সাঁঝক বাতি,১০,১১

0
608

সাঁঝক বাতি,১০,১১
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১০]

পরেরদিন, সিগ্ধপূর্ণ সকালের আবির্ভাব হলো। মনোমুগ্ধকর আবহাওয়া! সূর্য কেবল মিষ্টি রোদ ছড়িয়েছে। সোনালি রং! দেখতে ঠিক সোনার’ই মতো। এজন্যই বুঝি বলা হয়, কাঁচা সোনা মিষ্টি রোদ! থাই জানালা ভেদ করে তীর্যকভাবে রোদ রুমে ছড়িয়ে গেছে। এতে অন্ধকার লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। তাদের আয়ু এখানেই শেষ! এখন দিনের রাজত্ব শুরু।

রুমে নিষ্প্রাণ হয়ে শুয়ে আছে এক অর্ধনগ্ন মানবী। হিসাব কষছে! নিজের জীবনের হিসাব! তবে হিসাবের ফল ঘুরে-ফিরে শূন্যের কোঠাতেই এসে থামছে। বোধগম্য হচ্ছে না; জীবন ধোঁকা দিচ্ছে নাকি হিসাব ভুল হচ্ছে। সে হিসাবে বেশ পটু! তাহলে ফল শূন্য আসছে কেন? এমন তো হওয়ার কথা না! এই ফল যে মনমতো হচ্ছে না।
মানবী ঘাড়’টা কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে পাশে তাকাল। অদূরে মানুষটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নিষ্পাপ মুখ! নিদারুণ মুখের অবয়ব! সুঠাম দেহে অধিকারী।
আর ধূর্ততার কথা না বললেই নয়। সে কুটিল ও দয়াশূন্য চিন্তা-ভাবনার মাস্টার! নির্দয় মানব।তবে মানুষটার ঠোঁট দু’টোতে প্রাণবন্ত নয়; বরং ফিচেল হাসিই বেশি মানায়। যে হাসি সর্বদা ওর ঠোঁটে লেপ্টেই থাকে। দেখতেও বেশ লাগে! সব পুরুষের ঠোঁটে মুচকি হাসি শোভনীয় নয়। কারো কারো ফিচেল হাসিও নজরকাড়া! যেমন; দিগন্ত! সুদর্শন মানুষরা অহংকারী হয়! কথাটার সত্যতা দিগন্তের মধ্যেই স্পষ্ট। মানবীটার অর্থাৎ শিফার দৃষ্টি এখন পাশের শ্যামবর্ণ পুরুষটার নগ্ন বুকের দিকে! বুকটা কালো পশমে ঢাকা। আদুরে ভাব! একটু ছুঁইয়ে দেওয়ার ইচ্ছে জাগে। এটা নিষিদ্ধ ইচ্ছে! একটা প্রবাদে প্রচলিত আছে, পুরুষদের বুকে পশম থাকলে তারা উদারচিত্তের হয়। বুকে অসীম ভালোবাসা সঞ্চিত’ও রাখে। হৃদয়বল্লভ হয়! তবে প্রবাদটাকে দিগন্ত ভুল প্রমান করেছে। উদাহরণস্বরূপ দেখিয়েও দিয়েছে; সব বানোয়াট!
কারণ ওর কালো পশমে ঢাকা প্রশস্ত বুকে, মায়া, দূর্বলতা, টান, প্রণয়, কিচ্ছু নেই। যা আছে শুধু নিষ্ঠুরতা!

