সর্বনাশিনী,০৩,০৪

0
1229

#সর্বনাশিনী,০৩,০৪
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

আমরিন ভিলা…
রাতের ঘন কালো আকাশ সূর্যের ছোঁয়া পেতেই পালিয়ে গেছে। মিষ্টি রোদ গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে প্রবেশ করছে আমরিন ভিলার সব থেকে বড় কামরার মাস্টার বেডটির মাঝে শুয়ে থাকে এক যুগলের উপর। সাদা চাদরে ডাকা দুজন মানবের দেহে। বোঝায় যাচ্ছে দুজন নর-নারীর আদিম কামনা-বাসনায় রাতটি খুব সুন্দর কাটিয়ে এখন ক্লান্ত শ্রান্ত। দিলশাদ আমরিন। দ্যা বিজনেস কিং। রগচটা, একঘেয়ে, গাম্ভীর্যপূণ মুখের আদল। ঘন কালো কুচকুচে চুলের মাঝে আঙ্গুল চালিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা সাদা দেহের নারী মৃদু কম্পন কন্ঠে ডাকলো,

” দিলশাদ?”

সুন্দরী রমনীর বুকের মাঝে শুয়ে থাকা দিলশাদ মৃদু মৃদু পলকে কুচকে পিটপিট করে চোখ খুললো দিলশাদ। ঘন কালো কুচকুচে চোখের মনিতে ডীপ ব্লুর স্পর্শ। সুন্দর চোখ জোড়ায় শক্ত, তীক্ষ্ণ চাহনি মেলে দিলো সুন্দর রমণীর দিকে। শক্ত পক্ত হাতে এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিলো তাকে। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,

” তুমি এখনো এখানে কি করছো? গেট আউট? ”

বলতে বলতে বিছানা থেকে নেমে পড়লো দিলশাদ। নাইট গাউনটি তার অত্যশ্চার্য দেহেটি লুকিয়ে পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিকে। ওয়াশরুমের ঠিক সামনে এসেই থেমে গেলো দিলশাদ পিছনে না ফিরেই ডান হাতের দু’টি আঙ্গুল তুলে ঠান্ডা ভার গলায় বলল,

” তোমার কাছে দু’ মিনিট সময় আছে, ইউ যাস্ট গেট আউট মাই হাউজ!”

বলেই ঢুকে গেলো ওয়াশরুমের ভিতরে। বাহিরে রয়ে গেলো সুন্দরী রমণীর ক্রোদনরত মুখ আর ভাঙ্গা হৃদয়। মারিয়া উঠে দাঁড়ালো। দিলশাদের কামরায় হক বসাবার বৃথা চেষ্টাই না করছে সে। কিন্তু দিলশাদ যেন পাথর। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেরনদেহখান একবার দেখে নিলো। এই চেহারার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ তার ফ্যান। চলচ্চিত্র জগৎ এর কত দাম, কত মূল্য। মূল্য নেই শুধু দিলশাদের কাছে। শুধু শারীরিক চাহিদাটুকুর জন্যই কি সে? তা-ও আবার দিলশাদ এতেও যেন অতৃপ্ত কি চাই তার? কি চাই? এসব আকাশ কুসুম ভেবেই মারিয়া চোখের জল টুকু মুছে নিলো। দিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড় তুলে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে চোখের কোনের জল টুকু মুছে বিদায় হলো মারিয়া।

ঘন্টাখানেক পানির নিচে দাঁড়িয়ে থেকে-ও দিলশাদের শরীরের গরম যেন কমচ্ছে না। না ঠান্ডা হচ্ছে বুকের ভিতরটা। চোখ দুটি জলছে দিলশাদের। বুকের ভিতরে মাঝে মাঝে খাঁ খাঁ করে চৌচির মাঠ। কেমন যেন খালি খালি। যেন ভিতরটা তছনছ হয়ে গেছে, বাহিরটা শুধুই আবরণ। দিলশাদ এক হাত ওয়াশরুমের দেয়ালে রাখলো। চোখ দুটি বুঝতেই ভেসে উঠলো একটি মুখ। বিড়বিড় করে বলল,

” তুমি কি সত্যি-ই মরে গেছো?”

শেখ বাড়ি….

