সম্পূর্ণা-২০ ( অন্তিম পর্ব)

0
1021

সম্পূর্ণা-২০ ( অন্তিম পর্ব)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

মৃ’ত্যু! চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের মতোই জ্বলজ্যান্ত সত্য। এই সত্যকে অবলম্বন করেই প্রাণীকুল বাঁচে-ম’রে। করুণাময় পৃথিবীতে যত প্রাণীই সৃষ্টি করেছেন, সব প্রাণীকেই দিয়েছেন মৃ’ত্যুর স্বাদ! যা কিছুর জন্ম হয়েছে তার মৃ’ত্যু নিশ্চিত। কোনোকিছুই এখানে চিরস্থায়ী নয়। মানুষ, জীবজন্তু, পাখপাখালি, সবকিছুরই মৃ’ত্যু নিশ্চিত করেই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। এখানে কেউ-ই চিরস্থায়ী বাসস্থান তৈরী করতে আসেনি। ক্ষণস্থায়ী জীবনের যা কিছু প্রাপ্তি তা জীবিত অবস্থায়ই মানুষ উপলব্ধি করে, মৃ’ত্যুর পর সবকিছু মিছে হয়ে যায়। প্রাণপাখি যখন দেহ ছেড়ে উড়ে যায়, শূন্য দেহটাই শুধু পড়ে রয়। সাড়ে তিন হাত ওই কবরের মাটিতেই মিশে যায় মানুষের পুরো অস্তিত্ব! মিশে যায় ইহকালের স্বাদ, আহ্লাদ, ভালোবাসাটুকুও।

জারা, নোরা জানে না মৃ’ত্যুর সংজ্ঞা কী! জানে না, রূহানীর সাথে তাদের সম্পর্ক কী! ওইটুকু দুটো বাচ্চা একটা নিথর দেহকে দেখে শরীর কাঁপিয়ে কাঁদছে। মাত্র দু’দিনে কারও প্রতি এত মায়া জন্মে? সে যে মা! মা বলেই কি নাড়িরটান এত মজবুত! হয়তো। লা*শবাহী গাড়িতে বরফের কফিনে ঘুমন্ত নারী তাদের মা, এই কঠিন সত্যিটা তারা আজ জানে না, বুঝে না, সেই সম্পর্কে কোনো ধারণাই তাদের নেই, অথচ মাত্র কয়েকটা ঘণ্টার ব্যবধানে এই নারী তাদের এতটাই আপন হয়েছিল যে, আজ তার মৃ’তদেহ দেখে দুটো অবুঝ বাচ্চাও কাঁদতে বাধ্য হচ্ছে। ভদ্রমহিলা চেষ্টার কোনো কমতি রাখেননি। তাতে কী হবে? যে যাওয়ার সে তো যাবেই। তাকে আটকানোর সাধ্য আছে কারও? নেই। সেই ক্ষমতা কোনো সৃষ্টিকে দেননি স্রষ্টা। দেননি বলেই, মানুষ চাইলেই পারে না মৃ’ত্যুকে ঠেকাতে! সকল ক্ষমতা তো কেবল একজনেরই হাতে। যিনি জীবন দিয়েছেন, তিনি প্রয়োজনে জীবন নিতেও পারেন! বান্দার কী ক্ষমতা আছে, মৃ’ত্যু আটকে স্রষ্টার হুকুম তামিল করার!

রূহানীর মৃ’তদেহ নিয়ে একটু ঝামেলা তৈরী হলো! ফারদিন চৌধুরী প্রথমে মানতেই চাননি! তিনি কোনোভাবেই চাননি, নিজেদের পারিবারিক কব’রস্থানে রূহানীর দা’ফন হোক, জানা’যা হোক! মৃ’ত্যুর কথা শুনে তিনি খুব সহজেই আদনানকে বললেন,

“বেওয়ারিশ হিসেবে চালিয়ে দাও! সে আমাদের রক্তও না, আত্মীয়ও না!”

প্রিয় বন্ধুর বাবা হোক কিংবা মুরব্বি ব্যক্তি হিসেবে হোক, প্রবাসী ফারদিন চৌধুরীর এই কথা গ্রহণ করতে পারলো না আদনান। কোথাও যেন মনের ভেতর একটা খচখচানি শুরু হলো! অন্তত মানুষ হিসেবে তিনি তো বলতেই পারতেন, ‘দাফ’নটা এখানেই হোক!’ অথচ তিনি কেমন কঠোর কণ্ঠে বললেন, ‘রূহানী তাদের কেউ হয় না!’ মানুষ কত সহজেই মানুষকে পর ভেবে নেয়, আবার কত সহজেই আপন ভেবে বসে! মানুষের মন যে সেকেন্ডে, মিনিটে পাল্টাতে পারে এই সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে আদনানের। নিজের জন্য না হোক, অন্তত বন্ধুর সম্মানে, একটা মানুষকে মানুষ ভেবে তার দাফ’নকাজটা সুষ্ঠুভাবেই সম্পাদন করা উচিত বলে মনে করলো সে। শান্ত অথচ ধীরকণ্ঠে বলল,

“আংকেল, সে আপনার কেউ না হলেও আপনার ছেলের বিবাহিতা স্ত্রী! আপনার ছেলের মৃ’ত্যুর পর সেই যে মেয়েটা স্বামীর সম্মানে জীবনের সব রঙকে তুচ্ছ করে একাকী জীবন বেছে নিল, তার সম্মানের দিকে তাকিয়ে এইটুকু অনুমতি আমাকে দিন। দুটো মানুষ তো আজ সে-ই একই জায়গারই বাসিন্দা! প্লিজ আংকেল। আপনাদের ওখানে দাফ’নের কাজে বাঁধা আসলে ভাববেন না যে, তাকে আমি বেওয়ারিশ হিসেবে দাফ’ন করবো! প্রয়োজনে আমাদের পারিবারিক কব’রস্থানে দাফ’নের ব্যবস্থা হবে। তা-ও তার পরিচয়হীন জানাযা হবে না। এমন না যে তার কোনো পরিচয় নেই৷ সে আপনার ছেলের আইনত স্ত্রী! আপনার বাড়ির সম্মান। তাছাড়া এক মৃত্যু পথযাত্রীর শেষ ইচ্ছে ছিল, পাশাপাশি কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হবে। এইটুকু ভেবে…!”

