সর্দি_কন্যা,সূচনা_পর্ব

0
1055

#সর্দি_কন্যা,সূচনা_পর্ব
#রোকসানা_রাহমান

হাই কমোডে বসে একটি মেয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে! এই অত্যাশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী হতে কি আমি সাত সকালে অফিসে ছুটে এসেছি? বিরক্তে আর রাগে আমার চোখদুটো সরু হয়ে আসল। চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে মনে পড়ল, এটা আমার ব্যক্তিগত ওয়াশরুম। আমার অনুপস্থিতে এ কক্ষে অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। তাহলে এই মেয়ের আগমন ঘটল কী করে? তাও আবার ধৌতখানায়? আমি দু-বার উত্তপ্ত নিশ্বাস ফেলে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। রুমময় পায়চারি করতে করতে ইমার্জেন্সি বেল চাপলাম। মুহূর্তেই একটি তরুণী ছুটে এলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” এ্যানি প্রভলেম, স্যার? ”

আমি সরাসরি তার দিকে তাকালাম। ওয়াশরুমে থাকা মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থমকে গেলাম। দ্বিধায় জড়িয়ে পড়ল মস্তিষ্ক। মনে মনে বিড়বিড় করছি, ‘ আমি ঠিক দেখেছি তো? ছেলেদের ওয়াশরুমে মেয়ে ঢোকা অস্বাভাবিক, কমটে বসে ঘুমানো তো অলৌকিক টাইপ! তাহলে কি আমি ইল্যুশনের শিকার? ‘

” স্যার? ”

তরুণীর ডাকে আমার ভাবনা কাটল। বললাম,
” নাম কী তোমার? ”

তরুণী নেমপ্লেটে একহাত রেখে বলল,
” তনয়া কবির। ইউ ক্যান কল মি তনয়া। ”

আমি তার কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না এমন ভঙ্গিতে নেমপ্লেটে চোখ বুলিয়ে নিলাম। নিম্নপদে টানা দুই বছর খাটার পর উচ্চপদে প্রমোশন হয়েছে আমার, এক সপ্তাহ হলো। প্রমোশনের বদলে কাজের জন্য একটি ব্যক্তিগত কক্ষ ও এই তরুণীকে পেয়েছি। নাম-ধাম এখনও জানা হয়নি। প্রয়োজনও পড়েনি কখনও। এই প্রথম পড়ল।

” আমি আসার আগে এখানে কেউ এসেছিল? ”
” না, স্যার। ”
” শিউর? ”
” জি, স্যার। অফিস টাইম এখনো শুরু না হওয়ায় অন্যরাও আসেনি। আপনিই সবার আগে এসেছেন। ”

আমি খানিকটা ভাবুক ভঙ্গিতে তাকে চলে যাওয়ার জন্য ইশারা করলাম। সে চলে যেতেই সন্দেহি চালে আবারও ওয়াশরুমের দরজায় এগিয়ে গেলাম। ভেতরে উঁকি দিতে দেখলাম সেই মেয়ে এখনও কমটে বসে ঘুমাচ্ছে। কাঁঠালি রঙের ওড়না দিয়ে প্যাঁচানো মাথাটা একপাশে কাত হয়ে আছে। কাঁধের ব্যাগটি ইতিমধ্যে কাঁধ ছেড়ে কনুইতে ঝুলছে। কানের পাশের ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের উপর পড়ে থাকায় চেহারা ঠিকমতো বুঝা যাচ্ছে না। দূর থেকে ঝাপসা মুখখানা বড্ড ক্লান্ত লাগছে! আমি মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে ভেসিন থেকে পানি নিয়ে চোখে, মুখে ছেটালাম। মনে মনে সয়তান তাড়ানোর দোয়া পড়লাম কয়েকবার। তারপরে সজীব চোখে হাই কমোডের দিকে তাকালাম। মেয়েটি আমাকে বিস্মিত করে কমটের উপরেই বসে রইল। লক্ষ্য করলাম তার মাথাটা এখন সামনে হেলে পড়েছে। যেকোনো সময় মুখ থুবড়ে পড়বে! সেই আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিচু কণ্ঠে বললাম,
” এক্সকিউজ মি? আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? ”