আঁধারের সাথে আলোর গভীর সম্পর্ক। আঁধারের মাঝে হারিয়ে যায় ছায়ার অস্তিত্ব কিন্তু এক চিলতে আলোর মাঝেই ছায়ার দেখা মিলে। কখনো দুঃখ বা কখনো কষ্ট ছায়া ঠিকি তার বন্ধুত্বের দায়িত্ব পালন করে। আঁধার যদি কখনো গভীর ঘন কালো রাতের মতো লম্বা হতে থাকে তখন আরো কোনো মানুষ আপনার পাশে থাকুক আর না থাকুক। আপনার অস্তিত্ব আপনার ছায়া আপনার পাশেই উপস্থিত থাকবে। যেভাবে স্নেহার জীবনে হয়েছে। ছোট থেকেই বন্ধু বলে সাথে পেয়েছে নিজের ছায়া, নিজের অস্তিত্ব। আজ-ও একটি রাত কেঁটে গেছে বাহিরের আলো আধারের খেলা দেখতে দেখতে স্নেহার। পুরোনো স্মৃতি আজো তারা করে বেড়ায় তাকে। স্নেহা চোখ বুঝলো। মিষ্টি রোদের সাথে
তাল মিলিয়ে শীতল বাতস স্পর্শ করে গেলো স্নেহার ঘন কালো চুল। স্নেহার চোখ ভিজে উঠলো পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠলো। আজকের মতো সে-দিনও ছিলো আয়োজন আমেদ ফূর্তি। আজ থেকে ঠিক দু বছর আগের ঘটনা। দিলশাদ আমরিনের বিজনেস সাফ্যলের তৃতীয় বছর পদার্পণে সেদিন-ও বড় সড় পার্টি দিয়েছিলো। সেদিন এনাউন্সমেন্ট হয়েছিলো খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে যাচ্ছে সেহের তালুকদারকে। সেহের তালুকদার, যার ভাগ্যে ছিল দিলশাদ। নাকি অনাথ নামহীন কিংবা নাজায়েজ মেয়ে স্নেহা। দিলশাদ দেশে ফিরেই সেহেরকে আপন করে নেয়। এবং দুজনের ভালোবাসার গুঞ্জন প্রতিটি খবরের কাগজে কাগজে থাকতো তখন। কিন্তু ঠিক তাদের বিয়ের দিন ঘটলো অঘটন। সেহেরকে সব থেকে বড় নামি দামি পার্লারে সাজাতে নিয়ে যাওয়া হয়। সাথে যায় স্নেহা। বধূ সাজে সেহেরকে খুব সুন্দর লাগছিলো। সেখানে না সেজেই সেহেরকে আরো সুন্দর লাগছিলো। সেহের প্রতিবার স্নেহার এই রূপে হিংসা করতো। এমন-ও অনেক দিন গিয়েছিলো স্নেহার এই রূপকে ধংস করতে গরম তেল বা গরম পানির ব্যবহার করতেও পিছপা হয়নি সেহের। কিন্তু ভাগ্য বসতো বেচে ফিরেছে সে। স্নেহা সেহেরের পাশে এসে দাঁড়ালো,

” দিদিভাই, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”

সেহের নাক ছিটকালো। সেহেরের মাথায় তখন চিন্তার ভাব। সে বলল,

” স্নেহা আমার ফুল কম পড়ছে সামনেই একটি ফুলের দোকান আছে, যা ফুল নিয়ে আয়!”

স্নেহা প্রতিউত্তরে মাথা নাড়ালো। স্নেহা ছোট থেকেই ভুতি টাইপের মেয়ে ছিলো। অনাথ আশ্রমের নরকে ফিরে যাওয়ার ভয়ে সে সব সময় ওবিডিয়েন্ট ছিলো। সেহের সব সময় ওকে এই বলে ভয় দেখাতো। আর ছোট স্নেহা ভয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে যেত। স্নেহা বের হতেই সেহের রেডি হয়ে গাড়িতে করে চলে যায়। স্নেহাকে একা ফেলে যায়। স্নেহা বুঝতে পেরে গাড়ির পিছনে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু গাড়িটি কিছু দূরে গিয়েই বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে ধাক্কা লেগে যায়। এবং সেহের সেখানেই মারা যায়। আর এই দুঃখ সইতে পারে না দিলশাদ। সে পাথর হয়ে যায়। এই ঘটনার জন্য বরাবরই দায়ী করা হতো স্নেহাকে। তালুকদার বাড়ির মুরুব্বি শিথি শেখ স্নেহাকে সেদিন মেরে আধ মরা করে ফেলেন। সকলেই দোষারোপ করেন স্নেহা ইচ্ছে করেই এই কাজ করেছে। সম্পত্তির লোভে, দিলশাদকে পাওয়ার লোভে। কিন্তু স্নেহা চিৎকার করে বলে,