শিফা ভাবনার ছেদ কাটিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসল।
ভেবে লাভ নেই! এই পরিস্থিতিকেই মানতে হবে!
আর এটা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এছাড়া উপায় নেই। শিফা রান্নাঘরে গিয়ে কাজে হাত লাগাল।
নিহা পরোটার খামির তৈরি করছে। ভেজা চুল দেখে নিহা হাসি-ঠাট্টা করল। খোঁচা মেরেও কথা বলল। শিফা প্রত্যুত্তরে হাসল। নিষ্প্রাণ হাসি!
তারপর ওরা নাস্তা বানাতে মনোনিবেশ করল।

শিফার বাবা-মায়ের সঙ্গেও আর কথা হয় না। সেই বলে না। ইচ্ছে করে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। ওর গোপন ফোনটা নেই। হঠাৎ উধাও!
সব জায়গায় হন্ন হয়ে গুঁজেও পায় নি। দিগন্তেরই কাজ এটা! হয়তো কোনোভাবে দেখেছিল। তাই
সরিয়ে ফেলতে সময় নেয় নি। ঐ ফোনটা থাকা মানে; দিগন্তের বিপদে পড়া। জেনেশুনে কে বা বিপদে পড়তে চায়? কেউ’ই না। তেমনি দিগন্তও! ওর মতো ধূর্ত ছেলের ফোনটা দেখেও নিশ্চুপ না থাকাই স্বাভাবিক। ফেঁসে যাওয়ার ভুল সে করবে না। তাই হয়তো.. ! যদিও এখন কিচ্ছু করার’ও নেই।ওর লড়াইয়ের সর্বশেষ ফলাফল; পরাজয়। হুম, সে সত্যিই গো হারান হেরেছে। আফসোসও করে না। বিনাবাক্যে সে পরাজয় মেনে নিয়েছে।
কারণ যতবার’ই কিছু করেছে, ততবার’ই কিছু না কিছু হারিয়েছে। ওর হারানোর সংখ্যাও কম নয়। ওগুলো ত্যাগ করেছিল সুমিষ্ট সমাপ্তের আশায়। অথচ হয়েছে বিপরীত। অনেক তো হলো; আর কত! এখন ছোট্ট তনয়ও আঙ্গুল তুলে বলে,

-‘ফুপি খুব পঁচা। তুমি দুষ্টমি করো এজন্যই ওরা
আমার হাত কেটে দিয়েছে। কষ্টও দিয়েছে। আমি কাঁদছি ফুঁপি, আমার হাত এনে দাও, প্লিজ ফুপি! হাত ছাড়া আমাকে পঁচা দেখায়। আমার সাথে কেউ খেলে না। কিসব পঁচা, পঁচা, নামেও ডাকে।
আমার হাতটা ঠিক করে দাও, প্লিজ ফুপি প্লিজ।’

তনয়ের এই কথাগুলো শিফাকে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। তার হৃদয়ে অদৃশ্যভাবে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। কাউকে দেখাতেও পারে নি; বলতেও পারে নি। নিরবে শুধু অশ্রু ঝরিয়েছে! ভেতরের আতনার্দের কথা জানে নি, বুঝেও নি। নিশ্চুপ হয়ে সবার অভিযোগ কাঁধে নিয়েছে সে। সত্যিই, সব দোষ ওর। ওর জন্যই সবার জীবন ঝুঁকিতে। হঠাৎ তনয়ের জীবনের রং বদলে গেল। প্রানবন্ত বাচ্চাটা মুখের হাসি হারিয়ে ফেলল। দুষ্টুমি ভুলে গেল। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে হলো। সারাজীবন ওকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
নির্দোষ তবুও। ওদিকে স্বপ্নীলও নিঁখোজ! সাফার বাবা-মায়ের করুণ অবস্থা। ওদের সুখ-সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ পরিবারকে নিঃশেষ হতে দেখা। নিজের
বড় ভাইয়ের কাছে অপরাধী হওয়া। ভাবির সঙ্গে
কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলা। বাবা-মায়ের কাছে ছোট হয়ে যাওয়া। তনয় তো সবার আগে পর করেছে। সে শিফার সঙ্গে কথাও বলে না। শিফাকে দেখলেই হাতের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। যেন বোঝায়; তুমি পঁচা।
তোমার জন্য আমার হাত নেই।’ যতক্ষণ শিফা বাসায় থাকে, তনয় রুম থেকে বের হয় না। ওর অবুজ মনে অনেক অভিমান জমেছে। অভিমান কবে ভাঙবে? বলাও মুশকিল। এসবের কারণেই শিফার জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। সে নিজেকে সম্পূর্ণরুপে বদলে নিয়েছে। কাউকেই বিপদমুক্ত রাখতে পারছে না। বরং দিন দিন পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রতিকূলে যাচ্ছে। এরচেয়ে পরাজয় শ্রেয়। অন্তত আপনজনরা বিপদমুক্ত থাকবে। তাছাড়া এটাও বুঝেছে; জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা বোকামি ছাড়া কিছু নয়।

