সাঁঝক বাতি,০৪,০৫
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[০৪]
শিফাকে হাসতে দেখে দিগন্ত আর কথা বাড়াল না। বাবা ডাকছেন। জুরুরি নাকি কথা আছে।
সে ভেজা তোয়ালে বেলকনিতে মেলে চলে গেল। শিফাকে নাহয় পরে দেখে নিবে। বলার ভঙ্গিমা দেখে ঘাবড়ে গেছে। ফাজিল একটা! অকারণে ভয় দেখাল। সুযোগের সৎ ব্যবহার সেও করবে।
আগামীকাল বিয়ের অনুষ্ঠান। দাওয়াত দেওয়ার পর্ব প্রায় শেষ। আয়োজন বড় করেই করা হচ্ছে।
শিফাদের আত্মীয়-স্বজনরাও আসবে। এখন কালকের দিনটা ভালোই ভালোই কাটলেই হয়।
দিগন্ত বাবার সাথে হালকা নাস্তা সেরে অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করছে। সবকিছু তার পরিপাটি চায়। এজন্য অহেতুক বাসায় ঝামেলা করে নি। কমিউনিটি সেন্টারে সব আয়োজন করেছে।আর শিফার সব সাজ-পোশাক সকাল নয়টা নাগাদ পেয়ে যাবে। তারপর সবাই ওখানে চলে গেলেই হবে। খাবারের মেন্যুও ওর পছন্দ মতো জানিয়ে দিয়েছে।
প্রশান্ত এখনো বাসায় ফিরেনি। সে জানিয়েছে, ফিরতে রাত হবে। হসপিটালে কী সমস্যা হয়েছে, সেটা মিটিয়ে আসবে। তাই অপেক্ষায় না থেকে,
আলোচনা শেষে রাতে খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। রাত তখন বারোটা সাত। নিকষ কালো রাত। কোথায় থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।
কুকুরটা অনবরত ডেকেই যাচ্ছে। রাতে ঘুমায় নি কেন, কে জানে! বেলকনির দরজা দিয়ে বাতাস রুমে ঢুকছে। এতে জানালার পর্দাগুলো নড়ছে।
দিগন্তের রুমটা আকাশি আর সাদার সংমিশ্রণে
সাজানো। কী জানি কেন? হয়তো এই দু’টো ওর পছন্দের। বাতাসের সাথে ফুলের সৌরভ ভেসে আসছে। হয়তো বাগান থেকে। মনমাতানো এক মুহূর্ত!
শিফা ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল বাঁধছে আর গুনগুন করছে। মনটা বেশ ফুরফুরে, অজানা কারণে। শিফা সাফার ছবির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে হাসল। অর্থাৎ বলতো কেমন দেখাচ্ছে?
সাফার হাসি মুখের ছবিতে যেন শাড়ি পরিহিত শিফাকেই দেখছে। শিফা মনমতো উত্তর বানিয়ে পুনরায় হাসল। তখন দিগন্ত বলল,
-‘কালকে নাকি তোমাদের বাসায় যেতে হবে?’
-‘হয়তো!’
-‘থাকতে হবে?’
-‘থাকলে কী আপনার মান যাবে?’
-‘এভাবে কথা বলো কেন? আমি তা বলেছি?’
-‘আমি এভাবেই কথা বলি। জন্মের সময় বাবা মেয়াদ উত্তীর্ণ মধু খাইয়েছিল। তাই হয়তো এমন হয়েছি।’
দিগন্ত মুচকি হাসল। মেয়েটার কাছে জবাব তৈরী করায় থাকে। সে বলামাত্রই অকপটে উত্তর দেয়।
দিগন্ত উঠে শিফাকে পেছন থেকে জড়িয়ে কাঁধে থুতনি রাখল। শিফা নিজের কাজে ব্যস্ত। না হচ্ছে অস্বস্তি; না লজ্জাবোধ। দিগন্ত কাঁধে ঠোঁট ছুঁইয়ে আদুরে সুরে বলল,
-‘সত্যিই চাও আমায়?’
-‘হুম চাই তো।’
-‘কতটা চাও?’
-‘যতটা চাইলে, না পাওয়া অবধি মনটা অশান্ত থাকে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কষ্টগুলো অশ্রু হয়ে ঝরে, ঠিক ততটা।’
-‘আমি যদি না চাই?’
