছেলেটা তার নার্ভাসনেসটা ধরতে পেরেছে। কী লজ্জার ব্যাপার হলো এটা! এতটাও আতঙ্কিত হওয়া মানাচ্ছে না তাকে। রোজ কত পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা হয় তার, ওঠাবসাও হয়, কখনো তো এত লজ্জা, অস্বস্তি এসে ভর করেনি! তবে আজকেই কেন? নোভা আরও জড়োসড়ো হয়ে গেল নিজের জায়গাতেই। খানিকটা কেঁপে কেঁপে বলল,
“আ’ম অলমোস্ট ফাইন। আপনার যা জিজ্ঞেস করার একটু দ্রুত করুন।”
“আচ্ছা। আপনি একটু স্বাভাবিক হয়ে বসুন। এত আনইজি ফিল করে বসতে হবে না। ক’টা সহজ কথা বলবো, সহজভাবে নিবেন।”
“জি…!”
“একটু আগে আমার একটা ফোন এসেছিল। দুটো বাচ্চা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আসলে, আমাকে খুব তাড়াতাড়ি যেতে হবে।”
নোভা কিছু বললো না তবে চুপ করে মাথা নাড়লো। আদনান গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলল,
“বাবা আপনাকে পছন্দ করেছেন! এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার বাবার পছন্দই আমার পছন্দ। কনে, কালো নাকি ফর্সা সেটাও জানতে চাইনি আমি। আমি আমার বাবার কথাকে মূল্যায়ন করি। আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি ফালতু লেকচার দিচ্ছি তবে সেটা ভুল।”
“দেখুন, অপছন্দ হলে সেটা সরাসরি আমাকে বলে দিতে পারেন। এতে এত ভাবাভাবির কিছু নেই। মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ থাকতেই পারে। সবারই নিজ নিজ চাহিদা আছে। নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দেয়ার অগ্রাধিকার সকলের পাওয়া উচিত। আমি চাইবো, আপনি আপনার বাবার কথা না শুনে নিজের মনের কথা শুনুন। এতে নিজেও স্বস্তি পাবেন আর আমিও। অপছন্দ সেটা জেনে কারো ঘাড়ে চাপার মতো এতটাও বোঝা হইনি।”
চমৎকার শুনালো কথাটা! আদনান অবাক চোখে তাকালো। সরু চোখে গভীর দৃষ্টি ফেলে অচেনা নারীটির মনোভাব বুঝার চেষ্টা করলো। তার মুখবয়ব দেখেই আন্দাজ করলো, মেয়েটা যথেষ্ট রেগে গেছে তার কথায়। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বললেও, তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জোর তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে, মেয়েটা সরাসরি কথা বলাতে ওস্তাদ। একদম ঠোঁটকা’টা স্বভাবের! নিজের এমন আচরণের জন্য খারাপ লাগা অনুভব করলো আদনান। জবাবে বলল,
“আ’ম সরি! আপনি বোধহয় আমার কথায় রাগ করলেন?”
“না, না। মোটেও রাগ করিনি। বরং আপনার সহজ কথা খুব সহজেই বুঝতে পেরেছি। আমরা তাহলে আসি?”
নোভা উঠে দাঁড়াতে চাইলে আদনান ফের বলল,
“কথা তো শেষ হয়নি। আপনি একটু ধৈর্য নিয়ে বসুন। আমি আরও কিছু বলতে চাই।”
*****
তখন ওয়েটার অর্ডারকৃত কফি নিয়ে আসলো। আদনান একটা কফি মুনতাহার দিকে বাড়িয়ে দিল। মুনতাহা ফের হাসি দিয়ে বলল,
“আমিই নিয়ে নিতাম।”
“বড়ো ভাই হয়ে নাহয় একটু খেয়াল রাখলাম!”
পক্ষান্তরে স্বচ্ছ এক হাসি ফুটালো মুনতাহা। নোভার দিকে কফির আলাদা কাপটা বাড়িয়ে নিজেরটাতেও চুমুক দিল আদনান। একটু আগেই এক কাপ খেয়ে নিয়েছে। এখন শুধু ভদ্রতা রক্ষার্থে কফিটা নেয়া। নোভার আতঙ্ক তখনও কাটেনি। আদনান ধীরেসুস্থে বলল,
“কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে!”
“ক্ষিধে নেই।”
“ক্ষিধে পেলে মানুষ কফি খায়?”