ফারদিন চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ভেবেচিন্তে কাজটা করতে মতামত পাল্টালেন। হয়তো ভেতরের কোথাও ছেলের ভালোবাসার মানুষটার প্রতি সম্মান জেগে উঠেছে। সেই সম্মানকে বাঁচিয়ে রাখতেই বললেন,

“বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছে কব’রস্থানের গেটের চাবি আছে। ওটা তোমার কাছে রেখে দিও। পারলে মাঝেমধ্যে ওদের কব’র জেয়ারত করো। আমি তো আর দেশে ফিরবো না। ছেলের কবরও দেখা হবে না। তুমি সবকিছু দেখে রেখো। ভালো থাকো। রাখলাম।”

ভদ্রমহিলা এতক্ষণ শুধু আদনানের ধৈর্যের অপেক্ষায় ছিলেন। ফোন রাখার পর যখন সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তখন তিনিও নিশ্চিত হলেন। শত দৌড়ঝাঁপ থামার সময় হয়েছে। জানাযার পরপরই তাঁকে রওনা দিতে হবে চট্টগ্রামের পথে। মেয়েটার পিছুটান ছিল, তার বাচ্চাদুটো। সেই আদরের বাচ্চাদের ফেলে অন্ধকার ঘরের বাসিন্দা হয়ে গেছে সে। আর কোনো পিছুটান নেই, নেই কোনো দুঃখকষ্টও। শুধু এই পৃথিবীর কিছু নিকৃষ্ট মানুষের জন্য রেখে গেছে একরাশ অভিযোগ, অভিমান আর ঘৃ’ণা। যারা বেঁচে থাকতে তাকে সম্মান দেয়নি, দেয়নি মানুষ হিসেবে পরিচয়। হি*জ*ড়ার মেয়ে হিসেবে যে ছিল সমাজের অতি নিকৃ*ষ্ট মানুষের একজন! যার জন্ম পরিচয় কিছুই ছিল না। এই পৃথিবী যাকে প্রতি পদে পদে অপমানের সাগরে ভাসিয়ে মৃ’ত্যুর দ্বারে পৌঁছে দিয়েছে, সেই পৃথিবীকে ক্ষমা করাও বড্ড দায় ছিল তার জন্য। তবুও দিনশেষে একটা জায়গায় সে ছিল সুখী! যারা তাকে আপন ভেবে পাশে থেকেছে, তাদের জন্য একবুক ভালোবাসা রেখেই পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে রূহানী সিকদারের নাম, অস্তিত্ব! সে এখন শুধুই স্মৃতি, শুধুই একটা প্রাণহীন দেহ!

*****

সময়কে কভু আটকে রাখা গেছে কোনোকালে? কে পেরেছে আটকাতে? কেউ কখনও পারেনি আর পারবেও না! পৃথিবী ঘূর্ণায়মান! ঘূর্ণায়মান সময়ও। ঘড়ির প্রত্যেকটা কাঁটাও। নিজ অক্ষে প্রতিনিয়ত তারা ঘুরছে তো ঘুরছে। এই ঘূর্ণনের ফলেই দিন পেরিয়ে রাত আসছে, রাত পেরিয়ে ভোর! সময় ক্রমান্বয়ে সামনের দিকে অতিবাহিত হচ্ছে। পিছনের দিকটা পড়ে থাকছে একটা অতীত, একটা স্মৃতি, একটা দুঃস্বপ্ন কিংবা সুস্বপ্ন হিসেবে। দিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে! একের পর এক ক্যালেন্ডার তার পাতা উল্টাচ্ছে, অগণিত মুহূর্তরা কালের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই হারিয়ে যাওয়া দিন, সময়, মুহূর্ত আর চাইলেও ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়! তেমনি মানুষও। যে একবার পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায়, মুছে যায়, সে আর ফিরে আসে না। শত আহাজারি আর কান্নাও তাকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। এমন নিয়ম কোথাও কভু দেখা যায়নি যে, মৃ’ত মানুষ পুনরায় ফিরে এসেছে!

দু’জনকে পড়তে বসিয়ে পাশে থেকে গাইড দিচ্ছে নোভা। তার হাতে একটা ছোটোখাটো স্কেল! বাচ্চাদুটো এতটাই দুষ্টু যে, পড়াশোনাতে দিনরাত ফাঁকিবাজি শুরু করেছে তারা। পড়তে গেলে তাদের ক্ষিধে পায়, ঘুম পায়, কখনও আবার বাথরুম পায়৷ এইতো, এখনই বাথরুমে যাওয়ার বাহানায় বই ফেলে উঠে দাঁড়ালো জারা। অমনি হাতে স্কেল নিয়ে মেয়ের দিকে কড়া চোখে তাকালো নোভা। সে-ও ইঁদুরছানা দাঁত বের করে হাসিমুখে বলল,

“হিশু আসছে তো!”

“আধঘণ্টা আগে না বাথরুমে গেলে। ঘণ্টা পেরোনোর আগেই তোমার হিশু পেয়ে গেল?”

“সত্যি বলছি মাম্মা। যাই…?”

বাচ্চা মানুষ, কতক্ষণ আর চেপে রাখবে। শেষে দেখা গেল অতিরিক্ত বকাঝকা করতে গিয়ে প্যান্টসহ ফ্লোর নোংরা করে ফেললো। অগত্যা মেয়েকে নিয়ে ছুটলো বাথরুমে। ফাঁক পেয়ে নোরা বইটই সরিয়ে একগাদা রংপেন্সিল বের করে ড্রয়িং করতে বসে গেল। এখন তার আঁকিবুঁকিতে চলে আসবে রাজ্যের সব চিত্র। একদিকে গাড়ি, একদিকে বাড়ি। কোথাও নদী, কোথাও পাহাড়। কখনওবা নৌকা, কখনওবা জাহাজ, উড়োজাহাজ! যা কিছু পারছে, ছোটো ছোটো হাত দু’খানা দিয়ে আঁকিবুঁকির চেষ্টা করে চলেছে সে। হোক অসুন্দর, মন খুলে আঁকাতেই তৃপ্তি, শান্তি!

