#সর্বনাশিনী,০২
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
স্নেহা তরুনের দিকে তাকালো। তরুন মাথা নাড়লো। তার ঠিক দু দিন পর…..স্নেহা একটি বড় বাংলো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নামতেই…..একজন মধ্য বয়সি মহিলা ছুটে এলো। এসেই স্নেহাকে ঝাপটে ধরে কান্নায় মেতে উঠলো। স্নেহা মহিলাটিকে এক পলক দেখলো। সুন্দর গোলগাল মুখ, ঠিক তরুনের মুখের আদল যেন বসানো। বোঝায় যাচ্ছে তার যৌবন কালের রূপবতী ছিলেন। পরনের দামি লাইট কালার শাড়িতে ভি ইপি লুক দিচ্ছে। মহিলাটি স্নেহাকে ঝাপটে ধরে কান্না করতে করতে বলল,
” আমার মেয়ে ফিরে এসেছে, আমার মেয়ে। মা কোথায় রাগ করে চলে গেছিলি বল? আর তোকে কোথাও যেতে দিবো না। বল আর ছেড়ে যাবি না আমাদের!”
মহিলাটি ঢুকরে উঠছে বার বার। স্নেহা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। আড় চোখে একবার তরুনের দিকে তাকাতেই তরুন চোখের ইশারা করলো। স্নেহা বুঝতে পেরে মহিলাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” কোথা-ও যাবো না মা। এখন থেকে তোমার কাছেই থাকবো।”
মহিলার খুশিতে যেন বুক ভরে গেলো। আদুরে চুম্বন বসালো স্নেহার গালে। তরুন তখন বলল,
” মা ওকে ঘরে ঢুকতে দাও আগে, ও এখনো অসুস্থ। ”
মহিলাটি সরে গেলো।তরুন বলেছিলো তার মেয়ের এক্সিডেন্টের কথা। হাত পায়ের বেন্ডেজ দেখে শিউরে উঠলেন তিনি। তবু-ও ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেছে ভেবেই চোখের পানি টুকু মুছে, হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন,
” হ্যাঁ ওকে ওর রুমে নিয়ে যায়। মা তোর জন্য পছন্দের খাবার বানিয়ে নিয়ে আসচ্ছি। কেমন?”
স্নেহা মাথা নাড়লো। তরুন স্নেহাকে তার বোনের রুমে নিয়ে এলো। সারা রুমের ভিতরে পুতুল আর পুতুল। চাঁদ তারার লাইটিং টা টিপ টিপ করছে বিছানার ঠিক উপরে। বড় বড় পর্দা ফর ফর করে উড়ছে। তরুন স্নেহাকে গোলাপি রঙ্গের বিছানাটায় পরম যত্নে বসালো। এর পর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” নিচে যাকে দেখলে? সে আমার মা আয়না শেখ। পাঁচ বছর আগের একটা এক্সিডেন্টে আমার বোন নিখোঁজ হয়। তার লাশটা পর্যন্ত আমরা পায়নি। ”
সপ্তপর্ণে শ্বাস টুকু লুকিয়ে আবার বলল তরুন,
” আমার বোন আকৃতা শেখ যার জন্য আমার মা পাগল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। কিন্তু সেদিন তোমাকে পেয়ে, আমি নিজের স্বার্থটাই দেখেছি। তুমি ঠিকি বলেছিলে, পৃথিবীতে স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে খোঁজে না।”
স্নেহা হাসলো। তরুন এবার সিরিয়াস গলায় বলল,
” আজ থেকে তুমি আকৃতা শেখ। তোমার পরিচয়, শেখ বংশের এক মাত্র আদরের মেয়ে তুমি। এবং তোমার কাছে সব কিছুর পাওয়ার থাকবে যা শেখ বংশের মেয়ের প্রাপ্য।”
স্নেহা মনে মনে হাসলো। ভাগ্য তাহলে একেই বলে? কোথায় বন্ধ ছিলো সেই অন্ধকার ঘরের ভিতরে এক ফোঁটা পানির জন্য গলা কাটা মুরগির মতো ছটপট করেছে। আর আজ এই বাংলো বাড়িতে আরাম আয়েশের জীবন। স্নেহার বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। বিড়বিড় করে তার নতুন জীবনের নামটি উচ্চারণ করলো,
” আকৃতা শেখ..।”
তরুন এবার পকেট থেকে কিছু একটা বের করে স্নেহার সামনে দিলো,
” তোমার ফোন। আমার নাম্বার সেভ করে দিয়েছি। কিছু লাগলে, ফোন করো।”
স্নেহা মাথা নাড়লো। তরুন স্নেহাকে বিছনায় শুয়ে দিলো। কিছুক্ষণ রেস্ট করতে বলে চলে গেলো। স্নেহা ডান হাতে তার ফোনটি স্ক্রোল করলো। এবং আজকের খবর দেখতে লাগলো। যা সে খুঁজছিল পেয়েও গেলো।
দিলশাদ আমরিন আর এক রমণীর এয়ারপোর্টের বাহিরে বেড়িয়ে আসার ছবিটি জ্বল জ্বল করছে। যার নিচে চকচক করছে লাল রঙ্গা একটি হেডলাইন…
” দিলশাদ আমরিনের সাথে দেখা গেলো সুপার স্টার মারিয়াকে, তারা কি ডেট করছেন একে অপরের সাথে? জানতে সাথে থাকুন আমাদের!”
