সম্পূর্ণা-৬

0
670

সম্পূর্ণা-৬
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

ভোরের সৌন্দর্য যতখানি সুন্দর, একজন বাবার কাছে তারচেয়ে বেশি সুন্দর তার সন্তানের হাসি। তার আধো মুখের বুলি। তার চাঞ্চল্য এবং তার ছোটাছুটি। জীবনে প্রথমবারের মতো দুই নিষ্পাপ বাচ্চার আদুরে গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো আদনানের। চোখ মেলে তাকিয়ে দু’জনকে পালাক্রমে চুমু খেলো আগে। বাচ্চাদের সাথে এটাই তার প্রথম সকাল, প্রথম সুখের মুহূর্ত! ওদের এই প্রাণোচ্ছল হাসি সে চিরকাল দেখতে রাজি। ভরসা হয়ে পাশে দাঁড়াতে রাজি। সুন্দর এক আগামী গড়ে তুলতে সর্বদা মাথার ছায়া হতেও রাজি। তবুও বাচ্চারা তাকে ঘিরে থাকুক, এখানেই তার সমস্ত চাওয়া। একসঙ্গে দু’জনকে নিয়েই বিছানা ছাড়লো সে। মিষ্টি হেসে বলল,

“গুড মর্নিং মাই লিটল প্রিন্সেসেস! ঘুম ঠিকঠাক মতো হয়েছে তো দু’জনার।”

দু’জনে উপরনিচ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক ইশারা করলো। দু’জনকে নিয়ে ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকলো। ব্রাশে টুথপেস্ট ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নাও, নাশতা শেষে আমরা শপিংয়ে যাব।”

খুশিতে দু’জনই লাফিয়ে উঠে প্রায়। মা ছাড়া সন্তান লালন-পালন করা যেমন কষ্টের, তেমন বাবা ছাড়া সন্তানের জন্য ভরসা খোঁজাও কষ্টের। সময়ের ব্যবধানে বাচ্চাদুটো আজ অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে। কতটা দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছিল তাকে। এখনও যখন জারা, নোরার জন্মের মুহূর্ত চোখে ভাসে তখন মনে হয়, সে ছাড়া কেউ নেই এই দুটো বাচ্চাকে আগলে নেয়ার। রূহানীর বলে যাওয়া সেদিনের কথা, বার বার কেঁদে কেঁদে এক মায়ের বুক ফাঁটা আর্তনাদে ভেসে যাওয়া হসপিটালের কক্ষ! মনে পড়লেই বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। এমনটা না হলেও পারতো, থাকতো রূহানী চোখের সামনে তবুওতো বাচ্চারা মা’কে খুঁজে পেত।

বাচ্চার জন্য মায়ের আর্তনাদ কতটা করুণ হতে পারে, সেদিন খুব কাছ থেকে ওই ছটফটানি না দেখলে এই গভীর উপলব্ধি আসতোই না তার। একটা কান্নারত মায়াবী মুখশ্রী তাকে বার বার ঠে’লে দিচ্ছিলো হসপিটালের বাইরে। দু’হাত জোর করে মিনতি করছিল,

“আমার বাচ্চাদুটোকে বাঁচান আপনি! দূরে কোথাও নিয়ে যান। এ শহরে থাকলে ওদেরকে ওঁরা বাঁচতে দিবে না। চলে যান আপনি এখান থেকে। আর কোনোদিন এই শহরে আসবেন না। আদনান সাহেব, আমি আপনার পায়ে পড়ছি, যত যা-ই হয়ে যাক আপনি কোনোদিন আর আমাকে খুঁজতে এখানে আসবেন না। আজ থেকে রূহানী সিকদার মৃ’ত! যান বলছি, চলে যান এখান থেকে।”

মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ওইদুটো বাচ্চার সমস্ত দায়িত্ব চলে আসে তার নিজের কাঁধে। সেদিন থেকে দু’হাতে জারা, নোরাকে শুধু আগলেই নেয়নি, দিয়েছে সুন্দর একটা জীবন। যদি শেষ মুহূর্তে পালাতে না পারতো, হয়তো শেষরক্ষা হতোই না৷ সেই নবজাতকের চেহারাও ওদের বর্তমান চেহারার সাথে মিল নেই, নেই বার্থ সাটিফিকেট কিংবা হসপিটালের ঠিকানাও। ওরা পুরোটাই অন্য পরিচয়ে তার সাথে জড়িয়ে গেছে চিরদিনের জন্য।

