সর্দি_কন্যা,০৪,০৫

0
521

#সর্দি_কন্যা,০৪,০৫
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৪)

শরীরটাকে বৃষ্টির ফোঁটা থেকে রক্ষা করতে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ছুটলাম। রান্নাঘরের ছাউনিতে আশ্রয় নিলে আম্মু আর নাজু আন্টির গলার স্বর পেলাম। আন্টি বোধ হয় আমাকে দেখলেন। তাড়াহুড়ায় ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। চোখের পলকে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। আমার মাথায় ধরে বললেন,
” আসো। ”

আমি চুপচাপ ছাতার নিচে দাঁড়ালাম। আন্টি আমাকে একদম রুমের কাছে এগিয়ে দিলেন। আমি নীরবে খাটের উপর বসতে আম্মুর আগমন ঘটল। দূর থেকেই বলল,
” তুই আমাকে খুঁজেছিস? জরুরি কিছু বলবি বলে? ”

আমি সন্দেহ চোখে তাকালাম। আম্মু সে চাহনি ধরতে পারল না। আমার উত্তরের অপেক্ষায় রইল। সেসময় চোখ পড়ল পেছনে। উষ্মা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে, মুখে দুষ্টুমি! মোবাইল আর মানিব্যাগটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে আমাকে দেখাচ্ছে। আমি রাগ চোখে তাকালাম। চোয়াল শক্ত করে নাক ফুলালাম। সে কোনো পাত্তাই দিল না! মুখ বাঁকিয়ে চলে যাওয়ার ভাব ধরল। আমি ধপ করে নিশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” উষ্মার গানের গলা সুন্দর। ”

আম্মু ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। বুঝাই যাচ্ছে আমাকে বিশ্বাস করছেন না। আমি নরম গলায় বললাম,
” সত্যিই সুন্দর। ”
” তখন তো অন্য কিছু বলেছিলি। ”
” ইচ্ছে করে বলেছি। সবাই তো প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। আগুনের মতো ঝলকে ওঠে! ”

আম্মু সাথে সাথে কিছু বলল না। কেমন করে যেন তাকিয়ে রইল অল্পক্ষণ। তারপর হঠাৎ হেসে ফেলল। উৎসাহ নিয়ে বলল,
” তোর পছন্দ হয়েছে? আমি জানতাম হবে। ”
” আমার পছন্দ হয়েছে মানে কী, আম্মু? তুমি কি আমাকে…”

আম্মু আমার কথা শুনল না। ঠোঁটে হাসি নিয়ে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। আমি পিছু পিছু একটু এগোলাম। সন্দেহ মনে বিড়বিড় করলাম, ‘ উষ্মার কথায়ই ঠিক? ‘

” আপনি নাকি কয়েলের ধোঁয়া সহ্য করতে পারেন না? ”

উষ্মার কণ্ঠস্বরে আমি চমকালাম। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম সে মশারি টাঙাচ্ছে। আমি জোর কদমে এগিয়ে বললাম,
” তুমি এখানে কী করছ? ”

উষ্মা সহজ গলায় উত্তর দিল,
” মশারি টাঙাচ্ছি। ”
” তোমার টাঙাতে হবে না। যাও, এখান থেকে। এখনি। ”
” যাব না। ”

উষ্মার বেয়াড়াপনায় আমার মেজাজ চটে গেল। খানিকটা চড়া গলায় বললাম,
” তুমি যাবে মানে যাবে। এখনি যাবে। ”

আমি উষ্মার ডানহাতের কনুই ধরে ফেললাম। টেনে দরজার দিকে হাঁটা ধরলে সে বলল,
” আমাকে কেমন লাগছে? ”

আমি থামতে বাধ্য হলাম। সে আবার বলল,
” আমাকে দেখে বলুন তো, কেমন লাগছে? ”

