#সর্বনাশিনী,১১,১২
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
পর্ব-১১
ঘড়ির কাটা ঢং ঢং করে বেজে, মনে করিয়ে দিচ্ছে, এখন লাঞ্চের সময় প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে। দিলশাদ নিজের ডান হাতটা হাওয়া তুলে দেখলো। ব্যন্ডেজ করা। তারপর আবার খাবারের দিকে তাকালো। কিভাবে খাবে সে? এদিকে বড্ড ক্ষুধা -ও পেয়েছে। দিলশাদ উঠে এলো। খাবার টেবিলের পাশে যেতেই বড্ড মেজাজ গরম হলো। আজকের দিনটাতেই সব কটা মাছ আইটেম করতে হলো? হাহ্! দিলশাদ একবার ভাবলো খাবার টা চেঞ্জ করাবে, কিন্তু পেটের ভিতর চুচু ডাক আর ইঁদুরের লাফালাফি সইতে পাড়লো না। দিলশাদ অবাক হলো। মনে মনে ভাবলো,
” এমন তো কখন- ও হয়নি। এত ক্ষুধা কখনোই লাগেনি। আজ এমন কি হলো?”
পরে দিলশাদের মনে পড়লো। কাল দুপুরের পর থেকে এক ফোঁটা পানি ওর পেটে যায় নি। দিলশাদ হতাশার শ্বাস ছাড়লো। কাজের মাঝে এতই ডুবে গেছিলো সে, খাবারের কথা ভুলেই গেছিলো। দিলশাদ আর দেরি করলো না। একটি চামচ দিয়ে খাবার শুরু করলো। কিন্তু বাম হাতে ঠিক মতো খেতেই পারছিলো না। ঠিক সেই সময় দরজায় টোকা পড়লো। দিলশাদ তার শান্ত গভীর কন্ঠে বলল,
” কামিং!”
স্নেহা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো,
” স্যার এই ফাইলে আপনার সাইন লাগবে।”
দিলশাদ মাথা নাড়লো। ফাইলটি ভালো করে চেক করে খুব কষ্টে সাইনটি করে দিলো। আজ দিনের মধ্য ভাগেই এই লিখা লিখির কাজ টা বড্ড এড়িয়ে গেলেও এবার আর পারলো না। সাইন করার সময় রক্তে ভিজে যাওয়া সাদা ব্যন্ডেজটি চোখ এড়িয়ে গেলো না। স্নেহা তার বুকের মধ্যে ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করলো। তবে তা বুকের ভেতরেই কোথাও হাড়িয়ে গেল। স্নেহা পিছনে ফিরে চলে যেতে লাগলো। দু কদম এগিয়ে আবার ঘাড় বেকে পিছনে তাকালো স্নেহা তার ভাড়ি পল্লব নিয়ে। এবার আর স্নেহা থাকতে পারলো না। যাই হোক কোনো এক সময় এই ব্যক্তিটিকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে সে। দিলশাদের চোট পাওয়া হাতে খাবার তুলতেই দিলশাদ ব্যথায় মুখ কুচকে নিচ্ছে। দিলশাদের ব্যথাতুর মুখটা এতোটাই আকৃষ্ট করলো স্নেহার অবুঝ মনটাকে…. যে স্নেহা নিজের অজানতেই দিলশাদের কাছে পৌঁছে গেলো। দিলশাদের পাশে বসে তার হাত থেকে প্লেটটি নিয়ে খাবার নিজ হাতে মাখিয়ে মুখে তুলে দিলে। হুটহাট এমন এক অবস্থায় কি রিজেকশন দিবে দিলশাদ বুঝতে পাড়লো না। শুধু পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো খেতে লাগলো খাবার টুকু। দিলশাদ স্নেহা প্রতিটি মুহূর্ত গভীর ভাবে উপভোগ করতে লাগলো। স্নেহার তাকানো, তার চোখ, অগোছালো ছোট ছোট অবাধ্য চুল, ঠোঁট বাঁকানো, কখনো মাছের কাঁটা বাছার সময় মুখের অদ্ভুত ভঙ্গিমা সব কিছুই মনোমুগ্ধকর। দিলশাদের গোলাপী ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি অজান্তেই ভেসে গেলো। দিলশাদের হাসি মুখখানা বেশিক্ষণ আর রইলো না। ধারাম করে দরজা খুলে এক বিকট শব্দে। ভেসে আসে এক চিৎকার,
“এখানে কি হচ্ছে দিলশাদ?”
