সম্পূর্ণা-৭

0
642

সম্পূর্ণা-৭
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

সময়ে, অসময়ে দুঃশ্চিন্তার মুখোমুখি হলে একটা মানুষ খুব বা’জে পরিস্থিতি পড়ে। মনের ভেতর অকারণ এটা-সেটা নিয়ে নানারকম চিন্তার উদ্ভব হয়! মনের সাথে মনের অকারণ দ্ব*ন্দ্ব হয়, এই দ্ব*ন্দ্ব থেকে মুক্তির কোনো উপায়ও সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। ঘণ্টাখানেক ধরে দুঃশ্চিতার ভারে রীতিমতো মাথাব্যথা শুরু হলো নোভার। কিন্তু তার থেকে পরিত্রাণের কোনো পথই সে খুঁজে পেল না। দু’হাতে চুল খাম*চে ধরে সোফায় হেলান দিয়ে বসে রইলো। অনেকক্ষণ ধরে নোভার এই অস্থিরতা পর্যবেক্ষণ করলো নায়লা। চায়ের কাপ পাশে রেখে বলল,

“হয়েছে কী তোর? কী এত ভাবছিস তুই?”

ফেইসবুক পেইজের ফলোয়ারদের মধ্যে তার রেগুলার কয়েকজন কাস্টমার আছে, যারা প্রতিদিন নিয়ম করে বিভিন্ন খাবার অর্ডার করে থাকে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। বেশ কয়েকটা অর্ডারের কাজ কমপ্লিট করে সেগুলো পার্সেল করে দিয়েছে। আপাতত এই কাজ করেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দিচ্ছে সে। ফাঁকে ফাঁকে জারা, নোরার সাথে অল্পস্বল্প আলাপ হয়। এইতো বেশ! দিব্যি দিন চলে যাচ্ছে। চাকরি থেকে রিজাইন নিয়েও সে বসে নেই। দুঃশ্চিন্তা এখন এটা নিয়েই। বিয়ের পর এই কাজটা করতে পারবে তো? আদনান কোনোপ্রকার বাঁধা তৈরী করলে সবকিছু যে জলে ভেসে যাওয়ার জোগাড় হবে। নায়লার প্রেগন্যান্সির ছ’মাস চলছে। এই মুহূর্তে পরিবারের সব চাপ গিয়ে পড়ছে সাদাফের উপর। বেচারা কাউকে কিছু বলছে না ঠিকই, তবু নোভা বুঝতে পারে! ভাইটা দিনরাত এক করে সংসারের পিছনে ব্যয় করে চলেছে। ব্যক্তিগত সঞ্চয়ও করতে পারছে না। যা পাচ্ছে হাতে হাতে খরচ হয়ে যাচ্ছে। নায়লার প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না নোভা। মাথা খানিকটা নিচু রেখে নায়লার পেটের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

“বলতো বাবাই, ফুপ্পির কী করা উচিত? বিয়ের পর যদি এই কাজটা হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন তোর বাবা যে দিশেহারা হয়ে যাবে! তুই একটা বুদ্ধি দিবি আমাকে?”

নোভার দুঃশ্চিতার কারণটা এবার বুঝতে পারলো নায়লা। মুচকি হেসে বলল,

“তুই শুধু শুধু ভাবছিস। চলে যাবে যেকোনোভাবে। তোর ভাই তো আছেই!”

ঠিক সেই মুহূর্তে ছোটো ছোটো হাত-পায়ের ছোটাছুটি টের পেল নোভা। বলল,

“এই পা*জি ছেলে। মা’কে বিরক্ত করা হচ্ছে? একদম শান্ত হয়ে থাকো বলছি।”

নোভার এই আহ্লাদী কথাতে ছোটাছুটি থামলোই না বরং দ্বিগুণ বেড়ে গেল। নায়লা তার ফেইস দেখে খিলখিল করে হাসলো। বলল,

“তোর কথা ওর পছন্দ হয়েছে। এজন্যই খুশিতে লাফাচ্ছে। পৃথিবীর মুখ দেখার কত তাড়া তার!”