-‘কারণ দেখান। নয়তো স্ব-ইচ্ছায় আত্মসমর্পণ করুন।’
দিগন্ত শিফাকে একটানে ঘুরিয়ে ওর চোখে চোখ রাখল। শিফা চোখ সরাল না। বরং দিগন্তের চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করল। দিগন্ত হাসল।
মেয়েরা নাকি ছেলেদের চোখে চোখ রাখতে পারে না। অথচ শিফা! এমেয়েটা সত্যিই অসাধারণ।
আবেগপ্রবন ন্যাকা মেয়েদের ওর সহ্য’ও হয় না। এরা আবেগী হয়ে ভুল পদক্ষেপ নেয়। সবকিছু আবেগ দিয়ে বিবেচনা করে। তাই হয়তো ঠকেও বেশি। দিগন্ত শিফার গালে দুই গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল,
-‘আমি তোমাতে বিলীন হতে চাই। অনুমতি দিবে?’
শিফা ওড়নাটা ছুঁড়ে ফেলে দাঁড়িয়ে গেল। অর্থাৎ প্রস্তুত। দিগন্ত হেসে শিফার অধরচুম্বন করে সরে গেল। মূলত দেখতে চেয়েছিল, শিফা কী করে? শিফার দিকে থেকে একতরফা ভালোবাসা। কিন্তু ওর মনে এমন কিছু নেই। তাই সম্পর্কটাকে সময় দিতে চাচ্ছে।এই শরীর টাকার বিনিময়েও পাওয়া যায়। কিন্তু মনের মিল, প্রণয়, টান, মায়া, গাঢ় অনুভূতি? আদৌ চাহিবামাত্রই সেটা জন্মে কি? হয়তো না! এখন ঘনিষ্ঠ হওয়ার মানে, শারীরিক চাহিদা হাসিল ছাড়া কিছু নয়। গতরাত থেকে সে শিফার সঙ্গে আছে। এতটুকু সময়ে কতটুকুই বা মায়া জন্মে? আগে শিফাকে সেভাবে দেখেও নি। তাই একটু সময় দেওয়াটা; বুদ্ধিমানের কাজ নয় কী? যদি ঘনিষ্ঠ হয়ও, তা হবে মোহ বা চাহিদার তাগিদে। এছাড়া কিছু নয়! আর সে এরকম কিছু চাচ্ছে না। তাই শিফাকে বলল,
-‘সঠিক সময়ে আমার প্রাপ্য বুঝে নিবো, এখন ঘুমাও।’
শিফা সুবোধ বালিকার মতো মাথা নাড়িয়ে শুয়ে পড়ল। চোখজোড়া বন্ধ করে হাসছে। সে জানত, এমন কিছুই হবে। দিগন্তও পাশে শুয়ে পড়ল।ওর দৃষ্টি শিফার দিকে। শিফাকে হাসতে দেখে গালে টোকা দিয়ে বলল,
-‘ছাড় দিয়েছি ছেড়ে দেইনি।’
-‘ছাড় চেয়েছে কে?’
-‘তাহলে..!’
-‘রাত অনেক হলো ঘুমান, শুভ রাত্রি!’
শিফা পাশ ফিরে শুয়ে নিরবে হাসছে। দিগন্তও
হাসল। শিফা ভাংবে তবুও মচকাবে না।মেয়েটার ভালোবাসার ধরণ অদ্ভুত। হোক না, তাতে কী! অদ্ভুত ভালোবাসাকেই সে সাদরে গ্রহন করবে।
দিগন্ত ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো। বাকিটা নাহয় পরে দেখা যাবে!
