সর্বনাশিনী,১৯,২০

0
1032

#সর্বনাশিনী,১৯,২০
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
পর্ব-১৯

” মিস আকৃতা কেমন আছেন?”

দিলশাদের গম্ভীর কন্ঠে স্নেহা কেমন যেন দমে গেলো। হাসবার চেষ্টা করে বলল,

” আ’ম ফাইন!”

তাপর নিজের ছেলেকে কাছে টেনে বলল,

” লুবান! কোথায় চলে গেছিলে?”

লুবান বলল,

” এখানেই মমি!”

লিলিয়ান লুবান আর তার মাকে দেখে ঠোঁট ভেঙ্গলো।হুট করেই কেঁদে দিলো। স্নেহা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। লুবানকে ছেড়ে লিলিয়ানকে ধরে বলল,

” কি হয়েছে আম্মু? তুমি কাঁদছো কেন?”

লিলিয়ান ফোপাঁতে ফোঁপাতে বলল,

” মমি, মমি!”

স্নেহা কিছু বলবে তার আগেই কেউ একজন পিছন থেকে লিলিয়ানকে কেড়ে নেয়। স্নেহা, দিলশাদ দুজনেই হতভম্ব। পিছনে ফিরতেই আবিস্কার করে আগুন্তকঃ আর কেও না মারিয়া। মারিয়া লিলিয়ানের কান্না থামাতে থামাতে বলল,

” মমি এইখানে বাচ্চা, ডোন্ট ক্রাই।”

লিলিয়ান আরো জোড়ে কেঁদে দিলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্নেহার বুকের ভিতর কাচ ভাঙ্গার মতো শব্দ হতে লাগলো। স্নেহা বিড়বিড় করে বলল,

” মারিয়া তাহলে লিলির মা!”

কিন্তু মুহুর্তেই তার ভাবনায় ফোড়ন পড়লো। লিলিয়ান মারিয়াকে নাকে মুখে আঘাত করে চেচিয়ে উঠলো,

” তুমি আমার মা না, তুমি আমার মা না!”

মেয়েকে হাইপার হতে দেখে, দিলশাদ নিজের মেয়েকে কাছে টেনে নিলো। বুকের সাথে মিশিয়ে মারিয়াকে শক্ত কন্ঠে বলল,

” তুমি আমার মেয়েকে একা কেন ছেড়েছো?”

মারিয়া ঘামতে লাগলো। আমতা আমতা করে বলল,

” দিল, আমি একটু ফোনে কথা বলছিলাম, কখন যে লিলি বেড়িয়ে গেলো…!”

দিলশাদ মুহুর্তেই হিংস্র রাক্ষসের মতো হয়ে গেলো। এই মেয়েটিই তো তার বাঁচার ভরসা। এর যদি কিছু হয়? দিলশাদ কি করবে? মরেই তো যাবে সে!

” কাল থেকে তোমার আর প্রয়োজন নেই মারিয়া, তুমি এসো না!”

মারিয়ার চোখে মুখ হতাশা ফুটে উঠলো। ঢুকুর তুলে কেঁদে বলল,

” দিলশাদ গিভ মি অ্যা চান্স?”

“নোহ!”

মারিয়া বেড়িয়ে গেলো। দিলশাদের মাকে অবশ্যই খবরটা দিতে হবে! না হলে আবার এই চাকরিতে সে ঢুকতে পারবে না। মারিয়া যেতেই স্নেহা প্রশ্ন করলো,

” মি: আমরিন, লিলিয়ান?”

দিলশাদের মুখের ক্রোধ মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়ে হাসি ফুটে উঠলো,

“, হ্যাঁ ও আমার মেয়ে। আমার স্নেহার অংশ!”

স্নেহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তার অংশ মানে কি? লুবান? এক মাত্র লুবানই তার অংশ। তাহলে?

” স্নেহার অংশ মানে, স্নেহা তো মারা গেছে!”

দিলশাদ লিলিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” নাহ্ ও বেঁচে আছে!”