সোজা হয়ে বসলো নোভা। চায়ের কাপ হাতে তুলে তাতে চুমুক বসালো। ক্লান্তি আর দুঃশ্চিতার ভাবটা দূরে সরিয়ে বলল,

“ভাবী, এই কাজটা যদি থেমে যায়? সবকিছু সামলানো খুব কঠিন হয়ে যাবে, তাই না? আদনানকে বলবো? কিছু ভাবতে পারছি না ভাবী, সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে!”

নায়লা তার হাতটা ধরলো। নরম কণ্ঠে বলল,

“একটা মেয়ে বুঝ হওয়ার পর থেকে নিজের জন্য বাঁচতে চায়। স্বপ্ন দেখে জীবনে ভালোবাসা আসবে, সুখ আসবে, আসবে জীবনটাকে পরিপূর্ণ করার জন্য একজন মানুষ। কিন্তু তুই আমার দেখা এমনই এক নারী, যে কি-না নিজের জন্য স্বপ্ন দেখেনি কখনও। পরের জন্য নিজের সব চেষ্টাকে বিলি করে সাধ্য অনুযায়ী সবকিছু সামলে নেয়ার চেষ্টা করছিস। তোর নিজেরও তো একটা চাওয়া আছে, স্বপ্ন আছে, আছে ভালোবাসার জন্য সুপ্ত একটা মন। তুই বরং নিজের আগামী নিয়ে ভাব, ভাইয়া, আংকেল, জারা আর নোরা ওদেরকে নিয়ে সুন্দর একটা জগৎ তৈরী কর।”

নোভা জবাব খুঁজে পেল না। নিরুত্তর, নীরব, শান্ত হয়ে বসে রইলো। তার হাতটা তখনও নায়লার হাতে আটকে আছে। হ্যাঁ, নিজের জন্য সে স্বপ্ন দেখেনি কোনোদিন। যেদিন থেকে বুঝতে পারলো, মানুষজনের নোংরা দৃষ্টি কভু পাল্টানোর নয়, সেদিন থেকে ঘর-সংসার আর ভালোবাসার স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছে সে। আদনানের সাথে সম্বন্ধ ঠিকঠাক হওয়ার পরই অবচেতন মনে ঘুরেফিরে ওই প্রাণবন্ত মানুষটার চেহারা উঁকি মা*র*ছে। যার কথাতে ভরসা মিলে, যার চিন্তাচেতনা আর গভীর ভাবনা তাকে প্রশান্তি দেয়, যার কণ্ঠস্বরে ‘তুমি’ নামক ছোট্ট শব্দটায় হাজারও না বলা অনুভূতি ঝরে পড়ে, অশান্ত মন দিকবিদিকশুন্য হয়ে দিনরাত যাকে খুঁজে ফিরে, শুধু ক্ষণে ক্ষণে তাকে নিয়েই ভাবতে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, সময়টাকে এভাবেই, ওই সুখের মুহূর্ততেই আটকে দিক চিরদিনের জন্য। ভাবনাগুলো এমন থাকুক, স্বচ্ছ, সুন্দর আর বিশ্বস্ত হয়ে! ব্যকুল মনের চিন্তাভাবনা থামিয়ে বলল,

“আমার কী মনে হয় জানো ভাবী, ওই সুখটুকু পাওয়ার যোগ্য আমি নই! মানুষটা সুখী হবে তো? প্রতি পদে পদে, তাঁকে কোনোদিন শুনতে হবে না তো, আমরা একে-অপরের জন্য পারফেক্ট নই?”