পরেরদিন সকাল থেকে বাসায় তোড়জোড় শুরু হয়েছে। শিফার হেলদোল নেই।সে নিজের কাজে মগ্ন। ওর বাবা গতকাল থেকে ফোনে না পেয়ে দিগন্তের থেকে খোঁজ নিয়েছে। মেয়ে ঠিক আছে, শুনে শান্ত হয়েছেন। উনারাও অতিষ্ঠ। মেয়েটার এত রাগ, জেদ, বলার বাইরে। যখন যা বলবে তাই করবে! যে বাঁধা দিবে সেই তার শত্রুপক্ষ।
জেদের বশে তাড়াহুড়ো করে বিয়েটাও করেছে।
এমনকি উনাদের অনুষ্ঠান করতে বারণ করেছে। বারণ উপেক্ষা করে করলে, ‘সে আর বাসাতেই যাবে না।’
পরে দিগন্ত এসব শুনে উনাদের বুঝিয়ে বলেছে।
আর আশ্বস্তও করেছে সব সামলে নিবে।
সকাল দশটার দিকে শিফা নিজেই তৈরী হয়েছে। নিহা সেজেছে পার্লারের মেয়েটার থেকে। মেয়েটা এসেছিল, শিফাকে সাজাতে। শিফা সরাসরি না করে দিয়েছে। দিগন্ত একটু বাইরে গিয়েছিল।এক ঘন্টার জন্য। শিফার জরুরি তলবে তাৎক্ষণিক ফিরতে হয়েছে। আসার পরে, ওকে দিয়ে শাড়ির কুচি ধরিয়েছে। এতক্ষণ এভাবেই বসেছিল। পরে
দিগন্ত এই অবস্থায় দেখে বলল,
-‘ভাবিকে ডেকে দিবো?’
-‘আমি ভাবির সূত্রধরে এবাসায় এসেছি?’
-‘আচ্ছা বলো, কিভাবে, কী করব?’
শিফার কথামতো দিগন্ত সেভাবে সাহায্য করল।
দিগন্ত মনে মনে খুশি হয়েছে। এই অত্যাচার সহ্য করতে সর্বদা প্রস্তুত। সাথে এটাও অবগত, শিফা কোনো ইচ্ছেপোষণ করলে তাকে’ই পূরণ করতে হবে। নয়তো অভিমানে কথা বন্ধ। যেমনটা ওর বাবার সঙ্গে করছে। উফ, মেয়েটা প্রচুর জেদি! যা বলবে তাই ঠিক। তবে মুখ্য কথা, এমন প্রকৃতির মেয়েরা প্রচুর ভালোবাসতে পারে। সেদিক থেকে সে সৌভাগ্যবান।
তারপর যথাসময়ে সবাই নিদির্ষ্ট গন্তব্যে বেরিয়ে গেল। শিফার বাবা-মা ওখানেই অপেক্ষমাণ।
মেয়েটাকে একবার দেখার জন্য উনারা ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। না জানি ওখানে কেমন আছে?
শিফারা গাড়ি থেকে নামতেই সবাই উৎসুক হয়ে ওদের দিকে তাকাল। একটুদূরে, শিফার পরিবার দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা-মা। বড় ভাই শিহাব তার পাশে তার স্ত্রী তমা। একটুদূরে ছোট ভাই রাফি, আর রাফির কোলে শিহাবের চার বছরের ছেলে তনয়। মোট ছয় সদস্যে পরিবার। শিহাব ব্যাংকে কর্মরত আর রাফি দশম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত।
সুখী পরিবার। শিফা সেদিকে না এগিয়ে সাফার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলল। ওয়েটারকে ডেকে স্পেশাল আপ্যায়নের তাগিদ দিলো। সাফার মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-‘খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আমার মাকে।’
-‘এবার বলো, কে বেশি সুন্দর সাফা না শিফা?’
