সম্পূর্ণা-৩
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
আকাশে গোলগাল চাঁদের ঝলমলে আলো পড়েছে ধরণীতে। একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকলে চোখদুটোতে আলোর ঝাপটা লাগবে। দিনের আলোয় ধরণীর সবুজ-শ্যামল রূপ যতটা না সুন্দর, রাতের নীরবতা যেন দ্বিগুণ রূপে সাজিয়ে তুলে সবকিছু। চোখ মেলে তাকালেই সীমাহীন এক মুক্ত আকাশ পড়ে চোখে। অজস্র নক্ষত্রগুলো মিটিমিটি জ্বলে! মাঝেমধ্যে খসে পড়ে কিছু নক্ষত্র। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, এইবুঝি নক্ষত্রটা পৃথিবীর বুকে এসে পড়লো। বিধাতার সৃষ্টি এত অপরূপ কেন! এই সৌন্দর্যের শেষ কি আদৌ আছে?
পাকা উঠোনে চেয়ার পেতে আকাশ থেকে খসে যাওয়া নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে নোভা। মনে হচ্ছে মায়ের শেখানো শৈশবের সেই কবিতা। মা যখন শিখিয়ে দিতেন, কত আবেগ জড়িয়ে থাকতো তাতে। মায়া-মমতা ঘিরে থাকতো সবসময়। আজ বড্ড মনে পড়ছে শৈশব। মনে পড়ছে, মায়ের শিখানো কবিতা। মা শেখাতেন, ইংরেজি কবিতার বাংলা অর্থসহ। নোভা শিখতো। গভীর মনোযোগ দিয়ে কবিতার লাইন আওড়াতো। এখনো ঠিক তাই করছে সে। বিড়বিড় করে টুইংকেল টুইংকেল কবিতার অনুবাদ করছে। তার ঠোঁট নড়ছে, হাসছে, আবার বেদনাও এসে ভর করছে দু’চোখে। বিড়বিড় করছে,
“মিটিমিটি ছোটো তারা জ্বলে জ্বলজ্বল,
আশ্চর্য হই আমি, কে তোরা বল?
পৃথিবীর বহুদূরে, বহু উঁচুতে।
হীরার টুকরো যেন জ্বলে আকাশেতে।”
কাঁধে স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ফেরালো নোভা। নায়লা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বলল,
“ওভাবে এখানে বসে আছিস কেন? ঘরে আয়।”
“ভাবী, মেয়েদের জীবন এত কঠিন কেন? সবসময় শুধু মেয়েদেরকেই সব ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়! কই ছেলেদের রঙ ফর্সা, কালো, কিংবা মোটা-চিকন এসবকে তো ত্রুটি হিসেবে ধরা হয় না। তবে শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই কেন?”
“এটা নির্ভর করে মানুষের মানসিকতার উপর। যখন একজন মানুষ পুরোপুরি একটা মানুষের অন্তরকে স্পর্শ করতে চায় তখন কিন্তু সে কোনোভাবেই বাহ্যিক কোনো ত্রুটিকে প্রশ্রয় দিবে না। বরং সেটা তার কাছে স্বাভাবিক মনে হবে। যাদের মন-মানসিকতা নষ্ট তারাই মানুষের চেহারা, বডি ফিটনেস কিংবা উঁচুনিচুর তফাৎ খুঁজে। তবে ছেলেদের বেলায়ও খুঁজে। যেটা বেকারত্ব! একজন বেকার ছেলে কখনোই স্বপ্নগুলোকে সহজেই ছুঁয়ে দেখতে পারে না, যেটা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি পারে!”
“সব স্বপ্ন কি তবে টাকা দিয়ে পূরণ হয়?”
“আজকাল টাকার কাছে সততা বিক্রি হয়ে যায় নোভা। সবকিছুকেই মানুষ টাকা দিয়ে বিচার করে!”
“ভাবী, শেষ পর্যন্ত কী হবে! আমি কী করবো?”