“ওতো ভাবিস না! ভাইয়া যেহেতু নিজে থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি যখন বুঝতে পেরেছেন, সমাজে চলতে গেলে বয়স, চেহারা, কিংবা উঁচুনিচু আর শারিরীক ত্রুটি-বিচ্যুতি কোনো সমস্যা তৈরী করতে পারে না, যেখানে মনের মিলেই দু’জন অজেনা মানুষ তৈরী করে সুখের সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্য কিছু নিন্দু*কের কথায় কখনও ভা*ঙ*বে না নোভা। সেখানে তুই কেন মিছেমিছি ভয়কে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছিস? সব ভয় দূরে সরা, মানুষটাকে ভরসা কর, বিশ্বাস কর, একদিন ঠিকই বুঝতে পারবি, আদনান ভাই কতটা যোগ্যতাসম্পন্ন একটা মানুষ। যার ব্যক্তিত্বই শুধু অসাধারণ নয়, অসাধারণ তার মন-মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা!”

নায়লা তাকে ভরসা দিল। বুঝালো। অকারণ দুঃশ্চিন্তা করতে নিষেধ করলো। তবুও নোভার মনে ক্ষণে ক্ষণে অনেকগুলো প্রশ্নেরই উদয় হলো, ‘যা হচ্ছে সব ঠিক হচ্ছে তো? কোথাও কি কোনো ভুল হচ্ছে? জীবনে প্রথমবার যাকে ভরসা করে মন-প্রাণ হা*রি*য়ে ফেলতে যাচ্ছে, সারাজীবন সে পাশে থাকবে তো? ভরসা হবে তো? আগলে রাখবে তো ভালোবাসা দিয়ে? সীমাহীন সুখের প্রয়োজন নেই, শুধু একটুখানি ভরসা হয়ে মাথায় হাত রাখবে তো? বলবে তো, ভয় নেই আমি আছি তো পাশে?’ নোভার যে শুধু এইটুকু চাই।

*****

সময় যত এগোচ্ছে নোভার দুঃশ্চিতা তত বাড়ছে। একেই তো নিজেকে নিয়ে তার টেনশনের শেষ নেই, তবে কখনও আফসোস হয়নি। তবু সমাজের মানুষগুলোকে সে ভীষণ ভয় পায়। এরা যে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। সামনে এক কথা বলবে, আড়ালে গিয়ে অন্য কথা। এতসব কথার জা’ল যে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করার কোনো যুক্তি তার জানা নেই। প্রতি মুহূর্তে ভয় তাকে কাঁপিয়ে দেয়, ভেতরে হাজারও আত*ঙ্কের জন্ম দেয়, সেই আত*ঙ্ক কে*ড়ে নেয় রাতের ঘুমটুকুও। দুঃশ্চিন্তা ভুলে ঘুমোতে গেলেই আবারও দু’চোখের পাতায় জমা হয় অসংখ্য প্রশ্নের। জীবনের এত জটিল হিসাব নোভা বুঝে না। শুধু বুঝে নিজেকে ভালোবাসতে হবে। নিজের জন্য বাঁচতে হবে। মানুষ খুঁ*চি*য়ে যা-ই বলুক, সবকথা সে গিলবে না। এক কান দিয়ে শুনে, অন্য কান দিয়ে বের করে দিবে, তবুও বাচ্চাদুটোকে মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে দিবে না।

একদিকে পারিবারিক টানাপোড়ন, অন্যদিকে নিজেকে নিয়ে ভয়, এই দুটোর চাপে পড়ে নিজের জন্য সামান্য স্বস্তিটুকুও খুঁজে পাচ্ছে না নোভা। খুব করে মামাকে বলেছে, তিনি যেন বেশি খরচ না করেন। বিয়েতে এত খরচ করতে গেলে পরবর্তীতে অনেক চাপের মুখে পড়তে হবে। এমনিতেও নায়লা অসুস্থ। ক’দিন পর তাকে নিয়েই হসপিটাল আর বাড়ি ছোটাছুটি করতে হবে। এতসব ভাবনায় রাত্রি তখন নিশিথে রূপান্তরিত হয়েছে। তবুও ঘুমটা আজ অধরাই থেকে গেছে। দুঃশ্চিন্তা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন শান্তির ঘুমটাও হা*রা*ম হয়ে যায়। এই নির্ঘুম রাতটাও বুঝি জেনে নিল তার অশান্তির কারণ। বড়ো অসময়ে ফোনটা স্ব শব্দে বেজে উঠলো। ডিসপ্লেতে চোখ বুলালো নোভা। সময়টা দেখে আৎ*কে উঠলো। অন্তরাত্মা অজানা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে ঝরঝরে শব্দ, মন-মেজাজে প্রশান্তি ছুঁইয়ে দেয়া কণ্ঠস্বর শুনলো।

“কী ম্যাডাম? জেগে আছো? আমি তো ভাবলাম, এত দ্রুত ঘুমকন্যা ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝি! ফোন রিসিভই করছে না। অসময়ে বিরক্ত করছি না তো?”