উষ্মার দিকে তাকালাম। গোলাপি শাড়ি, যত্ন করে চুল বাঁধা ও মুখে হালকা প্রসাধনী মাখাতে একটু অন্যরকম লাগছে। না, একদমই অন্যরকম। চোখের চাহনি গাঢ় হতে আনমনা হয়ে বললাম,
” টিপ বাঁকা হয়েছে। ”

বলতে বলতে আমি হাত দিয়ে টিপে স্পর্শ করতে সে মাথা পিছিয়ে নিল। চটপটে বলল,
” এটা টিপ নয়, আঁচিল। ”

আমার বুঝি হুঁশ ফিরল। ভ্রু কুঁচকে সন্দেহ চোখে আঁচিলের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এমন জায়গাও আঁচিল হয়? ডানদিকে সামান্য নড়ালে বিশ্বাসই হবে না এটা আঁচিল!

” বিশ্বাস হচ্ছে না? ছুঁয়ে দেখবেন? ”

আমি সচেতন হলাম। ছুঁয়ে দেখার আগ্রহ দেখালাম না। উষ্মা পুরোনো কথায় ফিরে গেল,
” বললেন না, কেমন লাগছে? ”

আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বিদ্রুপ করে বললাম,
” মনে হচ্ছে বাদরের গলায় মুক্তোর মালা! ”
” মানে কী? ”

আমি খানিকটা উঁচু গলায় বললাম,
” মানে সুন্দর লাগছে না। খারাপ লাগছে। বিশ্রী! ”

উষ্মা রেগে গেল। কটমট চোখে চেয়ে থেকে বলল,
” আমি জানতাম আপনি এমনই বলবেন। সেজন্যই আন্টিকে সাথে করে আনিনি। আপনার কাজই হলো আন্টিকে কষ্ট দেওয়া। ”
” আম্মুর কথা বলছ? ”
” জি। ”
” তোমার সাজের সাথে আম্মুর কী সম্পর্ক? ”
” অনেক সম্পর্ক। এই শাড়ি, গয়না তো আন্টিরই। উনি নিজ হাতে সাজিয়ে বলেছেন, আমাকে সুন্দর লাগছে। ”

আমি চট করে উষ্মার আপাদমস্তক দেখে নিলাম। উষ্মা সত্যি বলছে। এই শাড়িটা আম্মুরই। কানের দুল, গলার লকেটটাও আম্মুর। আমি নিজে ইদে বানিয়ে দিয়েছিলাম। উষ্মা আমার কাছ থেকে সরে গেল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
” আপনার উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে। আপনি নিশ্চয় অন্য কারও ছেলে। আন্টি কুড়িয়ে এনেছে। এজন্যই আন্টির আনন্দ আপনার সহ্য হয় না। কষ্টে দিতে অন্তর কাঁপে না। ”

আমি উষ্মার কথা কানে নিলাম না। ছুটে এসে বললাম,
” এগুলো তুমি পরেছ কেন? ”

উষ্মা উত্তর দিল না। মশারি খুলে নিয়ে গরম চাহনি রেখে বলল,
” আপনাকে মশা খাক। মশার খাদ্য হওয়ার জন্যই আল্লাহ আপনাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। ”

উষ্মা চলে যেতেই আমার মানিব্যাগ আর মোবাইলের কথা মনে পড়ল। হিসেবে তো ওগুলো ফেরত পাওয়ার কথা। আমি দৌড়ে দরজা পার হয়ে তাকে খুঁজলাম। নেই, আশপাশে কোথাও নেই। হতাশ হয়ে ফিরে এসে দেখলাম খাটের মাঝখানে মানিব্যাগ আর মোবাইল পড়ে আছে। আমার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল। মেয়েটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা নয়। কথা রাখতে জানে। খাটের উপর উঠতে উঠতে জানালার দিকে তাকালাম। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। কালো অন্ধকার ঝাপসা দেখাচ্ছে। শীতল বাতাস গায়ে লাগতে সম্পূর্ণ শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠল। সেসময় মশার কামড় টের পেলাম। হাতে কামড়াচ্ছে, পায়ে কাপড়াচ্ছে, পিঠে কামড়াচ্ছে। কপালটাকেও ছাড়ছে না! হায় মাবুদ, এখন ঘুমাব কী করে?