“রাজী হয়ে যা। যেহেতু তার দিক থেকে কোনো বাধা নেই। তোর বস কিন্তু দারুণ ভালো মানুষ। খাঁটি সোনা চিনতে তাঁর বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি।”
“আমার ভয় হচ্ছে ভাবী। ভীষণ ভয় হচ্ছে! সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।”
“আরো দু’দিন সময় নে। ভেবে তারপর জানা। ছেলেটা ভালো। পরিবারটাও ছোটো। সবকিছু পারফেক্ট!”
“সত্যিই কি ভালো? নাকি শুধু তার বাইরের ভালো দিকটাই চোখে পড়েছে, খারাপটা আড়ালেই রয়ে গেছে?”
শেষোক্ত কথাগুলো বিড়বিড়িয়ে বললো নোভা। নায়লা শুনতে পেল না। ততক্ষণে সে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেছে। পিছনে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নোভা! বাচ্চাদুটোর চেহারা ভাসছে দু’চোখে। ভীষণ মায়াকাড়া চেহারা! দু’হাতে জড়িয়ে আদর করতে ইচ্ছে করছে তার। ইশ, যদি একটুখানি ছুঁয়ে দিতে পারতো!
*****
একটা বড়ো অনাথ আশ্রমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। ভেতর থেকে বাচ্চাদের জাদুময়ী কণ্ঠস্বরে ভেসে আসছে পবিত্র কুরআনের আয়াত। এত্ত মনোমুগ্ধকর শব্দধ্বনি যেন বার বার হৃদয়কে শীতল করে দেয়। প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয় মন। স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য করে। এত সুন্দর সুরে স্রষ্টাকে ডাকলে তিনি কীভাবে বান্দার ডাকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন? তিনি তো চান বান্দা তাঁকে ডাকুক, দিনরাত এক করে ডাকুক। যে ডাকে সাড়া দেবার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করে আছেন রব। বান্দাকে যে তাঁর দিকেই ফিরতে হবে। দিনশেষে তিনিই তো রক্ষাকারী! ভূমণ্ডলের সবকিছুই তো তাঁর ইশারায় ঘটে। কে আছে, যে তাঁকে অস্বীকার করতে পারে? রাব্বুল আলামীনের এই সৃষ্টিকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আজো কারো হয়নি। কোনো মুমিন পারে না, তাঁকে অস্বীকার করতে। তাইতো সৃষ্টি (মানুষ) প্রতি ওয়াক্ত নামাজে, প্রতিবার কুরআন তেলাওয়াতে, প্রতি মোনাজাতে শুধু স্রষ্টাকেই খুঁজে ফিরে।
আদনান একপলক ঘাড় ফিরিরে পাশে তাকালো। নোভার দৃষ্টি তখনো চারপাশে নিবদ্ধ। গভীর মনোযোগ দিয়ে সে কিছু ভাবছে। আদনান সেটা ধরতে না পারলেও অদ্ভুত একটা অনুভূতি অনুভব করছে সে। ঠিক কেন সেটা ধরতে পারছে না। এক দৃষ্টিতে সামনে থাকা নারীটিকেই পর্যবেক্ষণ করতে ভালো লাগছে তার। কেন? আদৌ সে উত্তর তার জানা নেই। কিছুক্ষণ পর নোভা তার দিকে তাকালো। বলল,
“কোথায় বাচ্চাদুটো?”
“ভেতরে আসুন। দেখা পাবেন। আপনি কিন্তু ফোন করেননি সেদিন!”
“অপেক্ষা করছিলেন নাকি?”