স্নেহার নিচের লিখাটির দিকে চোখ-ও গেলো না। সে শুধু দিলশাদের ছবিটি দেখতে লাগলো। চোখের কোনে জল ছল ছল করে উঠলো স্নেহার। বুকের ভিতর ভারী কিছু অনুভব করলো। একটি বছরে স্নেহার জীবন পাল্টে দিয়েছে সব। এই চেহারার মানুষটিকে কতই না ভালোবাসতো সে। পাগল পাগল ছিলো। সব জেনে শুনেও নিজের জীবন শেষ করে দিলো। কিভাবে পড়লো এই নিকৃষ্ট মানুষের প্রেমে। কিভাবে,? স্নেহা চোখ বুঝে রইলো। কিছু পুরোনো স্মৃতি জ্বল জ্বল করে উঠলো চোখের পাতায়….
১৫ বছর আগে…..
ছোট শহরে একটি অনাথ আশ্রমের মধ্য সব থেকে ওবিডিয়েন্ট ছোট বাচ্চা মেয়েটি ছিল স্নেহা।বয়স চার বছর। সব সময় চুপ চাপ আর সবার কথা মেনে চলা ছিল যেন তার ধর্ম। অনাথ অাশ্রম থেকে বাচ্চা দত্তক নিয়া… আবার নতুন বাচ্চা আসা প্রতিদিনের কারবার। এই ছোট অনাথ আশ্রমের নামটি ছিলো শান্তি নীড়। নামটি শান্তি নীড় হলেও শান্তি ছিলো এক ফোঁটা-ও। সব বাচ্চারাই এই শান্তি নীড় থেকে মুক্ত পেতে চাইতো। পেতে চাইতো একটি ঘর, বাবা-আত্নীয়স্বজন। এখানে বেঁচে থাকতে বাচ্চাদের নিজের জন্য লড়াই করতে হতো, খাবার হোক, খেলনা হোক বা কোনো পরিবার দত্তক নিতে আসুক, চলতে থাকে লড়াই। সেখানে স্নেহা চুপটি করে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। হয়তো ভাবতো একদিন কোনো দয়াবান ব্যক্তি তাকেও নিয়ে যাবে আপন করে। দিনটি খুব শীঘ্রই এলো। বড় শহরের নাম করা তালুকদার পরিবার থেকে দত্তক নেয়া হয় স্নেহাকে। তালুকাদার পরিবাবের বড় মেয়ে সেহের তালুকদারের ছোট বোন স্নেহা তালুকদার নামে পরিচিতি পায় স্নেহা।কিন্তু সুখটা বুঝি লিখা নেই স্নেহার কাঁপালে। তালুকদার বংশে পা রাখতেই সেহেরের অসুস্থ দাদা বিজয় তালুকদার দুনিয়া ছেঁড়ে দিলেন। এই দুঃখ সইতে পারলেন না সেহেরের দাদি শিথি তালুকদার। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে সেদিন বলেছিলেন নিজের ছেলে রায়হান তালুকদারকে,
” এই মেয়ে সর্বনাশিনী। সবাইকে ধংস করবে, সবার জীবনে গ্রহণ লাগাবে। এ আমার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে।”
বলেই মারার জন্য তেরে গিয়েছিলেন। সায়রা বাঁচিয়ে ছিলেন শুধু। কেন যেন সায়রা এই অনাথ মেয়েটিকে খুব আদর করতো। স্নেহার সুন্দর গোল গাল ছোট মুখ আর বড় বড় চোখ জোড়া দেখলেই যে কারোই মায়া লাগতো। আগলে রাখতে চাইত। স্নেহা সব সময় কুন্ডলী পাকাইয়ে যেতো সব সময় শিথি তালুকদারকে দেখলে।কখনো সোফার পিছনে, কখনো বা সায়রার পিছনে চুপটি করে লুকিয়ে যেতো। বাচ্চা মেয়েটি কখনোই বুঝতো কেন তাকে শিথি তালুকদার গালিগালাজ করে। সে তো বুঝতোই না একজন মানুষ মরার পিছনে তার কিভাবে হাত থাকতে পারে? স্নেহা তো একটা নিস্পাপ শিশু।