নোভার মনে হয়, আদনান তাকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবছে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না! তার হাবভাব চাল-চলন সবই ঠিক আছে, তবুও কোথাও সে ভয় পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, যা হচ্ছে একদমই ঠিক হচ্ছে না। কোনো জবাব আসলো না মুখ দিয়ে। গভীর ভাবনায় সে এতটাই ডুব দিল যে, ওপাশে একটা মানুষ মুখিয়ে রইলো তার কণ্ঠস্বর শুনার জন্য, অথচ তার নিশ্চুপ, নীরবতাতে সে-ও বুঝে গেল, নোভা এখনও সহজ হতে পারছে না। কথা ঘুরাতে বলল,

“যদি বেশি ঘুম পায়, তবে এটা রিসিভ না করলেই পারতে!”

এইটুকুতে কারও অভিমান হতে পারে, জানা ছিল না নোভার। কখনও ভালোবাসা জীবনে আসেনি, বুঝেনি মান-অভিমানের পাল্লা কেমন হয়, এ-ও বুঝে না; এই সুখটা তার পুরোপুরি সইবে তো! আত*ঙ্কে, ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“একটা দোটানায় পড়েছি আমি। আমার মনে হচ্ছে, আমি আপনার অযোগ্য! মনে হয়, কোনো এক সময় আপনি আমার কারণে অনেক ক*টু কথার সম্মুখীন হবেন, অনেক বা*জে পরিস্থিতিতে পড়বেন। এখনও সময় আছে আদনান, আপনি আরও দু’দিন ভেবে দেখতে পারেন।”

“তোমার কি মনে হয়? আমি একদিনে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি?”

তীব্র অথচ তেজী কণ্ঠস্বর! রাগী, গম্ভীর, অথচ অনুভূতিতে ভরপুর, মাদ*কতা জড়ানো শব্দ, এক নিমিষেই পুরো শরীর কেঁপে উঠলো নোভার। বুঝতে পারলো, ভুল সময়ে ভুল কথাটা বলে ফেলেছে। নয়তো, এভাবে হুংকা*র ছাড়তো না আদনান। পুরো কথার অর্থ তার বোধগম্য হলো না, তাই খানিকটা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল,

“মানে?”

“শুনো! স্রষ্টার সৃষ্টিতে কোনো ত্রুটি নেই এটা ঠিক কিন্তু ত্রুটি মানুষের চিন্তাভাবনায়। তিনি যেমন মানুষকে নিখুঁত অবয়ব দিয়েছেন তেমনি দিয়েছেন দোষ-ত্রুটি বুঝার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান। কেউ এই জ্ঞানটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগায়, কেউ-বা ভুলভাবে। যার কারণে একজনের চিন্তাভাবনার সাথে অন্যজনের পার্থক্য। দোষে-গুণেই তো মানুষ! কাউকে যে একেবারে সর্বগুণে গুণান্বিত হতে হবে তা নয়, থাকুক না কিছু ত্রুটি! তাতে ক্ষতি কী? সবাইকে কি একই পাল্লায় মাপলে চলবে?”