ছলছল চোখে প্রশ্ন করে বসলো সেহের। সেহেরকে এমন সময় হয়তো দুজনের কেউ আবিষ্কার করে নি এখানে। সেহেরকে দেখে দুজনের কোনো মুখমন্ডলের পরিবর্তন হলো না। তবে, স্নেহা লাস্ট খাবার টুকু দিলশাদের মুখে তুলে দিতেই সেহেরের মাথা গরম হয়ে গেলো। এক টানে খাবারের প্লেটটি টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো মাটিতে। রাগে গজ গজ করে স্নেহাকে টেনে তুলে ঠাট্টিয়ে এক চর মেরে দিলো।বলল,
” বেহায়া মেয়ে লজ্জা করে না, অন্যের বয়ফ্রেন্ডের গা ঘেসতে?”
স্নেহা ঠোঁট বাঁকালো। পাশ থেকে দিলশাদ ধমকে উঠে বলল সেহেরকে,
” সেহের আর ইউ আউট ওফ মাইন্ড?”
” দিলশাদ তুমি… তুমি আমাকে এভাবে ঠকাচ্ছো? আমি এখানে আজ না আসলে জানতেই পারতাম না, তুমি আমার পিট পিছে ছিঃ!”
দিলশাদের এবার চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। শক্ত গলায় বলল,
” সেহের আমি তোমাকে কিভাবে ঠকিয়েছি? তোমাকে শুধু সহ্য করছি, এ জন্য কারণ তুমি আমার মাকে বাঁচিয়েছো। তাই বলে আমার মাথায় চড়তে বসার অনুমতি দি নাই।”
স্নেহার সামনে এভাবে কথা গুলো শুনে মাটি বসে বিলাপ শুরু করে দিলো। সেহের সত্যি এ মেয়ের কাছে হেরে যাবে? ও প্রথমে স্নেহা, তারপর মারিয়া, এমন অনেক নারীকে সে সরিয়ে দিয়েছে দিলশাদের জীবন থেকে এবার কি এই আকৃতা শেখকেও সরাতে হবে? আজ সকালেই মারিয়া যদি তাকে ফোন না করতো? তাহলে সে আজো হাসপাতালে বসে থাকতো।
স্নেহা এসব দেখে হাসলো মনে মনে। দিলশাদের দিকে সিরিয়াস লুক করে তাৎক্ষণিক ভাবে বলল,
” স্যার আমি আসচ্ছি। ”
বলেই বেড়িয়ে গেলো। স্নেহা যেতেই সেহের দিলশাদের পা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” দিলশাদ, তুমি প্রতিবার আমাকে এড়িয়ে যাও, আমি তোমাকে কত ভালোবাসি আর তুমি? আমাকেেত অবহেলা করো? আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না।”
দিলশাদ তার পা ঝাটা মেরে সেহেরকে সরিয়ে দিলো। এবং যেতে যেতে বলল,
” আমার মনে ছোট থেকেই সেই একজনের বসবাস। আর সে হচ্ছে স্নেহা। সে ছিলো সে আছে এবং থাকবে!”
দরজা খুলে আবার বন্ধ হলো। সেহের নিজের হার এভাবে হবে মেনে নিতে পাড়ছে না। তবে সে লড়বে, লাষ্ট পর্যন্ত লড়াই করবে। দিলশাদ তার ছিলো থাকবে।
অন্যদিকে স্নেহা গাড়ির ভিতর বসে আছে। হাতের ফোনটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যাচ্ছে। একটি ফোনের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর ফোনটি বেজে উঠলো। ফোনটি তুলতেই ওপাশ থেকে কিছু বলতেই স্নেহা বলল,
” ধন্যবাদ আপনাকে স্যার!”