————–

স্নেহা রুমের ভিতর পায়চারী করছে। লুবান অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শেখ বাড়িতে আসার পর এখনো তারুনের সাথে দেখা হয়নি । কোনো এক কাজে আটকে আছে। স্নেহা তারুনের সাথে কথা না বলে আজ আর ঘুমাবে না। তার অনেক কিছু জানা দরকার। যার উত্তর শুধু তারুন দিতে পারবে। স্নেহা আর না পেরে তারুনকে ফোন করলো। ফোন বিজি দেখাচ্ছে। তাই সে টেক্সট করলো,

” ভাই আপনি কোথায়?”

ওপর প্রান্ত থেকে সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এলো,

” আমার খুব জরুরি কাজ পরে গেছে, আমি আউট ওফ কান্ট্রী যাচ্ছি! দু এক দিনের ভিতর চলে আসবো!”

স্নেহা হতাশার শ্বাস ছাড়লো। কিভাবে পারবে এই রহস্য থেকে বের হতে? স্নেহা সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলো। ভরে দরজায় টুকা পড়তেই ঘুম ভাঙলো তার। দরজা খুলতেই তারুনের মাকে দেখতে পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে,

” স্নেহা মা কেমন আছিস? ”

” ভালো আছি, মা!”

” তোমার এখন শরীর কেমন?”

” ঠিক আছি, তোকে দেখার স্বাদ জাগছিলো খুব তাই তারুনকে বললাম। নয়তো আজ নিজের মেয়েটাও মাহাদের সাথে বিয়ের পর অন্য দেশে পাড়ি জমিয়েছে!”

স্নেহা হাসলো,

” তো কি হয়েছে, আমিতো আছি মা!”

তারুনের মা হাসলেন। স্নেহার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বললেন,

” আগের কথা কি ভাবলি?”

স্নেহা তার ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

” আমার জীবন এখন সেই মা!”

তারুনের মা মনে মনে ভাবলেন,

” যদি স্নেহা জানতে পারে তার মেয়ের কথা? কি করবে তখন?”

উনি বললেন,

” দিলশাদের কথা কি ভাবলি?”

” ওটা পাস্ট মা। আমি সুখে আছি। লুবানি আমার জীবন। আর কাউকে নিয়ে ভাবতে চাই না!”

তারুনের মা উঠে পড়লেন। অনেক কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলেন না। মেয়েটির জন্য খুব কষ্ট হয় তার। এতটুকু বয়সে কত কি না সইলো, আর এখন একা একাই মানুষ করছে ছেলেকে। তারুনের মা উঠে পড়লেন। যেতে যেতে মা আর ছেলেকে এক পলক দেখে নিলেন। কি মধুর সম্পর্ক তাদের।

————-

তারুন তার পর দিন ফোন করলো। স্নেহা ছেলেকে নিয়ে রেডি হচ্ছে। শহরটাকে ঘুরাবে বলে। স্নেহা ফোন ধরতেই তারুন বলল,

” স্নেহা আই নিড ইউর হেল্প।”

” বলুন ভাইয়া!”

” দিলশাদের কম্পানীর সাথে আমাদের কোম্পানি ডিল করেছে। আমি দেশের বাহিরে যার জন্য কিছু করতে পারছি না। তুমি একটু ফাইলটা পৌছে দিতে পারবে? সে নিজের বাসায় আছে!”

স্নেহা সাত-পাঁচ ভেবে হ্যাঁ জানালো। ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়ে পরলো গন্তব্যে। লুবান তার পছন্দের বাড়িটির সামনে আবার আসতে পেরে লাফিয়ে উঠলো,

” মমি, আমরা এখানে কি ঘুরতে এসেছি?”

স্নেহা ছেলের মাথার চুল ঠিক করে হ্যাঁ জানালো। তারপর এগিয়ে গেলো ভিতরে। স্নেহার মনে অজানা ভয় কাজ করতে লাগলো। পুরোনো স্মৃতি গুলো ভেসে ভেসে উঠতে লাগলো। এই বাড়িটিতে তিক্ততায় ভরা সব অতীত মুছতে চেয়েও পারেনি স্নেহা। স্নেহা ভাবতে ভাবতে দরজায় নক করলো। ক্যায়ার টেকার এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো,

” কাকে চাই?”