ভুল হলো, বড্ড ভুল হলো। এত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তো সে চায়নি। চেয়েছে শুধু মনের অশান্তি লাঘবসূচক ছোট্ট একটা শব্দ। হ্যাঁ অথবা না। অথচ আদনান, রেগেমেগে পুরো তাৎপর্য তুলে ধরতে চাইছে। মাঝেমধ্যে শব্দরা হারিয়ে যায়, কথারা ফুরিয়ে, উপযুক্ত জবাবের অভাব শুরু হয়, গলা বসে যায়, কোনো কথা আসে না। নিজের নীরব অস্তিত্ব জানান দেয়, হে*রে যাওয়ার এই বুঝি শুরু। এমনভাবে বার বার হারতেও রাজি আছে নোভা। যদি মানুষটা এভাবেই থাকে, এমনই থাকে, আগলে রাখে সবসময়। প্রতুত্তরে কিছু তো বলা উচিত। অথচ সময় বুঝে, গলার জোরও হারিয়ে গেছে। কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে নিঃশ্বাসের শব্দে বলল,

“আ’ম সরি!”

পক্ষান্তরে মুচকি হাসলো আদনান। দু’দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে ব্রেঞ্চে বসে দেয়ালে মাথা ঠেকালো। বলল,

“শুধু এইটুকুই? আমি তো সরি’তে গলে যাওয়ার পাত্র নই! যে কথা বলেছো, তা উইথড্র করো। যতক্ষণ না এই ফাল*তু অভিযাগটা নিজের উপর থেকে সরাচ্ছো, ততক্ষণ আমার রাগ কমবে না। আমি এভাবেই ফোন কানে নিয়ে বসে থাকবো। আজ ঘুমাবোও না। এবার দেখি, কীভাবে রাগ ভাঙাও!”

“এটা অহেতুক রাগ! একদম ঠিক হচ্ছে না।”

“তুমি যে কথাটা বলেছো, সেটাও অহেতুক কথাবার্তার মধ্যেই পড়ে। যুক্তি ছাড়া কোনো কথা বলবে না। এমন বোকা বোকা চিন্তা মাথায় গেঁথে রাখো দেখেই, আমার সহজ কথাও সহজে নিতে পারো না।”

বেকায়দায় ফেঁ*সে গেল নোভা। কী বলে রাগ ভাঙানো উচিত তা-ও তো জানা নেই তার। কখনও এমন অভিমানী অভিযোগের পাল্লায় সে পড়েনি। প্রেম-ভালোবাসায় এমন সুন্দর অনুভূতি মিশে থাকে, তা তো আগে জানা হয়নি তার। হুট করে কী বলবে! আদনানের কথাবার্তাতেই স্পষ্ট, এই সামান্য সরি’তে তার মনের ক্ষ*ত সারবে না। অজান্তেই অনেক কঠিন কথা বলে ফেলেছে সে। নীরবে জবাব খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আদনানও কিছু একটা শুনার আসার কান বাড়িয়ে রাখলো, মন এগিয়ে রাখলো, তবু কোনো কাঙ্ক্ষিত আওয়াজ তার কানে এলো না। অনেকক্ষণ পর নোভা মুখ খুললো। নিজেকে ধাতস্থ করে স্পষ্ট বাক্যে বলল,

“স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই আমি, ভীষণ ভয় পাই! যা আমার হবে না, হওয়ার নয়, যা কিছুর যোগ্য আমি নই, তা যদি কেউ হুট করে দু’হাত ভরে সামনে নিয়ে আসে, তখন তো সেটা অবিশ্বাস্যই মনে হবে। আমারও তাই মনে হচ্ছে।”

নোভার এই কথাটা ফেলা দেওয়ার নয়। এটা তো আদনান জানতোই। জিসানের মুখোমুখি হয়েই তো পুরো ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে গেছে তার। জেনেশুনেই তো নোভাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে সে। এখানে তো কোনো মিথ্যে নেই, নেই কোনো ছলনাও। তবুও মেয়েটা কেন এত ভয় পাচ্ছে বুঝতে পারলো না আদনান। তাকে খানিকটা ভরসা দিতেই বলল,

“চোখ বন্ধ করো! অন্ধকারে কী ভাসে চোখে? সেখানে কি আমার অস্তিত্ব আছে? যদি পাও, তবুও কি আমাকে ফিরিয়ে দেয়ার দুঃসাহস দেখাবে?”