প্রশান্তের ডাক শুনে নিহা রুমে চলে গেল৷ আর শিফা মৃদু পায়ে দিগন্তকে ডাকতে এলো। অনেক বেলা হয়ে গেছে। অফিসের যাওয়ারও সময় হয়ে যাচ্ছে। এখন ডেকে না দিলে পরে ওকেই বকবে।
দিগন্ত ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। জেগেই আছে। তবে ইচ্ছে করেই চোখ খুলছে না। শিফা বিরক্ত না হয়ে পুনরায় ওকে ডাকল। তবুও সাড়াশব্দ নেই! যেন শুনতেই পাচ্ছে না। শিফা আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল,
-‘সাড়ে আটটা বাজে, উঠুন।’

দিগন্ত চোখ খুলে কিছুক্ষণ শিফার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা অনেক বদলে গেছে। এই শিফাটা যেন অন্যকেউ। কিছু বললে কাঁদে। তবুও জবাব দেয় না। অথচ আগে কিছু বললেই ফোঁস করে
উঠতো। সময় কি মানুষকে বদলে দেয়? হয়তো।
শিফা এত সহজে হার মানবে সেও ভাবে নি। ওর বাঘিনী শিফাকেই বেশ লাগত। আর এখনকার
শিফা যেন প্রাণহীন কেউ। প্রতিপক্ষ শক্তপোক্ত
ও ধূর্ত না হলে খেলাতে আগ্রহ আসে না। ওর’ও তাই! দিগন্তকে তাকাতে দেখে শিফা মুচকি হেসে কফির মগটা ধরিয়ে দিলো। যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দিগন্ত বলল,
-‘অবশেষে হেরেই গেলে!’
-‘হুম।’
-‘এত দাপট আর তেজ কোথায় গেল?’
-‘ আত্মসমর্পণ তো করেছি। তাহলে…!’
-‘সাহস দেখানোর জন্য শাস্তি পাওনা আছে।’
-‘কি শাস্তি?’
-‘শান্তিস্বরুপ কখনো যদি তোমাকে চাই, দিবে?’
-‘মন সমেত নাকি শরীর?’
-‘মন সমেত তোমাকে।’
-‘কখনো না।’
-‘কেন? চাঁদের গায়ে যেমন কলঙ্ক আছে; তেমনি আমারও। কঙ্কল নিয়ে চাঁদ তার আলো ছড়ায়।নিকষ কালো রাতকে পরিপূর্ণ করে তোলে। চাঁদ কলঙ্ক নিয়ে এত কিছু পারলে, আমি কেন পারব না?’

শিফা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ রুপ বদলাচ্ছে কেন মানুষটা? নিশ্চয়ই কোনো ফন্দি এটেঁছে। ওর মুখে এসব বুলি শোভনীয় নয়।বরং
এসব শুনে মনে হচ্ছে কেউ ওর কানে গরম সিসা ঢেলে দিয়েছে। দিগন্তের কাছে এসব আশা করাও যায় না। শিফাকে তাকাতে দেখে দিগন্ত সেদিকে এগিয়ে গেল। মুখে তার মুচকি হাসি বিদ্যামান।
শিফার বিষ্ময়কর চাহনি! দিগন্ত শিফার গলায় নাক ঘষতে ঘষতে মৃদু স্বরে বলল,

-‘এসব বলব আশা করেছিলে বুঝি? উফ, খুব শখ, না? আমার মন এতটাও সস্তা নয়। বুঝলে হটি? থুক্কু শত্রু, আরে ধুর কীসব যে বলছি! তুমি
আমি তো ভীতু বউ, তাই না?’