শিফা আর সাফা এসব নিয়ে খুব ঝগড়া করত।
একটুপরে মিটেও যেতো। একজন আরেকজনকে ছাড়া যেন অচল। যেখানেই যেতো একজোড়ে।
পোশাকও এক ;এমনকি চুলের স্টাইলও। ফিতা দিয়ে মেপে সাফার চুল একচিমটি বড় হলে শিফা কেটে দিতো। কোথাও বের হওয়ার আগে ফোনে আগে জেনে নিতো, কোন পোশাক, কিভাবে চুল বাঁধবে? তারপর দু’জনে বের হতো। অথচ আজ শিফার খুশির দিনে সাফা নেই। শিফা স্বাভাবিক
থাকলেও ওর কষ্টটা বুঝেছেন। এই মেয়েটা শক্ত হলেও মানুষ। উনি শিফাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। শিফাও উনাকে আঁকড়ে ধরল, তবে কাঁদল না। কেঁদে নিজেকে দূর্বল করার মানে হয় না। স্বপ্নীল আসে নি। তার নাকি জরুরি কাজ আছে। শিফার পরিবারের সবাই ওর সঙ্গে কথা বলল। ওর বাবা-মা ভালো-মন্দ কিছু জিজ্ঞাসা করলন। দিগন্ত সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে সরে গেছে। তমা শিফাকে দিগন্তের পাশে বসিয়ে দিয়ে আসল। আত্মীয়-স্বজনরা ওদের উপহার দিয়ে দোয়া করে যাচ্ছে। ফটোশুট, খাওয়ারপর্ব,
আরো যাবতীয় কাজের সমাপ্ত হলো। আজকে
শিফাদের বাসায় যেতে হবে। এটা নাকি নিয়ম।প্রশান্তরা বিদায় নিয়ে চলে গেল। আর দিগন্তরা এলো শিফাদের বাসায়।
দিগন্ত শিফার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। তনয় তার কোলে। আসার পর থেকে ওকে ছাড়তে না।
এতক্ষণ কোলে নিয়ে থাকায় হাতটা ধরে গেছে।
একটু নিচে নামালেই কাঁদছে। গলা তো না যেন বাঁশি। বিরক্তিকর শব্দ করলেও হুমকি দিচ্ছে,’
ছবাইকে বলে ডিবো কুন্তু।’ রাতের খাবারও ওকে কোলে নিয়ে খেতে হয়েছে। একটুপরে, তমা এসে ওকে নিয়ে গেল। দিগন্ত যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
শিফা এসে দরজা আটকে ফ্রেশ হয়ে বসল। খুব ক্লান্ত লাগছে। সে উঠে দাঁড়াতেই দিগন্ত ওর হাত মুঁচড়ে গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। জুতো মেরে গরু দান করার মতো। শিফা ব্যথা পেলেও নিশ্চুপ।
ব্যথায় নিচের ঠোঁট কামড়ে মুখ কুঁচকে নিয়েছে।
হাতটা বুঝি ভেঙেই যাবে। শিফাকে নিশ্চুপ দেখে দিগন্তই ফিচেল কন্ঠে বলল,
-‘আমার সঙ্গে লড়াই করবা জান? কিন্তু ভুল চাল দিয়ে ফেললে যে। এটা কিন্তু মোটেও ঠিক হয় নি। ছিঃ! এই তোমার ভালেবাসা?’
শিফা খুব কৌশলে দিগন্তের হাঁটু বরাবর লাথি দিলো। দিগন্তের হাত দূর্বল হলে চুল খামছে ধরে সরিয়ে দিলো। দিগন্ত মুখ থুবকে পড়তে গিয়েও সামলে নিলো। শিফা তখন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
-‘ভালোবাসা মাই ফুট বাস্টার্ড। জলে-ডাঙ্গা করে অহেতুক সময় অপচয়। তাই তোর স্থলেই আমি জায়গা করে নিয়েছি। এবার খেল দেখা। মিথ্যে
উক্তিতেও ভালোবাসা হয় বুঝি? উফ, এত্ত শখ ভালোবাসা পাওয়ার, আহারে!’
দিগন্ত উচ্চশব্দ হেসে উঠল। মেয়েটা খুব বেশিই সাহসী। কথাটা অস্বীকার করার মতে নয়। এটা অপ্রিয় হলেও সত্য। ওর চালে ওকেই বাজিমাত, বাহ! শিফা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারীণী। ইংলিশে বলে,’মাষ্টার মাইন্ড।’ এবার লড়াই জমবে।আর
দিগন্ত সঙ্গী হিসেবে এমন কাউকে আশা করতো! পরিস্থিতি মোতাবেক পেয়েছেও। পারফেক্ট জুটি। শিফা ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে। যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিবে।
তখন দিগন্ত এগিয়ে এসে শিফার ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে বলল,
-‘এই তেজের জন্য তোমাকে আমার এত্ত ভালো লাগে। নয়তো কবেই খেয়ে ছেড়ে দিতাম।’
To be continue……..!!