” আমি কিছু করিনি!”

কেউ বিশ্বাস করেনি সেদিন। কেউ না। উল্টো সর্বনাশিনীর খ্যাতাব দেয়া হয় তাকে। এবং সেহেরের বাবা রাগে এক মধ্যে বয়সী লোকের সাথে ১৯ বছরের স্নেহার বিয়ে ঠিক করে। স্নেহা সেদিন কেঁদে কুটেও রক্ষে পায়নি। সেহেরের বাবা-মার পায়ের কাছে পড়ে কেঁদেছে সে,

” বাবা-মা রহম করো, আমি বিয়ে করবো না। আমি দূরে কোথাও চলে যাবো। আমার জীবন এভাবে নষ্ট করো না!”

সেদিনের আত্মা চিৎকার না সায়রার কানে গেছে না রায়হানের। স্নেহাকে বিয়ের পিড়িতে বসতেই হয়েছিলো। সাধারণ একটি বেনারসি শাড়ির উপর একটি গোল্ডেন কালারের ওড়না মাথায় টায়ড়া, নাকে নথ, গলায় গাড় আর কানের দুল। হাত ভর্তি কাচের চুরিতে ছোট বালিকাবধূ মনে হচ্ছিলো স্নেহাকে। স্নেহা ভেঙ্গে পড়েছিলো ভিতরে ভিতরে। দিলশাদকে মনে মনে সে অনেক ভালোবাসতো। ভেবে ছিলো আর কাউকে কখনো এই মন প্রান দিবে না। সে তো অপেক্ষা করছিলো দিলশাদের। স্নেহা কথা রেখেছিলো, হ্যাঁ দিলশাদের কথা রেখে ছিলো। অপেক্ষা করেছিলো। স্বপ্ন দেখেছিলো দিলশাদের বউ হবার। কিন্তু দিলশাদ তো তাকে ভুলে গেছে। সে সেহেরকে বেছে নিয়েছিলো। সেহেরকে ভালোবেসে ছিল। বাসবেই না কেন? নামহীন এক মেয়েকে কেউ আপন করতে চায় না। সব্ই ব্যবহার করতে চায়। যেমনটি প্রতিবার তাকে করেছে এই তালুকদার পরিবার। ভেবেই স্নেহা আরো জোরে জোরে কান্না করতে লাগলো। এদিকে যখন কবুল বলার সময় হলো, স্নেহা মুখে কুলূপ এঁটে নিলো। তা দেখে সায়রা স্নেহা ইচ্ছে মতো চড় থাপ্পড় মেরে বলল,

” আর কত পরের ঘাড়ে বসে খাবি, স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক, আর কত সর্বনাস করবি আমার? আর কত??”

স্নেহের কান্নার কারণে শ্বাস আটকে গেছিলো। তবুও সে বলে নি। কিন্তু এতেও রক্ষে নেই যেন। শিথি তালুকদার জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে এসে স্নেহার পায়ে ছুঁয়ে দিতেই স্নেহা চিৎকার করে উঠলো। এর পর আর ছোট স্নেহা সইতে না পেরে হেঁচকি তুলে যেই কবুল বলতে নিলো তখনি একজল লম্বা এক দীর্ঘকায় দেহের ব্যক্তি এসে দাঁড়ালো স্নেহার সামনে। স্নেহার কান্নার জন্য চোখ দুটি ফুলে গেছিলো। টমেটোর মতো গাল দুটি লাল টুকটুকে হয়ে গেছিলো। হাটু ঘেরে যুবকটি বসলো স্নেহার কাছে। স্নেহে খুব কষ্টে উচ্চারণ করলো,

” দি..ল.. শা..দ!”