শিফা দিগন্তের দিকেই তাকিয়ে আছে। আর কত রুপ দেখবে? একটা মানুষ কত রুপই বা থাকতে পারে? এরা আদৌ মানুষ? মানুষের তো বিবেক থাকে। এর নেই। অথচ ওকে সবাই মানুষ বলে।
শিফা দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে রইল। তখন দিগন্ত শিফাকে খুব কাছে টেনে ফিসফিস করে বলল,

-‘ভেবেছিলাম তুমি নন-ভার্জিন। কিন্তু না…..! অদ্ভুত সুন্দর তোমার শরীরের গঠন। এতদিন খেয়াল করিনি। তবে কালকে রাতে…..!

To be continue……!!

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১১]

বেশ কিছুদিন পর,

আজ শুক্রবার! এখন বিকেল পাঁচটা। ছুটিরদিন তাই সবাই বাসাতেই আছে। সারাদিন পরিবারের সঙ্গে বেশ ভালো সময় কেটেছে। দুপুরে ভরপেট
খেয়ে অনেকে ভাতঘুমও দিয়েছে। দিগন্ত নিজেও ঘুমায় নি শিফাকেও ঘুমাতে দেয় নি। সে এখন
কানে ইয়ারফোন গুঁজে শুয়ে আছে। মুখে কালো রংয়ের ফেসপ্যাক লাগানো। নামিদামি ব্র্যান্ডের।
ব্র্যান্ডের জিনিস ছাড়া তার চলে না। তাছাড়া সে
ফেস নিয়ে খুব সতর্ক। ব্যস্ত থাকলেও হেলা করে না। শিফা সোফাতে বসে টিভিতে নাটক দেখছে। হিন্দি সিরিয়ালের প্রতি আগ্রহ নেই। মাঝে মাঝে
একটু-আধটু বাংলা নাটক আর সংবাদ দেখে, এই যা। সাফা থাকতে হরর মুভি দেখা, ড্রাইভিং,
বাজি ধরে খাওয়া, সাইকেল চালানো, ক্যারাতের প্র্যাকটিস, এসব ওদের নিত্যদিনের কাজ ছিল।
সাফা নেই। তাই এসব আর করা হয়েও ওঠে না। আনন্দগুলো যেন জীবন থেকে সব মুছে গেছে। এখন রঙহীন জীবন! তবুও তো বেঁচে আছে, এই ঢের। শিফা সাফার ছবির দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। লজ্জাও করে তাকাতে; হেরে গেছে। উদ্দেশ্যেও অসফল! পরিকল্পনাও বৃথা।
পরিশেষে পরাজিত এক মানবী। আপনজনদের
বিপদমুক্ত করতেও ব্যর্থ। ওর জন্য সবার জীবন
ঝুঁকিতে। একারণে সাফার ছবির দিকে তাকায়ও না। ওর মনে হয় সাফা বলছে,’ তুইও হেরে গেলি শিফা! আমার বিশ্বাসও ভেঙে দিলি!’

একজন মানুষ সবাইকে ভালো রাখতে পারে না।
কেউ না কেউ বেজার থাকেই। তেমনি সেও পারে নি। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে হয় নি। এসব ভেবে
শিফা বেলকণিতে গিয়ে দাঁড়াতেই দিগন্ত ডাকল।
ওর ডাক শুনে মনে হচ্ছে খুব জুরুরি কিছু।শিফা নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াতেই দিগন্ত ওর ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,

-‘দেখো, মেয়েটা হাত কেটে পাশের ওই ছেলেটার নাম লিখেছে। তুমিও লিখো, প্লিজ!’

-‘সকালে আপনার ফোন হাত থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। এজন্য এই শাস্তিটা, তাই না?’

