#সময়_থেকেও_শেষ
পর্বঃ ১
লেখাঃ মান্নাত মিম
১.
সময়টা ছিল শীতের দিকের। বিদেশে যেদিকে শৈত্য প্রবাহ, বাংলাদেশে সেদিকে শীতের অত প্রভাব নেই। গরমাঞ্চল দেশ নামে বাংলাদেশ খুব বিখ্যাত এদিক দিয়ে। নিশাত্যয় তার ফ্লাটের ব্যালকনিতে বসে কফি খাচ্ছে, আর মোবাইলে ফেসবুকে নিউজফিডে ঘোরাঘুরি করছে। এখানে সে আরও দুটো ছেলের সাথে শেয়ারিং করে থাকে দু’বছর ধরে। জীবিকার তাগিদেই এসএসসি পরীক্ষার পরেই এই সিঙ্গাপুর নামক ভিনদেশে কর্মরত। দেশে মা, ভাই-বোন নামক পরিবার ছেড়ে সে এতো দূরে। কেননা, বাবা ছাড়া অচল পরিবারের হাল বড় ছেলেদের-ই ধরতে হয়।
হঠাৎ টুং করে হাতে থাকা ফোনে নোটিফিকেশন আসার শব্দে ধ্যান ভঙ্গুর হয়। নোটিফিকেশন চেক করে দেখে বাংলাদেশ থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসছে। নাম মাবিহা সুলতানা। আইডিতে গিয়ে দেখল আসল আইডি নতুন খুলেছে মনে হয়, ছবিতে মেয়েটি কালো রঙের শাড়ি পরিধানকৃত। প্রোফাইলে অ্যবাউটে গিয়ে দেখল বয়স মাত্র পনেরো, থাকে মুন্সিগঞ্জে। তাদের বাড়িও সেখানে। এত অল্প বয়সের মেয়েকে ছবিতে দেখতে কেমন বড় দেখাচ্ছে! সম্ভবত শাড়ি পরায়। আনমনে ভেবে হেসে উঠল নিশাত্যয়। তারপরে রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে মেসেঞ্জারে নক করল।
২.
কয়েকদিন যাবত মাবিহার মেসেজ চ্যাক করা হচ্ছে না, জমা হয়ে ফিল্ড আপ হয়ে আছে সবগুলো। দেখতে হবে। এক এক করে দেখতে গিয়েই নিশাত্যয়ের মেসেজও চোখে পড়ে। ‘হায়’ লেখে পাঠিয়েছে। অপরিচিত মনে করে বিধায় মাবিহা মেসেজ করল,
“হ্যালো, কে বলছেন?”
সেই সময়টাতে নিশাত্যয় লাইনে থাকার দরুন মাবিহার পাঠানো মেসেজ দেখতে পেলো। অতঃপর রিপ্লাইতে লেখল,
“জি, আমি আপনার ফেবু ফ্রেন্ড নিশাত্যয় বলছি। চিনতে পারেননি?”
অবাক হওয়ার ইমোজি পাঠায় সাথে। এদিকে খানিক ভাবান্নিত করে মাবিহা জবাব পাঠায়,
“ওহ্, হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। সর্যি হ্যাঁ, এতদিন আপনাকে উত্তর দিতে পারিনি। আমার এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে তো তাই।”
“ইট’স ওকে, নো প্রবলেম। তা কেমন চলছে প্রস্তুতি?”
“ভালোই। আপনার খবর বলুন। কেমন আছেন?”
“এই তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি?”
“হুম সেম, ভালোই চলছে দিনকাল।”
“এটা তো ঠিক হলো না।”
বেশ অবাক হলো মাবিহা বিপরীতে প্রশ্ন করল,
“কোনটা?”
উত্তরে সুন্দরভাবে নিশাত্যয় বুঝিয়ে বলল,
“কেউ কেমন আছে জিজ্ঞেস করলে, সেম না বলে আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি বলতে হয়।”
সেদিন বেচারি এমন লজ্জা পেল, সাথে সাথেই অফলাইনে চলে গেল। কয়েকদিন পরে নিশাত্যয় নিজ থেকে মাবিহাকে নক করল, ‘লাইনে এলে নক করেন তো’। সেটার উত্তর এলো পরেরদিন রাতে।
“হুম বলুন। নক করতে বলেছিলেন বোধহয়।”
“আপনি কি আমার উপর রেগে?”
“না তো, আমি আপনার ওপর রাগ করতে যাব কেন?”
“সেদিন যে হঠাৎ করেই অফলাইনে চলে গেলেন আবার পরে নকও করলেন না।”
সেদিনের কথার প্রসঙ্গ আসতেই ফের লজ্জাতে চুপসে গেল মাবিহা। অবশ্য ফোনের ওপাশ হতে সেটা নিশাত্যয়ের দেখা হলো না।
“সেদিন আমি খুব লজ্জা পেয়েছিলাম আপনার ওই কথায়।”
“ওহ, আমি কিন্তু লজ্জা দেওয়ার জন্য কথাটি বলিনি।”
“তবুও কিন্তু আমি লজ্জা পেয়েছিলাম।”
” আচ্ছা, যান আমার দোষ আমি স্বীকার করে নিলাম।”
নিশাত্যয়ের কথার ভঙ্গিতে মাবিহা সেদিন হেসে ফেলেছিল। সেটাও নিশাতের চোখের আড়ালে অগোচরেই রয়ে গেল।
৩.