___________
নতুন জায়গাতে আমার এমনিতে ঘুম আসে না। তারমধ্যে মশার উৎপাত! কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে বসতে বাধ্য হলাম। এদিকে খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে বিছানার একপাশ ভিজিয়ে দিছে। কাঠের পাল্লা শব্দ করে দুলছে। বিরক্তিতে আমার মাথা ঝিম ধরে রইল। ঠিক করলাম বৃষ্টি কমলেই গ্রাম ছাড়ব। যত রাতই হোক।

আমি বসে বসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিলাম। সেসময় বাতাসের সাথে নারী কণ্ঠের গুণগুণ শব্দ ভেসে এলো। আমার কান খাড়া করলাম। মনোযোগ বাইরে দিতে খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে এলো। ভীষণ আশ্চর্য হলাম। চট করে ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা ছুঁইছুঁই। এতরাতে কে হাসছে? কে গান গাইছে? আমি কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলাম না। জানালার কাছে এসে বাইরে নজর রাখলাম। এদিক ছেড়ে ওদিকে তাকাতে বিস্ময়ের সীমানা ভেঙে গেল। বাঁশঝাড়ের ওখানে নারী অবয়ব! ছন্দ ধরে লাফাচ্ছে, ঘুরছে, হাত-পা ছুটে নাচছে। আমি দুইহাত দিয়ে জানালার শিঁক চেপে ধরলাম। কপাল ঠেকিয়ে আরও ভালো করে মেয়েটিকে দেখতে লাগলাম। সে লাফাতে লাফাতে এদিকে এগিয়ে আসছে। ঝাপসা অবয়বটি দৃষ্টিগোচরে রূপ নিতে আমি চেঁচিয়ে বললাম,
” এই মেয়ে, পাগল নাকি? এভাবে ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছ কেন? ”

উষ্মা দূর থেকেই চিৎকার করে বলল,
” ব্যাঙের মতো নয়, ব্যাঙের সাথে লাফাচ্ছি। ”
” ব্যাঙ? ”

উষ্মা লাফাতে লাফাতে আমার জানালার কাছে আসল। কাঁপতে কাঁপতে বলল,
” হ্যাঁ, ব্যাঙ। আমার পোষা। দেখুন কেমন নাচছে। ”

উষ্মা প্রসন্ন মনে কোথাও একটা ইশারা করল। আমি অন্ধকারে কিছুই দেখলাম না। বললাম,
” তুমি ব্যাঙ পালো? ”
” হ্যাঁ, অনেকগুলো। ”
” কী বলছ! ”
” বিশ্বাস হচ্ছে না? খাটের নিচে তাকান, তাহলেই বিশ্বাস হবে। ওখানে ওদের বাসা। ”

আমি সংকোচ নিয়ে খাটের নিচে উঁকি দিলাম। রুমে আলো না থাকায় কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। মোবাইলে আলো জ্বেলে ধরতে দেখলাম একটি ভাঙা কলস। যার মধ্যে ভেজা মাটি রাখা। মাটিতে শ্যাওলা জমে আছে।

” বিশ্বাস হলো? ”

আমি উত্তর দিতে পারলাম না। আপনমনে বিড়বিড় করলাম,
‘ মানুষ ব্যাঙও পুষে? এটা পোষার মতো প্রাণী? ‘ ঘৃণায় আমার শরীর রি রি করে উঠল। ফাঁপা ঢেঁকুর উঠল ঘন ঘন। বমি করার ভাব উঠতে উষ্মা পেছন থেকে বলল,
” কী হলো আপনার? ”

আমি উত্তর দিতে পারলাম না। শুধু শুনতে পেলাম মেয়েটা পেছন থেকে সরে যেতে যেতে বলছে,
” অপেক্ষা করুন। আরেকটু চেপে থাকুন। আমি গামলা নিয়ে আসছি। আমার রুম নষ্ট করবেন না, প্লিজ! ”