নাশতা শেষে দু’জনকে পুরোপুরি তৈরী করে নিল আদনান। বেরোবার আগেই রেদোয়ান হাসানের সঙ্গে একদফা ছোটাছুটি করলো দু’জনে। কখনও কাঁধে উঠে, আবার কখনও কোল চেপে বসে, কখনও-বা পিঠে বসে চষে বেড়ায় পুরো ড্রয়িংরুম।

দু’জনকে গাড়িতে তুলতেই হাজারও প্রশ্নের মুখোমুখি পড়ে আদনান। উৎসুক দৃষ্টি আর ভাবুক ভাবভঙ্গিমায় বাবার গলাটা পেঁ’চিয়ে ধরেলো নোরা। আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,

“মাম্মাকে সাথে নিয়ে যাই?”

ড্রাইভ সামলাতে ব্যস্ত আদনান। জারা সামনে বসলেও সবগুলো ছোটো ছোটো টেডি কোলে নিয়ে সেগুলোর সাথে বকবক করছে। অন্যদিকে নোরা পিছন থেকে তার সাথে আদরমাখা আবদার শুনিয়ে যাচ্ছে নোরা। মাথা নেড়ে সায় জানালো আদনান। বলল,

“মাম্মাকে একদম চমকে দেব। চুপিচুপি তাকে ভরকে দেবে দু’জনে। পারবে না?”

“খুব পারবো।”

কনফিডেন্সের সাথে মাথা ঝাঁকালো নোরা। বার বার ডানে, বামে তাকিয়ে চঞ্চল চড়ুই পাখির মতো ইতি-উতি চোখ বুলালো। কখন যে মায়ের কাছাকাছি পৌঁছাবে, তাকে জড়িয়ে ধরবে সেই অপেক্ষায় মুখিয়ে রইলো দু’জনে।

*****

ঘুম ঘুম চোখদুটো মেলে তাকাতে গিয়েই চরম ধা’ক্কা খেল নোভা। জারা, নোরা প্রায় তার মুখের উপর ঝুঁ’কে রয়েছে। দুঃশ্চিন্তার ভারে রাতে ঘুম হয়নি ঠিকঠাক, তারমধ্যে সকাল সকাল এই মারাত্মক ঘটনা তাকে পুরোপুরি চমকে দিয়েছে। বাড়িতে কী বলে ম্যানেজ করলো আদনান? বাচ্চাদুটোকে নিয়ে একেবারে হাজির! বিষয়টা সহজেই বোধগম্য হলো না তার। সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইলো নিষ্পাপ দুটো বাচ্চার দিকে। বলল,

“এত সকালে তোমরা?”

“শপিংয়ে যাব। তুমি ছাড়া ভালো লাগবে না তো!”
আহ্লাদী কণ্ঠে নোভার গলা জড়িয়ে ধরে প্রশ্নের জবাব দিল জারা। নোভা আবারও বলল,

“কার সাথে এসেছো?”

“পাপা নিয়ে এসেছে। ড্রয়িংরুমে বসে সবার সাথে গল্প করছে। উঠো না তুমি। এটা ব্যাড হ্যাবিট মাম্মা। এতক্ষণ কেউ ঘুমায়?”

বুদ্ধিমতী মেয়ের ভালো-মন্দের সংজ্ঞা দেখে মুচকি হাসলো নোভা। ঝটপট বিছানা ছাড়লো। সেই কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেছিল। নামাজ পড়ে বিছানায় আসতেই আবারও গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। এলোমেলো চুল খোঁপা করে গায়ে উড়না জড়ালো। দু’জনকে নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়েই চমকে গেল। একদম স্বাধীনচেতা মানুষের মতো কেমন হেসে-হেসে আড্ডায় ব্যস্ত সে। অথচ সবাইকে বাচ্চাদুটোর ব্যাপারে এখনও কিছুই জানায়নি নোভা। না জানিয়ে ধড়াম করে বাচ্চা নিয়ে কেউ আসে? লোকটার সেন্স যে এতটা দুর্বল এটা ভাবনায়ও আসেনি নোভার। রাতেও দু’জনার অল্পবিস্তর কথা হয়েছিল, তখনও বলেনি বাচ্চাদের নিয়ে এভাবে সকালে চলে আসবে।