দিন যেতে থাকে স্নেহার। তার নতুন বাবা-মা রায়হান আর সায়রা তালুকদার তাকে স্নেহার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। সেহের তালুকদার স্নেহাকে পছন্দ করতো না। একদিন সেহের আর স্নেহা তাদের বাসার সামনে খেলছিলো। সেহের তালুকদার স্নেহাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। স্নেহা নিশ্চুপ কাঁদতে থাকে। তাদের বাড়ির একজন কাজের মহিলা সুফিয়া স্নেহাকে খুব আদর করতো। তার মতে এত অল্প বয়সে এই বাচ্চাটি অনেক বাধ্য। সবার কথা শুনে। তার উপর বাচ্চাটি অনেক সুন্দর। টমেটোর মতো লাল গাল। ফর্সা গায়ের রং। সেহেরের থেকে বেশিই সুন্দর কি-না। তাই সেহের বাচ্চা মেয়েটিকে তেমন পছন্দ করে না। সেহেরে থেকে দূরে থাকতো চাইতো স্নেহা। এবং ছোট একটি পুতুল যা তার নতুন বাবা-মা এনে দিয়ে ছিলো তা নিয়েই খেলতো সব সময়। সুফিয়া স্নেহাকে আদর করে বেঞ্চে বসালো। কান্না মুছে দিয়ে বলল,
” স্নেহা কেঁদো না। একদিন দেখবে তোমার কাছে একটা ম্যাজিশিয়ান আসবে, আর তোমার সব দুঃখ এক ফু মেরে ভ্যানিস করে দিবে!”
স্নেহার বড় বড় চোখে উজ্জ্বলতা চলে আসে। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হেসে বলে,
” সত্যি? ”
সুফিয়া মাথা নাড়ায়,
” হুম সত্যি! ”
সুফিয়ার কথা যেন সেদিন সত্যি-ই সত্যি হলো। একটি কালো বিএমডব্লিউ এসে দাঁড়ালো তাদের বাসাার সামনে। একজন যুগল নেমে এলো একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে। সুফিয়া সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে তাদের কাছে গেলো।বলল,
“ওয়েলকাম মিস্টার শিশির এন্ড মিসেস বিন্দু আমরিন, স্যার মেডাম আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন আসুন।”
মিস্টার আমরিন আর অর্ধাঙ্গীনির কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনে নিলেন। তার পর পা ফেলালেন সামনে।
স্নেহা সেখানে বসেই বড় বড় পলক ফেলে দেখতে লাগলো তাদের। ছেলেটিও দেখলো স্নেহাকে। ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে স্নেহার। এত টুকু বাচ্চা ছেলের মুখে বড়দের মতো গম্ভীরতা যা একে বারেই মানাচ্ছে না যেন ছেলেটির বয়সের সাথে। চোখ দুটো গভীর। একদম যেন একরোখা মনোভাব ছেলেটির।ভাবলেশহীন। পরনে জীন্স আর টি শার্টের উপর ব্ল্যাক জেকেট। চোখে গোল চশমা। ছেলেটি স্নেহার দিকে একটি ডেইরি মিল্ক এগিয়ে দিয়ে বলল,
” ছিচকাদুঁনি।”
স্নেহা কিছু বলল না। ডেইড়ি মিল্ক ও নিলো না। স্নেহা চুপ রইলো। ছেলেটি গম্ভীর কন্ঠে ভাব নিয়ে বলল,
” তোমার ডেইড়ি মিল্ক পছন্দ না?”
