সর্ম্পকের বাঁধন
পর্ব ০১
লেখাঃনীল কাব্য
পাঁচ মাসের ফুটফুটে ছোট বাচ্চা মেয়ে টা কে কোলে নিয়ে বাসর ঘরে বসে আছে আদিবা। ঘরটা তেমন ভাবে সাজানো হয়নি, যেমন ভাবে সাজালে কেউ দেখলে বুঝতে পারবে এটা বাসর ঘর। খুব সাধারণ ভাবেই সাজানো হয়েছে। শুধু কয়েকটা লাল গোলাপ আর কিছু রজনীগন্ধা দিয়ে সাজিয়েছে। সৎ মায়ের লোভের স্বীকার হয়ে ২৭/২৮ বছর বয়সের একটা লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে আদিবার৷ এই তো আজ সন্ধ্যায় তিন বার কবুল বলে আদিবা, আদনান হোসাইন আদিল এর স্ত্রী হিসেবে নতুন পরিচয় পেয়েছে। যেখানে আদিবার বয়স ১৭+। সেখানে ওর স্বামী মানে আদিল এর বয়স ২৮ বছর। আদিবার স্বামী ওর থেকে দশ বছরের বড়। তার উপর আদিল আবার আগে থেকে বিবাহিত। আর আদিবার কোলের বাচ্চা মেয়ে টা আদিল এর সন্তান।
আদিবা এবার সবে মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এখনও রেজাল্ট আসেনি।
ছোট বেলায় মা মারা গেছে যখন আদিবার পাঁচ বছর বয়স। আদিবার বাবা, আদিবার ভালোর কথা চিন্তা করে আবার বিয়ে করে আদিবার জন্য নতুন মা এনেছিল। কিন্তু আদিবার নতুন মা ওর মা হয়ে উঠতে পারেনি। সৎ মা হয়েই রয়ে গেল। আদিবা এখনও কলেজ জীবনে পা দেয়নি। ক্লাস টেনে পড়া মেয়েটার উপর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তুলে দেওয়া হলো। একটা সংসারের দায়িত্ব। জীবনের রঙিন মুহূর্ত, হেসে খেলে পাড় করার দিন গুলো শেষ হওয়ার আগেই আদিবার সৎ মা তার বিয়ে দিয়ে দিল। আদিবা এখন পর্যন্ত আদিল কে দেখেনি। আদিল এখনও রুমে আসেনি। একটু আগে আদিবার ননদ এসে বাচ্চা টা কে আদিবার কাছে এই বলে দিয়ে গেল
“” ভাবী এই নেও তোমার মেয়ে। এবার থেকে ওকে তুমিই সামলাও।””
আদিবা নির্বোধের মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওর ননদের দিকে। কিছু বলতে পারলো না। বাবু টা আদিবার কোলে আসার সাথে সাথে জোরে শব্দ করে কান্না শুরু করে দিল। আদিবা অনেক কষ্টে ওকে শান্ত করে। সব বাচ্চারা যেমন নিষ্পাপ মায়াবী হয়। এই বাচ্চা টা ও তেমনই। চোখ গুলো একটু বড় বড়, চোখের মণি হালকা বাদামি রঙের। গাল এতো সুন্দর দেখলেই একটু আদর করে দিতে ইচ্ছে করে। ছোট ছোট হাত, পা। হাতে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়া সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চাদের যেমন হয় আর কি। দু’হাতে দুটো চুড়ি পড়া মাঝে মাঝে হাত নাড়লে চুড়ি গুলো ছনছন শব্দ করে উঠে। আদিবা বাচ্চা টা কে খুব যত্নে বুকের সাথে হালকা করে জড়িয়ে রেখেছে। বাচ্চা টা খুব প্রশান্তি তে ঘুমাচ্ছে। আর আদিবা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাচ্চা টা কে দেখে যাচ্ছে। হঠাৎ রুমের দরজায় শব্দ হলো। আদিবার স্বামী মানে আদিল রুমে আসছে। আদিল রুমে এসে বেডের কাছে এসে দাঁড়াল। আদিবা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিল বলে উঠলো।
।
“– অন্তীলা ঘুমিয়ে গেছে?