আচমকা নিজের এই প্রশ্নে বোকা বনে গেল নোভা। কী বলতে কী বলে ফেলেছে খেয়াল হতেই নিজেকে চরম লজ্জার মুখোমুখি আবিষ্কার করলো। অপেক্ষা করবে মানে, আসলেই করবে? এতটাও গুরুত্বপূর্ণ কেউ না সে! তবুও কেন জানি অহেতুক এই প্রশ্নটা উঁকি দিল মনে। আদনান ঠোঁট চেপে হাসলো। তবু মুখে কিছু বললো না। দু’পা সামনে এগিয়ে অনাথ আশ্রমের ভেতরে প্রবেশ করলো। নোভাও তাকে অনুসরণ করেই এগোলো।
ছোটো ছোটো একঝাঁক বাচ্চা হৈচৈ করছে মাঠে। সবুজ ঘাসের বুকে পা ফেলে দৌঁড়াচ্ছে তারা। ছড়িয়ে দিচ্ছে হাজারো গল্পকে। তারা বাঁচতে চায়, বড়ো হতে চায়, নিজেকে গড়ে নিতে চায় এক সাহসী তরুণ-তরূণী হিসেবে। সেইসব না বলা, না বুঝা গল্পকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে এগিয়ে আসে আদনানের মতো বড়ো হৃদয়ের কিছু সাহসী যুবক। মূলত যাদের জন্য অনাথ আশ্রমগুলো টিকে থাকে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। তাদের সামান্য অবদানেই জড়িয়ে আছে একটা আশ্রমের ভেতরে কষ্টে থাকা ছোট্ট শিশুর পবিত্র হাসি। আদনানরা সেসব হাসি বাঁচিয়ে রাখতেই নিজেদেরকে বিলিয়ে দেয় সর্বদা!
গেটের সামনে আদনানকে দেখা মাত্রই পাঁচ বছরের ছোট্ট জারা দৌড়ে আসলো। ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল আদনানের দু’গাল। রাগী চোখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে বলল,
“এই তোমার আসার সময় পাপা! দাদুন সেই সকালে বললেন, তুমি আসবে! আমি কত্ত অপেক্ষা করলাম।”
“আমি খুব দুঃখিত সোনা! আমার আরো আগে আসা উচিত ছিল। দেখো, একটা আন্টি এসেছে তোমাদের সাথে দেখা করতে। আন্টিকে সালাম দাও।”
জারা চোখ বের করে নোভার দিকে তাকালো। গালে আঙুল ঠেকিয়ে মুখে হাসি টেনে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
নোভা এগিয়ে এসে সালামের জবাব দিয়ে জারাকে কোলে তুলে নিল। তুলতুলে নরম গালে চুমু খেয়ে বলল,
“ভালো আছো তুমি?”
“খুব।”
আদনান আরেকটু ভেতরে গিয়ে নোরাকেও কোলে তুলে নিল। দু’জনকে একসাথে নিয়ে নোভার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“এরাই আমার প্রাণ। এদের জন্যই আমার বেঁচে থাকা। একটা নামি-দামি রেস্টুরেন্টের মালিক হওয়া ছাড়াও আমার ভিন্ন আরেকটা পরিচয়, আমি এই দুটো বাচ্চার বাবা। প্রফেশনাল কাজ শেষে আমার বাকি সময় এদের পিছনে কাটে। এখানে যদি একদিন না আসি, বাচ্চাদুটো দিশেহারা হয়ে যায়। এবার বলুন, আপনার সিদ্ধান্ত কী?”
নোভা হকচকিয়ে গেল। এতটাও সরাসরি প্রশ্ন আশা করেনি সে। লোকটা একটু ফাস্ট। ফাস্টই না, একদম সরাসরি বলা মানুষ। উত্তর নেগেটিভ হোক কি পজেটিভ। চাই মানে চাই। পারলে এক্ষুণি তার জবাব চাই। তবে একটা দিক ভালো লেগেছে তার, সে-ও রান্নাবান্না আর খাবার-দাবারের বিষয়ে আগ্রহী। রেদোয়ান হাসানের মুখে শুনেছে, আদনান নিজেও রান্না করতে ভীষণ পছন্দ করে। তবে খাবারের দিকটা খুব মেইনটেইন করে চলে!
