#সর্বনাশিনী,১৫,১৬
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১৫
“দিলশাদ!”
স্নেহা শক্ত করে চোখ বুজে রাখলো। হঠাৎ করেই ঘামতে শুরু করলো । অনেকক্ষণ এভাবে কেঁটে যাওয়ার পর স্নেহা ধীরে ধীরে চোখ খুললো। এক চিলতে আলোর ঝিলিক স্নেহার বড় বড় চোখ জোড়ায় জ্বালা করতে লাগলো। স্নেহা আবারো চোখ বুঝে ধীরে ধীরে চাইলো। নাহ্… সামনে কেউ নেই, কিছুটি নেই, নেই কোনো মানব অবয়ব। স্নেহা স্থীর শ্বাস ছাড়লো। কিন্তু ঝীম ঝীম করতে লাগলো স্নেহার শরীর। চোখের সামনেই আঁধার নেমে এলো মুহূর্তে-ই। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।
অনেকক্ষণ যাবত স্নেহাকে বের হতে না দেখে মাহাদ নিজেই এগিয়ে গেলো ট্রায়াল রুমের দিকে। নক করলো সে,
” আকৃতা? আকৃতা? এতক্ষন সময় লাগছে কেন? আর ইউ ওকে??”
ভিতর থেকে কোনো রা শব্দ এলো না। মাহাদ আবারো নক করলো। কিন্তু? কিন্তু? এবারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। মাহাদের কপালে এবার টেনশনের রেখা ফুটে উঠলো। এক ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই স্নেহার নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেই নিজের কোলে তোলে নিলো। ডানে নয়, বামে নয় সোজা হসপিটালে নিয়ে এলো তাকে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার খুশি খুশি কন্ঠে বললেন,
” কংগ্রাচুলেশন মি: মাহাদ, আপনি বাবা হতে চলেছেন।”
মাহাদ থতমত খেয়ে গেলো এমন একটি বাক্য শোনে। ড্যাব ড্যাব করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” কে বাবা? আ..আমি? কিন্তু…!”
ডাক্তার খুশিতে গদ গদ। নিজেরই যেন বাচ্চা কাচ্চা হচ্ছে। বললেন,
” আরে বাবা কোনো কিন্তু নই, জলদি যাও মিষ্টি নিয়ে আসুন, আপনার বউকে মিষ্টি মুখ করান। ”
মাহাদের এবার রাগ উঠলো। খায়া পিয়া কুচ নেহি গিলাস তুড়া বাড়ো আনা’, মাহাদের গল্প এক্কেবারেই তাই! সে তো কখনো আকৃতাকে স্পর্শ করেনি। যাস্ট আজ কোলে নিয়ে ছিলো। কোলে নিলে তো অবশ্য কেউ আর বাচ্চার মা হয়ে যায় না?? মাহাদ বলল,
” আপনার ভুল হচ্ছে ডাক্তার ও আমার বউ না।”
ডাক্তার বড় বড় চোখ করে চাইলেন। এক গাদা ভয়ংকর ভয়ংকর গালির ঝুড়ি খুলে মাহাদকে ধুয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
” আজকালকার ছেলে মেয়েদের যে কি হয়ে গেছে। বিয়ে আগেই বাচ্চা না নাউজুবিল্লাহ। আজ তোমাদের মতোই যুবকদের জন্য, বাচ্চারা অনাথ! আহারে!”
ডাক্তার দুঃখ প্রকাশ করলেন। এদিকে মাহাদের যেন ভরা বাজারে কাপড় খুলে যাবার অবস্থা। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে আগেই মুখের মাস্ক পড়ে এসেছিলো। নয়তো কাল সকালের বড় বড় অক্ষরে হ্যাডলাইন হতো… ” বিশিষ্ট পপ সিঙ্গার মাহাদ চৌধুরী করলো অবিবাহিত নারীকে একবার কোলে তোলেই প্রেগন্যান্ট?”
