#সর্দি_কন্যা,০২,০৩
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২)
” আপনার কাছে টিস্যু হবে? ”
উষ্মার হঠাৎ জিজ্ঞাসায় আমি অপ্রস্তুত হলাম। অবোধের মতো প্রশ্ন করলাম,
” কী? ”
উষ্মা বলতে গিয়ে বাঁধা পেল। টানা হাঁচি দিল কয়েকবার। তারপরে দু-হাতে মুখ ঢেকে ক্লান্ত ও অনুরোধের সুরে বলল,
” আমার টিস্যু লাগবে! ”
আমি এক মুহূর্ত চুপ থেকে নাক-মুখ কুঁচকে ফেললাম। না চাইতেও চোখের পর্দায় একটা নোংরা মেয়ে মুখ ভেসে উঠল।
” কী হলো? আমার কথা বুঝতে পারছেন না? ”
উষ্মার অসহায় কণ্ঠস্বরে আমার একটুও মায়া হলো না। গলার স্বর কঠিন করে ডাকলাম,
” তনয়া? ”
আমার সে রাগীস্বর কাচের দরজা ভেদ করে বাইরে গেল না। অথচ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তনয়া দরজার কাছটাতেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রাগে চেঁচিয়ে উঠলাম,
” তনয়া? তনয়া কবির? ”
এবারও সে শুনতে পেল না। প্রচণ্ড রাগে আমি ভুলেই গেলাম ইমার্জেন্সি বেলের কথা। যেটায় একটা চাপেই তনয়া ভূতের মতো হাজির হবে। আমি ভয়াবহ রাগ নিয়ে দরজার কাছে ছুটে গেলাম। দরজা ঠেলে চিৎকার করে বললাম,
” তখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছ না? ”
তনয়া চমকে উঠল। ভয়ে ভয়ে বলল,
” সরি, স্যার। আমি আসলেই শুনতে পাইনি। ”
তনয়া অপরাধীর মতো মুখ বানালে আমি বললাম,
” এক প্যাকেট টিস্যু নিয়ে আসো। ”
তনয়া চোখ তুলে তাকাল। চোখের চাহনিতে বিস্ময়! আমি মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ওর হাতে দিয়ে বললাম,
” যাও, ফাস্ট। ”
তনয়া জায়গা থেকে নড়ল না। বিস্মিত চাহনি প্রগাঢ় হলো। যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না, তাকে দিয়ে আমি টিস্যু আনাচ্ছি। আমি বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠলাম,
” এভাবে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? যেতে বললাম না? ”
তনয়া বিস্ময় কাটিয়ে মিনমিনে বলল,
” আপনার টেবিলে টিস্যু দেওয়া আছে, স্যার। ”
” তো কী হয়েছে? আবার আনবে। ”
” কিন্তু…. ”
তনয়াকে কিছু বলতে না দিয়েই আমি দরজা ছেড়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালাম। উষ্মা বোধ হয় এতক্ষণ আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তাকাতেই সে উল্টো ঘুরে দাঁড়াল। আমি ঘেন্নায় দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে চেয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সেসময় উষ্মা আমার হাত টেনে ধরল। আমি কিছু বুঝার আগেই হাতায় নাক মুছে হড়বড়ে বলল,
” মেয়ে মানুষকে দিয়ে টিস্যু আনাচ্ছেন? ছি! আপনার জীবন ব্যয় হোক টিস্যু কিনতে কিনতে। ”
কথাটা বলেই সে দৌড়ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল। আমি হতভম্ব চোখে তার চলে যাওয়া দেখলাম। বিমূঢ়তা কাটল ফোনের রিংটোনে,
” হ্যালো। ”
” স্লামু আলাইকুম, স্যার। ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কে বলছেন? ”
” আমি আসাদ, স্যার। আপনাগো অপিসের দারোয়ান। ”
” তুমি আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছ? ”
” উষ্মা আপা দিছে। ”
” উষ্মা? ”
” চিনতে পারতাছেন না, স্যার? একটু আগেই তো আপনার লগে দেহা করল। আরে ঐ যে আপনার আম্মার বান্ধুপির মে….”