কেঁদে ফেলার জোগাড় হলো নোভার। এই ছেলেটার একেকটা কথায় দ*ম বন্ধ হয়ে আসে তার। যা কিছু নি*ষি*দ্ধ, যা কিছু সুদুরপ্রসারি চিন্তাভাবনার ফল, অবাধ্য, অশান্ত মন তা-ই খুঁজে পেতে পায়। কিছুক্ষণ দু’চোখ বন্ধ করে রাখলো নোভা। অন্ধকার, শুনশান, নিস্তব্ধ একটা মুহূর্ত। তার ভেতরে একটা ছায়ার উপস্থিতি। হাত বাড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে সে। ইশারা করলো, কাছে ছুটে যেতে। সেই অন্ধকারে থাকা পুরুষটা যে ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তি, অশান্ত মন শুধু সেটাই ইঙ্গিত দিল। ভয়, দোটানা, দুঃশ্চিতাকে এক পলকেই পি*ষে ফেললো নোভা। মুখ ফুটে কোনো জবাব দিতে পারলো না আর, ঝরঝর করে অবাধ্য অশ্রুটুকু নির্গত হলো তার দু’চোখ বেয়ে! মুক্তোদানার মতো গড়িয়ে পড়া পানি নরম চিবুক ছাড়িয়ে গলার কাছে এসে মিশে গেল। মনের সাথে মনের এই নিঃশব্দের লেনদেনের মুহূর্তটা সাক্ষী হয়ে রইলো গোটা নিশুতিরাতও। তারাও জানলো, কিছু অব্যক্ত কথা, কিছু স্বপ্ন পূরণের গল্প, বাঁচিয়ে রাখলো কিছু মধুময় স্মৃতি!

*****

একটা কফিশপে বসে আছে দুই বন্ধু। বহুদিন পর দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছে তাদের। অবশ্য তারা কখনও সংখ্যায় দু’জন ছিল না, ছিল তিনজন। একজন পৃথিবীর বুক থেকে অনেক আগেই দূরে হারিয়ে গেছে। শুধু সে স্মৃতির মাঝে বেঁচে আছে, বেঁচে আছে দু’জনার মনের অনেক গভীরে, যেখান থেকে তাকে টেনেহিঁ*চড়েও কেউ বের করতে পারবে না। বন্ধুত্ব সবসময় এমনই হওয়া উচিত। মানুষ মা*রা যাওয়ার পরও যেন অন্তরে চিরদিন বেঁচে থাকতে পারে সেরকমই সম্পর্ক হওয়া উচিত। সময়ের সাথে হয়তো অনেককিছুই পালটে যায়, কিন্তু প্রকৃত সম্পর্ক সবসময়ই বেঁচে থাকে, তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় চিরকাল। এমন সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার নামই তো বন্ধুত্ব! আদনান আর সাফফাতের মাঝখান থেকে হারিয়ে যাওয়া তাদের অন্য বন্ধু হয়তো মৃ*ত্যুর কাছে হে*রে গেছে কিন্তু জিতে গেছে এমন দুটো বন্ধুর ভালোবাসার কাছে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ খুললো সাফফাত। বলল,

“হঠাৎ এত আর্জেন্ট কল! কোনো সমস্যা হয়েছে? বাচ্চারা ঠিক আছে তো?”

জবাবে মাথা দুলালো আদনান। ফোনের গ্যালারি ওপেন করে বহু পুরনো একটা ছবি বের করলো। তার সাথে এডিট করে দিয়েছিল, সেদিন রেস্টুরেন্টে বসে তোলা নোরা আর নোভার পিকচারটাও। সেই এডিট করা পিকচারই সাফফাতের সামনে তুলে ধরলো আদনান। বলল,

“দেখতো, চেহারায় মিল আছে কি-না!”

খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখলো সাফফাত। একটা সময় তার চোখদুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। স্ক্রিনের দৃষ্টি সরিয়ে আদনানকে দেখলো, ছেলেটা মুচকি হাসছে। ফের ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলালো। অবিশ্বাস্য কিছু আবিষ্কার করতে পেরে গলা দিয়ে একটা আওয়াজই বের হলো,

“ও মাই গড! হাউ ইজ ইট পসিবল? এটা তো সেই মেয়ে না, ঠিক সাড়ে চার বছর আগে শপিংমলে যে মেয়েটা জারাকে লুফে নিয়েছিল? কী দৌড়টাই না দিয়েছিলাম সেদিন! কিন্তু এখন এই মেয়ের সঙ্গে নোরা কীভাবে?”

আদনান এবারও হাসলো। সামনে থাকা বিয়ের কার্ডটা বাড়িয়ে দিল সাফফাতের দিকে। বলল,

“বিয়ে ঠিকঠাক দোস্ত! তা-ও এই মেয়েটার সাথে। সৌভাগ্য না-কি দুর্ভাগ্য জানি না, শুধু এইটুকু মনে হচ্ছে, সি ডিজার্ভ টু বি আ গুড মাদার এন্ড আ গুড পার্টনার! জীবন সাজানোর জন্য বেশিকিছুর প্রয়োজন পড়ে না, যদি এমন একজন মানুষ সঙ্গী হয়!”

সাফফাতের বিভ্রান্তি তখনও কাটছে না। বিস্মিত চোখেই বন্ধুর সকল কথা সে শুনছে। হ্যাঁ, সেদিন কাকতালীয়ভাবে নোভা একটা মারাত্মক দুর্ঘটনার হাত থেকে জারাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। সে ঘটনার পর থেকে শহরের অলিগলিতে নোভাকে অনেক খুঁজেছিল আদনান, শুধুমাত্র একটা ধন্যবাদ দেয়ার জন্য। যেভাবে জারাকে বাঁচিয়েছিল সেভাবেই জোর গলায় একটা ধমক মে*রেছিল সাফফাতকে বলেছিল,

“বাচ্চা আগলে রাখতে না পারলে তাকে নিয়ে রাস্তায় বের হোন কেন? যত্তসব দায়িত্বজ্ঞানহীন লোক! সরেন তো…!”

প্রায় ধা*ক্কা দিয়ে সাফফাতকে সরিয়ে শপিংমল থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে এসেছিল নোভা। আদনান দূর থেকে দেখছিল, জারাকে ঠিক কীভাবে বুকে আগলে নিয়েছিল অচেনা এই মায়াবতী নারী। অজস্র চুমু খাচ্ছিলো মুখে। বার বার আতঙ্কিত কণ্ঠে জানতে চেয়েছিল,

“ব্যথা পেয়েছো সোনা? কোথাও লাগেনি তো তোমার? কতটা লেগেছে বলো!”

ওইটুকু বাচ্চা কোনো জবাবই দিতে পারেনি তবে নোভার আতঙ্কিত চেহারাতে আদনান ঠিকই সেদিন আবিষ্কার করেছিল, মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব বোধ ঠিক পরিমাণ জেগে থাকলে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও একটা বাচ্চাকে কেউ বাঁচায়! হতবিহ্বল আদনান ঝটপট সেই দৃশ্যটা অজান্তেই ক্লিক করেছিল, এরপর যেভাবে চোখের পলকে নোভা অদৃশ্য হলো, সেদিন থেকেই শুরু হলো তাকে খোঁজে বের করা। একটা সময় ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিল আদনান। বুঝতে পারলো, খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতো অবস্থা, তাই হাল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল সে।

ছবিটা ভালোমতো দেখে মোবাইলটা আদনানের হাতে দিল সাফফাত। বলল,
“বাচ্চাদের কথা বলেছিস তাকে?”

“বলতে চেয়েছি, সে শুনতে নারাজ!”

“কেন? পরে তো ঝামেলা হতে পারে! দেখ, যদি রূহানী বেঁচে থাকে, তবে একদিন না একদিন সে বাচ্চাদের খুঁজে তোর ঠিকানায় আসবেই। কারণ সে খুব ভালো করেই জানে, তার বাচ্চাদুটো কার কাছে আছে!”