মাহাদ শুকনো ঢুক গিললো। তার মনে হচ্ছে এখনি এদিক সেদিক থেকে হয়তো কোনো পঁচা টমেটো, ডিম কেউ ছুঁড়ে মারবে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। স্নেহা চোখ খুললো। ডাক্তার খুশির ঝলক মুখে টেনে দাঁত কেলিয়ে বলল,
” মি. আকৃতা? আপনি মা হতে চলেছেন!”
স্নেহা চমকালো। সাথে সাথে উঠে বসলো। নিজের পেটের মাঝে হাত রেখে বলল,
“আমি প্রেগনেন্ট……! ”
স্নেহা ফুপিয়ে উঠলো…এটা কি খুশি কান্না? নাকি দুঃখের? কিন্তু সে তো পিল খেয়েছিলো। তাহলো?
স্নেহার ভাবনার মাঝেই মাহাদের থমথমে কন্ঠ ভেসে এলো,
” আকৃতা? এসব কি?”
স্নেহা চোখ মুছলো। পেটের মাঝে হাত রেখেই ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
” মি: মাহাদ, আপনার সত্যিটা এবার জানা উচিত আমি আকৃতা নই, আমি স্নেহা।”
মাহাদের পায়ের নিচে থেকে যেন মাটি সরে গেলো। হাত দুটো শক্ত করে নিয়ে নিজের অনুভূতি গুলো দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করলো।বলল,
” তুমি… তুমি মিথ্যা বলছো? তুমি আকৃতা? আমি জানি আকৃতা আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, তাই বলে এভাবে আমাকে ফিরিয়ে দিও না!”
লাস্ট কথা টুকুতে ব্যাকুলতা ভেসে উঠলো মাহাদের কন্ঠে।
স্নেহা ফিকে হাসলো। বলল,
“এমন কেনো হয়? আপনি যাকে বেশি ভালোবাসেন, সেই ব্যক্তি আপনাকে কষ্ট দেয়, দূরে ঠেলে দেয়। আবার সেই ব্যক্তি যখন দূরে চলে যেতে চায় বা চলে যায়? তখন আপনারা তাকে কাছে পাবার জন্য লড়াই করেন? ভালোবাসার মানুষকে কখনো হারিয়ে যেতে দিতে নেই মি: মাহাদ। আকৃতা আপনাকে অনেক ভালোবাসতো। আফসোস আপনি বুঝতে পারেন নি সময় মতো!”
মাহাদ পিছিয়ে গেলো। বলল,
” ভালোবাসতো মানে? আ.. কৃ..তা কোথায় এখন?”
স্নেহা মাহাদের দিকে তাকালো। লোকটির কন্ঠ কাঁপছে। আবারো চোখ ফিরিয়ে রাতের আঁধারে ভেসে থাকা তারার দিকে ইশারা করে বলল,
” আমাদের অনাথ আশ্রমে একজন সিস্টার ছিলেন। খুব আদর করতেন আমায়, রাতে যখন বাবা-মার জন্য কান্না করতাম? বলতেন, মানুষ মারা গেলে নাকি তারা হয়ে যায়। যদিও কথাটি এখন বুঝতে পারি ভিত্তিহীন। তবে মনের শান্তির জন্য এখনো আকাশে তাকিয়ে আমার বাবা-মার মুখটি দেখার চেষ্টা করি!”
মাহাদের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। সুদর্শন মুখ লাল হয়ে গেলো। ছিটকে বেড়িয়ে গেলো স্নেহার কেবিন থেকে। হঠাৎ করে মনে হতে লাগলো তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এখনি নিশ্চয়ই সে দম আটকে মারা যাবে?
এদিকে স্নেহা নিজের পেটের মাঝে হাত বুলিয়ে যেতে লাগলো। আগের বার তার বাচ্চাটি পৃথিবীর বুকে আসার আগেই হারিয়ে গেছিলো। এবার? এবার কি করবে স্নেহা? বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলবে? নাকি এই সুন্দর পৃথিবীর মুখ দেখাবে?
