সম্পূর্ণা-৮,৯
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
৮
স্মৃতি মানুষকে ক্ষণে ক্ষণে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, হাসায়, কাঁদায়, আবার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ছবি মনের গভীর থেকে নিয়ে আসে চোখের পর্দায়। সেখানে মিশে থাকে কিছু রঙিন শৈশব, কৈশোর আর জীবনের চঞ্চলতা। সেই পর্দার সামনে মানুষ খুঁজেফিরে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে। ঝকঝকে আয়নার সামনে যেমন স্পষ্ট একটা অবয়ব মিশে থাকে, ঠিক তেমনি নিজের সামনে এই মুহূর্তে একটা ক*ফি*ন আবিষ্কার করলো নোভা। তার ভেতরে থাকা একটা মৃ*ত*দেহ। তার ছেলেবেলাতেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটা যে, সংসারের অভাব, অনটন দূর করতে সুদূর প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিল, বছর খানেক পর সেই তরতাজা মানুষটা ফিরে এলো লা*শ হয়ে। ঝরঝর করে চোখের পানি ফেললো নোভা। যাওয়ার বেলা বাবা বলেছিলেন, তিনি ফিরে আসবেন আবারও। কই? ফিরলেন না তো! কেন তিনি তার বাচ্চাকে দেয়া কথা রাখতে পারলেন না? মৃ*ত্যু*র কাছে কেন সবকিছু অসহায় হয়ে পড়ে? কেন য*মদূ*ত তার বাবাকেই কে*ড়ে নিল? কেন তাকে বাবার অনাদরে দিন কাটাতে হলো? কেন সোনালী সুখের শৈশবটা বেদনার নোনা জলে ভেসে গেল? এতসব কথার কোনো উত্তর জানা নেই নোভার। শুধু জানে, যিনি জীবন-মৃ*ত্যু*র মালিক, যিনি ভূ-মণ্ডলকে নিজের ইশারায় ঘুরান, তার সিদ্ধান্তের বাইরে মানবজীবনের চাওয়া-পাওয়া সবসময়ই অচল!
একটা কাঙ্ক্ষিত স্মৃতিমধুর দিনও অতীতের বেদনাদায়ক দৃশ্যের কাছে অসহায় হয়ে গেল। যেদিন প্রবাস থেকে তার বাবার মৃ*ত*দেহ বাড়ির উঠোনে আসলো, সেদিন থেকেই অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে যান নোভার মা অনন্যা। খালিদ সাহেব অসুস্থ বোন আর বোনের একমাত্র মেয়েকে নিজের কাছেই নিয়ে আসেন। দাদা বাড়িতে নোভার আত্মীয়স্বজন থাকলেও, বাবার মৃ*ত্যুর পর আর সেখানে যাওয়া হয়নি তার। কেউ খোঁজও নেয়নি তাদের। শয্যাশায়ী মা-ও একদিন মৃ*ত্যু*কে আলিঙ্গন করে নেন। সেই থেকে সাদাফ আর মুনতাহার সাথে, নানা বাড়িতেই বেড়ে উঠে নোভা। শৈশবের যতসব সুন্দর স্মৃতি সবকিছুর শুরু এখান থেকেই। আজ নববধূর সাজটাও এই বাড়িতেই হলো। এখান থেকেই হবে কনে বিদায়!
হাতের আঙুলে টান পেয়ে সম্বিত ফিরে পেল নোভা। বাবা-মায়ের স্মৃতিতে সে এতটাই ডুবেছিল যে, এক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিল আজ তার বিয়ে! চোখমুখ মুছে কান্নার ভাব চেহারা থেকে সরিয়ে ফেললো। দু’হাত মেলে দু’জনকে নিজের কাছে টেনে আনলো। আহ্লাদী বাচ্চাদুটোও বোধহয় মায়ের চোখের জল দেখে ভরকে গেছে তখন। ছোটো ছোটো দুটো হাতের মৃদু স্পর্শে চিবুকে লেপটে থাকা সমস্ত পানি মুছে দিল জারা। বুকের সাথে সেঁটে গেল একদম। বলল,
“তুমি কাঁদছো কেন মাম্মা?”