আদিবা প্রথমে বুঝতে না পারলে ও পরে বুঝতে পারলো, এই বাবু টার নাম অন্তীলা।আর আদিল ওর কথা ই জিঙ্গেস করছে। আদিবা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল। আদিল আবার বললো
।
“– তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমি জানি এই কথা গুলো এখন বললেও কিছু হবে না। বিয়ের আগে বললে হয়ত অনেক কিছু হতে পারতো। হয়ত তুমি এ বিয়েটা ই করতে না। আমি আগে থেকে বিবাহিত এটা তো এতক্ষণে বুঝেই গেছো। অন্তীলা আমার আর নিরার সন্তান। ওর আম্মু নিরা ডেলিভারির সময় অন্তীলা আর আমাকে ছেড়ে এ পৃথিবী থেকে চিরতরের জন্য চলে গেছে।
এই কথা টা বলার পর আদিলের কন্ঠ স্বর কেমন যেন ভারী হয়ে গেল। আদিবা বুঝতে পারছিলো আদিলের খুব কষ্ট হচ্ছে। আদিবা এটাও বুঝতে পারলো আদিলের বুকের মাঝে হয়ত চিনচিন ব্যথা অনুভব করছে। আদিবা কিছু বললো না। নিজের সবথেকে কাছের প্রিয় মানুষ টা কে হারানোর কষ্ট কতটুকু এটা আদিবা খুব ভালো করেই জানে। জীবন থেকে এমন মানুষ গুলোর চলে যাওয়ায় জীবন থেমে থাকে না। কিন্তু জীবনের চলার পর অনেকটা কঠিন হয়ে যায়।
।
“– আমি আর নিরা পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে লাভ ম্যারেজ করেছিলাম। ওর ফেমিলির আর আমার ফেমিলির কেউ ই আমাদের বিয়েটা মেনে নেয়নি। ভালোই ছিলাম আমরা একসাথে। দু’জনে মিলে আমাদের ছোট ছোট স্বপ্ন, ইচ্ছে গুলো কে পূরণ করে সুখে শান্তিতে সংসার করছিলাম। কিন্তু কথায় আছে না, সবার কপালে সুখ সয় না। সুখের মুহূর্ত গুলো খুব কম সময়ের জন্য আসে। আমাদের কপালেও সুখ সইলো না। দুটি পরিবারের মানুষ গুলোর মনে কষ্ট দিয়ে আমরা সুখী হতে পারলাম না। সুখ আমাদের কাছে ধরা দিয়েছিল। কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী সময়ের জন্য নয়। আন্তীলার জন্মের কিছুক্ষন পর ই নিরা আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে। কিছু মুহূর্তের জন্য ও নিরা তার ছোট সোনামনি টা কে কোলে নিয়ে একটু আদর করতে পারলো না।
আমি আজও নিরা কে ঠিক আগের মতই ভালোবাসি।
আদিল আর কিছু বলতে পারলো না। তার গলায় কথা বেজে গেল। চোখের কোণে নোনাজল গুলো উঁকি দিয়ে উঠছে। আজকাল চোখের জল ও আদিলের অবাধ্য হয়ে উঠছে। নিরার কথা মনে করলে, না চাইতে ও ওরা চোখ থেকে অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়তে চায়। আদিল চোখ মুছে কিছুক্ষন চুপ থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল।
।
“– আমার ভাগ্য টা ই এমন। ছোট বেলা মায়ের ভালোবাসা পাইনি। আর এখন না হয় স্বামীর ভালোবাসা পাবো না। পরেও আমি আমার বাকিটা জীবন উনার স্ত্রী আর অন্তীলার মা হয়েই কাটিয়ে দিব।এখন থেকে ওরা ই আমার সব। আমি অন্তীলার মা। অন্তীলা আমার মেয়ে। আমি ওকে গর্ভে ধরিনি তো কি হয়েছে, আমি ই ওর মা।
আদিবা মনে মনে নিজেকে নিজেই কথা গুলো বলছে। বার বার নিজেকে অন্তীলার মা বলে দাবি করতে বেশ ভালোই লাগছে আদিবার। অজানা এক সুখ অনুভব করছে নিজেকে অন্তীলার মা বলতে গিয়ে।
।
“– আমি জানি মায়ের ভালোবাসা ছাড়া জীবনে কতটা কষ্ট হয়। পৃথিবীতে মা কতটা আপন তা আমার থেকে ভালো করে আর কেউ বলতে পারবে না। আমার কাছে তো মা ডাকার জন্য মা ছিল। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা ছিল না। আমি ছোট থেকে যে কষ্ট পেয়েছি, সে কষ্ট আমি অন্তীলা কে পেতে দিব না। অন্তীলা আমার মেয়ে আমি ওর মা। হঠাৎ করে অন্তীলা ঘুমের মাঝে ওর ছোট ছোট আঙুল দিয়ে আদিবার আঙুল ধরে ফেললো।
চলবে…?