মেয়েটি লাফিয়ে উঠল। চারপাশটায় ঝটপট চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকাল। বিস্মিত চাহনি কয়েক সেকেন্ড স্থির থেকেই অস্থির হয়ে উঠল। অকস্মাৎ আমার পা জড়িয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়ে বলল,
” কথা দিন, আমাকে এখনই বিয়ে করবেন না। প্লিজ, কথা দিন। ”

তার এমন কাণ্ডে আমি বুদ্ধিশূন্য হয়ে পড়লাম অল্পক্ষণ! কণ্ঠে যখন স্বর ফিরে পেলাম তখন বললাম,
” বিয়ে? কিসের বিয়ে? পাগল নাকি? পা ছাড়! ”

মেয়েটি পা ছাড়ল না। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
” কথা না নিয়ে পা ছাড়ব না। আগে কথা দিন। দিন না, প্লিজ! ”

আমি অনেক জোরাজুরি করেও পা ছাড়াতে ব্যর্থ হলাম। তার এই কঠিন বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে বাধ্য হয়ে বললাম,
” আচ্ছা, কথা দিচ্ছি। এখন কেন, কোনো ক্ষণেই বিয়ে করব না। এবার পা ছাড়। ”

মেয়েটি পা ছাড়ল। চোখ মুছতে মুছতে ব্যাগ তুলে নিল। ওড়না দিয়ে ভালো করে মাথাসহ মুখের অর্ধেকটা ঢেকে বলল,
” থ্যাংক ইউ। আপনি অনেক ভালো। আপনার মনে অনেক দয়া। আন্টি সত্যিই বলেছেন। ”
” আন্টি! কোন আন্টি? ”
” আপনার মা। ”
” আমার মাকে তুমি চিনো? ”
” হ্যাঁ। ”
” কিভাবে? ”

মেয়েটি কথার ফাঁকে কাঁধ ব্যাগটার চেইন খুলল। কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে বলল,
” ছোটবেলায় আমার একবার টাইফয়েড হয়েছিল। অবস্থা খুব খারাপ ছিল। গ্রামের ডাক্তাররা বলেছিল আমি আর বাঁচব না। তখন আম্মু আপনার মাকে ফোন দিয়ে অনেক কান্নাকাটি করে। আপনার মায়ের মনেও তো অনেক দয়া। তাই সেরাতেই আমাদের বাড়িতে আসেন উনি। আমাকে বাঁচাতে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যান। বেঁচেও যাই। আর বেঁচে গিয়েই আন্টিকে প্রথমবারের মতো দেখি। তারপর থেকেই আন্টিকে চিনি। ”

মেয়েটির মাকে চেনার ঘটনা শুনে আমার মাথা ভনভন করছিল। সেসময় সে বলল,
” এখন আসি। দুপুরের আগে বাড়ি ফিরতে হবে, নাহলে আম্মু বুঝে যাবে আমি কলেজ ফাঁকি দিয়ে আপনার এখানে এসেছি। ”
” তুমি কলেজ ফাঁকি দিয়ে এখানে এসেছ? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” আপনার কাছ থেকে কথা নেওয়ার জন্য। ”
” কী কথা? ”
” এই যে আপনি আমাকে এখনই বিয়ে করবেন না। ”

মেয়েটির চটপটে জবাবে আমার সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কী থেকে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কেমন যেন বিভ্রান্তিকর ব্যাপার-স্যাপার। বিভ্রান্ত থেকে বের হতে জিজ্ঞেস করলাম,
” আমি কেন তোমাকে বিয়ে করতে যাব? ”
” আন্টি বলবে তাই। ”
” কোন আন্টি? ”

এ পর্যায়ে মেয়েটির কণ্ঠ থেকে বিরক্ত ঝরে পড়ল,
” উফ! ভুলে গেলেন? আপনার মা, আমার আন্টি। ”

আমি দ্রুত মনে করে প্রশ্ন করলাম,
” আমার আম্মু তোমাকে বিয়ে করতে বলবে কেন? ”
” কারণ, তার আমি ভীষণ পছন্দ। একদম মনের মতো। ”

