সম্পূর্ণা-৫

0
674

সম্পূর্ণা-৫
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

জীবনে মানুষ যতগুলো শব্দের সাথে পরিচিত, সম্বোধন কিংবা সম্পর্কের সাথে পরিচিত, তার মধ্যে অত্যাধিক প্রিয়, সুন্দর, চমৎকার এবং প্রশান্তির শব্দ হচ্ছে মা ডাকটা। জাগতিক সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায় কেবল এই একটা জায়গায় এসে। মা’যে কত মমতাময়ী তার সম্পর্কে ধারণা খুব কমই আছে মানুষের। যদি সন্তানরা ঠিকমতো তার এই মা’কে বুঝতে পারতো, তবে এত বৃদ্ধাশ্রম সৃষ্টির প্রয়োজন হতো না। শৈশব, কৈশোরে সন্তানকে মা যেভাবে আগলে নিয়েছে, তাঁর বার্ধক্যে পৌঁছানোর পর সেই সন্তানের উচিত মা’দের আগলে নেয়া। এই বোধশক্তি এই সমাজের কিছু মানুষের অনেক কম। ফলস্বরূপ, সন্তান আর মায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব!

প্রথম কোনো কাঙ্ক্ষিত শব্দ, সুখের শব্দ যখন একটা নারীর কর্ণকুহরে পৌঁছায় তখন তার মনোভাব কিংবা সুখের সীমাটুকু কাউকে বুঝানোর মতো পর্যাপ্ত বাক্যেরও বোধহয় অভাব পড়ে যায়। সুপ্ত একটা সুখে ভরে উঠে মনপাড়া৷ হুটহাট এই শ্রুতিমধুর, অর্থবোধক তীক্ষ্ণ শব্দটা তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। অবিশ্বাস্য চোখে নোরার দিকে তাকিয়ে রইলো নোভা! তার পবিত্র হাসিতে যেমন রাজ্যের মায়া উপচে পড়েছে, তেমনি কণ্ঠে মিশে রয়েছে হাজারও খুশির ঢ্ল। নোরা বাচ্চামো ভঙ্গিমায় আবারও বলল,

“তুমি খাইয়ে দাও না মাম্মা!”

হাত বাড়িয়ে নোরাকে নিজের কোলে টেনে আনলো নোভা। আবেগের তাড়নায় অজস্র চুমুর স্পর্শ দিল নরম দু’গালে। দু’চোখ বন্ধ করে ওই শব্দগুলোর মাধুর্যতা, স্বার্থকতা উপলব্ধি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। নোরাও আদুরে মেজাজে জড়িয়ে রইলো নোভার সাথে। রক্তের সম্পর্ক নেই, অথচ মা-মেয়ের এই দৃশ্যটা দেখে আদনান নিজেও বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলো চেয়ারে। আলগোছে ফোন বের করে খুব দ্রুত হাতে একটা ছবি তুলে ফেললো। অবচেতন মন বুঝে গেল, একটা নারীর সৌন্দর্য ঠিক কোথায়! কখন একটা মেয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে! ফোন পকেটে রেখে জারার দিকে তাকালো। মেয়েটা চোখ পাকিয়ে, অভিমানী চোখে, গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এইটুকু সময়ে রাজ্যের অভিমান এসে ভর করেছে তার চোখেমুখে। মুচকি হেসে জারাকে নিজের কোলে তুললো সে। নোভার দিকে তাকিয়ে বলল,

“একজনের প্রতি ভাব-ভালোবাসা শেষ হলে, অন্যজনের দিকেও নজর দিন। কেমন গাল ফুলিয়েছে দেখুন!”

ঠিক এই মুহূর্তে খুশির কান্না কাঁদবে নাকি হাস্যরসের এই কথাতে সুখের হাসি হাসবে বুঝতে পারলো না নোভা। আড়চোখে জারার দিকে তাকিয়ে অন্যহাত বাড়িয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যেই মেঘের ঘনঘটা চেহারা থেকে সরে গিয়ে একফালি সতেজ, ঝলমলে রোদ্দুরে ভরে গেল তার মুখবয়ব! তুলতুলে নরম গালে আদর দিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে নিল দ্রুত। বলল,

“রাগ করেছো সোনা?”

