সর্দি_কন্যা,০৯,১০

0
1033

#সর্দি_কন্যা,০৯,১০
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৮)

উষ্মাকে দেখেই মা আত্মহারা হয়ে পড়লেন। বুকে টেনে আদুরে বুলি আওড়াচ্ছেন। আমি দুজনকে রেখে নিজের রুমের দিকে এগুলাম। গোসল করেই বেরিয়েছিলাম বলে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। বিছানায় সবে বসেছি তখনই মা আর উষ্মার আগমন ঘটল। আমি জিজ্ঞেসা চাহনি রাখলে তিনি বললেন,
” উষ্মা গোসল করবে। ”

আমার ভ্রূজোড়া আপনা-আপনি কুঁচকে এলো। বিরক্ত ভরা গলায় বললাম,
” তো আমি কী করব? আমাকে জানাচ্ছ কেন? ”

মা এগিয়ে এসে বললেন,
” তোর গোসলখানায় করবে তাই জানালাম। ”

আমি ফুঁসে উঠে বললাম,
” আমার গোসলখানা কেন? তোমারটা কী হয়েছে? ”
” ওটা তে তোর বাবা করছে। ”
” তাহলে অপেক্ষা করুক। ”

মা রেগে গেলেন। ধমকে বললেন,
” কেন অপেক্ষা করবে? কয়দিন পর তো এখানেই গোসল করবে। তাহলে আজ করলে সমস্যা কী? ”

আমাকে উত্তর দেওয়ার সময় দিল না মা। উষ্মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে টেনে নিয়ে আসলেন ভেতরে। গোসলখানায় ঠেলে দিয়ে আমাকে শুনিয়ে বললেন,
” তুই এখানেই গোসল করবি। যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ করবি। কেউ কিছু বললে আমায় ডাকবি। ”

মা আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন। তার শাসানির চাহনি ফেলে আমি বের হয়ে যাচ্ছিলাম। মা জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় যাচ্ছিস? ”
” মসজিদে। ”
” এখন? আযানই তো দেয়নি। ”

আমি পেছন না ঘুরেই চলতে চলতে বললাম,
” শুধু আযান দিলেই যে মসজিদে যেতে হবে এমন কোনো বাঁধা নিয়ম নেই, আম্মু। ”

____________

আমি জুমু’আর নামাজ শেষ করে আস্তে-ধীরে বাসার দিকে এগুলাম। গেইট পেরিয়ে সিঁড়ি বাইছিলাম। মাঝপথে দেখা হলো নিচতলার কাকিমার সাথে। পথরোধ করে জিজ্ঞেস করলেন,
” অরুণ, তোমাদের বাসায় কি মেহমান এসেছে? ”

আমি ভদ্রতাসূচক মাথা নেড়ে বললাম,
” জি। ”
” বাচ্চাগুলো খুব দুষ্টু নাকি? ”

বাচ্চার কথা শুনে একটু অবাক হলাম। পর মুহূর্তে বললাম,
” আমাদের বাসায় তো কোনো বাচ্চা আসেনি, কাকিমা। ”

কাকিমা আমার থেকেও বেশি অবাক হলেন। বললেন,
” তাহলে এমন ধুপধাপ শব্দ করছে কে? মনে হচ্ছে, এখনই মাথায় ছাদ ভেঙে পড়বে! ”

আমি কাকিমাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সিঁড়ি কাটলাম। মা দরজা খুলে দিতেই বললাম,
” উষ্মা কোথায়? ”

মা কিছু একটা বললেন বোধ হয় কিন্তু আমার কর্ণগহ্বরে পৌঁছাল না। তার আগেই আমি আমার রুমে ছুটে এলাম। সোজা গোসলখানার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছিটকানি ভেতর থেকে টানা। আমি দরজায় মৃদু আঘাত করে ডাকলাম,
” উষ্মা? ”

উষ্মা উত্তর দিল না। আমি পানি ঝরার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। দরজায় আড়ি পাততে গানের গলা ও ধুপধাপ লাফানোর শব্দও পেলাম। নিমিষেই আমার মেজাজ পাল্টে গেল। খানিকটা শক্ত গলায় বললাম,
” উষ্মা বের হও। জলদি। ”