স্নেহা বলল,

” দিলশাদ আমরিন? ”

” আপনি আকৃতা শেখ? ”

স্নেহা মাথা দোলালো।

” স্যার উপরের আছেন সোজা চলে যান!”

স্নেহা লুবানকে সোফায় বসিয়ে উপরে উঠে এলো। স্নেহা যেতেই ভ্রু যুগল কুচকে একটি বার্বি ডলের মতো মেয়ে এসে দাঁড়ালো লুবানের সামনে। লুবান দিলশাদের মতো ঠান্ডা আর গম্ভীর ভাবেই বসে রইলো। যেন তাকে সে দেখেই নি। লিলিয়ান তার ছোট ছোট পায়ে গুটি কয়েক কদম এসে মিষ্টি সুরে বলল,

” ভাইয়া?”

লুবান এবার মুখ তুলে তাকালো। বাচ্চা মেয়েটিকে দেখলে লুবানের কাছে কেন জানি মনে হয়, অনেক আংশে মেয়েটি তার মতোই। কিন্তু কেন? লিলিয়ান বলল,

” ভাইয়া তুমি এখানে কেন?”

” মমির সাথে এসেছি!”

লিলিয়ান খুশি হয়ে বলল,
” মমি এসেছে!”

” সে তোমার মমি না!”

লিলিয়ান মন খারাপ করে বলল,

” আমি কি তাকে মমি ডাকতে পারি? আমার না মমি নেই।”

লুবানের বড্ড মায়া হলো। বলল,

” ওক্কে!”

লিলিয়ান দাঁত বের করে হাসলো। বলল,

” ইয়ে… এই খুশিতে চলো তোমাকে আমাদের বাসা দেখাই?”

লুবান না করলো না, এই বাসার প্রতি আলাদা টান জম্মেছে কেনো যেন তার।

এদিকে দিলশাদের সামনে বসে আছে স্নেহা। অনেকটা অস্বস্তি হচ্ছে তার। তবুও প্রকাশ করছে না সে। লোকটি আড় চোখে একবার দেখলো স্নেহা। আগের মতোই আছে যেন, তবে খানিকটা শুকিয়ে গেছে। হয়তো ঠিক মতো খাচ্ছে না, ঘুমুচ্ছে না বলে? পরক্ষনেই স্নেহার মনে লিলিয়ানকে নিয়ে প্রশ্ন জাগে স্নেহার। গলা ঝেড়ে কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে,

” লিলিয়ান… লিলিয়ান কি সত্যি আপনার মেয়ে?”

দিলশাদ ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেয়,

” এনি ডাউট? ”

স্নেহা থতমত খেয়ে যায়,

” না না। তা হবে কেন? আমার জানা মতে স্নেহা তো মরে গেছে, তাহলে আপনি যে বললেন?”

দিলশাদ যে কাজ করছিলো তা নামিয়ে রাখলো। জানালা দিয়ে বাহিরের তাকালো। নীল আকাশ মেঘ নেই। একদম পরিস্কার। ঠিক দিলশাদের ভাগ্যের মতো। দিলশাদ এবার সরাসরি স্নেহার দিকে চাইলো। মেয়েটি বার বার তাকে স্নেহার কথা মনে করিয়ে দেয় কেন? স্নেহা তো আছে, কিন্তু লুকিয়ে আছে, অভিমান করে দূরে সরে আছে। আচ্ছা থাক না দূরে একবার না একবার তো তাকে দিলশাদের কাছে আসতেই হবে, ধরা তো দিতেই হবে কি-না? দিলশাদ নিজের চোখ মুখে হাত বুলালো। এখনো মনে আছে সে দিনটির কথা… শীতকাল,মধ্যে রাত। বাহিরে ঠান্ডা হার কাঁপানো বাতাসের মাঝে কেউ একজন দরজা নাড়লো। দিলশাদ তখন কাজ করছিলো অফিসের। এত রাতে কে এসেছে দেখার জন্য দরজা খুলতেই ঝুড়িতে ফুটফুটে একটি বাচ্চা মেয়েকে দেখে বুকের ভেতর মেঘের ডাকের মতো গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হতে লাগলো। বাচ্চা মেয়েটি তাকিয়ে ছিলো। বড় বড় চোখ করে দেখছিলো। কতটুকুই হবে তখন এই এক বা দুই দিনের। দিলশাদের মনে তখন পিতার ভালোবার, মায়ার বন্যা বয়ে গেলো। বুকে কাছে টেনে নিতেই শান্তি শান্তি অনুভব করলো। এইটুকুন বাচ্চা কত মায়ায় ঢুবিয়ে ফেলেছে দিলশাদকে। সেদিন বাচ্চার সাথে একটি নোট পেয়ে ছিলো দিলশাদ। তাতে লিখা ছিলো,