জারা কোনো জবাব পেল না। হয়তো ওইটুকু মনে এই প্রশ্নের পর্যাপ্ত জবাবটা তার জানা নেই। শুধু আদুরে বিড়ালের মতো নোভার শরীরের সাথে মিশে গেল সে। আদনানের মনে হলো, বহুদিন পর একটা মনভুলানো দৃশ্য তার চোখে ভাসছে। কত দুঃশ্চিন্তা ছিল, এইদুটো মেয়েকে নিয়ে। অনিশ্চিত জীবনের সাথে কতখানি ভরসা হয়ে আগলে নিয়েছিল দু’জনকে। যার ফলস্বরূপ জীবনের সবচেয়ে দামী একটা জিনিস সে হারিয়ে ফেলেছিল বহু আগে। সেই হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়টাও খুব দ্রুতই মুছে ফেলেছিল মন থেকে। ধরে নিয়েছিল, সব সুখ সবার জন্য নয়, এমনকি মানুষও শত গুণে গুণান্বিত নয়! মানুষের কিছু ত্রুটি তার ভুলই সঠিক সময়ে, সঠিক বোধবুদ্ধি জাগিয়ে দেয়। যেমনটা সে-ও একদিন টের পেয়েছিল। অতি সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদনান। থাক না কিছু স্মৃতি তিক্ত, থাক না কিছু সময় অপরিচিত, সে তো জীবনকে সুযোগ দিচ্ছে, একটা সুন্দর আগামীর জন্য।

ছানাপাখিরা মায়ের সংস্পর্শে এসে যেমন আহ্লাদী, আদরী হয়ে উঠে এই মুহূর্তে জারা, নোরাও তেমন রূপে ফিরে গেল। অচেনা এই নারীটির সাথে তাদের যে রক্তের টান নেই, নাড়ির টান নেই, তার ব্যাখ্যা হয়তো তারা বুঝে না, কিন্তু এইটুকু বুঝে গেছে এই নারীটাই তাদের মা। এই নারীটাই তাদের ভালোবাসবে, আগলে রাখবে, যত্ন নিবে, ঘুম পাড়াবে। দু’জনকে খুব যত্ন নিয়েই খাইয়ে দিল নোভা, অথচ নিজে তখনও কোনো খাবারের দিকে মনোযোগ দেয়নি। অনেকক্ষণ পর মুখ খুললো আদনান। বলল,

“আপনি তো কিছুই মুখে তুলছেন না ম্যাডাম! খাবার কি পছন্দ হয়নি?”

পুরো টেবিল খাবার দিয়ে সাজিয়ে রাখা। অথচ নোভার আজকের পুরো মনোযোগ দুই বাচ্চার দিকে। সদ্য জাগ্রত হওয়া সুপ্ত অনুভূতির মায়াজাল থেকে বেরোতে পারছে না সে। ক্ষণে ক্ষণে হৃদয়জুড়ে শীতল, সুবাতাস বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, জীবনটা বুঝি সুখে পরিপূর্ণ। অথচ এখনো বন্ধনটা জোড়া লাগেনি। তবুও চোখের পলকে এইদুটো বাচ্চা তার কতখানি আপন হয়ে গেছে! ভাবনাটা সুখের, আনন্দের, নতুন কিছু পাওয়ার। সুখের আতিশয্যে খাবারের দিক থেকে মনোযোগ সরে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। আদনানের প্রশ্ন শুনে অসহায় চেহারা নিয়ে তাকালো নোভা। বলল,

“আমার ক্ষিধে নেই!”

“ডা’হামিথ্যে কথা! এই মিথ্যের জন্য আপনাকে সেরা মিথ্যেবাদী অ্যাওয়ার্ড দেয়া উচিত।”

অভিযোগের স্বরে বললো আদনান। নোভার তখন কেঁদে ফেলার অবস্থা। এইটুকু কারণে তাকে মিথ্যেবাদী উপাধি দেয়াও হয়ে গেছে। আদনান কি বুঝতে পারছে না, তার মনের অবস্থা? বুকের কাছটায় অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, এই অনুভূতিকে মুছে ফেলে খাবারে মনোযোগ দিবে কী করে সে! তবুও চেহারায় সিরিয়াস একটা ভাব ধরে রেখে বলল,

“ট্রাস্ট মি, আমার একটুও ক্ষিধে নেই। ওদের সাথে এইটুকু সময়ের আনন্দেই পেট ভরার সাথে সাথে মনটাও ভরে গেছে। গলা দিয়ে কিছু নামবে না এখন!”