“এটাই তো সমস্যা এখন। কিন্তু নোভা তো এসব কথা শুনতে চাইছে না।”

“ঝামেলা বাড়াস না। এখনও সময় আছে, বিয়ের আগেই সব ক্লিয়ার কর। যতদূর বুঝতে পারলাম, মেয়েটা বাচ্চাদের সাথে মিশে গেছে। এখন যদি কেউ ওদের কে*ড়ে নিতে আসে, ঠিক কী পরিমাণ আঘাত আসবে বুঝতে পারছিস তুই? সমস্যা বাড়তে দিস না। আজই বল, পারলে এক্ষুণি বল!”

জোর দিয়ে বললো সাফফাত। আদনান হতাশ হয়ে তাকালো। দু’হাতে চোখ-মুখ মুছে মাথাটা হেলিয়ে বলল,

“ঝামেলা আগেই বাড়িয়ে ফেলেছি রে! মিথ্যে বলেই ভুল করেছি। এখন এই সত্যিটা ওর জন্য কতটা হজমযোগ্য সেটাই বুঝতে পারছি না। ভুল বুঝে যদি বিয়েটাই ভে*ঙে দেয়, ওকে তো হারাবোই, নিজেকেও কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না।”

“জেনে-বুঝে এমন একটা কাজ তুই কেন করলি? তুই তো জানিস, বাচ্চাদুটো কার!”

টেনশনে দিশেহারা অবস্থা হলো আদনানের। নোভার সাথে গতকাল রাতের আলাপের সময়টুকু বুকে লাগছে। মেয়েটার নীরব কান্না বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। বুঝতে পারছিল, বিশ্বাসের সবে শুরু। বার বার মনে হচ্ছে, এতসব কথা নোভা যেদিন জানবে, মনে তো আঘাত পাবেই, অভিমানে, অপমানে দূরে সরিয়ে দিবে তাকেও। ভুল করেও আর যোগাযোগ করবে না। কারণ নোভা এখনও সিদ্ধান্তের পুরো ভারটাই তার উপর দিয়েছে। তাকে বিশ্বাস করে এতদূর এগিয়েছে। মাঝপথে এই বিশ্বাস কি এখন ভে*ঙে দেয়া উচিত হবে? কবে আসবে নির্দিষ্ট সময়? কোনো ভুল বুঝাবুঝি, মান-অভিমান ছাড়া কবে সে সব সত্য তুলে ধরতে পারবে নোভার সামনে? কবে বলতে পারবে, জারা আর নোরা তার সন্তান নয়! বরং তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু তানভীর আর তার স্ত্রী’র ফেলে যাওয়া আমানত। সেই রূহানী সিকদার, যাকে এক সময় মনে-প্রাণে নিজের আকাঙ্ক্ষিত নারী হিসেবে চেয়েছিল সে, অথচ সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ ছিল উলটো! সব হারিয়ে যায় জীবন থেকে, যাকেই সে ভালোবেসে বেঁচে থাকতে চায়, সে-ই ভুল বুঝে দূরে হারিয়ে যায়। হারাতে হারাতে আজ তো সে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত পথিক। যার জীবন এখন ভালোবাসার অভাবে শুকনো, খটখটে মরুভূমি। যেই মরুভূমির বালুচরে শীতল বৃষ্টির স্পর্শ নিয়ে নোভাও জড়িয়ে গিয়েছিল, এখন কি নিজের ভুলে তাকেও হারিয়ে ফেলবে? দু’হাতে নিজের চুল খা*ম*ছে ধরলো আদনান। টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে অসহায়ভাবে উচ্চারণ করলো,

“খোদা, তুমি তো জানো আমি কতখানি অসহায় ছিলাম। বাধ্য হয়েছি মিথ্যে বলতে। এই সামান্য ভুলের জন্য কঠিন কোনো শা*স্তি তুমি দিও না আমায়। বেঁচে থাকাটাই তো শেষে কঠিন হয়ে যাবে!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here