স্নেহা তার বড় বড় পলক ফালিয়ে মাথা দুলালো বলল,
” আমার পছন্দ।”
” তাহলে নাও!”
স্নেহা আবার চুপ। ছেলেটি রাগ রাগ নিয়ে বলল,
” তোমার এইটা চাই না? তাহলে কিন্তু নিয়ে নিবো, আর দিবো না!”
স্নেহা সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে নিলো। মিষ্টি হেসে বলল,
” আমার চাই!”
ছেলেটি এবার স্নেহার চোখের কোনের পানি মুছে দিতেই। স্নেহার কেমন একটা অনুভূতি হলো। হয়তো এতদিন পরে কোনো আপন মানুষের ছোঁয়া পেলো। ছেলেটি আবার বলল,
” আর কেঁদো না। তাহলে আর চকলেট দিবো না। ”
স্নেহা মাথা এক সাইড কাত করলো, যার অর্থ আর কাঁদবে না। ঠিক তখনি সেহের দৌঁড়ে এসে বলল,
” দিলশাদ, দিলশাদ। এসে এসে আমরা খেলি, চলো।”
বলে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো সেহের দিলশাদকে। সেদিন দিলশাদ স্নেহার ছোট মনের কোনের ঘরে অজান্তেই জায়গা করে যায়। ঠিক তার কিছুদিন পর সেহের শরীর খারাপ হতে থাকে। তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার জানায় সেহেরে দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, তাকে বাঁচাতে হলে একটি কিডনির দরকার। এসব কিছু শুনে সায়রা ভেঙে পরে। কিন্তু রায়হান স্বাভাবিক থাকে। সায়রা কান্নারত কন্ঠে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
” তুমি এসব জানতে?”
রায়হান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ায়। তারপর সেহের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
” হ্যাঁ জানতাম৷ তাই ডোনার হিসেবে স্নেহাকে আমি দত্তক নিয়েছিলাম!”
সেহেরে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। এত টুকু একটা বাচ্চা যার শরীরের ছোট ছোট সব অঙ্গ পতঙ্গ কিভাবে নিবে এই বাচ্চা থেকে তার একটি অংশ কেরে নিতে? রায়হান তালুকদার নিজের স্ত্রীকে বুঝাতে থাকেন,
” আমরা একটা কিডনি নিবো, আরেকটা তো থাকবেই ওর কাছে, আর তাছাড়া ওকে আমরা পালবো, বড় করবো, ও যা চাইবে তাই দিবো।”
কিন্তু সায়রা সায় দেয় না। সে বলে,
” আমরা এমনটা করতে পারি না। ও তো একটা ছোট বাচ্চা। অন্য কোনো রাস্তা নেই?”
রায়হান সায়রাকে নিজের বুকে নিয়ে বলে উঠে,
” সায়রা আমরা ভালো কোনো ডোনার পাবো কিনা তার গ্যারান্টি নেই। বুঝতে চেষ্টা করো, আমি আগেই স্নেহার সব টেষ্ট করিয়েছি৷ ”
সায়রা ফুপিয়ে উঠলো। রায়হান এবার শক্ত কন্ঠে বলল,
” নিজের মেয়ের কথা ভাবো সায়রা, আমাদের একটি মাত্র মেয়ে। ও চলে গেলে আমাদের সব শেষ, তুমি কি চাও? নিজের মেয়ে, নাকি এডপটেড মেয়ে।”
সায়রা বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। সত্যি তো, আগে নিজের সন্তান তাই নয় কি? সায়রা বলল,
” ঠিক আছে অপারেশনের ব্যবস্থা করো!”
বলেই বেড়িয়ে গেলো সে। এদিকে শিথি তালুকদার কখন থেকে একটি লাঠি দিয়ে পিটিয়ে যাচ্ছেন স্নেহাকে। সুফিয়া সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে। সাহস নেই নিজের মালকিনের সামনে কিছু করার বা বলার। বাচ্চা মেয়েটি কি দোষ করেছে, সেহেরের কিডনি নষ্ট হয়েছে স্নেহার কি তাতে কোনো হাত থাকতে পারে? স্নেহা চোখের পানি ফেলছে, চিৎকার করেও কাঁদতে পারছে না। কাঁদলেই দাদু বেশি মারে। স্নেহা ভয়ে চুপ করে আছে। মুখ খুলে আধো আধো কন্ঠে বলছে,
” দাদু আমি কিছু করি নি, আমাকে মেরো না। আমি সেহের দিদিভাইকে ব্যথা দেই নি!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা? ঠিক তখনি উপস্থিত হয় সায়রা। স্নেহাকে এভাবে ভয়ে গুটিশুটি মেরে মার খেতে দেখে চিৎকার করে বলল,
” মা কি করছেন কি, ছোট একটা মেয়ে, মারছেন কেন। ”
শিথি তালুকদার গলা চওড়া করে হায় হায় করে বললেন,
” এই মেয়ে, এই সর্বনাশিনী আমার সংসার টা খেলো। এই মেয়ে আমার স্বামী খেলো, এখন আমার নাতিকে খাচ্ছে, এরে বের কর বউ মা বের কর, সব ধংস করে দিবে সব!”