আমি ভারি বিরক্ত হয়ে তাড়াতাড়ি বললাম,
” কী জন্যে কল করেছ তাই বলো। ”
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ ফিসফিসের শব্দ হলো। তারপর বলল,
” উষ্মা ম্যাডামের তো সিএনজি চইলা গেছে। এখন বাড়ি যাইব ক্যামনে বুঝতে পারতাছে না। বৃষ্টিও থামে না। ”
” এখন আমি কী করব? বৃষ্টি থামিয়ে দেব? নাকি কোলে করে বাড়ি দিয়ে আসব? ”
” স্যার দেহি রাগ করতাছেন৷ ”
” ফোন কাটো। খবরদার আমাকে আর কল দিবে না। ”
ফোন পকেটে ভরে আমি ঘন ঘন শ্বাস ছাড়লাম। রাগ কিছুতেই কমছে না। মাথাটা ধপ ধপ করছে। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, আম্মুর পছন্দ এতটা জঘন্য!
____________
আমি বাসায় ফিরলাম ঠিক দুপুরে। আম্মু আর আব্বু তৈরি ছিল। আমাকে দেখেই ভারী ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে এলেন বাবা। বললেন,
” এত দেরি করলি কেন, অরু? তোর মা তো….”
বাবা কথাটা শেষ করতে পারলেন না। আমি চটে গিয়ে বললাম,
” তুমি আবার আমাকে অরু ডাকছ, আব্বু? ”
বাবা খানিকটা দমে গেলেন। আমতা আমতা শুরু করলে মা এগিয়ে এসে বললেন,
” তো কী ডাকবে? গরু? ”
” আম্মু! ”
আমার করুণ কণ্ঠস্বরে মা বিরক্তের মুখ বানালে আমি বললাম,
” অরুণ ডাকবে। আমার নাম অরুণ। ”
বাবা নরম স্বরে বললেন,
” জানি তো। ওটা তো আমরা আদর করে ডাকি, বাবা। ”
” আদর করে অন্যকিছু ডাকো, আব্বু। অরু বলবে না। কেমন যেন মেয়েলি লাগে! ”
” আচ্ছা। ”
বাবার ‘ আচ্ছা ‘ শব্দটা বড়ই হালকা শোনাল। বুঝে গেলাম একটু পরেই আবারও ‘ অরু ‘ বলে ডাকবে। এভাবেই তো চলছে। আমি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
” তুই শার্ট পাল্টেছিস? ”
মায়ের প্রশ্নে আমি নিজের শার্টের দিকে তাকালাম। সাথে সাথে উষ্মার কথা মনে পড়ল। তার নোংরা মুখটা মনে পড়ল। নোংরা আচরনও।
” ভালোই হয়েছে একদম তৈরি হয়ে এসেছিস। এমনিতেও আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে। চল, বেরিয়ে পড়ি। ”
কথাটা বলেই মা বাবাকে ব্যাগপত্রসহ ঠেলে বাইরে বেরুতে বলে নিজেও হাঁটা ধরে। আমি উষ্মার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করব কী করব না দ্বিধায় পড়ে গেলাম। মনে প্রশ্ন জমল, উষ্মা মেয়েটা আসলেই আম্মুর বান্ধুবীর মেয়ে তো? নাকি অন্য কেউ? সত্যিই সে আম্মুর পছন্দ? আসলেই কি আমরা তাকে দেখতে যাচ্ছি? ওকেই বিয়ে করতে হবে? উষ্মার সাধারণ গড়নের শরীরখানা কল্পনায় ভেসে উঠতে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,
” আম্মু? ”
আম্মু থমকে পেছন ঘুরলেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
” কী রে, কী হলো? ”
আমি দৌড়ে আসলাম। অস্থির চিত্তে বললাম,
” আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছ? ”
” কী লুকাব? ”
” এমন কিছু যেটা আমি পছন্দ করব না৷ ”
” তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না! আর তুই পছন্দ করবি না এমন কিছু করতে পারি? তোর সব পছন্দ আমার জানা। ”
আমি স্বস্তি পেলাম! কয়েক দিন আগে আমার কেমন মেয়ে পছন্দ জিজ্ঞেস করেছিল আম্মু। আমিও বলে দিয়েছি। বিয়ে করব না বা পরে করব এমন চিন্তা-ভাবনা আমার মধ্যে নেই। শুধু মেয়ে আমার পছন্দসই হলেই হবে।
_____________
আম্মুর বান্ধুবীর বাড়ি শরিয়তপুর। যাত্রা পথেই জানলাম উষ্মা তার একমাত্র মেয়ে। এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। অথচ আমাকে বলেছিল কলেজে পড়ে। মিথ্যাবাদী! এমন মিথ্যুক মেয়ে কখনই আম্মুর পছন্দ হতে পারে না। এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। ভরসা ভারী করছিলাম।
উষ্মাদের বাড়িতে পৌঁছালাম সন্ধ্যা নাগাদ। মাটি রাস্তা শেষ করে উঠোনে পা পড়তেই কেউ একজন চিৎকার করে উঠল। আমি সচকিত হয়ে সামনে তাকালাম। ঝাপসা অন্ধকারে দেখলাম এক মহিলা এসে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি হতভম্ব চোখে আব্বুর দিকে তাকালাম। সেও সংশয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী হয়েছে বুঝার চেষ্টা করছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে জানতে পারলাম উষ্মা নাকি হারিয়ে গেছে! সারা গ্রাম খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার বাবা শপথ করেছে, মেয়েকে না পাওয়া পর্যন্ত বাসায় ফিরবে না। সেও এখন লাপাত্তা! এই অবস্থায় উষ্মাদের বাসা থেকে আমাদের তেমন কোনো আপ্যায়ন হলো না। নাজু আন্টি গলায় কান্না নিয়ে আমাকে একটা রুমে দিয়ে গেল। বাবা মায়ের সাথে বাইরেই থেকে যাওয়াই আমি রুমে একা হয়ে গেলাম। চিন্তায় পড়তে বাধ্য হলাম। মনের অজান্তেই ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল, ‘ উষ্মা কি সত্যিই হারিয়ে গেছে? ‘ আমি তাৎক্ষণিক দারওয়ানের নাম্বারে কল দিলাম। শেষবার তো তার সামনেই শুনেছিলাম! একবার ছেড়ে দু-বার রিং হতেই কেমন একটা শব্দ হলো। আমি ফোন কানে নিয়েই পুরো রুমে চোখ বুলালাম। সেসময় শব্দটা আবার হলো। পরপর তিনবার। আমি স্পষ্ট বুঝলাম এটা কারও হাঁচির শব্দ। মেয়েরই হবে। কিন্তু শব্দটা আসছে কোথা থেকে? আমি ফোন কান থেকে নামিয়ে রুমের কোণায় কোণায় চোখ রাখছিলাম। কোথাও কিছু না পেয়ে খাটের উপর ধপাস করে বসতেই শব্দটা আবার হলো। আমার কর্ণদ্বয় সজাগ হলো। মস্তিষ্ক খুব সচেতন হতেই বুঝে গেলাম শব্দটা খাটের নিচ থেকে আসছে। আমি বসা অবস্থায় খাটের নিচে উঁকি দিতেই চোখদুটো ছানাবড় হলো। সীমাহীন বিস্ময় ঝরে পড়ল কণ্ঠ থেকে,
” তুমি! ”
চলবে
#সর্দি_কন্যা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩)
আমি বসা অবস্থায় খাটের নিচে উঁকি দিতেই চোখদুটো ছানাবড় হলো। সীমাহীন বিস্ময় ঝরে পড়ল কণ্ঠ থেকে,