“একজন ছেলে কখনো একজন মেয়ের বন্ধু হতে পারে না। তাদের মাঝে প্রেম-ভালোবাসা নামক প্রণয় ঘটবেই।”
নিশাত্যয় ও মাবিহার কথোপকথন আস্তে-ধীরে সময়ের চাকার মতো এগিয়ে চলতে লাগল। সময়ে অসময়ে দু’জনের কথা বলা প্রবল হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। সেখানে অন্যরকম অনুভূতির অবস্থান ছিল প্রখরভাবে। কিন্তু সমুখে কেউ-ই কাউকে নিজেদের অনুভূতিকে প্রদর্শিত করেনি। আড়ালে-আবডালে মন নামক স্থানে যে, ভালোবাসার অনুভূতির বসত গড়েছে, সেটা কেউ কাউকে জানায়নি টের পেতেও দেয়নি। বন্ধুসুলভ কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে নিশাত্যয় ভালো রেজাল্ট করার জন্য সর্বক্ষণ উৎসাহ দেখিয়ে ছিল মাবিহাকে। এভাবেই কেটে গিয়েছিল একটা বসন্ত। সেদিন আবারও বসন্ত ফিরে এসেছিল। যখন নিশাত্যয়ের জীবনে মাবিহা নামক ফেসবুক ফ্রেন্ড ভালোবাসার মানুষ হয়ে ওঠে। সেদিনের কথা কখনো ভুলতে পারে না নিশাত্যয় আর না মাবিহা। সেদিনই তো মাবিহাকে প্রথম ভিডিয়ো কল দিলো নিশাত্যয়। তাও আবার প্রথমই ভালোবাসি বলে প্রপোজ করল। সেদিনের দিনটি মাবিহার কাছেও ছিল চমকপ্রদ প্রাপ্তি। সেই মুহূর্তটাতে সে-ও নিশাত্যয়ের প্রপোজ একসেপ্ট করছিল। এতোটাই খুশি হয়েছিল যে, সেদিন সে খুশিতে কান্না করে ফেলে অঝোরে। কারণ একে তো সেই দিন তার এসএসসির রেজাল্ট দিয়েছিল এবং সাইন্স বিভাগে খুব ভালো রেজাল্টও করেছিল। উপরন্তু অপ্রত্যাশিত গিফট হয়ে সারপ্রাইজ প্রপোজ পেয়েছিল; যাকে সে গোটা একবছর ধরে নিরবে নিভৃতে ভালোবেসে গিয়েছিল। আজ প্রকাশ্যে তার মুখ থেকে ভালোবাসা শব্দ শুনতে পেয়ে ধন্য হলো। নিশাত্যয়কে স্কুলের সামনে থেকেই রেজাল্টের খবর দিয়েছিল সে। আগে থেকে নিশাত্যয় তাকে এমনটাই করতে বলেছিল। সেদিনও মাবিহা কালো শাড়ি পড়েছিল, তখন তাকে একজন পরিপূর্ণ যুবতীর মতো দেখতে লাগছিল। তার কথার মোহতে তো নিশাত্যয় আগেই পড়েছিল, শেষ বিকেলের অগ্নিশর্মা হলদেটে রোদের আলোক ছটায় তাকে তখন আরো বেশি আবেদনময়ী লাগছিল। তখনই ভিডিও কলে নিশাত্যয় তাকে সর্ব প্রথম দেখে প্রপোজ করে বসে। আর লাজুকলতা মাবিহাও ভালোবাসার মানুষের থেকে পাওয়া প্রপোজ আর প্রত্যাখান করেনি।
৪.
“ভালোবাসা আসে চুপ করে,
বেঁধে রেখ আমায় বাহুডোরে।
জাগ্রতচিত্তে স্বপ্নলোকে,
প্রবেশাধিকার কেবলই তোমার।”
“বাহ বেশ চমৎকার আবৃত্তি করো তো তুমি!”
লাজুকলতার ন্যায় আবারো নুইয়ে পড়ে মাবিহা। এবার নিশাত্যয় ফোনের অপরপ্রান্তে হতেও টের পায়। কারণ এতদিনে সে খুব ভালো করেই মাবিহার সম্পর্কে অবগত হয়েছে। মেয়েটা অতিরিক্ত নাজুক প্রকৃতির। তবে একবারই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে সেটা, তাও আবার প্রপোজ করার দিন-ই।
“চুপ করে যে?”
কিয়ৎক্ষণ পরে ওপাশ থেকে মাবিহার জবাব আসে মিনমিনে স্বরে,
“আপনি বলুন, আমি শুনছি।”
“ইস! মেসেঞ্জারের কথাই ভালো ছিল। তখন কথার খই ফুটতো। এখন তো গলার স্বর শোনাও যায় না। কী একটা অবস্থা!”
মাবিহা বুঝল নিশাত্যয় ইচ্ছা করেই তাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলছে। কারণ মাবিহার নিস্তব্ধতা, চুপটি করে থাকা নিশাত্যয়ের আপাতত ভালো লাগছে না। সে জানে, তার চঞ্চলতা, চপলতা, উল্লাসী ভাবের কথাবার্তা পছন্দ করে নিশাত্যয়। কিন্তু তার কী করা? সে যে বর্তমানে অপারগ। নতুন প্রেমের জোয়ারে ভিজে চুপসে গিয়ে লাজুকতা ভর করেছে তার মাঝে। প্রেম পুরাতন হলে নাহয় সে ভিজতে ভিজতে ঢেউয়ের সাথে অভ্যস্ত হবে। তখন লাজলজ্জা হারাবে সমুদ্রে গা ভাসিয়ে।
চলবে…