নোভা কোনো জবাব দিল না, চুপচাপ ওদেরকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। বাড়িতে আত্মীয়স্বজনে ভরপুর। নোভার দাদাবাড়ী থেকেও হাতেগোনা কয়েকজন এসেছেন। খালিদ সাহেব জোর দিয়ে বলেছেন আসতে, যেহেতু তাদেরই বংশের মেয়ে। তাই আত্মীয়তা রক্ষার্থে তাদের আসতেই হলো। বিয়ে নিয়ে খুব একটা হুলস্থুল কাণ্ড বাধাতে চায়নি নোভা, এমনিতেও লোকের গা জ্বালানো কথাবার্তা তার হজম করতে কষ্ট হয়, বাড়তি লোকজনের চাপে দেখা গেল, সেই ক*টু কথার জা*লে সে আবারও ফেঁ*সে গেল। এতসব কথা কানে তুলতে নারাজ সে। বিয়েবাড়িতে কানাঘুঁষা হয় না, এমন কোনো বিয়ে বোধহয় বাঙালি চোখে দেখেনি। তাদের কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে নাক সিটকানো অভ্যাস। তাই খালিদ সাহেব এতসব কথার ভিড় থেকে নোভাকে আগলে নিতেই আলাদা রুমে বসিয়ে রেখেছেন। সেখানে শুধু ফাঁকে ফাঁকে মুনতাহা আর নায়লা আসা-যাওয়া করছে। বরযাত্রীও ওতো ব্যান্ড বাজিয়ে আসেনি, বরং নিজেদের কয়েকজন আত্মীয়স্বজন নিয়ে মাত্র দুটো গাড়ি এসেছে। আদনান আগে থেকেই বুঝতে পারছিল নোভার মনোভাব। মানুষগুলোর নোংরা কথার হাত থেকে বাঁচাতেই অল্প পরিসরের এই বিয়ের আয়োজন। বাদ্য-বাজনার দরকার কী, যদি দিনশেষে সংসারটা পরের ক*টু কথার ভিড়ে পড়ে। তাদের টোনাটুনির সংসারটা নাহয় নিজেরা নিজেদের বুঝেই এগিয়ে নিবে। এত সাজসজ্জা, এত ঝাকানাকা ডি’জে, কিংবা লোক দেখানো রংতামাশার প্রয়োজন নেই।
অল্পস্বল্প আয়োজন হলেও বরযাত্রীদের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখলেন খালিদ সাহেব। বোনের মেয়ে হলেও নোভাকে তিনি এতগুলো বছর নিজের মেয়ের মতোই আগলে নিয়েছিলেন। মেয়ে মানুষ সবসময়ই ঘরের সম্মান। তিনি সেই সম্মানকে স্বস্নেহে বড়ো করেছেন, বাঁচতে শিখিয়েছেন, বুঝিয়েছেন জীবনের মর্ম। নিজের এই ফিটনেস নিয়ে যখন অজানা ভয়ে কুঁকড়ে যেত সে। লোকের নিন্দেমন্দ শুনবে না বলে কতশত ব্যায়াম, দৌড়, কতশত চেষ্টা। কিছুই বাদ রাখতো না। তবুও ওজন কমতো না। সামান্য কমলে আবারও আগের জায়গায় ফিরে যেত। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে চেষ্টা করতে করতে একটা সময় হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিত সে। তখনই তিনি তার মাথায় ভরসার হাত রাখতেন। বলতেন,
“তুমি যেমন আছো তেমনই থাকো মা। যার নজর ভালো, সে এভাবেই তোমাকে সুন্দর বলবে। কারও বাহ্যিক সৌন্দর্য তার আসল সৌন্দর্য নয়, বরং ভেতরের সৌন্দর্যই হলো আসল সৌন্দর্য! বাহিরটাকে নয়, ভেতরটাকে মনুষ্যত্ব বিকাশের সুযোগ দাও। দেখবে, জীবন এমনিতেই সুন্দর। কখনও নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতে হয় না মা, বাহির যতই সুন্দর হোক, যদি ভেতরটা নোংরা থাকে তবে বাইরের এই সৌন্দর্য কোনোদিন কোনো কাজে আসবে না। বাইরের রূপ লাবণ্য ক্ষণিকের মোহ বৈ কিছু নয়। মানুষের আধ্যাত্মিক গুণ হলো, সর্বশ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য। তাই চলার পথে কখনও নিজের ভেতরকে কলুষিত করবে না। ভেতর যত পবিত্র থাকবে, অন্তর যত ঝকঝকে থাকবে, পৃথিবীটা ততটাই সুন্দর হয়ে ধরা দিবে তোমার চোখে।”
খালিদ সাহেবের এতসব কথার ভিড়ে নোভা বুঝতে পারতো, মানুষের চিন্তাভাবনায়ই তার সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। সেই থেকে নিজেকে সে এভাবেই ভালোবেসে এসেছে। কেউ ফিটনেস নিয়ে ল*জ্জা দিতে চাইলে, উলটে সে আরও তাকে নাজেহাল অবস্থায় ফেলে দেয়। যেমনটা অফিসে প্রতি মুহূর্তে জিসান সাহেবকে বুঝিয়ে দিত, সে ঠিক কতটা শক্ত মনের মানুষ।
*****
অবশেষে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে দুটো মানুষের সম্পর্ক একই সুঁতোয় জোড়া লেগে গেল, চিরদিনের জন্য। কনে বিদায়ে ঘরভর্তি মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে গেল পরিবেশ। খালিদ সাহেবের স্ত্রী’ও মুখে আঁচল চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“তোর সব স্বপ্ন হয়তো পূরণ করতে পারিনি আমরা। কোনো অভিযোগ রাখিস না, মা। ভালো থাকিস সবসময়। যখন মন চাইবে, চলে আছিস। আমি অপেক্ষায় থাকবো!”