—————-
তালুকদার বাড়ির সামনে একটি মেয়ে জীর্ণশীর্ণ শরীরে উপস্থিত হয়েছে। শরীরের নোংরা ছেড়া কাপড় আর অনেক দিনের না গোসল করার ফলে সেহেরকে ভিকেরি মনে হচ্ছে। সায়রা দরজা খুলে এক ভিক্ষুক ভেবে নাক ছিটকে দুর দুর করে তারিয়ে দিতে লাগলো। সেহের নিজের মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
” মা.. মা আমি সেহের তোমার সেহের!”
সায়রা অবাক হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগে ভিক্ষারি ভেবে যাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো তাকে কাছে টেনে নিলো। মা-মেয়ে দুজনে ডুকরে উঠে কাদলো। সায়রা বলল,
” তুই কোথায় ছিলি এতদিন? এ হাল কেন তোর? ”
সেহের তার মাকে সব খুলে বলল,
” মা… মা এই সব ওই আকৃতা করেছে!”
সায়রা রাগে কিড়মিড় করে উঠলো। বলল,
” ওকে আজ আমি জমের ঘরে পাঠাবো!”
সেহের আটকালো,
” মা এখন না। পরশু আমার জম্মদিন। সেদিন না হয় ওকে শিক্ষা দিবো!”
সায়রা তালুকদার সেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” আহারে আমার মেয়েটার কি হাত করেছে ডাইনিটা?”
—————-
দেখতে দেখতে সময়ের পরিবর্তন হতে থাকলো। সেহেরের ধুমধাম জম্মদিনে তালুকদার বংশ ধুমধাম করে আয়োজন করা হলো। এদিকে আমরিন পরিবার শেখ পরিবার সহ সবাইকে দাওয়াত করা হলো। আকৃতা শেখ তার মায়ের সাথে পা রাখলেন হলে। সেহের দূর থেকে দেখে বাঁকা হাসলো। মনে মনে বলল,
” স্নেহা? তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়ে অনেক বড় ভুল করেছো, সে বার মারতে পারিনি, কিন্তু এবার? এবার আর ছাড়ছি না তোমায়!”
এদিকে জমকালো সন্ধ্যা টুইস্টের যেন শেষ নেই। বড় বড় নামি দামি মানুষের সামনে সেহের কেক কাটলো। দিলশাদ না চাইতেও রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। স্নেহা দূর থেকে লোকটিকে দেখছে। আচ্ছা আজ এই লোকটি যখন জানবে? যেই সেহেরকে তার মায়ের জান বাঁচানোর জন্য, এতটা প্রাধাণ্য দিচ্ছে? সেই সেহের তার মাকে মারতে চেয়েছে কি করবে দিলশাদ?
স্নেহা জুসের গ্লাসে চুমুক দিলো। সেহেরের এবার কেক কাটার পালা। সকলের এটেনশন সেহেরের দিকে। সেহের কেক কাটলো। সেহের তার বাবা মাকে কেক খাইয়ে দিয়ে দিলশাদের মুখে তুলে দিতে নিলো। ঠিক সেই সময় পুরো হলের আলো বন্ধ হয়ে গেলো। আর তখনি সামনের পর্দায় ভেসে উঠলো সেহেরের প্রতিছবি,
” হ্যাঁ আমি খুন করেছি স্নেহাকে, আমি বিন্দু আন্টিকে মারতে চেয়েছি, আমি স্নেহার বাচ্চাকে এই পৃথিবীর মুখ দেখতে দেই নি!”
সকলেই জমে গেছে যেন নিজ নিজ জায়গায়। সেহের থরথর করে কাঁপতে লাগলো। আকৃতা শেখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলো সে। আকৃতা জুসের শেষের ঢুক পান করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। লাইট ততখনে জ্বলজ্বল করছে হল ঘরটিতে। সেহেরের মনে হলো সেই আধার কেন চলে গেলো? কেন তাকে নিয়ে গেলো না? আকৃতা হাসলো,
” কার্মের ফল সবাইকে পেতে হয় । হয়তো এই দুনিয়ায় নয়তো পরের দুনিয়ায়। একেই বলে কর্মা…!”