-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[০৫]
-‘এই তেজের জন্য তোমাকে আমার এত্ত ভালো লাগে। নয়তো কবেই খেয়ে ছেড়ে দিতাম।’
একথা শুনে শিফা শব্দ করে হেসে উঠল। যেন খুব মজার কথা শুনেছে। হাসি থামাতে পারছে না। দিগন্ত ভ্রু কুঁচকে তাকাল। হেসে যে অপমান করছে, বুঝতে বাকি নেই। মেয়েটা খুব ধূর্ত। পাল্টা জবাব দিবেই, হেসে হোক বা কথার খোঁচা মেরে। এই ব্যাপারটা দিগন্তেরও বেশ লাগে। সে পকেটে হাত গুঁজে শিফার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েরা রুপবতী হলেও, তেজী। ঠিক গোলাপের মতো। গোলাপ যেমন সৌন্দর্য এবং কাঁটায় পূর্ণ। তেমনি এই মেয়েটা রুপ আর তেজে। এজন্যই ওর কাজে আকৃষ্ট হয়েছে। তবে রুপের ফাঁদে সে কখনোই গলবে না। এমন রুপবতীরা ভোগের যোগ্য, ভালোবাসার নয়। তাছাড়া ভালোবাসা, মায়া, টান, ওর মধ্যে নেই বললেই চলে। এটাও ওর কাছে গর্বের! কারণ এসব জিনিস পুরুষদের
কাবু করে। এসব ভেবে দিগন্ত ফিচেল হাসল।
শিফাকে সে ধীরে ধীরে আঘাত করবে। ওর ধৈর্য্য আর সহ্য ক্ষমতা দেখবে। কতদূর অবধি যায়; পরীক্ষা করবে। একেবারে মারলে কষ্ট কম হয়। এতে মজা পাওয়া যাবে না। আর খেলাতে টুইস্ট না পেলে ইচ্ছেও জাগে না। বিরক্ত এসে খেলার মজা নষ্ট করে দেয়। এজন্য টুইস্ট খুঁজতেই সে শিফাকে ব্যবহার করবে। লাগামহীনভাবে উড়তে দিবে। কারণ পিপীলিকা মরার জন্য বেশি উড়ে।
শিফাকে ক্ষুদে পিপীলিকা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না। তখন শিফা বলল,
-‘খাবেন জানতাম। এজন্য তো তোড়জোড় করে বৈধতা দিলাম।’
একথা শুনে দিগন্ত তালি বাজিয়ে মাথা নাড়াল।
শিফা তাচ্ছিল্যের হাসল। তখন দিগন্ত গদগদ হয়ে বলল,
-‘ওহ হো, সত্যি জানতে? দারুন তো! তবে বেশ
ভালো অভিনয় পারো। একদম আমার’ই মতো। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুমি পারফেক্ট।’
কথাটা বলে দিগন্ত পায়ের উপর পা তুলে বসল।
শিফা ড্রেসিংটেবিলের সামনে এদিক-ওদিক ঘুরে বলল,
-‘ড্রেসটাতে আমাকে বেশ মানিয়েছে না? আগুন সুন্দরী মানবেই তো।’
একথা বলে শিফা বেডে শুয়ে পড়ল। এমনভাব, ঘুমে তাকাতে পারছে না। দিগন্ত ওর পাশে শুয়ে হাত বাড়াতেই শিফা ওর হাত মুচড়ে দিলো।উফ, শব্দ করে বসে দিগন্ত হাত ঝাড়ল। চোখে রাগের ছাপ। বাঁধা দেওয়া ওর মোটেও পছন্দ নয়। দিগন্ত
শুয়ে পুনরায় হাত বাড়াল। শিফার দু’চোখ বন্ধ।
তবে ষষ্ঠইন্দ্রীয়ও জানান দিচ্ছে, মানুষটা এদিকে তাকিয়ে আছে। দিগন্ত ওকে ঝাপটে শুয়ে পড়ল।
শক্ত বাঁধনে নড়ার চেষ্টাও বৃর্থা। নিষিদ্ধ জিনিসে
ওর আকষর্ণ বরাবরই বেশি। কেউ বারণ করলে; আড়ালে সেকাজ করবেই, করবে। আর এটা ওর পুরনো অভ্যাস। নয়তো মনটা অশান্ত থাকে।
শিফা নড়ল না। নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে রইল। কবুল বলে; সে শরীর এবং মনকে প্রস্তুত করে নিয়েছে। জান, মান, এবং যৌবণপূর্ণ শরীরের মায়াত্যাগ করেছে। বাঁধা দেওয়া এখন ফিঁকে। তাই ঢং করে দিগন্তকে বাঁধা দিচ্ছে না। কারণ অবগত, বাঁধা দিলে দিগন্ত সেটাই করবে। এজন্য দিগন্ত কাছে আসতে চাইলে বোঝায়, সেও প্রস্তুত। আর এটা দিগন্তের পছন্দ নয়। এজন্য গতদু’বারে সিদ্ধান্ত বদলেছে। কারণ দিগন্ত নিজের মর্জিমতো চলে। কেউ কিছুতে আগ্রহ দেখালে সেটাতে সে পিছিয়ে যায়। কেন? এর উত্তর কেবল দিগন্তেরই জানা।
ওকে যতটা ভালো দেখায় সে ততটাই ভয়ংকর।
যে ভদ্র ভাববে সেই চরম বোকা। বাহ্যিকরুপটা অমায়িক হলেও ওর অভ্যন্তরটা….!!