টেনশনে রীতিমতো হাত-পা কাঁপছে নোভার। সবাইকে কী বলে ম্যানেজ করেছে কে জানে! বাচ্চাদুটোর কথা জেনে সবাই যদি বিগড়ে যায়, কী হবে তখন? ভয়ে, দুঃশ্চিন্তায় মাথাটা তার ফাঁকা হয়ে গেল। তাৎক্ষণিক কোনো কথাও আসলো না মুখ দিয়ে। কেমন ড্যাবডেবে চোখে আদনানের হাসিখুশি চেহারাটাই পরখ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। নোভাকে দেখে নায়লা এগিয়ে আসলো। বলল,

“দ্রুত তৈরী হয়ে আয়! ভাইয়া চাইছে, আজকেই শপিংটা হয়ে যাক। সঙ্গে মুনতাহাও যাবে।”

এমনিতেও মাথাভর্তি যন্ত্রণা, অকারণ দুঃশ্চিতা আর হাজারও প্রশ্নের জা’ল তৈরী হয়েছে মনে। তারমধ্যে আদনানের একেকটা আচরণ তাকে বিস্মিত হতে বাধ্য করে। মনে হয়, লোকটা ধুরন্দর। মারাত্মক লেভেলের চালাক। তার কথা এবং কাজে একেক সময় একেক ধরনের ইঙ্গিত প্রকাশ পায়। কখনও মনে হয়, এই মানুষটা বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ আচরণ একই, আবার কখনও মনে হয়, পুরোটাই নাটক। সাজানো, গোছানো পরিপাটি একটা প্ল্যান।

দূর থেকেই আদনান হাতের ইশারায় বলল,
“পরনের পোশাক পালটে দশ মিনিটে তৈরী হোন।”

নোভা জবাবে শুধু ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তা দেখে আদনান দু’দিকে মাথা নেড়ে ঠোঁট উলটে বলল,

“এত ভেবে মাথাব্যথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। যা বলছি তা করুন। এক্ষুণি বের হবো। আমি এসেছি আধঘণ্টা হয়ে গেছে।”

আদনানকে এই মুহূর্তে ঠিক কী ভাববে বুঝে আসলো না নোভার। সবার সামনে বাচ্চাদের ব্যাপারে খোলাশা কোনো আলাপই হলো না। চরম বিরক্তি আর অসহায় চেহারা নিয়ে ফের নিজের রুমে ঢুকলো সে। তড়িঘড়ি করে তৈরী হলো। মেকাপবক্স হাতে তুলেও সাজতে ইচ্ছে হলো না। ঠাস করে সেটা ড্রেসিংটেবিলের উপর রাখলো। বিড়বিড় করে বলল,

“সাজবোই না আজ। এভাবেই বের হবো। অসভ্য লোক। কী চাইছে সে! কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না। এসব কি তার মিথ্যে অভিনয়ের একটা? প্রথমদিনের আচরণ আর পরবর্তী আচরণের পার্থক্যই বুঝিয়ে দিচ্ছে, তিনি গভীর জলের মাছ। আমার সাথে চালাকি মি. আদনান। আমিও আপনাকে বুঝিয়ে দিব, নোভা কতটা বদরা’গী আর চরম লেভেলের পাজি মেয়ে! টের পাবেন, পরে ঠিকই টের পাবেন।”

*****

ড্রাইভে প্রচুর অমনোযোগী মনে হলো আদনানকে। তার কুঁচকে যাওয়া ভ্রু, আর ক্ষণে ক্ষণে কপালের কোণে আঙুল চালানোতে যে কেউ বুঝে যাবে তার দৃষ্টি সামনের দিকে হলেও ভেতরে তার অন্য ঝড় চলছে। তার বেগ কিংবা গতি ঠিক কতটুকু তা সম্পর্কে এই মুহূর্তে কোনো আন্দাজই করা যাচ্ছে না। চোখের পলকে বার কয়েক আদনানের চিন্তিত চেহারাকেই জড়িপ করলো নোভা। ঘাবড়ে গিয়ে বলল,

“আপনি কি কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত আদনান?”