দু’হাতে মামীকে জড়িয়ে ধরলো নোভা। অনেকক্ষণ কাঁদলো। জীবন থেকে মায়ের আদর হারিয়ে ফেলার পর, এই নারীটিই ছিল তার সবসময়ের ছায়া। কতখানি ধৈর্য্য নিয়ে একেকটা সন্তানকে তিনি মানুষ করেছেন, তা তো নোভা নিজ চোখে দেখেছে। মায়েদের এই ত্যাগই তাকে বুঝিয়ে দেয়, নারী সর্বক্ষেত্রে কতটুকু ধৈর্যের প্রমাণ দিতে পারে! মুনতাহা, নায়লা, দু’জনকেও জড়িয়ে ধরে কাঁদলো নোভা। বিদায় দিয়ে তাকে ফুলে ফুলে সাজানো গাড়িতে তোলা হলো। মুনতাহা নিজেদের বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রাস্তার মূল সীমানা পর্যন্ত দৃষ্টি দিয়ে রাখলো। একটা সময় দুটো গাড়িই চোখের আড়াল হলো, শৈশবের, কৈশোরের সঙ্গীই শুধু দূরে চলে গেল সেটা নয়, ঝগ*ড়াঝা*টি, এমনকি গল্পগুজবের সঙ্গীকে সে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেললো। আর হয়তো আগের মতো আড্ডা হবে না, ঝগ*ড়া, খুঁনসুটি এসব কিছুই হবে না, হবে শুধু কয়েক মিনিটের ফোনালাপ আর ভালোমন্দের লেনদেন।
সম্পর্কে রেদোয়ান হাসানের চাচাতো বোন সাফিয়া খানম। এক ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে হয়েছে তার। চেনা পরিচিত আত্মীয় বলতে তিনি আর আর পরিবারের লোকজন। বিয়েতে তারাই এসেছেন। নোভাকে বরণের কাজটা তিনিই করলেন। নিয়ম মেনে নতুন বউকে ঘরে তোলা হলো। কিছুক্ষণ ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে সামান্য মিষ্টিমুখ করালেন। দো’আ করলেন, হাতে গুঁজে দিলেন হাজার পাঁচেক সালামী। মাথায় হাত রেখে বললেন,
“আদনানের মা বেঁচে থাকলে হয়তো আজ তিনিই ছেলের বউকে বরণ করে ঘরে তুলতেন। পরিপূর্ণ সংসারটা দেখার আনন্দে হয়তো দু’চোখের পানি ফেলতেন। মানুষ মৃ*ত্যু*র কাছে এতটাই অসহায় যে, কিছু চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করার আগেই আয়ু ফুরিয়ে আসে। ইহলোক ত্যাগ করে মুহূর্তেই মানুষ হয়ে যায়, পরলোকের বাসিন্দা। দিনদুনিয়ার সাথে সব সম্পর্কই ছিন্ন হয়ে যায়। একবার চলে গেলে ফিরে আসার আর কোনো সুযোগ তাকে না। ভাবীও চলে গেলেন। একমাত্র ছেলের বউকেও দেখার সুযোগ পেলেন না। কতবার যে বিয়ের জন্য ওর হাত-পা ধরেছি মা, তার কোনো হিসেব নেই৷ বিয়ে করবে না, করবে না বলে পালাই পালাই করতো সবসময়। অবশেষে তুমি আসলে, অথচ একটা সুন্দর মনের মানুষকে দেখতে পেলে না। ভাবী বেঁচে থাকলে কত খুশি হতেন আজ!”
আফসোসের কণ্ঠে ভাবীর সুখস্মৃতি মনে করলেন সাফিয়া খানম। হারিয়ে ফেলা মানুষটার স্মৃতিতে দুঃখে, আবেগে কেঁদে ফেললেন তিনি। নোভাও নিশ্চুপে শুনলো, দেখলো, বুঝলো। মানুষের কিছু চাওয়া-পাওয়া সবসময়ই মৃ*ত্যু*র কাছে এসে হেরে যাচ্ছে। পৃথিবীর কেউ না কেউ প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে। হারানোর হিসাব কষছে, প্রাপ্তির খাতা শূন্য নাকি পূর্ণ সেটাও মেপে দেখছে। দিনশেষে একবুক অভিযোগ জমা হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তার নামে। কেন তিনি সব কে*ড়ে নেন? কেন কাউকেই পরিপূর্ণভাবে সুখী হতে দেন না? কেন কোথাও না কোথাও একটুখানি ফাঁক রেখেই দেন? তিনি তো চাইলেই সব পারেন। তবুও কেন অপূর্ণতা, শূন্যতা আর হতাশা দিয়ে মানুষের এত পরীক্ষা নেন?