বলেই ফোনটি কেঁটে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে হসপিটালের ভিতরে ঢুকে পরে স্নেহা। বিশাল বড় একটি কেবিন। হসপিটালের মধ্যে খুব সুন্দর করে ঘরের মতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিন্দুর কেবিনটি। স্নেহা বিন্দুর পাশে বসলো। নিথর দেহটি পড়ে আছে হসপিটালের সাদা চাদর জড়িয়ে। স্নেহার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। বিন্দু সব সময় স্নেহাকে তার মেয়ের মতো দেখেছে, আদর করেছে। কখনো পর ভাবেনি। এমনকি স্নেহাকে দিলশাদ বাসা থেকে বের করে দেয়ার পরেও বিন্দু দেখে করতে গেছে কয়েকবার স্নেহার সাথে। স্নেহা তখন অভিমানে কথা বলে নি। অথচ এই বিন্দুই তাকে বাঁচাতে গিয়ে আজ প্যারালাইজড। স্নেহা বিন্দুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” মা আমাকে চিন্তে পেরেছেন? আমি আপনার স্নেহু। মা আপনি সেদিন না থাকলে আজ হয়তো আমি পৃথিবীতে থাকতাম না। কিন্তু কি অদ্ভুত তাই না মা, যেই ব্যক্তি আপনার আর আমার অস্তিত্ব বদলে দিলো, সে ঠিকই আছে আর আমরা গন্তব্যহীন!”
স্নেহা কিছুক্ষণ চোখের জল ফেললো। বিন্দুকে আবারো ভালো করে দেখে স্থান ত্যাগ করলো। যে কোনো মুহুর্তে দিলশাদের গার্ড চলে আসতে পারে, এই ভেবে সে দ্রুত চলে গেলো। কিন্তু পিছনে আর ফিরলো না। হয়তো ফিরলে দেখতে পেতো বিন্দুর চোখের কোনে থেকে-ও জল গড়িয়ে পরছে।
———-+
কয়েকটা দিন কেঁটে গেলো। শীত পেরিয়ে বসন্ত চলে এলো। নীল আকাশের রঙ্গিন ঘুরি বাতাসে উড়ে আর কোকিলের সুর শুনে আগমন জানলো দু-হাত ভড়ে। তেমনি এক বিকেলে হেলতে দুলতে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে এলো সেহের। কিছু একটা নিয়ে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন। তখনি একটি কালো রঙ্গের গাড়ি এসে থামলো সেহেরের সামনে। সেহের কিছু বুঝে উঠার আগেই কিছু লোক এসে জোর করে তুলে নিলো গাড়িতে। সেহের চিৎকার করবে তার আগেই মুখের সামনে কাপড় চেপে ধরতেই জ্ঞান হারালো সে। যখন জ্ঞান ফিরলো, নিজেকে এক অপরিচিত জায়গায় আবিষ্কার করলো সে। অন্ধকার একটি রুম। চারিদিকে ভ্যাপসা গন্ধ । বমি চলে এলো সেহেরের। ঠিক সে সময় সেহের খেয়াল করলো পর্দার আড়ালে কোনো ছায়া মূর্তি। সেহের ভয়ে কুঁকড়ে গেলো। গলার শব্দ কোথাও হারিয়ে যেতে লাগলো,
” স্নেহা… স্নেহা? এটা তুমি? প্লিজ আমাকে মেরো না আমাকে যেতে দাও।”
ছায়া মুর্তিটির কোনো পরিবর্তন হলো না। সে শুধু স্নেহার দিকে তাকিয়ে রইলো। সেহের কাকুতি মিনতি করতে লাগলো। কিন্তু নিজের জায়গা থেকে নরতে পারলো না।শিকলে বাঁধা তার পা। এবার স্নেহা বলল,
” সেহের তোমার মনে আছে? এভাবেই একটি রুমে আমাকে বন্দী করে রেখে ছিলে? এখন তোমার পালা।”
বলেই স্নেহা দরজা লাগিয়ে চলে গেলো। বিড়বিড় করে বলল,
” সেহের সময় তোমাকে এবার সব ফিরিয়ে দিবে।”
চলবে,
#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
পর্ব-১২