ক্রমশ বেজে চলেছে ফোনের রিংটোন। একবার, দু’বার, বার বার। কে’টে গেলে আবার বাজছে। তবুও ক্লান্তি আসছে না। ওপাশ থেকে কেউ অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছে, যোগাযোগ করার। অথচ এপাশের নারীটি বাচ্চাদের নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, রুমের ভেতরে থাকা মুঠোফোনের আওয়াজ তার কানে আসছে না। একটা সময় রিংটোন থেমে গেল। এবার বাজলো টেলিফোন। পাশে থাকায় ঝটপট সেটা রিসিভ করলো নোভা। ওপাশ থেকে আদনান প্রায় তাড়া দিয়ে বলল,

“মুনতাহা ফোন করছে, রিসিভ করছো না কেন?”

“ফোন তো রুমে!”

“দ্রুত বাচ্চাদের নিয়ে তৈরী হও! ওনারা ভাবীকে নিয়ে হসপিটালে এসেছেন।”

“সেকী! ভাবীর কী হলো হঠাৎ!”

আদনান হেসে ফেললো। মেয়েটা এরইমধ্যে ভুলে বসেছে, নায়লার ডেলিভারির ডেট পেরিয়ে গেছে। ভুলে যাওয়াটাও স্বাভাবিক। জারা, নোরা তাকে যেভাবে নাজেহাল অবস্থায় ফেলে দেয়, ওদের সামলে নিজেকে নিয়েই ভাববার সময় পায় না বেচারী, সেখানে বাড়তি ভাবনা মাথায় ঠাঁই দেওয়াও দুষ্কর তার জন্য। হাসির মৃদু শব্দ কানে আসতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো নোভা। বলল,

“হাসছেন কেন?”

ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো আদনান। হাসি থামালো। নোভাকে খানিকটা লজ্জায় ফেলতে কথার ভাবভঙ্গি পালটে নরম স্বরে একটু ধীরগতিতে বলল,

“ভাবী বোধহয় জারা, নোরার জন্য একটা ভাই নিয়ে আসতে চলেছে। তাই তাকে নিয়ে সবাই এখন হসপিটালে এসেছে। অলরেডি অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। ফুপ্পি হিসাবে তোমার সেখানে থাকা উচিত। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি, তৈরী হয়ে থাকো।”

খানিকটা লজ্জা পেল নোভা৷ কী করে ভুলে গেল সে এই কথা। নিজের মাথাতেই গুঁতো মা’র’লো সে। লজ্জার মুখ থেকে বাঁচতে ‘তৈরী হচ্ছি’ বলে তড়িঘড়ি করে ফোন কাটলো। দ্রুত হাতে দু’জনের জামা পালটে নতুন জামা পরিয়ে দিল। নিজেও ঝটপট কূর্তি জড়ালো গায়ে। ওড়নাটা ঠিকঠাক পিন দিয়ে আটকে ড্রয়িংরুমে পা ফেলতেই আদনান এসে সামনে দাঁড়ালো। বাচ্চারা দৌড়ে পালালো আদনানের সঙ্গে। পিছন পিছন এগোলো নোভাও।

রূহানীর মৃ’ত্যুর প্রায় চার মাস হতে চললো! এই চার মাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাচ্চাদুটো মায়ের সুখ কী তা বুঝে উঠার আগেই মা হারিয়েছে। কিন্তু যে মা তাদের আগলে রেখেছে সেই মায়ের প্রতি ভাব-ভালোবাসা আরও দ্বিগুণ হয়েছে। উপচেপড়া সুখের সংসারে সুখপাখি এসে বিনা আয়োজনে ইতিউতি উড়াউড়ি করছে। হাসান মঞ্জিল পরিণত হয়েছে সুখনীড়ে! এই নীড়ে কারও কোনো দুঃখ নেই, রাগ নেই, অভিযোগ নেই, আছে শুধু একে-অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বিশ্বাস!

*****

হসপিটালে পৌঁছে তাদের কী আনন্দ! নায়লাকে তখনও সিটে আনা হয়নি। তার জ্ঞান ফিরেনি। মুনতাহার কোলে ছোট্ট একটা ছেলে সন্তান। যে কিছুক্ষণ আগেই পৃথিবীতে এসে আগমনী কান্নায় ভিজিয়ে দিয়ে সকলের চোখ। যার আগমনে পরিবারের সবাই কেঁদেছে, আনন্দে, আবেগে। নোভা বাচ্চাদের নিয়ে পৌঁছাতেই তারা প্রায় দৌড়ে এসে দাঁড়ালো মুনতাহার সামনে। উঁকিঝুঁকি মে’রে চেহারা দেখার কত যে তাড়না শুরু হলো। কত কৌতূহল, আগ্রহ, উচাটন জন্ম নিল ওই দুটো বাচ্চার বিস্ময়কর চাহনিতে! ছোটো ছোটো হাতে আরও একজনের ছোট্ট হাত স্পর্শ করলো দু’জনে। একসাথেই উচ্চারণ করলো,

“আমাদের ভাই?”

মুনতাহা মাথা নাড়লো। সাদাফ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কানের কাছে মৃদুশব্দে আজানের প্রতিটা বাক্য সুমধুর কণ্ঠে উচ্চারণ করলো! এরপর নোভার কোলে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“দেখ বোন, কেমন পুতুল পুতুল চেহারা! ও আমার সন্তান। আমার।”

আবেগের তাড়নায় অজস্র চুমুর স্পর্শ দিল, সদ্যোজাত সন্তানকে। পিতৃত্বের অদ্ভুত অনুভূতি জন্মালো মন-প্রাণ জুড়ে। শীতল, শান্ত, সুখে ভরে গেল হৃদয়পুরী। মনে থেকে, স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা বেরিয়ে এলো। প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা দ্বিগুণ হলো। মনে হলো, এই রমনী সঙ্গী ছিল বলেই আজ সে বাবা হতে পেরেছে। এই সুখ মুখে প্রকাশ করা যায় না, সীমাহীন অনুভূতি কেবল অন্তরই উপলব্ধি করে।

নোভা যখন তাকে কোলে নিয়ে বসলো, তখন বাচ্চাদুটোও মাকে ঘিরে ধরলো। একবার, বার বার, নবজাতককে ছোঁয়ার আশায় মুখিয়ে রইলো দু’জন। তাদের সকলের আনন্দ দেখেই বুঝা যায়, একটা সদ্যোজাত শিশু পরিবারে কত সুখ নিয়ে আসে! নরম, তুলতুলে শরীরে কাঁপা কাঁপা হাতের স্পর্শ দিল নোরা। বলল,

“মাম্মা, ওর নাম কী?”