-‘বাপ্রে, বুঝলে কিভাবে?’

শিফা হাসল! সকালে তাড়াহুড়োয় কিছু বলেনি। তাই শোধ নিচ্ছে। ফোনটা ওর হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিল। ফোনের স্কিণ কিছুটা ফেটেছে। শিফা
ইচ্ছে করে করে নি দিগন্তও জানে, তবুও! হয়তো
এটা শাস্তি দেওয়ার ছুতো মাত্র। দিগন্ত মুখ ধুয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে আসল। তারপর শিফাকে ওর সামনে বসিয়ে পটাপট দু’টো ইনজেকশন পুশ করল। অবশের ইনজেকশন! শিফা নিশ্চুপ হয়ে দিগন্তের হাসিটা দেখছে। ফিচেল হাসি! প্রানবন্ত
লাগছে। দিগন্ত খুব আগ্রহ নিয়ে কাজটা করছে।
যেন এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পূর্ণের কাজ।
দিগন্ত উঠে একটা বক্স আনল। সবুজ রংয়ের।
সেখানে ডাক্তারদের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি আছে। এক একটা যন্ত্র এক এক কাজের। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য কেনা। দিগন্ত হেসে শিফার হাতে ওর নাম লিখতে থাকল। টপটপ করে লাল রক্ত ঝরছে৷ রক্তে বেডশীট ভিজে যাচ্ছে। এখন বিশ্রী দেখাচ্ছে সুন্দর বেডশীটটা। দিগন্তের হাত থেমে নেই। সে নিজের কাজে মগ্ন। শিফা দু’চোখ বন্ধ করে বসে আছে। হাত অবশ করাতে কিছু বুঝতে পারছে না। তবে গভীরভাবে দিগন্ত নাম লিখছে, তা বুঝতে পারছে। শিফা কাঁদতে চাচ্ছে না।তবুও চোখ বারণ শুনছে না। অঝরে অশ্রু ঝরিয়েই যাচ্ছে। দিগন্ত লিখা শেষ করে হাত ব্যান্ডেজ করে হাসল। আহা! এখন শান্তি লাগছে। শিফা থম মেরে বসে আছে। নিজেকে মস্তিষ্কশূন্য লাগছে।
একটুপরে, শিফা দু’চোখ খুলে হাত দেখে হাসল। ভুলের শাস্তি! শিফা চোখ মুছে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকল। আর দিগন্ত শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল।

শিফা রক্ত রাঙানো বেডশীটটার দিকে তাকিয়ে শুয়ে পড়ল। মাথাও ঘুরছে। অবশ ছুটছে হয়তো, ব্যথা বাড়ছে। চিনচিনে অসহ্য ব্যথা। দিগন্তকে আসতে দেখে শিফা চোখ বন্ধ করে নিলো। সহ্য হচ্ছে না এই যন্ত্রণা। না বুকের আর না হাতের।
চারিদিকে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। আজানের
সুমধুর সুর ভেসে আসছে। প্রাণ জুড়ানো সুর।
শিফাকে শুতে দেখেও দিগন্ত কিছু বলল না। সে
নিজের মতো রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল। একটুপরে, নিহা এসে শিফাকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেল। ওর নামে পার্সেল এসেছে। বড় পার্সেল! শিফার হাতে
ব্যান্জেজ দেখে নিহাসহ সবাই জিজ্ঞাসাও করল।
শিফা কথা এড়িয়ে পার্সেলটা নিয়ে ড্রয়িংরুমেই খুলতে বসল। অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করল না। দিগন্ত বাদে এখানে সবাই উপস্থিত আছেন। সবার উৎসুক দৃষ্টি। শিফা পার্সেল খুলেই দুই পা পিছিয়ে গেল। ভয়ার্ত চাহনি। ওর পুরো শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। শিফার অবস্থা দেখে নিহা দ্রুত ধরে বসাল। দৌড়ে পানি এনে খাওয়াল।
দিগন্তের বাবা কিছু বুঝতে না পেরে পার্সেলের দিকে তাকালেন। দেখে, উনিও চমকে উঠলেন।
পার্সেলের মধ্যে কঙ্কাল। তবে মনে হচ্ছে, কারো কঙ্কালের পুরো বডি’ই পার্সেল করা হয়েছে। এটা উপহার। তাও আবার কঙ্কাল! কে এমন ভয়ানক চিন্তা-ধারার মানুষ? উনিও শিফাকে কিছু বলার শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না। কারণ সবাই’ই হতবাক।
একটু সময় নিয়ে শিফা নিজেকে সামলে নিলো।
সে উঠে পার্সেল খুলে আবার দেখল। পার্সেলের
মধ্যে কালো রংয়ের চিরকুটও আছে। তনয়ের বেলাতে যেরকম দিয়েছিল। তাহলে সেই ব্যাক্তি।
শিফা কাঁপা হাতে চিরকুট খুলে দেখে,