আজ তিন দিন পেটে কিছু পরেনি সেহেরের। পড়নের কাপড়টি-ও ময়লা আর ছেড়া। সেহের ধীরে ধীরে নিজেকে নাড়াতে চাইলো। ব্যর্থ হলো। পানির পিপাসায়… বুকটা চৌচির খা খা মাঠ। আকৃতা শেখ সেই তিন দিন আগে যে তাকে বন্ধ করে গেলো? আর খবর নেই…..আর… আর ওই আকৃতা শেখ কি সত্যি স্নেহা? নাকি কোনো ভ্রম? নাকি কোনো নতুন রহস্য? সেহের আর ভাবতে পারলো না। কোনো রকম উঠে গিয়ে তিন আগের পুড়নো রুটির টুকরো কুঁড়ি নিলো। পিঁপড়ে আর ময়লা লাগা রুটিটি পাগলের মতো গিললো। কিন্তু গলায় খাবার আটকে গেলো। এদিক ওদিক পানি না পেয়ে গলা কাটা মুরগীর মতো ধাপড়াতে লাগলো। ঠিক তার কিছুক্ষণ পরেই বমি করে সব ভাসিয়ে নেতিয়ে পড়লো। নিজের এই বেহাল মায়া দেখে নিজেরি মায়া হলো সেহেরের চোখ দিয়ে অঝড়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলেও ব্যর্থ সে। আকৃতা শেখ মেয়েটিকে তার চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। এক বার সে এখান থেকে ছাড়া পেলে মেয়েটির মুখের মাংস তুলে নিবে। ছুড়ে দিবে নরপশুদের ভীড়ে। সেহের বিড়বিড় করে বলল,
” আকৃতা শেখ আমি তোমায় ধংস করে দিবো। আমার এই অবস্থার জন্য তোমাকে আমি ছাড়বো না।”
এদিকে সেহেরে প্রতিটি কর্মকান্ড স্নেহা নিজের লেপটপে বসে দেখছে। ঠোঁটের কোনে শ্লেষের হাসি। স্নেহা চেয়ারে হেলে পড়লো। দমকা হাওয়া এসে স্নেহের ঘন কালো চুল গুলো স্পর্শ করে গেলো। স্নেহা মন মাতানো মাতাল বাসাতের স্পর্শে চোখ বুজে নিলো। ভেসে উঠলো তিক্ত কিছু অনুভূতি। ঠিক সেহেরে জায়গায় ছিলো স্নেহা। দমবন্ধ , ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর। এক ফোঁটা পানির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলো। না খেতে পেরে অচল হয়ে গেছিলো স্নেহার শরীর। ফর্সা শরীর ফেকাসে বর্ণের হয়ে উঠেছিলো। সেহেরে প্রতিটা অত্যচার। প্রতিটা মারের দাগ সারা শরীরে কালশিটে দাগ করে গেছিলো। এখনো শরীরের কাপড় সরালে দাগ গুলো দৃশ্য মান হয়ে উঠে। ভয়ংকর রাত গুলো আর স্নেহার বুক ফাঁটা চিৎকার আর হা হা কার শোনার মতো কেউ ছিলো না। স্নেহা এখনো ভুলতে পারেনি। সেদিন গুলোর কথা। যেদিন সেহের স্নেহাকে পানির সাথে মরিচে গুরো ইচ্ছে মতো মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলো। স্নেহা পাগলের মতো হয়ে গেছিলো। এদিক ওদিক গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। এক পর্যায় ঝাল সহ্য করতে না পেরে নিজেই জিবে নখ দিয়ে আঁচড় কেঁটে ছিলো। সেদিনের পর থেকেই স্নেহার ভোকাল কর্ড নষ্ট হয়ে যায় কন্ঠের। স্নেহা চাইলেও চিৎকার করতে পারেনি। ঠিক তার কয়েকদিন পরেই স্নেহাকে মেরে ফেলার জন্য সেহের একটা ধারালো ছুরি নিয়ে আসে। এবং স্নেহার সুন্দর চেহারা নিমিষেই কুৎসিত করে দেয়। সেদিন স্নেহা নিজের জোরে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেছিলো। মুক্ত করেছিলো নিজেকে। পেয়েছিলো এক নতুন চেহারা। নতুন আইড্যান্টি। স্নেহা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। পুরোনো স্মৃতি গুলো যদি ভোলা যেত? তাহলে, তাহলে সে ভুলেই যেত। স্নেহা উঠে দাঁড়ালো। হাতের মুঠে চাবি নিয়ে বেড়িয়ে গেলো সেহেরকে আটকিয়ে রাখা ঘরটির দিকে।
পায়ের আওয়াজে মিয়ে গেলো সেহের। ভয়ে আত্মা ধুকধুক করছে তার। দরজাটি খুলতেই হাটুতে ভর দিয়ে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো সেহের।
” একটু.. একটু পানি দাও, একটু একটু খাবার দেও!”