সায়রা বুকের ভিতর লুকিয়ে নিলো স্নেহাকে।শিথিকে বলল,
” মা ও বাচ্চা মেয়ে, ও কিছু করে নি, সব আল্লাহর ইচ্ছে, ওকে কেন দোষ দিচ্ছেন?”
শিথি তালুকদার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন,
” অন্যের বাচ্চার জন্য এত দরদ ভালো না বউ মা। পর কখনো আপন হয় না। একদিন ঠিকি বুঝবে যখন কালনাগিনী সব খাবে।”
এসব বলে শিথি তালুকদার কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন। সুফিয়া জলদি ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এলো। সায়রা স্নেহার হাতের তলায় মেডিসিন লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
” স্নেহু ব্যথা বেশি করছে?”
স্নেহা মাথা না বোধক দুলালো। একটু পর মাথা নত করে হা বোধক দুলালো। ঠোঁট ফুলিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। সায়রার বুকের ভিতর কেমন করে উঠলো। সাধারণ সুতির জামাতে নাদান নাদুসনুদুস একটি বাচ্চা। একদম খোট পরির মতো। কিভাবে পারবে এই বাচ্চা মেয়েটির থেকে তার একটি অংশ করে নিতে? তবুও নিজেকে শক্ত করলো। স্নেহার গালে হাত রেখে চোখের পানি টুকু মুছে দিয়ে বলল,,
” স্নেহু মাকে ভালোবাসো তুমি?”
স্নেহা মাথা হ্যাঁ বোধক নাড়ালো। সায়রার গলা ধরে এলেও ছোট স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” সেহের দিদিভাইকে বাঁচাবে? ”
স্নেহা আবারো হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। স্নেহার টোম্যাটোর মতো গাল গুলোতে চুমু দিয়ে কোলে তোলে নিলো। তখনি সুফিয়া বলল,
” মেডাম এই বাচ্চা মেয়েটি কি দোষ করেছে? কেন কেড়ে নিচ্ছেন ওর কিডনি, মেডাম এমন করবেন না। বাচ্চা মেয়েটির যদি কিছু হয়।”
সায়রা বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো স্নেহাকে। বলল,
” আমার কাছে আর কোনো পথ নেই সুফিয়া…!”
কিছু ঘন্টা পর…
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে স্নেহা। চারিদিকে ধবধবে বিধবা সাজে সজ্জিত একটি রুম যেন। ফিনাইল আর মেডিসিনের বিশ্রী গন্ধ রুমটির ভিতর বাহির। স্নেহার ক্ষত স্থানে খুব ব্যথা করছে। সিলি করা জায়গাটা জ্বলছে আগুনে পোড়ার মতো। সুন্দর শরীরে ভয়ানক লাগছে সিলির দাগটি। দেখলেই যেন যে কারো গা শিরশির করে উঠবে। খালি কেবিনে সুফিয়া ছাড়া কেউ নেই। ব্যথায় নিরবে চোখের জল ফেলছে স্নেহা। সুফিয়া স্নেহার মাথা হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। আজ যদি এই সুন্দর বাচ্চা মেয়েটির বাবা-মা বেঁচে থাকতো? কত সুন্দর একটা লাইফ লিড করতো। তালুকদার বংশের এডপ্টেট হওয়াই যেন দূর্ভাগ্যের। স্নেহা বিড়বিড় করছে,
” মা মা খুব ব্যথা করছে, মা কই তুমি? একটু চুমু দেও। মা ও মা মা গো!”