ফিক করে হেসে ফেললো নোভা। মুনতাহাও হাসলো। আদনান আড়চোখে সেই হাসিটা পরখ করলো। গজ দাঁতের হাসিটা তো ভীষণ সুন্দর! সবই পারফেক্ট! একটাই সমস্যা, মেয়েটার ফিটনেস। যদি স্লিম হতো, নির্ঘাত ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিতে দ্রুত নাম ছড়াতো। নামি-দামি মডেল হতে পারতো! ফুঁস করে দম ছাড়লো সে। অচেনা মেয়েকে নিয়ে এত ভাবছে কেন? কোনোভাবে পাশ কাটাতে পারলেই হলো। এবার নোভা বেশ স্বাভাবিক হলো। যতটা মুডি মনে হয়েছিল, ততটাও না। ছেলেটা আলাদাই মনে হচ্ছে। মিশুক স্বভাবের। নড়েচড়ে বসে জানতে চাইলো,
“বাচ্চাদুটো কারা?”
আচমকা প্রশ্ন শুনে ভরকে গেল আদনান। ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। তারপর বলল,
“আমার।”
“মানে! আপনি বিবাহিত?”
“আসলে, বাবা সেটা জানেন না!”
“আপনি আমার পরিবারের লোকজনকে মিথ্যে বলেছেন! ছিঃ ছিঃ। বিবাহিত হয়েও, আবারও বিয়ে করার কী মানে?”
“আপনি একটু বসুন প্লিজ। আমি বলছি।”
“আর কী বলবেন আপনি? একজন মেয়ে
মানুষ দিয়ে আপনাদের মতো পুরুষের পুষোয় না। টাকার গরম দেখিয়ে আমাদের মতো অসহায় মেয়ে মানুষের জীবনটাকে সস্তা বানিয়ে ফেলেন। এভাবেই বুঝি মেয়েদের নিয়ে ব্যবসা করেন?”
রাগে, অপমানে থমথমে হয়ে গেল আদনানের চেহারা। চোখদুটো খানিকটা লালও হলো। দৃষ্টিকে সংযত রাখলো, সেইসাথে মেজাজের ওঠানামার পারদটাও দ্রুত কন্ট্রোল করে নিল। মেয়েটা সরাসরি কথা বলা মানুষ এটা সে বুঝে গেছে, তাই বলে এভাবে বলা ঠিক হলো? কাউকে না জেনে, এমন মন্তব্য কেউ করে কী করে! তবুও বাবার কথার মর্যাদা রাখতে একটুখানি সহ্য সে করবেই। নিজেকে পুরোপুরি সামলে বলল,
“ম্যাডাম, আপনি কিন্তু ভুল বুঝছেন। আমার পুরো কথাটা তো শুনবেন। কাউকে পুরোটা না জেনে, না বুঝে তার সম্পর্কে বা’জে কমেন্ট করা উচিত হয়নি আপনার! আমাকে কতটা চিনেন আপনি?”
“সরি! আমি মোটা হতে পারি, পেটুক হতে পারি। কিন্তু অসহায় নই। নিজের অস্তিত্বের বিসর্জন দিয়ে, আত্মসম্মান বলি দিয়ে কোনো বিবাহিত, বউ-বাচ্চা থাকা পুরুষের সঙ্গে নিজেকে জড়াবো না। আসছি…!”
নোভা উঠে দাঁড়ালেই আদনান চট করে অনুরোধসূচক ‘প্লিজ শুনুন’ বলে তাকে আটকে নিল। আশ্চর্য! এর আগে কখনো কোনো মেয়ে মানুষের সাথে এমন আচরণ করেনি সে। আজই উল্টাপাল্টা কিছু হচ্ছে তাকে দিয়ে। এত জোর কেনই বা করছে সে! হুট করে সিচুয়েশন পালটে যাচ্ছে, কথার স্বর বদলে যাচ্ছে, রাগতে গিয়েও ঠিকঠাক রাগটাকে আঁকড়ে ধরা যাচ্ছে না বরং খুব বেসামালভাবেই তা গতি হারিয়ে বাঁকা পথে দৌড়াচ্ছে। অযাচিত এমন আচরণে নিজেই দোটানায় পড়লো আদনান। তবুও যথেষ্ট শান্তস্বরে বলল,
“ভুল বুঝছেন। আসলে আমি সত্যটা আপনাকে জানাতেই এসেছি। সব জেনে যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে তবে আমার দিক থেকেও কোনো আপত্তি আসবে না। আগে আপনি সবটা শুনুন।”
মুনতাহা এবার চোখ ঘুরিয়ে দু’জনের দিকেই তাকালো। নোভার দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে নিল। আদনানের দৃষ্টিতে শূন্যতা। অথচ তার বোনটার চেহারা কেমন কঠোর। দয়ামায়াহীন এক নিষ্ঠুর মহিলার রূপ ফুটে উঠেছে তার চেহারায়। নিজেই খানিকটা গলা উঁচিয়ে বলল,
“আপু, রিকুয়েস্ট যখন করছেন পুরো কথাটা শুনেই যাই। এত রি’অ্যাক্ট করছো কেন তুমি?”