স্নেহা কাছে মনে হলো কোনো ভিক্ষারী ভিক্ষা চাইছে। সেহেরকে অবশ্যি কোনো ভিক্ষীর থেকে কম মনে হচ্ছে না। স্নেহা বলল,
” সব দেবো। তুমি যা যা করেছো আমার সাথে স্বীকার করো… আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো।”
সেহেরের মুখ চুপসে গেলো। কিভাবে সে সব সত্যি বলে দিবে? কিভাবে? একবার যদি দিলশাদ এসব জেনে ফেলে তাহলে? তাহলে সেহেরকে মেরে ফেলবে সে। এখন এই অবস্থা থেকে আরো কঠিন অবস্থা করে দিবে। সেহের শুকনো ঢুক গিললো। স্নেহা সেহেরকে ভাবতে দেখে বলল,
” আই থ্যিংক তোমার এই অবস্থা তুমি খুব ইনজয় করছো?”
সেহের চুপ করেই রইলো। তার এখন এই অবস্থা একদিকে নদী, অন্য দিকে কুমির। সেহের ঢুকরে উঠলো। বলতে লাগলো,
” প্লিজ আমাকে যেতে দাও, আমি কিছু করিনি। আমি কিছু জানি না।”
স্নেহা বাঁকা হাসলো। কর্কস কন্ঠে বলল,
” কুকুরের লেজ সত্যি কখনো সোজা হয় না। ঠিক তেমনি তুমি। এনজয় ইয়োর স্যাল্ফ।”
বলেই স্নেহা বেড়িয়ে গেলো। এভাবে আরো দুটো দিন কেঁটে গেলো। সেহেরকে খুঁজে না পেয়ে তালুকদার বংশের মাথা নষ্ট। এক মাত্র মেয়ে আজ ৪ দিন যাবত নিঁখোজ। পুলিশ নিজেও কিছু করছেনা। না পেরে তারা দিলশাদের কাছে আসে। দিলশাদ সব শুনে ভাবলেশহীনের মতো বলে উঠে,
” আন্টি, আঙ্কেল চিন্তা কেন করছেন? এইটা তো সেহেরের অভ্যস তাই নয় কি? এভাবে হঠাৎ গুম হয়ে ফিরে আসা তার অভ্যস। আপনাদের তো এসব কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা। বাসায় যান। যার সাথে গেছে, মন ভরে গেলে ঠিক আবার ফিরে আসবে!”
দিলশাদের এমন কথা লজ্জিত হলেও তাঁরা বেহায়ার মতো সাহায্য চাইতেই থাকলো,
” দিলশাদ বাবা, আগের বারের সাথে এবারের অনেক বড় তফাৎ। একটু, একটু খোঁজ লাগাও। বাবা আমার একটা মাত্র মেয়ে!”