উষ্মা বের হলো না। আমাকে শুনলই না। নিজের মতো ধুপধাপ শব্দ তুলে খালি গলায় গান গেয়ে চলছে। আমি দরজায় জোরে জোরে থাপ্পড় মেরে চেঁচিয়ে বললাম,
” বের হবে নাকি দরজা ভেঙে ফেলব? ”

ভেতরের পানি পড়ার শব্দ হলো। দরজা একটুখানি ফাঁক করে বলল,
” আমার তো গোসল শেষ হয়নি! ”
” শেষ হয়নি মানে কী? দুই ঘণ্টা ধরে গোসল করছ তাও শেষ হয়নি? শরীরে কি গোবর মাখা? ”

উষ্মা দরজা আটকে দিল। আমি আবারও থাপ্পড়ের ঝড় তুললে সে খুলে দিল। বেরিয়ে এসে বলল,
” অনেকদিন ধরে বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি, তাই আজ ভিজছিলাম। ”

আমি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললাম,
” এখন কি বৃষ্টি হচ্ছে যে ভিজছ? ”
” হ্যাঁ। ”
” কোথায়? ”

উষ্মা আবার গোসলখানায় ঢুকল। ঝরণার বাঁট ঘুরিয়ে বলল,
” এই তো বৃষ্টি। ”

আমি বাইরে থেকে বললাম,
” ওটা বৃষ্টি না ঝরণা। ”

উষ্মা বাঁট ঘুরিয়ে ঝরণা বন্ধ করে বলল,
” হ্যাঁ, জানি। ওটা ঝরণা। ”
” তাহলে বৃষ্টি বলছ কেন? তুমি কি সত্যিই পাগল? ”

উষ্মা গরম চোখে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড পর বলল,
” বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে টুপটাপ ছন্দ করে পানি পড়ে। তাই বৃষ্টি বলেছি। ”

কথাটা বলেই উষ্মা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এদিকে আমার নিজের চুল ছেঁড়া দশা হলো!

_________

দুইদিন হতে চলল উষ্মার ফিরে যাওয়ার কোনো ভাবভঙ্গি নেই। আমার চোখের সামনে পড়লেই বলতে ইচ্ছে হয়, ‘ এই মেয়ে এখনও যাচ্ছ না কেন? ‘ ভদ্র হওয়ার কারণে বলা হয়ে উঠে না। এমনই এক বিরাগী সন্ধ্যায় মা নাস্তা দিতে এলেন রুমে। টেবিলে নাস্তা রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
” কিছু বলবে, আম্মু? ”

মা আমার পাশে বসে পড়লেন। স্নেহভরা চোখে চাইলেন। আদুরে হাত রাখলেন চুলে। আমি সন্দেহভরা গলায় সুধালাম,
” কী হয়েছে, আম্মু? ”

মা আনন্দিত গলায় বললেন,
” উষ্মা রাজি হয়ে গেছে। ”
” কোন ব্যাপারে? ”
” তোদের বিয়ের ব্যাপারে। আমাকে বলল, বিয়েতে তার আর আপত্তি নেই। আমরা চাইলে যেকোনো দিন বিয়ের তারিখ ঠিক করতে পারি। ”

আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যেন অসম্ভব কিছু ঘটে গেছে, কল্পনাতীত, ভাবনাতীত! বাকশূন্য হয়ে বসে থাকলাম অনেক্ষণ। মা আমার কাঁধ ঝাকিয়ে বললেন,
” নাজুদের এখানে ডেকে আনি, কী বলিস? ”

আমি আচমকা রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালাম। সটাং দাঁড়িয়ে কাঠ স্বরে বললাম,
” না। কাউকে ডাকতে হবে না। ”
” কেন? ”

মায়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম,
” উষ্মা কোথায়? ”
” বসার রুমে। তোর বাবার সাথে নাস্তা খাচ্ছে আর গল্প করছে। ”
” ও কে পাঠিয়ে দেও। ”