পরনের ভারী সাজ পালটে, মুখ পরিষ্কার করে একদম ঝরঝরে শরীর নিয়ে বাচ্চাদের সাথে গল্প করছে নোভা। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সাফিয়া খানমের প্রত্যেকটা কথার মর্মার্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে, হাত-পা ধরে আদনানকে বিয়ের জন্য রাজী করানো, এই ব্যাপারটাই মাথায় ঢুকছে না তার। বাড়িতে বিয়ের কথা বললে, পালাই পালাই স্বভাব যার, সে কি-না পালিয়ে বিয়ে করে দুই বাচ্চার বাপও হয়ে গেল, এই জটিল অংকের হিসাবটা ঠিক মিলাতে পারলো না নোভা। বার বার ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার, মন-মস্তিষ্কে উঁকি মারছে অসংখ্য কথার প্যাঁচ। যার চাপে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে কপালে পড়ছে অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃশ্চিতার ভাঁজ। মনে হচ্ছে, কোথাও একটা গণ্ডগোল তো আছেই। এই নিয়ে আদনানকে যে কোনো একটা প্রশ্ন করবে, সেই সাহসটাও পাচ্ছে না। সে তো আগেই বলতে চেয়েছিল, নিজেই তো ঘাড়ত্যাড়ামি করে শুনতে চাইলো না, এখন এই অহেতুক দুঃশ্চিতা মাথায় নিয়ে অশান্তি টে*নে আনার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেল না নোভা। দুঃশ্চিন্তা নিয়েই দুটো বাচ্চার সাথে গল্পগুজবে মনোনিবেশ করলো।
*****
লাইট, ক্যামেরা, ঢঙ্গী সেজে এদিক-ওদিক, নানাদিক ত্যাড়াবেঁকা হয়ে ছবি তোলা হলো না। কোনো ধরনের ক্যামেরাম্যানকেই ডাকেনি আদনান, সাজায়নি পুরো বাড়িও। এমনকি ধুমধাম গানবাজনারও আয়োজন হয়নি কেবল নোভার অস্বস্তি হবে দেখে। মুনতাহা এক ফাঁকে নোভার এই অস্বস্তিকর ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করেছিল আদনানের সাথে, সেই অনুযায়ী ছোটোখাটো আয়োজনেই বিয়েটা সারা।
রাতের খাবারের জন্য নিচে নামতে হলো না নোভাকে। রুবিনাই সব খাবার রুমে নিয়ে আসলো। বাচ্চারাও বায়না ধরলো, মায়ের সাথে বসে খাবে। ব্যস, দু’জনকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়াতে গিয়েই রাত বারোটা বেজে গেল। আধশোয়া হয়ে পালটাপালটি করে দু’জনের মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো নোভা। কিছুক্ষণ পর পর ঘাড় তুলে এপাশ-ওপাশ নাড়ালো। টের পেল, ঘাড়ের একপাশে ব্যথা বেশ ঘাপটি মেরেই বসেছে। ঠিকঠাক নাড়ানোও যাচ্ছে না। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বিছানা ছাড়লো নোভা। দ্রুত ছুটে আসলো ড্রেসিংটেবিলের সামনে। ব্যথানাশক মলম খোঁজার চেষ্টা করলো। বার দু’য়েক এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখলো, সেটা আয়নার ভেতরে রাখা। আয়নাটা বাইরে থেকে লক করা। এখন এর চাবিটা কোথাও পাবে সে?
আদনান যখন রুমে আসলো তখনও নোভা ঠায় বসে রইলো ড্রেসিংটেবিলের সামনে থাকা টোলে। দু’হাতের মাঝখানে মাথা ফেলে রেখেছে সে। যন্ত্রণায় ছটফটানি শুরু হয়েছে তার। একপাশে শুয়ে, বসে একাধিক ঘণ্টা অতিক্রম করার ফলই ভোগ করছে এখন। নোভাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ দুঃখবোধ হলো আদনানের। বিয়ে করে বউ ঘরে নিয়ে আসলো ঠিকই, সবদিক সামলানোর ঝামেলায় নতুন মানুষটাকেই বুঝি অবহেলা করে ফেললো! এইভেবে নিজের উপরই চরম বিরক্ত হলো সে। কিছুটা এগিয়ে এসে পিছনে দাঁড়ালো। খানিকটা বিচলিত দেখালো তাকে। আবেগী অথচ কোমল স্বরে বলল,
“কী হয়েছে নোভা? ঠিক আছো তুমি?”
ঘাড় ফিরিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলো নোভা, কিন্তু পারলো না। চোখমুখ কুঁচকে আবারও যেভাবে ছিল, সেভাবেই বসে রইলো। আদনান কিছুটা ভরকে গেল তার এই আচরণে। তখনই মিনমিন সুরে সামান্য আওয়াজ আসলো।
“মুভ লাগবে! চাবি খুঁজে পাইনি।”
তড়িঘড়ি করে অন্য একটা ড্রয়ার থেকে চাবি বের করলো আদনান। এসব ব্যথানাশক মলম সে খুব কমই ব্যবহার করে। খুব একটা প্রয়োজন না হলে হাতও লাগায় না। ওভাবেই পড়ে থাকে ড্রেসিংটেবিলের লকে। নোভার এমন আতঙ্কিত চোখমুখ মোটেও ভালো লাগছে না তার। ঝটপট লক খুলে মুভ বের করে আনলো। বলল,
“ব্যথা কোথায়?”
“ঘাড়ে! দিন আমার কাছে।”
“ওভাবেই থাকো। চুপচাপ। আমি ম্যাসাজ করে দিচ্ছি। ব্যথা আসলো কীভাবে?”
খানিকটা গম্ভীর স্বরেই প্রশ্ন করলো আদনান। নোভাও ত্যাড়াবেঁকা করে উত্তর দিল।
“সঙ সেজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকলে ব্যথা তো হবেই।”
“সঙ সাজতে বলেছে কে তোমাকে?”