” তুমি! ”
উষ্মা চোরের মতো তাকাল। গোলগাল মুখটায় ভয়ের আভা প্রকাশ পেয়ে হারিয়ে গেল। আমি অধৈর্য্য হয়ে আবার বললাম,
” কখন এসেছ? ”
উষ্মা আমাকে ছাপিয়ে রুমের দিকে উঁকি দিল। বের হওয়ার জন্য নড়তেই খাটের তলার সাথে মাথাটা বাড়ি লাগল। নিচু স্বরে ‘ আহ! ‘ শব্দ করলে আমি বললাম,
” লাগল নাকি? খাটের নিচে কী করছ? ”
উষ্মা নড়াচড়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। ফিসফিস করে বলল,
” লুকিয়েছি। ”
আমি কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলাম,
” কেন? ”
” আম্মুকে ঠাণ্ডা করার জন্য। ”
” বুঝিনি। ”
উষ্মা বেশ উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে চাইলে আবারও মাথা গিয়ে লাগল খাটে। আমি সতর্ক করে বললাম,
” সাবধানে বসো। ”
উষ্মা বামহাতে মাথাটা ডলতে ডলতে আসন ধরে বসল। দারুন উৎসাহ নিয়ে বলল,
” বৃষ্টির জন্য আমার ফিরতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। গ্রামে ঢুকতেই আমার বান্ধুবী মিতার সাথে দেখা। ওর মুখ থেকে শুনলাম আমি বাসায় ফিরতে দেরি করছিলাম দেখে আম্মু নাকি কলেজে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে জানতে পারে আমি আজ কলেজে যাইনি। ওদের অনেক বকাঝকা করে। বলে আসে, আমি বাড়ি ফিরলেই চ্যালাকাঠ পিঠে ভাঙবে। পা কেটে দেবে। চুল পুড়িয়ে দিবে। খাটের পায়ার সাথে হাত-পা বেঁধে রাখবে। পড়ালেখা বন্ধ! ”
আমি বিস্ফারিত চোখে বললাম,
” কী বলছ এসব! নাজু আন্টি সত্যি এমন করে? মুখ দেখে বুঝাই যায় না। ”
আমার কথা শুনে সে ভীষণ আনন্দ পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে হাসল। একটু থেমে বলল,
” মাথা গরম হয়ে গেলে আরও অনেক কিছু করে। তো যেটা বলছিলাম, মিতার মুখ থেকে সবটা শোনার পর আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। বাড়িতে ফেরার সাহস পাই না৷ তার মধ্যে আব্বাও বাসায় নেই, সন্ধ্যায় ফিরবে। আমাকে বাঁচাবে কে? এদিকে দুইবার বৃষ্টিতে ভিজে আবার শুকিয়ে গেছি। জামা পাল্টানো দরকার! পুরো শরীর বরফ হয়ে আছে। ক্ষুধাও লাগছে। আপনার কাছে যাওয়া-আসা করতে করতে আমার জমানো টাকা শেষ! কোনো উপায় না পেয়ে আমি বাড়ির দিকেই হাঁটা ধরলাম। চুপিচুপি উঠোনে ঢুকে দেখলাম আম্মু বাসায় নেই। কোথাও একটা গেছে। সে সুযোগে আমি ভাত খেলাম। জামা পাল্টালাম। কিছুক্ষণ পরই আম্মুর গলা পেলাম। ভয়ে আমি দৌড়ে খাটের তলায় লুকায়। তার একটু পরে আব্বু আসে। আমি সাহস পেয়ে বের হব তখন শুনি আম্মু কাঁদছে আর বলছে, আমি নাকি হারিয়ে গেছি। যে করেই হোক খুঁজে এনে দিতে। মসজিদে জিলিপি দেবে এমন মানতও করে ফেলছে। আমি তো খুব খুশি! বুঝে গেলাম আম্মুর রাগ কমাতে হলে আমাকে হারিয়েই থাকতে হবে। তাই আর বের হয়নি। ঠিক করেছি, মাঝরাতে বের হব। যাতে আমাকে দেখেই….”