জারা, নোরাকে পিছনে নিয়ে বসেছে মুনতাহা। সামনের দিকে তার কোনো মনোযোগ কিংবা দৃষ্টি নেই। সে নিজের মতো করে বাচ্চাদের সাথে কথা বলছে, হাসছে আবার গল্পের ছলে মাতিয়ে রাখছে দু’জনকে। নোভার প্রশ্ন শুনে উপরনিচ মাথা নাড়লো শুধু। কিন্তু কোনো কথা খুঁজে পেল না। ড্রাইভে মনোযোগ রেখে অনেকক্ষণ পর বলল,

“জরুরী কিছু কথা ছিল নোভা। আমার মনে হয়, আমার কিছু অতীত আপনার জানা উচিত! অতীতের একটা গোপন কথা বর্তমানের সুন্দর সময়টা নষ্ট করতে যথেষ্ট! আমি চাই না, এর প্রভাবটা আপনার কিংবা আমার বাচ্চাদের ভবিষ্যতকে প্রশ্নবিদ্ধ করুক।”

এমনটাই আন্দাজ করেছিল নোভা। রেস্টুরেন্টে আদনান সব সত্য বলেনি। যা বলেছে, উপরদিক দিয়েই বলে গেছে যেন কোনো দোটানা না আসে! এরচেয়ে কঠিন অথবা করুণ কিছু হয়তো লুকিয়ে আছে, যা শুনার মতো ধৈর্য্য কিংবা ইচ্ছে, আগ্রহ কোনোকিছুই আজ তার নেই। অসহায় চোখে আদনানের দিকে তাকালো নোভা। চোখমুখ স্বাভাবিক রেখে জানতে চাইলো,

“আপনি শুধু আমাকে এতটুকু বলুন, স্যার কি আপনাকে এই বিয়ে করতে ফোর্স করেছেন? নিজের মনের ডাকে সাড়া দিন আদনান, কখনও কারও সিদ্ধান্ত নিজের উপর চাপিয়ে দিবেন না। এতে আমি তো কোনোদিন শান্তি পাব না, উলটে সবসময়ের জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হবে।”

মেয়েটা আত্মসম্মানী এই সম্পর্কে ধারণা অনেক আগেই জন্মেছিল আদনানের। প্রথম পরিচয়, টুকরো টুকরো আলাপে বুঝে গিয়েছিল, ভালো এবং মন্দের তফাৎটা ঠিক কোথায়। তাই তো সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেনি সে। ঝটপট নিজের বুদ্ধিসম্পন্ন বিবেককে কাজে লাগিয়েছে। মনে হয়েছে, মোড় ঘুরানোর সময় হয়তো এটাই। কিন্তু কখনও ভাবেনি, নোভা এতটা অভিমানী। তার শান্তশিষ্ট চেহারা আর জ্বল ছলছল আঁখিতে কিছু একটা লুকিয়ে আছে, যা আদনান অতি নিকটে থেকেও ধরতে পারছে না। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটালো সে। হাত বাড়িয়ে বুড়ো আঙুলের স্পর্শে উপচেপড়া পানিকে আটকে নিল দ্রুত। বলল,

“আমার আচরণে কি কখনও প্রকাশ পেয়েছে এমন কিছু? নোভা আমি নিজের বিবেকের কাছে স্পষ্ট থাকতে চাই। ছোট্ট একটা মিথ্যে বলেছি আপনাকে। মিথ্যেটা সামান্য হলেও তার প্রভাব অনেক বোকা। আমি চাই না, কোনো এক হাসিখুশি কিংবা সুখের মুহূর্তে এই মিথ্যেটা আপনার আর আমার মাঝখানে অকারণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর মান-অভিমানের দেয়াল হয়ে দাঁড়াক।”