মুচকি হাসলো আদনান। বলল,
“আপনি আমার গেস্ট! আমার রেস্টুরেন্টে এসে অভুক্ত অবস্থায় ফেরত যাবেন, সেটা আমি হোস্ট হয়ে মেনে নিব? চলুন আমার সাথে!”

ঝটপট চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আদনান। জারা, নোরার খাওয়া ততক্ষণে কমপ্লিট। খুব সাবধানেই বাচ্চাদুটোকে খাইয়ে দিয়েছে নোভা৷ ওরাও তৃপ্তি নিয়ে মায়ের আদর, স্পর্শ উপভোগ করেছে। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে ওয়েটারকে ডাকলো আদনান।

“সায়েম, এইদিকে এসো।”

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সায়েম সেখানে উপস্থিত হলো। আদনান তাকে আলাদা চেয়ার ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আধঘণ্টা বাচ্চাদের সামলাও। কিচেন ফ্রি আছে না?”

“জি স্যার!”

সায়েমের জবাব শুনে দেরী করলো না আদনান। ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল নোভার দিকে। বলল,

“আসুন ম্যাডাম! গেস্টদের জন্য হোস্টরা সবসময়ই সাধ্যমতো চেষ্টা করে, ত্রুটিবিচ্যুতি দূরে সরিয়ে তাদের খুশি রাখতে। আমি কেন নিজেকে সেই দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখবো? আপনি শুধু আমার বাচ্চাদের মা নন, আমার অতি নিকটের একজন হতে যাচ্ছেন! আপনাকে অভুক্ত রাখলে পা’প হবে।”

নোভার চোখে-মুখে একরাশ অজানা বিস্ময়, ভালো লাগা। তার সেই অবাক চাহনি আরও দ্বিগুণ অবাকে রূপান্তরিত হলো আদনানের হাতের স্পর্শে। খুব যত্নে সে ডানহাতটা আগলে নিয়েছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুলো না আর, সমস্ত অস্তিত্বে তার ভালো লাগা, ভালোবাসা, নেমে এলো হঠাৎ!

*****

কিচেনে ঢুকে ঝটপট গায়ের ব্লেজার খুলে ফেললো আদনান। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই সেটা নোভার হাতে ধরিয়ে দিল। অন্যপাশ থেকে সাদা অ্যাপ্রোনটা গলার সাথে ঝুলিয়ে কোমরে বেঁধে ফেললো। মাথায় একটা সাদা রঙের পাচক টুপি পরলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আদনানকে পাকা শেফের রূপে আবিষ্কার করলো নোভা। পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পরিবর্তনের ধরনটা দেখলো। আদনান ততক্ষণে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রথমে যে খাবারগুলো অর্ডার করেছিল সেখান থেকে নোভা কেবল জুসটাতেই চুমুক দিয়েছিল। বাকিসব খাবার পড়ে রয়েছে। হয়তো লজ্জা, সংকোচের কারণে খেতে পারছে না তাই কথা ফেলতে পারবে না দেখে ক্ষিধে নেই এই অজুহাত দাঁড় করিয়েছে। বেশ দক্ষ হাতে নিজের কাজ হ্যান্ডেল করছে আদনান।

কয়েক মিনিটে থাই স্যুপ, বার্গার, এমনকি ঝটপট হাতে দু’কাপ কফি আর সবজি মিশিয়ে চাউমিনও তৈরী করে নিয়েছে। এগুলো সহজ কাজের একটাই। আপাতত এই সহজ খাবার দিয়েই গেস্টকে আপ্যায়নের যথাসাধ্য চেষ্টা করবে সে। পরবর্তীতে তার পছন্দের খাবার জেনে কোনো এক অবসরে নাহয় সেসব খাবার রান্না করবে। আপাতত অল্পসময়ে যতটুকু করা যায় সেটুকু করলো আদনান। আধঘণ্টার বদলে ঘণ্টাখানেক সময় ব্যয় হলো। সবকিছু ঠিকঠাক মতো ফুড ট্রলিতে তুলে পরনের অ্যাপ্রোন, টুপি রেখে নোভাকে বলল,

“এবার খাবেন তো নিশ্চয়ই?”