চলবে

#সর্দি_কন্যা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৫)

উষ্মা বালতি নিয়ে আমার কাছে ছুটে এলো। খাটের কাছে রেখে বলল,
” এখন করুন। ”

আমার বালতি দেখেই বমি ভাব কেটে গেল। উষ্মার আশপাশে ব্যাঙের খোঁজ চালিয়ে বললাম,
” এটা তোমার রুম? ”

সে উত্তর দেওয়ার বদলে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” জানতেন না? ”
” না। ”
” দেখেও বুঝেননি? ”

আমি চুপ হয়ে গেলাম। বোকা চোখে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। সে আমার পাশে বসল নিঃসংকোচে। বলল,
” কোথায় থাকছেন একবার দেখে নিবেন না? আপনি এত বোকা? আন্টি তো বলেছিল, আপনি খুব বুদ্ধিমান। আপনি আবারও আন্টিকে মিথ্যে প্রমাণ করলেন। ”

এই প্রথম উষ্মার কথায় রাগ হওয়ার বদলে লজ্জা পেলাম। লুকিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলালাম। মধ্য আকারের রুমটিতে একজনের খাট, তার পাশেই কাঠের পড়ার টেবিল। বই-খাতা বেশ গুছানো। টেবিলের উল্টোদিকে ছোট্ট আলনা। ভাঁজে ভাঁজে মেয়েদের কাপড় গুছানো।
” আমি খুব গুছানো, তাই না? ”

আমার চোখের দৃষ্টি উষ্মার মুখে ফিরে আসল। সে উৎসুকে চেয়ে আছে। আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললাম,
” না। ”

উষ্মার চোখের চাহনি বদলে গেল। মুখের ভাব বদলে গেল। বসা থেকে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিতেই আমি বললাম,
” আমি আবারও আম্মুকে মিথ্যে প্রমাণ করেছি, এটাই বলবে তো? ”

উষ্মা অবাক হলো। বিস্ময় খেলে গেল চোখের তারায়। আমি বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম,
” আম্মু হয়তো মিথ্যেকেই সত্যি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। ”
” মানে? ”

আমি উত্তরে সামান্য হাসলাম। উষ্মার ভাঁজ করে রাখা কাপড় থেকে একটা জামা হাতে নিয়ে বললাম,
” এটা তো খুব সুন্দর। এক পিসই নাকি? ”
” না। থ্রি-পিস। ”
” অন্য দুটো কোথায়? ”
” ওখানেই আছে। ”

আমি আলনার দিকে একটুখানি চেয়ে থেকে বললাম,
” দেখতে পাচ্ছি না। তুমি খুঁজে দেও তো। ”

উষ্মা আমার কাছে এগিয়ে এলো। যেখান থেকে জামাটা নিয়েছিলাম সেখানে অন্য অংশগুলো খুঁজছে, পাচ্ছে না। ঐ সারি রেখে, উপরে, নিচে এমনকি পেছনেও খোঁজা বাকি রাখল না। একসময় বিরক্ত হয়ে বলল,
” পাচ্ছি না। মনে হয়, আম্মুদের রুমে। ”
” না। এ রুমেই। ”

উষ্মা রেগে গেল। মুখ শক্ত করে বলল,
” আমার থেকে আপনি বেশি জানেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে দেখান। ”

আমি সোজা হেঁটে গেলাম টেবিলের কাছে। সাজিয়ে রাখা বইয়ের পেছনে হাত দিতেই ওড়না পেয়ে গেলাম। উষ্মার মুখের সামনে ধরে বললাম,
” অন্য অংশটা মনে হয় খাটের নিচে। ”