আর শত্রুপক্ষের খুঁটিনাটি তথ্য শিফার জানা। অহেতুক লড়াইয়ে নামে নি। জেনে, বুঝে, প্রাণের মায়া ত্যাগ করে স্বজ্ঞানে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কথায় আছে, করো নয়তো মরো। তাই সে লড়াই করে মরবে। এটা তার দৃঢ় কল্পনা! এর শেষটা দেখেই ছাড়বে।
আশ্চর্যজনক ভাবে দু’জনই ওদের পরিকল্পনার ব্যাপারে জ্ঞাত। তবুও নিখুঁত অভিনয় করেছে।যেন দু’জনেই এই বিয়েতে খুব খুশি। কারো মনে আক্ষেপ নেই। সুখী দম্পতি! শিফা কেন বিয়েটা করেছে; দিগন্ত জানে। আর দিগন্ত কেন সম্মতি
দিয়েছে; শিফা জানে। এজন্য দু’জন বেশ মজাও পাচ্ছে। জেনেবুঝে ভালো সাজতে এই অভিনয়। তা দু’জনেরই, স্বার্থে। শত্রুকে চোখে চোখে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। ওরা সেটাই করছে। চুন খেলে মুখ পুড়ে। কথাটা দু’জনেরই জানা। তাই দেখার পালা, সময় কি বলে?
______________________________
পরেরদিন রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন। রান্নাঘরে বেশ তোড়জোড় চলছে। মেয়ের জামাইয়ের সমাদরে ত্রুটি যেন না থাকে! সকালথেকে সেই অয়োজন চলছে। ঘন্টায় ঘন্টায় নতুন নতুন পদ জামাইকে দেওয়া হচ্ছে। দিগন্ত খুব বিরক্ত হলেও, নিশ্চুপ।
আদিখ্যেতা জিনিসটা ওর বরাবরই অপছন্দ।
তনয়ও খুব জ্বালাচ্ছে। মনটা চাচ্ছে, বুক বরাবর ঘুষি মেরে দম আটকে দিতে। যাতে চিরতরে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। শিফা সকাল থেকেই বাসায় নেই।
জুরুরি কাজের জন্য বাইরে গেছে এখনো ফিরে নি। কি কাজ? একমাত্র সেই ভালো জানে। তবে এভাবে দিগন্ত মাথা ঘামাচ্ছে না। আপাতত রাগ
দমন করে তনয়ের সঙ্গে খেলায় মন দিলো।এবং প্রতিজ্ঞাও করল, সুযোগ বুঝে তনয়কে সে উচিত শিক্ষা দিবে। ঘন্টা দু’য়েক পর শিফা ফিরল।ওর
মুখে কুটিল হাসি। দিগন্ত দেখেও নিশ্চুপ রইল।
শিফা তনয়কে বাইরে রেখে ফিরে আসল। পানি খেয়ে গুনগুন করতে করতে ফ্রেশও হয়ে আসল।
এমনভাব, রুমে আর কেউ নেই। আর থাকলেও পাত্তা দেওয়ার সময় নেই। সে তার কাজে ব্যস্ত।
শিফা কিছু একটা ভেবে দিগন্তের দিকে খানিক ঝুঁকে বলল,
-‘লোক লাগিয়েছেন। তবুও ফাঁকি দিয়ে গেলাম। আহারে, বৃথা কষ্ট।’
দিগন্ত শিফার গালের ঠোঁট ছুঁইয়ে আদুরে সুরে বলল,
-‘বেশ করেছো। চলো আদর আদর খেলি।’
-‘ওকে।’
একথা বলে শিফা ওর পাশে বসে পড়ল। দিগন্ত পুনরায় শুয়ে ফোন স্কল করতে লাগল। মুড চলে গেছে। সত্যি, শিফার পেছনে সর্বদা লোক থাকে।
শিফার কার্যকলাপের খবর দেওয়াই ওদের কাজ।
মেয়েটা ধরে ফেলেছে। বুদিমতী ধরা অস্বাভাবিক নয়। তখন শিফা হাসতে হাসতে বলল,
-‘পুরুষত্বে অহংকার শেষ? এছাড়া পুরুষরা কী বা পারে?’