” আমার শরীরের একটি অংশ তোমাকে দিলাম। যেভাবে আমাকে অবহেলায় দূরে ঠেলে দিয়েছিলে? এই বাচ্চাটি তেমন অবহেলা করো না। তাহলে আমি আর কখনো তোমাকে ক্ষমা করবো না দিলশাদ। জানো এই বাচ্চাটি আমার সব, বুকের মাঝে আগলে রেখো। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করো না। আমি ভালো আছি। আর হ্যাঁ ওর নাম রেখো ” লিলিয়ান ”

ইতি
স্নেহা”

দিলশাদের চোখ ভিজে উঠলো। নিজেকে সামলাবার বৃথা চেষ্টা করলো। স্নেহাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” আর কিছু জানার আছে?”

স্নেহা মাথা নাড়ালো। কিছুই জানার নেই। সত্যি বলতে অনেক কিছু জানার আছে, কে এই ব্যক্তি? যে স্নেহা সেজে এভাবে দিলশাদকে ঠকিয়েছে? কে এত বড় একটা মিথ্যা বলছে তার নাম করে। কই স্নেহা তো কখনো দিলশাদকে চিঠি দেয় নি। না কখনো নিজের অংশ দিয়েছে। স্নেহা তা কখনোই করতে পারবে না। একদম না। নিজের মেয়েকে সে কিভাবে আলাদা করবে? তার থেকে বড় কথা, তার তো একটি ছেলেই!..

স্নেহার ভাবনার ফোঁড়ন পড়লো। লুবান আর লিলিয়ানের এক সাথে চিৎকার পুরো বাড়িতে হা হা কার করে তুললো। দুজনেই এক ছুটে বাড়ির বাহিরে এসে পড়লো। আর সামনে যা দেখলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না কেউ।

ঘন্টা খানেক পর…

স্নেহা আর দিলশাদ বাহিরে বসে আছে। অপারেশন থিয়েটারের লাল বাতি জ্বলছে। দিলশাদ স্নেহার হাত শক্ত করে চেপে বসে আছে। যেন একটি পাথরের মুর্তি। স্নেহাও এমন একটি কান্ডে হতভম্ব। কিভাবে লুবান আর লিলিয়ান একতলা থেকে নিজে পড়ে গেলো এক সাথে? এমনিটি তো হবার নয়… তাহলে কিভাবে হলো এমন? দু’জনেরই মাথা ফেটে গেছে। হাত পা ছুলে গেছে। রক্ত বয়ে গেছে খুব। স্নেহা দুটো বাচ্চা এই রক্তাক্ত অবস্থা কিছুতেই ভুলতে পারছে না।

অপারেশন থিয়েটারের লাল বাতি নিভে গেল। ডাক্তার দৌঁড়ে বেড়িয়ে এলো। বলল,

” আপনাদের বাচ্চাদের ব্লাড প্রয়োজন। তবে ছেলেটির জন্য আমরা ব্লাড পাচ্ছি না।’ ও’ নেগেটিভ এই ব্লাডগ্রুপটা রের। যদি আপনাদের মাঝে কারো থাকে জলদি আসুন।”

স্নেহার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো। দিলশাদের ব্লাড গ্রুপ ‘ও’ নেগেটিভ। স্নেহা বিচলিত হয়ে বলল,

” ডা. দিলশাদের ব্লাড ‘ও’ নেগেটিভ। ও ব্লাড দিবে!”