দিলশাদ বলল,
” ঠিক আছে দেখছি।”
তালুকদার পরিবার চলে যেতেই। দিলশাদ ফোন করলো কাউকে। বলল,
” সেহের কোথায়? খবর নাও!”
ওপাশ থেকে কি বলল, শোনা গেলো না। দিলশাদ ফোন কেটে দিলো। বরাবরের মতো পকেটে হাত গুঁজে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ১৫ তলা ভবনটির উপর কোনো রকম শব্দ পৌঁছাতে পারে না। শুধু দেখায় ছোট ছোট ঘর বাড়ি, যানবাহন। দেখা যায় দূরের আকাশের নীড়ে ফেরা পাখি। দিলশাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মনে পড়লো সেদিনটির কথা….
স্নেহাকে দিলশাদের বাসা থেকে বের করে দেয়ার কিছুদিন পর দিলশাদ একটি রেস্টুরেন্টে পা রাখে মিটিংয়ের জন্য। চারিদিকের টিমটিম সোনালী আলোয় ঝকমক করছে। বাহারী মানুষদের মন মতো করে তোলা একটি অসাধারণ জায়গা। দিলশাদ একটি টেবিলে বসে অপেক্ষা করছিলো তার ক্লাইন্টের জন্য। বিরক্তিতে তার চোখ, মুখ, কঁপাল কুচকে। চোখ ঘুড়িয়ে চারপাশটা দেখতই চোখে পড়লো, পরিচিত একটি মুখ। দিলশাদ নামটি উচ্চারণ করলো,
” স্নেহা?”
দূর থেকেই দেখতে লাগলো দিলশাদ স্নেহাকে। ওয়েটারের ড্রেস পড়ে কিছু লোককে ড্রিংস সার্ভ করছে। স্নেহার পড়নেন টি শার্টির বড় গলা দিয়ে বেড়িয়ে আসচ্ছে আকর্ষনীয় অংশ বিশেষ। এটা দেখেই দিলশাদে মাথায় যেন রক্ত উঠে গেলো। বড় বড় পা ফেলে টেনে নিয়ে গেলো একটি রুমের ভিতর। চেপে ধরলো দেয়ালের সাথে। দাঁতে দাঁত চাপ বলল,
” বেশরম মেয়ে? লাস্ট পর্যন্ত প্রস্টিটিউট এর খাতায় নাম লিখিয়েছো?”
স্নেহা তার বড় বড় চোখে জোরা আরো বড় বড় করে ফেললো। সামনের মানুষটিকে দেখে। কিছু বুঝবার আগেই তার গা জলানো কথা শুনে রাগে চোখের কোনে জল টলমল করে উঠলো। লোকটি তাকে এত ঘৃণা করে? এতটাই??দিলশাদের বুকের উপর হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বলল,
” আমি যা ইচ্ছে তাই করবো! তাতে আপনার কি? আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই…!”