“নাম তো এখনও ঠিক হয়নি। পরে যখন সুন্দর নাম রাখা হবে, তখন নাম ধরে ডেকো। এখন ভাই ডাকলেই হবে।”

দু’জনেই সানন্দে সেটা মেনে নিল। নায়লার জ্ঞান ফেরার পর তার সাথে দেখা করলো নোভা৷ অল্পস্বল্প কথা বললো। তাদেরকে হসপিটালে রেখে বাচ্চাদের নিয়ে ফেরার প্রস্তুতি নিল। বেরোবার আগে একটা চেকে অ্যামাউন্ট লিখে সাদাফের হাতে ধরিয়ে দিল। সাদাফ অবাক হয়ে বলল,

“এটা কীসের জন্য?”

“অনেক খরচ হবে। এখান থেকে খরচ করো।”

“তুই কি পা’গ’ল? তুই কেন টাকা দিবি? আমার যা আছে তাতে হয়ে যাবে!”

“সারাজীবন আমার পিছনে অনেক খরচ করেছো! এইটুকু সেই তুলনায় সামান্যই। তাছাড়া এ টাকা আমার ইনকামের। বিয়ে দিয়ে পর করে দিয়েছো বুঝি? তোমাদের পাশে থাকার একটা সুযোগ পেয়েছি, তা-ও পারবো না?”

বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পায়নি সাদাফ। সুখের এটাই যে, বোনকে এক বিশ্বস্ত সঙ্গীর হাতে তুলে দিতে পেরেছে। সে শত বিপদেও যেভাবে পাশে আছে, এভাবেই যেন সারাজীবন থাকে, শুধু প্রার্থনা তার এইটুকুই। প্রতিটা ভাই-বোন আর পরিবারের মানুষের সম্পর্ক যদি এমন সুন্দর, সৌহার্দপূর্ণ হয়, তবে তো সেই পরিবারে সুখ আসতে বাধ্য।

ফেরার পথেই শুরু হলো, জারা-নোরার মাত্রাতিরিক্ত কান্না। যে যেভাবে পারছে, চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। তাদের কান্নার মূল সূত্র একটাই, ‘ভাই চাই, ভাই চাই।’ পারলে জোর করে টেনে নিয়ে আসবে। তা-ও নতুন ভাইকে ফেলে আসতে নারাজ দু’জনে। হসপিটালে অযথা ভিড় করতে চায়নি দেখেই বিদায় নিয়ে আসতে চাইছিল নোভা। তারমধ্যেই বাচ্চারা অহেতুক জেদ ধরে বসেছে। সেই জেদে সবার এখন দিক হারানোর অবস্থা! মুনতাহা দু’জনকে সামলাতে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

“তোমাদের মাম্মা-পাপাকে বলো, ভাই এনে দিবে। ও তো বাচ্চা। ও এখন তোমাদের সাথে যেতে পারবে না সোনা। এখন ওর নিজের মা’কে ভীষণ প্রয়োজন!”

নোভা চোখ পাকিয়ে তাকালো। আদনান পাশে থেকে সে কথা শুনে নোভাকে একনজর দেখলো। হাসি আড়াল করে রাগী রাগী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীর ভাবভঙ্গি বুঝার চেষ্টা করলো। যেভাবে রাগী চোখে বোনকে গিলছে, কাঁচা খাবে কী পাকা! সেই হিসেবে সে যাবেই না। আস্তো ধরেই গি’লে ফেলবে এমন অবস্থা হয়েছে তার। একটা সময় দাঁত কিড়মিড়ি করে নোভা বলেই ফেললো,

“এসব কী বলছিস মুন? যখন তখন যা খুশি বলে দিলেই হয়!”

“বারে! তাদের এক্ষুণি ভাই চাই। আমি তো আমার ভাইপোকে দিয়ে দিতে পারবো না। তাই বললাম, যেখানে চাইলে পাবে সেখানেই চাইতে।”

“চাইলেই হয়? হাওয়ায় ভেসে আসবে?”

মুনতাহা সে কথা কানে নিল না। ফিক করে হেসে নিজের ভাইপোকে কোলে নিয়ে বিড়বিড়িয়ে তার সাথে আহ্লাদী কথাবার্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নোভা এক পর্যায়ে বাচ্চাদুটোকে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো। আদনান বিদায় নেয়ার সময় মুনতাহাকে বলল,

“একেবারে জায়গামতোই উচিত কথা বলে ফেলেছো! এরজন্য তোমার জন্য একটা গিফট থাকছে। আর সেটা হচ্ছে, আগামী বছরই তোমার বিয়ের সব কাজ সম্পন্ন হবে। প্রিপারেশন নিয়ে নাও শালিকা! শুভদিন আর বেশিদূরে নয়। সে তো পা বাড়ালেই সামনে এগোয়।”

ঠাট্টার ছলে হলেও আদনানের এই কথাতে ভীষণ হাসি পেল মুনতাহার। তাকে বিদায় জানিয়ে একা একাই হাসলো। মানুষ কত সুন্দর মনের হয়! কতটা বিশ্বস্ত হয়! আদনানকে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না তার। মনে মনে এক সৎ, স্বচ্ছ, সুন্দর, পবিত্র প্রার্থনায় ডুবলো সে। এমন একটা জীবনসঙ্গী তারও হোক। আসুক সে, ভালোবাসা হয়ে। বিশ্বাস আর ভরসা হয়ে। খোদার কাছে চাইতে দোষ নেই। বলা যায় না, তার এই সৎ চাওয়া হয়তো কোনো এক শুভদিনে সত্যি হয়ে গেল!