কিছু একটা পড়ার শব্দে স্নেহার ধ্যান ভাঙ্গলো।সময়ের গতির সাথে স্নেহা এখন সুস্থ । আজ শেখ বাড়িতে চলছে আয়োজন। ছোট মেয়ে ফিরে আসার খুশিতে ধুমধাম করে চলছে সব। স্নেহা সপ্তপর্ণে শ্বাস ছাড়লো, অন্যের অস্তিত্বকে নিজের মাঝে বাঁচিয়ে রাখা অনেক বড় দায়িত্ব। যা পদে পদে আমল করবে স্নেহা। এই পরিবারের মানুষ গুলোর কাছে ঋণি যে স্নেহা। স্নেহার ভাবনার মাঝে দরজায় টোকা পড়লো। স্নেহা তার মৃদু কর্কস কন্ঠে বলল,

” কামিং!”

একজন কাজের লোক কয়েকটি বেগ নিয়ে হাজির হলো,

” মেডাম বড় স্যার এইগুলো পাঠিয়েছেন আজকে পার্টিতে পরার জন্য।”

” ঠিক আছে!”

কাজেরর লোকটি চলে গেলো। স্নেহা কাপড় গুলো বের করে ছুঁয়ে দেখলো। তালুকদার বাড়িতে থাকার সময় স্নেহাকে নব সময় সেহের পুরোনো কাপড় পড়তে দেয়া হতো। সেগুলোই সুন্দর করে ধুয়ে আয়রন করে পড়তো স্নেহা। একটি নতুন জামার জন্য অপেক্ষা করতে হতে দুটি ঈদের। অধির আগ্রহে দিন পার করতো স্নেহা। ক্যালেন্ডার দাগ কেঁটে রাখতো একটি ঈদ গেলে। স্নেহার চোখ আবার জ্বলে উঠলো। বড় বড় চোখ জোড়া টলমল করছে পানিতে। কিন্তু স্নেহা নিজেকে সামলে নিলো। ঘন ঘন ঢুক গিলে তৈরি হয়ে বের হতেই বাহিরে তরুনকে সোফায় বসে সিগারেট টানতে দেখলো। স্নেহা মুচকি হেসে বলল,

” ভাই, আপনি কখন এলেন?”

তারুন তার দাম্ভিক মুখখানায় বিষন্ন হাসলো,

” মাত্রই। আমার বোনটিকে সুন্দর লাগছে।”

স্নেহা প্রতিউত্তর হাসলো।তরুনের কাছে গিয়ে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলো। অভিমানী কন্ঠে বলল,

” ভাই আপনাকে না করেছি এসব খেতে!”

তরুন বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” অনেক দিনের অভ্যস তো। চেষ্টা তো করছি!”

স্নেহা তরুনের হাত ধরে বলল,

” আপনি এমন কেনো ভাই?”

তরুন ফিকে হেসে বলল,

” আমি এমনি।”

” কারণটা তো বোন হিসেবে জানতেই পারি!”

” হুম পার, আমারো একটি গল্প আছে। আমি একজনকে হারিয়ে ফেলেছি, নিজের অবহেলার জন্য। এখন আর তাকে খুঁজে পায় না আর হয়তো পাবো-ও না।”

স্নেহা আশ্বস্ত করে বলল,

” ট্রু লাভ কখনো হারায় না ভাই, দেখবে সে চল আসবে!”

তরুন বলল,

” আই হোপ সো! কিন্তু তোমার ভালোবাসার মানুষ কিন্তু আজ আসবে। দ্যা গেম স্টার্ট নাউ!”