নোভা কোনো জবাবই খুঁজে পেল না। আদনানের এমন সব কাজে সে রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যাওয়া এক আবেগী নারী। যে কি-না জীবনে এমন মুহূর্ত কখনো উপভোগ করেনি। আদৌ সে কি এতটাও ভাগ্যবতী? এত সুখ পাওয়ার যোগ্য? এইটুকু ভেবেই চমকে গেল সে। ক্ষণে ক্ষণে আদনানের কাজ তাকে শুধু বিস্মিতই করছে না, নিজেকে সুখী ভাবতে বাধ্য করছে। জবাব না পেলেও থেমে থাকলো না আদনান, দ্রুত পায়ে নোভাকে নিয়ে টেবিলের কাছে চলে এলো। আগে আনা খাবারগুলো ফেরত পাঠিয়ে সদ্য তৈরী খাবার দিয়ে টেবিল সাজালো। সেই ফাঁকে সায়েম বিদায় নিল। স্যুপের বাটিটা নোভার সামনে রেখে বলল,

“শুরু করুন! আমিও নিচ্ছি।”

না বলার আর কোনো অজুহাত খুঁজে পেল না নোভা। লজ্জা, অস্বস্তিতে দূরে সরিয়ে বিস্মিত ভাবকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলো। তার দৃষ্টি তখনো আদনানের চেহারা পরখ করতে ব্যস্ত। মানুষটা সত্যিই কি এমন? নাকি সবকিছু তাকে ইমপ্রেস করার ধান্ধা? অবশ্য তাকেই বা কেন ইমপ্রেস করার চেষ্টা করবে, সে তো বিশ্ব সুন্দরী নয়! তবে কি এটা মন থেকে, ভালোবেসে করছে? না-কি শুধু বাচ্চাদের মা এইভেবে করছে? অহেতুক প্রশ্নের জা’লে জড়িয়ে গেল তার সমস্ত চিন্তাভাবনা। কোনোমতেই কোনোকিছুতে মনোযোগ পাচ্ছে না আজ। কোনোকিছুই স্বাভাবিক ভাবতে পারছে না। নোভার এমন অবাক করা চাহনি দেখে তুড়ি মে’রে আঙুল নাড়ালো আদনান। বলল,

“এ্যানি প্রবলেম? এগুলোও অপছন্দ? আপনি আজ অভুক্ত থাকবেন, এই পণ করেই এসেছেন তবে!”

হাসিখুশি মুহূর্তে আদনানের এমন গম্ভীর স্বরে ভরকে গেল নোভা। ঝটপট স্যুপের বাটিটা হাতের কাছে টেনে আনলো। কোনো বিরক্তি ছাড়াই চামচ নেড়েচেড়ে সেটা মুখে তুললো। এইটুকু পাতলা পানিও যেন আজ তার কাছে অমৃত মনে হলো। কেউ ভালোবেসে রান্না করেছে, তার স্বাদ নিশ্চয়ই খারাপ হবে না। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আবারও চোখ ঘুরিয়ে আদনানকে দেখলো। হাসিমুখেই বাচ্চাদের সাথে গল্পে মেতে উঠেছে সে। দৃশ্যটা তার এতক্ষণের জমে ওঠা সমস্ত অবান্তর চিন্তাভাবনাকে দূরে সরিয়ে দিল নিমিষেই। নিজের অযাচিত ভাবনার জন্য নিজের বিরক্ত নোভা। কেন যে হুটহাট এমন ভুল ভাবনা আসে, বুঝতেই পারে না সে। নিজেকেই নিজে বকলো, শুধালো, ভুল করেও আর এমন ভাবনাকে মনের মধ্যে ঠাঁই দিবে না।

*****

“পাপা, মাম্মা আমাদের সাথে যাবে না? এখানেই রেখে যাব?”