দিলশাদের রাগ ধেই ধেই করে বেরে চললো। স্নেহার কোমরে শক্ত করে চেপে ধরে থুতনিতে হাত রাখলো। চোখে চোখ রেখে বলল,
” ইউ আর মাই ওমেন। ভুলে যেওনা, আমাদের ডিভোর্স হয়নি। ”
স্নেহা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলল,
” ভুলে তো আপনি গিয়েছেন মিঃ আমরিন। খাতা কলমে না হোক আলাদা আপনি নিজেই করে দিয়েছেন আমাদের সম্পর্কটাকে। যেদিন বের করে দিয়ে ছিলেন আমায়। ”
দিলশাদ বলল,
” ডিভোর্সের খুব তারা তাই না তোমার? ”
স্নেহা বলল,
” হে খুব তারা। মুক্তি চাই আমি আপনার থেকে।”
দিলশাদ ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” ডিভোর্স দিবো তোমার স্বপ্ন। ”
স্নেহা হু হু করে কেঁদে উঠে। দিলশাদ রুমটি থেকে বেড়িয়ে যায়। স্নেহা নিজের কান্নার দমক সামলে বাহিরে আসতেই মেনেজার হুড়মুড় করে এসে বলল,
” মিস. স্নেহা, আপনি আর এখানে চাকরি করতে পারবেন না। উপর থেকে অর্ডার এসেছে।”
স্নেহা চোখ মুছে হাসি মুখে বেড়িয়ে আসে সেখান থেকে। এই কাজটুকু সে অনেক কষ্টে জোগাড় করে ছিলো। তাও গেলো। দিলশাদের বাসা থেকে বের হওয়ার পরে তালুকদার বাড়ি ঠাই আর মিলেনি স্নেহার। তাই নিজের পথ নিজেই খুঁজে চলে ছিলো। এবার আর এই শহরে থাকবে না স্নেহা। চলে যাবে বহু দূরে। এসব ভেবেই রাতের আঁধারে মিলিয়ে যেতে লাগলো স্নেহার ছায়া মূর্তি। এদিকে দূর থেকে গাড়ির সাথে হেলে নিকটিনের ধোঁয়া ছড়িয়ে স্নেহার চলার পানে তাকিয়ে আছে। এ ছায়া মূর্তিটিকে সে ঘৃণা করে, তবুও কেন মনের কোনে মানুষটির জন্য কষ্ট হয়, কেন ছুটে আসে দিলশাদ এই মানুষটির পিছনে, কেনো হাজার কষ্ট দিয়েও নিজের মনের কোনে ক্ষত অনুভব করে। দিলশাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোয়া ছাড়লো নিকটিনের। আকাশে আজ এক চিলতে চাঁদ উঠেছে, অথচ চাঁদের মাঝে আজ নেই যেন কোনো আলো, নেই কোনো প্রাণ, নেই কোনো ছন্দ। ঠিক দিলশাদের বুকের ভিতরটা মতো। দিলশাদ সপ্তপর্নে শ্বাস টুকু লুকিয়ে নিলো। গাড়িতে উঠার জন্য এগিয়ে যেতেই দিলশাদ চোখ পড়লো এক কপোত-কপোতীর উপর। যারা একে অপরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে চুম্বন করছে। দিলশাদের হঠাৎ করে মেয়েটির মুখ দেখে চমকে গেলো। কয়েক সেকেন্ড থমকে গেলো তার হার্ট বিট। বুকের ভিতর খুশির এক ঝলক উঁকি দিলেও পরমুহূর্তেই মিলে গেলো মেয়েটির পাশের লোকটিকে দেখে। দিলশাদের পায়ের রক্ত যেন মাথায় উঠে গেলো। দিলশাদ এগিয়ে গেলো। থমথমে কন্ঠে হাড়কাঁপানো কান্ঠে ডাকলো,
” সেহের,…!”
সেহের তার নতুন বয়ফ্রেন্ডের সাথে ডেটে এসেছিলো আজ। দিলশাদকে দেখে, আতঙ্কিত হলো। তার বয়ফ্রেন্ডের জ্যাকেট শক্ত করে মুঠ করে চেপে ধরলো। ভয়ে ভয়ে বলল,
” দি…ল… শাদ..!”
দিলশাদ ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
” আমাকে কেন ঠকালে?”
সেহের দিলশাদ লাল লাল নিস্প্রভ চাহনি দেখে কাঁপতে লাগলো। বলল,
” আমি.. আমি..!”
দিলশাদ বলল,
” এত বড় নাটক কেন করলে?”
সেহের যেন হঠাৎ দিলশাদের আগমনে কথা বলতেই ভুলে গেছে, কি বলবে সে কি উত্তর দিবে? খুঁজে পাচ্ছে না। দিলশাদ এবার ধমকে উঠলো। তা দেখে সেহের কেঁদে দিলো। তখনি তার বয়ফ্রেন্ড বলল,
” আশ্চর্য লোকতো, কে আপনি? আমার সামনেই আমার গফকে ধমকাচ্ছেন? ”
দিলশাদ এবার সরাসরি ছেলেটির দিকে তাকালো। দিলশাদের ধারালো চোখের দৃষ্টিতে ছেলেটি মুহূর্তেই লেজ গুটিয়ে পালালো। তা দেখে সেহের আরো ঘাবড়ে গেলো। দিলশাদ এবার সেহেরের দিকে তেড়ে গিয়ে চিৎকার করে বলল,
” আমি সত্যি জানতে চাই….!”