বাচ্চাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে হাতের ঘড়ি দেখলো নোভা। দু’জনকে ভেতরের রক্ষণশীল নারীর হাতে তুলে দিয়ে কিছু টাকা দিয়ে ওদের ঠিকমতো খেয়াল রাখতে বললো আদনান। ভদ্রমহিলা মুচকি হেসে তাকে বিদায় জানালেন। নোভা তখনো খোলা মাঠের একপাশে তীর্যক আলোর উত্তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে আছে। সেই আলোর স্পর্শ যখন স্নিগ্ধ চেহারায় এসে চোখমুখের ভাবভঙ্গিকে কুঁচকে দিচ্ছে, তা ভীষণ উপভোগ্য মনে হচ্ছে তার। চেহারায় বিরক্তি নেই, তবে পবিত্র এক হাসি ঠোঁটে লেপটে আছে। নিজের কাজে নিজেই চরম বোকা হলো আদনান। আজ বড্ড মনোযোগ দিয়েই নোভাকে সে দেখছে। কী হতে চলেছে তাকে নিয়ে? জানা নেই তার। শুধু জানে, ইগনোর করতে হবে। খুব করে। অতি সুক্ষ্মভাবে। যেন টেরই না পায়। মুচকি হেসে নোভার সামনে দাঁড়ালো। বলল,
“চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি!”
“আমি একা যেতে পারবো।”
“সে কী করে হয়! এসেছেন আমার প্রয়োজনে! আপনাকে কষ্ট দিয়ে একা ফেরত পাঠালে বাবা বকবে। শুধু বকবেই না, ইমোশনাল কথাবার্তা বলে, চরম নার্ভাস করে দিবে। টেপ রেকর্ডার একবার বাজতে শুরু করলে আর থামবে না। মৃ’ত মা’কে পর্যন্ত তুলে এনে ব্ল্যাকমে’ইল শুরু করেন। এইজন্য অকারণ বকা শুনতে চাইছি না।”
“বাবাকে খুব ভয় পান?”
“ভয় নয় ম্যাডাম, ওটা শ্রদ্ধা। আমরা যাদের শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি, তার কোনো অনুরোধ কিংবা কথা কাজকে অগ্রাহ্য করতে পারি না। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে হলেও চেষ্টা করি, মানুষটাকে ভালো রাখতে। আমার ব্যাপারটাও সেরকম। বাবাকে শ্রদ্ধা করি দেখেই, কষ্ট দিতে চাই না।”
“আমার একটু তাড়া আছে।”
“কেন?”
“একটা নতুন রেসিপি ট্রাই করবো। সেটা য়্যু’টিউবে আপলোড করবো।”
“রান্নাবান্না খুব পছন্দ?”
“ভীষণ!”
“তাহলে তো আর আপনাকে আটকে রাখা যায় না। চলুন, এগোই।”
মূল সড়কের সামনে এসে নোভা একটা অটোরিকশায় উঠে পড়লো। আদনান নিজের গাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ অটোরিকশার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। খানিকক্ষণ ভেবে বলল,
“আমি গতদিন আপনার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম!”
এইটুকু বলেই আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায়নি। ড্রাইভারের হাতে কিছু টাকা দিয়ে নোভাকে সাবধানে নিয়ে যেতে বলে দ্রুত নিজের গাড়িতে এসে হাওয়ার গতিতে উড়ে পালালো। নোভা স্থির হয়ে বারংবার চোখের পলক ফেলে, চোখ পিটপিট করে বুঝার চেষ্টা করলো; হচ্ছেটা কী এটা!