দিলশাদ এক মুহুর্তের জন্য চমকে গেলো। মি. আকৃতা কিভাবে জানে তার ব্লাড গ্রুপের খবর? কিন্তু সে কিছু বলল না। মনের কোনে সন্দেহের বীজ বুনতে শুরু হলো দিলশাদে। এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে সে চলে গেলো ডাক্তারের কাছে। এবং ব্লাড দিতে লাগলো। দিলশাদ হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে ভড়ছে ব্যাগে। দিলশাদের সেদিকে খেয়াল নেই। সে ভাবনায় ব্যস্ত… আকৃতা শেখের সাথে লুবানের কি সম্পর্ক? যতটুকু জানে গত বছর আকৃতার সাথে মাহাদের বিয়ে হয়। এত জলদি কিভাবে এত বড় বাচ্চার মা হয় সে? সত্যি কি যা দেখা যাচ্ছে তা সিম্পল? নাকি এর ভিতর কোনো রহস্য আছে?? দিলশাদ বিছানায় শুয়েই কাউকে কল দিলো। ১০ মিনিটের মাথা সব ডিটেইলস চলে এলো দিলশাদের ফোনে। ততখনে ব্লাড নেয়া শেষ। দিলশাদ ডাক্তারকে বলে,

” আপনার একটু সাহায্য লাগবে, আমি এই বাচ্চা দুজনের ডি এন এ টেষ্ট করাতে চাই!”

ডাক্তার মাথা নাড়লো। এবং চলে গেলো। দিলশাদ এখনো শক্ত হয়ে বসে আছে। হয়তো নিজের রাগ দমানোর চেষ্টা করছে। তারুনের বোন বলে দিলশাদ এই আকৃতা শেখকে নিয়ে কখনো ভাবেনি। কিন্তু তার নাকের ডগার নিচ দিয়ে এত কিছু হয়ে গেলো? এত বছরে… সে টের পেলো না? হোয়াই? দিলশাদের জবাব চাই সব কিছুর। এই ছ’টি বছরের হিসাব, ছ’টি বছরের প্রতিটি দিন, রাত, মুহুর্তের হিসাব চাই তার। দিলশাদ উঠে পায়চারি করতে লাগলো। কিছু মুহূর্তের মাঝে ডাক্তার একটি কাগজ নিয়ে উপস্থিত হলো। কাগজটি দেখেই দিলশাদ বাঁকা হাসলো। হিংস্রতা ফুটে উঠেছে সেই হাসিতে। এত বড় ধোকা তার সাথে? এত বড়? দিলশাদ কাগজটি হাতে বাহিরে বেড়িয়ে এলো। স্নেহা তখনো বাহিরে বসার জায়গায় চিন্তিত মুখে বসে। দিলশাদ এক ঝটকায় টেনে তুললো স্নেহাকে পাশের একটি খালি রুমের ভিতর ছিটকে ফেললো স্নেহাকে। হঠাৎ এমন একটি ঘটনায় স্নেহা বিস্মিত হয়ে গেলো। কিছু বুঝে উঠবার আগেই দিলশাদ বলতে শুরু করলো,

“তুমি আমাকে এভাবে কেন ঠকালে স্নেহা? আমি জানি আমি অনেক বড় দোষ করেছি, তোমার কাছে অপরাধী। তাই বলে এত বড় শাস্তি আমাকে কেন দিলে? তুমি জানো? আমি যে এখনো জিন্দা লাশ? আজ লিলিয়ান পাশে না থাকলে হয়তো আমি মরেই যেতাম!”

দিলশাদ এবার পূর্ণ দৃষ্টি দিলে চাইলো স্নেহার দিকে। মেয়েটি আজো তাকে ভয় পায়? স্নেহা কাচুমাচু হয়ে আছে। মনে হচ্ছে দিলশাদ বুঝি এখনি তার গায়ে, হাত-টাত তুলবে?স্নেহা পিছিয়ে গেলো দু কদম। তা দেখে দিলশাদ তার গম্ভীর বরফ কন্ঠে শক্ত ভাবে বলল,

” স্টোপ স্নেহা! আর কোথাও তোমাকে পালাতে দিচ্ছিনা আমি!”