ঘুরাঘুরি আর জম্পেশ খাওয়া-দাওয়ার পর নোভাকে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিতে আসলো আদনান। জারা, নোরাকে গাড়িতে রেখে যখন নোভাকে নিয়ে বের হলো, তখনই জারা ভাবুক চেহারা নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। পক্ষান্তরে ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো নোভা। আদনান মেয়েকে থামাতে বলল,

“এখনও সঠিক সময় আসেনি মামনি। যখন কাঙ্ক্ষিত দিন আসবে সেদিনই নিয়ে যাব। চিরদিনের জন্য। এই কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে পারবে না?”

“মাম্মাকে ছাড়া থাকবো কী করে?”

নোরার এই কথায় অজান্তেই ভেতর কেঁপে উঠলো নোভার। দু’পা এগিয়ে বাচ্চাদুটোকে আদর করে বলল,

“অপেক্ষা করো সোনা। মাত্রই তো কয়েকটা দিন। তোমরা দু’জনেই তো গুড গার্লস। এই কয়েকটা দিন পাপা আর দাদুর সাথে কাটাবে। যখন ধর্ম আর সমাজের সমস্ত রীতিনীতি মেনে সবসময়ের জন্য তোমাদের মা হবো, তখন আর এই দূরত্ব আসবে না আমাদের।”

বাচ্চাদের থেকে বিদায় নিয়ে গেটের কাছাকাছি আসলো দু’জনে। পিছন ফিরে বার বার দু’জনার দিকে চোখ বুলালো নোভা। অপেক্ষারত দুটো ছানাপাখি যেন মায়ের সংস্পর্শ পাওয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ফেলে আসতে মন চাইছে না। আবার এইভাবে যাওয়াও যায় না। সঠিক সময়টা যে এখনও আসেনি। বাচ্চাদের চেয়েও নোভার মনটা যেন আরও বেশি কাঁদছে, কেন তা সে নিজেও জানে না। আবেগী মেয়ের মতো ক্ষণে ক্ষণে চোখের জল মুছে বাড়ির সীমানায় পা রাখলো। আদনান বাহিরেই দাঁড়িয়ে রইলো। নোভা যখন ভেতরে প্রবেশ করে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলো তখনই তার জ্বল ছলছল চোখদুটোতে নজর পড়লো আদনানের। ঝটপট তার চিবুকে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,

“আর য়্যু ওকে?”

শান্ত চোখে মাথা নাড়লো নোভা। আদনান ফের বলল,
“টেক কেয়ার। পৌঁছে ফোন করবো।”

“ভেতরে আসবেন না?”

“যখন সময় হবে ঠিকই আসবো। দেরী হয়ে যাচ্ছে, ওদের ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে।”

যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর পর্যন্ত তাকিয়ে রইলো নোভা। একটা সময় গাড়ি দৃষ্টির আড়াল হলো, বাচ্চাদুটো দূরে সরে গেল, আস্তেধীরে গেট বন্ধ করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো নোভা।

রুমে প্রবেশ করেও স্বাভাবিক হতে পারলো না নোভা। আজকের পুরোদিন, একটু আগের অনাকাঙ্ক্ষিত সুখ, এমনকি আদনানের টুকরো টুকরো জাদুমাখা কথাতে অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ছেয়ে যাচ্ছে তার অন্তর। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বাহ্যিক রূপের সাথে আদনানের মতো একজন সুন্দর মনের মানুষের ব্যক্তিত্বকে মেলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে নোভা। কোনোভাবেই ম্যাচ হয় না তাদের। নিজেকে কেমন সস্তা, আর অযোগ্য পাত্রীই ভাবনাতে আসছে তার। আচমকাই দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো নোভা। বিড়বিড় করলো,

“আপনি ভুল মানুষকে চুজ করছেন আদনান। আমি আপনার যোগ্য নই। এরজন্য হয়তো একদিন আপনি আফসোস করবেন! আমার থেকেও বেটার কাউকে ডিজার্ভ করেন আপনি। আ’ম নট য়্যুওর পারফেক্ট পার্টনার!”