“বারে! বিয়ে না? স্পেশাল দিনে মানুষ তো একটু সাজগোছ করেই।”
“মেয়েদের এই একটা অভ্যাস! যেকোনো অনুষ্ঠানে মুখে একগাদা মেকাপ তারা ব্যবহার করবেই। ন্যাচারাল বিউটি ইজ রিয়্যাল বিউটি। ওতো রঙচঙ আর ঘষামাজার কী প্রয়োজন ভাই!”
ঘাড়ে ম্যাসাজ করার ফাঁকে ফাঁকেই মেকাপের চৌদ্দপুরুষকে বকাঝকা দিয়ে উদ্ধার করছে আদনান। নোভা এই কথা শুনে হাসতে চাইলো, কিন্তু হাসলো না। ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো। কিছুটা রাগী রাগী চেহারা বানিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আদনানের চোখে চোখ রাখলো। বলল,
“ওসব রঙচঙ আমি নিজেও পছন্দ করি না। রেস্টুরেন্টে প্রথম যেদিন দেখা করি, সেদিনও আমি সাধারণভাবেই ছিলাম। তাই আপনি আমাকে এই কথা বলতে পারেন না যে, আমি মেকাপের কারণে নিজেকে সুন্দরী প্রমাণ করতে চাইছি।”
আদনান চোখ গোল গোল করে তাকালো। বুঝতে পারলো, অকারণ মেয়েটাকে রাগিয়ে দিয়েছে। ডানহাতে কান ছুঁয়ে মৃদুশব্দে সরি উচ্চারণ করলো। অন্যহাতে ঘাড়ে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিল। আয়নাতেই তার এই চেহারার ঢং দেখে হেসে ফেললো নোভা। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“হয়েছে থাক, আর ঢং করতে হবে না। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাবো। সকালে কথা হবে। গুড নাইট। ওহ, হ্যাঁ। কী যেন বলতে চাইছিলাম! আপনার ওই বন্ধু, বিয়েতে যে ছিল। তাকে বোধহয় আমি চিনি। স্বপ্নে-টপ্নে দেখলাম, নাকি বাস্তবে দেখলাম, মনে করতে পারছি না। তবে এইটুকু শুধু মনে হচ্ছে, ওই চেহারাটা আমার পরিচিত।”
বলতে বলতে হাই তুললো নোভা। আদনানের নাকের ডগায় চেপে ধরে ফের গুড নাইট বলে বিছানায় গেল। ফুলে ফুলে সাজানো ফুলশয্যার খাটটা বাচ্চাদের কু*স্তি আর ছোটাছুটিতে সেই সন্ধ্যেবেলায়ই এলোমেলো হয়ে গেছে। ওদেরকে মাঝখানে রেখে একপাশে শুয়ে পড়লো সে। আদনান শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। বুঝতে পারলো না, ঠিক কী হলো! বিয়ে হলো, অথচ বাসরের কোনো নাম-গন্ধ নেই। জারা, নোরাকে পেয়ে দিব্যি তার নববধূ তাকে ভুলে গেছে। এটা কেমন বিয়ে সেটাও বোধগম্য হলো না তার। পানসে না-কি মিষ্টি, কীভাবে বুঝবে! প্রেমালাপ কিংবা মনের লেনদেন কিছুই তো হলো না। এখন কি এই লম্বা রাতটা জ্বি*ন, ভূতের সাথে গল্প করে কাটাতে হবে তাকে?
চলবে…
সম্পূর্ণা | ৯
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
জীবনে পূর্ণতা যেমন সুখ নিয়ে আসে, তেমনি কিছু অপূর্ণতাও বিনা বজ্রপাতে অসুখ সৃষ্টি করে! সুখের চেয়ে দুঃখের হিসাবটাই মানুষ বেশিরভাগ মনে রাখে। সুখ ক্ষণিকের জন্য হলেও, দুঃখও ক্ষণিকের জন্যই। অতি সুখে পড়ে ভাবাবেগে ভেসে যাওয়ার চেয়ে এই সুখটাকে আলিঙ্গন করে সারাজীবন বেঁচে থাকার প্রার্থনা করাই উত্তম। খুব বেশি আনন্দ জীবনে চলে আসলে, মানুষ যেমন স্রষ্টার প্রশংসা আদায় করতে ভুলে যায়, তেমনি খুব বেশি দুঃখ পেলে সেই স্রষ্টার উপরই সমস্ত অভিযোগ অর্পণ করে। এটাই মানুষের স্বভাব। অল্পতে যারা সন্তুষ্টি অর্জন করতে শিখেনি, দিনশেষে তাদেরকেই চরম মূল্য দিতে হয়।
জীবন যখন দু’চোখে সুন্দর হয়ে দেখা দেয়, প্রাপ্তির খাতা ভরে উঠলে অন্তরাত্মা প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। মনে হয়, এইতো জীবন। এমনই সুন্দর। এভাবেই চলুক। ঠিক এমনটাই উপলব্ধি করছে নোভা। বিবাহিত জীবনের প্রথম সকাল, মাতৃত্বের প্রথম স্বাদ পাওয়া, জীবনের আরও একটা অধ্যায়কে দু’হাতে আঁকড়ে ধরতে পারা, এখানেই তো সবকিছু পাওয়া হয়ে গেছে। আর কি কিছু বাকী আছে? এইটুকু নিয়েই তো গোটা জীবন অনায়াসে পার করে দেয়া যায়। হেসেখেলে আনন্দে বেঁচে থাকা যায়।