মা আর কিছু বললেন না। উষ্মাকে পাঠিয়ে দিলেন। সে দরজার কাছ থেকে সুধাল,
” আসব? ”

আমি অনুমতি না দিয়ে ওর কাছে ছুটে গেলাম। একহাত ধরে টেনে ভেতরে এনে বললাম,
” তুমি মাকে কী বলেছ? ”

সে সরল গলায় জানতে চাইল,
” কী বলেছি? ”

আমি ধৈর্য ধরে বললাম,
” বিয়ের তারিখ ঠিক করতে বলেছ? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” ব্যালেন্সিংয়ের জন্য। ”
” কিসের ব্যালেন্সিং? ”

উষ্মা আমার বিছানায় বসল। রয়ে-সয়ে বলল,
” আন্টি তো বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে আছেন। আপনার আর আমার জন্য হচ্ছে না। তিনি যেমন আপনাকে চাপ দিচ্ছেন তেমন আমাকেও। এখন দুই দিক থেকেই যদি বার বার ব্যর্থ হয়ে পড়েন তখন ধৈর্য্য হারাবেন, রেগে যাবেন। তখন যদি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে? বেঁধেধরে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দেয়? তাই তাকে খুশি করার জন্য বলেছি, আমি রাজি। এখন আপনি না করে দিবেন, তাহলে আবার অখুশি হবেন। খুশি-অখুশিতে কাটাকাটি। হলো তো ব্যালেন্সিং? ”

আমি বুঝলাম কী বুঝলাম না তার ধার ধারল না সে। চট করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

___________
ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটল উষ্মার বিদায় নেওয়ার দিন সকালে। পুরো এক সপ্তাহ বেড়ানোর পর তার হঠাৎ করে মা-বাবার কথা মনে পড়েছে। মাও তাদের জন্য শুকনো খাবার, রান্না খাবারসহ নানা ধরনের কেনাকাটা করে প্যাকেটের পর প্যাকেট সাজাচ্ছেন। আমি অফিসের জন্য বের হব তখনই মা পিছু ডাকলেন। আমি থামলে বললেন,
” তোকে না বললাম আজ ছুটি নিতে? ”
” কেন? ”
” ভুলে গেলি? উষ্মাকে দিয়ে আসার কথা ছিল না? ”

আমি জুতোয় ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বললাম,
” আমি কেন দিয়ে আসব? ও একাই যেতে পারবে। ”
” না, পারবে না। তুই দিয়ে আসবি। ”
” আশ্চর্য তো! আসার সময় তো একাই আসছে। তাহলে এখন একা যেতে কী সমস্যা? ”
” অনেক সমস্যা। মানুষ কী বলবে? যে মেয়ে দুইদিন পর এ বাড়ির বউ হবে, সে কেন একা একা চলাফেরা করবে? ”
” দুই দিন পর ও বউ হয়ে যাবে? ”
” হ্যাঁ, হবে। তুই শুধু হ্যাঁ বলে দেখ। ”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
” তুমি আবার বিয়ে নিয়ে পড়লে? ”
” তো পড়ব না? যেটা হবেই সেটা এত পেছনে টানার কী আছে? আর এখন তো উষ্মা রাজিই। তাহলে তুই কেন হচ্ছিস না? সমস্যা কী তোর? ”

আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালাম। ভূত-ভবিষ্যৎ ভুলে বলে ফেললাম,
” কোনোদিনই হবে না। ”

মা বিস্ফারিত চোখে বললেন,
” কী বলছিস এসব! ”
” হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। ঐ মেয়েকে আমার বউ হিসেবে কল্পনা করলেই আমার শরীর রি রি করে ওঠে। আমার পছন্দের একদম শেষ তালিকাতেও নেই। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি বলে সরাসরি না করতে পারিনি। ”

মা চিৎকার করে বললেন,
” অরুণ! রাগাবি না বলছি। ”

আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম,
” আমার কিছু করার নেই, আম্মু। আমি আর মিথ্যা বয়ে বেড়াতে পারছি না। উষ্মা আমার পছন্দ নয়। আমি তো অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, তোমার ও কে পছন্দ হলো কী করে? আর কেউ না জানুক, তুমি তো আমার পছন্দ জানো? তোমার সিদ্ধান্তে আমি হতাশ! ”