স্নেহা মাথা নাড়লো। সময় এসে গেছে শত্রু পক্ষের মুখোমুখি হওয়ার।

চলবে,

#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৪।
বর্ষাকালের তান্ডব চলছিলো সেদিন। ছিল ঘন কালো আকাশের বুক ভাঙা চিৎকার। ঝুমঝুম বৃষ্টির তীক্ষ্ণ শব্দ কর্কস একরোখা। স্নেহার বুক ভাঙার ফটল আকাশের বুকের বিদুৎ চমকানোর মতো। স্নেহা দিলশাদকে দেখে অসহায় ভাবে তাকালো। স্নেহার গোলাপি মুখের বড় বড় টানা চোখের কোনের জল মুছে দিল দিলশাদ। গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে এক ঠান্ডা স্পর্শ যে কারো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। দিলশাদ হাঁক ছেড়ে বলল,

” আন্টি, আই ম্যারি হার।”

সায়রা আর রায়হান থমকে গেলো। তারা কি ঠিক শুনছে তো? সত্যি কি? সত্যি কি দিলশাদ তার মেয়েকে ভুলে গেলো? ৬ মাস তো হয়নি সেহের মারা গেছে৷ তাহলে? সায়রা মুখ খুললো,

” দিলশাদ তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুমি কি ভুলে গেছো সব? ভুলে গেছো তোমার সেহেরকে?”

দিলশাদ আমরিন এড়িয়ে গেলো সায়রার কথা। ডাক দিলে কাউকে। ভিতরে ঢুকলো একজন উকিল হাতে কিছু পেপার। সবাইকে উপেক্ষা করে দিলশাদ স্নেহার গালে হাত রেখে বলল,

” ভালোবাসো আমায়?”

অবুঝ স্নেহা। মাথা নাড়ালো। উপর ওয়ালা হয়তো তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছে! তাইতে.. যেই দিলশাদকে পাবে না যেনেও ভালোবেসে গেছে? সে সামনে থেকে তাকে বিয়ে করবে বলছে? স্নেহার চোখে মুখে খুশি ঝিলমিল । ফেকাসে মুখে চাঁদের মতো ঝলমলে আলো ফোঁটে উঠলো। দিলশাদ বাঁকা হাসলো। উকিলের কাছ থেকে নেয়া পেপারস্ গুলো এগিয়ে দিলো সঙ্গে সঙ্গে স্নেহার দিকে। স্নেহার টমেটোর মতো গাল টেনে বলল দিলশাদ,

” সাইন ইট!”

স্নেহার শরীর কেঁপে উঠলো। আচমকা যেন আকাশের কালো কুচকুচে ভাব কেঁটে গেলো। আলোকিত হলো চারিদিক। সূর্যের এক ঝিলিকে হেসে উঠলো পুরো পৃথিবী। স্নেহার মনের কোনো এক বিন্দু আশা জম্মালো। হবে এবার হয়তো তার বিষন্ন শহরে কোমলতার ছোয়া… স্নেহা কাঁপা কাঁপা হাতে সাইন করে দিলো। সেদিন তো স্নেহা জানতোই না। এই এক টুকরো কাগজ খুব শীঘ্রই সুখের মহল নয়…বরং ঘন কালো এক জঘন্য নরকের সাক্ষাৎ করাবে।

বিয়ে হয়ে গেলো, তালুকদার বাড়ি ছেড়ে জায়গায় হলো আমরিন বাড়ি। সময় গেলো, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। দিলশাদ আমরিনের আলিশান বাংলোয় ঠিকানা হলো। কিন্তু? কিন্তু সব ভাবনা পাল্টে গেলো। সব মেয়েদের বিয়ের রাত নিয়ে থাকে কতই না কল্পনা, কতই না অনুভূতি থাকে? হায়… কিন্তু স্নেহার কপালে… শুধুই বুঝি কষ্ট?

ঘড়ির কাঁটা ঢং ঢং করে এগিয়ে যেতে লাগলো। রাত গভীর থেকে গভীরতম হলো। স্নেহার দিলশাদের নরম মাস্টার বেডটিতে গুটিশুটি মেরে বসে রইলো। পক্ষা করতে থাকলো তার অর্ধাঙ্গের। যার স্বপ্ন সে দিন রাত বপন করেছিলো নিজের মনে, তার স্বপ্নের পুরুষ দিলশাদ…. ধাম করে দরজাটি খুলে গেলো দিলশাদের ঘরের। স্তম্ভিত আসবাবপত্র-ও যেনো কেঁপে উঠলো। মুহূর্তে-ই ঘরের পরিবেশ গুমোট বাতাবরণটা বৃদ্ধি পেলো। কেঁপে উঠলো স্নেহা। দাঁড়িয়ে গেলো স্নেহার গায়ের লোম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দিলশাদের তীক্ষ্ণ শক্ত চাহনি ভীত করে তুললো স্নেহার মন। স্নেহা আরো গুটিয়ে গেলো। দিলশাদের ঘন কালো কুচকুচে চোখ জোড়া রক্তিম চাহনির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না স্নেহা। দিলশাদ ধীরে পায়ে স্নেহার সানে এসে দাঁড়ালো। স্নেহার থেকে দিলশাদ অনেক লম্বা। স্নেহা তার আকারেই লুকিয়ে গেলো যেন। দিলশাদ স্নেহার টমেটোর মতো গালে হাত রাখলো। স্নেহা তার বিছানার চাদরে শক্ত করে চেপে ধরলো। দিলশাদ আমরিন ঠান্ডা বরফ গলায় বলল,