*****
ডাইনিং টেবিলের উপর খাবার সাজিয়ে রাখা। রুবিনা সবকিছু ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে রেদোয়ান হাসানকে টেলিভিশনের সামনে থেকে ডেকে আনলো। তিনি এসে আদনানকে গলা উঁচিয়ে ডাকলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আদনানের পা পড়লো খাবার টেবিলের সামনে। চেয়ার টেনে বসে ভাত মাখিয়ে ঝটপট বাবার মুখে ভাত তুলে দিল। এটা প্রতিদিনের রুটিন। ছোটোবেলা বাবা-মা তাকে যত্ন করে খাইয়ে দিয়েছেন এখন নাহয় সে দিবে। তাই প্রতিদিন খাবারের প্রথম অংশটা বাবার মুখে তুলে দেয় সে। এরপর নিজে খায়। রুবিনা সেটা দেখে হাসে। মনে মনে প্রার্থনা করে, এই দুজনের সম্পর্ক যেন চিরকাল এমন থাকে। খাবার খেতে খেতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন রেদোয়ান হাসান। খানিকটা হেসে রুবিনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আর ক’দিন পর ঘরে বউ আসবে। তোর চাপ অনেকটা কমবেরে মা!”
“বউ আসবে মানে?”
বিস্ময়ে হতবাক আদনান। বউ আসবে এখন? সে কী প্রস্তুত! না না, এত জলদি কীভাবে হয়! খাওয়া থামিয়ে বাবার দিকে মনোযোগ দিল। রেদোয়ান হাসান ফের হাসি টেনে বললেন,
“নোভা মতামত জানিয়েছে! তার কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি থাকবে কীসের জন্য? আমার ছেলেটা যে রাজপুত্র! এমন রাজপুত্র কি চাইলেই পাওয়া যায়? বলতো বাপ, কবে দিনতারিখ পাকা করবো?”
হাত থেকে খাবার পড়ে গেল আদনানের! ইচ্ছে করছে এক্ষুনি গিয়ে নোভাকে কিছু কথা বলে আসতে! আরেহ্, এত তাড়াহুড়ো কীসের! মানুষ কি পালিয়ে যাচ্ছে? না-কি সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে? আরেকটু ভেবেচিন্তে এগোনো উচিত না?
কিন্তু না! মুখের কথা মুখেই আটকে গেল তার। বাবার হাসিতে অদ্ভুত প্রশান্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে কতদিন পর তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন। এমন প্রানবন্ত হাসিযে বহু বছর পর তার চেহারায় প্রকাশ পেয়েছে। এই হাসিটাকে কীভাবে থামিয়ে দিবে সে! খাবার শেষে ঝটপট উঠে গেল আদনান। নোভার হাসিমাখা মুখখানি চোখে ভাসছে। তার কথা বলা, হুটহাট রেগে যাওয়া কিংবা জারা-নোরার প্রতি তার অসাধারণ আচরণ, সবকিছুই মন ভুলানো। তাছাড়া বাচ্চাদুটোর কথাও ভাবতে হবে। কীভাবে সামলাবে সবদিক? অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে তার।
মামা-মামী আর মায়ের সাথে বসে গল্প করছে নোভা। ভেতরে অদ্ভুত শান্তি অনুভব হচ্ছে। জারা আর নোরার হাসিমাখা মুখটা চোখে ভাসছে। কী আদর আদর লাগে ওদের দেখলে! একাকী হাসছে সে! মুনতাহা সেটা লক্ষ্য করে নোভাকে টেনে তার রুমে নিয়ে আসলো। বিছানায় বসিয়ে বলল,
“কী? খুব খুশি খুশি লাগছে? এত দ্রুত মতামত জানিয়ে দিলে যে?”