চলবে

#সর্দি_কন্যা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৯)

আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম,
” আমার কিছু করার নেই, আম্মু। আমি আর মিথ্যা বয়ে বেড়াতে পারছি না। উষ্মা আমার পছন্দ নয়। আমি তো অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, তোমার ও কে পছন্দ হলো কী করে? আর কেউ না জানুক, তুমি তো আমার পছন্দ জানো? তোমার সিদ্ধান্তে আমি হতাশ! ”

মা রাগ সামলাতে পারছেন না। মুখমণ্ডল মৃদু কাঁপছে ক্রমাগত। উত্তপ্ত শ্বাস ছাড়ছেন ঘন ঘন। আমি সবটা অগ্রাহ্য করে বললাম,
” আমার যেমন পশ্চিমাদের মতো অর্ধ উলঙ্গ মেয়ে পছন্দ নয় তেমন বাঙালিয়ানাও না। আমার গুছানো, পরিপাটি, উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন মেয়ে পছন্দ। উষ্মার মধ্যে এসব কিছু নেই। গলায় সুর নেই, চালচলনে তাল নেই। তার মধ্যে সারা বছর সর্দি লেগেই থাকে। ”

এইটুকু বলেই আমি থামলাম। গা গুলিয়ে আসছে যেন! লম্বা দম টেনে আবার বললাম,
” সব থেকে বড় কথা উষ্মার মধ্যে আত্মসম্মান বোধ নেই। যখন-তখন পা চেপে ধরে। মাথা নিচু করে নিজের সম্মান বিলিয়ে দেয়। আম্মু, আমার বউ হবে আত্মসম্পন্না। সমাজে মাথা উঁচু করে চলবে। ”

আমার বুকের ভেতর বয়ে বেড়ানো কথাগুলো একদমে শেষ করেই আমি মায়ের দিকে তাকালাম। খেয়াল করলাম তার রাগে থমথমে মুখটা মিইয়ে এসেছে। লজ্জিত চাহনি আমার পেছনে। আমি চট করে পেছনে তাকিয়েই চমকালাম। উষ্মা ছলছল চোখ জোড়া নামিয়ে ফেলল। মৃদু গলায় বলল,
” আমি আসছি, আন্টি। ”

মায়ের নীরবতা ভাঙল না। কেমন যেন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি নিজেই আগ বাড়িয়ে বললাম,
” চলো, আমি এগিয়ে দিচ্ছি। ”

উষ্মা সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“, আমি একা যেতে পারব। ”

আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম উষ্মা আমার সঙ্গ চাচ্ছে না। এড়িয়ে যাওয়ার তুমুল ইচ্ছা। তবুও তার পিছু পিছু নিচে নামলাম। গেইট পার হয়ে পাকা রাস্তায় আসলাম। একটা দোকানের সামনে এসে বললাম,
” একটু দাঁড়াও। ”

উষ্মা থামল না। নিজের মতো হেঁটে চলল। আমি এক প্যাকেট টিস্যু কিনে দৌড়ে তার পাশাপাশি আসলাম। শীতল গলায় বললাম,
” আমি জানি, তুমি কষ্ট পাচ্ছ। কষ্ট পাওয়ারই কথা। কোনো মানুষই নিজের সম্পর্কে দোষ-ত্রুটি শুনতে পারে না, মানতে পারে না। কিন্তু উষ্মা, তোমার খারাপ লাগলেও আমার বলতো হচ্ছে, ওগুলো একটাও মিথ্যা ছিল না। সব সত্য। এই সত্যগুলো ঢাকতেই এতদিন আমাকে মিথ্যা বলতে হয়েছে। আশা করছি আর বলতে হবে না। ”

উষ্মা আমার কথা শুনল নাকি বুঝতে পারলাম না। ভালো-মন্দ কোনো অভিব্যক্তিই প্রকাশ পেল না। চুপচাপ সামনে হেঁটে চলেছে। আমার আর এগোতে ইচ্ছে হলো না। ওর ডানহাতে টিস্যু প্যাকেট দিয়ে বললাম,
” তোমার ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা। আল্লাহ তোমাকে কারও যোগ্য করে তুলুক। কারও চোখে সুন্দর করে তুলুক। কারও ভালোবাসার…..”