ঘুম ভাঙার পরই এই অদ্ভুত সুখস্মৃতিকে উপলব্ধি করছিল নোভা। ঘুমন্ত দুটো নিষ্পাপ বাচ্চার মায়াবী মুখ যেন সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিল তাকে। চোখ মেলে রোজ যদি এমন দৃশ্য দেখেই সকাল হয়, জীবন তো তখনই পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে তার। এরচেয়ে বেশি কিছু আর কী চাওয়ার থাকতে পারে? ভাবতে ভাবতেই চোখ সরালো সে। একপলক আদনানকে দেখলো। ঘুমিয়ে আছে, নাকি জেগে আছে ঠিক বুঝার উপায় নেই। তার চোখদুটো বন্ধ, বুকের কাছে ধরে রাখা বইটা দিব্যি সেখানে লেপটে আছে। সারারাত তবে বই পড়েই কাটিয়েছে! কী ভেবে যেন তিনজনের চেহারা ভালোমতো দেখলো নোভা। মৃদু আলো, স্পষ্ট বুঝার উপায় নেই, তবে ঘুমন্ত তিনটে চেহারাতেই যেন রাজ্যের মায়া জড়িয়ে আছে। মনে মনে নিজেকেই বকলো নোভা। গতকাল ওভাবে ঘুমিয়ে পড়া একদমই উচিত হয়নি। আনমনেই বিড়বিড় করলো,
“বেচারা! ফুলশয্যাকে বইশয্যা বানিয়ে রাত কাটিয়েছে।”
নিজের মাথাতেই গুঁতো মা*র*লো নোভা। সবসময় ভুল হয়, এলোমেলো হয়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। নিশ্চয়ই আদনান রাগ করেছে, হয়তো কিছু বলতে চেয়েছে, নয়তো কিছু শুনতে চেয়েছে। এভাবে ম*রা*র মতো ঘুমানো একদমই ঠিক হয়নি। বড্ড ভুল হলো তার। ধীরপায়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে আসলো। বিছানার ফাঁকা অংশে বসে মুখ খানিকটা ঝুঁকিয়ে নিল। চোখ পিটপিট করে ভালোমতো দেখলো, নিশ্চিত হলো আদনান তখনও গভীর ঘুমে। দূরের মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসলো। কণ্ঠে খানিকটা জোর করে মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
“আদি…! উঠুন না। আযান হচ্ছে তো। না উঠলে এক জগ পানি ঢেলে দিব আপনার উপর। মানুষের ঘুম এত গাঢ় হয় কী করে!”
এমন মোহনীয় ডাক, কার সাধ্যি আছে উপেক্ষা করে ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকবে। আদনানও পারলো না। ঘুম ঘুম চোখেই বলল,
“বরকে অপেক্ষায় রেখে বউ যদি ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে বরে’রাও ইচ্ছে করে কানে তুলো গুঁজে রাখতে পারে।”
লজ্জায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললো নোভা। ঠোঁট গোল করে উচ্চারণ করলো,
“সরি। ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম।”
“তা তো আমি বুঝতেই পারছিলাম। ঘাড়ে ব্যথা কমেছে এখন?”
উপরনিচ মাথা নাড়লো নোভা। খানিকটা সরে বসলো এবার। দু’হাত দু’দিকে মেলে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসলো আদনান। নোভাকে সহজ করতে বলল,
“নতুন জায়গা, ঘুম হয়েছিল রাতে?”
আবারও উপরনিচ মাথা নাড়লো সে। চোখ তুলে তাকালো না আর। আদনান ঝটপট বিছানা ছাড়লো। ওয়াশরুমের যেতে চাইলে নোভা পিছন থেকে বলল,
“একটা দরকারি কথা ছিল।”
“বলো।”
“রূহানীর কোনো ছবি আছে?”
“কেন?”
“না, মানে! আসলে আমার মনে হচ্ছে একবার দেখি। বাচ্চাদের চেহারার সাথে আপনার চেহারার কোনো মিল নেই, হয়তো মায়ের সাথে মিল থাকতে পারে। তাই…!”
“মায়ের পেট থেকে বেরিয়েছে, তাই মায়ের মতো দেখতে হয়েছে। বাবার পেট থেকে তো বেরোয়নি! বেরোলে নিশ্চয়ই বাবার মতো দেখতে হতো।”
*****
ফের লজ্জায় লাল হয়ে গেল নোভা। ঠোঁটকাটা স্বভাবের এই ছেলেটা যখন তখন যা খুশি বলে ফেলে। তবুও সাফিয়া খানমের কথার মর্মার্থ তাকে উদ্ধার করতেই হবে। যেভাবে হোক, জানতে হবে এতসব কথার মানে কী! সরাসরি প্রশ্ন করা যাবে না, তাই ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়েই জানতে হবে। কিছুটা নড়েচেড়ে বসলো নোভা। বলল,
“তবুও বাবার সাথে একজনের চেহারার অন্তত মিল থাকতো।”
“ওদেরকে মঙ্গলগ্রহ থেকে নিয়ে এসেছি, তাই আমার চেহারার সাথে মিল নেই। হয়েছে?”