সেহের কান চেপে ধরে। দিলশাদের ভয়ানক কন্ঠ আর তার কান সইতে পাড়ছে না। সেহের না পেরে সব সত্য বলে দেয়,
” আমি তোমার থেকে পালাতে চেয়ে ছিলাম। বিয়ে করতে চায়নি তোমাকে। আমি.. আমি তো আমার লাইফ এনজয় করতে চেয়েছিলাম । কিন্তু…. কিন্তু তুমি আমাকে সব সময় বাঁধা দিয়েছো, এটা করো না, ওটা করো না । এইটা তোমার পছন্দ না, ওইটা তোমার পছন্দ না.. আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম তাই.. তাই আমি চলে গেছিলাম!”
দিলশাদ কসে এক চড় বসালো সেহেরের গালে। এই মেয়েটির জন্যই স্নেহাকে কতই না টর্চার করেছে সে, এই মেয়েটির জন্য? দিলশাদ এবার সেহেরের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,
” তোমাাে ভালোবাসা আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল। ”
বলেই হাত বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। সেহের গালে হ্ত দিয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। দিলশাদ ঠিক কি জন্য হাত বাড়িয়েছে বুঝতে পাড়ছে না সে।কিন্তু যখনি দিলশাদ সেহের গলায় থাকা দিলশাদের নামের তাবিজের লকেটটির দিকে হাত বাড়ায়, সেহের দূরে সরে গিয়ে বলে,
” এই কি করছো? এটা আমার লকেট!”
দিলশাদ ফিচেল হেসে বলল,
” এইটা আমার লকেট। ”
সেহের লকেটটি আরো শক্ত করে ধরে বলল,
” নাহ্, এটা তোমার না এটাতো স্নেহার..।”
দিলশাদ এই একটি বাক্য শুনে যেন দম আটকে এলো। পুরো দুনিয়া উল্টে যেতে লাগলো তার। কাঁপা হাতে সেহের গলা থেকে টেনে ছিঁড়ে নিলো লকেটটি। হাতের মুঠোয় নিয়ে দেখলো অপলক। হঠাৎ অজানতেই ঝড়ে পড়লো গড়িয়ে শক্ত মনের মানুষটির চোখের জল।দিলশাদ ভিজে গলায় বলল,
” আমি.. আমি এই লকেটি স্নেহাকে পড়িয়ে ছিলাম। আমার ছোট বেলার ভালোবাসাকে বড় হয়ে চিন্তে পারার জন্য। আর আজ তোমার জন্য আমি আমার ভালোবাসার মানুষটিকে কতটা অপমান করেছি, কতটা অন্যায় করেছি। শুধু তোমার মতো মিথ্যাবাদির জন্য। সেহের এবার আরো ভয় পেয়ে গেলো। ছোট বেলায় স্নেহার থেকে এই লকেটি ছিনিয়ে নিয়ে ছিলো সেহের। সেদিন স্নেহা অনেক কেঁদেছিলো। আজ বুঝতে পাড়ছে সেহের, কেনো এই লকেটি এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো স্নেহার কাছে। সেহের এবার মুখ খুলে কিছু বলতে চাইলো । দিলশাদ আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসিয়ে বলল,
” ভবিষ্যতে-ও আমার সামনে আসবে না। না হয় আমি তোমাকে নিজের হাতে খুন করে ফেলবো, এবার নাটক হবে না কিন্তু!”
বলেই স্থান ত্যাগ করলো দিলশাদ। ছুটে গেলো স্নেহার খুঁজে। কিন্তু আফসোস সেদিনের পর আর স্নেহার কোনো খোঁজ পায়নি দিলশাদ। আর যেদিন পেলো, সেদিন সে মৃত, বলে জানলো… !
চলবে,