আমাকে কথা শেষ করতে দিল না উষ্মা। টিস্যু প্যাকেট চেপে ধরে বড় বড় পা ফেলে চলে গেল। একবারটি পেছন ফিরল না। অথচ আমি চাচ্ছিলাম মেয়েটা একবার পেছন ঘুরুক। আমার যে ‘ সরি ‘ বলা হয়নি!

________

বর্ষার এক বৃষ্টিমুখর বিকালে চায়ের তেষ্টা পেল খুব। তনয়াকে ডেকে তেষ্টার কথা জানিয়ে কাজে মনোঃসংযোগ করছিলাম। ঠিক তখনই মৃদু হাঁচির শব্দ এলো কানে। আমি কেঁপে উঠলাম। টের পেলাম শরীরের শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচল বেড়ে গেছে।

” স্যার, আপনার চা। ”

তনয়ার কণ্ঠস্বরে আমি তটস্থ হলাম। চায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে তার দিকে তাকালাম। মৃদু হেসে ধন্যবাদটুকু দিতে পারলাম না। বিরক্ত স্বরে ঝাড়ি দিয়ে বসলাম,
” অসুস্থ হলে অফিসে আসছ কেন? ”

তনয়া টিস্যু দিয়ে নাক মুছে বিনয়ীর সাথে জানাল,
” তেমন অসুস্থ না, স্যার। কাল যাওয়ার সময় হঠাৎ বৃষ্টির কবলে পড়েছিলাম। হালকা ভিজে যাওয়ায় একটু ঠাণ্ডার সমস্যা হয়েছে। ”

আমি চিৎকার করে বললাম,
” গেট আউট। আমি না চাইলে আমার চোখের সামনে আসবে না। আসলেই চাকটি নট করে দেব। ”

তনয়া ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। কাঁপা চাহনি দিয়ে দ্রুত আমার কেবিন ত্যাগ করে। তারপরের সারাবিকেল কাটে আমার বিরক্ত ও খিটখিটে মেজাজে। কাজে মন বসেনি একটুও। বসের সঙ্গে মিটিংয়ের সময়টা পিছিয়ে নিয়েছিলাম অনুরোধ করে।

____________

রাতে বাসায় ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে একটু অন্যমনস্ক সময় কাটালাম। বৃষ্টির ছাঁটে মুখ ভিজিয়ে শীত শীত ভাব টেনে আনলাম শরীরে। তন্মধ্যে মা খেতে ডাকলে জানালার কাচ টেনে দিলাম। খাবার টেবিলে পৌঁছে জিজ্ঞেস করলাম,
” আজ কী রেঁধেছ, আম্মু? ”

ফোনালাপে ব্যস্ত থাকায় মা উত্তর দিতে পারলেন না। আমার সামনে প্লেট উল্টে ভাত বেড়ে দিলেন। বাবার পাতে তরকারি দিচ্ছিলেন তখন বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
” কার সাথে কথা বলছ? নাজু নাকি? ”

মা হাসি মুখে মাথা নাড়লে আমার সর্ব মনোযোগ গিয়ে পড়ল মায়ের দিকে। কী কথা বলছে তাই শোনার চেষ্টায় খাওয়া বন্ধ হলো। মা কথার ফাঁকে আমাকে বললেন,
” খাচ্ছিস না কেন? ”

আমি খানিক ছিটকে উঠলাম। অ-মাখা ভাব মুখে তুলে বললাম,
” খাচ্ছি তো। ”

এই সুযোগে আবার বললাম,
” নাজু আন্টিকে আমার সালাম দিও। ”

মা শুধু শুনলেন, সালামের কথা জানালেন না। অনেক্ষণ পর মোবাইল রেখে বাবার পাশে বসলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
” অনেক দিন পর কথা বললে নাকি? কেমন আছেন উনি? ”
” ভালো। ”
” আংকেল? উনি এখন কী করছেন? ”
” তেমন কিছু নয়। ”
” ওহ, আর উষ…”