স্নেহা হেটে বেড়িয়ে গেলো হল ঘরটি থেকে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো দিলশাদের মুখটির দিকে একবার দেখবার। তখনি পিছন থেকে ভেসে এলো ধাম করে হওয়া একটি শব্দ। তারপর… তারপর…..
চলবে,
#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১৬।
স্নেহার জীবনের কষ্ট শুরু হয়েছিলো, যেদিন তার বাবা এক কার এক্সিডেন্টে মারা যায়। যদিও অনাথ আশ্রমের সুপার ভাইজার এটিই তাকে বলেছে,,
” বড় রাস্তার ধারের বড় একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খায় স্নেহার বাবা-মার গাড়ি, এবং খাইয়ে পড়ে যায়। তুমি জানি কিভাবে গাড়ি থেকে ছিটকে পড়। আমরা সেখানেই কুড়িয়ে পেয়েছি তোমাকে।”
স্নেহা ছোট থেকেই এই সত্যিটা শুনে এসেছে। বাবা-মার স্মৃতি বলতে তার চোখে আবছায়া দুজন নর-নারীর প্রতিছবি ঘোলা হয়ে ভেসে উঠে। স্নেহা তাতেই সন্তুষ্ট ছিলো। অনাথ আশ্রমের কষ্টের মাঝেও মিষ্টি অনুভূতি ছিলো, ছিলো আনন্দময় মুহুর্ত। স্নেহার সেখানে সব থেকে প্রিয় আপু ছিলো। নাম ছিলো ইরিনা। ঠিক বড় বোনের মতো আগলে রাখতো স্নেহাকে।অথচ স্নেহার থেকে দুব বছরেরই বড় সে। স্নেহাকে নিয়েই ছিলো ইরিনার শুরু আর শেষ। কিন্তু সেও একদিন অনাথ আশ্রম ছেড়ে চলে যায়। স্নেহা এর পর আর তার কোনো খোঁজ পায়নি। তবে একবার তাদের সুপার ভাইজার তার ছবি দেখিয়েছিলো। বলেছিল অনেক বড় ঘরের এক মাত্র সন্তান হিসেবে আছে সে। হয়তো প্রিয় মানুষ গুলো এভাবেই হারিয়ে যায় স্নেহার জীবন থেকে। প্রথমে বাবা-মা, তারপর ইরিনা আর তারপর.. দিলশাদ। স্নেহার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। লাভ ফ্যারি রেস্টুরেন্টের সুইমিং পুল এড়িয়াতে নির্জন একটা টেবিলে বসে আছে স্নেহা। হাত একটি জুসের মগ। জীবনের ২০ টা বছর পাড়ি দিয়ে আজ ২১ এ পড়েছে। নিজের জন্মদিনের সময়টুকু একাই বসে কাটিয়ে দিচ্ছে। টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা ১২ টায় এসে ঠেকলো। টেবিলের সামনে থাকা ছোট একটি কেকের উপর টিমটিম করে জ্বলা হলদে আলো ফু দিয়ে নিভিয়ে দিলো স্নেহা। কান্নারত কন্ঠ নিজেকে নিজেই সমর্থণ করলো,
” হ্যাপি, হ্যাপি বার্থ ডে স্নেহা!”
