#সময়_থেকেও_শেষ,পর্ব ২
লেখাঃ মান্নাত মিম
৫.
সম্পর্কের মাত্র তিনবছর। কিন্তু তাদের দেখে মনে হয় প্রণয় তাদের একযুগের, এতোটাই গভীর নিখাঁদ ছিল তাদের ভালোবাসা।
প্রণয়ের দিনগুলো যেমন খুবই মিষ্টি হয়, ঠিক তেমনই তাড়াতাড়ি শেষও হয়।
“মনে হয়, এই তো সেদিন তার সাথে কথা বলা
হাজার হাজার জমানো অভিযোগ তো এখনো রয়েছে তোলা।
আবেগে’রা যে এখনো ঝরে পড়ে,
তার এক মিষ্টি শব্দে,
সে তো আসে রোজ কল্পনা জগতে।
সময় কি না শেষ হতে চায়,
না সে তো অপেক্ষায় প্রণয়ের প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের আশায়।”
মাবিহার আঠারোতম জন্মদিন সাথে তার জীবনের সবচেয়ে বড় গিফট। তার বিয়ের জন্য পাত্র রেডি করেছে তার বাবা। সে তার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে সন্তান। ধনী পরিবারের মেয়ে সে৷ বাবা-মায়ের ইচ্ছাতে চলতে হবে, এটাই তার অভিভাবকের আশা। কিন্তু তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা? রয়ে যায় নিভৃতেই। এদিকে নিশাত্যয় খবরটা শুনে একচোট কথা শুনিয়ে দেয় মাবিহাকে।
“কেমন বাবা-মা তোর? একমাত্র মেয়ে তুই তাদের। কই একটু বেশি সময় ধরে আঁটকে নিজেদের কাছে রাখবে। তা না করে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। কম কীসের তোদের? একটা মেয়েকে খাওয়াতে-পড়াতে পারে না? যত্তসব ফালতু লোকজন।”
বলাবাহুল্য নিশাত্যয়ের বদমেজাজি স্বভাব সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত মাবিহা। রাগ উঠলে তার কোনো হুঁশ থাকে না, কাকে কী বলছে না বলছে সেসবের তোয়াক্কা করে না। মাবিহাকে তো তুই-তোকারি করেই সাথে কী বলতে কী বলে ফেলল আগে পিছে দেখল না আর না ভাবল।
কিন্তু এদিকে বেচারি মাবিহা অকুল পাথরে পড়ে নিশাত্যয়ের কাছে এসেছিল কী করবে না করবে তা জানতে, সাজেশন চাইতে। অথচ উলটো তাকে নিশাত্যয়ের রাগের শিকার হতে হলো। এমনিতেই মন-মেজাজ তারও খুব খারাপ, সেখানে নিশাত্যয় তাকে স্বান্তনা না দিয়ে আরও ঝেড়ে চলছিল। তবুও সে যথেষ্ট ঠান্ডা, শান্ত থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই বলে নিশাত্যয়ের এভাবে বলা ঠিক হয়নি। যতই খারাপ হোক বাবা-মা তো বাবা-মা’ই হয়। তার তো খারাপ লাগে অন্যের মুখে বাবা-মায়ের নামে কটুবাক্য শুনতে।
“ভালো করে কথা বলো বলছি। তোমার সাহস কীভাবে হয় আমার বাবা-মাকে এমনটা বলার?”
“কী করে ভালো কথা বলবো হ্যাঁ? মাত্রই তোর এইচএসসির রেজাল্ট দিলো। আর সাথে সাথেই বিয়ে দিতে চাচ্ছে তোর বাপ। তাহলে আমি কী করব? বসে বসে আঙুল চুঁষবো বাল!”
মেজাজের এবার রফাদফা অবস্থা। বুঝালেও বুঝতে চাইছে না, ঝামেলা আরো বাড়াচ্ছে নিশাত্যয়। মাবিহা তিরিক্ষি হয়েমফোনের ওপাশ থেকে বলল,
“দেখ তুমি কিন্তু আবারও মুখ খারাপ করছ। তুমি তো বিদেশ থেকে সেরে গেছ, এখানে থেকে আমি-ই ঝামেলা পোহাচ্ছি। বিদেশেই বসে থাক এদেশে আর আসা লাগবে না। ওখানের সুন্দরী কোনো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও। আমার আর চিন্তা করতে হবে না। আমি-ও আমার বাবা-মা’য়ের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে নিব।”
৬.