চলবে,

#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-২০

প্রকৃতি মানুষকে অনেক কিছু শিখায়… তেমনি বাঁচতেও শিক্ষায়। স্নেহাও শিখে গেছিলো। কিন্তু জীবন নামক গোলাক ধাঁধাঁয় আবার কিভাবে যেন জড়িয়ে পড়লো। স্নেহা দিলশাদের মুখের দিকে চাইলো। ক্লান্ত শ্রান্ত চেহারা। যেন বয়স হঠাৎ করেই দশ বছর বেড়ে গেছে। হেরে যাওয়া একটা মানুষ। একজন পিতা। দিলশাদ স্নেহার বাহু ডোরে শক্ত করে চেপে ধরলো,

” স্নেহা ডোন্ট গো, প্লিজ ফোরভিম মি! ”

স্নেহা অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে চাইলো,

” মনে আছে, সেদিন আমি আপনাকে বলেছিলাম, আমাকে ফেলে না যাতে, পায়ে পর্যন্ত পড়েছিলাম আপনার। আপনি শুনেন নি, তাচ্ছিল্য করে ছিলেন আমায়। আপনার এই ভালোবাসা আমার কাছে, এখন মূল্যহীন!”

দিলশাদ হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। চোখে দুটি ভর্তি জল টলটল করছে, এই বুঝি ঝুপ করে আসা বৃষ্টির মতো ঝড়ে যাবে! স্নেহার বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলো। তবুও নিজে সামলে নিলো। এত অবহেলা, এত কষ্টে নিজেকে সামলে নিতে শিখেছে যে স্নেহা। দিলশাদের গলা ধরে এলো। স্নেহার আঙুলের মাঝে বাচ্চাদের মতো হাত দুটো ধরলো। যেন কোনো বাচ্চা বায়না করছে। দিলশাদ বলল,

” স্নেহা, আমি যা করেছি, তার জন্য আমি লজ্জিত। আমি ক্ষমা চাইছি স্নেহা। প্লিজ ক্ষমা করে দাও।”

স্নেহা ফিচেল হাসলো,

” আচ্ছা করে দিবো ক্ষমা। তবে আপনাকে আমার হারিয়ে যাও সাতটি বছর ফিরিয়ে দিতে হবে। আমার পরিচয়, আমার চেহারা, আমার অস্তিত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। পারবেন? পারবেন দিতে?”

দিলশাদ স্তব্ধ হয়ে গেলো। আলতো করেই তুলোর মতো যেন ছুটে গেলো তার হাত। সত্যি তো, দিলশাদ কখনোই পারবে না, কখনোই না। তাহলে কি দিলশাদ আরো একবার হারাবে তার স্নেহাকে? দিলশাদের এবার শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। এই বুঝি মরেই যাবে সে শ্বাসকষ্টে। দিলশাদ মাথা নত করে ফেললো। চোখের জল গড়িয়ে পরছে এবার ফ্লোরে। মুক্ত দানার মতো চিকচিক করছে লাইটের আলোয়। দিলশাদ আর চোখে তাকালো। স্নেহা চলে গেছে প্রায় দরজার কাছে। দিলশাদ নিস্তেজ হয়ে রইলো। ভাঙ্গা গলায় নিস্প্রভ চাহনিতে বলল,

” স্নেহা লুবান আর লিলিয়ানের কথাটা ভাবো?

স্নেহার পা দাঁড়িয়ে গেলো। যতটা কঠোর তার মন দিলশাদের প্রতি হয়েছে অতটা একটি মার মন তো হয় না? চাইলেও করতে পারবে না! তবে.. তবে স্নেহার মনে হচ্ছে এটাও হয়তো নতুন কোনো ফন্দি? স্নেহা তাই পিছনে না ফিরেই বলল,

” আমার একটি মাত্রই সন্তান। তার নাম লুবান। ”