বলেই মুখের ভিতর ছোট একটি কেকের পিস তুলে নিলো। নিজের পেটের মাঝে হাত বুলিয়ে বলল,
” বেবি, আপনি জানেন? আজ আমার বার্থডে।আম্মুর সাথে তুমিও উপভোগ করো কেক। খুব মজা তাই না,? বেবি, তুমি আমাকে ছেড়ে কখনো যেও না, তাহলে এই শূন্য পৃথিবীতে আমি মৃত লাশ হয়ে যাবো! আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসবো। বাবা-মা দু’জনের ভালোবাসা দিবো।”
স্নেহা হাসলো। সেই মুহূর্তে একজন ওয়েটার এসে একটি ট্রে নিয়ে দাঁড়ালো তার টেবিলের সামনে। স্নেহা প্রশ্ন চোখে তাকাতেই, ওয়েটার হাসি মুখে বলল,
” ম্যাম আজ একজন কাস্টমারের ওয়াইফের বার্থ ডে তাই উনি সবার সাথে কেক খাচ্ছেন। ”
স্নেহা অবাক হলো। সাথে খুশি। এমন ভাগ্যবান ক’জন হয়? স্নেহা গ্রহণ করলো। সেই যুগলকে দেখার প্রবল ইচ্ছে লুকাতে না পেরে বলল,
” আপনি কি বলতে পারেন? উনারা কোন টেবিলে বসে? আমি এমন একজন মানুষকে ধন্যবাদ আর শুভকামনা দিতাম।”
ওয়েটার ভিতরের একটি টেবিলের দিকে ইশারা করলো। স্নেহা সেদিকে তাকাতেই তার চোখ যেন ছানাবড়া। ধক করে উঠলো। একাকি বসে আছে দিলশাদ। হাতে ছোট একটি ছবি। যার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। স্নেহা না চাইতেও কিছুটা কাছে গিয়ে থেমে গেলো। দিলশাদের মৃদু কথা শুনে,
” হ্যাপি বার্থডে স্নেহা। আই মিস ইউ, আই লাভ ইউ, প্লিজ কাম ব্যাক!”
দিলশাদ চোখ বুঝলো। চোখের কোনে তার চিকচিক করছে জলো রাশি। স্নেহার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আজ পাঁচ দিন পর দেখছে দিলশাদকে। মনে হচ্ছে তার বয়স ১০ বছর বেশি হয়ে গেছে। গোছালো মানুষটা আজকে এলোমেলো। দাঁড়ি হয়তো বেড়েছে কিছুটা। চুল গুলোও পড়েছে কঁপালে। স্নেহার বুকের ভিতরটা ভাড় হয়ে গেলো। সেদিন সেহেরকে উনি সকলের সামনে এক লাথি বসিয়েছিলো পেটে। তারপর টেনে হিছড়ে মাটিতে ফেলে এলো পাথাড়ি মেরেই চলেছিলো। সেহেরের ফর্সা শরীর ক্ষত বিক্ষত করতে ২ সেকেন্ড ভাবেনি দিলশাদ। দিলশাদের এমন কাজে সবাই হতভম্ব হয়ে গেছিলো। দিলশাদকে টেনে তার বাবা আর কিছু গার্ডস সরিয়ে নিয়ে ছিলো। সেই আধমরা অবস্থাতেই সেহেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। মেয়ের এত শত পাপ কর্ম দেখে তালুকদার বংশ হতভম্ব। চেয়েও মেয়েকে বাঁচাতে পারেনি। স্নেহার কানে সব এসেছিলো। স্নেহা হা করে শ্বাস নিলো। এবং পিছনে ফিরে চলে যেতে নিতেই, কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। মাথা তুলে তাকাতেই, মাহাদের ফেকাসে মুখটি ভেসে উঠলো। স্নেহা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“মাহাদ আপনি এখানে?”
” আন্টি পাঠিয়েছেন তোমায় খুঁজতে। টেনশন করছেন উনি!”
তারপর মাহাদ পিছনে ফিরে দিলশাদকে এক পলক দেখলো। লোকটি থেকে সেতো কম কিছু না। তাহলে কেন তার আকৃতা তাকে এক বার ভালো করে চেয়েও দেখে না। এতটা ইগনোর কেনো? মাহাদের হিংসে হয়, বড্ড হিংসে হয়। মাহাদ কিছুটা শক্ত কন্ঠে বলল,
” আকৃতা পাস্ট ইজ পাস্ট। তুমি তোমার অতীতে স্নেহা হলেও এখন কিন্তু তুমি আকৃতা। কেন নিজের অতীত ভুলে এগিয়ে যাচ্ছো না?”