সেদিন কথাগুলো বেশ কষ্ট পেয়েই বলেছিল মাবিহা। পরে আর কথা হয়নি নিশাত্যয়ের সাথে। এদিকে নিশাত্যয় তার কথাকে সত্য মনে করে ভয়ে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছিল ভিনদেশে। জ্বরের ঘোরে মাবিহার নাম ডাকাসহ জ্বর ছিলো প্রায় একসপ্তাহের মতো, সে এক নিদারুণ পরিস্থিতি! যার সাক্ষী ছিল তার সাথে থাকা রুমমেটরা। পরে তার জ্বরের কথা শুনে মাবিহার বোধহয় একটু দয়া হয়েছিল সেদিন, যেদিন সে নিশাত্যয়ের কল ধরে।
“দেখ মাবিহা, আমার মাথা কিন্তু সেদিন খুব গরম ছিল তাই ওমন ব্যবহার করেছিলাম।প্লিজ লক্ষীটি এবারের মতো মাফ করে দাও।”
দুজনের মাঝে তখন কোনো কথা না হয়নি। মান-অভিমানের পাল্লা চলতে চলতে একসময়; শুধু মন ও নিশ্বাসের মাধ্যমে মনে জমে থাকা অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করা হচ্ছিল সেদিন। ভালোবাসা তো এমনই যেখানে মনের কথাগুলো মুখে বলতে হয় না, বুঝে নিতে হয় এমনই এক মন দিয়ে।
সেদিন মাবিহার কাছ থেকে সময় চেয়েছিল নিশাত্যয়, দু’বছরের মতো। কারণ তার ঘরে ছিল বিয়ের উপযুক্ত একবোন। আবার ছোটো ভাইটাকে ভালো ক্যারিয়ার গড়ে দেওয়ার জন্যও তো কিছু এমাউন্ট লাগবে। সাথে তো আছেই স্বপ্ন মাবিহার সাথে সংসার করার, সেটা গুছানোর জন্যও প্রয়োজন সময়ের। তবে কথা হলো, পরিস্থিতি বা সময় কিংবা ভাগ্য কখনোই নিজেদের হাতে থাকে না। কাছেপিঠে থেকেই অনেকে পরিস্থিতির শিকার হয়। আর সেই দিক দিয়ে তো নিশাত্যয় তার গন্তব্য থেকে বহুদূর। আর সেই পথটাও বেশ দুর্গম সাথে সময়ের ব্যাপারও আছে।
৭.
“সময়ের স্রোত বেগবান,
আমরা অতটা নই মহান।
যে, চলে যাওয়া সময় ও বইতে থাকা ঢেউয়ের পথ রোধ করতে পারব।”
সেদিন মাবিহা অনেক চেষ্টা করেও আঁটকাতে পারেনি, বাবা তাকে এবার বিয়ে দিবেনই।নিশাতকে দেওয়া সময়ের আর মাত্র ছ’মাস বাকি। বহু কষ্ট এদি কসে করে বিয়ে আঁটকে রেখেছিল এতদিন সে। কিন্তু বাবা তার নাছোড়বান্দা। এদিকে নিশাত্যয়-ও বেশ কিছুদিন ধরে মোবাইল ধরছে না। সে একা কীভাবে এদিকটা সামলাবে বুঝতে পারছে না? সামনের শুক্রবারে তার বিয়ে, সেদিনই তাকে চলে যেতে হবে অচেনা এক মানুষের ঘরের বউ হয়ে। এমনটা তো কথা ছিল না, দুঃখ-কষ্টে তো আছেই সাথে ক্ষোভে সে পাগলপ্রায়। কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না, এমন সময় কে না চায় তার ভালোবাসার মানুষটা তাকে সঙ্গ দিক, ভরসা জোগাক। নাহ, কেউ নেই তাকে বোঝার মতো। বাবা-মা তো কোনোদিনও মানবে না নিশাত্যয়কে, তা তারা আগেই বলে দিয়েছিলেন। কারণ নিশাত্যয়ের বাবা নেই, উপরন্তু প্রবাসী ছেলে চরিত্রের ঠিক নেই। তাঁদের সাথে নিশাত্যয়ের স্ট্যাটাস একদমই মিলে না। সেদিন বাবার নানান যুক্তির কাছে হারাতে হয়েছিল তার ভালোবাসাকে। তবুও সে ক্ষীণ আসা রেখেছিল অন্তত বাবা তাকে দেরিতে বিয়ে দিবেন। কিন্তু না তার ভাবনা চিন্তার বাইরে গিয়ে তাকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করে আসেন। দিকবিদিকশুন্য হয়ে রুমে পায়চারি করতে করতে ফোনের ওপর ফোন দিতে থাকে মাবিহা। ওপাশে ফোন বন্ধের কথা বলে নিশাত্যয়ের। চোখ ছাপিয়ে জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় ফোন। মাথার চুল টেনে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে গিয়েও কাঁদতে পারে না। এত ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে হয়ে কেন সে অসহায়বোধ করছে? উত্তর আসে না কোথাও থেকে। কিন্তু তার মন তো জানে, ভালোবাসা মানে অসহায়, নিরূপায়, সহায়হীন।
চলবে…