“বাপরে, ওতো চটছেন কেন?”
“একশবার চটবো। তুমি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে না বলে, সরাসরি বলো! এত প্যাঁচাচ্ছো কেন? কী জানতে চাও? বাচ্চাদুটো আমার নয় তাই-তো?”
শুকনো ঢোক গিললো নোভা। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। আদনান রীতিমতো রাগী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তার দিকে। বুঝাই যাচ্ছে, সকাল সকালই মেজাজটাকে হাই ভোল্টেনের শক দিয়েছে সে। কিন্তু কী-ই-বা করার আছে। মনে অকারণ প্রশ্ন উঁকি দিল কেন? তাই-তো এত ইনিয়েবিনিয়ে জানতে চাইতে গেল! মিনমিন কণ্ঠস্বর তুলে বলল,
“ফুপ্পি কেন বললেন, বিয়ের জন্য আপনার হাত-পা ধরতে হয়েছে?”
“কারণ আমি রাজি ছিলাম না বিয়ে করতে!”
“রাজি না হওয়ার কারণটাই তো জানতে চাইছি।”
অসহায় ভঙ্গিতে দু’দিকে মাথা নাড়লো আদনান। ফের নোভার পাশে এসে বসলো। শান্তস্বরে বলল,
“শুরু থেকে জানতে হবে তোমাকে, সময় লাগবে। এখন নয়, রাতে বলবো। বাচ্চাদের কানে গেলে অসুবিধা আছে। ওরা কষ্ট পাবে। আমি চাই না ওদের ওইটুকু মনে কোনো আঘাত আসুক। ওরা যা জেনেছে, সেটা জেনেই বাঁচুক।”
আতঙ্কভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নোভা। আদনান তাকে আশ্বস্ত করতে বলল,
“ঘাবড়াচ্ছো কেন? সত্যের মুখোমুখি হতে আমি কখনও ভয় পাই না নোভা। ভয় শুধু একটা জায়গায়ই, রূহানীতে।”
নোভা এবার পুরোটাই ঘাবড়ে গেল। রূহানীকে ভয় পাওয়ার কী এমন কারণ আছে! পুরুষ মানুষের থেকে কি নারীশক্তি বেশি? রূহানী বাচ্চাদের মা, এখানেই কি আদনানের যত ভয়? সে-ও তো বাচ্চাদের বাবা! তবে? জটিলতা ঠিক কোথায়? কেন ধরতে পারছে না সে? কেন এসব অকারণ যন্ত্রণা দিচ্ছে মনে? কেন মনে হচ্ছে, সব পেয়েও আবার সব হারিয়ে যাবে? এমন কি সত্যি, যা বলতে আদনান এত ভয় পাচ্ছে? কিছুই বুঝতে পারছে না নোভা, মাথার ভেতর ফাঁকা বাঁশের মতো দ্রিম দ্রিম আওয়াজ হচ্ছে। এই অস্বস্তিকর, বিব্রতকর, বিরক্তিকর আওয়াজ থেকে বাঁচতে একটু শান্তি দরকার। কোথায় গেলে মনের সব প্রশ্ন হাওয়ায় মিলাবে? কোথায় লুকোলে এত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে? আছে কি এমন কোনো জায়গা, যেখানে মানুষ শুধু নিজেদের জন্য স্বপ্নপুরী সাজিয়ে তুলতে পারে? যেথা গেলে এত যন্ত্রণা মুছে যাবে তার, সেথা যাওয়াই কি মঙ্গলজনক নয়?
*****
রান্নাঘরে সকালের নাশতা তৈরী করছে রুবিনা। খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে সে। একা হাতে সব কাজ সামলায়। আজ অবশ্য তাকে একা কিছুই করতে হলো না। এটা-সেটা এগিয়ে দেয়ার কাজই কেবল করছে সে। রান্নার পুরো কাজটা সামলাচ্ছে নোভা। নামাজ শেষে এসে যখন দেখলো, রুবিনা একাই এতসব রান্নার আয়োজন শুরু করেছে, তখন সবকিছু জেনে নিজেই হাত লাগাতে চলে এসেছে। রুবিনাও পাশে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসটা হাতের নাগালে এনে দিচ্ছে। সকাল আট’টা বাজার পরপরই সমস্ত রান্না শেষ করে ফেললো নোভা। বাচ্চাদের জন্য পাস্তা তৈরী করলো। গোশত ভুনা, সবজি, রুটি সব চটপটে হাতে তৈরী করে টেবিল সাজিয়ে নিল। দুপুরের রান্নায় একটু ঝামেলা হবে, কারণ নোভার মামা-মামী সবাই আসবেন। আদনান অবশ্য শেফকে বলে রেখেছে, সে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো চলে আসবে।
খাবার মুখে নিয়ে তৃপ্তির হাসি ফুটালেন রেদোয়ান হাসান। খুব সহজেই বুঝে গেলেন, আজকের রান্নার রাঁধুনি কে। বাবার এই মুখের এই ভাবভঙ্গি দেখে মুচকি হাসলো আদনান। এই দৃশ্য তার মুখস্থ। নোভার হাতের রান্না যেদিনই খাবেন, সেদিনই এভাবে মুখের ভাবভঙ্গি দিয়ে বুঝিয়ে দিবেন, খাবার কতটা সুস্বাদু হয়েছে। সাফিয়া খানমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটা তোমার ভাইজানের রোজকার অভ্যাস। দেখে মনে হচ্ছে, বাবা নোভার হাতের রান্না এই প্রথম খেলেন। অথচ তিনি রোজই ওর হাতের খাবার খেয়ে অভ্যস্ত!”