স্নেহা বলল,
” আমার চেহারা পাল্টেছে মাহাদ। দেহো টা না, মনটা না। কিছু অনুভূতি, কিছু স্মৃতি, কিছু মানুষ কখনো ভুলা যায় না। ”
মাহাদের শরীরে রাগে রি রি করে উঠলো। স্নেহার বাহু ডোড়ে চেপে ধরে বলল,
” আকৃতা তুমি এখন শুধুই আকৃতা। বুঝলে?”
স্নেহা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। আশ্চর্যবোধক চিন্হটা মুখে ঝুলিয়ে বলল,
” মি: মাহাদ? করছেনটা কি? ছাড়ুন? আমি ব্যথা পাচ্ছি। কি চাইছেন টা আপনি বলুন তো? প্লিজ লেট মি গো!”
মাহাদ ছেড়ে দিলো। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো,
“আকৃতা ? আমি তোমার বাচ্চার বাবা হতে চাই, দিবে কি একটা সুযোগ? ”
স্নেহা চমকালো। মাহাদের আকুলতা ভরা কন্ঠ শুনে স্নেহা মাহাদের দিকে তাকালো। মাহাদের চোখ ভরা আশা দেখে স্নেহার কষ্ট লাগলো। আজ যদি সত্যি আকৃতা থাকতো? তাহলে মাহাতে এই কেয়ারিং সাইডটা দেখে বোধহয় খুব খুশিই হতো। কিন্তু স্নেহা ভাবলেশহীন ভাবে রইলো। ওকে দেখে এই মুহুর্তে বোঝা যাচ্ছে না! কি উত্তর দিবে? তাকে কি মাহাদকে একটা সুযোগ দিয়া উচিত? নাকি নিজের সন্তানকে নিয়েই বাকিটা জীবন পাড় করে দিয়া উচিত?
—————–
ঘন কালো কুচকুচে একটি অন্ধকার ঘর, আলো বলতে কিছুই নেই। সেহের চেচিয়ে উঠলো,,
” হেল্প, প্লিজ হেল্প। কেউ আছো?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। সেহের ভয়ে কাচুমাচু হয়ে যাচ্ছে। হুট করেই কিছু একটা তার কোলে উঠে পড়তেই সেহের আবারো চিৎকার করলো। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো এই ঘরটিতে অনেক গুলো ইঁদুরের বসবাস। সেহের ছুটাছুটি করতে শুরু করলো। আঁধারের মাঝে এদিক সেদিক বেজে থুমথাম পড়ে যাচ্ছে। সেহের কিছুতেই বুঝতে পারছে না, সে তো জেলে ছিলো, এমন একটি কামড়ায় কিভাবে এলো সে? ঠিক কিছুক্ষণ পর সেহেরের ভাবনা চিন্তার বাহিরে গিয়ে দরজাটি খুলে গেলো। আলোর ঝলক আসতেই সেহের চোখ বুঝে নিলো। তখনি কিছু নেকড়ে কুকুরের ডাক শুনে সেহের ঘাবড়ে গেলো। লোকটিকে কিছু বলার পূর্বেই কুকুর ঘুলোকে ছেড়ে দিয়ে আবারো দরজা বন্ধ করে দিলো লোকটি। ভিতর থেকে ভেসে আসতে লাগলো সেহেরের গগনবিদারী চিৎকার। বাহিরেই রোলিং চেয়ারে বসে দিলশাদ এই চিৎকার শুনে তার কানকে আরাম দিচ্ছে। আশেপাশে দাঁড়ানো লোক গুলো তাদের বসের ভাবলেশহীন মুখ দেখে অবাক হচ্ছে। লোকটি কতটা নির্দয়? এভাবে একটি মেয়েকে শাস্তি দিচ্ছে, অথচ কঁপালে এক ফোঁটা ভাজ নেই। দিলশাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট মনে মনে ভেবেই পাচ্ছে না, এই হিংস্র মানুষটিকে, কিভাবে মেয়েরা ভালোবাসে, কিভাবে তার প্রেমে হাবুডুবু খায়? কিভাবে?