” ডু ইউ লাভ মি?”

স্নেহা এই কথাটি দ্বিতীয় বারের মতো শুনতে পেয়ে আজিব লাগলো। কিছু না ভেবে মাথা নাড়লো। দিলশাদ স্নেহার দিকে ঝুকে এলো। স্নেহা স্পষ্ট শুন্তে পাচ্ছে দিলশাদের হার্টবিট। ঢিপঢিপ হৃদছন্দ হচ্ছে। দিলশাদ স্নেহার কানের কাছে মুখ নিলো। স্নেহা শিউরে উঠলো। দিলশাদ ফিসফিস করে বলল,

” কি করতে পারবে আমার জন্য?”

স্নেহার যেন কি হলো! আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,

” আপনার জন্য আমি সব করতে পারবো দিলশাদ!”

দিলশাদ আমরিন এই বাক্য টুকু শুনেই রাঙ্গানিত হলো। এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে দিলো স্নেহাকে। স্নেহার উপর উঠে স্নেহার গলায় নির্দয় ভাবে চাপ দিলো। হিংস্র পশুর মতো হুংকার ছেড়ে বলল,

” তাই বুঝি তুই আমার সেহেরকে মেরেছিস? বুক কাঁপলো না? তুই সেহেরকে নয় দিলশাদকে মেরেছিস।”
কেন করেছিস এসব? আমার জন্য তো? এবার বুঝবি, আমার আপনজনের কাছে আমি যতটা ভালো তার থেকে হিংস্র আমি আমার শত্রুদের জন্য।”

বলেই গলার মধ্যে থেকে হাত সরিয়ে নিলো স্নেহার। এদিকে স্নের গলায় চাপ এতোই জোরে দিয়ে ছিলো দিলশাদ, যে স্নেহা মনে হয় প্রায় মরেই গেছে। গলার মাঝে দিলশাদের লম্বা আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে একেবারে। দিলশাদ স্নেহাকে ছাড়তেই স্নেহা দূরে সরে গেলো। শ্বাসকষ্টের মতো শ্বাস নিতে লাগলো। ভয়ে আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছিলো মুখ, ঠোঁট। স্নেহা আরো সরে যেতে চাইলো। বহু কষ্টে বিড়বিড় করে বলল,

” আমি… আমি কিছু করিনি দিদি ভাইকে। বিশ্বাস করুন। সবাই ভুল…!”

কথাটি শেষ করতে পারলো না স্নেহা। গোলাপি গালে ঠাস করে এক চড় বসালো দিলশাদ। আবারো বিছানায় ফেলে গালচেপে ধরলো। হিসহিসিয়ে বলল,

” ডোন্ট লায়। আদারওয়াইজ আই কিল ইউ। খুব শখ ছিলো না তোর বিয়ে করার আমাকে? আজ শখ মিটাবে, তুই জানিস না তুই এক হিংস্র পশুকে জাগিয়েছিস। হিংস্র পশু!”