পক্ষান্তরে তিনি শুধু হাসলেন। আদনানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“শুধু কি ভাইজান একা? তুই কিছু বলিসনি?”
আদনান মাথা নিচু রেখে খাবারে মনোযোগ দিল। ফাঁকে ফাঁকে জারা, নোরার মুখেও অল্পস্বল্প খাবার তুলে দিল। ভদ্রমহিলা নোভার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। গলা উঁচু করে বললেন,
“এই বাঁ*দ*রটাও তো তোমার হাতের রান্নার পা*গ*ল ছিল। কত মেয়ের ছবি দেখালাম, রাজকুমার বিয়ে করবেন না বলে পণ করে বসে রইলেন। শেষে কি-না ভাইজানকে বলে, তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে!”
খাবার মুখে মারাত্মক বিষম খেল আদনান। সাফিয়া খানমের গড়গড় করে গোপন কথা ফাঁ*স করার অভ্যাস আছে। এরজন্য আগেই সিগনাল দিয়ে রাখা উচিত ছিল। অথচ সে-তো সেটাও করেনি। চোখের সামনে পানির গ্লাস দেখে ডগডগ করে পানি পান করলো। নোভা শুধু মিটিমিটি হাসলো। বাড়তি কোনো প্রশ্ন করলো না। তবে সে এইটুকু বুঝে গেছে, সে আদনানকে রেস্টুরেন্টে প্রথম দেখলেও আদনান তাকে আরও আগেই দেখেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় দেখেছে? আর কবে দেখেছে? রেদোয়ান হাসান বোনের কথা শুনে হো হো শব্দে গা কাঁপিয়ে হাসলেন। বললেন,
“আগে তো খেয়েছি কেনা খাবার! এখন খাচ্ছি নিজের বৌ’মার হাতের খাবার। দুটোতে পার্থক্য আছে। খাবারের স্বাদ একই হলেও মানুষটার আসন পালটেছে। তাইতো মুখের ভাবভঙ্গি চমৎকৃত হওয়ার সাথে সাথে মনটাও ফুরফুরে হয়ে গেছে। আজ যদি মৌ বেঁচে থাকতো, ছেলের বউ দেখে খুশি না হয়ে থাকতে পারতো না।”
বৃদ্ধ বয়সেও রেদোয়ান হাসানকে এই মুহূর্তে খুব আবেগী দেখালো। প্রিয়জন হারানোর বেদনা তিনি খুব গোপনেই আগলে রাখেন। ছেলের সামনে যতই শক্ত থাকেন, আড়ালে ঠিকই প্রিয়তমা স্ত্রী’র জন্য চোখের পানি ফেলেন। অনেকদিন পর বাবাকে এমন ইমোশনাল অবস্থায় আবিষ্কার করলো আদনান। হাত বাড়িয়ে আগলে ধরলো। বলল,
“দুঃখ পেও না বাবা। উপরওয়ালার হুকুমের কাছে আমাদের চাওয়া-পাওয়া তো সবসময়ই তুচ্ছ তাই না? তুমি দেখছো, শান্তি পাচ্ছো, এইটুকুই তো আমার জন্য অনেক।”
হাসিখুশি পরিবেশটা হুট করে দুঃখজনক মুহূর্তে রূপ নিল। নোভা শুধু গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাবা-ছেলের আস্থা আর বন্ধনের চমৎকার দৃশ্য দু’চোখে তৃপ্তি নিয়ে দেখলো। যতখানি ভয়, জড়তা, সংকোচ ছিল, রূহানীকে নিয়ে উদ্ভট প্রশ্ন ছিল, সব একটু একটু সুদূরে মিলাতে শুরু করলো। চোখের সামনেই বিশ্বস্ত এক পুরুষকে আবিষ্কার করলো। মনে হলো, জীবনে চলার পথে এমন সঙ্গী ঢের পাওয়া। কোটি কোটি টাকার রাজপ্রাসাদ কিংবা কোনো রাজার রাজকুমারও তার চাওয়ার সীনায় উপস্থিত ছিল না। না চাইতেও যে দামী সম্পদ সে পেয়েছে, তাকে অন্তত অবহেলা করা যায় না, দূরে ঠেলা যায় না। এমনকি অবিশ্বাস করলেই বুঝি গুরুতর অপরাধ হয়ে যাবে।
*****
চলবে…