—————
তারুন আজ দেশে ফিরেছে। লোকটির গম্ভীরতা একে বারেই দিলশাদের মতো। এই দুই ব্যাক্তির ভিতরে কি চলে বোঝা বড় মুশকিল। স্নেহা তারুনের রুমের সামনে গিয়ে নক করলো,
” ভাই, আসবো?”
তারুনে হ্যাঁ বলতেই স্নেহা ভিতরে চলে গেলো। তারুনকে দেখে স্নেহার খারাপ লাগলো, যাকে ভালোবাসলো, সেই ব্যক্তিটির জন্য এখনো বসে আছে। শেখ বাড়ির মানুষ জন চেয়েও ছেলেটিকে বিয়ে করাতে পারেনি। এবার তো সকলেই হাড় মেনে বসে আছে। অথচ লোকটি তার পরিবারকে কতটাই না ভালোবাসে। স্নেহা গলা ঝাড়লো,
” ভাই আকৃতা এখন কেমন আছে?”
তারুন ফাইলে মুখ গুঁজে ছিলো। স্নেহার মুখটির দিকে তাকালো এবার। ঠিক যেন তার বোনটি দাঁড়িয়ে আছে। তারুন এবার জানালার দিকে তাকালো। কলমটি ফাইলের উপর রেখে বলল,
” সে এখন ভালো আছে, তবে..!”
” তবে?”
তারুন সুপ্তপর্ণে শ্বাস লুকিয়ে ফেললো,
” ও আমাদের কাউকে চিনতে পারছে না।”
স্নেহা বলল,
” ভাই আকৃতাকে নিয়ে আসো এখানে, দেখবে পরিবারের মাঝে থাকলে সব ঠিক হবে!”
তারুন বলল,
” তুমি কি তাই চাও।” জানো তো? ও আসলে কি হবে?”
স্নেহা মাথা নাড়লো,
” আমি বাবা-মাকে সব সত্য বলে দিতে চাই।”
তারুন মাথা হেলিয়ে চোখ বুঝলো। বলল,
” তাহলে তুমি সত্যি দেশ ছাড়ছো?”
স্নেহা খানিক চুপ রইলো। এই পরিবারের মানুষ গুলো তাকে কতটা ভালোবেসেছে, সে কখনো ভুলবে না, তবে নিজের অস্তিত্বটা কি তা সে কিভাবে ভুলে যাবে? দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আকৃতা চোখ খুলেছে। কখনো না কখনো সে তো চাইবে তার পরিবারকে? তারুন এত দিন সত্যিটা লুকিয়ে গেছে, কারণ আকৃতা কখনোই নাকি কোমা থেকে বের হবে না বলেছিলো ডাক্তাররা। তাই তো এতদিন সবাইকে মিথ্যা কাহিনি বলেছে তারুন। কিন্তু এখন? স্নেহা তো পরগাছা। প্রতিবারের মতো এবারো, তার প্রিয় মানুষ গুলোকে ছেড়ে দিতে হবে। স্নেহা নিজেকে শক্ত করলো। হাসি মুখে বলল,
” একদিন তো যেতেই হতো। ”
তারুন বলল,
” স্নেহা, এভাবে বলো না। মনে রেখো, এই পরিবার তোমার। এই পরিবারের মেয়ে হয়েই থাকবে আজীবন। ”
স্নেহা প্রতি উত্তরে আসলো। বলল,
” মনে থাকবে!”
তারুন স্নেহার যাওয়ার দিক তাকিয়ে রইলো।
তাহলে কি এখানেই শেষ হচ্ছে সর্বনাশিনীর কাহিনী?এখানেই কি শেষ স্নেহা আর দিলশাদের ভালোবাসার। স্নেহা কি সত্যি চলে যাচ্ছে সব কিছু থেকে দূরে? দিলশাদ কখনো কি জানবে? তার বাচ্চার কথা? নাকি স্নেহার মতোই অনাথ ভাবে মানুষ হবে তার বাচ্চাটা? কি হবে এর পর??