মেয়েটি এইটুকু বলে দারুন কৌতূহলে বলল,
” আন্টি আপনাকে আমার কথা বলেনি? ”

আমি দ্বিধান্বিত গলায় বললাম,
” না। ”
” আজ যে আমাকে দেখতে যাবে, এটাও বলেনি? ”

আমি না বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। মনে পড়ল, রাতে খাবার টেবিলে বসে আম্মু বলেছিল, তার এক বান্ধুবীকে দেখতে যাবে। বাসা অনেক দূরে হওয়ায় একা যেতে সাহস পাচ্ছে না। আমাকে দিয়ে আসতে হবে। বসের সাথে কথা বলে ছুটি নিয়ে দুপুরের আগেই যেন আজ বাড়ি ফিরি।

” চুপ করে আছেন কেন? বলেনি? ”

আমি মৃদু চমকে বললাম,
” না। বলেছে, তার বান্ধবীকে দেখতে যাবে। ”
” মিথ্যে বলেছে। বান্ধবীকে না বান্ধবীর মেয়ে উষ্মাকে মানে আমাকে দেখতে যাবে। ”
” তোমার নাম উষ্মা? ”

মেয়েটি ধীরে মাথা নাড়ল। ব্যাগের মধ্যে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে আমাকে পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। আমি দ্রুত পায়ে ছুটে এসে বললাম,
” তুমি আমার ঠিকানা পেলে কোথায়? ”
” আন্টি যখন আম্মুকে আপনার ব্যাপারে বলছিল তখন আমি শুনে শুনে খাতায় টুকে রেখেছিলাম। ”
” টুকে রাখা ঠিকানায় আমার ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছ? ”

মেয়েটি খোঁজাখুঁজি বন্ধ করল। মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। এককদম এগিয়ে এসে বলল,
” না। আন্টি তো শুধু অফিসের নাম বলেছিল। বাকিটা দারওয়ান বলেছে। ”
” দারওয়ান আমার ওয়াশরুমে ঢুকতে বলেছে? ”
” আরে না, উনি তো শুধু আপনাকে কোথায় পাব সেটা বলেছিল। ”
” আমার অনুমতি ছাড়াই ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে? ”
” না। একদমই ঢুকতে দেয়নি। টাকা দিতে চেয়েছিলাম, তাও ঢুকতে দেয়নি। পরে চুরি করে ঢুকেছি। ভেতরে ঢুকে দেখি কেউ নেই। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম! যদি কেউ চোর বলে পুলিশের কাছে তুলে দেয়? তাই আপনার ওয়াশরুমে লুকিয়ে ছিলাম। কিন্তু কখন যে চোখ লেগে এসেছে, বুঝতে পারিনি। আপনি কি মাইন্ড করেছেন? ”

আমি উষ্মার শেষ কথাটার উত্তর না দিয়ে বললাম,
” আমার কেবিনের তো ডোরলক করা থাকে। তুমি চাবি পেলে কোথায়? ”
” আমার কাছে চাবি নেই। ”
” তাহলে ঢুকলে কী করে? ”
” হাত দিয়ে ঠেলে। ”
” মানে? ”
” মানে দরজায় লক ছিল না। আপনি হয়তো লক করতে ভুলে গেছিলেন। আন্টির মুখে শুনেছি, আপনি নাকি রাতে ঘুমান না, সকালেও ঘুমান না। তাই সবকিছু ভুলললল…”

মেয়েটি কথা শেষ করতে পারল না। শরীর ঝাকিয়ে হাঁচি দিতে দিতে অন্যদিকে ঘুরে গেল। একহাতে নাক চেপে ধরে অন্যহাতে দ্রুত ব্যাগের চেইন খুলল। মরিয়া হয়ে কিছু একটা খুঁজতে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখন আমার চোখে পড়ল, মেয়েটি আধ ভেজা। ঠিক তখনই খেয়াল হলো, সকাল থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। আমি অফিসের গাড়ি দিয়ে আসতে গিয়েও ভিজে গেছি।

” আপনার কাছে টিস্যু হবে? ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here