“আমি কিচ্ছু জানতে চাই না আদনান। কিচ্ছু শুনতে চাই না। আপনার কাছে অনুরোধ, আপনি শুধু আমাকে আমার দায়িত্বটুকু পালন করতে দিবেন। আমি কখনও আপনার প্রথম স্ত্রী’কে নিয়ে কোনোকিছু জানতে চাইবো না, কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবো না আপনাকে, এমনকি জোরও করবো না আমাকে ভালোবাসতে! তবু প্লিজ, পিছনের কোনো কথা এই মুহূর্তে টেনে আনবেন না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদনান। মনোযোগটা রাস্তার দিকে দিল। কী বুঝাতে গেল, আর মেয়েটা কী বুঝলো! সব কথা বলার উপযুক্ত সময় এটা নয়, বেশ বুঝতে পারলো আদনান। কিন্তু এভাবে আর কতদিন। মিথ্যে যে কী পরিমাণ ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে তার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে তার। তবুও চেয়েছিল, নিজের ত্রুটিটা শেয়ার করে ভুল বুঝাবুঝির দেয়ালটা আগেই ভে’ঙে ফেলতে। নয়তো ভবিষ্যতে এর প্রভাবে সাজানো, গোছানো সংসারটাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কীভাবে বুঝাবে এই বোকা মেয়েকে? কীভাবে সব সত্য তুলে ধরবে? রূহানীর দিকটা এখনি পুরোপুরি পরিষ্কার না করলে পরবর্তীতে বিরাট ঝামেলার তৈরী হতে পারে! কে জানে মেয়েটা এখন কোথায় আছে? বেঁচে আছে নাকি মা’রা গেছে, তা-ও জানা নেই!

*****

শপিংমলের ভেতরেও নোভাকে আর স্বাভাবিক থাকতে দেখলো না আদনান। সেই যে মুখ অফ করেছে, আর একটা শব্দও মুখ দিয়ে বের করেনি। যা পছন্দ করছে তা শুধু বাচ্চাদের জন্যই। নিজের জন্য একটা জামাও টাচ্ করে দেখছে না। আদনানের অনুমতি পেয়ে মুনতাহা প্রায় বাড়ির সকলের জন্য জামা-কাপড় পছন্দ করতে নেমে পড়েছে অথচ নোভার মধ্যে সেরকম কোনো ভাবান্তর নেই, উদ্দীপনাও নেই। যতটা নিশ্চুপ, নীরব থাকতে সে পছন্দ করে তারচেয়েও বেশি নীরবতা নিয়ে নিজেকে আগলে নিয়েছে। দৃশ্যটা যতটা ব্যথা দিচ্ছে, ততটাই অস্থির, অশান্ত করে তুলছে তাকে। এমনিতেই মনের ভেতর হাজারও দুঃশ্চিতার জা’ল তৈরী হয়েছে তারমধ্যে নোভার এই অভিমানী আচরণ তাকে শূন্য বানিয়ে ছাড়লো।

বহুদিন পর হৃদয়পুরীতে কারও আনাগোনা স্পষ্ট টের পাচ্ছে আদনান। মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না, সহ্যও করতে পারছে না। অকারণ, অহেতুক এই মান-অভিমানকেই ভীষণ ভয় পায় সে। ভালোবাসতে ভয় হয়, ভয় হয় সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতেও। আচমকাই নোভার হাত ধরে তাকে অন্যদিকে নিয়ে গেল। মুনতাহাকে বললো, বাচ্চাদুটোকে দেখে রাখার জন্য। কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে আসলো শপিংমলের একপাশে থাকা ফুড কর্ণারে। চেয়ার বের করে নোভাকে সেখানে বসিয়ে দিল। ডানহাতটা শক্ত করে ধরে বলল,

“এই অহেতুক অভিমানটাই আমার অপছন্দ নোভা। আমি চাইনি, আমার সামান্য অতীত তুমি বিয়ের আগে নও পরে জানো। যার কারণে তোমাকে ক্লিয়ার করতেই এতসব কথা। এইযে হুট করে সামান্য কথাতেই চটে গেলে এটা কিন্তু খুব বা’জে একটা স্বভাব। কাউকে পুরোটা বুঝিয়ে বলার সময়টুকু দাও, ভুল কিছু ভেবে অকারণ অভিমান জমিয়ে রেখো না।”

বিস্মিত হলো নোভা। ভ্রু’কুটি করে আদনানের দিকে মনোযোগ দিল। আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে সে, তার মানে তাকে নিয়ে আদনান যথেষ্ট সিরিয়াস! পুরোটাই সিরিয়াস। যতখানি অভিমান ছিল, মুহূর্তেই মুছে গেল তার। তবে কথার জবাব না দিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালো। আদনান ফের বলল,