*****

রেদোয়ান হাসান অফিস থেকে ফিরে কাউকেই বাসায় পেলেন না। সন্ধ্যে অবধি একা একাই বাড়ির আঙিনা ঘুরেফিরে সময় অতিবাহিত করলেন। যখন দেখলেন তার আদরের দাদুমনিরা বাবা-মায়ের কাছে কোনোকিছু চেয়ে পাচ্ছে না তখনই তাঁকে বেছে নিল তারা। দু’জনে তার দু’হাতে ধরে লটকে গেল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

“দাদুন, হসপিটালে একটা নতুন ভাই এসেছে। খালামনি তাকে আনতে দিল না। মাম্মা-পাপার কাছে চাইলে নাকি ভাই পাব! এখন মাম্মা-পাপাও ভাই এনে দিচ্ছে না। আমাদের ভাই লাগবে।”

বাচ্চারা কোনোকিছু আবদার করা মানে, সে জিনিস হাতের নাগালে আসা অবধি তাদের ঘ্যানঘ্যানানি থামবার নয়! এটা ননস্টপ চলছে এবং চলবে। বাড়ি ফিরেও যখন দু’জনের মুখ থেকে ভাই’য়ের গান বন্ধ করা গেল না, তখন নোভার বিরক্তি চরমে। রেগেমেগে একাকার সে। এত করে বুঝিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। দু’জনে মানতেই চাইছে না। মুরব্বি মানুষটার সামনে এমনধারা আবদার বসাতেই নোভার অবস্থা চরমে। পারলে সে এক্ষুণি গলায় দ’ড়ি দিয়ে কোনো একটা গাছের ডালে ঝু’লে যায়। আদনান কথার প্যাঁচ থেকে বাঁচতে দ্রুত পায়ে রুমের ভেতরে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। একা একা হাসলো। কীভাবে বাচ্চাদের হ্যান্ডেল করে এটাই এখন দেখা বাকি!

রাতে দু’জনকে খাওয়াতে গিয়ে সে-ই একই কাহিনী শুরু হলো। নোভা শুধু বিরক্তিই হলো না, এ পর্যায়ে মুনতাহার উপর রাগ হলো তার। কেন যে এসব কথা ওদের কানে ঢুকাতে গেল এই মেয়ে! এখন শা’স্তি সে একা পাচ্ছে। বাকিরা দিব্যি বসে বসে মজা নিচ্ছে। অসহ্য! এমন আজিব কিসিমের বাচ্চা-কাচ্চা তার-ই হলো কেন? এদের এখন সামলাবে কীভাবে সে? কীভাবে বুঝাবে এই না আসা ভাইয়ের গল্প! খাবার খাওয়ানোর জন্য কথার সাজানোর চেষ্টা করলো নোভা। দু’জনকে বসিয়ে রেখে বলল,

“ভাই আসবে, কিন্তু তার জন্য তোমরা আমার কাছে তাকে চাইলে হবে না!”

“কেন? খালামনি তো বললো, তুমি ভাই এনে দিবে!”

অবিশ্বাস্য মনে প্রশ্ন করলো নোরা। নোভার এই কথা শুনে দু’জনের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। গাল ফুলিয়ে বসে রইলো তারা। মাথায় হাত বুলিয়ে খাবারের প্লেটটা হাতে নিল সে। ভাত, মাছ মাখিয়ে অল্প অল্প করে দু’জনের মুখেই ঢুকিয়ে দিল। বলল,

“এসব তো আমার হাতে নেই। তবে এটা কেবল তুমি আল্লাহর কাছে চাইলেই পাবে। তুমি যদি আল্লাহ্’কে বলো, তোমার মাম্মার কোলে ভাই আসুক, তবেই তিনি তোমার দো’আ কবুলে ভাই এনে দিবেন। সময় লাগবে। অনেক সময়। যখন তোমাদের দো’আ কবুল হবে, তখনই ভাই আসবে। এখন বলো, এভাবে আর মাম্মা-পাপার কাছে ভাই চাইবে না। চাইবে কোথায় জানো?”

“আল্লাহর কাছে।”

ব্যস! বুঝাতে সক্ষম হলো সে। দু’জনেই বুঝে গেছে বিষয়টা। এবার আর ভাই ভাই বলে মাথা খাবে না। কারও সামনে লজ্জাও পেতে হলো না, বাচ্চাদের মনটাও খারাপ হলো না। এরপর আর কোনো ঝামেলা করেনি দু’জনের কেউ-ই। শান্তশিষ্ট ভদ্র বাচ্চার মতো খাবারটা শেষ করেছে। ওদেরকে রুমে পাঠিয়ে নিজেদের খাবারের জন্য টেবিল সাজাতে শুরু করলো সে।

ততক্ষণে জারা, নোরা রুমে এসে আরেক কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছে। আদনান মাত্রই এশার নামাজ শেষ করে উঠেছে। মাগরিবটা আজ অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাজা হয়ে গেছে। জায়নামাজ খালি পেয়ে দু’জনেই হুড়মুড়িয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে গেল। একজন আরেকজনকে বুঝাতে কীসব বলছে আর ঝটপট রুকু সিজদাহ্ দিচ্ছে। কিছুক্ষণ বাচ্চাদের কাণ্ড দেখলো সে। এরপর মোনাজাত অবধি অপেক্ষা করলো। দু’জনেই হাত উঠিয়ে দো’আ করলো। তাদের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হলো, খুব দামী কিছু চাইছে দু’জনে। কৌতূহল জাগলো মনে। জানতে চাইলো,

“দো’আতে কী চাইলে?”

“ভাইকে চাইলাম। আল্লাহ্ খুব তাড়াতাড়ি ভাইকে পাঠাবে।”

খুক খুক করে কাশি শুরু হলো আদনানের। সেন্টার টেবিল থেকে গ্লাস তুলে পানি পান করলো। নোভা দরজায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে!

বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে গিয়ে খানিকটা দেরী হলো নোভার। গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দু’জনের কপালে চুমু খেল। রুমের বাতি নিভিয়ে মৃদু আলোর হলদে বাতি জ্বালিয়ে ধীরপায়েই রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। এই রুমটার সাথে কানেকশন করে নিজেদের রুমের ভেতরে বাড়তি দরজা খুলিয়েছে আদনান। যেন রাতেও বাচ্চাদের দেখতে অসুবিধা না হয়। নোভাকে ভেতরে আসতে দেখে মাথায় দুষ্টামি চাপলো তার। বলল,

“ভাইয়ের ভূ’ত মাথা থেকে নেমেছে?”

মাথা নিচু রেখেই লাজুক হাসলো নোভা। ঘুমানোর সময় আর ভাই, ভাই গান গায়নি দু’জনের কেউ। এরপর আর গাইবেও না নিশ্চিত। জবাব না দিয়ে ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকলো সে। ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। সামান্য ক্রিম নিল হাতে। ঘুমানোর আগে হাত-মুখ বা ধুয়ে থাকতে পারে না সে। গা ঘিনঘিন করে। মনে হয়, এখানে ওখানে চুলকাচ্ছে। হাতে ক্রিম হলেও তার দৃষ্টি আয়নার ভেতরে থাকা মানুষটার দিকে। একমনে বই পড়ছে সে। ঠোঁটে হয়তো কিঞ্চিৎ হাসিও আছে। আশ্চর্য হলো নোভা। ছেলেটা হাসছে কেন? বাচ্চাদের অদ্ভুত আবদার শুনে? হবে হয়তো! ওভাবে তাকিয়ে থেকেই হাতের ক্রিমটুকু গালে ছুঁয়ালো। তখনই মৃদুশব্দে কিছু চমৎকার লাইন কর্ণকুহরে এসে পৌঁছালো। নোভা পিছনে তাকানোর আগেই আদনান এসে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লো। দু’হাতে গলা জড়িয়ে থুতনি ঠেকালো মাথায়। কণ্ঠে মাদ’কতা তুলে আবৃত্তি করলো,

কী এমন বিষ লুকিয়ে রেখেছ ওই চোখে?
যে চোখের তীর্যক দৃষ্টিতে হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে মাঝেমাঝে!
কী এমন আবিষ্টতা জমিয়ে রেখেছ তোমার ওই গজদাঁতে?
যে দাঁতের মৃদু হাসিতে সময় জ্ঞান লোপ পেয়ে যায় আমার মাঝেমাঝেই।
কী রহস্য লুকিয়ে রেখেছ এ হাসিতে?
যে হাসিতে খেই হারিয়ে ফেলি আমার ভেতরের আমিটাকে !

কী এমন মায়া কব্জা করেছ তোমার অধরে?
যেদিকে দৃষ্টি ফেরালে আমার দৃষ্টি সর্প দৃষ্টির বেহায়াপনায় মাতে।
কত রুপ ছিনিয়ে নিয়েছ তুমি সর্বগ্রাসী হয়ে?
যে রুপের বহ্ণিশিখায় মরি ডুবেডুবে।
যত তৃপ্ত হই তোমাকে না দেখে,
ততই অতৃপ্তি বাসা বাঁধে তোমাকে দেখে দেখে!

গোলকধাঁধা
© সাদেকুল ইসলাম

এমন মোহনীয় সুরে কেউ ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে জানা ছিল না নোভার। দু’চোখ বন্ধ রেখে কবিতার লাইনগুলো শুনলো। মনের ভেতর ভালোবাসার রঙিন ঘুরি উড়তে শুরু করলো! মন চাইলো, সে-ও কিছু বলুক! অথচ সাহসে কুলোলো না। কবিতার রেষটুকু কাটবার আগেই ভালোবাসার গভীরতা ছুঁয়ে গেল তার অধরের লাজুক লাজুক হাসিতে। স্পর্শের গভীরতা ক্রমান্বয়ে বাড়লো। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা তো দূর, প্রেমিক পুরুষের এমন ছোঁয়াতে দিকবিদিক হারিয়ে ফেলার উপক্রম হলো তার। নিজেকে লুকাতে প্রশস্ত বুককে আপন করে নিল। হাতের বেষ্টনী মজবুত করে ওভাবেই জড়িয়ে রইলো একে-অন্যের সাথে। এ বাঁধন ছিঁড়ে ফেলা কঠিন! প্রয়োজনে বাঁধন আরও মজবুত হোক, তবু প্রিয়জনের উষ্ণ আলিঙ্গন এভাবেই জড়িয়ে থাকুক সবসময়।

অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল! দু’জনার কেউ-ই কোনো কথা বললো না আর। নিঃশব্দের সাথে নীরবে অনুভূতির লেনদেন হলো। প্রথম মুখ খুললো আদনানই। ফিসফিস করে বলল,

“কেউ কি চায়, বাচ্চাদের ইচ্ছেটা পূরণ হোক?”

“উঁহু! ওরা দু’জনই পরিপূর্ণ করেছে আমাকে। ওদের ভালোবাসায় ভাগ বসাক, এমন কেউ না আসুক।”

“সন্তান দশজন হলেও বাবা-মায়ের ভালোবাসা তাদের সবার জন্য সমান থাকে। তাই বলে, নিজে এই সুখ থেকে কেন বঞ্চিত হবে?”

“ওদের প্রতি যদি অবহেলা তৈরী হয়? যদি আপনার বিশ্বাসটা ভেঙে যায়? যদি ওদের প্রতি অযত্ন হয়? তখন?”

“মায়েরা কখনও পালটায় না। মায়াবতী নারীরা শুধু মায়ায় জড়াতে জানে, মায়া উপেক্ষা করে না। আমার বিশ্বাস, আমাদের যদি আরও দশটা বাচ্চাও আসে, তবুও জারা-নোরার প্রতি তোমার ভালোবাসা একফোঁটাও কমবে না।”

“আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে!”