-‘নাও, তোমার স্বপ্নীলকে ফেরত দিলাম। তেমন কিছু করি নি। শুধু এডিসের কূপে ছেড়ে হালকা করে ভেজেছি। যদি স্বপ্নীলের কঙ্কাল বিশ্বাস না হয়, তাহলে অপেক্ষা করো। দুইদিন পর, তোমার ছোট ভাই রাফিটাও পেয়ে যাবে। জানো? আমি মানুষ ভাজতে বেশ পটু।’

এইটুকুই পড়ে শিফা ধপ করে বসে পড়ল। শরীর যেন অকেজো হয়ে গেছে। কেউ যেন শরীরের সব শক্তি শুষে নিয়েছে। বিচারবুদ্ধির লোপ পেয়েছে। আর কত সহ্য করবে? কত? আর কতজনকেই বা হারাবে? কষ্টে যে বুকটা ঝাঁজরা হয়ে যাচ্ছে।
শিফা মাথা নিচু করে থম মেরে বসে রইল। কথা বলছে না, অশ্রুও ঝরাচ্ছে না। সে নিষ্প্রাণ দেহে পার্সেলের দিকেই তাকিয়ে রইল। তখন প্রশান্ত শিফাকে বলল,

-‘শিফা! এ্যাই শিফা! বোন আমার কিছু হয় নি।
কেউ হয়তো মজা করে দিয়েছে। ভয় পেও না।’

দিগন্তের মা শিফার মাথায় পিঠে স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন,

-‘মারে, আমার সবাই আছি। ভয় পাস না মা।’

নিহা কঙ্কালের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলছে। সে এসবে খুব ভয় পায়। একবার তো কঙ্কালের হরর মুভি দেখে জ্বর এসেছিল। সেই জ্বরটা একসপ্তাহ ছিল। পরে তাবিজ কবজ করে জ্বরটা সেরেছিল। ওই জ্বরের কথা ওর এখনো মনে আছে। যদিও ভোলার মতোও না। নিহা দ্রুত উঠে প্রশান্তের গা ঘেষে দাঁড়াল। স্বামী’ই আপন। স্বামীর কাছে বউ নিরাপদ। বাহ্, এই যে এখন আর ভয়ও লাগছে না। এসব ভেবে নিহা মনে মনে হাসল।