“আশ্চর্য মেয়ে মানুষ তো তুমি! আমায় কৈফিয়তটুকু দেয়ার সুযোগ দিবে না? শুধু শুধু রাগ জমিয়ে রাখবে? ওকে ফাইন, বিয়ের পর যখন জানবে তখন অকারণ ঝামেলা তৈরী করলে খুব খারাপ হবে কিন্তু! নিজেকে তোমার সামনে, ঠ’ক, প্রতার’ক, কিংবা ধোঁকাবা’জ সাজাতে চাই না। আমার দিক থেকে আমি পুরোটাই সৎ থাকতে চাই। তারপরেও যদি এমন বিহেভ করো, আমার আর কিচ্ছু বলার নেই।”

“যে অতীত আপনাকে ধোঁকাবা’জ উপাধি দিতে পারে, এমন কোনো সন্দেহ থাকলে, সে অতীত জানার কোনো প্রয়োজন আমার নেই। মানুষকে বিচার করার জন্য যথেষ্ট বিবেক-বুদ্ধি আমার আছে! এই মুহূর্তে শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, আপনি ভীষণ ভয় পাচ্ছেন। কীসের ভয় আপনার? সম্পর্ক ভা’ঙার? তবে কি আমি ধরে নিব, এটা কাউকে ভালোবাসার পূর্বলক্ষ্মণ? যখন মানুষ কারও প্রেমে পড়ে, কাউকে ভালোবাসে, তখনই কিন্তু সে ভয় পেতে শুরু করে! হারানোর ভয় প্রতি মুহূর্তে তাকে শঙ্কিত, আতঙ্কিত রাখে।”

নীরবে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল আদনান, মুখ ফুটে কথার উত্তরে কিছু বললো না। নোভা তার হাতের বাঁধনটায় জোর দিয়ে বলল,

“একদম ঠিক হয়নি।”

চমকে উঠলো আদনান। ভরকালো। শুকনো গলায় ঢুক গিললো। বিস্মিত চোখে জানতে চাইলো,

“কেন? তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো?”

প্রচণ্ড হাসি পেল নোভার। আদনানকে খানিকটা ভরকে দিতে বলল,

“আমার সাইজ দেখেছেন? ভালোবাসা আমার জন্য কখনওই ছিল না। মনের আকাশে কখনও রঙিন ঘুড়ি উড়েনি, প্রজাপতি ডানা মেলেনি, দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে কেউ বলেনি, তুমি এমনিই সুন্দর, এভাবেই পারফেক্ট!”

বেদনাজনিত মলিন কণ্ঠস্বরও হৃদয়ে নাড়া দিয়ে উঠলো আদনানের। আনমনেই বিড়বিড় করলো,
“তুমি যেমনই হও তেমনই থাকো। আমার থাকো, সবসময়। পৃথিবী দেখুক, জানুক, বুঝুক, মানুষের আসল সৌন্দর্য বাস করে তার মনে। যে মেয়েরা মায়াবতী, তারা কোনো জাদুম’ন্ত্র, তাবিজ-কবজ ছাড়াই অন্যকে পরাজিত সৈনিক বানিয়ে ফেলতে পারে। প্রেমের জন্য, ভালোবাসার জন্য চণ্ডিদাস যদি রজকিনীর পথচেয়ে প্রেমের বড়শী বাইতে পারে, শিরি-ফরহাদ যদি স্মরণীয় এক ইতিহাস রচনা তৈরী করতে পারে, তবে আমি পারবো, তোমার জন্য এক সমুদ্র ভালোবাসা কুড়িয়ে আনতে। শুধু মন থেকে উপলব্ধি করো, ভরসা করো আমায়!”

নোভা সে-কথা শুনলো কি-না ঠিক নেই, তবে আদনানের এমন ভীতিগ্রস্ত চোখমুখ দেখে খিলখিল করে হাসলো সে। ঠিক সেদিনের মতো আবারও গজ দাঁতের হাসিতে নিজেকে হারিয়ে ফেললো আদনান, মনে হলো; বাঁচার জন্য কেউ এসেছে জীবনে, সুখ এসে ধরা দিয়েছে মনের গহীন ভেতরে। অতীতের একটুখানি ধূসরস্মৃতিও এক নিমিষেই দূরে সরিয়ে দিল সে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলো নিজের কাছে। সময় এসেছে, আবারও ভালোবাসার, আবারও সুন্দর জীবনের জন্য এগোবার।

*****

চলবে…

[ এই গল্পে আদনান চরিত্রটা জটিল, এবং কঠিনও। তাই আশা করবো ধৈর্য নিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়ুন। ভালো কিছু পাবেন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here