“আমার ওইদুটো বাচ্চার জন্য মন কেমন করছে! ওদের কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। বেচারা, বাবার ভয়ে নিজের সন্তানদের দূরে সরিয়ে রেখেছে! যদি আমার জন্য ওরা বাবাকে কাছে পায়, পরিবার পায়, মা খুঁজে পায়, তবে আমি কেন বাধা দিব তাতে? আমি কি এতই খারাপ? হয়তো ওদের সৎ মা হতে হবে কিন্তু ওরা সেটা উপলব্ধি করবে না। আমি ওদের আপন মা হওয়ার চেষ্টা করবো।”
মুনতাহা কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু নোভার ফোনটা বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো। বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে তুলে ভ্রু কুঁচকে গেল নোভার। আদনান ফোন করছে! তাও এই প্রথম। ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তবে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে তার। ফোনটা কানে ঠেকিয়ে সালাম দিয়ে চুপ করে রইলো নোভা। মুনতাহা মুখে হাত দিয়ে মিটিমিটি হাসতে শুরু করেছে। নোভা তাকে থামিয়ে ফোনের দিকে মনোযোগ দিল।
“আমাকে এত অপেক্ষা করানোর মানে?”
“দুঃখিত! আসলে, আমি সরাসরি আপনাকে ফোন করতে চাইনি। যদি বিরক্ত হোন!”
দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আদনান। আসলেই সে চায়নি নোভা তাকে কল করুক। ওটা শুধু মন রক্ষার্থে বলেছিল। তখনো বুঝেনি, এই মেয়েটা এত আত্মসম্মানী। নিজেকে নিয়ে সে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন! কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম, আপনি রাজি হবেন না। আসলে রাজি হওয়ার কথাও না। এইযুগে কেউ চায় না, যেচে সৎ মা হতে! একজন হলেও অসুবিধা ছিল না, এখানে তো দু’জন। তবুও আপনি আপত্তি করলেন না, এটাই ভাবাচ্ছে।”
“সব মানুষ কি এক? কিছু খারাপ, কিছু ভালো, এইসব মিলিয়েই তো পৃথিবী। যদি প্রতিটা সন্তান সৎ মায়ের কাছ থেকে খারাপ আচরণ পেয়ে কষ্ট অনুভব করে তবে তো সৎ মা সম্পর্কে তাদের ধারণা পাল্টাবে না কোনোদিন। মা শব্দটা এতটা মধুর যে, যখন একটা সন্তান মা বলে ডাকে তখন মা কতখানি সুখ অনুভব করে তা হয়তো শুধু নারীজাতি অনুভব করে। এই অনুভূতি সম্পূর্ণ আলাদা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পবিত্র আর সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক হচ্ছে, মা আর সন্তানের।”
“সব সৎ মা তবে ভালো হয় না কেন?”
“মানুষের মানুষিকতা খারাপ হলে আপনার আমার কিছু করার নেই। আমি যদি বাচ্চা দুটোর মা হতে চাই, তাতে কি আপনি আপত্তি করবেন? আপনার আপত্তি থাকলে বলতে পারেন, আমি স্যারকে সামলে নিব৷”
আদনান স্তব্ধ। এই মুহূর্তে তার না বলার আর কোনো রাস্তা নেই। এভাবে যে ফেঁসে যাবে ভাবেইনি আগে। নোভা অসুন্দর বা অপছন্দের পাত্রী এরকম কিছুই নয়। খুব কাছ থেকে তাকে না দেখলে কেউ টেরই পাবে না, মেয়েটা জাদুময়ী, মায়াবতী। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ সুখ বয়ে আনবে তো জীবনে? মেয়েটাকে ভালোবাসতে পারবে তো? কিংবা ভালো রাখতে? বাবাকে যে মানা করবে সেরকম কোনো অজুহাত আর নেই। জারা, নোরার কথা বলা মানে, এই বয়সে বৃদ্ধ বাবার হৃদয়ে আঘাত করা। ভাবতে পারছে না আদনান, অস্থির অস্থির লাগছে! কীভাবে পুরো পরিস্থিতি সামলাবে সে? বিড়বিড় করে শুধু একটা কথাই বলল,
“হে খোদা! পথ দেখাও আমায়। মেয়েটার সাথে জেনেবুঝে কোনো অন্যায় করতে চাই না। এত বড়ো মিথ্যে, কীভাবে সামলাবো আমি!”
*****
চলবে…