উষ্মার নামটা উচ্চারণ হতে গিয়েও ঠোঁটে আটকে গেল। জড়তায় চেপে ধরল কণ্ঠস্বর। মা বোধ হয় খেয়াল করলেন না। বাবার দিকে মনোযোগী হয়ে পড়লেন। আমি চুপচাপ ভাত খেতে চাইলেও মস্তিষ্ক সচল হয়ে রইল। বার বার উষ্মার কথা মনে হতে লাগল। বাঁধা মনের খুব জানতে ইচ্ছে হলো মেয়েটা এখন কী করছে, কেমন আছে? বিয়ে করেছে কি? বাচ্চা-কাচ্চাও হয়েছে নিশ্চয়? মেয়ে হয়েছে নাকি ছেলে? নাম রেখেছে কী? আমার অজস্র গোপন প্রশ্নের মধ্যে মায়ের গলা পেলাম,
” দুই বছর পর মেয়েটা এ বাসায় আসছে অথচ থাকবে না। এটা কোনো কথা? ”

মায়ের কণ্ঠে চাপা অভিমান। বাবা খুশি করতে বললেন,
” যেতে দিও না তাহলেই তো হবে। ”

মা ক্ষোভ ভরে বললেন,
” পরীক্ষা না থাকলে দিতামই না! ”

আমি কৌতূহলী হয়ে পড়লাম। তাদের কথপোকথনের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম,
” কিসের পরীক্ষা, আম্মু? ”

মা আগ্রহ নিয়ে বললেন,
” বিসিএসের। ”

আমি আশ্চর্য হয়ে উচ্চারণ করলাম,
” বিসিএস! ”

মায়ের আগ্রহ বেড়ে গেল। মুখ এগিয়ে এনে আহ্লাদিত হয়ে বললেন,
” হ্যাঁ। প্রিলিতে টিকে গেছে তো। এখন লিখিত দিবে। সেজন্যই তো ঢাকা আসবে। এতক্ষণে মনে হয় রওনা হয়েছে। ভোরের দিকে তোর বাবা আনতে যাবে। দুই-তিন ঘণ্টা এখানে বিশ্রাম নিয়ে তারপর কেন্দ্রে যাবে। ”

আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম,
” কাল পরীক্ষা তাহলে আজ রাতে বের হয়েছে কেন? এতে তো প্রেশার পড়বে। কয়েক দিন আগে আসলেই তো হতো। ”
” আমিও তাই বলেছিলাম, শুনেনি। ”
” কেন? ”
” তোর জন্য। ”
” আমি আবার কী করলাম? ”

মা চোয়াল শক্ত করে বললেন,
” একবার অপমান করে মন শান্তি হয়নি আবার করতে চাচ্ছিস? ”

আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মায়ের দিকে তাকালে তিনি নীরস গলায় বললেন,
” আত্মসম্মান নেই বলেই বাসায় আসতে রাজি হয়েছে। হোক কয়েক ঘণ্টার জন্য, আসছে তো! ”

আমার চাহনি করুণ হয়ে গেল। অনুতাপে, অনুশোচনায় হৃদয় ঝলসে যেতে শুরু হলো। মনে পড়ল, মেয়েটাকে সরি বলা হয়নি।

__________
রাতে আমার ঘুম হলো না। অস্থির চিত্তে এপাশ-ওপাশ করে অর্ধেক রাত কাটিয়ে দিলাম। বাকি সময়টা আর বিছানায় শুয়ে থাকার ধৈর্য, ইচ্ছে, রুচি কোনোটাই হলো না। ফোন হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সারাদিন বৃষ্টি ঝরিয়ে আকাশ এখন মেঘমুক্ত। চাঁদ উঠেছে, তারাও। তাদের আলোয় রাতের অন্ধকার গাঢ় থেকে ঝাপসায় পরিণত হয়েছে। সে ঝাপসা অন্ধকারে মন উদাস হতেই কলিংবেলের শব্দ শুনলাম। আমি চমকে উচ্চারণ করলাম, ‘ উষ্মা! ‘

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here