বলেই স্নেহার পড়নের শাড়ি টেনে খুলে নিলো, ছিড়ে ফিললো সব। স্নেহার চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। দিলশাদ আমরিন তার পুরুষত্বের জোর খাটালো। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেলো স্নেহা। ঠোঁটের কোন গড়িয়ে রক্ত পড়তে থাকলো। শরীরের প্রতিটি অংশে দাগ ছেড়ে গেলো দিলশাদের স্পর্শের। রাতের গভীরে এক অভাগিনী নারীর চিৎকারের সাক্ষী হলো আকাশের চাঁদ তারা, প্রকৃতি। সাক্ষী হলো বিছানার মাঝে থেকে যাওয়া রক্তের ছোপ ছোপ ছাপ।

পুরোনো অতীত আরো একবার ভেবে কেঁপে উঠলো স্নেহা। দিলশাদের সাথে কাটানো রাত গুলো প্রতিবারর যেন নরক ভ্রমণ করিয়ে আনার মতো ছিলো স্নেহার কাছে। স্নেহা আয়নায় নিজেকে দেখলো। বুকের মাঝে দিলশাদের কামোড়ের দাগ এখনো রয়েছে। কালসিটে পড়ে গেছে। স্নেহা তার ড্রেসের আড়ালে লুকিয়ে নিলো। আয়নায় নিজেকে নতুন রূপ, নতুন চেহারায় দেখে হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি।

জমকালো সন্ধ্যায় টিমটিম আলো আর লো ভলিউমের মিষ্টি ধুন আরো রোমাঞ্চকর করে তুলছে পরিবেশ। আশেপাশে বড় বড় বিজনেস ম্যান বড় বড় সেলিব্রেটি উপস্থিত হচ্ছে। টিভি রিপোটারদের-ও হুড়োহুড়ি শেষ নেই।

বড় বড় দামী গাড়ি একটু পর পর এসে থামছে, আর রিপোটারটা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ব্ল্যাক কালার ল্যাম্বরগিনি এসে থামলো শেখ বাড়ির সামনে। এই গাড়ির নাম্বারটি সবার চেনা। রিপোর্টারা শকুনের মতো ঘিরে ধরেছে গাড়িটিকে। পিছন থেকে কালো পোষাকধারী কিছু লোক গাড়িটিকে কাভার করলো। গাড়িটি থেকে নেমে এলো ব্ল্যাক টাক্সিডোতে অত্যাশ্চর্য সুদর্শন যুবক। যার মাসকুলার বডি ব্ল্যাক টাক্সিডোতেও দৃশ্যমান। দিলশাদ একজন সেলিব্র্যাটি থেকে কম ছিলো না। যেখানেই যত সব সময় স্পট লাইট তার উপর থাকতোই। ঠিক তার পাশেই এসে দাঁড়ালো এক রমণী। যার সুন্দরর্য মেকাপের জন্য আরো ফুটে উঠছে। আলোকিত হয়েছে বেশির ভাগ যেন দিলশাদ আমরিনের আলোয়। হোয়াইট গাউনের খোলা পিঠের জামাটি স্লিম বডিতে চিপকে আছে যেন। দূর থেকে যারাই দেখছে সকলেই চিৎকার করে বলছে,

” দিলশাদ ইজ হিয়ার। ”

ভীড়ের এই কোলোহল শেখ বাড়ির দ্বিতীয় তলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছে তরুন আর স্নেহা।তরুনের হাতে একটি ওয়াইনের গ্লাস। গ্লাসটিতে চুমুক দিয়ে তরুন বলল,

” আকৃতা, তোমার লড়াই কিন্তু যেন তেন মানুষের সাথে নয়। আর ইউ রেডি ফর দিস?”

দিলশাদকে দেখেই স্নেহার মনের কোনে জমে থাকা পুরোনো ভালোবাসার আবেগে আপ্লূত হতে শুরু করেছিলো। কিন্তু ঠিক তখনি কিছু কালো অতীত যা অস্তিত্ব কেঁড়ে নিয়েছে তার, ভেবেই শক্ত হয়ে উঠে সে। শক্ত পক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

” আ’ম রেডি ফর দিস!”
বলেই হাতে মুঠোই শক্ত করে নিলো। এবং তরুনের হাতে হাত রেখে এগিয়ে গেলো সামনে। হলের প্রতিটি মানুষ তরুনের সাথে থাকা সুন্দরীর ব্যপারে জানতে কৌতুহল। সাদা শরীরে আসমানী রঙ্গের গাউন তার সাথে মেচিং জুয়ালারি। দূর থেকে কেউ বলছে যেন কোনো অপসরী। আবার কেউ কেউ বলছে কোনো রাজ্যের রাণী। কিন্তু স্নেহার মুখের আদল আর তরুনের মুখের আদলের সাথে মিল দেখেই অনেকেই বলে যাচ্ছে, ভাই-বোন খুব সুন্দর৷ কেউ বলছে মেয়েটি তার মার রূপ পেয়েছে। সকলের কথা এড়িয়ে দিলশাদের সামনে এসে দাঁড়ালো তারা। তরুন হেসে হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