“ভয় পেও না। আমি আছি তো পাশে। সবসময়। তুমি শুধু তাকে এইখানটায় দশমাস যত্ন করে আগলে রাখবে। পৃথিবীতে আসার পরই তার পরবর্তী দায়িত্ব আমার হয়ে যাবে। যেভাবে জারা, নোরাকে বুকে আগলে বড়ো করেছি, তাকেও করবো।”

আলতো স্পর্শে অর্ধাঙ্গিনীর উদরে অধর ছোঁয়ালো আদনান। দু’জনার ভালোবাসাকে পরিপূর্ণ করতে এখানে কেউ আসুক। যে আসবে সে-ও হবে ভাগ্যবান, কিংবা ভাগ্যবতী। কারণ আদনান জানে, তাদের অনাগত সন্তান বাবা-মায়ের সবটুকু ভালোবাসা পেয়ে বড়ো হবে। সে যেমনই হোক, দু’জনে সময় দিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে তাকে। স্রষ্টার নিকট শুধু একটাই চাওয়া, সব প্রিয়জনেরা ভালো থাকুক সবসময়!

*****

মুমতাহিনা’স কিচেন নামে সৃষ্টি হওয়া ফুডকর্ণারটা জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন নিত্যনতুন খাবার অর্ডার আসার পাশাপাশি কাস্টমারও আসছে! অবসর সময়ে বসে চা-কফি খেয়ে বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা চলে সেখানে। শিশু কিশোর থেকে শুরু করে যুবক-যুবতীদেরও ঢল নামে সেখানে।

“এ্যাক্সমিউজমি ম্যাম, আপনার বিল!”

ক্যাশের ড্রয়ারটায় মাত্রই হাত রেখেছিল নোভা! আদনানের এমন সিরিয়াস কথা শুনে চোখ তুলে তাকালো। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চাদুটো। জবাব না দিয়ে গম্ভীরমুখে তাকিয়ে রইলো সে। আদনানও হাতের টাকা অর্ধাঙ্গিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“ফ্রি’তে খেতে আসিনি আমরা। ন্যায্য মূল্য দিয়ে তবেই খাব!”

“আদিইইই!”

ঝলমলে উজ্জ্বল আলোর মতো স্বচ্ছ হাসি ফুটালো আদনান। বলল,

“বারে! এত দারুণ দারুণ খাবার খাচ্ছি। তার দাম দিব না? এত কিপটে আমি?”

“ঢং করবেন না তো! কোথায় যাচ্ছিলেন যান। একটু তাড়াতাড়ি ফিরবেন।”

আদনান বেরোবার পথেই বাবার মুখোমুখি পড়লো। ব্যবসা গুছিয়ে তিনি এখন বিন্দাস জীবন কাটাচ্ছেন। নাতনিদের নিয়ে রোজ খেলাধুলা করে সময় কাটে তার। দু’জনে দুটো শপ নিয়ে ব্যস্ত! ফ্রি সময়টুকু সকলে একসাথে কাটায়। আনন্দ করে, পিকনিক পিকনিক আমেজ ফুটিয়ে তুলে। বাবাকে দেখেই হুট করে তার কীযে হলো, দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মনে মনে বিড়বিড়য়ে বলল,

“তুমি ছিলে বলে, এই সুন্দর জীবনটা আরও সুন্দরতম হয়ে উঠেছে। ধন্যবাদ দিব না বাবা, শুধু খোদার দরবারে একটাই প্রার্থনা, তিনি যেন তোমাকে আরও অনেকগুলো বছর বাঁচিয়ে রাখেন। আমাদের পরিবারের সুখটাকে এভাবেই প্রাণবন্ত রাখেন।”

ভদ্রলোক নিজেও ইমোশনাল হয়ে গেলেন। চোখের কোণে আসা পানি আটকে ফেললেন দ্রুত। কতদিন পর ছেলেকে এভাবে বুকে জড়ালেন, হৃদয়টা যেন শীতল হয়ে গেল তাঁর। অন্তরাত্মা সুখে পরিপূর্ণ হলো। প্রত্যেকটা বাবা-মা এভাবেই সন্তানদের সাথে ভালো থাকাতে সুখ খুঁজে নিক। পৃথিবী হোক, ভালোবাসাময়। বাবাকে ছেড়ে খানিকটা সহজ হলো আদনান। বলল,

“বাচ্চাদের নিয়ে তানভীরদের কব’রস্থানে যাচ্ছি!”

“তাড়াতাড়ি ফিরিস!”

তিনিও নিজের ইমোশন লুকোতে ঝটপট জবাব দিলেন। নোভা দূর থেকে সবার দিকে তাকালো। স্পষ্ট বুঝতে পারলো, বাবা-ছেলে দু’জনের চোখেই জল চিকচিক করছে। আনন্দ হোক কী বেদনা, প্রিয়জনের চোখে জল দেখে নিজেও খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়লো। চোখে চোখ পড়তেই দু’দিকে মাথা নাড়লো। কাঁদতে নিষেধ করলো। ঠোঁটে আঙুল টেনে বলল,

“হাসুন না প্লিজ! একটু হাসুন।”

কিছুটা দূরত্ব থাকলেও নোভার হাতের ইশারা বুঝে গেল আদনান। বুড়ো আঙুলের আলতো স্পর্শে চোখের পানি মুছলো। ঠোঁটে হাসি ফুটালো। দূর থেকে সেই হাসিতে নোভাও হাসলো৷ অপ্রত্যাশিতভাবে দু’জনেই ঠিক একই মুহূর্তে বিড়বিড় করলো,

“আমার ভালোবাসাকে সবসময় তোমার ভালোবাসায় বাঁচিয়ে রেখো খোদা! এভাবেই তাকে হাসিখুশি রেখো। পৃথিবীর সব ভালোবাসাকে পরিপূর্ণ করো তুমি।”

কী অদ্ভুত! দু’জনে জানে না, দু’জনের প্রার্থনা এক। অথচ গোপনে, নীরবে একে-অন্যের প্রতি দো’আ অব্যাহত রাখছে সবসময়। প্রিয়জনকে ঘিরে এই ভালোবাসা অটুট থাকুক সবসময়। সম্পর্ক আরও সুন্দর হোক, হোক বিশ্বস্ত। একজন নারী কিংবা পুরুষ, এমন বিশ্বস্ত সম্পর্ককে জীবনে পেলে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। যেমনটা নোভাও হয়েছে! পরিপূর্ণ নারী। যার জীবনে না পাওয়া নেই, দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, আছে শুধু পরিপূর্ণতা। যে এখন পুরোটাই সুখী রমনী, সম্পূর্ণাদের একজন। জীবনটা যখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে তখন একজন নারীও হয়ে উঠে সম্পূর্ণা! সে-ও আজ সম্পূর্ণা’ই। গোটা জীবন প্রাপ্তিগুলো এভাবেই ঘিরে থাকুক তাকে। বাঁচিয়ে রাখুক ভালোবাসাকে প্রত্যেকটা মোনাজাতে।