দপ করে চেয়ারে বসলো নোভা। ভীষণ জোরে শব্দ হলো। রাগে পুরো গা জ্বলে যাচ্ছে তার। আদনান কেমন ভীরু চোখে তাকালো। স্বভাবতই মেয়েরা কোমল স্বভাবের হয়। হাসি-খুশি আর প্রাণবন্ত! জীবনে অসংখ্য রাগী মানুষ দেখেছে সে, তবে নোভার মতো এমন মেয়ে কখনো চোখে পড়েনি। যেমন রাগ, তেমনি তার বোধশক্তি আর আচার-আচরণ। স্বাভাবিক হয়ে বসে মূল আলোচনায় যেতে চাইলো সে। ফোনের গ্যালারি থেকে দুটো বাচ্চার ছবি বের করে নোভার সামনে তুলে ধরলো। বলল,
“ওরা জমজ। পাঁচ বছর বয়স। রূহানীকে লুকিয়ে বিয়েছিলাম। ভালোবাসতাম তাকে। ও নিজেও আশ্রমে বড়ো হয়েছে। বাবা মানবেন না তাই পালিয়ে বিয়ে করি। এই শহরেই আলাদা বাসায় তাকে উঠাই। বিয়ের এক বছরের মাথায় এই দুই বাচ্চাকে জন্ম দিতে গিয়েই রুহী মা’রা যায়। বাবার ভয়ে বাচ্চাদের বাড়িতে আনতে পারিনি। তাই…!”
“তাই কী?”
“ওদেরকে অনাথ আশ্রমে রেখে বড়ো করছি। ওরা বায়না ধরেছে ওদের মা’কে নিয়ে যেতে। আমি অপারগ! ওদের মা’তো নেই। কাকে নিয়ে যাব? আপনি যদি ওদের মা হওয়ার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেন, তবে এই বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আপনি যেমনই হোন, তেমনি ওদের মা হয়ে উঠবেন। এবার সিদ্ধান্ত আপনার হাতে! আমি অপেক্ষা করবো! ফোন করবেন তো নিশ্চয়ই?”
নোভা কী রি’অ্যাক্ট করবে ভেবে পাচ্ছে না। তবে ছেলেটাকে একটু আবেগী মনে হচ্ছে। মৃ’ত স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছে! আহারে, বাচ্চাদুটো! মায়ের অভাবে দিনদিন ছন্নছাড়া জীবন কাটাচ্ছে। বাবা থেকেও যেন নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুনতাহার দিকে তাকালো। নিজের এই অনাকাঙ্ক্ষিত রাগ আর কথাগুলোর জন্য লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো সে। না বুঝে মারাত্ম’ক বা’জে কথা বলে ফেলেছে। ছেলেটা যদি খারাপ কিছু ভাবে! উঁহু, সে তো এমন নয়! তবে কেন এমন ব্যবহার করতে গেল? নোভার এমন দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ চেহারা দেখে মুনতাহা বলল,
“ভাইয়া, আমরা তাহলে আসি। সিদ্ধান্ত পরে এক সময় জানিয়ে দিব।”
“আমি পৌঁছে দেই?”
“তার আর দরকার নেই।”
“এই কথাগুলো কাউকে জানাবেন না দয়া করে। শুধু আপনারা দু’জনের মাঝেই রাখবেন। আমি চাই না, কথাটা আমার বাবার কানে পৌঁছাক।”
মুনতাহা মাথা নেড়ে নোভাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। এক সময় লিফটে ওঠে নিচে চলে এলো। আদনান ঠায় দাঁড়িয়ে ঠোঁট চেপে কারো নাম্বারে ফোন করে বলল,
“ওদের সামলে রাখুন, আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি!”
****
চলবে…