উষ্মার মুখ হাঁ হয়ে গেল। যেন আমি অসম্ভব কিছু করে ফেলেছি। আমি হাসলাম। ভীষণ তৃপ্তিমাখা হাসি। যেন কত বছর পর এমন আনন্দ পেয়েছি। উষ্মা লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেলল। আমি বললাম,
” যতটা অগোছাল হলে একটা মেয়ে তার জামা-কাপড়ের খোঁজ রাখতে পারে না, তুমি ঠিক ততটাই অগোছাল। ”

উষ্মার নতমাথা আরও ঝুঁকে গেল। আমি মায়া ভুলে বললাম,
” তুমি শুধু অগোছালই না, কাণ্ডজ্ঞানহীন। নাহলে এভাবে ভেজা কাপড়ে মেঝে ডুবাতে না। বিছানাটাও ভিজিয়ে ফেলেছ। মাঝরাতে ব্যাঙের সাথে লাফাচ্ছ। সর্দি লাগিয়ে বৃষ্টিতে নেচে-গেয়ে বেড়াচ্ছ। জ্বরে পুড়ে মরবে নাকি? ”

উষ্মা মাথা নিচু অবস্থায় বলল,
” বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসে না। শুধু সর্দি হয়। ”
” সর্দিও একটা রোগ। শরীরের ভোগান্তি। আর তুমি তো শুধু নিজেকে না আমাকেও…”

আমি কথাটা শেষ করলাম না৷ মুখ কুঁচকে ফেললাম। উষ্মার থেকে দূরে সরে বললাম,
” মানছি, আম্মু চাচ্ছে আমি তোমাকে বিয়ে করি। কিন্তু তুমি তো চাও না, তাহলে এসবের মানে কী, উষ্মা? কেন বারবার আমার পছন্দ সাজার চেষ্টা করছ? শুধুই কি আম্মুকে খুশি করতে নাকি অন্য কিছু? ”

উষ্মা উত্তর দিল না। নীরব দাঁড়িয়ে রইল। আমি অপেক্ষা করেও যখন উত্তর পেলাম না। তখন বললাম,
” আম্মু যেহেতু এখনও বিয়ের কথাটি তুলতে পারেনি আর পারবেও না। আমি সেই সুযোগ দেব না। ভোরের আলো ফুটতেই আমি বেরিয়ে পড়ব। যদিও কাউকে বলার ইচ্ছে ছিল না। তবুও তোমাকে বললাম, যাতে আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা না হয়। আম্মুর ঘুম ভাঙলে তুমি বলে দিও। ”

উষ্মা হ্যাঁ-না কিছু বলল না। আগের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তার কম্পিত শরীরটাতে চোখ রেখে বললাম,
” যাও, কাপড় পাল্টে নেও। ”

উষ্মা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। আমি দরজায় খিল টেনে বিছানায় এগোলাম। বালিশে মাথা রাখার আগে জানালাটা বন্ধ করতে প্রস্তুত হলাম। পাল্লাদুটো এক করতে সেই লাফানোর শব্দ, গানের গলা, গানের মাঝে খিলখিল হাসির শব্দ। আমা পাল্লা ছেড়ে বাঁশঝাড়ে দৃষ্টি রাখলাম। বিশ্ব মাপের বিস্ময় নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম,
” তুমি আবার ভিজছ? ”

উষ্মা দূর থেকেই দ্বিগুন স্বরে চিৎকার করে বলল,
” আমার বৃষ্টি ভালো লাগে, রাতের বৃষ্টি আরও বেশি। ভিজলে মনে হয়, আমি উষ্মা নই, অন্য কেউ। অন্য ভুবনের বাসিন্দা। ”

__________
আমার সে রাত কাটল একদমই নির্ঘুমে। চোখ বুঝে শুধু অন্য ভুবনের বাসিন্দার গান শুনলাম, লাফানোর ঝুপঝাপ শব্দ শুনলাম, ক্ষণে ক্ষণে বাতাস কাঁপানো হাসি শুনলাম।