উষ্মা কথা শেষ করতে পারল না। প্রচণ্ড শব্দে হাঁচি দিতে গিয়ে মাথায় আবারও বাড়ি খেল। ব্যথা উপেক্ষা করে নাকসহ মুখ চেপে ধরল দুই হাতে। মাথা অনেকটা নামিয়ে বলল,
” টিস্যু দিন। ”
আমার কৌতূহল মিটে গেল। নাক-মুখ কুঁচকে অন্যদিকে ঘুরে বললাম,
” আমি কি টিস্যুর কারখানা যে সারাক্ষণ টিস্যু মজুদ থাকবে? ”
উষ্মা এক হাতে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসল। কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকল অল্পক্ষণ। তারপরেই জোর করে আমার হাতায় নাক মুছে বলল,
” টিস্যু মজুদ করার জন্য কারখানা হতে হয় না, ভদ্রলোক হতে হয়। শহরে থেকে এটুকু শিখেননি? ছি! ”
_____________
রাতে খেতে বসে আম্মুকে বললাম,
” আমি ঢাকা ফিরব। ”
আম্মু আঁতকে উঠে বলল,
” এত রাতে? কেন? ”
আমি উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। উষ্মা রান্নাঘরে হাজির হলো সালাম নিয়ে,
” আসসালামু আলাইকুম। আপনারা সকলে ভালো আছেন? ”
আম্মুর মনোযোগ চলে গেল উষ্মার দিকে। হাত দিয়ে টেনে পাশে বসাল। বামহাতে মুখ হাতিয়ে বলল,
” অনেক বড় হয়ে গেছিস! ”
উষ্মা লাজুক হাসল। আম্মুর হাতে আরেক চামচ ভাত তুলে দিয়ে বলল,
” আপনি অনেক শুকিয়ে গেছেন। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন না, তাই না? ”
আমি খাওয়া বন্ধ করে তাদের কথাবার্তা শুনছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম মায়ের চোখ ছলছল হয়ে আসল। সে অবস্থায় আমাকে বলল,
” উষ্মা খুব ভালো গান গায়, শুনবি? ”
আমি হ্যাঁ- না কিছুই বলতে পারলাম না। আম্মু উষ্মার দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল,
” একটা গান শোনাত মা। ”
উষ্মাও গান শুরু করে দিল। যেন আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। গান শেষ হতে মা খুব প্রশংসা করে আমাকে জিজ্ঞেস করল,
” কী দারুন কণ্ঠ তাই না রে? একদম মন শান্ত করার মতো। ”
আমি কটমটে চাইলাম উষ্মার দিকে। দাঁত চিবিয়ে বললাম,
” জঘন্য! আমার ভাত খাওয়ার রুচিই নষ্ট করে দিছে। কেউ যে এত খারাপ গান গাইতে পারে উষ্মাকে না দেখলে জানাই হতো না। ”
আমি ভাত ছেড়ে উঠে পড়লাম। গটগট শব্দে রুমে ফিরে আসলাম। মোবাইল আর মানিব্যাগ নিয়ে ঢাকার উদ্যেশ্য বের হব তখনই উষ্মা পথ আটকে দাঁড়াল। কঠিন স্বরে বলল,
” আন্টিকে কষ্ট দিলেন কেন? ”
আমি এড়িয়ে যেতে গিয়েও প্রশ্ন করে বসলাম,
” কোন আন্টি? ”
” আপনার মা। ”
” আমি কেন মাকে কষ্ট দেব? ”