সুফিয়ার চোখের পানি চলে আসচ্ছে। স্নেহাকে এখানে একা ফেলে সেহেরের কেবিনে সবাই বসে আছে। সেহের কেবিন থেকে জোরে জোরে কান্নার আওয়াজ আসচ্ছে। সুফিয়া ভাবছে, সেহের কত কান্নাকাটি করছে, আর স্নেহা বাচ্চা মেয়েটি একদম চুপটি করে চোখের জল ফালছে। আচ্ছা বাচ্চা মেয়েটির কি দোস? এটাই! কি তার বাবা মা নেই, সে অনাথ। সুফিয়া স্নেহাকে ঘুম পারানোর জন্য গুন গুন করছে। কিন্তু কষ্টে গলা ধরে আসচ্ছে পারছে না কিছু করতে। বাচ্চা মেয়েটি তার পালক মায়ের সন্তানকে বাঁচিয়ে দিলো, অথচ একটি বার স্নেহাকে দেখতে-ও এলো না? হায়রে দুনিয়া… স্নেহা তার বড় বড় চোখে সুফিয়াকে বলল,
” আন্টি পানি, একটু পানি।”
সুফিয়া মাথা নাড়লো। কিন্তু পানি কেবিনটিতে না পেয়ে বাহিরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর পানি এনে খাইয়ে দিলো । ঠিক তখনি দরজাটা আবার খুলে গেলো। ভিতরে ঢুকলো দিলশাদ। প্রতিবারের মতো গম্ভীরতা গুমরে মুখ বজায় রেখে বলল,
” ছিচকাদুঁনি।”
‘ছিচকাদুঁনি ‘ শব্দটি শুনেই স্নেহা কান্না থামিয়ে দেয়। ঘাড় কাত করে ভাবলেশহীন মুখটি দেখতে পায়। স্নেহা কান্না থামিয়ে ব্যথা ভুলে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। দিলশাদ তার ছোট ছোট হাতে আজ-ও চোখের জল টুকু মুছে দিয়ে বলল,
” তোমাকে যখন দেখি তুমি শুধু কাঁদো। কেন? তোমার চোখে কান্না ভালো লাগে না।”
স্নেহা মাথা কাত কারলো আগের মতোই, যে সে কাঁদবে না। দিলশাদ তখন এগিয়ে এসে একটি স্বর্ণের তাবিজের লকেট পড়িয়ে দেয়। তাবিজের মধ্যে সুন্দর করে দিলশাদের নামটি খোঁদাই করা। চক চক করছে একদম। দিলশাদ স্নেহার গালে হাতে রেখে বলল,
” এইটা আমার তাবিজ, ছোট থাকতে আমার দাদু এক হুজুরের কাছ থেকে এনে আমাকে পড়িয়েছিলো। আমি সব সময় অসুস্থ থাকতাম বলে। তুমি অসুস্থ তাই তোমাকে দিলাম এইটা। খবরদার হারাবে না। হারালে আর চকলেট দিবো না।”
স্নেহা তার বড় বড় পলক ফেলে হ্যাঁ বলল। দিলশাদ স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
” আমি চলে যাচ্ছি । আমার অপেক্ষা করবে। মনে রাখবে, তুমি শুধু আমার বন্ধু কেমন?”
স্নেহা তার স্বভাব সূলভ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে বলল,
” অপেক্ষা করবো।”
এরপরে দিলশাদ অনেক গুলো চকলেট এগিয়ে দিলো। স্নেহার ছোট মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো। কিছু ঘন্টার মাঝে এই প্রথম সুফিয়া হাসতে দেখলো স্নেহাকে। এর পর স্নেহা তার সব থেকে প্রিয় পুতুলটি এগিয়ে দিলো দিলশাদের দিকে,
” আমার কাছে কিছু নেই এই পুতুল ছাড়া। এটি আমার ফেভারেট এইটা তুমি রাখো।”
দিলশাদ খুশি হলো। স্নেহার গোল গাল চেহার টোম্যাটোর মতো গালে টেনে বলল,
” থ্যাঙ্ক ইউ! ”
সময় গুলো খুব তাড়াতাড়ি পাল্টে গেলো। পাল্টে গেলো স্নেহার জীবন।
” আকৃতা?”
আয়না শেখের কন্ঠ পেয়ে স্নেহা চোখ মেলে তাকালো। পুরো অতীতের পাতা আর দিলশাদের সাথে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্তে ধুলি কণা জমা হতে হতে মাটির সাথে যেন মিশে গেলো।
চলবে,