*****

সমাপ্ত…

বি : দ্র : কোনো লেখাই পারফেক্ট হয় না। কোথাও না কোথাও ত্রুটি থেকে যায়। আপনাদের কাছে অনুরোধ, যদি এই গল্পের ত্রুটি চোখে পড়ে সেটা নির্দ্বিধায় কমেন্ট বক্সে উল্লেখ করবেন। পরবর্তীতে তা এডিট করে নেয়া হবে।

লেখিকার কথা : এটা লেখার উদ্দেশ্য একটাই, আপনাদের মাঝে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ পৌঁছানো। পৃথিবীতে আমরা কেউ-ই পারফেক্ট নই! কোথাও না কোথাও আমাদের ত্রুটি আছে। আমাদের আশেপাশে চোখ মেলে তাকাতেই তা আমরা খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারবো। আমি গল্পে উল্লেখ করেছি, স্রষ্টার সৃষ্টিতে ত্রুটি নেই। ত্রুটি আমাদের চিন্তাভাবনায়। হ্যাঁ, একদমই তাই।

কারণটা পরিষ্কার করে বলি, আমাদের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তা কিছু পার্থক্য দিয়েছেন, কেউ ফর্সা কেউ কালো। কেউ মোটা, কেউ চিকন। কেউ বেটে, কেউ অতিরিক্ত লম্বা। যখন আমরা এই মানুষগুলোকে দেখবো, তখন যেন তাদেরকে কষ্ট না দেই। অনেক সময় বলে ফেলি, এ্যাই তুই এত মোটা ক্যান? এত কালো ক্যান? সুন্দর হতে পারিস না? স্মার্ট হতে পারিস না? আপনি কি জানেন, আপনার আমার এই সামান্য কথা ওই মানুষটার অন্তরে কতটুকু ব্যথার সৃষ্টি করে? মানুষটা কতটুকু আঘাত পায়? নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগে? অভিযোগ জন্মায় স্রষ্টার প্রতি? আমি আবারও বলছি, স্রষ্টার সৃষ্টিতে কোনো ত্রুটি নেই। ত্রুটি আমাদের চিন্তাভাবনায়। আপনার এই কথাতে কিন্তু সে সুন্দর হয়ে যাবে না, তবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটা তার নিকট স্পষ্ট হয়ে যাবে। পরবর্তীতে তার যতই প্রশংসা করুন না কেন, সে আপনাকে বিশ্বাস করবে না। স্রষ্টা কিন্তু তাকে ভালোবেসে ওই রূপে সৃষ্টি করেছেন, তাই সেই সৃষ্টিকে অপমান করার অধিকার আপনার নেই!

কারও মিথ্যে প্রশংসা করবেন না ঠিক আছে, তার দোষ নিয়ে খোঁচাখুঁচি করবেন না। বরং তার ভালো দিকটা নিয়ে আলোচনা করুন। বলুন, সে কীসে সুন্দর, কেমন সুন্দর। বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিন, সৌন্দর্য কোথায়! চেহারায় নাকি ব্যক্তিত্বে? ফিটনেসে নাকি মনুষ্যত্বে!

আদনান চরিত্র কাল্পনিক! বাস্তবে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। আজ থেকে যদি নিজেরা নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনি, তবে আদনান চরিত্র তৈরী হওয়া খুব একটা কঠিন না। অনেকেই সঙ্গী/সঙ্গিনীকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগেন। ভাবেন, অপজিটের মানুষটা পারফেক্ট না! এখানেও আমরা ভুল। সবাই যদি পারফেক্ট হই, তবে ত্রুটি যাদের তারা যাবে কই? তাদের কি ভালোবাসা নিষেধ? বিয়ে করা বে’আঈণী? তবে কেন সামান্য একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে পাশের মানুষটাকে কষ্ট দিবেন। তার দোষটা ভুলে যান, গুণটা খেয়াল করুন। সে কীভাবে আপনার মন পাওয়ার চেষ্টা করে তা দেখুন। মানুষের মাঝে একজন প্রকৃত মানুষকে খুঁজুন, জীবন এমনিতেই সুন্দর হয়ে যাবে। কারও মাঝে ফিটনেস, চেহারার সৌন্দর্য আর টাকা-পয়সা খুঁজতে যাবেন না, খুঁজবেন বিবেকবান, চরিত্রবান, মনুষ্যত্বসম্পন্ন ব্যক্তি! যে আপনার ইহকাল এবং পরকালের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

অনেক কথা বলে ফেলেছি! বুঝে নেয়াটা আপনাদের দায়িত্ব। আসুন নিজেদের চিন্তাভাবনা পাল্টাই, সত্যিকারের মানুষ হই। মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করি, ভালোবাসি। বাহ্যিক সৌন্দর্য ক্ষণিকের মোহ, কিন্তু অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য একটা মানুষের পুরো পরিচয় বহন করে। তাই বাইরের সৌন্দর্যকে নয়, ভেতরের সৌন্দর্যকে খুঁজে সঠিক মানুষ বাছাই করি। নিজে যেমনই হই, তেমনি নিজেকে ভালোবাসি। যেন জীবনে কখনও নিজেকে হীনমন্যতায় ভুগতে না হয়! থাকুক কিছু ত্রুটি, সবকিছুকে সবার সাথে বিচার করতে নেই। নিজের জন্য কেউ না থাকুক, নিজেই যথেষ্ট। আপনি যেমনই, তেমনি নিজেকে ভালোবাসুন। নিজেকে ভালোবাসতে পারার মাঝে স্বার্থকতা আছে।

_______________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here