” দিয়েছেন তো। ”
” কখন? ”
” একটু আগে। ”
” কিভাবে? ”
” আমার গলাকে খারাপ বলে। ”
আমি বুঝতে পারিনি এমনভাবে তাকালে সে বুঝিয়ে দিল,
” আমার গানের গলা আন্টির পছন্দ। আপনি তার পছন্দকে জঘন্য বলেছেন। তাই আন্টি কষ্ট পেয়েছে। ”
” আম্মু তোমাকে এমন বলেছে? ”
উষ্মা আত্মবিশ্বাসে বলল,
” বলতে হবে কেন? মুখ দেখেই বুঝেছি। ”
বলতে বলতে আমার হাত থেকে ফোন ও মানিব্যাগ কেড়ে নিল উষ্মা। পালিয়ে যেতে যেতে বলল,
” যতক্ষণ না আন্টিকে বলছেন, আমার গানের গলা সুন্দর ততক্ষণ এগুলো পাবেন না। ”
আমি দৌড়েও তাকে ধরতে পারলাম না। কোথায় যেন হারিয়ে গেল! মায়ের কাছে নালিশ দিতে গিয়ে পেলাম না। নাজু আন্টিকে নিয়ে কারও সাথে দেখা করতে গিয়েছে। বাবা ক্লান্ত দেখে বের হয়নি। উষ্মার বাবার সাথে গল্প করছে। আমি রাগ লুকিয়ে বাবার পাশে বসলাম। সময় বুঝে বললাম,
” আব্বু, কিছু টাকা দেও তো। ”
আব্বু বিনা প্রশ্নেই পকেটে হাত দিল। গল্প থামিয়ে দুই পকেট হাতিয়ে হেসে ফেলল। সহাস্যে বলল,
” উষ্মা বলল, এদিকে নাকি খুব চুরি হচ্ছে! জানালার শিক কেটে, মাটি খুঁড়ে সব লুটে নিচ্ছে। তাই আমার মোবাইল, টাকা-পয়সা উষ্মা সরিয়ে রেখেছে। তুই ও কে ডেকে নিয়ে আয়, আমি বলছি তোকে টাকা দিতে। ”
আমার বসে থাকা রাগটা আবার ফুঁসে উঠল। বিরক্তে ঠোঁট শক্ত হয়ে আসল। এত খারাপ মেয়ে মানুষ হয়! আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না এই মেয়ে আমার আম্মুর বান্ধুবীর মেয়ে।
” তোকে যেতে হবে না। দাঁড়া আমি ডাকছি। ”
” লাগবে না। ”
আমি ধপধপ পা ফেলে আবারও নিজের রুমে ফিরে আসলাম। ঘরময় পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করছি, কী করব এখন? খালি হাতে ঢাকায় ফিরব কী করে? মোবাইলও তো নেই যে কারও সাথে যোগাযোগ করব। উষ্মার বাবার কাছে চাইব? ছি! ছি! ছি! এসব আমি কী ভাবছি? মেয়েটা আমাকে এভাবে অপদস্ত করছে? কোণঠাসা করছে? তার কথামতো চলতে বাধ্য করছে! কিছুতেই শুনব না। কিছুতেই মানব না।
আমি আবার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। উষ্মাকে খুঁজে বের করতে হবে। করতেই হবে! আমার জিনিস আমি নিয়ে ছাড়ব। প্রয়োজনে কানের নিচে কয়েকটা লাগাব। বেয়াদব! কার সাথে কী আচরণ করতে হয় জানে না। ম্যানারলেস!
উষ্মাকে খুঁজতে খুঁজতে রাস্তায় চলে এসেছি। কোনদিকে যাব ভাবতেই মেঘ গুড়ুমগুড়ুম ছন্দ তুলল। আমি আকাশের দিকে তাকাতেই মুখের মধ্যে ঠাণ্ডা পানির স্পর্শ পেলাম।
চলবে