” ওয়েলকাম দিলশাদ। আ’ম সো গ্লেড ইউ কামিং।”

দিলশাদ তার গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখ খানায় হাসির রেখা টেনে বলল,

” আপনি বলছেন আর আমি না আসি তা হয়!”

প্রতি উত্তরে হাসলো তরুন তারপর স্নেহাকে কাছে টেনে বলল,

” মিট মাই লিটিল সিস্টার আকৃতা শেখ।”

দিলশাদ এক পলক চাইলো স্নেহার দিকে। হালকা আসমানী রঙ্গা গাউনের মাঝে যেন ছোট একটি পরি দাঁড়িয়ে আছে। মাথা ভর্তি চুল বেঁধে আছে যেন ফুলের মেলা। পাতলা শরীর আর দূসর চোখ জোড়ায় মায়বী এক পরি। স্নেহা দিলশাদকে তার দিকে তাকাতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে নিচে তাকালো। স্নেহা জানে দিলদাশ চোখের ভাষা পড়তে জানে। ভয়ে ভয়ে সবাইকে সমর্থন করলো। দিলশাদ শুধু তাকিয়ে রইলো স্নেহার দিকে। স্নেহার দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করলো তরুনকে,

” আপনার বোন আছে, আগে কখনো শুনিতো।”

তরুন হেসে বলল,

” ও দেশের বাহিরেই ছিলো ছোট থেকেই তাই ওর সম্পর্কে তেমন কেউ জানে না। ও এই বছর ফিরে এসেছে তাই ভাবলাম সবার সাথে পরিচিত হোক।”

” ওহো আচ্ছা!”

বলেই আবারো পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো স্নেহার। দিলশাদের নাকে এক পরিচিত সুবাস দোল খেতে শুরু করেছে আকৃতা শেখের আগমনের পরপর। আর স্নেহার চোখ জোড়া… এত ফ্যামিলিয়ার কেন? ভাবছে দিলশাদ।না চেয়েও পরিচিত কারো সাথে মিলিয়ে ফেলতে চাইছে দিলশাদ কিন্তু নাহ্ মিলছে না। তবুও যেন অনেক মিল মনে হচ্ছে। দিলশাদ আর তরুনের কথার মাঝে এসে দাঁড়ালো সেহের। সেহেরকে দেখেই তরুনকে শক্ত করে ধরে ফেললো স্নেহা। কিন্তু নিজের মুখের মাঝে ভাব আবেগ আনতে দিলো না। তবে মনের কোনে জমে থাকা রাগ হি হি করে বের উঠতে লাগলো।তরুন বুঝতে পেরেই হেসে বলল,

” আপনি সেহের তালুকদার না? স্ট্রেঞ্জ? একবছর আগে আপনি নাকি মারা গেলেন, হুট করেই আবার জীবিত হয়ে ফিরে এলেন? একদম সিনেমার কাহিনির মতো। তাই না…. তা ইচ্ছে করে গুম হয়ে ছিলেন?”

সেহেরের সাজ সজ্জার মুখের মাঝে কেউ যেন ওয়াইন ঢেলে দিয়েছে, মুখের ভাব তেমন করেই বলল,

” আসলে, আমি কোমায় চলে গেছিলাম। ”

তারপর মুখের মাঝে হাসির রেখা ফুটিয়ে দিলশাদের হাত শক্ত করে চেপে ধরে মুখের মাঝে জোরপূর্বক হাসি নিয়ে বলল,

” তাছাড়া আমাকে তো আসতেই হতো, আমার ভালোবাসার জন্য!”

সেহের কথা শেষ হতেই সেহের দিলশাদের দিকে তাকালো। দিলশাদ সেহের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেহেরের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” এক্সকিউজ মি। ”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here