দিগন্তের বাবা-মা শিফাকে বুঝ দিচ্ছে। প্রশান্তও চেষ্টা করছে। মেয়েটা সত্যিই ভয় পেয়েছে। এমন করার মানে হয়? শিফা নিশ্চুপ হয়ে সোজা রুমে চলে গেল। যে ভয়টা পাচ্ছিল তাই হলো। এখন সে বেঁচে থেকে কি করবে? পরাজয় মেনেও কাজ হলো না। ওর জন্যই এতকিছু। শিফা স্বপ্নীলকেও বাঁচাতে পারল না। পরিশেষে, স্বপ্নীলও নিঃশেষ।
ওর হারানোর লিষ্ট কবে পরিপূর্ণ হবে? কবেই বা কিঞ্চিৎ শান্তি মিলবে? যাদের ভালোর জন্য সে নিজেকে বদলাতে চাচ্ছে; তারাই তো থাকছে না।
ওদিকে, দিগন্তের পরিবারও কিছু বুঝতে পারছে না। এসবের মানে কী? আর শিফাকে এসব কে পাঠালো? চিরকুটে কী লিখা ছিল? শুধু কঙ্কাল দেখে ভয় পাচ্ছে নাকি অন্যকিছু? হলেও কারণ কি? উনার আর কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। শিফা ততক্ষণে রুমে দরজা আটকে দিয়েছে। কোনো সাড়াশব্দও নেই। নিহা আর শাশুড়ি অনবরত ডেকে যাচ্ছে। শিফা জবাব দিচ্ছে না। মেয়েটা ভুল-ভাল কিছু করে বসবে না তো? আত্মহত্যা
বা ভুল পদক্ষেপ। উনারা এসব ভেবে ঘাবড়েও
যাচ্ছেন। তাই কালবিলম্ব না করে দ্রুত দিগন্তকে ফোন দিলেন। পুরো ঘটনার সারমর্ম জানালেন।
দিগন্ত বাসার আশেপাশেই ছিল বিধায় চলেও এলো। যদিও আসার ইচ্ছে ছিল না। সে জরুরি কাজে ব্যস্ত ছিল। তাছাড়া সবাইকে বোঝাতে হবে শিফা তার সবকিছু। বউ ছাড়া তার পুরো জীবন অচল। ওর ভালোবাসায় খাদ নেই। ভালোবাসে বলেই; হাত কেটে নাম লিখতে বিবেকে বাঁধে নি, কষ্টও হয় নি। দিগন্ত এসে দরজা ধাক্কিয়েও ব্যর্থ হলো। রাগে ওর পুরো শরীর জ্বলছে। বেয়াদবটা আবার নখরা শুরু করেছে। বিকেলের শাস্তিটা বোধহয় কম হয়ে গেছে। ডোজ’টা বাড়াতে হবে।
দিগন্ত রাগটা সামলে লক ভাঙ্গার ব্যবস্থা করল।
তাছাড়া হবে না। মিস্ত্রি এসে লক ভেঙ্গে ফেলল।
কিন্তু শিফাকে পেল না। সে রুমে’ই নেই। বাসার সবাই অবাকের চরম শিখরে। মেয়েটা কোথায় গেল? দরজা আটকানো ছিল, তাহলে? এভাবে যাওয়ার মানে কি? আর গেল’ই বা কিভাবে?

দিগন্ত বেলকনিতে গিয়ে দেখে রেলিংয়ে ওড়না বাঁধা। ব্যাপারটা বুঝতে বাকি নেই। সবার চলে গেলে দিগন্ত শব্দ করে হাসল। আহারে, বেচারা শিফা! ভয় পেয়ে অবশেষে পালিয়েই গেল। তবে দিগন্ত জানে শিফা থেমে যাওয়ার পাত্রী নয়। সে ঠান্ডা মস্তিষ্কের মেয়ে। ঝোপ বুঝে কোপ মারবেই, মারবে। শিফা এতদিন দুঃখীর অভিনয় করেছে।
মেয়েটা প্রচুর ধূর্ত। আর অভিনয় করতে করতেই পাতাল ঘরের সন্ধান পেয়ে গেছে। ভালো সেজে দিগন্তের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করেছিল।
সেও জানত, দিগন্তের নজর সর্বদা ওর দিকেই।
তবে দিগন্তকে ফাঁকি দেওয়াও এত সোজা নয়।
সে ঠিকই ধরে ফেলেছে। দিগন্ত হাসতে হাসতেই বলল,

-‘খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে, জান। মারতে নয়তো মরতে।’

To be continue……..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here