এই কথাগুলো যদি আদনানকে সরাসরি বলা যেত, তবে কি মানুষটা কষ্ট পেত? কী কারণে তার মতো অযোগ্য পাত্রীকে জীবনসঙ্গী করতে যাচ্ছে সে! কেনই-বা এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে? কোনোকিছুই বুঝে আসছে না নোভার, শুধু সব অধরা স্বপ্নই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ঘুমের ঘোরে এসব অবাস্তব স্বপ্ন সে দেখছে যা ঘুম ভাঙলেই দূরে হারিয়ে যাবে।

“যোগ্যতা কারও চেহারা কিংবা বডি ফিটনেসের মধ্যে লেখা থাকে না আপু! মানুষের মন-মস্তিষ্ক, আচার-ব্যবহার আর গুণের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। শুধু সঠিক সময়, সঠিক মানুষের নজরে পড়তে হবে। এটাই…!”

মুনতাহার গলার আওয়াজে চমকে গেল নোভা। দ্রুতহাতে চোখের পানি মুছে নিজেকে সামলে নিল। কথা ঘুরাতে বলল,

“একী! তুই এখনও জেগে আছিস। যা গিয়ে ঘুমো। আমি এখন আর কিছু খাব না! সবার খাওয়া শেষ নিশ্চয়ই, শুধু শুধু জেগে আছিস!”

ওয়ারড্রব থেকে জামা নিয়ে তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো নোভা। মুনতাহা আর কিছু বলার সুযোগই পেল না। শুধু বোনের সুখের জন্য গোপনে প্রার্থনা করলো।

আদনানের পেটের উপর বসে আছে জারা। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে কোনোমতে নোরাকে ঘুম পাড়াতে পেরেছে। সেই থেকে তার সাথে কু’স্তি খেলছে পা’জি মেয়েটা। বকাও দেয়া যাচ্ছে না, আবার অন্য কাজেও মনোযোগ দেয়া যাচ্ছে না। তার এখন একটাই বায়না, মাম্মাকে শীঘ্রই বাড়িতে চাই। নয়তো হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিবে। আদনান কতকিছু বলে বুঝানোর চেষ্টা করছে, তবুও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উলটে সে জোঁ’কের মতো লেপটে আছে শরীরে। মেয়ের এমন আহ্লাদীপনা দেখে তাকে কাতুকুতু দেয়া শুরু করলো সে। দুষ্টু মেয়েটা খিলখিল হাসিতে ঘরটাকে শব্দের ঝনঝনানিতে ভরিয়ে ফেললো, তবুও কোল থেকে সামান্যও নড়লো না। এক পর্যায়ে খানিকটা গম্ভীর চেহারায় ফিরে গেল আদনান। বলল,

“এখন না ঘুমোলে পাপা কিন্তু খুব বকা দিব তোমাকে। দেখো, নোরা কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি জানো না, রাতে যত তাড়াতাড়ি ঘুমাবে, ঠিক তত ভোরে ঘুম থেকে উঠবে?”

“জানি তো! আর্লি টু বেড অ্যান্ড, আর্লি টু রাইজ! মেইকস্ আ ম্যান হেলদি, ওয়েলদি অ্যান্ড ওয়াইজ!”

“তাহলে? জারা মামনি কি এবার ঘুমাবে? পাপার একটা দরকারী কাজ আছে না? তোমার মাম্মার খোঁজ নেয়া উচিত তো!”

“ওকে, গুড নাইট। তুমি পাশে শুবে কিন্তু।”

তুলতুলে নরম ঠোঁটে আদনানের দু’পাশের গালে চুমু খেলো জারা। ঝটপট অন্য পাশটায় শুয়ে পড়লো। মাঝখানে ফাঁকা রাখলো, যেন বাবা নির্দ্বিধায় এখানে এসে ঘুমাতে পারে। দু’জনেই বেশ বুদ্ধিমতী। এই যুগের বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও অনেককিছুই বুঝে। কথাবার্তার যেমন তারা পটু, তেমনি কাজেকর্মে। জারার এমন হিসাব দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে সুখের হাসি ফুটালো আদনান। মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে ঘুম পাড়ানোর পরবর্তী ধাপ অনুসরণ করে গেল। কয়েক মিনিটের মাথায়ই জারা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। সেন্টার টেবিল থেকে ফোন হাতে তুলে নিয়ে নোভার নাম্বারে ডায়াল করলো। এবার অন্তত জানানো উচিত, সে বাচ্চাদের নিয়ে ঠিকমতোই পৌঁছেছে। নয়তো মেয়েটা অকারণ দুঃশ্চিন্তা করবে।

*****

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here