দিলশাদ যতটুকু শক্ত ছিলো, এবার আর তা রইলো না। হেলে পড়লো। তার মনে হচ্ছে, এই মুহুর্তে তাকে কেউ হয়তো লাঠি পিটা করেছে কেউ? স্নেহা সত্যি এতটাই কঠিন হয়ে গেছে? যে নিজের মেয়েকেই চায় না সে? দিলশাদ তার ভাবনার মাঝেই ঢুবে রইলো। স্নেহা স্থান ত্যাগ করলো তাৎক্ষণিক। বুকের ভিতর তারো হাতুড়ি পেটা করছে । মনটাকে হয়তো কেউ কয়েকশ পিস করেছে কেউ কেটে? স্নেহা দৌড়ে এসে দাঁড়ালো লুবান আর লিলিয়ানের রুমের সামনে। স্বচ্ছ কাচের ভিতর ছেদ করে দেখা যাচ্ছে ছোট দুটি ফুটফুটে বাচ্চা গুলোকে। স্নেহার চোখ ভর্তি জল গড়িয়ে পড়লো। ঢুকরে উঠলো বার বার। সত্যি সত্যি কি লিলিয়ান তার অংশ? এই ছোট জানটা কি সত্যি তার মেয়ে? কিন্তু তা কি আদো সম্ভব? দিলশাদ আবারো হয়তো তাকে ঠকাচ্ছে? আবারো তাকে নিয়ে কোনো নতুন খেলায় মেতে উঠেছে? স্নেহা চোখ মুছলো। বিড়বিড় করে বলল,

” লিলিয়ান? তুমি সত্যি কি আমার মেয়ে?”

” হ্যাঁ স্নেহা, লিলি তোমার মেয়ে।”

চেনা পরিচিত এক কন্ঠ পিছন থেকে ভেসে আসতেই চমকে উঠলো স্নেহা। পিছনে ফিরে আরো এক দফা চমকালো। তারুন, আকৃতা, মাহাদ, দিলশাদের মা সকলেই উপস্থিত। তারুণ এগিয়ে এলো। মাথা নত করে বলল,

” স্নেহা, আমি… আমি লিলিকে দিলশাদের কাছে দিয়ে গেছিলাম। ”

স্নেহার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। তারুনের দিকে প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে চাইলো। এই পৃথিবীর সবাই বুঝি তাকে এভাবে ঠকাবেই? তারুনের পিছন থেকে দিলশাদের মা বলল,

” স্নেহা, আমিও এই পাপ কর্মের সাথে যুক্ত স্নেহা। আমাদের আর কোনো পথ খোলা ছিলো না সামনে।”

” তাই বলে.. আপনারা আমার মেয়েকে ছিনিয়ে নিবেন?”
এই পর্যায় চেচালো স্নেহা। তারুন বলল,

” স্নেহা তখন পরিস্থিতি এমন ছিলো যে…!”

স্নেহা তারুনকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয় বলল,

” সিচুয়েশনে যেমনি ছিলো? আমি তো মা.. আমার কি জানার অধিকারবোধ টুকু ছিলো না? আমি এত বড় অভাগা? আমার একটি মেয়ে আছে তা আমি জানি না?? গ্রেট! আপনাকে তো আমি ভাই ভেবেছিলাম মন থেকে… তাহলে.. তাহলে কেন করলেন???”

সবাই চুপ করে রইলো। স্নেহা নিজে চুল টেনে ধরলো। তারপর আবার বলল,

” আমি যখন আল্ট্রা স্নো করিয়েছিলাম? তখন-ও তো আমাকে বলেছিলো আমার একটা বেবি, তার মানে, তোমরা সব প্লেন করেছিলে? আমি কাদের মাঝে আছি, প্রতিটা মানুষ ধোঁকাবাজ। আমি আর থাকবো না, কারো সাথে থাকবো না। আমার সন্তাদের নিয়ে চলে যাবো, অনেক দূরে চলে যাবো!”

বলেই স্নেহা তার বাচ্চাদের কাছে যেতে নেয়। ঠিক তখনি মাহাদ স্নেহা হাত দুটি শক্ত করে ধরে বলে,

” পাগলামি করো না স্নেহা। আমাদের কথাটা শোনো!”

স্নেহা মাহাদকে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মারলো। তারপর দরজা ঠেলে যেই ভিতরে যেতে নিলো তখনি একটি বাক্যে থেমে গেলো সে,

” স্নেহা দিলশাদ মরতে বসেছিলো!”