-‘তোমাকে পুরুষত্বের জোর দেখাব না। আমাকে হারিয়ে দেখাও। যাও, এইটুকু ছাড় দিলাম। তুমি
বৈধ শত্রু বলে কথা। তবে না পারলে; শর্ত মেনে
আত্মসমর্পণ করতে হবে।’
শিফা দিগন্তের চোখে চোখ রেখে হাতটা বাড়িয়ে দিলো। অর্থাৎ সম্মত। দিগন্ত মৃদু হেসে করমর্দন করল। দু’জনের চোখে’ই তেজ। যেন কেউ কারো থেকে কম নয়। তাদের চাহনিতে স্পষ্ট অঘোষিত লড়াইয়ের পুনরায় আহ্বান।ফলস্বরূপ; নিঃশেষ।
ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি। মস্তিষ্কও পরিকল্পনা
তৈরিতে সক্ষম। শিফা রুম থেকেই বেরিয়ে গেল। অর্ধদিন আর দিগন্তের সামনেই গেল না। রাগে অথবা ঘৃনায়! দুপুরে খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে দু’জনেই বেরিয়ে পড়ল। শিফা ফোনে গেম খেলছে। আর দিগন্ত লেপটপে কিছু করছে। মুখটা বেশ গম্ভীর। হঠাৎ ফোনে কাউকে বলল,
-‘একসপ্তাহ মুখ দেখাবি না। নয়তো শুট করতে দু’বার ভাববো না।’
কথাটা বলে কল কাটল। অপর ব্যাক্তির উপরে প্রচন্ড রেগে আছে। হয়তো ওর মনমতো কাজ হয় নি। শিফা ঠোঁট টিপে হাসল। সে জানত, এমন কিছুই হবে। কারণ সকালে দিগন্তের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করতেই বেরিয়েছিল। সে ছদ্মবেশে কাজটা করেছে। সফলও হয়েছে। দিগন্তের লোক যখন ওকে খুঁজছিল, সে পেছনেই ছিল। দেখছিল ওরা কি করে? কাজ সম্পূর্ণ করে ফেরার সময়, ভিক্ষা চাওয়াতে তাদের থেকে ধমকও খেয়েছে। ধমকে প্রচন্ড ভয়ের ভান ধরে কেটে পড়েছে। পিছু ফিরে তাকায় নি। লোকগুলো হন্ন হয়ে খুঁজে না পেয়ে পরে ফিরে গেছে। ওরা ধরতে না পারলেও, দিগন্ত ঠিক বুঝে ফেলেছে। কারণ সে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পূর্ণ মানুষ। তাতে কী! কাউকে পরোয়া করে নি, আর করবেও না। তখন দিগন্ত লেপটপটা সরিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
-‘এবার শান্তি হয়েছে?’
-‘প্রচুর।’
-‘ বাহ! তা স্বপ্নীলের বিরহে কাঁদছ না কেন? ইস, বেচারাকে কষ্ট না দিলেও পারতে। সময় আছে, ফিরে যাও।’
-‘ভয় পাচ্ছেন?’
-‘সো ফানি, বেইব।’
দিগন্তের কথায় পাত্তা না দিয়ে অবজ্ঞায় ভঙ্গিতে বসল। কয়েকবার শিষ বাজিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজতে গুঁজতে শিফা বলল,
-‘স্বপ্নীলকে মেরে দিন। নয়তো আমিই শেষ করে দিবো। সিংহ-সিংহীর লড়াইয়ে দূর্বল প্রাণীদের না থাকায় উত্তম। ঝামেলা মাত্র।’
To be continue……..!!