ভোরের আলো ফুটল। পাখির কিচিরমিচির শব্দে চোখ মেললাম। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাসি মুখে দরজা খুলেই উষ্মার দর্শন পেলাম। কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের শাড়ি এখনও শরীরে জড়ানো। ভেজা নাকি শুকনো বুঝা যাচ্ছে না। কিন্তু টুপটুপ করে পানি পড়ছে না। আমি এড়িয়ে যেতে চেয়েও পারলাম না। প্রশ্ন করলাম,
” সারারাত ভিজেছ? ”

উষ্মা মাথা উপরনিচ করে হ্যাঁ বুঝাল। আমি আবার বললাম,
” ঘুমাওনি? ”

তার বোধহয় এ প্রশ্নটা পছন্দ হলো না। নত মাথা সোজা করে বলল,
” আমি পানি ছুঁলেই সর্দি হয়। তাই আম্মু বৃষ্টিতে ভিজতে দেয় না, পুকুরে নামতে দেয় না। ”
” আচ্ছা৷ ”
” ছোটবেলা একবার খেলতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম, তাই আম্মু দূরে কোথাও একা যেতে দেয় না। ”
” আচ্ছা। ”
” আমাদের এখানে ষোল-সতেরো বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়, আমার বয়স একুশ। ”
” আচ্ছা। ”
” আমি প্রথমবারের মতো যেদিন পাত্রপক্ষের সামনে বসেছিলাম সেদিন আপনার আম্মু হুট করেই চলে আসে। একঝাঁক মেহমানের সামনে আমার মাকে খুব বকে। এত অল্প বয়সে বিয়ে দিতে মানা করে। পরবর্তীতে জানায়, আমাকে তার খুব পছন্দ। আঠারো হলেই আপনার বউ করে নিয়ে যাবে। ”
” আচ্ছা। ”
” কিন্তু আঠারো, উনিশ পার হয়ে যখন বিশে পড়লাম তখন পাড়া-প্রতিবেশিরা নানান কথা বলে বেড়ায়। আমার মা খুব চিন্তায় পড়ে যায়। তখন আন্টি সান্ত্বনা দেয়, খুব শীঘ্রই আপনাকে নিয়ে আসবে। ”
” আচ্ছা। ”
” কিন্তু আমার এই মুহূর্তে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই, তাই আপনার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। ”
” আমারও নেই। ”

উষ্মা আমার দিকে তাকাল। করুণ চাহনি! আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। দরজা ছেড়ে বাইরে বের হয়ে আসলাম। উঠোনের দিকে চলতে চলতে বললাম,
” আমি মোবাইল রেখে যাচ্ছি, আম্মুর কাছে দিয়ে দিও। ”

আমি উঠোনের মাঝপথেও আসতে পারলাম না। তার আগেই একজোড়া কোমল হাত আমার পা জড়িয়ে ধরল। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
” আপনি যাবেন না। প্লিজ, যাবেন না। ”

আমি বিপদে পড়ে গেলাম। উষ্মার হাত সরাতে চাইলাম। নিজেকে উদ্ধার করার প্রচেষ্টা চালাতে চালাতে বললাম,
” আরে, কী করছ? পা ছাড়। কেউ দেখবে। সবাই জেগে যাবে। ”
” যাক। দেখুক। তবুও যেতে দেব না। ”
” কী আশ্চর্য! যেতে দেবে না কেন? এখানে থেকে কী করব? তুমি চাচ্ছোটা কী? ”
” আমি চাই বিয়েটা হোক। ”

আমি উষ্মার হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে ফেললাম। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উগ্র গলায় বললাম,
” তুমি তো বিয়ে করতে চাও না, আমিও চাই না। তাহলে বিয়েটা কেন হবে? কেন? ”
” আমার জন্য। ”

আমি হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লাম। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে উষ্মাকে দূরে সরিয়ে বললাম,
” তুমি কি পাগল? কথার কোনো ঠিক নেই। একেক সময় একেকটা বলছ। মাথায় সমস্যা আছে নাকি? তোমার তো চিকিৎসার প্রয়োজন। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here