স্নেহা পা দুটি মাটির সাথে লেগে গেলো যেন। সেখানেই স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে গেল। তারুন আবার বলল,

” স্নেহা আমরা বাধ্য হয়েছিলাম। দিলশাদকে বাচ্চানোর একটা রাস্তা দরকার ছিলো স্নেহা।”

স্নেহা ধীরে ধীরে পিছনে ফিরে চাইলো। তারুন স্নেহার হাত টেনে চেয়ারে বসালো। আবার বলতে শুরু করলো,

” স্নেহা সত্যি বলছি, দিলশাদ তুমি চলে যাবার পর থেকেই কেমন যেন হয়েগেছিলো। খাবার দাবার ছেড়ে দিয়েছিলো। রোবটের মতো কাজ আর কাজ করে যেতো। এভাবে মানুষ কদিন বাঁচতো বলো? হঠাৎ একদিন রাতে বাসায় ফিরবার সময় ওর গাড়ি ব্রীজ ভেঙে নদীতে পড়ে যায়। ক্রিটিকাল অবস্থায় হসপিটালে আনা হয়। ডাক্তার তার সব চেষ্টা করে, লাস্ট পর্যন্ত জানায়, রোগী হয়তো নিজেও আর বাঁচতে চায় না। হয়তো এটি এক্সিডেন্ট নয়, এটেম টু সুইসাইড। তার উপর দিলশাদের গুরুতর অ্যাক্সিডেন্টের সে বাবা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ”

এতটুকু শুনেই স্নেহা আঁতকে উঠল। ভয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে গেলো। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো শুধু।

” আমি না পেরেই এই পদক্ষেপটা নেই স্নেহা। দিলশাদ ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে চলে যাচ্ছিলো। আমি ওর বন্ধু হয়ে কিভাবে এত বড় ক্ষতি হতে দেই বলো? জানো, যখন তোমার দুটো বাচ্চা আমার এই হাতে মুঠোয় ছিলো, আমার মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর এই সুখটি যদি দিলশাদ উপভোগ করতে পারতো? তাহলে বাঁচার একটা পথ তার হতো। তাই.. তাই আমি সেদিন স্বার্থপরের মতোই, লিলিয়ানকে নিয়ে আসি। তোমাকে জানাই শুধু লুবানের কথা। বিশ্বাস করবে কি না জানি না… তবে.. দিলশাদ লিলিয়ানকে পেয়ে আবার বাঁচতে শিখলো। স্নেহা বেঁচে আছে এটা জেনেই সে সন্তুষ্ট ছিলো। স্নেহা পাঁচটি বছর কেঁটে গেছে। দিলশাদ শুধু তোমার অপেক্ষাতেই আছে। হে সে তোমাকে চিন্তে ভুল করেছিলো। নিজের ভালোবাসাকে ঊর্ধ্বে রেখেছিলো। সেহেরের প্রতারণায় যেমন তুমি শিকার হয়েছে তেমনি দিলশাদো হয়েছে! এবার কি সব ভুলে এক হওয়া যায় না?”

স্নেহা সব কিছু শুনলো। ভাবলেশহীন ভাবে এবার তাকালো সবার দিকে। উঠে দাঁড়ালো হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে নিজ সন্তানদের কাছে। লিলিয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটির গালে হাত রাখলো স্নেহা।মুখে, কঁপালে, হাতে অসংখ্য চুমু খেলো। তার মেয়ে.. সত্যি তার মেয়ে লিলিয়ান? ছোট বেলায় সে-ও বাবা-মার আদর পায়নি। না পেয়েছে ভালোবাসার মানুষটিকে। হয়ে উঠেছিলো সর্বনাশিনী। কি থেকে কি হয়ে গেলো স্নেহা? কি হয়ে গেলো স্নেহার জীবন? স্নেহা এবার কি করবে? সে কি ছেড়ে দিবে সব.. দূরে চলে যাবে লুবান আর লিলিয়ানকে নিয়ে? নাকি… আঁকড়ে ধরবে আবারো ভালোবাসার মানুষটির হাত….. স্নেহার এই মুহুর্তে কি করা উচিত????

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here